[মুহাসাবার ফল]
২. হেদায়াত লাভে সমর্থ হওয়া এবং তার উপর অটল থাকা :
মুহাসাবার
ফলে মানুষ যেমন আল্লাহর দেওয়া সরল পথ লাভ করতে পারে, তেমনি তার উপর অটল
থাকতে পারে। কাযী বায়যাভী (রহঃ) বলেন, ‘হেদায়াত লাভ এবং তাতে অটল থাকার মত
যোগ্যতা তখনই লাভ করা সম্ভব হবে যখন এজন্য চিন্তাশক্তি ব্যয় করা হবে। যেসব
দলীল-প্রমাণ এক্ষেত্রে রয়েছে সেগুলো নিয়ে সদাই চিন্তা-গবেষণা করা হবে এবং
কী আমল করা হচ্ছে বা না হচ্ছে লাগাতারভাবে মন থেকে তার হিসাব নেওয়া হবে।[1]
৩. কলবের রোগের চিকিৎসা :
মানুষের মনে নানা রোগ বাসা বাঁধে। যেমন, লোভ, হিংসা, অহংকার, আত্মতুষ্টি, অহমিকা, নিজেকে বড় দ্বীনদার ভাবা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, কর্মবিমুখতা, অমিতব্যয়িতা ইত্যাদি। মনের থেকে নিজের কথা ও কাজের হিসাব না নেওয়ার ফলে নিজের অজান্তে এসব রোগ হয়। তাই মন থেকে নিজ আমলের হিসাব নিলে এবং মনের ইচ্ছার বিরোধিতা করলে তখনই কেবল কলবের রোগ প্রতিরোধ ও তার চিকিৎসা করা সম্ভব। মনের হিসাব না নিয়ে বরং যদি মানুষ নিজের মনের ইচ্ছার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে তাহ’লে কলব ধ্বংস হয়ে যায়। সুতরাং যে মূর্খ কেবল সেই তার মনকে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী করে এবং আল্লাহর কাছে অলীক আশা পোষণ করে। তার মন যেদিকে ঝোঁকে সেও সেদিকে ঝোঁকে। মন যেদিকে চায় সে সেদিকেই যায়। এতে করে তার কলব বরবাদ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে মনের ইচ্ছার বিরোধিতা করে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কিসে নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণ হয় তা ভেবে কাজ করলে কলব সুস্থ থাকে এবং তার রোগ-ব্যাধিরও চিকিৎসা হয়।
৪. মনের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করা এবং নিজের আমল-আখলাকে ধোঁকার শিকার না হওয়া :
নিজের
কাজের ভালো-মন্দ যাচাই ও পরখ করে না দেখলে নিজের কাছে নিজেকে ভালো মনে হয়।
আমল-আখলাকে কোন সমস্যা আছে বলেও মনে হয় না। নিজেকে বরং আল্লাহর পিয়ারা
বান্দা ভাবতেই ইচ্ছা করে। কিন্তু মনের হিসাব-কিতাব করলে তখন তার নানান দোষ
বেরিয়ে আসবে। আর যখনই নিজের সামনে মনের দোষ প্রকাশ হয়ে পড়বে, তখন আর নিজের
আমলকে ফ্রেশ ও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য ভেবে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলার ইচ্ছা জাগবে
না। তার বরং মনে হবে, তার রব যেন এই টুটা-ফাটা কলুষিত আমল দয়া করে কবুল
করে নেন। আব্দুল আযীয বিন রাওয়াদ (রহঃ) বলেন, ‘যখনই আমি কোন পুণ্য কাজ শুরু
করে তা শেষ করেছি তখনই আমি আমার মন থেকে হিসাব করে দেখেছি যে, তাতে আল্লাহ
তা‘আলার ভাগের থেকে শয়তানের ভাগ বেশী।[2]
৫. মুহাসাবা বিদ্বেষহীন অহংকারমুক্ত জীবনের পথে নিয়ে যায় :
মানুষ
যদি নিয়মিত নিজের মনে নিজের আমলের হিসাব নেয় আর কুরআন, সুন্নাহ, রাসূল
(ছাঃ)-এর জীবনী ও ছাহাবীদের আমলের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখে তবে নিজের আমলের
স্বল্পতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখে তার মনে অহংকার ও বিদ্বেষ দানা বাঁধবে না
ইনশা‘আল্লাহ। আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, কোন লোক ফক্বীহ বা
সমঝদার হ’তে পারবে না, যে পর্যন্ত না সে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে
অন্য মানুষকে যতটুকু তুচ্ছ মনে করবে তার থেকেও নিজেকে বেশী তুচ্ছ মনে
করবে’।[3]
আমাদের অতীতের পূর্বসূরীগণ যখন
নিজেদের নফস বা মনের হিসাব নিতেন তখন তারা মনের অবস্থা বুঝে আল্লাহর হুযূরে
তাকে তুচ্ছ ও নগণ্য ঠাওরাতেন। আরাফার ময়দানে জনৈক পূর্বসূরী তাঁর চারপাশের
জনগণের মাঝে এই বলে দো‘আ করছিলেন যে, ‘হে আল্লাহ, আমার কারণে তুমি এদের
(দো‘আ) ফিরিয়ে দিও না।[4]
মুহাম্মাদ বিন ওয়াসি‘ (রহঃ) বলতেন, (হায়! আমি এতই পাপী যে,) পাপের যদি গন্ধ থাকত তাহলে তার দুর্গন্ধে আমার কাছে কেউ টিকতে পারত না।[5] অথচ তিনি ছিলেন এই উম্মতের একজন বড় আবেদ।
ইউনুস বিন উবায়েদ (রহঃ) বলেন, ‘আমি অবশ্যই একশত সদভ্যাসের কথা জানি, যার একটাও আমার মধ্যে আছে বলে আমার মনে হয় না।[6]
হাম্মাদ
বিন সালামা (রহঃ)-কে দেখুন, সুফিয়ান ছাওরী যখন মরণাপন্ন তখন তিনি তাকে
দেখতে যান এবং বলেন, ওহে আবু আব্দুল্লাহ, আপনি যে জিনিসের (জাহান্নামের) ভয়
করতেন তার থেকে কি নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না? আর যিনি সবচেয়ে দয়ালু,
যার দয়ার আশায় আপনি থাকতেন তার নিকট যেতে সাহস পাচ্ছেন না? উত্তরে তিনি
বললেন, হে আবু সালামা, আমার মত মানুষের জাহান্নাম থেকে মুক্তির আশা তুমি কর
কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই তা করি।[7]
ভেবে দেখুন! হাদীছ, ফিক্বহ ও সংসারবিমুখ ইবাদতগুযারদের এই সমস্ত দিকপাল যদি জাহান্নাম থেকে মুক্তি না পান তাহ’লে আর কে মুক্তি পাবে?
জা‘ফর
বিন যায়েদ (রহঃ) বলেন, আমরা কাবুল অভিযানের সেনাদলে অংশ নিয়েছিলাম। ঐ
সেনাদলে ছিলাহ বিন আশইয়াম নামে একজন আল্লাহওয়ালা লোক ছিলেন। রাতের বেলায়
সৈনিকরা এক জায়গায় ডেরা ফেলে এশার ছালাত আদায় করে শুয়ে পড়ল। আমি মনে মনে
স্থির করলাম যে, দীর্ঘ সময় ধরে আমি ছিলাহর আমল দেখব। তিনি লোকেদের
অমনোযোগের সুযোগ খুঁজছিলেন। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তিনি চুপিসারে বেরিয়ে পড়লেন
এবং আমাদের কাছাকাছি কিছু ঘন গাছপালার বনে ঢুকে পড়লেন। আমিও তার পিছনে
পিছনে গেলাম। তিনি ওযূ করে ছালাতে দাঁড়ালেন। এমন সময় একটা সিংহ এল এবং
একেবারে তাঁর কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। এ দৃশ্য দেখে আমি একটা গাছে উঠে পড়লাম।
যখন তিনি সিজদায় গেলেন তখন আমি মনে মনে ভাবলাম, এই বুঝি সিংহটা তাঁকে ফেড়ে
খাবে। কিন্তু তিনি ছালাত চালিয়ে গেলেন। তারপর বসে দো‘আ-দরূদ শেষে সালাম
ফিরালেন। এবার সিংহটাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে শ্বাপদ, তুই অন্য কোথাও তোর
খাবার তালাশ কর। এখানে তোর খাবার নেই। তখন সিংহটা গজরাতে গজরাতে ফিরে গেল।
আর তিনি ভোর হওয়া পর্যন্ত একইভাবে ছালাত আদায় করতে থাকলেন। ভোর হ’লে তিনি
বসে বসে আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং এই বলে দো‘আ করলেন যে, ইয়া আল্লাহ, আমার
মত হতভাগার তোমার কাছে জান্নাতের আবেদন করতে শরম লাগে; তাই তোমার কাছে
আমার নিবেদন যে, তুমি আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিও। তারপর তিনি তাঁর
তাঁবুতে ফিরে এলেন। সকালবেলায় মনে হচ্ছিল তিনি তাঁর তোশকে শুয়ে রাত
কাটিয়েছেন। এদিকে কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আমার ভোর হয়েছে একমাত্র আল্লাহই তা
জানেন।[8]
৬. সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো :
মনের হিসাব নিলে মানুষ নিজের সময়কে সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগাতে পারে। ইবনু আসাকির (রহঃ) বলেন, আবুল ফাতাহ নছর বিন ইবরাহীম আল-মাক্বদিসী প্রতি শ্বাস-প্রশ্বাসে মনের হিসাব নিতেন। একটা মুহূর্তও যেন বেকার না যায় সেজন্য তিনি চেষ্টা করতেন। হয় কিছু লিখতেন, নয় পড়াতেন, কিংবা নিজে পড়তেন।[9] সুতরাং যে মুহাসাবার এসব ফলাফল জানতে পেরেছে তার কর্তব্য হবে, নিজ মনের হিসাব গ্রহণ থেকে কখনও উদাসীন না থাকা। মনের অস্থিরতা, স্থিরতা, ভাবনা-চিন্তা, পা তোলা, পা ফেলা ইত্যাকার প্রতি পদক্ষেপে কড়াকড়ি আরোপ করা। আসলে মানব জীবনের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস মূল্যবান মণিমুক্তাবিশেষ। সুতরাং এই শ্বাস-প্রশ্বাসকে বেকার নষ্ট করা অথবা তার বিনিময়ে নিজের ধ্বংস ডেকে আনার মত কিছু করা মহাক্ষতি বৈ আর কিছু নয়। চরম অজ্ঞ, মূর্খ ও অবিবেচক ছাড়া আর কারও পক্ষে এমন ধরনের কাজ করা সমীচীন নয়। এ ক্ষতির স্বরূপ ক্বিয়ামতের দিন সে স্বচক্ষে দেখতে পাবে।
কে নিজের মনের হিসাব করবে?
মুহাসাবা এমন নয় যে একদল মানুষ করবে তো অন্য দল করবে না। বরং ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, নেককার-বদকার, আলেম-জাহেল ইত্যাদি সকল মুমিন আমভাবে তার অন্তর্ভুক্ত। যিনি জাহেল-অজ্ঞ তিনি এভাবে নিজের হিসাব করবেন যে, অজ্ঞতার অবস্থায় কীভাবে তিনি আল্লাহর ইবাদত করছেন? কখন তার এ অজ্ঞতা দূর হবে? কীভাবে দূর হবে? কীভাবে সে শিখবে? কী দিয়ে শুরু করবে?
এভাবে আলেম বা বিদ্বান ব্যক্তিও নিজের হিসাব করবে। কথিত আছে যে, শুরুতে করা মুহাসাবা থেকে শেষে করা মুহাসাবা হবে আরও নিবিড়। অর্থাৎ জীবনের প্রথম বেলায় লোকেরা যখন আল্লাহর পথ সম্পর্কে অজ্ঞ ও গাফেল থাকে তখন নিজেদের মনের যেভাবে হিসাব নেয়, সেই অজ্ঞতা ও গাফলতি কেটে গিয়ে তাদের জীবন যখন উঁচু পর্যায়ে উন্নীত হয় এবং তারা বিদ্যাচর্চা, সৎকাজ সম্পাদন, ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ ইত্যাদি আমল করতে থাকে তখন তাদের মনের হিসাব আরও কঠোরভাবে করতে হবে। আমরা কত তালেবুল ইলম বা দ্বীনী বিদ্যা শিক্ষার্থীকে দেখেছি যারা মনের হিসাব রাখে না এবং আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধী পথ থেকে আত্মরক্ষা করে না। ফলে নানান জায়গায় তাদের পদস্খলন ঘটেছে এবং মানবতা বিনষ্টকারী আচরণ থেকে তারা নিজেদের হেফাযত করতে পারেনি। মাকরূহ বা অপসন্দনীয় কাজ পরহেয করাতো দূরের কথা, সময়বিশেষে তারা বরং হারামের সাথেও জড়িয়ে পড়ে।
এ ধরনের দ্বীনী বিদ্যা শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিদ্যার উপর নির্ভর করে মনের হিসাব রাখে না। তারা তাদের বিদ্যার বড়াই করে এবং অহংকার বশত কাউকে গ্রাহ্য করে না। হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত ও পরনিন্দা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়। তারা কুৎসিত কথা ছড়িয়ে বেড়ায় এবং গোপনীয় বিষয় ফাঁস করে দেয়। তারা নিজেদের জন্য এমন এমন মর্যাদার কথা ভাবে যা তাদের ছাড়া অন্যদের জন্য তারা ভাবতেই পারে না। হয়তো এক পর্যায়ে তাদের ভাবনা সঠিক হ’তেও পারে, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তো সকল শ্রেণীর মানুষেরই পাপ-পঙ্কিলতার হিসাব নিবেন। সেক্ষেত্রে বরং তাদের হিসাব হবে আরও কঠোর। তাদের মতো শিক্ষার্থীদের বিদ্যা তাদের কোন উপকারে আসে না। কেননা মুজাহিদের জন্য যেমন তলোয়ার, আমলের জন্য তেমনি বিদ্যা। তলোয়ার ব্যবহার না করলে তা দ্বারা মুজাহিদ কীভাবে উপকৃত হবে? আবার ক্ষুধার্তকে দেখুন, সে ক্ষুধা থেকে বাঁচার জন্য খাদ্য জমা করে। কিন্তু ক্ষুধায় যদি সে নাই খেল, তবে আর খাদ্য জমিয়ে কি লাভ! কবি বলেন,
يُحَاوِلُ نَيْلَ الْمَجْدِ وَالسَّيْفُ مُغْمَدٌ * وَيَأْمَلُ إِدْرَاكَ الْعُلاَ وَهُوَ نَائِمُ
‘সে মুজাহিদের সম্মান লাভে প্রয়াসী, অথচ তার তলোয়ার কোষবদ্ধ, সে উচ্চমার্গের নাগাল পেতে আশাবাদী, অথচ ঘুমিয়ে আছে বিছানায়’।[10]
জাহিল-মূর্খদের হাল-হকীকতও অনেক সময় এ ধরনের শিক্ষার্থীদের থেকে ভাল হয়ে থাকে। কেননা কিছু কিছু জাহিল-মূর্খ নিজেদের মনের হিসাব করে মন্দ আমলগুলো বের করে ফেলে এবং খেয়াল-খুশীর মৌতাতে মজে সর্বনাশ ডেকে আনার আগে নিজেদের সংশোধনে সচেষ্ট হয়। অনেক শিক্ষার্থী তাদের শেখা বিদ্যার প্রচার-প্রসার করে না এবং পঠন-পাঠনেও অংশ নেয় না। এটি তাদের একটা বড় ভুল। অথচ এ ভুল যাতে না হয়, সেজন্য তাদের নিজেদের দায়িত্বের হিসাব রাখা আবশ্যক ছিল। আর যারা বিদ্বান বা আলেম তারা নিজেদের মনের হিসাব রাখতে অন্যান্যদের তুলনায় বেশী সমর্থ। আজকাল আমরা ইন্টারনেট, ইউটিউব, টিভি ইত্যাদি মিডিয়াতে প্রচারিত যেসব ভুলে ভরা দ্বীন বিনষ্টকারী ফৎওয়া দেখতে পাই তার কারণ আলেমদের মুহাসাবা বিমুখতা। তারা যদি নিজেদের মনে একবারের জন্যও ভেবে দেখতেন তাহ’লে ফৎওয়া জিজ্ঞাসাকারীদের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী তাদের মর্যি মাফিক ঐসব বাজে ফৎওয়া দিতেন না। কাজেই আলেম ও তালেবুল এলেম বা দ্বীন শিক্ষার্থীদের জন্য অন্য যে কারও তুলনায় নিজেদের মনের হিসাব কঠিনভাবে রাখা উচিত। কেননা তারা যদি নিজেদের মনের হিসাব রাখে তবে নিজেরা উপকৃত হবে এবং জনগণেরও উপকার করতে পারবে। আর যদি নিজেদের মনের হিসাব রাখা ছেড়ে দেয় তবে নিজেরা পথহারা হবে এবং অন্যদেরও পথহারা করবে।
সৎকাজে মনের মুহাসাবার প্রকারভেদ : মনের হিসাব শুধু পাপকাজেই নয়, বরং সৎকাজেও আবশ্যক। সৎকাজে মনের হিসাব গ্রহণের দু’টি ধারা রয়েছে। এক- সৎকাজ করার আগে। দুই- সৎকাজ করার পরে।
১. সৎকাজ করার আগে মনের হিসাব :
ব্যক্তি কাজ শুরুর আগে নিজের মনের অবস্থা যাচাই করবে। তার চিন্তা-ভাবনা কোন দিকে, মনের ইচ্ছা, ঝোঁক ও সঙ্কল্পইবা কী তা লক্ষ্য করবে। কাজটা নির্ভেজালভাবে আল্লাহর জন্য করা হচ্ছে কি-না তা ভেবে দেখবে। যদি তার নিয়ত আল্লাহর জন্য হয় তাহ’লে কাজে নেমে পড়বে, তা না হ’লে তা পরিত্যাগ করবে।
হাসান বছরী
(রহঃ) বলেন, আল্লাহ তার ঐ বান্দার উপর রহম করুন, যে সৎকাজের শুরুতে একটু
থেমে নিজের নিয়ত যাচাই করে দেখে। যদি কাজটা আল্লাহকে রাযী-খুশী করার জন্য
হয় তবে তা করে, আর যদি না হয় তবে তা বাদ দিয়ে দেয়।[11]
অবশ্য রিয়া বা লোক দেখানোর আশঙ্কা মনে জাগার কারণে কেউ যেন তার সকল আমল ছেড়ে না দেয়। এখানে ঐ সকল আমলের কথা বলা হচ্ছে যার প্রথম শুরুতেই সে লৌকিকতার ভয় করছে। কিন্তু যে সকল সৎকাজ ফরয কিংবা নফল, যাতে সে অভ্যস্ত, তা লৌকিকতার ভয়ে ছেড়ে দেবে না। বরং নিয়তের সঙ্গে যুদ্ধ করে তা সংশোধনের চেষ্টা করবে।
আমল যাতে ইখলাছ অনুযায়ী হয় সেজন্য এই প্রকারের মুহাসাবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিনা মুহাসাবায় আমল করলে তা লোক দেখানোর ধারায় হয়ে যাবে এবং আমলকারী নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে। তখন তার অবস্থা দাঁড়াবে, যেমনটা আল্লাহ বলেছেন, عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ، تَصْلَى نَارًا حَامِيَةً، ‘ক্লিষ্ট, ক্লান্ত। তারা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে’ (গাশিয়া ৮৮/৩-৪)। সুতরাং সে তার আমল থেকে মোটেও উপকৃত হ’তে পারবে না, যদিও বাহ্যত তা সৎ আমল বলে মনে হবে।
নিয়ত খালেছ বা আল্লাহর জন্য নির্ভেজাল করার পর খেয়াল করবে এই আমল বাস্তবায়ন তার সামর্থ্যের ভিতরে, না বাইরে? যদি সামর্থ্যের বাইরে হয় তাহ’লে তা বাদ দেবে। যা করতে পারবে না তার পেছনে খামাখা সময় ব্যয় করবে না। আর যদি সামর্থ্যের ভিতরে হয় তাহ’লে আরেকবার থামবে এবং ভাববে কাজটা না করার চেয়ে করা উত্তম, নাকি করার চেয়ে না করা উত্তম?
যদি না করার চেয়ে করা উত্তম হয় তাহ’লে তা করবে। আর যদি করার চেয়ে না করা উত্তম হয় তাহ’লে করবে না। এ মুহাসাবা মনকে বড় শিরক, ছোট শিরক ও গোপন শিরক তথা রিয়া থেকে বাঁচানোর জন্য খুবই যরূরী।
২. আমলের পর মুহাসাবা :
এটি আবার তিন প্রকার। প্রথমত: এমন সৎ কাজে মুহাসাবা যা আল্লাহর হক বা অধিকারভুক্ত:
সৎ কাজ করার পর তা যাচাই করে দেখাই এ মুহাসাবা। কিভাবে সে ইবাদাতটা করল? যেভাবে কাজটা করা উচিত সেভাবে করেছে কি-না? তা কি সুন্নাত মাফিক হয়েছে, নাকি তাতে কোন ত্রুটি হয়েছে? যেমন ছালাতের মধ্যে খুশূ-খুযূ বা আল্লাহর প্রতি ধ্যান-খেয়াল টুটে যাওয়া, কোন প্রকার পাপ-প্রমাদ ঘটিয়ে ছিয়ামের মূল্য হ্রাস করা কিংবা হজ্জ পালনকালে নাফরমানিমূলক কাজ কিংবা ঝগড়াঝাটি করা।
সৎকাজে আল্লাহ তা‘আলার হক ছয়টি। যথা :
১. আমলের মধ্যে ইখলাছ বজায় রাখা।
২. শিরক মুক্তভাবে খালেছ ঈমান সহকারে আমল সম্পন্ন হওয়া।
৩. আমলটি রাসূলুল্লাহ (ছঃ)-এর অনুসরণ করে করা।
৪. সুন্দর-সুচারুরূপে ও মযবুতভাবে আমলটি করা।
৫. আমলটি সম্পন্ন করার পিছনে তার প্রতি আল্লাহর যে অনুগ্রহ ও সাহায্য-সহযোগিতা রয়েছে অকুণ্ঠচিত্তে তার সাক্ষ্য দেওয়া।
৬. কাজ শেষে নিজের অপূর্ণতার স্বীকারোক্তি করা।
দ্বিতীয়ত : যে ধরনের আমল করার চেয়ে না করা উত্তম সে ধরনের আমলে মুহাসাবা :
একজন মুসলিমের সামনে উত্তম আমল থাকা অবস্থায় তার থেকে অনুত্তম আমলে মশগূল হওয়া কখনই সমীচীন নয়। যেমন ক্বিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদের ছালাতে মশগূল হওয়ার দরুন ফজর ছালাত কাযা হয়ে যাওয়া অথবা এমন কোন যিকিরে মশগূল হওয়া যেখানে তার থেকে উত্তম অনেক যিকির রয়েছে। এ বিষয়ে উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া (রাঃ) বর্ণিত নিম্নের হাদীছটি প্রণিধানযোগ্য-
عَنْ جُوَيْرِيَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا بُكْرَةً حِينَ صَلَّى الصُّبْحَ وَهِىَ فِى مَسْجِدِهَا ثُمَّ رَجَعَ بَعْدَ أَنْ أَضْحَى وَهِىَ جَالِسَةٌ فَقَالَ مَا زِلْتِ عَلَى الْحَالِ الَّتِى فَارَقْتُكِ عَلَيْهَا. قَالَتْ نَعَمْ. قَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم لَقَدْ قُلْتُ بَعْدَكِ أَرْبَعَ كَلِمَاتٍ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ لَوْ وُزِنَتْ بِمَا قُلْتِ مُنْذُ الْيَوْمِ لَوَزَنَتْهُنَّ سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ عَدَدَ خَلْقِهِ وَرِضَا نَفْسِهِ وَزِنَةَ عَرْشِهِ وَمِدَادَ كَلِمَاتِهِ-
‘উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদিন
ফজর ছালাত শেষে ভোর বেলায় নবী করীম (ছাঃ) ঘর হ’তে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তিনি
তখন তাঁর জায়নামাযে বসা অবস্থায় ছিলেন। পূর্বাহ্ন হওয়ার পর নবী করীম (ছাঃ)
যখন ফিরে আসলেন তখনও তিনি বসা অবস্থায় ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে নবী করীম (ছাঃ)
বললেন, আমি যে অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে গেছি তুমি সে অবস্থায়ই আছ? তিনি বললেন,
হ্যাঁ। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি যদি ফজর ছলাতের পরে চারটি বাক্য
তিনবার বলতে তবে তা তোমার আজকের সারা দিনের বলা সকল কথার সমতুল্য হ’ত। সেই
বাক্য চারটি হল : সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী ‘আদাদা খালক্বিহী, ওয়া রিযা নাফসিহী, ওয়া যিনাতা আরশিহী, ওয়া মিদা-দা কালিমা-তিহী।
অর্থাৎ ‘আমি আল্লাহর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করছি তার সৃষ্টির সংখ্যার
সমপরিমাণে; তার নিজের সন্তুষ্টির সমপরিমাণে; তার আরশের ওযন পরিমাণে এবং তার
বাক্যসমূহের সংখ্যার সমপরিমাণে’।[12]
তৃতীয়ত : নিত্যকার অভ্যাসমূলক মুবাহ কাজকর্মে নিয়ত ছুটে যাওয়ার উপর মনের হিসাব নেওয়া :
মানুষ তার অভ্যাসমূলক মুবাহ কাজগুলোকে খুব কমই আমলে ছালেহ বা সৎ কাজে রূপান্তর করতে চেষ্টা করে। অথচ অভ্যস্ত মুবাহ কাজে সৎ নিয়ত করলে এবং আল্লাহর কাছে তার আমলের প্রতিদান লাভের সদিচ্ছা রাখলে ওই মুবাহ কাজগুলোই তখন ছওয়াবের কাজে পরিণত হয়।
عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِى وَقَّاصٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِى بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِى فِى امْرَأَتِكَ-
সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘(হে সা‘দ,) তুমি যা কিছুই ব্যয় কর না কেন, তাতে যদি তুমি আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের চেষ্টা কর তাহ’লে তুমি সেজন্য ছওয়াব পাবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে খাদ্যগ্রাস তুলে দাও সেজন্যও’।[13] সুতরাং মুসলমানের মুবাহ ও অভ্যাসমূলক কাজেও মনের হিসাব নেওয়া কর্তব্য। সে খেয়াল করবে তার ওই ধরনের কাজে নেক নিয়ত আছে কি-না যেজন্য সে ছওয়াব পাবে? আর যদি নেক নিয়ত না করে থাকে তাহ’লে বিনা ছওয়াবেই কাজটা হয়ে গেল কি-না?
মুহাসাবার সহায়ক বিষয় সমূহ
১. আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলাকে জানা :
মনের হিসাব গ্রহণের অন্যতম সহায়ক আল্লাহকে জানা। মনের মধ্যে যদি এ অনুভূতি জাগরুক থাকে যে, বান্দা আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণাধীন, তিনি তার লুকোনো বা গোপনীয় সকল বিষয় জানেন, কোন কিছুই তার নিকট অবিদিত নয়, তাহ’লে হিসাব করে আমল করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ ‘নিশ্চয়ই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমরা জানি তার অন্তর তাকে যেসব কুমন্ত্রণা দেয়। বস্ত্ততঃ আমরা গর্দানের রগের চাইতেও তার নিকটবর্তী’ (ক্বাফ ৫০/১৬)। তিনি আরও বলেন,وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا فِي أَنْفُسِكُمْ فَاحْذَرُوهُ ‘জেনে রেখ যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরের খবর রাখেন। অতএব তাঁকে ভয় কর’ (বাক্বারাহ ২/২৩৫)।
এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ছা‘আলিবী (রহঃ) বলেন, বান্দার নিজের দোষ-ত্রুটির পরিমাণ কতটুকু, তার রবের মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও অমুখাপেক্ষিতার সীমা-পরিসীমাই বা কতদূর এবং তার রব কোন কিছুর জন্য জিজ্ঞাসিত নন, অথচ তাকে প্রতি পদে পদে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে, বান্দার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত থাকলে আল্লাহর প্রতি তার ভয় জোরালো হবে। ফলে সে তখন তার রবকে সবচে বেশী ভয়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং নিজেকে ও নিজের রবকে সবচেয়ে বেশী জাননেওয়ালাদের শ্রেণীভুক্ত হবে।
অতঃপর যখন আল্লাহর মা‘রেফাত (জ্ঞান) পূর্ণতা লাভ করবে তখন তা আল্লাহভীতি ও অন্তরে জ্বলুনি-পুড়ুনি সৃষ্টি করবে। তারপর অন্তর থেকে সেই জ্বলুনির প্রভাব সারা দেহে ছড়িয়ে পড়বে। ফলশ্রুতিতে মনের কামনা-বাসনা বিদূরীত হবে এবং আল্লাহর ভয়ে তা জ্বলে-পুড়ে যাবে। মনে দেখা দেবে ভয়-ভাবনা ও অপমানিত হওয়ার চিন্তা। আল্লাহর ভয়ে বান্দা তখন পুরো পেরেশান থাকবে এবং নিজের পরকালীন পরিণাম কী দাঁড়াবে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে। তখন তার কাজ হবে শুধুই মুহাসাবা ও মুজাহাদা।
শ্বাস-প্রশ্বাস
নিতে এবং চোখের পলক নড়াতেও তার তখন ইতস্তবোধ হবে। প্রতি পদক্ষেপ ও কথায় সে
মনকে পাকড়াও করবে, কেন এটা করলে বা বললে, কিংবা কেন এটা করলে না বা বললে
না?[14]
২. কাল ক্বিয়ামতে শান্তি লাভের অনুভূতি :
ইবনুল
ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ব্যক্তি যখন এ অনুভূতি নিজের অন্তরে তাজা রাখবে যে,
আজ এ দুনিয়াতে সে যত মেহনত করবে কাল ক্বিয়ামতে অন্যের হাতে হিসাব-কিতাব চলে
যাওয়ার কালে সে বহু শান্তিতে থাকবে; কিন্তু আজ যদি সে তার জীবনের মূল্যবান
সময় অযথা নষ্ট করে তাহ’লে আগামী দিন তার জন্য হিসাব দেওয়া বড়ই কঠিন হয়ে
পড়বে, তখন এ অনুভূতি তার মনের হিসাব গ্রহণে এবং মনকে নিয়ন্ত্রণে সহায়তা
করবে।[15]
৩. ক্বিয়ামত দিবসে তার সামনে উত্থাপিত প্রশ্ন সম্পর্কে চিন্তা :
ক্বিয়ামতের দিন বান্দা কী কী প্রশ্নের মুখোমুখি হ’তে পারে তৎসম্পর্কিত চিন্তা তার মনের হিসাব গ্রহণে তাকে তৎপর করতে পারে। তাতে করে সে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করবে, সত্যের অনুসরণ করবে, বাজে কাজে সময় ব্যয় ও খেয়াল-খুশীর অনুসরণ ত্যাগ করবে এবং ফরয পালন, হারাম ত্যাগ, নফল-মুস্তাহাব বেশী বেশী আদায় আর মাকরূহ ও সন্দেহ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে বদ্ধপরিকর হবে। বান্দাকে তো ক্বিয়ামত দিবসে তার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজের হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ‘নিশ্চয়ই তোমার কর্ণ, চক্ষু ও বিবেক প্রতিটিই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৬)।
বান্দাকে আল্লাহ যত নে‘মত এ দুনিয়াতে দিয়েছেন তার শুকরিয়া সে যথাযথভাবে আদায় করেছে কি-না সে সম্পর্কে সে জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ ‘অতঃপর তোমরা অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে দেওয়া নে‘মতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (তাকাছুর ১০২/৮)।
প্রশ্ন শুধু কাফের-ফাসেকদেরই করা হবে না, বরং সৎলোক ও রাসূলদেরও করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لِيَسْأَلَ الصَّادِقِينَ عَنْ صِدْقِهِمْ ‘যাতে সত্যবাদীদেরকে তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা যায়’ (আহযাব ৩৩/৮)। মুজাহিদ (রহঃ) সত্যবাদীদের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, সত্যবাদী হ’ল তারা, যারা রাসূলগণের পক্ষ থেকে প্রচারকারী ও পৌঁছানেওয়ালা।[16] আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন, অচিরেই আল্লাহ তা‘আলা নবীদের এবং তাদের অনুসারীদের তাবলীগ বা প্রচার সংক্রান্ত এই কঠিন প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন যে, তারা প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছে এবং সত্য বলেছে, বিধায় তাদের তিনি জান্নাতুন নাঈম প্রদান করবেন, নাকি তারা কুফুরী করেছে বিধায় তাদের জ্বালাময় শাস্তি দিবেন?[17] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ ‘অতঃপর আমরা যাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল তাদেরকে এবং রাসূলগণকে অবশ্যই (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসাবাদ করব’ (আ‘রাফ ৭/৬)।
ভেবে দেখুন! যেখানে রাসূল ও সত্যবাদীরা ক্বিয়ামতের দিন প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন সেখানে অন্যদের অবস্থা কী দাঁড়াবে!
৪. প্রতিফল বা পুরস্কারের কথা জানা থাকা :
যেসব আমল করলে জাহান্নাম থেকে বাঁচা যাবে এবং জান্নাতে যাওয়া যাবে সেসব আমলকে সূরা ছফয়ে ‘তিজারত’ বা ব্যবসা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, মানুষ যখন জানবে যে, এই তিজারতের লাভ, জান্নাতুল ফিরদাউসে বসবাস ও রববুল আলামীনের দর্শন লাভ এবং এই তিজারতের লোকসান, জাহান্নামে প্রবেশ ও রববুল আলামীনের দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং এ কথার ইয়াক্বীন তার অন্তরে বদ্ধমূল হবে তখন তার জন্য আজকের জীবনের হিসাব রাখা সহজ হয়ে যাবে।
৫. ক্বিয়ামত দিবসের স্মরণ :
আমীরুল
মুমিনীন ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) আদী বিন আরতাতকে এক পত্রে লিখেছিলেন,
হে আদী, আল্লাহকে ভয় করো এবং ক্বিয়ামত দিবসে হিসাব দেওয়ার আগে নিজে নিজের
হিসাব নাও। আর স্মরণ রাখো সেই রাতকে, যে রাতের পেট চিড়ে ক্বিয়ামতের ভয়াবহ
সকাল দেখা দেবে। যেদিন ক্বিয়ামত আসবে সেদিন সূর্য নিষ্প্রভ (আলোহীন) হয়ে
যাবে, আকাশ থেকে নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে এবং মানুষ দলে দলে ভাগ হয়ে যাবে- এক
দল যাবে জান্নাতে, আর এক দল যাবে জাহান্নামে’।[18]
৬. মৃত্যুকে স্মরণ :
মা‘রূফ
কারখী (রহঃ)-এর মজলিসে এক লোক হাযির ছিল। তিনি তাকে বললেন, ‘আমাদের সাথে
যোহর ছালাত আদায় করুন’। লোকটি বলল, ‘আমি আপনাদের সাথে যোহর ছালাত আদায় করতে
পারব, কিন্তু আছর ছালাত আদায় করতে পারব না’। তখন মা‘রূফ (রহঃ) বললেন, ‘মনে
হয় যেন আপনি আছর ছালাত পর্যন্ত বেঁচে থাকার আশা করেন’! আমি লম্বা আশা পোষণ
থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি।[19]
এক
ব্যক্তি মা‘রূফ কারখী (রহঃ)-এর সামনে গীবতমূলক কথা বলল। তা শুনতে পেয়ে তিনি
তাকে বললেন, ‘তুমি সেই তুলার কথা স্মরণ কর, (মৃত্যুকালে) যা তোমার
দু’চোখের উপর রাখা হবে’।[20]
অনন্তর মানুষ যখন তার মৃত্যুর কথা স্মরণ করবে তখন তার যাবতীয় আমলের হিসাব নিজ মন থেকে নিতে পারবে এবং মনকে তার সীমার মধ্যে স্থির রাখতে পারবে।
[চলবে]
[1]. তাফসীরুল বায়যাভী, পৃ. ১২৯।
[2]. ইবনু আদী, আল-কামিল, ৫/২৯১।
[3]. মুহাসাবাতুন্নাফস, পৃ.২৩।
[4]. ইমাম আহমাদ, আয-যুহ্দ পৃ. ২৪৪।
[5]. মুহাসাবাতুন্নাফস, পৃ. ৩৭।
[6]. ঐ, পৃ. ৩৪।
[7]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান ১/৮৫।
[8]. শু‘আবুল ঈমান, হা/৩২১১।
[9]. তাবয়ীনু কিযবিল মুফতারী, পৃ. ২৬৩।
[10]. ইবনুল জাওযী, আল-মুদহিশ, পৃ. ৪৭০।
[11]. শু‘আবুল ঈমান, হা/৭২৭৯।
[12]. মুসলিম হা/২৭২৬; মিশকাত হা/২০৩১।
[13]. বুখারী হা/৫৬; ছহীহুল জামে হা/৩০৮২।
[14]. তাফসীরে ছা‘আলিবী ৪/৪১২।
[15]. ইগাছাতুল লাহফান ১/৮০।
[16]. তাফসীর ইবনু কাছীর ৩/৫৬৮।
[17]. তায়সীরুল কারীমির রাহমান, ৬৫৯ পৃ.।
[18]. তারীখু দিমাশক ৪০/৬২।
[19]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/১৬৩।
[20]. ঐ, ৮/১৬৪।