একটি চমৎকার স্বাদের মৌসুমি ফল
তরমুজ। পানিতে ভরা থাকে বলেই হয়তো এই ফলটির ইংরেজি নাম Water melon। তরমুজ
মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার ফল। তবে বর্তমানে তরমুজ বাংলাদেশের নিজস্ব মৌসুমি ফলে
পরিণত হয়েছে। তরমুজের ভাল ফলন হয় চরাঞ্চল এবং নদী সংলগ্ন চরের বেলে মাটি
বা পলি মাটিতে। তরমুজ ভাল উৎপাদনের জন্য শুকনো আবহাওয়া এবং প্রচুর রোদ
প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের সর্বত্রই তরমুজ পাওয়া যায়। তবে তরমুজের বেশি চাষ হয়
চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও যশোর যেলায়। এক সময়
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা তরমুজের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেশজুড়ে পতেঙ্গার তরমুজের
আলাদা একটা খ্যাতি ছিল।
তরমুজ বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি ফল। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই তিন মাসে বাজারে প্রচুর পরিমাণে তরমুজ পাওয়া যায়। মজাদার এই ফলটির ঔষধি গুণ অনেক। তরমুজের বহু ধরনের ঔষধি গুণের মধ্যে কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হ’ল-
(ক) তরমুজে প্রচুর পরিমাণ লাইকোপিন পাওয়া যায়। লাইকোপিন হচ্ছে একটি লাল বর্ণ, হরিদ্রাবর্ণ রঞ্জক বিশেষ যা টমেটো এবং বীজশূন্য ক্ষুদ্র রসালো ফলে এবং অন্যান্য ফলে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানব শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী লাইকোপিন গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি ফল তরমুজে টমেটোর চেয়ে চল্লিশ গুণ বেশি।
লাইকোপিনের উপকারিতা : মানুষের শরীরে ফ্রি-র্যাডিকেলস বা এক ধরনের মুক্ত রাসায়নিক কণা উৎপন্ন হয়, যা ত্বকের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট করে দেয় এবং শরীরের চামড়ায় ভাঁজ ফেলে দেয়। ফলে অল্প বয়সেই মানুষকে বৃদ্ধ দেখায়। এই মুক্ত রাসায়নিক কণা মানব শরীরে বিভিন্ন ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ তৈরিতে সাহায্য করে। লাইকোপিন নামক এই রঞ্জক মানব শরীরে নানাভাবে উৎপন্ন ফ্রি-র্যাডিকেলস বা মুক্ত রাসায়নিক কণাগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে নানাবিধ শারীরিক জটিলতা ও রোগ থেকে মানুষ রক্ষা পায়। লাইকোপিন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। এটি রক্ত থেকে প্রস্টেট স্পেসিফিক এন্টিজেন কমিয়ে দেয়। ফলে প্রস্টেট বৃদ্ধি ও প্রস্টেট ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমে যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রায় ৬০ শতাংশ প্রস্টেট ক্যান্সার লাইকোপিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। এছাড়া লাইকোপিন ফুসফুস, পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, মুখগহবর, রেক্টাম, শরীরের চামড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে। বিশেষ করে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ নানাবিধ জটিলতার প্রায় ৮০ শতাংশই লাইকোপিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। ফিনল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, লাইকোপিন হৃদপিন্ডের রক্তবাহী নালীতে চর্বি জমতে দেয় না, এর ফলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমে যায়। চোখের অন্ধত্ব নিবারণেও লাইকোপিন গুরুত্বপূর্ণ।
মহিলাদের জন্য তরমুজ আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ। তরমুজের উপাদান লাইকোপিন মহিলাদের স্তন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা বিশেষ করে খিঁচুনি থেকে রক্ষা করে থাকে। যাদের শরীরের রক্তে লাইকোপিনের পরিমাণ বেশি, তারা অন্যদের চেয়ে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য ও নীরোগ জীবন-যাপন করে থাকেন।
(খ) লাইকোপিন ছাড়াও তরমুজে প্রচুর পরিমাণ শর্করা, প্রোটিন, কার্বো হাইড্রেড, পানি, প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি ইত্যাদি পাওয়া যায়। অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রমের কারণে যারা ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েন, তাদের জন্য তরমুজের শরবত খুবই উপকারী। তরমুজের শরবত পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি ও দুর্বলতা দূর করে।
(গ) ঘন ঘন পিপাসা রোধে তরমুজ অধিক কার্যকরী। যাদের ঘন ঘন পিপাসা পায়, বিশেষ করে হৃদরোগের কারণে ঘন ঘন ও অধিক পিপাসা নিবারণে কিছুদিন তরমুজের শরবত পান করলে ভাল উপকার পাওয়া যায়।
(ঘ) তরমুজের শরবত টাইফয়েড জ্বরের তীব্রতা কমায় এবং জ্বর পরবর্তী অস্থিরতা ও ক্লান্তি দূর করে।
(ঙ) যারা রোদে কাজ করেন, বিভিন্ন কারণে রোদে সময় কাটাতে হয়, যাদের রোদ্রের তাপজনিত ডিহাইড্রেশন হয়, তা কাটাতে তরমুজের শরবত বেশ ফলপ্রদ।
(চ) পুরুষের বন্ধ্যাত্ব ঘোচাতে তরমুজের বীজ বেশ উপকারী।
তরমুজের পুষ্টিগুণ : প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তরমুজে আছে ৯২ থেকে ৯৫ গ্রাম পানি, আঁশ ০.২ গ্রাম, আমিষ ০.৫ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, ক্যালোরি ১৫ থেকে ১৬ মি. গ্রাম। এছাড়াও তরমুজে ক্যালসিয়াম রয়েছে ১০ মি. গ্রাম, আয়রন ৭.৯ মি. গ্রাম, কার্বহাইড্রেট ৩.৫ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.২ গ্রাম, ফসফরাস ১২ মি. গ্রাম, নিয়াসিন ০.২ মি. গ্রাম, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ও ভিটামিন বি২।
পাকা তরমুজ চেনার উপায় : পাকা তরমুজ হাতে তুলে নিলে সাইজের তুলনায় অধিক ভারী অনুভূত হবে এবং নাকের কাছে নিলে এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাবে।
সতর্কতা : তরমুজ যদিও রোদে ভাল জন্মে, তবে পাকা তরমুজ সর্বদা ঠান্ডা স্থানে রাখা উত্তম। গরমে, তাপে তরমুজের উপাদান আয়রণ নষ্ট হয়ে যায়। তরমুজ কেটে বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়। তাতে তরমুজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভিটামিন-সি নষ্ট হয়ে যায়।
\ সংকলিত \