অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে আব্দুল্লাহ। বছর
পনের হ’ল গ্রামের মায়া-মমতা ত্যাগ করে দ্বীনী ইলম অর্জনের জন্য তার বাইরে
যাওয়া। গ্রামে কোন ভাল আলেম ছিল না, যার কাছ থেকে গ্রামবাসী দ্বীনী ইলম
শিক্ষা করবে। এতদিন পরে আব্দুল্লাহ যোগ্য আলেম হয়ে নিজ গ্রামে ফিরে এসেছে।
আগামীকাল ২১শে ফ্রেব্রুয়ারী; শহীদ দিবস। এটা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিদ্যালয়সমূহে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হবে। তাই বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা ফুল সংগ্রহে মেতে উঠেছে। বিভিন্ন প্রকার ফুল সংগ্রহ করে তারা পুষ্পাঞ্জলী তৈরী করছে। আব্দুল্লাহ এ দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল এবং মনে মনে ভাবল, আমিও এক সময় এমনটিই করতাম। এটা ভেবেই সে খুব মানসিক কষ্ট অনুভব করল। অতঃপর একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, হায়! এভাবেই রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে বিদ্যালয় সমূহের শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের ঈমান হরণ করছেন। এরপর সে ঐ ছেলে-মেয়েদের নিকটে আসল এবং তাদেরকে ২১শে ফেব্রুয়ারীর করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে বুঝাল। হাসান নামের একটি ছেলে ব্যতীত সবাই তার কথাকে উপেক্ষা করে চলে গেল।
পরদিন সকাল বেলা হাসান সিদ্ধান্ত নিল যে, সে ২১শে ফেব্রুয়ারী উদযাপন অনুষ্ঠানে যাবে না। কিন্তু বন্ধুদের চাপের মুখে অবশেষে তাকে যেতেই হ’ল। ছাত্র-ছাত্রীরা নগ্নপায়ে শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ করল। তাদের পিছু পিছু হাসান জুতা পরে খালি হাতে নীরবে শহীদ মিনারে গেল। একজন শিক্ষক তাকে জুতা পরে শহীদ মিনারে আসতে দেখে দ্রুত তার কাছে এলেন। হাসানের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে শহীদ মিনার থেকে নামালেন এবং একজন ছাত্রকে একটি লাঠি আনার হুকুম দিলেন। এরপর তাকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ না করেই বেদম প্রহার করলেন। আর বেয়াদব, অসভ্য, মূর্খ ইত্যাদি বলে গালি-গালাজ করলেন। শিক্ষকের বেধড়ক লাঠির বাড়িতে হাসান অসুস্থ হয়ে পড়ল।
বন্ধুরা ধরে তাকে বাড়িতে নিয়ে এল। বাবা-মা ছেলের এ অবস্থা দেখে অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না। হাসানকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আদ্যোপান্ত ঘটনা শুনে হাসানের বাবা তাকে নিয়ে আব্দুল্লাহর নিকটে আসলেন এবং তাকে সবকিছু খুলে বললেন। গ্রামের কতিপয় গণ্যমান্য লোককে সাথে নিয়ে আব্দুল্লাহ ও হাসানের বাবা পরদিন স্কুলে গেলেন। যে শিক্ষক হাসানকে মেরেছিল আব্দুল্লাহ ঐ শিক্ষককে মারার কারণ জিজ্ঞেস করল। শিক্ষক বললেন, হাসান জুতা পরে শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদদের অপমান করেছে, এটিই তার অপরাধ। আব্দুল্লাহ বলল, বলুনতো পৃথিবীতে উত্তম জায়গা কোনটি, মসজিদ নাকি শহীদ মিনার? তিনি বললেন, মসজিদ। আব্দুল্লাহ বলল, মসজিদ উত্তম জায়গা হওয়া সত্ত্বেও পরিষ্কার জুতা পরে সেখানে ঢোকার ও ছালাত আদায়ের অনুমতি রয়েছে। আল্লাহর ঘর মসজিদে জুতা পরে প্রবেশ করলে অপমান করা হয় না, আর শহীদ মিনারে জুতা পরে উঠলে অপমান করা হয়? এই শিক্ষা আপনারা কোথা থেকে পেলেন? আপনারা ভাষা শহীদের জন্য ভক্তি গদগদ চিত্তে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এসব করছেন, কিসে শহীদদের প্রকৃত মঙ্গল ও কল্যাণ হবে তা কি কখনও ভেবে দেখেছেন? ভাষা শহীদের জন্য আপনারা কয়দিন দো‘আ করেছেন? কয়দিন তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করেছেন? কয়দিন তাদের নাজাতের জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদেছেন। তাদের জন্য কয় টাকা নিজে ছাদাক্বা করেছেন? এসব না করে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে, নীরবতা পালন করে নিজে যেমন শিরক করছেন, তেমনি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিরক করাচ্ছেন। এভাবে আপনারা ছাত্র-ছাত্রীদের ঈমান বিনষ্ট করে চলেছেন। এর জন্য অবশ্যই আপনাদেরকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আব্দুল্লাহর কথায় একজন অভিভাবক বললেন, বাবা তুমি হাছা কইতাছো? তাইলে আমি আর আমার পোলারে এইহানে পড়ামু না। ওরে মাদ্রাসায় দিমু। তার কথায় সবাই সমস্বরে বলল, হ আমরাও আমাদের পোলা-মাইয়ারে মাদ্রাসায় দিমু। হাসানের বাবা বললেন, আপনে ওর শিক্ষক না অইলে আইজ আমিও বুঝাইতাম আমারে কতখানি কষ্ট দিছেন।
আব্দুল্লাহ সবাইকে থামিয়ে বলল, আমরা বাবারাও সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকে শিরক শিক্ষা দিয়ে থাকি। একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেমনে বাবা? আব্দুল্লাহ বলল, আমরা সন্তানদের কপালে কাল টিপ দেই এই বিশ্বাসে যে, তার প্রতি বদনযর লাগবে না। সন্তানদের কোমরে কালো সুতা বেঁধে দেই। অনেকে তাতে বিভিন্ন কড়ি গেঁথে দেই। একটু কিছু হ’লেই তাদের গলায় তাবীয ঝুলিয়ে দেই। এসব করি রোগ প্রতিরোধ কিংবা তাদের মঙ্গলের জন্য। অথচ এতে তাদের কোন উপকার হয় না বরং ক্ষতি হয়। কারণ এসব শিরকী কাজ। এসবের জন্য আমাদেরকেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আব্দুল্লাহর কথায় সবাই সিদ্ধান্ত নিল যে, ভবিষ্যতে তারা এসব করবে না। শিক্ষকও লজ্জিত হয়ে হাসানের বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল এবং বলল, না জেনে প্রশাসনের চাপে আমাদেরকে এসব করতে হয়। তবে যতদূর পারি আগামীতে এসব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আব্দুল্লাহকে বললেন, আপনি আমাদেরকে অনেক শিরকী বিষয়ে সতর্ক করলেন। এ ব্যাপারে আমরা নিজেরা সাবধান হব এবং অন্যদেরকেও সাবধান করার চেষ্টা করব। আপনার মত দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত লোকজন সমাজে আরো দরকার।
মুহাম্মাদ লাবীবুর রহমান
হয়বৎপুর, পার্বতীপুর, দিনাজপুর।