পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ ।

কোত্থেকে মুহাসাবা শুরু করব?

আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, প্রথমেই ফরয আমল দিয়ে নিজের হিসাব শুরু করবে। তাতে কোন ত্রুটি বুঝতে পারলে কাযা অথবা সংশোধনের মাধ্যমে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর নিষিদ্ধ বিষয়ের হিসাব নেবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, সে কোন একটা নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে তাহ’লে তওবা, ইস্তিগফার ও পাপ বিমোচক কোন পুণ্য কাজ করে তার প্রতিবিধান করবে। তারপর গাফলতির হিসাব নিবে। নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যদি সে গাফেল থাকে তাহ’লে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা এবং যিকির করার মাধ্যমে সে গাফলতির প্রতিবিধান করবে।

তারপর সে কী কথা বলেছে, কোথায় দু’পায়ে হেঁটে গেছে, দু’হাত দিয়ে কী ধরেছে, দু’কান দিয়ে কী শুনেছে তার হিসাব নিবে। সে ভাববে এ কাজ দ্বারা আমার কী নিয়ত ছিল? কার জন্য আমি এ কাজ করেছি? কোন পদ্ধতিতে কাজটি করেছি? জেনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক হরকত (কাজ) ও কথার জন্য দু’টো খাতা (রেজিস্টার) তৈরি করতে হবে। এক খাতায় থাকবে, কার জন্য কাজ করছি তার তালিকা; আরেক খাতায় থাকবে, কীভাবে কাজ করছি তার তালিকা। প্রথমটা ইখলাছ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা এবং দ্বিতীয়টা অনুসরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা।[1]

আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) নাফস বা মনের হিসাব গ্রহণের একটি কার্যকরী পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। তিনি কোত্থেকে মুহাসাবা শুরু করতে হবে এবং তারপর কোনটা করতে হবে তার ধারাবাহিকতা বর্ণনা করেছেন। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হ’ল।-

১. ফরযের হিসাব : শরী‘আতে ফরয বিধান সমূহের প্রতিপালন হারাম সমূহের তরক থেকে ঊর্ধ্বে গণ্য করা হয়েছে।[2] কেননা ফরয পালনই শরী‘আতের আসল মাক্বছাদ বা উদ্দেশ্য। সুতরাং বান্দা ফরয দিয়ে তার নফসের হিসাব শুরু করবে। যদি তাতে কোন ঘাটতি দেখতে পায় তাহ’লে ফরয পুনরায় আদায় করে কিংবা বেশী বেশী নফল আদায় করে তা পূরণ করবে। হাঁ, যদি দেখে যে, মূলেই ঐ ফরয শুদ্ধভাবে পালিত হয়নি তাহ’লে তা পুনর্বার আদায় করবে; আর যদি কিছুটা ত্রুটি হয়ে থাকে তাহ’লে বেশী পরিমাণ নফল আদায়ের মাধ্যমে তা পূরণ করবে।

২. হারাম ও নিষেধের হিসাব : হারাম ও নিষেধের বেলায় নফস বা মনের হিসাব করতে গিয়ে দেখবে যে, সে কোন হারাম কিংবা নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলেছে কি-না। তারপর যা তাকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে তা সংশোধনের চেষ্টা করবে। উদাহরণ স্বরূপ যদি সে সূদ থেকে হারাম সম্পদ উপার্জন করে তাহ’লে সূদ খাওয়া ছেড়ে দিবে এবং আসল রেখে যাদের থেকে সূদ নিয়েছে সূদের অর্থ তাদেরকে ফেরত দিবে। আর যদি অন্যদের অধিকার জোর করে নিয়ে থাকে তাহ’লে তাও তাদের ফেরত দিবে। কারও গীবত, লাঞ্ছনা ও অপমান করলে তাদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবে, তাদের জন্য দো‘আ করবে এবং তাদের পক্ষ থেকে দান করবে। আর যদি এমন অন্যায় করে যার বিকল্প প্রতিবিধান নেই। যেমন মদ পান করেছে কিংবা কোন মহিলার দিকে তাকিয়েছে তাহ’লে অনুশোচনা ও তওবা করবে এবং ভবিষ্যতে এমন যাতে না ঘটে সেজন্য সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে। সাথে সাথে পাপ মোচনকারী নেক কাজ বেশী বেশী করে করবে। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন,وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ‘আর তুমি ছালাত কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে ও রাত্রির কিছু অংশে। নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ মন্দ কর্মসমূহকে বিদূরিত করে’ (হূদ ১১/১১৪)

৩. তাকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার গাফলতি বা উদাসীনতার হিসাব : সে খেয়াল করবে যে, (হারাম ছাড়াও) অসার গান-বাজনা ও খেলাধূলায় নিজেকে মত্ত রেখেছে কি-না? এমনটা নযরে এলে গাফলতিতে অতিবাহিত সময় থেকে আরও বেশী সময় ধরে যিকির, ইবাদত ও নেক কাজে মশগূল থাকবে। গাফলতির বদলা হিসাবে এটা করবে।

৪. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হিসাব : সে নিজেকে জিজ্ঞেস করবে-আমার পা দিয়ে, আমার হাত দিয়ে, আমার কান দিয়ে, আমার চোখ দিয়ে, আমার জিহবা দিয়ে আমি কী করেছি? অঙ্গগুলোর কোনটি থেকে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে থাকলে প্রতিকার হিসাবে অঙ্গগুলোকে আল্লাহর আনুগত্যমূলক কাজে নিয়োজিত রাখবে।

৫. নিয়তের হিসাব : (নিয়ত যাচাইও যরূরী বিষয়)। আমার এ আমল দ্বারা আমার কী ইচ্ছা? এতে আমার নিয়তই বা কী? এভাবে প্রশ্ন করে নিয়ত যাচাই করবে। ক্বলবের হিসাব একান্ত খাছভাবে নিতে হবে। কেননা নিয়তের স্থান ক্বলব, আর ক্বলব হরহামেশাই বদলাতে থাকে, ফলে মুহূর্তের মধ্যেই নিয়তেরও বদল ঘটে। এই বদলানোর জন্যই ক্বলবের নাম হয়েছে ক্বলব।

মনকে শাস্তি প্রদান :

মুমিন যখন তার নফস বা মনের হিসাব নিবে তখন দেখতে পাবে, মন কোন না কোন পাপ করেছে, কিংবা ফযীলতমূলক কাজে শিথিলতা ও অলসতা দেখিয়েছে। ফলে যা ছুটে গেছে তার প্রতিকারের জন্য মনকে শাস্তি-সাজা ও আদব শিক্ষা দেওয়া তার কর্তব্য। যাতে ভবিষ্যতে এমনটা আর না ঘটে এবং মন শায়েস্তা ও কর্মতৎপর হয়।

মনকে মুজাহাদা বা কর্মতৎপর না রাখলে, হিসাব না নিলে এবং শাস্তি না দিলে মন সোজা থাকবে না। আশ্চর্য যে, মানুষ কখনো কখনো চারিত্রিক দোষ কিংবা অন্য কোন ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে নিজ পরিবারের সদস্য ও চাকর-বাকরদের শাস্তি দেয়, কিন্তু সে নিজে কোন মন্দ কাজ করলে নিজেকে শাস্তি দেয় না। অথচ নিজেকে শাস্তি দেওয়াই উত্তম ও সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ। কখনো কখনো শাস্তির নামে উপেক্ষা ও ছাড় দিতে দেখা যায়। তবে নিজেকে শাস্তি দানের মূল লক্ষ্য নিজের মনকে আল্লাহর অনুগত রাখা এবং আগে করা হয়নি এমন সব ভালো কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। মনকে শাস্তি দানের পূর্বসূরীদের পদ্ধতি এমনই ছিল। এখানে তার কিছু নমুনা তুলে ধরা হ’ল : ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর একবার আছর ছালাতের জামা‘আত ছুটে গিয়েছিল। সেজন্য নিজেকে শাস্তি স্বরূপ তিনি এক খন্ড জমি দান করে দেন। যার মূল্য ছিল দুই লক্ষ দিরহাম!![3]

ইবনু ওমর (রাঃ)-এর কোন ছালাতের জামা‘আত ছুটে গেলে সেদিন তিনি পুরো রাত ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাতেন!![4]

একবার ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর মাগরিবের ছালাত আদায়ে এতটুকু বিলম্ব হয়েছিল যে, সন্ধ্যাকাশে দু’টো তারা নযরে আসছিল। তাতেই তিনি দু’জন গোলাম আযাদ করে দিয়েছিলেন, যদিও মাগরিব ছালাতের ওয়াক্ত তখনও শেষ হয়নি!![5]

ইবনু আবী রবী‘আ (রহঃ)-এর একবার ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ছুটে গিয়েছিল। সেই দুঃখে তিনি একটি গোলাম আযাদ করে দিয়েছিলেন!![6]

ইবনু আওন (রহঃ)-কে তার মা ডাক দিলে তিনি তার  ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তার কণ্ঠস্বর মায়ের কণ্ঠস্বর থেকে একটু উঁচু হয়ে গিয়েছিল। তাতেই তিনি দু’দু’জন গোলাম আযাদ করে দিয়েছিলেন!![7]

সুতরাং পূর্বসূরীরা নিজেকে শাস্তিদান বলতে মনকে নেক কাজে লাগানো এবং যিকির-আযকার ও দো‘আ-ওযীফায় মশগূল রাখা বুঝতেন। যে সকল হাদীছে অল্প আমলে অনেক ছওয়াবের উল্লেখ আছে সেগুলো নিয়ে গভীর অনুধাবন ও আমল করাও নফসকে শাস্তিদানে সহায়ক।

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ قَامَ بِعَشْرِ آيَاتٍ لَمْ يُكْتَبْ مِنَ الْغَافِلِينَ وَمَنْ قَامَ بِمِائَةِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْقَانِتِينَ وَمَنْ قَامَ بِأَلْفِ آيَةٍ كُتِبَ مِنَ الْمُقَنْطَرِينَ ‘যে ব্যক্তি  (রাত জেগে ছালাতে) দশটি আয়াত পড়বে তার নাম গাফিল-অলসদের তালিকায় লেখা হবে না। আর যে (রাত জেগে ছালাতে) একশ’ আয়াত পড়বে তার নাম ‘কানিতুন’ বা অনুগতদের তালিকায় লেখা হবে। আর যে (রাত জেগে ছালাতে) এক হাযার আয়াত পড়বে তাকে ‘মুকান্তারুন’ বা প্রাচুর্যময়দের তালিকাভুক্ত করা হবে’।[8]

কোন মুসলমান এই হাদীছ ও এ ধরনের অন্যান্য হাদীছ মনোযোগসহ লক্ষ্য করলে তার জীবনের অনেক মুহূর্ত যে অহেতুক ব্যয় হয়ে গেছে এবং শুধুই নিজ দেহকে আরাম দেওয়ার জন্য যে কত ছওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে তা ভেবে সে অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়বে এবং এ ধরনের অল্প আমল কিন্তু অধিক ছওয়াবময় কাজে নিজেকে সাগ্রহে নিয়োজিত করে তুলবে।

অতীতের মুজতাহিদ ও সাধকগণ আল্লাহর পথে কী পরিমাণ সাধনা ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার ইতিহাস এবং পূর্বসূরীদের জীবনপথের নানা ঘটনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলেও নিজের নফস বা মনকে বেশী বেশী ইবাদত-বন্দেগী এবং মুস্তাহাব ও নফল আমলে নিয়োজিত করে শাস্তিদানের ইচ্ছা জাগবে। যদিও আজকের যুগে তাদের মত সাধক মানুষের উদাহরণ মেলা ভার।

কাসেম বিন মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন, ‘আমার সকালে হাঁটা-হাটির অভ্যাস ছিল। আর হাঁটতে বের হ’লেই আমি প্রথমে (আমার ফুফু) আয়েশা (রাঃ)-এর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে সালাম দিতাম। একদিন আমি তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তিনি ছালাতুয যুহা বা চাশতের ছালাত আদায় করছেন এবং তাতে নিম্নের আয়াত বারবার পড়ছেন আর কেঁদে কেঁদে দো‘আ করছেন। فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ ‘অতঃপর আল্লাহ আমাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন’ (তূর ৫২/২৭)

সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার বিরক্তি ধরে এল, কিন্তু তিনি তা পুনরাবৃত্তি করেই চলেছিলেন। এমন অবস্থা দেখে আমি ভাবলাম, বাজারে আমার একটু প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন সেরে না হয় আবার আসব। বাজার থেকে আমার কাজ সেরে বেশ কিছুক্ষণ পর আমি ফিরে এসে দেখি, তিনি আগের মতই একই আয়াত পুনরাবৃত্তি করছেন, আর কেঁদে কেঁদে দো‘আ করছেন।[9]

আবু দারদা (রাঃ) বলেন, ‘তিনটি জিনিস না থাকলে আমি এক দিনের জন্যও বেঁচে থাকতে পসন্দ করতাম না। এক- দুপুর রোদে আল্লাহর জন্য পিপাসিত হওয়া (আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও জিহাদের উদ্দেশ্যে মরুভূমির উত্তাপ সহ্য করা এবং তৃষ্ণার্ত হওয়ার মজা)। দুই- মধ্যরাতে সিজদাবনত হওয়া (তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় ও তাতে কুরআন পড়ার মজা)। তিন- সেসব লোকের সঙ্গে ওঠা-বসার সুযোগ, যারা উৎকৃষ্ট ফল বেছে বেছে সংগ্রহের মতো বেছে বেছে ভালো ভালো কথা সংগ্রহ করে।[10]

তাবেঈ মাসরূক (রহঃ)-এর স্ত্রী বলেন, মাসরূক এত দীর্ঘ সময় ধরে ছালাত আদায় করতেন যে, দাঁড়িয়ে থাকার দরুন বেশীর ভাগ সময় তার পা দু’টো ফুলে থাকত। আল্লাহর কসম! তার প্রতি অনুকম্পা বশত আমি অনেক সময় তার পেছনে বসে কাঁদতাম।[11]

রবী (রহঃ) (আল্লাহর ভয়ে) এত বেশী কাঁদতেন এবং রাত জেগে ইবাদত করতেন যে, তার মা ছেলের জীবন নাশের আশঙ্কা করতেন। একদিন তিনি তাকে বললেন, প্রিয় পুত্র আমার! তোমার হাতে কেউ হয়তো নিহত হয়েছে? রবী (রহঃ) বললেন, হ্যঁা মা, হয়তো তা হবে! মা বললেন, বৎস আমার,  বলো তো, এই নিহত লোকটা কে হ’তে পারে, যার হত্যাকারীকে তার পরিবারের কাছে নিয়ে গেলে তারা হত্যাকারীর অবস্থা দেখে তাকে ক্ষমা করে দিবে? আল্লাহর কসম! নিহতের পরিবার যদি তোমার এত কান্নাকাটি ও রাত জাগার কথা জানতে পারে তাহ’লে তাদের মনে তোমার প্রতি অবশ্য করুণা জাগবে। তখন রবী (রহঃ) বুঝতে পেরে বললেন, هى نفسي সেই নিহত লোকটা হ’ল আমার নফস বা মন। (অর্থাৎ তিনি তার নফসকে কান্না ও রাত জাগার কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলেছেন)।[12]

মনকে শাস্তি প্রদানের সীমা :

একজন মুসলিমের নিজ মনকে এমনভাবে পরিচালনা করা কর্তব্য, যাতে আখিরাতে সে নাজাত পেতে পারে। এজন্য সে মনের সঙ্গে সংগ্রাম (মুজাহাদা) করবে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে ভাল কাজে লাগাবে। যখন সে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়বে তখন তার সাথে সদাচার (মুদারাত) করবে এবং কষ্ট দেওয়া বন্ধ রাখবে। এভাবে সংগ্রাম ও সদাচারের মধ্য দিয়ে না চললে মন ঠিক থাকবে না।

যখন দেখবে, মন বেশ নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত হয়ে আছে তখন তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ ও তাঁকে ভয় করতে বলবে। আবার যখন দেখবে, মন বিচলিত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তখন তার মাঝে আল্লাহর নিকটে ভাল ফল লাভের আশা জাগাবে। এভাবেই মনের পরিচালনা ও পরিচর্যা করতে হবে।

অনেক সময় মনোলোভা কিছু বিষয় মনের সামনে তুলে ধরবে। তাকে বুঝাবে যে, তুমি এটা করলে এ পুরস্কার পাবে। তখন তার জন্য অনেক সৎকাজ করা সহজ হয়ে যাবে। ইবনুল জাওযী (রহঃ) বলেন, একবার আমার পাশ দিয়ে দু’জন কুলি একটা গাছের ভারী গুঁড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওরা গান গাচ্ছিল আর পথ চলছিল।[13] দু’জনের একজন অন্যজন কী বলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, অতঃপর তার কথার পুনরাবৃত্তি করছিল অথবা তার মতো কিছু একটা বলছিল। প্রথমজনও আবার দ্বিতীয় জনের কথা খেয়াল করছিল। আমি ভেবে দেখলাম, তারা দু’জন যদি এভাবে গান না গাইত তাহ’লে তাদের কষ্ট বেড়ে যেত এবং গাছের গুঁড়ি বহন দুষ্কর হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন যেই তারা গান গাইছে অমনি তাদের জন্য বোঝা বহন সোজা হয়ে আসছে। কেন তা সহজ হচ্ছে, আমি তার কারণও ভেবে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, প্রত্যেকের মনোসংযোগ অন্যে কী বলছে তার প্রতি নিবদ্ধ হচ্ছে। আবার নিজেও অনুরূপ জবাব দানের চেষ্টা করছে। এভাবেই তাদের পথ কেটে যাচ্ছে; গুঁড়ি বহনের কথা মনেই আসছে না।

এখান থেকে আমি একটা আজব শিক্ষা পেলাম। আমি খেয়াল করলাম, মানুষকেও তো অনেক কঠিন কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়। তন্মধ্যে সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব, মন যা ভালবাসে তা থেকে তাকে বিরত রাখা এবং যা ভালবাসে না তা করতে তাকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে মনকে বাগে আনা এবং তাকে এ অবস্থায় ধৈর্য ধরানোর সাধনা। আমি বুঝতে পারলাম, ধৈর্যের সাধনায় মনকে পাকাপোক্ত করতে হ’লে তাকে সান্ত্বনা যোগানো ও তার সঙ্গে মজা করার মতো কিছু একটা করতে হবে।[14]

নেককারদের জীবনে মুহাসাবার কিছু নমুনা

১. আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) :

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমার পিতা শপথ করে বললেন, ‘মানবকুলে আমার নিকট ওমর থেকে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই’। তারপর তিনি কথাটি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে বললেন, ‘বেটি, বলতো কথাটা আমি কিভাবে কি বলেছি’? তিনি বললেন, আপনি বলেছেন, ‘মানবকুলে আমার নিকট ওমর থেকে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই’। তিনি বললেন, ‘অধিক সম্মানিত’।[15]

দেখুন! কীভাবে তিনি একটা শব্দ বলার পর নিজের মনে তা নিয়ে চিন্তা করলেন এবং অন্য শব্দ দিয়ে তা বদলে দিলেন! কেননা তাঁর কাছে মনে হয়েছে ‘অধিক প্রিয়’ স্থলে ‘অধিক সম্মানিত’-ই বেশী সূক্ষ্ম এবং বেশী যথার্থ।

২. ওমর ফারূক (রাঃ) :

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর সংগে বাইরে বের হ’লাম। চলতে চলতে তিনি একটা বাগানে ঢুকে গেলেন। তাঁর আর আমার মাঝে তখন একটা দেয়ালের ব্যবধান। তিনি বাগানের ভেতরে। আর আমি (বাইরে থেকে) তাঁকে বলতে শুনলাম, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব! আমীরুল মুমিনীন! সাবাস!! সাবাস!! আল্লাহর কসম, হয় তুমি আল্লাহকে ভয় করবে, নয়তো আল্লাহ তোমাকে শাস্তি দিবেন।[16]

তিনি ‘আমীরুল মুমিনীন’ নামে আখ্যায়িত করে নিজেকে বুঝিয়েছেন যে, এসব উপাধি আল্লাহর সামনে তাঁর কোনই উপকারে আসবে না। 

৩. আমর ইবনুল আছ (রাঃ) :

ইবনু শিমাসা আল-মাহরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমর বিন আছ (রাঃ)-এর মরণকালে আমরা তাঁর কাছে হাযির ছিলাম। তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করলেন এবং দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেন। তখন তাঁর ছেলে বলতে লাগলেন, আববা, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গ লাভের পরও কি এ চিন্তা! আববা, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গ লাভের পরও কি এ চিন্তা!!

তিনি তখন মুখ ফিরিয়ে বললেন, আমরা যা সবচেয়ে উত্তম গণ্য করি তা হ’ল, কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)-এর সাক্ষ্য দান। আমার জীবনের তিনটি পর্যায় আমি অতিবাহিত করেছি। একসময় ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আমার থেকে অধিক ঘৃণাকারী দ্বিতীয় কেউ ছিল না। সেসময় তাঁকে বাগে পেলে হত্যা না করা পর্যন্ত আমার মনে স্বস্তি মিলত না। ঐ অবস্থায় মারা গেলে আমি হ’তাম জাহান্নামী।

তারপর যখন আল্লাহ তা‘আলা আমার অন্তরে ইসলামের আকর্ষণ পয়দা করলেন তখন আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললাম, ‘আপনার ডান হাত প্রসারিত করুন, আমি আপনার নিকট বায়‘আত হব (আনুগত্যের শপথ করব)’। তিনি তাঁর ডান হাত প্রসারিত করে দিলেন, কিন্তু আমি আমার হাত টেনে নিলাম। তিনি বললেন, ‘আমর, তোমার কী হ’ল’? আমি বললাম, ‘আমি একটা শর্ত করতে চাই’। তিনি বললেন, ‘কী শর্ত’? আমি বললাম, ‘আমাকে যেন মাফ’ করে দেওয়া হয়। তিনি বললেন, ‘ইসলাম তার পূর্বেকার সকল গুনাহ নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং হিজরত তার পূর্বেকার সকল গুনাহ নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং হজ্জ তার পূর্বেকার সকল গুনাহ নিশ্চিহ্ন করে দেয়’। এভাবে ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে (আমার অন্তরে) অধিক প্রিয় এবং আমার চোখে অধিক মর্যাদাশালী দ্বিতীয় আর কেউ ছিল না। তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব আমার চোখে এতটাই ভরপুর হয়ে ধরা দিত যে, তাঁকে দু’চোখ ভরে দেখার সামর্থ্য আমার হ’ত না। আমাকে যদি তাঁর দৈহিক রূপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, তবে আমি তা বলতে পারব না। কারণ আমি তাঁকে দু’চোখ ভরে দেখতে পারিনি। ঐ অবস্থায় মারা গেলে আমার জান্নাতবাসী হওয়ার আশা ছিল। তারপর আমি অনেক রকমের দায়িত্বে জড়িয়ে পড়েছি। জানি না তাতে আমার অবস্থা কী দাঁড়াবে।

অবশ্য আমি যখন মারা যাব তখন যেন আমার সাথে কোন মাতমকারিণী না যায়, আর না কোন আগুন সাথে নেওয়া হয়। তারপর যখন তোমরা আমাকে দাফন করবে (মাটির নীচে রাখবে) তখন মাটির উপর ভাল করে পানি ছিটিয়ে দিবে। পরিশেষে তোমরা একটা উট যবেহ করে তার গোশত বিতরণ পর্যন্ত যে সময় লাগে সেই পরিমাণ সময় আমার কবরের পাশে অবস্থান করবে। যাতে করে আমি তোমাদের বিচ্ছেদকে মানিয়ে নিতে পারি এবং আমার রবের দূতদের সঙ্গে আমি কী কথোপকথন করতে পারব তা ভাবতে পারি’।[17]

৪. হানযালা আল-উসায়দী (রাঃ) :

হানযালা আল-উসায়দী (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একজন অহী লেখক। তিনি বলেন, একবার আবুবকর (রাঃ)-এর সাথে আমার সাক্ষাৎ হ’লে তিনি বললেন, হানযালা, কেমন আছ? আমি বললাম, হানযালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে! তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! আরে তুমি বলছ কি? আমি বললাম, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থাকি আর তিনি আমাদের সামনে জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করেন তখন তো মনে হয় আমরা সরাসরি তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মজলিস থেকে চলে এসে স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির সাথে মিশি এবং পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়ি, তখন অনেক কিছুই ভুলে যাই। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমারও তো এমন অবস্থা হয়। তখন আবুবকর (রাঃ) ও আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম এবং বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, হানযালা মুনাফিক হয়ে গেছে! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কীভাবে? আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা যখন আপনার নিকটে থাকি আর আপনি আমাদের সামনে জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা করেন তখন তো মনে হয় আমরা সরাসরি তা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যখন আপনার নিকট থেকে চলে এসে স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির সাথে মিশি এবং পেশাগত কাজে জড়িয়ে পড়ি তখন অনেক কিছুই ভুলে যাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম! তোমরা আমার নিকট যে অবস্থায় থাক সে অবস্থা যদি সদাসর্বদা বজায় রাখতে পারতে এবং যিকিরে মশগূল থাকতে পারতে তাহ’লে ফেরেশতারা ঘরে-বাইরে তোমাদের সাথে মুছাফাহা বা করমর্দন করত। কিন্তু হে হানযালা! সময় সময় অবস্থার হেরফের হয়’। একথা তিনি তিনবার বললেন’।[18]

৫. আলী বিন হুসাইন (রাঃ) :

ইমাম যুহরী (রহঃ) বলেন, আমি যায়নুল আবেদীন আলী বিন হুসাইন (রহঃ)-কে তার নিজের নফসের হিসাব নিতে এবং স্বীয় রবের নিকট মুনাজাত করতে শুনেছি। তিনি বলছিলেন, হে আমার মন! আর কত দিন তুমি দুনিয়ার ধোঁকায় পড়ে থাকবে? কত কাল তোমার ঝোঁক দুনিয়া আবাদের দিকে থাকবে? তুমি কি তোমার বিগত পূর্বপুরুষদের থেকে; যমীনের কোলে আশ্রয় নেওয়া তোমার মহববতের লোকদের থেকে; অন্তরে ব্যথা জাগানিয়া ভাইদের থেকে এবং তোমার দুর্বলদেহী বন্ধুদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে না? কালের কুটিল চক্রের আবর্তে কত কিই না ধ্বংস হয়ে গেছে! কত ধরনের মানুষের সাথে তুমি ওঠাবসা করেছ এবং কতজনকে তুমি কবরের মাঝে বিদায় জানিয়েছ! যমীন তাদের সব কিছু পাল্টে দিয়েছে এবং মাটির তলে অদৃশ্য করে দিয়েছে!

আর কতকাল তুমি দুনিয়ার পানে ছুটবে? কতকাল দুনিয়ার খাহেশে মজে থাকবে? একদিকে বার্ধক্য তোমাকে পেয়ে বসেছে। সতর্ককারী তোমার দ্বারে পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে তুমি জীবনের লক্ষ্য ভুলে বসে আছ এবং ঘুমঘোরে অচেতন পড়ে আছ। অতীত জাতি ও বিলুপ্ত রাজ্যসমূহের কথা একবার চিন্তা করো। কালচক্র কিভাবে তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে এবং মৃত্যু কিভাবে তাদের পাকড়াও করেছে? দুনিয়া থেকে তাদের সকল চিহ্ন মুছে গেছে। এখন তাদের বাড়িঘর ও স্মৃতিগুলো শুধুই ইতিহাস হয়ে আছে। কত শক্তিধর রাজা-বাদশাহ, সৈন্যসামন্ত ও পাত্রমিত্র এই দুনিয়াতে ছিল। দুনিয়াতে তারা কত ক্ষমতার মালিক হয়েছিল। তাদের জাগতিক ইচ্ছাগুলো তারা অকপটে পূরণ করেছিল। বহু প্রাসাদ ও মিলনায়তন তারা বানিয়েছিল এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ও ধন-সম্পদ জমা করেছিল। একদিন আল্লাহর পক্ষ থেকে অমোঘ হুকুম এসে সব তছনছ করে দিল। তার অপ্রতিরোধ্য ফায়ছালা (মৃত্যু) তাদের আঙিনায় হানা দিল। রাজাধিরাজ, প্রবল প্রতাপান্বিত, বড়াইকারী ও পরাক্রমশালী মহান আল্লাহ এই পৃথিবীতে বলদর্পী স্বৈরাচারীদের মূলোৎপাটনকারী এবং অহংকারীদের বিনাশকারী।

সুতরাং দুনিয়া ও তার চক্রান্ত থেকে সাবধান!! দুনিয়া তোমার জন্য কত ফাঁদ পেতেছে! তোমাকে ভুলাতে কত সাজগোজ করেছে! তোমাকে ধরতে কত রূপ-রস যাহির করেছে! এসব থেকে সাবধান!! জলদি করো, জলদি করো, নিজেকে বাঁচাও। দুনিয়া নিশ্চিতই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার স্থায়িত্বের কোনই আশা নেই জেনেও কি কোন বুদ্ধিমান মানুষ তার প্রতি লোভী হ’তে পারে? নাকি কোন অভিজ্ঞজন তাতে খুশী হ’তে পারে?

যে রাতে দস্যু-তস্করের আক্রমণের ভয় করে তার দু’চোখ কিভাবে নিদ্রা যায়? যে মৃত্যুর তোয়াক্কা করে তার মন কিভাবে আরামে থাকে? দুনিয়াতে কত চিত্তাকর্ষক জিনিসই না রয়েছে। তা পেতেও কত শ্রম ব্যয় করতে হয়। কত রোগ-শোক, ব্যথা-বেদনা ও দুঃখ-কষ্ট পোহাতে হয়। তারপরও যে দুনিয়াদার মানুষ তার মজা লাভ করতে পারবে বা তার চাকচিক্য উপভোগ করতে পারবে, তেমনটা আশা করা যায় না।

কত যে অটুট স্বাস্থ্যধারী বর্ষীয়ান মানুষ দুনিয়ার ধোঁকায় পতিত হয়েছে! তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া কতজনকে যে সে তার কুস্তির প্যাঁচে কুপোকাত করেছে! দুনিয়ার ধোঁকা থেকে সে আর উদ্ধার পায়নি। কুপোকাত অবস্থা থেকেও দুনিয়া তাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। দুনিয়ার মোহকেন্দ্রিক তার ব্যথা-বেদনা ও রোগ-ব্যাধির সবই রয়ে গেছে। কোনটা থেকেই তার আরোগ্য ও নিষ্কৃতি মেলেনি। 

সুতরাং হে মন! তুমি তোমার আখিরাত দিয়ে আর কত তোমার দুনিয়াকে তালি দিবে এবং তোমার খেয়াল-খুশীর রঙিন ঘোড়া দাবড়াবে? আমি দেখছি, তুমি একজন দুর্বল চিত্তের মানুষ। হে দ্বীনের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দানকারী! তোমাকে কি এ আদেশ দিয়েছেন দয়াময় রহমান? নাকি এ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে আল-কুরআন?[19]

৬. আল-হারিছ মুহাসিবী (রহঃ) :

হারিছ মুহাসিবী (রহঃ) ছিলেন সংসারে অনাসক্ত একজন সাধক ও দরবেশ মানুষ। তিনি অতিমাত্রায় তার মনের হিসাব নিতেন বলে তার নাম হয়ে যায় ‘মুহাসিবী’ বা হিসাব গ্রহণকারী। আল্লামা সাম‘আনী (রহঃ) বলেন, মুহাসিবীকে এ নামে আখ্যায়িত করার কারণ তিনি রীতিমতো তার মনের হিসাব রাখতেন।[20]

৭. ইবনুল জাওযী (রহঃ) :

আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহঃ) নিজের সম্পর্কে বলেন, একদিন আমি একজন অনুসন্ধানী গবেষকের ভঙ্গিতে আমার নফসকে নিয়ে চিন্তা করলাম। ফলে (আল্লাহর দরবারে) তার হিসাব হওয়ার আগে আমি নিজে তার হিসাব নিলাম এবং (আল্লাহর দরবারে) তার ওযন হওয়ার আগে আমি তাকে ওযন করলাম। আমি দেখলাম, সেই শৈশব থেকে আজ অবধি আল্লাহর অনুগ্রহ আমার উপর একের পর এক হয়ে চলেছে। আমার মন্দ কার্যাবলী তিনি গোপন রেখেছেন এবং যে ক্ষেত্রে (দুনিয়াতেই) শাস্তি দেওয়া আবশ্যক ছিল সেক্ষেত্রে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অথচ সেজন্য একটু মৌখিক শুকরিয়া ছাড়া আমি আর কিছুই করিনি।

আমি পাপগুলো নিয়ে ভেবে দেখলাম যে, তার কয়েকটার জন্যও যদি আমাকে শাস্তি দেওয়া হ’ত তবে দ্রুতই আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম। যদি মানুষের সামনে তার কিছু প্রকাশ পেত তবে আমি লজ্জায় অধোবদন হয়ে যেতাম। এসব কবীরা গুনাহের কথা শুনে একজন বিশ্বাস পোষণকারী আমার বেলায়ও ঠিক তাই বিশ্বাস করত যা ফাসেক-ফাজেরদের বেলায় বিশ্বাস করা হয়। (অর্থাৎ আমাকেও একজন পাপাচারী ফাসেক ঠাওরানো হ’ত।) বরং আমার বেলায় তা আরও কদর্য বিবেচনা করা হ’ত, আর আমি (আত্মপক্ষ সমর্থনে) তার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করতাম। এরপর আমি এই বলে দো‘আ করি যে, ‘হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসার খাতিরে এবং আমার গুনাহের উপর তোমার গোপনীয়তার আচ্ছাদনের বদৌলতে তুমি আমাকে মাফ করে দাও’। তারপর আমি আমার নফসকে আল্লাহর এত বড় ও বেশী অনুগ্রহের জন্য তার শুকরিয়া আদায় করতে আহবান জানালাম। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যেমন শুকরিয়া আদায় করা উচিত ছিল তেমনটা হ’ল না। ফলে আমি আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও গুনাহ-খাতার জন্য মাতম করতে শুরু করি এবং বড়দের আসন লাভের প্রত্যাশা করতে থাকি। কিন্তু আমার আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেল, অথচ সে প্রত্যাশা পূরণ হ’ল না।[21]

শেষ কথা :

ব্যক্তির উচিত, প্রত্যহ একটা সময় নির্ধারণ করতঃ সে সময়ে নিজের মনকে তলব করা এবং তার নিকট থেকে তার সকল নড়াচড়া, ওঠাবসা, কাজ-কর্ম ও কথাবার্তার হিসাব নেওয়া। যেমন করে জাগতিক ব্যবসায়ীরা অংশীদারী কারবারে তাদের পাওনার কিছুমাত্র যেন বাদ না যায় সেজন্য তন্নতন্ন করে হিসাব করে। আসলে ব্যক্তির গুনাহ অসংখ্য। তাই মানুষের জন্য সেদিন আসার আগেই প্রতিদিন নিজের হিসাব নেওয়া ভাল, যেদিন তার সারা জীবনের হিসাব একবারে নেওয়া হবে।

এক লোক নিয়মিত মুহাসাবা করত। একদিন সে তার জীবনে কত বছর, কত দিন গুজরে গেছে তা হিসাব করল। সে দেখল,

বছরের হিসাবে তার জীবন থেকে ষাট বছর পেরিয়ে গেছে। তারপর দেখল, ষাট বছরে দিনের সংখ্যা দাঁড়ায় একুশ হাযার পাঁচশত দিন। তখন সে একটা চিৎকার দিয়ে বেহুঁশ হয়ে গেল। হুঁশ ফিরে এলে সে বলল, হায় আফসোস! আমি আমার মালিকের হুযুরে একুশ হাযার পাঁচ শত গুনাহ নিয়ে হাযির হব! তাও তো প্রতিদিন একটা গুনাহ হ’লে!! আর গুনাহের সংখ্যা অসংখ্য, অগণিত হ’লে তখন অবস্থা কেমন দাঁড়াবে!! তারপর সে বলল, আহ! আমি আমার দুনিয়া আবাদ করেছি, আমার আখিরাত বিরান করেছি, আর আমার মাওলার নাফরমানী করেছি! এখন আমি আবাদী ভূমি দুনিয়া ছেড়ে বিরান ভূমি আখিরাতে যেতে ইচ্ছুক নই! আর কিভাবেই বা আমি বিনা আমলে ও বিনা ছওয়াবে হিসাব-কিতাব ও আযাব-গযবের জগতে পা রাখব? তারপর সে খুব জোরে একটা চিৎকার দিয়ে চুপ হয়ে গেল। লোকেরা তখন তার দেহ নাড়া দিয়ে দেখল তার প্রাণপাখি দেহপিঞ্জর ছেড়ে চলে গেছে।[22]

আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট আমাদের এবং আপনাদের মনের পরিশুদ্ধির জন্য দো‘আ করি। আর সেই সঙ্গে আল্লাহ ছালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর- আমীন!


[1]. ইগাছাতুল লাহফান ১/৮৩।

[2]. জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/৯৬।

[3]. উমদাতুল ক্বারী, ১২/১৭৩।

[4]. এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/৪০৮।

[5]. ইবনু তায়মিয়াহ, শারহুল উমদাহ, ৪/২১০।

[6]. এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/৪০৮।

[7]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ৩/৩৯।

[8]. আবুদাঊদ, হা/১৩৯৮, আলবানী, সনদ ছহীহ।

[9]. ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ২/৩১।

[10]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহ্দ, পৃঃ২৭৭; তারীখু দিমাশক, ৪৭/১৫৯।

[11]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহ্দ, পৃঃ ৯৫; তারীখু দিমাশক, ৫৭/৪২৬।

[12]. আহমাদ ইবনু হাম্বল, আয-যুহ্দ পৃঃ ৩৪০; হিলয়াতুল আওলিয়া ২/১১৪।

[13]. এ ছিল এক ধরনের বোল, যা কুলিরা সমস্বরে বলে, যাতে বোঝা বহনের কথা ভুলে থাকা ও পথ চলা সহজ হয়।- অনুবাদক।

[14]. ছায়দুল খাত্বির, পৃঃ ৭১।

[15]. তারীখু দিমাশক ৪৪/২৪৭।

[16]. মুওয়াত্ত্বা মালিক, হা/১৮০০।

[17]. মুসলিম হা/১২১।

[18]. মুসলিম হা/২৭৫০।

[19]. তারীখু দিমাশক ৪১/৪০৪-৪০৮।

[20]. ইমাম নববী, আত-তিবয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন, পৃঃ ১১৭।

[21]. ছায়দুল খাত্বির, পৃঃ ৪৭১।

[22]. আল-আকিবাতু ফী যিকরিল মওত, পৃঃ ৩১।





ইসলাম ও পর্দা - মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান
গীবত থেকে বাঁচার উপায় - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল্লাহর সাথে আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শিশুদের চরিত্র গঠনে ‘সোনামণি’ সংগঠনের ভূমিকা - ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইমামদের দায়িত্ব ও কর্তব্য - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
ধন-সম্পদ : মানব জীবনে প্রয়োজন, সীমালংঘনে দহন (১ম কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (৪র্থ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
জান্নাতের পথ - ড. নূরুল ইসলাম
ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আরও
আরও
.