ব্রেলভীদের স্বতন্ত্র কিছু আক্বীদা-বিশ্বাস[1]
রয়েছে যেগুলো তাদেরকে সাধারণতঃ ভারতীয় উপমহাদেশের হানাফী মাযহাবের
অনুসারী অন্যান্য ফিরক্বা বা দল থেকে আলাদা করে রেখেছে। তাদের অনেক
আক্বীদা শী‘আদের মতো। এটা বলা অযৌক্তিক হবে না যে, ব্রেলভী মতবাদ আহলুস
সুন্নাহর চেয়ে শী‘আদেরই অধিক নিকটবর্তী। তবে কে কার দ্বারা প্রভাবিত তা
অজ্ঞাত।
যে সকল আক্বীদা-বিশ্বাস ব্রেলভীরা পোষণ করে এবং যেগুলো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচারিত সেগুলো কাল্পনিক, অন্ধ অনুসরণ, কুসংস্কার এবং অবাস্তব-উদ্ভট কল্প-কাহিনীর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেগুলো বিভিন্ন সময়ে ছূফী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের মাঝে সুবিদিত ছিল। ইসলামী হুকুম-আহকামের সাথে এগুলোর কোনই সম্পর্ক নেই। মূলতঃ এগুলো ইহুদী-খ্রিষ্টান ও কাফের-মুশরিকদের থেকে অতি সংগোপনে মুসলমানদের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে।
অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, এ সকল অনৈসলামী এবং জাহেলী আক্বীদা-বিশ্বাসকেই ইসলামের মৌলিক আক্বীদা বলে অনেকে মনে করে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেগুলোকে দ্ব্যর্থহীনভাবে মিথ্যা বলে ঘোষণা করেছেন। এসব আক্বীদা-বিশ্বাসের কতিপয় নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের নিকট দো‘আ বা প্রার্থনা করা :
ব্রেলভীরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের কাছে প্রার্থনা করা ও অন্যের কাছে চাওয়াকে বৈধ মনে করে। যা তাওহীদের বিপরীত।
তাদের
আক্বীদা হ’ল- আল্লাহর এমন কিছু বান্দা আছে, যাদেরকে তিনি সৃষ্টির রোগ ও
সমস্যা দূরীকরণের জন্য বিশেষভাবে বাছাই করেছেন। লোকেরা তাদের সমস্যা এবং
বিচার-আচার তাদের নিকট নিয়ে যাবে।[2]
আহমাদ
রেযা লিখেছেন, আউলিয়াগণের নিকটে সাহায্য চাওয়া, তাদেরকে ডাকা এবং তাদের
মাধ্যমে দো‘আ করা জায়েয এবং পসন্দনীয় বিষয়। অহংকারী কিংবা হক্বের শত্রু
ব্যতীত কেউ এর বিরোধিতা করবে না।[3]
তিনি আরো লিখেছেন, নবী-রাসূল, আউলিয়া, আলিমগণ এবং নেককারগণের নিকট সাহায্য চাওয়া বা তাদের কাছে দো‘আ করা জায়েয’।[4]
অন্যত্র
তিনি লিখেছেন, ‘হুযুর (ছাঃ) এমন ব্যক্তি যিনি সকল বিপদাপদে সাহায্য করেন।
হুযুর (ছাঃ) হ’লেন সেই ব্যক্তি, যিনি কল্যাণ দান করেন। অসহায় অবস্থায়
হুযুরকে আহবান কর, হুযুর সকল অকল্যাণ থেকে নিরাপত্তা দাতা।[5]
শুধু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-ই স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতার মালিক নন; বরং আলী (রাঃ)ও সকল ক্ষমতার মালিক। তিনি নিম্নোক্ত আরবী কবিতা দিয়ে যুক্তি পেশ করেন,
نادي عليا مظهر العجائب * تجده عونا لك في النوائب
كل هم وغم سينجلي * بولايتك يا علي يا علي يا علي
‘কারামতের
প্রকাশ আলী মুর্তাযাকে ডাকো তুমি তাকে বিপদাপদে সাহায্যকারী হিসাবে পাবে।
হে আলী! হে আলী! হে আলী! সকল দুশ্চিন্তা এবং দুঃখ-কষ্ট নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে
তোমার বেলায়েতের দ্বারা’।[6]
শায়খ আব্দুল
কাদের জীলানী (রহঃ)-এর উপর অপবাদ আরোপ করে ব্রেলভীরা তাঁর উদ্ধৃতি উল্লেখ
করেছেন এভাবে যে, ‘যে ব্যক্তি দুঃখ-কষ্টে আমাকে আহবান করে, তার দুঃখ-কষ্ট
দূর হয়ে যাবে এবং দুঃখ-কষ্টে যে আমার নাম ধরে ডাকে তার দুঃখ-কষ্ট ম্লান হয়ে
যাবে। আর যে ব্যক্তি কোন প্রয়োজনে তার প্রভুর কাছে প্রার্থনা করে এবং
আমাকে অসীলা বানায়, তার প্রয়োজন পূরণ হবে’।[7]
এমনকি কাযায়ে হাজাত বা প্রয়োজন পূরণের জন্য তাদের রয়েছে ‘ছালাতুল গাউছিয়া’। এর পদ্ধতি হ’ল- প্রতি রাক‘আতে সূরা ইখলাছ ১১ বার, দরূদ ও সালাম ১১ বার। তারপর বাগদাদের দিকে ১১টি ‘শিমালী কদম’ ফেলবে এবং প্রতি কদমে আমার নাম নিতে হবে এবং তার প্রয়োজনের কথা বলবে। আর এ পংক্তিটি আবৃত্তি করবে-
أيدركنى ضيم وأنت ذخيرتى * وأظلم فى الدنيا وأنت نصيرى
‘আমাকে
কি কোন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করতে পারে, যখন তুমি আমার ধনভান্ডারের কারণ? আর
দুনিয়াতে কি কোন ক্ষতি আমাকে স্পর্শ করতে পারে, যখন তুমি আমার
সাহায্যকারী’?[8]
আহমাদ ইয়ার গুজরাটী লিখেছেন, এখন জানা গেল যে, যারা মরে গেছে তাদের কাছ থেকে সাহায্য কামনা করা জায়েয এবং উপকারী।
রেযা
খান ব্রেলভী লিখেছেন, ‘যখনই আমি সাহায্য প্রার্থনা করেছি, তখন অন্য একজন
অলী (হযরত মাহবূবে ইলাহী)-কে আহবান করার ইচ্ছা করেছিলাম। কিন্তু আমার জিহবা
তা উচ্চারণ করতে পারেনি, কেবলমাত্র ‘ইয়া গাওছ’ শব্দটিই আমার মুখ থেকে বের
হয়েছে’।[9]
রেযা খান ব্রেলভী আরো লিখেছেন,
‘যখন কোন ব্যক্তি কোন নবী-রাসূল অথবা অলীর সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তখন সে
(নবী-রাসূল বা অলী) তার ডাকে উপস্থিত হয় এবং তার প্রয়োজন সহজ করতে সাহায্য
করে’।[10]
কবরবাসীদের নিকট সাহায্য কামনা
করার বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যখনই তুমি তোমার কাজে (সমস্যায়) পড়বে, তখনই কবরে
শায়িত অলীগণের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে’।[11]
কবর
যিয়ারতের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করার ব্যাপারে আহমাদ রেযার এক অনুসারী
লিখেছেন, ‘কবর যিয়ারতের উপকারিতা রয়েছে। নেককার মৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে
সাহায্য প্রার্থনা করা যেতে পারে’।[12] মূসা কাযিমের কবর সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘মূসা কাযিমের কবর একটি রোগ নিরাময়কারী ঔষধ’।[13]
আহমাদ
জারুক, ‘সাইয়িদ বাদাবী ও মুহাম্মদ বিন ফারগাল সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
‘যেকোন প্রয়োজনে তার কবরের নিকট গিয়ে চাইলে তিনি প্রয়োজন পূরণ করবেন’।[14]
ব্রেলভীদের উপরোক্ত আক্বীদার সম্পূর্ণ বিপরীত হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর শিক্ষা। আল্লাহ বলেন, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ ‘আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং একমাত্র আপনার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি’ (ফাতিহা ১/৫)। মহান আল্লাহ আরও বলেন,
إِنْ تَدْعُوْهُمْ لَا يَسْمَعُوْا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوْا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُوْنَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيْرٍ-
‘তোমরা তাদেরকে আহবান করলে তারা তোমাদের আহবান শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের আহবানে সাড়া দিবে না। তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ তা তারা ক্বিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞের ন্যায় কেউই তোমাকে অবহিত করতে পারে না’ (ফাতির ৩৫/১৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُوْ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيْبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُوْنَ-
‘সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে, যা ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না? আর তারা তাদের আহবান সম্বন্ধে অবহিতও নয়’ (আহক্বাফ ৪৬/৫; আ‘রাফ ৭/১৯৭)।
রাসূল (ছাঃ) তাঁর চাচাতো ভাই ইবনে আববাস (রাঃ)-কে বলেছেন,
يَا غُلاَمُ إِنِّى أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الْأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَىْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلاَّ بِشَىْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَكَ وَلَوِ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَىْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلاَّ بِشَىْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ رُفِعَتِ الأَقْلاَمُ وَجَفَّتِ الصُّحُفُ-
‘হে বৎস! আমি
তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি আল্লাহর (বিধান) হেফাযত করবে,
তাহ’লে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য
রাখবে, তুমি আল্লাহকে সম্মুখে পাবে। তুমি যখন কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর
নিকটেই চাইবে, আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর নিকটেই সাহায্য
প্রার্থনা করবে। আর জেনে রাখ, সমস্ত উম্মতও যদি একত্রিত হয়ে তোমার কোন
কল্যাণ করতে চায়, তবে আল্লাহ তোমার জন্য যেটুকু লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত
কোন কল্যাণই করতে পারবে না। আর যদি তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমার কোন ক্ষতি
করতে চায়, তবে আল্লাহ যতটুকু তোমার জন্য লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কোন
ক্ষতিই করতে পারবে না। কলমসমূহ উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং দফতর সমূহ শুকিয়ে
গেছে’।[15]
২. নবী ও আউলিয়ার ক্ষমতা :
তাদের আক্বীদা হচ্ছে, আল্লাহ সকল কর্তৃত্ব এবং সৃষ্টির সকল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর বাছাইকৃত কিছু বান্দার উপর অর্পণ করেছেন। যেহেতু তারা আল্লাহর সহকারী তাই দুঃখ-দুর্দশার সময় যে কোন ব্যক্তি আল্লাহর এ বান্দাগণের নিকট যাচ্ঞা, সাহায্য প্রার্থনা এবং তাদের নিকট রোগের আরোগ্য কামনা করতে পারে। সকল ক্ষমতা তাদের হাতে ন্যস্ত। তারা আসমান ও যমীনের মালিক। তারা যাকে ইচ্ছা দেন, যাকে ইচ্ছা দেন না। তারা জীবন-মৃত্যু, রিযিক সব দান করেন। এক কথায় রুবুবিয়াহ-এর সকল ক্ষমতাই তাদের নিকট সোপর্দ করা হয়েছে।
নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রশংসায় অতিরঞ্জন করে আহমাদ রেযা ব্রেলভী বলেন,
আল্লাহর মহান সহযোগী (নায়েব)
তিনি ‘কুন’-এর রং প্রদর্শন করেন।
আপনার হাতেই সবকিছুর চাবি,
আপনি সকল কিছুর মালিক বলে জানা যায়।
এর
ব্যাখ্যায় তার পুত্র লিখেছে, সারা পৃথিবীর যেকোন স্থানে যত নে‘মত রয়েছে,
তার সবই মুহাম্মাদ (ছাঃ) কর্তৃক প্রদত্ত। তাঁর মাধ্যম ব্যতীত কোন কিছুই
আল্লাহর কাছ থেকে নেয়া যায় না। রাসূল (ছাঃ) যা ইচ্ছা করেন, তা-ই ঘটে এবং
তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই ঘটে না। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা পরিবর্তন করার
কেউ নেই’।[16]
শী‘আদের ন্যায় আলী (রাঃ)
সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আলী (রাঃ) জাহান্নামের বণ্টনকারী। অর্থাৎ তিনি তাঁর
বন্ধুদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাঁর শত্রুদের জাহান্নামে প্রবেশ
করাবেন।[17]
তাদের শিরকী আক্বীদা প্রমাণ করতে
আব্দুল কাদের জীলানীর উপর মিথ্যারোপ করে তারা বলেন যে, আব্দুল কাদের
জিলানী বলেছেন, আল্লাহ আমাকে সকল অলীর প্রধান বানিয়েছেন এবং সকল অবস্থায়
আমার নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়। হে আমার মুরীদগণ! শত্রুদের ব্যাপারে ভয় পেও
না। আমি হ’লাম এমন ব্যক্তি যে বিরোধীদের হত্যা করে। আসমান-যমীনে আমার
কর্তৃত্ব ও উচ্চমর্যাদা রয়েছে। আল্লাহর পুরো রাজ্য আমার নিয়ন্ত্রণে। আমার
সকল অবস্থা যে কোন ত্রুটি হ’তে মুক্ত। সর্বদা গোটা পৃথিবী আমার চোখের সামনে
থাকে। আমি জীলানী, মুহীউদ্দীন আমার নাম, পাহাড়ের উপর রয়েছে আমার চিহ্ন’।[18]
আহমাদ
রেযার ছেলে ভাষ্য মতে, ‘নিঃসন্দেহে সকল শায়খ, আউলিয়া, আলেম তাদের
অনুসারীদের জন্য সুপারিশ করে এবং যখন তাদের অনুসারীর রূহ কবয করা হয়, যখন
মুনকার নাকীর তাদের প্রশ্ন করে; যখন সে পুনরুত্থিত হবে কিয়ামত দিবসে, যখন
তার আমলনামা খোলা হবে (হাশরে), যখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে ও হিসাব নেয়া
হবে, যখন তার আমল ওযন করা হবে, যখন সে পুলছিরাত পার হবে, প্রতি মুহূর্তে
এবং সার্বক্ষণিক (শায়খগণ) তাদের পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করবেন। কোন স্থানেই
তার থেকে অমনোযোগী হবেন না (তাকে ভুলে যাবেন না)। সকল ইমাম তাদের
অনুসারীদের জন্য সুপারিশ করবেন। পৃথিবীতে, কবরে এবং আখিরাতে সর্বদা তারা
তাদের প্রতি নযর রাখবেন এবং পুলছিরাত পার না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে ক্ষতি
হ’তে রক্ষা করবেন।[19]
এ আক্বীদা কুরআন-হাদীছ পরিপন্থী। যেমন আল্লাহ বলেন,
قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيْرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْن، سَيَقُوْلُوْنَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُوْنَ-
‘বল, তিনি কে, যার হাতে সকল কিছুর কর্তৃত্ব, যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যাঁর উপর কোন আশ্রয়দাতা নেই, যদি তোমরা জান? তারা বলবে, আল্লাহ। বল, তবুও কীভাবে তোমরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছ’? (মুমিনূন ২৩/৮৮-৮৯)।
নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খাঁন স্বীয় ‘তাফসীরে ফাতহুল বায়ান’-এ ‘বল (হে মুহাম্মাদ!) আমার নিজের কোন ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা আমি রাখি না, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত’-এ আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন- ‘এ আয়াতে ঐ সকল লোকদের জন্য মারাত্মক হুমকি রয়েছে, যারা রাসূল (ছাঃ)-কে বিপদের সময় আহবান করার আক্বীদা পোষণ করে। কারণ এ আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, বিপদ-আপদে একমাত্র আল্লাহই সাহায্য করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি সেই মহান সত্তা, যিনি রাসূলগণকে ও নেককারগণকে সাহায্য করেন। এ আয়াতেও আল্লাহ তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর উম্মাতকে পরিষ্কার ভাষায় এ কথা বলতে যে, তিনি কোন রকম উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন না। এমনকি নিজেরও না। কুরআন বলছে, রাসূল (ছাঃ)-এর নিজের ক্ষতি বা উপকার করার কোন ক্ষমতা নেই। তাহ’লে কিভাবে তিনি সবকিছুর মালিক হ’তে পারেন? আর যদি ‘খাতামুন নাবিইয়ীন’-এর স্রষ্টাসুলভ ক্ষমতা না থাকে, তবে সৃষ্টির অন্যদেরকে কিভাবে প্রয়োজন পূরণকারী ও বিপদে উদ্ধারকারী মনে করা যেতে পারে?
তাদের আক্বীদা জাহিলী যুগের লোকদের
আক্বীদার চেয়েও নিকৃষ্ট। তারা তো কেবল তাদের মা‘বূদদেরকে আল্লাহর নিকট
তাদের জন্য সুপারিশকারী বলে মনে করত। কিন্তু এ সকল লোকেরা আল্লাহর পরিবর্তে
রুবূবিয়াতের সকল ক্ষমতা তাদের আউলিয়াদেরকে দিয়ে রেখেছে। তাদের পীরদের নিকট
যখন তারা সরাসরি সাহায্য প্রার্থনা করে, তখন তারা বিন্দুমাত্রও ভয় করে
না...’।[20]
৩. মৃত ব্যক্তির শ্রবণ :
ব্রেলভী
ফিরকার আরেকটি আক্বীদা হ’ল, তাদের মুরীদগণ পৃথিবীর যেকোন স্থান হ’তে তাদের
ডাকুক না কেন, তারা মুরীদগণের ডাক শুনতে পায় ও তাদের সাহায্য করতে আসে। আর
এর উপর ভিত্তি করে তারা বলে, আউলিয়াগণ তাদের কবরে জীবিত। তাদের জ্ঞান ও
অনুভূতি, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি তাদের (কবরে) পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী
(শক্তিশালী) হয়’।[21]
ব্রেলভীদের মতে, এ
ক্ষমতা শুধু নবীগণের জন্যই খাছ নয়; বরং দ্বীনের বুযুর্গগণও এ মর্যাদায়
পৌঁছেছেন। এজন্য বলা হয়েছে, আল্লাহর অলীগণ মরেন না। তারা এক গৃহ হ’তে অন্য
গৃহে স্থানান্তরিত হন মাত্র। তাদের রূহ এক মুহূর্তের জন্য কেবল তাদের ছেড়ে
যায় এবং তারপরই পূর্বের ন্যায় তাদের দেহে ফিরে আসে’।[22]
তাদের বই-পত্র এ ধরনের মিথ্যা, বানোয়াট গালগল্প ও কাল্পনিক কিচ্ছা-কাহিনীতে ভরপুর। এসব আক্বীদা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ পরিপন্থী। যেমন আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ لاَ يَخْلُقُوْنَ شَيْئاً وَهُمْ يُخْلَقُوْنَ، أَمْواتٌ غَيْرُ أَحْيَاء وَمَا يَشْعُرُوْنَ أَيَّانَ يُبْعَثُوْنَ- ‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য যাদেরকে ডাকে তারা কিছুই সৃষ্টি করে না, তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়। তারা মৃত, জীবিত নয় এবং পুনরুত্থান কখন হবে সে বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই’ (নাহল ১৬/২০-২১)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘জীবিত ও মৃত সমান নয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শোনান; আর তুমি তাদেরকে শুনাতে পারবে না যারা কবরে আছে’ (ফাত্বির ২২)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তুমি মৃতদেরকে শোনাতে পারবে না...’ (রূম ৩০/৫২)। তিনি আরো বলেন, ‘তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কাউকে ডাকে, যে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিবে না? আর তারা তাদের আহবান সম্পর্কে অনবহিত’ (আহক্বাফ ৪৬/৫; আ‘রাফ ৭/১৯১-১৯৭)।
তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস খন্ডন করতে গিয়ে হানাফী মুফাসসির আল্লামা আলুসী উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘এ আয়াত হ’তে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, (জাহিলী যুগের) মুশরিকরা বিপদের সময় কেবল আল্লাহকে ডাকত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হ’ল এ সকল লোকেরা বিপদের সময়ে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যের নিকট সাহায্য কামনা করে এবং এমন ব্যক্তিদের আহবান করে, যারা না তাদের কথা শুনতে পায়, আর না তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারে, আর না তাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে। তাদের কেউ কেউ খিযির অথবা ইলিয়াসকে আহবান করে কিংবা ‘আবুল হামীস’ ও ‘আববাস’ এবং অন্যদের নাম ধরে সাহায্য কামনা করে। আবার তাদের কেউ কেউ তাদের ইমামগণকে আহবান করে। তাদের কেউই আল্লাহর নিকট তার হাত দু’খানা উত্তোলন করার তাওফীক পায় না। (সম্ভবত) তার মনের কোণে একবারও এ চিন্তা উঁকি দেয় না যে, যদি সে কেবল আল্লাহকেই ডাকত, তবে এ সকল বিপদ থেকে রক্ষা পেত।
হে পাঠক!
আল্লাহর কসম করে বলছি, আমাকে বলুন তো, এ দিক থেকে মক্কার মুশরিকরা এবং
বর্তমান যুগের মানুষদের মধ্যে কারা হেদায়াতের অধিক নিকটবর্তী এবং কারা
মিথ্যার চোরাবালিতে আটকে পড়েছে? উভয় প্রার্থনাকারী ও আহবানকারীর মধ্যে কার
প্রার্থনা অধিকতর সত্য? আল্লাহর নিকটই মনোবেদনা জ্ঞাপন করছি এমন এক যুগে,
যে যুগে অজ্ঞতার প্রবল ঘূর্ণিঝড় সকলকে আচ্ছন্ন করেছে; বিভ্রান্তির প্রবল
ঢেউ বিশাল আকৃতি নিয়ে আছড়ে পড়েছে। শরী‘আতের নৌকার রশি ছিন্ন হয়েছে।
গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য ও প্রার্থনাকেই মুক্তির অসীলা রূপে গণ্য করা
হয়েছে। জ্ঞানীদের জন্য সৎ কাজের আদেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং অন্যায় থেকে
নিষেধ করার ক্ষেত্রে নানা প্রকার বিপদ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ
আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন’।[23]
৪. ইলমে গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞান সম্পর্কিত আক্বীদাহ :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল সকল কিছুর জ্ঞান কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য খাছ। আল্লাহ তা‘আলাই আলিমুল গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞাতা। এমনকি নবীগণও কোন বিষয় সম্পর্কে জানতেন না, যতক্ষণ আল্লাহ তাদেরকে অহি-র মাধ্যমে অবগত না করতেন।
সকল গায়েবের জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলার জন্য খাছ, অন্য কোন সৃষ্টির এ ব্যাপারে কোন অংশীদারিত্ব নেই। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُ وَمَا يَشْعُرُوْنَ أَيَّانَ يُبْعَثُوْنَ ‘বল, আল্লাহ ছাড়া আসমানসমূহে ও যমীনে যারা আছে তারা গায়েব জানে না। আর কখন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে তা তারা অনুভব করতে পারে না’ (নামল ২৭/৬৫; ফাতির ৩৫/৩৮; লোক্বমান ৩১/৩৪; আ‘রাফ ৭/১৮৮; মায়েদা ৫/১০৯)।
এক্ষেত্রে
ব্রেলভীরা কুরআন ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ বিরোধী আক্বীদা পোষণ করে। তাদের মতে
নবীগণ (সৃষ্টির) ১ম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সবকিছু জানেন; বরং তারা
(সবকিছু) দেখেন ও পর্যবেক্ষণ করেন।[24]
ব্রেলভীর
এক ভক্ত লিখেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বিশ্বের কোন কিছুই গোপন রাখা
হয়নি। এই পবিত্র রূহ আসমানের উপর হ’তে নীচ পর্যন্ত সকল কিছু এবং
দুনিয়া-আখিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম সবকিছু সম্পর্কে অবগত। কারণ এসব কিছু এই
কামেল ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে’।[25]
পবিত্র
কুরআনের আয়াত সমূহের সম্পূর্ণ বিপরীতে রেযা খান ব্রেলভী গায়েবী পঞ্চকুঞ্জি
সম্পর্কে বলেছেন, ‘হুযুর (ছাঃ) শুধু সেগুলো জানতেনই না, বরং তিনি সেগুলো
যাকে ইচ্ছা বণ্টন করতে পারেন’।[26]
ব্রেলভীদের
ইমাম আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী লিখেছেন, ‘কিয়ামত কখন আসবে, কখন কতটুকু
বৃষ্টি হবে, মাতৃজঠরে কি আছে, আগামীকাল কি ঘটবে এবং কোথায় সে ব্যক্তি
মৃত্যুবরণ করবে এসব বিষয় যা আয়াতে কারীমাতে উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনটিই
হুযুর (ছাঃ)-এর নিকট গোপন ছিল না। এ সকল বিষয় কিভাবে হুযুর (ছাঃ) থেকে গোপন
থাকতে পারে, যখন ৭ জন কুতুবের সকলেরই এ জ্ঞান রয়েছে এবং তারা গাওছের চেয়ে
নিম্ন পদ মর্যাদার? গাওছ সম্পর্কে কি বলা যেতে পারে এবং সে ব্যক্তি
সম্পর্কে কি বলা যেতে পারে, যিনি পূর্বে এবং পরবর্তীতে আগত সকলের মালিক এবং
জগৎ সমূহের অধিপতি এবং যিনি সকল বস্ত্তর কারণ এবং সমস্ত বিষয় তাঁর জন্যই
অর্থাৎ হুযুর (ছাঃ)-এর জন্য।[27]
এগুলো শুধু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্যই খাছ নয়, শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী ও অন্যান্য অলীরাও এ পঞ্চকুঞ্জিতে শরীক আছে বলে ব্রেলভীরা বিশ্বাস করে।
তারা
শায়খ আব্দুল কাদের জিলানীর উপর একটি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলে,
‘সাইয়্যেদুনা গাওছুল আযম হুযুরের প্রতি নূর প্রেরণ করেন। যদি শরী‘আত আমার
জিহবাকে আটকে না রাখত, তবে আমি তোমাদেরকে সবকিছু জানিয়ে দিতাম যা তোমরা খাও
এবং যা তোমরা তোমাদের ঘরে সংরক্ষণ করে রাখ। আমার জন্য তোমরা স্বচ্ছ কাঁচের
মত। আমি তোমাদের যাহির ও বাতিন (প্রকাশ্য ও গোপন অবস্থা) দেখতে পাই’।[28]
তিনি আরো লিখেছেন, ‘পরিপূর্ণ মুমিনের দৃষ্টি সাত আসমান ও সাত যমীনকে এমনভাবে বেষ্টন করে, যেমন বিরাণ ভূমিতে একটি বৃত্তাকার আংটি’।[29]
অনুরূপভাবে অন্য একজন ব্রেলভী লিখেছেন, ‘একজন ইনসানে কামেল (পরিপূর্ণ
মানুষ) ঘটনাবলীর হাক্বীক্বাত বা গূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবগত এবং তার জন্য
‘গায়েব’ এবং ‘গায়েব আল-গায়েব’ উন্মুক্ত করা হয়’।[30]
৫. নবী করীম (ছাঃ)-এর মানবত্ব প্রসঙ্গ :
তাদের আক্বীদা হ’ল নবী করীম (ছাঃ) আল্লাহর নূরের একটি অংশ। তারা তাঁকে মানবত্বের সীমা থেকে বের করে দেয় এবং তাঁকে নূরের সৃষ্টির মধ্যে গণ্য করে। তাদের বিশ্বাস মানুষ কখনও রাসূল হ’তে পারে না। এটা কাফেরদেরও আক্বীদা। পার্থক্য কেবল এই যে, কাফেররা বলত যে, ‘মানবত্ব’ রিসালাতের পরিপন্থী। আর এ ব্রেলভীদের আক্বীদা হ’ল রিসালাত মানবত্বের পরিপন্থী। অতএব তাদের উভয়ে এ বিষয়ে একমত যে, মানবত্ব ও রিসালাত একসঙ্গে (একক ব্যক্তির মাঝে) সহাবস্থান করতে পারে না। অথচ মহান আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় এরশাদ করেন,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ-
‘বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট অহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহই এক ইলাহ...’ (কাহফ ১৮/১১০; ফুছছিলাত/হা-মীম-সাজদা ৪১/৬)।
আব্দুল্লাহ
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের নিয়ে পাঁচ রাক‘আত
ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, ছালাত কি
বৃদ্ধি করা হয়েছে? তিনি বলেন, তোমরা এ প্রশ্ন করছ কেন? তারা বললেন, আপনি
পাঁচ রাক‘আত ছালাত আদায় করেছেন। তখন তিনি বললেন, ‘আমি তো তোমাদের মতই একজন
মানুষ মাত্র। তোমরা যেমন স্মরণ রাখ, আমিও তেমনি স্মরণ রাখি এবং তোমরা যেমন
ভুলে যাও, আমিও তেমনি ভুলে যাই। অতঃপর দু’টো সাহো সিজদা করলেন’।[31]
রাসূল
(ছাঃ) নূরের তৈরী এ সম্পর্কে তারা নিম্নোক্ত একটি হাদীছ উল্লেখ করে, নবী
করীম (ছাঃ) জাবির (রাঃ)-কে বললেন, ‘নিশ্চয়ই অন্যান্য সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ
সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেন। নবীর নূরকে আল্লাহ তাঁর কুদরতী
শক্তিতে যেখানে ইচ্ছা রূপান্তরিত করেছেন। তখন লাওহ, কলম, জান্নাত-জাহানণাম,
ফেরেশতা, আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, মানব কোনকিছুই সৃষ্টি করেননি। যখন
আল্লাহ সৃষ্টিকুলকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তাঁর নূরকে চারভাগে
ভাগ করলেন। ১ম ভাগ দিয়ে কলম, ২য় ভাগ দিয়ে লাওহ, ৩য় ভাগ দিয়ে আরশ এবং ৪র্থ
ভাগকে আরও চারটি ভাগে ভাগ করলেন ...’।[32]
তারা কবিতায় বলে,
‘আপনি নূরের ছায়া, আপনার সর্বাংশই নূর
ছায়ার কোন ছায়া নেই, আর নূরেরও কোন ছায়া নেই।
আপনার পবিত্র বংশের প্রত্যেক শিশুই নূর হ’তে (সৃষ্টি)
আপনি পুরো নূর এবং আপনার পুরো পরিবারই নূর হ’তে’।[33]
তারা বলে, নবী করীম (ছাঃ)-কে বাশার (মানব) বলা কাফিরদের কথা।[34]
যদি তা-ই হয়, তবে এ হাদীছের অর্থ কি যেখানে আয়েশা (ও অন্যান্যরা) (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাশার ছিলেন’?[35]
৬. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাযির-নাযির প্রসঙ্গে :
ব্রেলভীদের
আক্বীদাসমূহের মধ্যে অন্যতম হ’ল, তারা বিশ্বাস করে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
সর্বত্র হাযির (উপস্থিত) ও নাযির (দর্শনকারী) এবং সশরীরে একই সাথে একাধিক
স্থানে উপস্থিত থাকতে পারেন। তাদের মতে, আল্লাহর অলীগণ একই সময়ে বহু স্থানে
উপস্থিত থাকতে পারেন এবং তারা একই সময়ে বহু দেহ ধারণ করতে পারেন।[36]
আরো
বলা হয়, ‘তাঁর উম্মতের আমল দেখাশোনা করা, তাদের গুনাহর জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা করা, তাদের বালা-মুছীবত দূর হওয়ার উদ্দেশ্যে দো‘আ করা, পৃথিবীর
চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ানো, একে বরকতপূর্ণ করা এবং যদি কোন নেককার ব্যক্তি মারা
যায়, তার জানাযায় উপস্থিত হওয়া- এসব হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দায়িত্ব।[37]
নবী করীম (ছাঃ) সম্পর্কে তারা আরো বলে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রূহ মুবারক বিশ্বের সকল মুসলিমের বাড়িতে হাযির রয়েছে।৪২
অপর এক ব্রেলভী লিখেছে, নবী করীম (ছাঃ) আদম (আঃ)-এর সময় হ’তে তাঁর
শারীরিকভাবে অস্তিত্ব লাভ করা (জন্মগ্রহণ করা) পর্যন্ত হাযির ছিলেন।[38]
সে
অন্যত্র লিখেছে, রাসূল (ছাঃ) হাযির ও নাযির। তিনি পৃথিবীতে যা ঘটছে এবং যা
ঘটবে, তা প্রত্যক্ষ করেন। তিনি সকল স্থানে হাযির আছেন এবং তিনি সকল কিছু
দেখেন।[39]
অথচ কুরআন-হাদীছের বক্তব্য এসব আক্বীদার সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহ বলেন,
وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الْغَرْبِيِّ إِذْ قَضَيْنَا إِلَى مُوسَى الْأَمْرَ وَمَا كُنتَ مِنَ الشَّاهِدِينَ، وَلَكِنَّا أَنشَأْنَا قُرُوناً فَتَطَاوَلَ عَلَيْهِمُ الْعُمُرُ وَمَا كُنتَ ثَاوِياً فِي أَهْلِ مَدْيَنَ تَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَلَكِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ، وَمَا كُنتَ بِجَانِبِ الطُّورِ إِذْ نَادَيْنَا وَلَكِن رَّحْمَةً مِّن رَّبِّكَ لِتُنذِرَ قَوْماً مَّا أَتَاهُم مِّن نَّذِيرٍ مِّن قَبْلِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ-
‘মূসাকে যখন আমরা নির্দেশনামা দিয়েছিলাম, তখন তুমি পশ্চিম প্রান্তে ছিলে না এবং তুমি প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলে না। কিন্তু আমরা অনেক সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিলাম, অতঃপর তাদের অনেক যুগ অতিবাহিত হয়েছে। আর তুমি মাদইয়ানবাসীদের মধ্যে ছিলে না যে, তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করতে। কিন্তু আমরাই ছিলাম রাসূল প্রেরণকারী। আমরা যখন মূসাকে আওয়াজ দিয়েছিলাম, তখন তুমি তূর পর্বতের পার্শ্বে ছিলে না। কিন্তু এটা তোমার পালনকর্তার রহমতস্বরূপ, যাতে তুমি এমন এক সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন কর, যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোন ভীতি প্রদর্শনকারী আগমন করেনি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ক্বাছাছ ২৮/৪৪-৪৬)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ذَلِكَ مِنْ أَنبَاء الْغَيْبِ نُوْحِيهِ إِلَيكَ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُون أَقْلاَمَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُونَ ‘এটা হ’ল গায়েবী সংবাদ, যা আমরা তোমাকে পাঠিয়ে থাকি। আর তুমি তো তাদের কাছে ছিলে না, যখন প্রতিযোগিতা করছিল যে, কে প্রতিপালন করবে মারিয়ামকে এবং তুমি তাদের কাছে ছিলে না, যখন তারা ঝগড়া করছিল’ (আলে ইমরান ৩/৪৪)।
উপরোক্ত আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, কোন এক ব্যক্তির জন্য একই সময়ে একাধিক স্থানে উপস্থিত থাকার আক্বীদা সঠিক নয়। কুরআনের আয়াত উপরোক্ত ভ্রান্ত আক্বীদা বিরোধী।
বাস্তবতা ও প্রকৃত ঘটনাবলীও তাদের আক্বীদাকে বাতিল করে দেয়। যখন রাসূল (ছাঃ) তাঁর হুজরায় অবস্থান করতেন তখন তিনি মসজিদে হাযির থাকতেন না। তাই ছাহাবীগণ তাঁর জন্য মসজিদে অপেক্ষা করতেন। তিনি যদি সর্বত্র হাযির-নাযির হ’তেন, তবে তাঁর ছাহাবীগণের তাঁর জন্য অপেক্ষা করার কোন অর্থ থাকে না। তেমনি তিনি যখন মদীনায় ছিলেন, তখন তিনি হুনাইনে হাযির ছিলেন না। যখন তাবুকে হাযির ছিলেন, তখন তিনি মদীনায় হাযির ছিলেন না এবং যখন আরাফায় ছিলেন, তখন তিনি মদীনায় বা মক্কায় হাযির ছিলেন না।
অতএব উপরোক্ত ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস থেকে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক সাবধান হ’তে হবে। যাতে এসব ভ্রান্ত আক্বীদা আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে আমাদের ঈমান-আমল ধ্বংস না করতে পারে এবং পরকালে আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ নূর আব্দুল্লাহ হাবীব
প্রভাষক, আরিফপুর জে.ইউ.এস. ফাযিল (ডিগ্রী) মাদরাসা, পাবনা।
[1]. এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ রেযা খাঁন ব্রেলভী ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরেলী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। দ্রঃ দায়িরাতুল-মা‘আরিফ, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৪৮৭; আলা হযরত ব্রেলভী, (লেখক অস্পষ্ট) পৃঃ ২৫। জাফরুদ্দীন বিহারী রিযভী এবং তার অনুসারী আলিমগণ কর্তৃক উদ্ভাবিত বা রচিত এবং সুবিন্যস্ত আক্বীদা-বিশ্বাসই হ’ল ব্রেলভী আক্বীদা বা মতবাদ। দ্রঃ দায়িরাতুল-মা‘আরিফ, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৪৮৫।
[2]. আহমদ রেযা খান ব্রেলভী, আল-আমান ওয়াল আলা (লাহোর : দারুত তাবলীগ), পৃঃ ২৯।
[3]. আহমদ রেযা, ফৎওয়া রিযভিয়াহ, (পাকিস্তান), ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩০০, ।
[4]. ঐ পৃঃ ৩০০।
[5]. আল-আমান ওয়াল আলা, পৃঃ ১০।
[6]. ঐ, পৃঃ ১৩।
[7]. বারকাতুল ইসতিমরায, ব্রেলভী রিসালা রিযভিয়াহ, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৮১।
[8]. মুফতী আহমাদ ইয়ার খাঁন ব্রেলভী, জাআল হাক্ব, পৃঃ ২০০।
[9]. মালফূযাত, পৃঃ ৩০৭।
[10]. ফৎওয়া আফ্রিকা, পৃঃ ১৩৫।
[11]. আল-আমান ওয়াল আলা, পৃঃ ৪৪।
[12]. মুহাম্মাদ ওছমান ব্রেলভী, ফৎওয়া কুয়ুদ, পৃঃ ৩৯।
[13]. ঐ, পৃঃ ৫।
[14]. আহমাদ রেযা, আনওয়ারুল ইনতিবাহ্ ফী মাজমূ‘ রাসায়েলে রিযভিয়াহ, ১ম খন্ড পৃঃ ১৮২।
[15]. আহমাদ হা/২৫১৬; ছহীহ তিরমিযী, হা/২৫১৬; মিশকাত হা/৫০৭২, সনদ ছহীহ ।
[16]. আল-ইস্তিমদাদ আলা আহইয়ালিল ইরতিদাদ, পৃঃ ৩২-৩৩।
[17]. আল-আমান ওয়াল আলা, পৃঃ ৫৮।
[18]. আয-যামযামাতুল গামারিয়া ফিয যাবিব আনিল খামর, পৃঃ ৩৫।
[19]. আল-ইস্তিমদাদুল হাওয়ামেশ, পৃঃ ৩৫-৩৬।
[20]. নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খাঁন, ফাতহুল বায়ান, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২১৫।
[21]. আমজাদ আলী, বাহরে শরী‘আত, ১ম খন্ড পৃঃ ৫৮।
[22]. ফৎওয়া নাঈমিয়া, পৃঃ ২৪৫।
[23]. আলূসী, রূহুল মা‘আনী ৭/৪৭৪; নাক্বালাত আনিল আয়াতিল কারীমাহ ফী আদমে সামাইল মাওয়াত, মুকাদ্দামাহ, পৃঃ ১৭।
[24]. আদ-দাওলাতুল মাক্কাহ বিল মাদ্দাতিল আলফিইয়াহ (লাহোর, পাকিস্তান), পৃঃ ৫৭।
[25]. নাঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী, আল-কামাতুল ‘আয়া লিআ‘লাই ইলমিল মুছতফা, পৃঃ ১৪।
[26]. খালিছুল ই‘তিকাদ, পৃঃ ১৪।
[27]. ঐ, পৃঃ ৫৩-৫৪।
[28]. ঐ, পৃঃ ৪৯।
[29]. ঐ, পৃঃ ৫২।
[30]. জাআল হাক্ব, পৃঃ ৮৫।
[31]. বুখারী, ৮/৩১, হা/৪০১; মুসলিম ১/৪০০; আবুদাঊদ, হা/১০২০; তিরমিযী/১১০, নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৯৯, ৯০১; মিশকাত হা/৯৫০।
[32]. আছ-ছলাতুছ ছফ ফী নূরিল মুছতফা, রিসালাহ ফী মাজমূ‘আ রাসাইল, পৃঃ ৩৩।
[33]. নাফিউল ফাই আম্মান আনারা বিনূরিহি কুল্লা শাই’, রিসালাহ ফী মাজমূ‘আ রাসাইল পৃঃ ১২৪। এ হাদীছটি ভিত্তিহীন, মুছান্নাফ আব্দুর রায্যাক বা অন্য কোন গ্রন্থে তা নেই। ইমাম সুয়ূতী, শায়খ আব্দুল্লাহ গুমারী, শায়খ আহমাদ গুমারী, শায়খ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ ও অন্যান্য প্রাচীন ও সমকালীন সালাফী ও ছূফী সকল মতের মুহাদ্দিছ একমত যে, এ কথাটি হাদীছ নয়। হাদীছের গ্রন্থে এর কোন অস্তিত্ব নেই। নূরে মুহাম্মাদী বিষয়ে বিস্তারিত দ্রঃ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীছের নামে জালিয়াতি, পৃঃ ৩১০-৩৪০; ইসলামী আক্বীদা, পৃঃ ১৯১-১৯৬।
[34]. ফৎওয়া রিযভিয়াহ, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ১৪৩; মাওয়ায়েযে নাঈমিয়াহ, পৃঃ ১১৫।
[35]. মুসলিম, ৪/২০০৭; তিরমিযী, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিনয় সম্পর্কে যা এসেছে’ অনুচ্ছেদ হা/৩২৫।
[36]. জাআল হাক্ব, পৃঃ ১৫০।
[37]. ঐ, পৃঃ ১৫৪।
[38]. খালিছুল ই‘তিকাদ, পৃঃ ৪০।
[39]. জাআল হাক্ব, পৃঃ ১৬৩।