পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।

মুহাসাবার পদ্ধতি

মুহাসাবায় কড়াকড়ি :

কৃপণ ও লোভী অংশীদার যেমন তার অন্য অংশীদারদের থেকে নিজের পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নেয়, তেমনি করে মানুষ নিজের মনের নিকট থেকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব বুঝে না নেওয়া পর্যন্ত সে মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত হ’তে পারবে না। মায়মূন বিন মিহরান (রঃ) বলেছেন,لا يكون الرجل تقيا حتى يحاسب نفسه أشد من محاسبة الرجل شريكه، حتى ينظر من أين مطعمه ومشربه ومن أين مكسبه؟ ‘শরীক থেকে নিজের পাওনা বুঝে নিতে মানুষ যত না কঠিন-প্রাণ হয়, নিজের মন থেকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব বুঝে নিতে তার থেকেও বেশী কঠিন মনষ্ক না হওয়া অবধি সে মুত্তাকী হ’তে পারবে না। এমনকি কোত্থেকে তার খাদ্য-পানীয় ও আয়-রোযগার হচ্ছে তাও সে গভীরভাবে লক্ষ্য করবে’।[1] তিনি আরো বলেছেন, ‘একজন মুত্তাকী তার মনের হিসাব গ্রহণে কৃপণ ও লোভী অংশীদার কর্তৃক হিসাব গ্রহণ থেকেও মহাকঠোর’।[2]

সুতরাং মুহাসাবায় কড়াকড়ি করলে সেই মুহাসাবা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মুহাসাবায় গা ছাড়া যেন-তেন ভাব দেখালে তা কোন মুহাসাবাই হবে না। তা বরং মনের জন্য সবকিছু হালাল করার পাঁয়তারা। যার ফলে মনের বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যাবে। অনেকেই মুহাসাবা করতে গিয়ে বলে, ‘এ আমল তো ছোটখাট আমল’; ‘এ আমল হারাম হওয়া নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে’; ‘জোরালো মতানুসারে এ আমল মাকরূহ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে নানা ছুতো তুলে সে ঐসব আমল করে। এভাবে একসময় মন লাগামহীন কাজে জড়িয়ে পড়ে।

সবকিছুতেই মুহাসাবা :

আল্লাহ তা‘আলার বাণী وَلَا أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ ‘এবং শপথ করছি ধিক্কার দানকারী অন্তরের (বিবেকের)’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২) সম্পর্কে সাঈদ বিন জুবায়ের (রহঃ) বলেন, সে (ভৎর্সনাকারী মন) ভাল-মন্দ উভয়ের জন্য ভৎর্সনা করে।[3] হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَا تَرَاهُ إِلَّا يَلُومُ نَفْسَهُ، يَقُولُ مَا أَرَدْتُ بِكَلِمَتِي، يَقُولُ مَا أَرَدْتُ بِأَكْلَتِي، مَا أَرَدْتُ بِحَدِيثِ نَفْسِي، فَلَا تَرَاهُ إِلَّا يُعَاتِبُهَا وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَمْضِيْ قُدُمًا فَلَا يُعَاتِبُ نَفْسَهُ- ‘নিশ্চয়ই কোন মুমিনকে তুমি এমন পাবে না, যে তার মনকে ভৎর্সনা করে না। কোন কথা বললে সে বলে, হে মন! আমার এ কথায় তুমি কী বুঝাতে চেয়েছ? কোন কিছু খেলে বলে, আমার এ খাবার গ্রহণে তোমার উদ্দেশ্য কী? মনে মনে কথা বললে বলে, আমার মনে উদিত এ ভাবনায় তুমি কী ইচ্ছা করছ? এভাবে সব ক্ষেত্রেই দেখবে যে, সে মনকে নানা প্রশ্ন তুলে ভৎর্সনা করছে। কিন্তু যে কাফের-ফাসেক সে কোন ভ্রূক্ষেপ না করে সামনে পা ফেলে। ফলে সে তার মনকে ভৎর্সনা করে না’।[4]

সুতরাং মুহাসাবা কেবল পাপ কাজের সাথে যুক্ত নয়। বরং প্রত্যেকটা মানুষকে তার প্রতিটি কাজে মনের সাথে বুঝাপড়া করতে হবে, এমনকি তার মুবাহ* বা বৈধ কাজেও।

মুহাসাবা শেষে সৎ কাজে মনকে নিবদ্ধ রাখা :

যে কাজ তার কাঙ্ক্ষিতফল বয়ে আনে না, নিশ্চয়ই তা ত্রুটিযুক্ত ও অপূর্ণ। কাজটি যিনি করেছেন তাকে দ্বিতীয় বার তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। সুতরাং মুহাসাবা কোন ফল বয়ে না আনলে মুহাসাবাকারীর উপর আরেকবার মুহাসাবা করা আবশ্যক হবে। বরং তাকে এভাবে মুহাসাবার পর মুহাসাবা চালিয়ে যেতে হবে।

মালেক বিন দীনার (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার উপর দয়া করুন, যে তার মনকে বলে, ‘তুমি কি এটা করনি, তুমি কি ওটা করনি? তারপর তার নাক ছিদ্র করে তাতে লাগাম পরিয়ে দেয় এবং আল্লাহর কিতাব মেনে চলতে বাধ্য করে। এভাবে সে তার মনের চালকের আসনে বসে’।[5]

ইবরাহীম আত-তায়মী (রহঃ) বলেছেন, একবার আমি মনে মনে কল্পনা করলাম যে, আমি জান্নাতে আছি। জান্নাতের ফল খাচ্ছি, জান্নাতের নহরের পানি পান করছি, জান্নাতের তরুণীদের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হচ্ছি। আবার কল্পনা করলাম যে, আমি জাহান্নামে আছি। জাহান্নামের যাক্কূম খাচ্ছি, পুঁজ পান করছি এবং তার শিকল ও বেড়ির শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে আছি। এবার আমি আমার মনকে বললাম, মন আমার, তুই কোনটা চাস? মন বলল, আমি দুনিয়াতে ফিরে গিয়ে নেক কাজ করতে চাই। আমি বললাম, তুই তো তোর কাঙ্ক্ষিত স্থানেই আছিস। কাজেই এখনই নেক কাজ কর।[6]

মুহাসাবার ফল :

নিশ্চয়ই মনের কথা, কাজ ও কল্পনার হিসাব রাখা সব রকমের কল্যাণ লাভ ও সফলতার পথ। মুহাসাবার ফলে একজন মুসলিম দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন,إِنَّ الْعَبْدَ لا يَزَالُ بِخَيْرٍ مَا كَانَ لَهُ وَاعِظٌ مِنْ نَفْسِهِ، وَكَانَتِ الْمُحَاسَبَةُ مِنْ هِمَّتِهِ. ‘যতক্ষণ কোন বান্দার মুহাসাবা করার সদিচ্ছা থাকবে এবং যতক্ষণ তার নিজের ভেতর একজন উপদেশদাতা থাকবে, ততক্ষণ সে সৎপথে থাকবে’।[7]

নিচে মুহাসাবার কিছু নিশ্চিত সুফল তুলে ধরা হ’ল।-

ক্বিয়ামতের দিন হিসাব সহজ হওয়া :

কোন মুসলিম দুনিয়াতে নিয়মিত নিজের মনের হিসাব নিলে ক্বিয়ামতের দিন তা তার হিসাব হাল্কা হওয়ার মাধ্যম হবে। কেননা মুহাসাবার কারণে দুনিয়ার জীবনে তার পাপপ্রবণতা কমে যাবে এবং নেক কাজের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেছেন,حاسبوا أنفسكم قبل أن تحاسبوا فإنه أهون لحسابكم وزنوا أنفسكم قبل أن توزنوا وتجهزوا للعرض الأكبر، ‘(আল্লাহর নিকটে) তোমাদের হিসাব দানের আগে তোমরা নিজেরা নিজেদের হিসাব গ্রহণ করো এবং (আল্লাহর নিকটে) ওযনের আগে নিজেরা নিজেদের ওযন করো। কেননা এটা করা তোমাদের জন্য তুলনামূলক সহজ। আর তোমরা সবচেয়ে বড় আরয বা হিসাবের জন্য পাথেয় যোগাড় করো’। আল্লাহ বলেছেন,يَوْمَئِذٍ تُعْرَضُونَ لَا تَخْفَى مِنْكُمْ خَافِيَةٌ ‘সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। কোনকিছুই তোমাদের গোপন থাকবে না’ (হাক্কাহ ৬৯/১৮)।[8]

জা‘ফর বিন বুরকান (রহঃ) বলেন, আমার নিকট পৌঁছেছে যে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) তাঁর এক কর্মকর্তাকে একটি পত্র দিয়েছিলেন, সেই পত্রের শেষাংশে লেখা ছিল,حَاسِبْ نَفْسَكَ فِي الرَّخَاءِ قَبْلَ حِسَابِ الشِّدَّةِ، فَإِنَّهُ مَنْ حَاسَبَ نَفْسَهُ فِي الرَّخَاءِ قَبْلَ حِسَابِ الشِّدَّةِ، عَادَ مَرْجِعُهُ إِلَى الرِّضَا وَالْغِبْطَةِ، وَمَنْ أَلْهَتْهُ حَيَاتُهُ، وَشَغَلَهُ هَوَاهُ، عَادَ مَرْجِعُهُ إِلَى النَّدَامَةِ وَالْحَسْرَةِ، فَتَذَكَّرْ مَا تُوْعَظُ بِهِ، لِكَيْ تُنْهَى عَمَّا يُنْتَهَى عَنْهُ، ‘দুঃসময়ে হিসাব দেওয়ার পূর্বে সুসময়ে তোমার মনের

হিসাব রাখো। কেননা যে দুঃসময়ে হিসাবের পূর্বে সুসময়ে তার মনের হিসাব রাখে, পরিণামে সে পরিতুষ্টি ও ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করে। আর যাকে তার আয়ুষ্কাল দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অনাগ্রহী উদাসীন করে দিয়েছে এবং সে খেয়াল-খুশীর বশে ভোগবিলাসে মত্ত থাকছে, পরিণামে সে লাভ করবে আফসোস ও অনুশোচনা। সুতরাং যে বিষয়ের উপদেশ দেয়া হয়, তার শিক্ষা গ্রহণ করো। যাতে যেসব কাজ থেকে বিরত থাকা সঙ্গত তা থেকে বিরত থাকা যায়’।[9]

হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, ‘মুমিন তার মনের অভিভাবক। সে আল্লাহর ওয়াস্তে মনের হিসাব রাখে। আর নিশ্চয়ই যে জাতি দুনিয়াতে নিজেদের মনের হিসাব গ্রহণ করে ক্বিয়ামত দিবসে তাদের হিসাব হাল্কা ও আরামদায়ক হবে। আর ক্বিয়ামত দিবসে কেবল তাদের হিসাব কঠিন ও কষ্টদায়ক হবে, যারা হিসাব ছাড়াই জীবন কাটিয়েছে। মুমিনের হঠাৎই কোন জিনিস ভাল লাগলে সে বলে ওঠে, আল্লাহর কসম, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে কামনা করি এবং তোমার প্রয়োজনও আমার আছে। কিন্তু আল্লাহর কসম, তোমার নাগাল পাওয়ার সুযোগ আমার হাতে নেই! তোমার ও আমার মাঝে দেয়াল তোলা রয়েছে। আর যদি তার কিছু সামান্য ভোগ করে বসে তাহ’লে সে মনের কাছে প্রশ্ন তোলে, কোন উদ্দেশ্যে এটা করলে? এটার আমার কী দরকার ছিল? আল্লাহর কসম! আমার তো অজুহাত তোলারও সুযোগ নেই। আল্লাহর কসম! আগামীতে আল্লাহ চাহে তো আমি এ কাজ আদৌ করব না।[10]

ফুযাইল বিন ইয়ায (রঃ) বলেছেন,المؤمن يحاسب نفسه ويعلم أن له موقفا بين يدى الله تعالى، والمنافق يغفل عن نفسه، فرحم الله عبدا نظر لنفسه قبل نزول ملك الموت به، ‘মুমিন তার মনের হিসাব রাখে এবং সে জানে যে, একদিন তাকে আল্লাহ তা‘আলার সামনে দাঁড়াতে হবে। পক্ষান্তরে মুনাফিক যে, সে জীবন ও মন সম্পর্কে উদাসীন। সুতরাং সেই বান্দার উপর আল্লাহর দয়া বর্ষিত হেŠক, যে তার কাছে মালাকুল মওত আসার আগেই নিজ জীবনের হিসাব নেয়’।[11]

[চলবে]


[1]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৪/২৮৯।

[2]. মুহাসাবাতুন নাফস, পৃ. ৯।

[3]. তাফসীরে ত্বাবারী ১২/৩২৭

[4]. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, আয-যুহদ, পৃ. ২৮১।

* যে সকল কাজ করলে কিংবা না করলে পাপ-পুণ্য নেই সেগুলো মুবাহ।-অনুবাদক।

[5]. মুহাসাবাতুন নাফস, পৃ. ৮; তারীখু দিমাশক ৫৬/৪২০।

[6]. মুহাসাবাতুন নাফস, পৃ. ১০।

[7]. মুহাসাবাতুন নাফস, পৃ. ৬।

[8]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ, পৃ. ৩০৭।

[9]. মুহাসাবাতুন নাফস, পৃ. ১৬

[10]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ, পৃ. ৩০৮।

[11]. তারীখু বাগদাদ ৪/১৮৪।





ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান - লিলবর আল-বারাদী - যশপুর, তানোর, রাজশাহী
মাদ্রাসার পাঠ্যবই সমূহের অন্তরালে (৩য় কিস্তি) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শারঈ মানদন্ডে ঈদে মীলাদুন্নবী - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৩য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আল-কুরআনের আলোকে জাহান্নামের বিবরণ - বযলুর রশীদ
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল
মানব সৃষ্টির ইতিহাস - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
চিন্তার ইবাদত (৪র্থ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
হজ্জের ক্ষেত্রে প্রচলিত কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি - মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৪র্থ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
আরও
আরও
.