বড় ছাহেব এক আজীব ব্যক্তি। বাজার-ঘাট করা তার মোটেই সয়না। যদিও পসন্দ মত জিনিস তার চাই। শত মানুষের ভিড়ের মাঝে দরকষাকষি করা তার পক্ষে অসম্ভব। কাজের লোক ছুটিতে। তাই কি আর করা? বেঁচে থাকার জন্য খেতে তো হবেই। অগত্যা বড় ছাহেব লাল রঙের চটের ব্যাগ নিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চললেন বটতলায় গ্রাম্য হাটে।

পাঞ্জাবী পরা তার বড় শখ। যদিও অফিস করেন শার্ট-প্যান্ট পরে। আজ শখ মেটাতেই পাঞ্জাবী পরেছেন। সেজেগুজে নতুন দুলার মত চললেন বাজারে। প্রবেশ করে নযর বুলালেন সাজিয়ে রাখা নানা রকম শাক-সবজির দিকে। নযরকাড়া পাকা লাল টমেটো হাতে নিয়ে যেই না দাম ঠিক করছেন, ইত্যবসরে অনুভব করলেন কে যেন তার পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিয়ে ফাঁকা করে দিচ্ছে। অমনি হাত চেপে ধরলেন। দেখা গেল, বার তের বছরের ফুটফুটে চেহারার সুদর্শন একটি ছেলে। তিনি ছেলেটার হাত শক্ত করে ধরলেন। যাতে পালাতে না পারে।

খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলেন, এখন যদি পকেটমার বলে চিৎকার দেই সাথে সাথে কাম শেষ! অর্থাৎ এই অল্প বয়সের ছেলেটি গণপিটুনিতে হয়তো চিরবিদায় নেবে সুন্দর বসুন্ধরা থেকে। তাই তিনি কৌশল করে বাজারের উত্তর পার্শ্বের এক চায়ের দোকানের আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই চুরি করছিস কেন? বোবার ন্যায় ছেলেটি বড় ছাহেবের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে রইল। বড় ছাহেবের বুঝতে বাকি থাকল না যে, চুরি করা তার স্বভাব বা পেশা নয়। বাধ্য হয়ে সে চুরি করছে। হাত ছেড়ে তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেটি দৌড়ে পালিয়ে যায় কি-না এদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে একেবারে কাতর কন্ঠে বলল, তার নাম কলি। প্রকৃত নাম আব্দুল বারী। ছোট বেলায় বাবা আদর করে কলি বলে ডাকতেন। ছয়-সাত বছর বয়সে কঠিন রোগে মা মারা যাওয়ার পর মধ্যবয়সী বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ মা আমাকে দেখতে পারত না। কারণে অকারণে মারধর করত। গাল-মন্দ তো আছেই। এরই মাঝে বাবা মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হ’লে সৎ মা অসুস্থ বাবাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।

ইতিমধ্যে বাবার কথা স্মরণ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল কলি। বড় ছাহেব বুঝতে পারলেন যে, তার ধারণা সত্যি হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় থাকিস? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কলি বলল, কোথায় আর থাকব? বাবা মারা যাওয়ার পর খুলনা সার্কিট হাউসের নিকটে চাচার বাসায় থাকতাম। সেখানে থাকাটাও নিরাপদ হয়নি। চাচিও অনেকটা সৎ মায়ের মত খারাপ আচরণ করত। এমনকি মাঝে-মধ্যে শারীরিক নির্যাতনও করত।

হঠাৎ একদিন বাসায় বিকট চিৎকার শোনা গেল। কি হয়েছে জানতে চাইলে অমনি চাচি মারধর শুরু করলেন। চাচির স্বর্ণের গহনা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ অপরাধের গ্লানি চাপানো হ’ল আমার স্কন্দে। যদিও বাসা থেকে বের করার জন্য এটা ছিল চাচির পূর্ব পরিকল্পিত কৌশল মাত্র। চাচা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ঘটনা যাচাই না করে চাচির কানকথা শুনেই শুরু করে আমার উপর অমানষিক নির্যাতন। এমনকি র‌্যাবের হাতে তুলে দিবে বলে পরিকল্পনা নেয়। একদিকে শারীরিক নির্যাতন, অপরদিকে র‌্যাবের কথা শুনে ভয়ে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে পাশের রেলওয়ে স্টেশনে আশ্রয় নেই। রাতে সেখানেই থাকি। আজ তিনদিন কিছু খেতে পাচ্ছি না। তাই ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে নিরুপায় হয়ে আপনার পকেটে...

যাদের অর্থ-সম্পদ বেশী তারা স্বাভাবিকভাবে কঠিন হৃদয়ের হয়ে থাকে। গরীব মানুষ ও ইয়াতীম-অসহায়দের দেখতে পারে না। আবার ফকীর-মিসকীনকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু বড় ছাহেব ভিন্ন মনের মানুষ। কলির কথায় তার মায়া হ’ল। ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মন খারাপ কর না। আল্লাহর উপর ভরসা কর। সকল সমস্যার সমাধান তিনিই করতে পারেন।

বড় ছাহেব খানিকটা কলির চাচার উপর রেগে গেলেন। কাছে পেলে হয়তো কোন ধরনের অঘটন ঘটে যেতো। তিনি বললেন, এমন দুরাচার মানুষের সংখ্যা কম নয়। এরাই পৃথিবীটাকে আবর্জনার স্তূপে পরিণত করেছে। প্রকৃত মানুষের স্বভাব তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। কলির মত এমন কোমলমতি ছেলেদেরকে দিয়ে কেউ অবৈধ ব্যবসা করছে। কেউবা বাসায় পশুর মত খাটাচ্ছে। আবার কেউ মিথ্যা আশ্রয়ের কথা দেখিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এসবই আইন বহির্ভূত। কিন্তু কে দেখে আইনের দিকে? শুধু কলি নয়, কত হাযারো কলি এসকল অবৈধ কর্মকান্ডের অসহায় শিকার।

বড় ছাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি করবি? কলি চুপ করে থাকল। বড় ছাহেব বললেন, সমুদ্রের মাছ ও বন্য প্রাণী যদি উদরপূর্তি করে খেয়ে বেঁচে থাকে, আশরাফুল মাখলূকাত মানুষ হয়ে তুই অনাহারে মরবি কেন? তোকে আল্লাহ যখন সৃষ্টি করেছেন তোর রিযিকের ব্যবস্থাও করবেন। চুরি করবি না। চুরি করা ভাল নয়। চোরকে সমাজের কেউ ভালবাসে না। সব কথাই কলি মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছে। আর মনের মাঝে রঙিন স্বপ্ন দেখছে। বড় ছাহেব বললেন, চুপ করে না থেকে আমার সাথে চল। আমি তোর খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি পড়ালেখা করার ব্যবস্থাও করব। তোর মত দু’চার জন কলি আমার এখানে থাকলে ও খাইলে কোন কিছুর অভাব হবে না। আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট সম্পদ দিয়েছেন। বড় ছাহেব তাকে নিজ বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তীতে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।

শিক্ষা : অনাথ-ইয়াতীম, অসহায় শিশুদের প্রতি রূঢ ও কঠোর হওয়ার কোন বুদ্ধিমান মানুষের কর্তব্য নয়। তাছাড়া তাদেরকে বিভিন্ন কষ্টকর কাজে বাধ্য করা এবং তাদেরকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা মহা অন্যায়। এসব কাজ থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে। সাথে সাথে তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে দেওয়া অশেষ ছওয়াবের কাজ ও জান্নাত লাভের মাধ্যম। সুতরাং এ কাজে ব্রতী হওয়ার জন্য আল্লাহ সকলকে তাওফীক্ব দিন- আমীন!

শেখ হাফীযুল ইসলাম

দুর্গাপুর, বোয়ালমারী, ফরিদপুর।






আরও
আরও
.