সম্প্রতি একটি বিতর্ক স্বয়ং সালাফী আক্বীদার কিছু অনুসারীর মধ্যে মাথা চাড়া দিয়েছে। তারা মনে করে থাকেন যে, সালাফী বা আহলেহাদীছ নামকরণ করা বিদ‘আত। কেননা রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগে এ নামের কোন অস্তিত্ব ছিল না। আর আল্লাহ তা‘আলা সূরা হজ্জের ৭৮ নং আয়াতে বলেছেন, ‘আর তিনি পূর্বেই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম’। বিতর্কটি যে একেবারে সর্বসাম্প্রতিক, তা নয়। বরং যুগশ্রেষ্ঠ মুহাক্কিক আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯ ইং)-কেও একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। প্রখ্যাত মিসরীয় বিদ্বান ও ‘রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে নারী স্বাধীনতা’ গ্রন্থের রচয়িতা আব্দুল হালীম আবু শুক্কাহ (১৯২৪-১৯৯৫ ইং)-এর সাথে তাঁর এ বিষয়ে একটি চিত্তাকর্ষক সংলাপ রয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল।-

আলবানী : (হে আবু শুক্কাহ!) তোমাকে যদি বলা হয় যে, তোমার মাযহাব কী? তখন তুমি কি জবাব দিবে?

আবু শুক্কাহ : বলব- আমি মুসলিম।

আলবানী : কিন্তু এটা তো যথেষ্ট নয়!

আবু শুক্কাহ : কেন? আল্লাহ তো আমাদের মুসলিম হিসাবে নামকরণ করেছেন।

আলবানী : এ জবাব সঠিক হ’ত যদি আমরা ইসলামের প্রথম যুগে অবস্থান করতাম। যখন বিভিন্ন মতবাদের প্রসার ঘটেনি। আর যে মতবাদগুলির সাথে আমাদের মৌলিক আক্বীদাগত মতপার্থক্য রয়েছে, যদি আমরা তাদেরকে এই প্রশ্ন করি (তোমার মাযহাব কি?), তাদের জবাবও কিন্তু একই হবে। শী‘আ, রাফেযী, খারেজী, দ্রুযী, নুছায়রী, আলাবী সবাই বলবে ‘আমি মুসলিম’। অতএব আজকের দিনে কেবল মুসলিম বলাই যথেষ্ট নয়।

আবু শুক্কাহ : ঠিক আছে। তাহ’লে আমি বলব- আমি কিতাব ও সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিম।

আলবানী : এটাও তো যথেষ্ট নয়!

আবু শুক্কাহ : কেন?

আলবানী : শী‘আ, রাফেযী সহ যাদের কথা আমরা উদাহরণ স্বরূপ বললাম তাদের কেউ কি বলে যে, আমি মুসলিম, তবে কিতাব ও সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত নই? কেউ কি বলে যে, আমি কিতাব ও সুন্নাহ অনুযায়ী চলি না?

(অতঃপর তিনি ‘সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কিতাব ও সুন্নাহর অনুসরণ’-এর গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলেন)

আবু শুক্কাহ : ঠিক আছে। আমি সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারী মুসলিম।

আলবানী : কেউ তোমার মাযহাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তুমি কি তাকে একথাই বলবে?

আবু শুক্কাহ : হ্যাঁ।

আলবানী : আচ্ছা আমরা যদি এর ভাষাগত সংক্ষেপায়ন করে ‘সালাফী’ বলি। সেক্ষেত্রে তোমার মতামত কী? কেননা সর্বোত্তম বাক্য তো সেটাই, যেটা সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ।

আবু শুক্কাহ : আমি আপনার প্রতি ভদ্রতা প্রদর্শনের খাতিরে ‘হ্যাঁ’ বলছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস পূর্বের মতই। কারণ যখনই কোন মানুষ শুনবে যে আপনি সালাফী, তখনই তাঁর চিন্তাধারা ঘুরে যাবে কঠোরতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাওয়া এমন অনেক অনুসৃত বিষয়ের দিকে, যার মধ্যে সালাফীগণ ডুবে আছেন।

আলবানী : ধরে নিলাম তোমার কথাই সঠিক। কিন্তু যদি তুমি নিজেকে মুসলিমও বল, তবে কি সেটা শী‘আ রাফেযী, দ্রুযী বা ইসমাঈলীর দিকেও প্রত্যাবর্তিত হবে না?

আবু শুক্কাহ : হ’তে পারে। তবে আমি কুরআনের ঐ আয়াতেরই অনুসরণ করতে চাই- ‘আর তিনি পূর্বেই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিম’ (হজ্জ ২২/৭৮)

আলবানী : না হে ভাই! তুমি এই আয়াতের অনুসরণ করনি। কেননা আয়াতটি দ্বারা সঠিক ও বিশুদ্ধ ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া মানুষকে সম্বোধন করা উচিত তার জ্ঞানের পরিমাপ বুঝে। অথচ তোমার এই ‘মুসলিম’ পরিচয় দানের মাধ্যমে তুমি আয়াতটিতে উদ্দেশ্যকৃত মুসলিম কি-না তা কি কেউ বুঝবে?

ইতিপূর্বে সালাফী বলার ক্ষেত্রে তুমি যে ভীতিসমূহের কথা উল্লেখ করলে, সেটা সঠিক হ’তে পারে বা অন্য কিছুও হতে পারে। কেননা সালাফীদের কঠোরতার ব্যাপারে তোমার যে বক্তব্য, তা কোন কোন সালাফীর মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা সালাফীদের আক্বীদা ও জ্ঞানগত মানহাজ নয়। তুমি ব্যক্তির কথা ছেড়ে দাও। আমরা এখন কথা বলব মানহাজ নিয়ে। কেননা আমরা যদি শী‘আ, দ্রুযী, খারেজী, ছূফী বা মু‘তাযেলীদের কথা বলি, তাহলে সেখানেও কিন্তু তুমি যে ভীতির কথা বলছ, তা ফিরে আসবে।

অতএব এটা আমাদের বিষয় নয়। বরং আমরা এমন একটি নাম খুঁজব, যা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল মাযহাবের দিকে নির্দেশ করে।

অতঃপর আলবানী বলেন, আচ্ছা ছাহাবায়ে কেরামের সবাই কি মুসলিম ছিলেন না?

আবু শুক্কাহ : অবশ্যই।

আলবানী : কিন্তু তাদের মধ্যেও এমন কেউ ছিলেন যিনি চুরি করেছেন, যেনা করেছেন। তবু তাদের কেউ কিন্তু একথা বলার অনুমতি দেননি যে, আমি মুসলিম ছিলাম না। বরং সে মানহাজ বা নীতিগতভাবে মুসলিম এবং আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসী। কিন্তু সে কখনো স্বীয় নীতির বিপরীত করে ফেলেছে। কেননা সে তো নিষ্পাপ নয়।

এজন্যই আমরা এমন একটি শব্দ সম্পর্কে কথা বলছি, যা আমাদের আক্বীদা, চিন্তাধারা এবং যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর ইবাদত করি এরূপ দ্বীন সংশ্লিষ্ট জীবনের সকল বিষয়কে নির্দেশ করবে। তবে যারা চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী, তাদের বিষয়টি আলাদা।

অতঃপর আলবানী বলেন, আমি চাই যে তুমি ‘সালাফী’ নামক সংক্ষিপ্ত এই শব্দটি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা কর, যাতে তোমার মধ্যে ‘মুসলিম’ শব্দ নিয়ে আর যিদ না থাকে। কেননা তুমি জান যে, মুসলিম শব্দ দ্বারা তুমি যা বুঝাতে চাচ্ছ, তা বোঝার মত কখনই কাউকে পাওয়া যাবে না। সুতরাং মানুষের সাথে তাদের জ্ঞান মোতাবেক কথা বল। আল্লাহ তোমাকে বিষয়টি মেনে নেওয়ার জন্য (তোমার চিন্তায়) বরকত দিন [গৃহীত : সালীম বিন ঈদ আল-হেলালী, লিমাযা ইখতারতুল মানহাজাস সালাফী? (জর্দান : দারু আহলিল হাদীছ, ১ম প্রকাশ ১৯৯৯/১৪১৯), পৃঃ ৩৬-৩৮)]

শিক্ষা : আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা ‘মানুষ’। তাই অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে নিজের পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের মানুষই বলতে হবে। অতঃপর ধর্মীয় ক্ষেত্রে আমাদের পরিচয় হ’ল আমরা ‘মুসলিম’। তাই কাফির তথা অমুসলিমদের মাঝে পরিচয় দানের ক্ষেত্রে আমাদের ‘মুসলিম’ বলতে হবে।

অর্থাৎ বিভিন্ন জাতের পশু আছে বলেই আমরা মানুষ। জড়বস্ত্ত আছে বলেই আমরা জীব, অমুসলিম আছে বলেই আমরা মুসলিম। অতঃপর মুসলমানদের মধ্যে বাতিল মতবাদের প্রসার ঘটায় আমাদের বৈশিষ্ট্যগত পরিচয় হবে  ‘আহলেহাদীছ’ বা ‘সালাফী’। কেননা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকৃত অনুসরণ, শিরক ও বিদ‘আত মুক্ত জীবন-যাপন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে একমাত্র অনুসরণীয় হিসাবে পরিগ্রহণকারী ব্যক্তির নাম হিসাবে সালাফে ছালেহীনের যুগ থেকে অদ্যাবধি এই দু’টি নামই বিশ্বময় পরিচিত ও অনুশীলিত। অতএব বৈশিষ্ট্যগত এই নামে পরিচয়দানে আপত্তির কোন সুযোগ নেই।

যেদিন দুনিয়ায় শী‘আ, রাফেযী, খারেজী, দ্রুযী, ছূফী, ব্রেলভীদের ন্যায় ফেরক্বাগুলি থাকবে না। সকলেই কুরআন ও ছহীহ সুন্না্র অনুসারী প্রকৃত মুসলিম হয়ে যাবে, সেদিন কাউকে আর আলাদা করে আহলেহাদীছ বলার প্রয়োজন থাকবে না। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!








আরও
আরও
.