কিডনী মানবদেহের
একটি অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। যা মানবদেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিডনীর ভিতরে নেফ্রন নামক প্রায় ১০ লক্ষ ছাঁকনি থাকে। কোন কারণে কিডনীর
স্বাভাবিক কাজের ব্যাঘাত ঘটলেই মানবদেহে শুরু হয় ছন্দপতন। কিডনীর রোগের
মধ্যে রয়েছে জন্মগত ত্রুটি, হঠাৎ বা ধীরে ধীরে বিকল হয়ে যাওয়া, পাথর এবং
প্রস্রাবের সংক্রমণ ইত্যাদি। কোনভাবে কোন জীবাণু যদি মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ
করে সংক্রমণ সৃষ্টি করে, তাহ’লে সেই অবস্থাকে বলা হয় মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ
বা সংক্ষেপে ইউটিআই। এটি একটি বিব্রতকর স্বাস্থ্য সমস্যা।
কিডনীর কাজ : মানবদেহের পিঠের নীচের অংশে মেরুদন্ডের দু’পাশে দু’টি কিডনীর অবস্থান। মানবদেহে কিডনী গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। দেহের বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করে এবং বাড়তি তরল পদার্থ নিঃসরণ করে। দেহের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। দেহের প্রয়োজনীয় লবণের সমতা ঠিক রাখে। দেহে এসিড ও ক্ষারের সমতা বজায় রাখে। এক ধরনের হরমোন তৈরীর মাধ্যমে অস্থিমজ্জাকে প্রভাবিত করে শরীরে রক্ত তৈরী করে। দেহের হাড়গুলোকে সরল ও মযবূত রাখতে সাহায্য করে।
মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ : কিডনী, মূত্রথলি, মূত্রনালী এবং ইউরেটার এ চারটি অংশ নিয়ে মূত্রতন্ত্র গঠিত। মূত্রতন্ত্রের যেকোন অংশ জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হ’লে তাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই বলে। ইউরেথ্রাইটিস, সিস্টাইটিস, পায়েলোনেফ্রাইটিস প্রভৃতি প্রস্রাবের সংক্রমণের বিভিন্ন নাম। ই. কলাই নামক জীবাণু শতকরা ৭০ ভাগ প্রস্রাবের সংক্রমণের কারণ। এছাড়া অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন প্রস্রাবের নালীতে নল থাকলে ইউটিআই হ’তে পারে।
মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণের প্রকার : অবস্থান অনুযায়ী মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ তিন প্রকারের হয়ে থাকে। উপসর্গবিহীন বা অ্যাসিম্পটোমেটিক সংক্রমণ। নিম্ন মূত্রন্ত্রের সংক্রমণ, যা শুধু মূত্রথলি বা ব্লাডার এবং মূত্রনালী বা ইউরেথ্রা আক্রান্ত হয়। উপর মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ বা পায়েলোনেফ্রাইটিস। যা কিডনী নিজেই আক্রান্ত হয়।
জীবাণু যেভাবে মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে : মূত্রনালী থেকে প্রস্রাবের থলি, সেখান হ’তে ইউরেটরের মাধ্যমে জীবাণু কিডনী পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ই. কলাই জীবাণুর শতকরা ৯৫ ভাগ খাদ্যনালী বা বৃহদান্ত্রে বসবাস করে। মলত্যাগের সময় যদি কোনভাবে এ জীবাণু প্রস্রাবের নালীর সংস্পর্শে আসে, তখন এ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশী আক্রান্ত হয়।
কারণ : মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণের কারণ বহুবিধ। কারণগুলো নিম্নরূপ-
বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া (প্রায় ৯০ ভাগ) এবং কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাক বা পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়। এলার্জিজনিত কারণেও হ’তে পারে। মূত্রতন্ত্রে সংক্রমণ মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশী দেখা যায়। কারণ মেয়েদের ক্ষুত্রনালির দৈর্ঘ্য ছোট। মেয়েদের মূত্রদ্বার এবং যৌনীপথ খুব কাছাকাছি, ঋতুস্রাবের সময় অনেকে নোংরা কাপড় ব্যবহার করে। ফলে সহজেই জীবাণু যোনীপথে এবং পরে মূত্রনালীকে সংক্রমিত করে। মেয়েদের প্রস্রাব আটকে রাখার প্রবণতা বেশী। ফলে সহজেই সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। যারা পানি কম পান করে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী। ষাটোর্ধ্ব বয়স, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
যাদের হয় : পুরুষের তুলনায় নারীদের ইউটিআই ৪ গুণ বেশী হয়। সাধারণত ১৫-৬০ বছরের নারীরা বেশী ভোগেন, গড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী বিশেষ করে যৌন সক্রিয় বয়সে ইউটিআই এ আক্রান্ত হয়। মূত্রনালীতে জন্মগত ত্রুটি মূত্রনালির ভাল্ব, ব্লাডার নেক অবস্ট্রাকশন ইত্যাদির কারণে শৈশবে ছেলেদের এ রোগ হয়। এ বয়সে উপসর্গবিহীন জীবাণুর নিঃসরণ ঘটে। এছাড়া স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের মধ্যেও এ রোগের প্রকোপ দেখা যায়। এক্ষেত্রে উপসর্গবিহীন সংক্রমণ হয়। সচেতন না হ’লে বিয়ের পর এবং গর্ভাবস্থায় ক্রনিক রূপ নিতে পারে। চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষের প্রস্টেটগ্ল্যান্ড বড় হয়ে প্রস্রাবে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে এ রোগ আক্রান্ত হয়। গর্ভাবস্থায় ৫ শতাংশ নারী উপসর্গবিহীন নিঃসরণে ভোগে, যাদের ১৫-৫০ শতাংশের মধ্যে পায়েলোনেফ্রাইটিসের ঝুঁকি থাকে। গর্ভাবস্থায় এ রোগ মা ও শিশুর জন্য হুমকিস্বরূপ। এতে প্রিম্যাচিউরড বাচ্চা প্রসব, নবজাত শিশুর মৃত্যু, ষ্টিলবার্থ, অ্যাবরশন ইত্যাদি বেশী হয়। আবার গর্ভবতীর উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি এক্লাম্পটিক টক্সিমিয়া হ’তে পারে।
লক্ষণ : ইউটিআই এর বেশী কিছু লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। তবে সংক্রমণের উপসর্গ আক্রমণের স্থানভেদ ভিন্নতর। যেমন প্রসাবের জ্বালাপোড়া ও ঘন ঘন প্রস্রাব। প্রসাবের সময় ব্যথা অনুভব হওয়া। প্রস্রাবের বেগ বেশী অথচ কম প্রস্রাব ত্যাগ। প্রস্রাবের পরও প্রস্রাব করার ইচ্ছা। তলপেটে ব্যথা এবং ভার ভার বোধ। ঘন ফেনার মত দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব ত্যাগ। প্রস্রাবের রং ঝাপসা বা লালচে। ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব ত্যাগ, অনেক সময় রক্ত যাওয়া। দুর্বলতা, খাবারে অরুচিভাব। বারবার জ্বর হওয়া। শিশু বিছানায় প্রস্রাব ত্যাগ এবং যথাযথ না বেড়ে ওঠা। পেটের রোগ যেমন অজীর্ণ, ডায়রিয়া ইত্যাদি।
জটিলতা : ইউটিআই এর বিরক্তিকর দিক হ’ল পুনরাগমন বা বারবার সংক্রমণ। যখন বারবার একই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন পুনরাগমন রিকারেন্সকে রিলাপ্স বলে। সংক্রমণ রক্তে প্রবেশ চার সেপসিস এবং ক্ষেত্রবিশেষে জীবনসংহারী সেপটিসিমিয়া হ’তে পারে। এ অবস্থা অত্যন্ত মারাত্মক। যা সঠিক চিকিৎসা না করালে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা : রোগ নির্ণয়ের জন্য নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলো করা যেতে পারে। প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা, প্রস্রাবের কালচার, রক্তের সেরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা, তলপেটের আন্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা, মূত্রনালীর রস পরীক্ষা, সিস্টোস্কপি ইত্যাদি।
চিকিৎসা : ইউটিআই আসলে খুব সাধারণ রোগ। চিকিৎসকেরা উপযুক্ত রোগের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করলে এ রোগ থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এ সময়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং প্রচুর পরিমাণে পানি বা তরল জিনিস পান করতে হবে। হোমিওপ্যাথিক উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি। তাই সঠিক সময়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিলে এ রোগ হ’তে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও প্রচুর পানি পান করে জীবাণুগুলোকে বিধৌত করে বের করে দিতে হবে। বার বার প্রস্রাব করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ক্র্যানবেরি জুস খাওয়া যেতে পারে। বেশী সময় প্রস্রাবের বেগ ধরে রাখা যাবে না।
প্রতিরোধ : যে কোন রোগ প্রতিরোধ হ’ল সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা। সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন নিয়মিত ও পরিমিত পানি পান করা। সকালে ঘুম হ’তে উঠে খালি পেটে পানি পানের অভ্যাস গড়ে তোলা। প্রস্রাব আটকে না রাখা। যখনই বেগ আসে তখনই প্রস্রাব করা। র্ক্যানবেরী জুস খেলে মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ কমে যায়, তা খাওয়ার অভ্যাস করা। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাথরুম ব্যবহারের পর টয়লেট টিস্যু পেছন হ’তে সামনের দিকে না এনে, সম্মুখ হ’তে পিছনের দিকে ব্যবহার করতে হবে, যাতে করে মলদ্বারের জীবাণু মূত্রপথে এসে সংক্রমণ না করতে পারে। মূত্রত্যাগের পর যথেষ্ট পানি ব্যবহার করতে হবে। শারীরিকভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সহবাসের পূর্বে প্রস্রাব করতে হবে। এতে মূত্রনালিতে আসা সব জীবাণু পরিস্কার হয়। স্যানিটারী প্যাড ঘন ঘন বদলিয়ে নেওয়া। মেয়েদের ডিওডারেন্ট ব্যবহার না করাই উত্তম। এগুলো ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করে। মুসলমানি করানো হ’লে সংক্রমণ হ’তে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। খুব আটসাট অন্তর্বাস না পরা। সুতী অন্তর্বাস পরিধান করা উত্তম। \ সংকলিত \