২৪ থেকে ২৭শে ফেব্রুয়ারী চারদিন ব্যাপী রাজধানী দিল্লীর উত্তর-পূর্বাংশে চলে ভয়াবহতম রক্তক্ষয়ী সহিংসতা। গভীর রাতে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে হিন্দুত্ববাদীরা ঘুমন্ত মুসলিমদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। হাতে বন্দুক ও ধারালো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে গলিতে ঢুকেই তারা সেখানকার বাসিন্দাদের মারধর ও ব্যাপক লুটপাট শুরু করে। এরপর তারা বাছাই করে করে মুসলমানদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে নিশ্চিহ্ন করতে থাকে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব), জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধক (এনপিআর) নিয়ে চলমান বিক্ষোভের ব্যাপারে বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন বিধায়ক কপিল মিশ্র-এর উস্কানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারী উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে একের পর এক দাঙ্গা এবং সহিংসতার ঘটনা শুরু হয়, যার ফলে এযাবত ৫৩ জন মুসলমান নিহত, প্রায় ২০০ জন আহত এবং ৬০০ জন গ্রেফতার হয়। এসময় হিন্দুত্ববাদীরা স্থানীয় মুসলমানদের সম্পত্তি ও মসজিদগুলিতে ভাঙচুর চালিয়ে সেখানে গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে দেয়। বর্তমানে সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

বিপরীত দৃশ্য :

(১) গত ২৪ ফেব্রুয়ারী সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলায় যখন উত্তর-পূর্ব দিল্লীর গোকুলপুরী এলাকার মুসলমানদের নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে, খুঁজে খুঁজে তাদেরকে মারা হচ্ছে, এই অবস্থায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মাহিন্দার সিং ও তার পুত্র ইন্দ্রজিৎ সিং নামে দুই শিখ ৭০ জন মুসলমান মাদ্রাসা ছাত্র ও মুছল্লীর প্রাণরক্ষা করেছেন।

মাহিন্দার জানান, আমি ও আমার ছেলে গোকুলপুরী এলাকার একটি মাদ্রাসা এবং এর সংলগ্ন মসজিদে ৭০ জন মুসলমান শিক্ষার্থী এবং মুছল্লী আটকা পড়েছেন বলে জানতে পারি। দাঙ্গাবাজরা খোঁজ পেলে এরা প্রাণে বাঁচতে পারবেন না, সেই কথা চিন্তা করেই আমরা এগিয়ে যাই। আমার স্কুটার আর ছেলের বাইক দিয়ে ২০ বার যাওয়া-আসা করে তাদেরকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাই। দাঙ্গাকারীরা যেন যাত্রীদের চিনতে না পারেন সেজন্য তাদের মাথায় শিখদের পাগড়িও বেঁধে দিয়েছিলেন তারা।

একাজকে তিনি দায়িত্ব বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, পরিস্থিতি দেখে ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে হওয়া শিখ নিধন যজ্ঞের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। তাই হিন্দু বা মুসলিম কিছু দেখিনি। আমার চোখে শুধু মানুষ ভাসছিল। শুধু ছোট ছোট শিশুর মুখ চোখে পড়ছিল। এসব দেখে আমার মনে হয়, এরা সবাই আমার সন্তান। এদের কোনো ক্ষতি হতে দেব না আমি। মানবিকতার তাগিদেই প্রয়োজনের সময় তাদের সাহায্য করেছি আমরা।

বেঁচে যাওয়া মানুষেরাও বলছেন, সেদিন এই পিতাপুত্র না থাকলে তারা প্রাণে বাঁচতে পারতেন না। দুই পিতাপুত্র নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে মানবতা রক্ষার সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

(২) খাজুরি খাসের চার নম্বর গলির হিন্দু বাসিন্দারা ওই সময় তাদের মুসলিম পড়শিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। মুসলিমদের ঘর-বাড়িগুলি যখন পুড়ছে, তখন তারা নিজেদের বাড়ি থেকে বালতির পর বালতি পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি, জানালেন চার নম্বর গলির এক হিন্দু বাসিন্দা। যিনি কিছুতেই তার নাম জানাতে চাইলেন না। ভয়ে, যদি এরপর তার ওপরেও চড়াও হয় দুষ্কৃতীরা। শুধু খাজুরি খাস নয়। মৌজপুর, বাবরপুর, ভাগীরথী বিহার, সর্বত্রই এ তান্ডব চালিয়েছে দুষ্কৃতিকারীরা।

(৩) হিন্দু সন্ত্রাসীরা যখন দলবদ্ধভাবে এসে মুসলিম নারীদের উপর চড়াও হচ্ছিল, তখন প্রতিবেশী হিন্দু নারীরা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বোন দাবী করে তাদেরকে গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নেয়।

[যুগ যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিম পরস্পরের ভাই ভাই হয়ে বসবাস করে আসছে। অথচ রাজনৈতিক দুবৃৃর্ত্তরাই তাদের নিজেদের হীন স্বার্থে মুসলিম নিধন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় শাসক দলকে যথাযথ দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলিকে মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিচ্ছি (স.স.)] 






আরও
আরও
.