প্রতিদিনের মতো আজও রেলস্টেশনের প্লাটফর্ম লাগোয়া ফাঁকা জায়গায় ট্রেনের জন্য প্রতীক্ষা করছি। এই সময়টায় ঢাকা অভিমুখী জয়দেবপুর থেকে তুরাগ এবং নরসিংদীর দিক থেকে তিতাস কমিউটার ট্রেন টংগী জংশনে সামান্য সময়ের ব্যবধানে আগ-পিছে আগমন করে। যেহেতু দু’টো ট্রেনের গন্তব্যই কমলাপুর, তাই কর্মক্ষেত্র, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে ঢাকামুখী মানুষের ভিড় থাকে।

পায়চারী করছি আর হাতে রাখা তাসবীহ দানার মালা থেকে একটা একটা করে গুণে গুণে যিকর করছি। এক ভাই এসে সালাম দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই যদি অনুমতি দেন আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি। বললাম, জ্বী ভাই বলেন, কোন সমস্যা নেই। ছোট্ট ছোট্ট কথায় কোথায় থাকি, কি করি, কোথায় যাব জিজ্ঞেস করছেন। আমিও কেন জানি সুবোধ বালকের মতই উত্তর দিচ্ছি। লোকটি আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। প্রায় প্রতিদিনই ট্রেনে যাতায়াত করি। কিন্তু তার সাথে ইতিপূর্বে কখনো দেখা হয়নি। কথার ফাঁকে বললেন, ভাই আপনি পায়চারী করতে করতে তাসবীহ মালা নিয়ে যেভাবে যিকর করছেন তা তো ইসলামের নিয়মে হচ্ছে না। উপরন্তু এই পদ্ধতিতে গুনাহ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। সবার সামনে পায়চারী করছেন আর হাতে মালা নিয়ে ঘুরছেন তাতে কি আপনার ভিতরে একটা অহংকার সৃষ্টি হচ্ছে না! যে, আপনি যিকর করছেন আর অন্যরা অহেতুক বিষয় নিয়ে আলাপচারিতায় মত্ত? কথাগুলো শুনছি আর ভাবছি ঠিকই তো বলছেন। কিন্তু মসজিদের ইমাম ছাহেব ও অন্যরাও তো এভাবেই যিকর করে; তারা কি না বুঝেই করে? ভাবছি তবে মুখ ফুটে বলছি না, দেখি তিনি কতদূর এগোতে পারেন। তাসবীহ দানার মাধ্যমে যিকর করা বিদ‘আত। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ কখনোই এভাবে যিকর করেননি। কোন যন্ত্র বা বস্ত্ত দ্বারা তাসবীহ গণনা করা যাবে না। বরং আঙ্গুল দ্বারা গণনা করতে হবে। গণনায় ভুল হ’লে আল্লাহ ক্ষমা করবেন। রাসূল (ছাঃ) আঙ্গুলে তাসবীহ গণনা করতে আদেশ করেছেন। কেননা ক্বিয়ামতের দিন আঙ্গুলগুলো কথা বলবে (আবূদাঊদ হা/১৫০১)। ট্রেন চলে আসায় কথায় ব্যাঘাত ঘটলো। দু’জন একই কামরায় উঠলাম। জানলাম, এখন থেকে তিনি ট্রেনে যাতায়াত করবেন। অবশ্য মাঝপথে তেজগাঁও নামবেন। আমার গন্তব্য অবশ্য টংগী থেকে কমলাপুর। প্রথম সাক্ষাতে পরিচয়, কিছু কথা, এরপর মোবাইল নম্বর আদান প্রদান হ’ল।

এরপর থেকে প্রায় দিনই এক সাথে আসা-যাওয়া করি। ট্রেনে বসে কথার ফাঁকে বাদাম, চিপস জাতীয় খাবারও আস্বাদন করা হয়। অধিকাংশ সময় তিনিই ফোন দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। মাসখানেক পর একদিন বললেন, ভাই আপনাকে একটা বই দিব। তবে শর্ত হচ্ছে পুরো বই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে। পরদিন সকালে একটি বই দিলেন। বইয়ের নাম ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ লেখক- মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। বইয়ের মূল্য দেখে বললাম, একশত টাকা দাম? কিন্তু তিনি বললেন, ভাই, বইয়ের দাম আপনাকে দিতে হবে না। আপনি বইটা পড়ুন। ঠিক আছে বলে ব্যাগে রেখে দিলাম।

সপ্তাহখানেক পর জিজ্ঞেস করলেন, বইটা কি পড়ছেন ভাই? কিছুটা অপরাধী ভঙ্গিতে এড়িয়ে গেলাম। আসলে মার্কেটিং-এর ছোট্ট চাকুরী, পরিবার এসব নিয়ে ব্যস্ততার কারণে পড়ার সময় হয়ে উঠেনি। উনার প্রশ্নের ভয়ে হ’লেও সেদিন থেকে পড়া শুরু করলাম। বইটা ব্যাগেই রাখি যাতে ট্রেনে যাতায়াতের সময়টাতে অন্তত পড়া যায়। সময় গড়িয়ে যায়। তিনি মাঝে মাঝে কিছু বক্তব্যও আমার ফোনে শেয়ার করেন। সেগুলোও শুনতে থাকি। আরো প্রায় মাসখানেক পর একদিন আমি ট্রেনে বসে ছালাত শেষ করেই ফিরে দেখি, ঐ ভাইটি দাঁড়িয়ে আমার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছেন। বললাম, ভাই এভাবেই ছালাত আদায় করা সঠিক। মহান আল্লাহর রহমতে এই বইটা আমার ছালাত পুরো সংশোধন করে দিয়েছে। যত পড়ছি ততই বিস্মিত হয়েছি। এটা যে সঠিক আমার কাছে দলীল-প্রমাণ দেখে তাই মনে হয়েছে। আসলে সহযাত্রী ভাই তখন দেখছিলেন, আমি বুকে হাত বেঁধে, রাফঊল ইয়াদায়েন করে ছালাত আদায় করছি। তারপর থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হ’ত। বাড়িওয়ালা হজ্জ থেকে এসে ছোট্ট একটা বই দিয়েছিলেন অনেক পূর্বে তবে পড়া হয়নি। চলমান অনুভূতির তোড়ে ঐ বইটাও একদিন পড়লাম। সহযাত্রী ভাই যেসব কথা বলেন তার সাথে বইয়ের কথাগুলোও হুবহু মিলে যায়। ফলে বিশ্বাসটা আরো দৃঢ় হয়। পরবর্তীতে তিনি আরো বক্তব্যের রেকডিং ও বই দেন। কিছু বই আমিও ক্রয় করে পড়তে থাকি। অধিকাংশ বই ছিল হাদীছ ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত। বাসায় ছিফাত ও মাহিমের আম্মুকে (স্ত্রী) যখন দাওয়াত দেই প্রথম দিকে সে বিব্রতবোধ করে। তবে মহান আল্লাহর রহমতে আমার প্রচেষ্টায় ও সে শিক্ষিত হওয়ায় বইটি পড়ে খুব দ্রুতই বিষয়টি বুঝে নিতে সক্ষম হয়। এ বিষয়ে দু’জনের ঐক্যমতের কারণে আমাকে আর বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। উপরন্তু দুই ছেলেকে নিয়ে যখন মসজিদে ছালাত আদায় করি, বাপ-বেটাদের ছালাত দেখে অনেকেই বিস্ময় বোধ করেন। পুরনো সাথীগণ বিব্রত হ’লেও মেনে নিয়েছেন। এক ইমাম ছাহেবকে বই দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি দলীল ভিত্তিক আলোচনা দেখে বললেন, এটা ঠিক আছে। আমাদেরটাও ঠিক!

ইতিমধ্যে প্রতি বৎসরের ন্যায় ঐ বৎসরেও টংগীতে বিশ্ব ইজতেমার দিনক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। ইজতেমা উপলক্ষে কয়েকদিন পূর্বেই শ্বশুর-শাশুড়ির আগমন। তাদেরকেও আহলেহাদীছ বিষয়ে বুঝালাম। বইটি কিছু পড়ে কি বুঝেছিলেন জানি না। বললেন, এটাও ঠিক ওটাও ঠিক। ইজতেমায় আখেরী মুনাজাতে যাওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়ি প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন, যেহেতু এই উদ্দেশ্যেই আসা। আমি বিনয়ের সাথে বারণ করলাম। কিন্তু তারা এড়িয়ে গেলেন। মনে কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এর বেশী কিছু করারও তো নেই। বাড়াবাড়িতে মনোমালিন্য বাড়বে। পূর্বের বছরগুলোতে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ অন্যান্য স্বজনদের সাথে আখেরী মুনাজাতে অংশগ্রহণ করেছি। কেবল এ বৎসরই ব্যতিক্রম! ছিফাতের আম্মুকে বললাম, তোমার বাবা-মা যাক, কিন্তু তুমি যাবে না এটা আমার আদেশ। যেহেতু উভয়েই সত্যটা জানতে পেরেছি এবং মানার সুযোগ আছে। কেন তা মানবো না? সে আমার সাথে একমত হয়ে সন্তানদের নিয়ে বাসায় থাকল। আর আমি অফিসের দিকে রওনা দিলাম। চলতে চলতে মনে সাফল্যের আমেজের অনুভূতি বইছিল যে, একটা বিদ‘আত পরিবারসহ ত্যাগ করতে পেরেছি। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

কিছুদিন পর সহযাত্রী ভাইটি বললেন, রাজশাহীতে আহলেহাদীছদের সর্ববৃহৎ তাবলীগী ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরাম সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেন। ধর্মীয় অনেক বিষয়ে জানা যাবে। যাবেন কি? তৎক্ষণাৎ আমতা আমতা করলাম। কারণ একে তো আমার সাপ্তাহিক বন্ধ শুক্রবার। সাথে মাসের শেষ সময় চলছে। বেতন পেতে আরও সপ্তাহখানেক দেরী। ছা-পোষা মানুষ হিসাবে হাত ও পরিবার খরচ নিয়ে টানাটানি। আমার গড়িমসি দেখে তিনি বললেন, আপনার যাওয়া-আসার পথ খরচের ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলেই পাঁচশত টাকার একটা নোট পকেটে গুঁজে দিয়ে বললেন, এটা দিয়ে রাজশাহী আসেন ফেরার পথে বাকী খরচ দিয়ে দিব ইনশাআল্লাহ। রাতে বাসায় গিয়ে এ বিষয়ে আলাপ করলাম এবং আর্থিক বিষয়ের কারণে না যাওয়ার কথা মাহিমের আম্মুকে বললাম। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছিল যে, আমি মুখে যা-ই বলি অন্তরে ইচ্ছে পোষণ করছি রাজশাহী যাওয়ার।

পরিশেষে আমাকেই চাপ দেয়া হ’ল তাবলীগী ইজতেমায় গিয়ে স্বচক্ষে সেখানকার অবস্থা অবগত হয়ে আসতে। অন্যথা সে খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিবে। নিজের কাছে থাকা কিছু টাকাও দিল। বিকেলের ট্রেনে চড়ে তাবলীগী ইজতেমায় পৌঁছেছিলাম বৃহস্পতিবার রাত দশটার দিকে। যখন আশেপাশের রাস্তা, পুরো মাঠ জনসমুদ্র। ট্রেনের সহযাত্রী ভাইটি ইজতেমার মাঠে ব্যস্ততার কারণে আমাকে সময় দিতে পারছিলেন না। তবে কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয়েছিল মামূন ভাইয়ের সাথে। যিনি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ যেলা ‘যুবসংঘে’র অর্থ সম্পাদক। ঐ সময়ে সংগঠনের শিমুলিয়া শাখার দায়িত্বে ছিলেন। এই ভাইয়ের সান্নিধ্যে থাকার সময় এবং ইজতেমায় আগত মানুষদের আচরণ আমার বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে ছিল। ইসলামের সৌন্দর্যকে বাস্তবে ফুটিয়ে তুলছে এই একটি সংগঠন। দাঈগণের অসাধারণ বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য আর সংগঠনের কর্মীদের আচরণে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি। অথচ জীবনে কখনও তাদের নাম পর্যন্ত শুনিনি। না মিশলে বুঝা যায় না যে, তারা ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় কতটা আন্তরিক। মহান আল্লাহর রহমতে যে লেখকের বই পড়ে পরিবর্তন হয়েছি সেই স্যারের সাথে কুশল বিনিময় করেছি, বক্তব্য শুনেছি, ইমামতিতে জুম‘আর ছালাত আদায় করেছি। এক কথায় অনুভূতির সময়গুলো বিস্ময়কর। ফেরার পথে ভিডিও করে নিলাম ইজতেমার কার্যক্রম। সেই সাথে হাদীছ ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত কিছু বই।

ফেরার পথে নিজের পাথেয় যথেষ্ট থাকায় সহযাত্রী ভাই থেকে আর পথখরচ নেইনি। পরবর্তীতে নিজেও সাধ্যমত আত্মীয় ও শুভাকাঙ্খীদের মাঝে ‘ছালাতুর রাসূল (ছাঃ)’ বইটি বিতরণ করেছি। আল্লাহর রহমতে ২-৩ জন পরিবর্তিতও হয়েছেন। এখনও সহযাত্রী ভাইটির সাথে সপ্তাহে কয়েকবার দেখা হয়। বর্তমানে দু’জন মিলে মাঝে মাঝে নতুন এক পদ্ধতি ব্যবহার করি। অচেনা যাত্রী হিসাবে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন কোন একটি বিষয়ে। আমি ভুল উত্তর দেই (যা সমাজে প্রচলিত)। তিনি সংশোধন করে উত্তর দিতে থাকেন। এতে অন্যান্য যাত্রীগণ আকৃষ্ট হয়ে কথা শুনতে থাকে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন তখন দাওয়াত দিতে সহজ হয়। তবে সবসময় সফলতা আসে না। তীর্যক মন্তব্যই আসে বেশী। তারপরও যথাসাধ্য দাওয়াতী কাজ তো করতে হবে ছওয়াবের লক্ষ্যেই। এভাবেই যেখানে যখন অবস্থান সেখানেই চলবে বিনয়ের সাথে কৌশলে দাওয়াতী মিশন ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহ বইয়ের লেখক (মুহতারাম আমীরে জামা‘আত), সহযাত্রী ভাই ও অন্যান্য দ্বীনি ভাই-বোনদেরসহ প্রিয় সংগঠন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সংশ্লিষ্ট সকলকে ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন- আমীন!







আরও
আরও
.