পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।
ইখলাছ না থাকার ক্ষতি :
ইখলাছের যেমন অনেক উপকারিতা ও ফল আছে- যা একজন মুসলিম ইখলাছের বদৌলতে অর্জন করে থাকে, তেমনি ইখলাছহীনতার অনেক কুফলও রয়েছে। ইখলাছহীন লোককে তা ভোগ করতে হবে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল :
জান্নাতে প্রবেশ না করা :
ইখলাছহীন আমল করলে মানুষ জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ পাবে না; যদিও ঐ আমল ইখলাছসহ করলে জান্নাতে যাওয়া যেত। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيْبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَعْنِىْ رِيْحَهَا- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ব্যতীত যদি কেউ শুধু পার্থিব স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে বিদ্যা শিখে, তাহ’লে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[1]
ক্বিয়ামত দিবসে জাহান্নামে প্রবেশ :
আমল যত দামীই হোক না কেন- তা ইখলাছ শূন্য হ’লে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘ক্বিয়ামতের দিন যার বিরুদ্ধে বিচারের প্রথম রায় ঘোষিত হবে সে একজন শহীদ। তাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে যত নে‘মত দিয়েছিলেন তা তাকে স্মরণ করানো হবে। সে তা স্বীকার করবে। তখন তিনি বলবেন, এসব নে‘মত পেয়ে তুমি কী করেছিলে? সে বলবে, তোমার পথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ (كَذَبْتَ)। তুমি বরং (জনগণের মাঝে) বীরপুরুষ আখ্যায়িত হবে সেজন্য যুদ্ধ করেছিলে। তোমাকে তা বলাও হয়ে গেছে। তারপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে অধোমুখী করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।
অপর ব্যক্তি (যার বিরুদ্ধে প্রথম রায় ঘোষিত হবে) সে ইলম অর্জন করেছিল ও অন্যদের শিক্ষা দিয়েছিল এবং কুরআন পড়েছিল। তাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে যত নে‘মত দিয়েছিলেন তা অবহিত করবেন। সে তা স্বীকার করবে। তখন তিনি বলবেন, এসব নে‘মত পেয়ে তুমি কী করেছিলে? সে বলবে, আমি ইলম অর্জন করেছিলাম, অন্যদের তা শিখিয়েছিলাম এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত করেছিলাম। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি বরং (জনগণের মাঝে) আলেম বা বিদ্বান বলে আখ্যায়িত হবে সেজন্য বিদ্যা শিখেছিলে এবং ক্বারী বলে পরিচিত হবে সেজন্য কুরআন তেলাওয়াত করেছিলে। তোমাকে তো সেসব বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। তারপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে অধোমুখী করে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তি (যার বিরুদ্ধে প্রথম রায় ঘোষিত হবে) সে যাকে আল্লাহ প্রাচুর্য দিয়েছিলেন এবং তাকে হরেক রকমের ধন-সম্পদ দিয়েছিলেন। তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাকে যত নে‘মত দিয়েছিলেন তা তাকে অবহিত করবেন। সে তা স্বীকার করবে। তখন তিনি বলবেন, এসব নে‘মত পেয়ে তুমি কী করেছিলে? সে বলবে, আপনার জন্য এমন কোন পথে অর্থ ব্যয় আমি বাদ দেইনি যেখানে অর্থ ব্যয় আপনি পসন্দ করতেন। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি বরং একজন দাতা হিসাবে পরিচিত হওয়ার জন্য অর্থ ব্যয় করেছিলে। আর তোমাকে তা বলাও হয়েছে। তারপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে অধোমুখী করে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[2]
এ হাদীছ এতটাই ভারী ও গুরুত্ববহ যে আবু হুরায়রা (রাঃ) যখনই হাদীছটি বর্ণনা করতে যেতেন তখনই ভয়ে বেহুঁশ হয়ে যেতেন। এ সম্পর্কে বর্ণনাকারী শুফাই আল-আছবাহী বলেছেন যে, একদিন তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় গমন করেন। সেখানে হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন একজন লোকের পাশে বহু লোক জমায়েত হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? তারা বলল, ইনি আবু হুরায়রা (রাঃ)। আমি তাঁর কাছাকাছি যেতে যেতে একেবারে তাঁর সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি তখন লোকদের হাদীছ শুনাচ্ছিলেন। তিনি যখন হাদীছ বলা বন্ধ করে একাকী হ’লেন তখন আমি তাঁকে বললাম, আমি আপনাকে হকের পর হকের শপথ দিয়ে বলছি, আপনি আমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাবেন যা আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে (নিজ কানে) শুনেছেন, বুঝছেন এবং জেনে রেখেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, আমি তা করব। আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটা হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন, আমি তা বুঝেছি এবং মনে রেখেছি। একথা বলে আবু হুরায়রা (রাঃ) বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। একটু পরেই হুঁশ ফিরে পেয়ে তিনি বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন। তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এই বলে আবু হুরায়রা (রাঃ) আবার বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে তাঁর মুখমন্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন, তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এই বলে আবু হুরায়রা (রাঃ) পুনরায় বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে তার মুখমন্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি করব, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন। তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এবার আবু হুরায়রা (রাঃ) পুনরায় বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে তার মুখমন্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি করব, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন। তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এবার আবু হুরায়রা (রাঃ) কঠিনভাবে বেহুঁশ হয়ে গেলেন এবং মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে তাঁকে আমার শরীরের সাথে লাগিয়ে রাখলাম। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে বললেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন, ... এভাবে তিনি পূর্বের হাদীছের ন্যায় বর্ণনা করে শুনান। আর তার শেষে রয়েছে ثُمَّ ضَرَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى رُكْبَتِى فَقَالَ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أُولَئِكَ الثَّلاَثَةُ أَوَّلُ خَلْقِ اللهِ تُسَعَّرُ بِهِمُ النَّارُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার হাঁটুতে মেরে বললেন, হে আবু হুরায়রা! এই তিনজনই আল্লাহর সৃষ্টির প্রথম, যাদের দ্বারা ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন উত্তপ্ত করা হবে’।[3]
দেখুন! জাহান্নামের আগুনের তাপ প্রথমে কোন খুনী, ব্যভিচারী, চোর, মদ্যপ ইত্যাদি ধরনের লোক দ্বারা বৃদ্ধি করা হবে না, বরং কুরআন পাঠক, দাতা, জ্ঞানী ও মুজাহিদ শ্রেণীর লোকদের দ্বারা তা করা হবে। আর এসবই হবে তাদের রিয়া বা লোক দেখানো কাজের কারণে।
কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ- ‘যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করে যে, তা দ্বারা আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে কিংবা নির্বোধদের সঙ্গে বিতর্ক করবে অথবা মানুষের ঝোঁক তার দিকে ফিরিয়ে আনবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।[4]
আমল কবুল না হওয়া :
আমল যদি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর জন্য না করা হয় তাহ’লে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন যে, قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيهِ مَعِى غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ- ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমি শিরককারীদের শিরক থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত। কাজেই যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যাতে সে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি তাকেও বর্জন করি এবং তার শিরককেও বর্জন করি’।[5]
عَنْ أَبِى أُمَامَةَ الْبَاهِلِىِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَرَأَيْتَ رَجُلاً غَزَا يَلْتَمِسُ الأَجْرَ وَالذِّكْرَ مَا لَهُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ شَىْءَ لَهُ. فَأَعَادَهَا ثَلاَثَ مَرَّاتٍ يَقُولُ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ شَىْءَ لَهُ. ثُمَّ قَالَ : إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ-
আবু উমামা আল-বাহিলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, আপনি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কী মনে করেন যে ছওয়াব ও খ্যাতি উভয়টি লাভের নিয়তে যুদ্ধ করে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার জন্য কিছুই মিলবে না। সে কথাটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, তার জন্য কিছুই মিলবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ আমল কবুল করেন না, যা তাঁর জন্য খালেছভাবে করা না হয় এবং তা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে না হয়’।[6]
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِى سَبِيلِ اللهِ وَهُوَ يَبْتَغِى عَرَضًا مِنْ عَرَضِ الدُّنْيَا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ أَجْرَ لَهُ. فَأَعْظَمَ ذَلِكَ النَّاسُ وَقَالُوا لِلرَّجُلِ عُدْ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَعَلَّكَ لَمْ تُفَهِّمْهُ. فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِى سَبِيلِ اللهِ وَهُوَ يَبْتَغِى عَرَضًا مِنْ عَرَضِ الدُّنْيَا. فَقَالَ لاَ أَجْرَ لَهُ. فَقَالُوا لِلرَّجُلِ عُدْ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ لَهُ الثَّالِثَةَ فَقَالَ لَهُ لاَ أَجْرَ لَهُ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! একজন লোক জাগতিক ধন-সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করতে চায়। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তার জন্য কোন ছওয়াব নেই। লোকেরা কথাটিকে ভারী মনে করে তাকে বলল, তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে ফিরে গিয়ে কথাটি পুনরায় তুলে ধরো- হয়ত তুমি তাঁকে বুঝাতে পারোনি। ফলে সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! একজন লোক জাগতিক ধন-সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করতে চায়। তিনি বললেন, তার কোন ছওয়াব মিলবে না। তারা লোকটিকে বললেন, তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আবার বল। সে তৃতীয়বার তাঁকে বলল। তিনি বললেন, তাঁর কোন ছওয়াব মিলবে না’।[7]
আমলের ছওয়াব ও পারিতোষিক বিনষ্ট হওয়া :
আল্লাহ বলেন,وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُوْرًا- ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)।
হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা লোক দেখানো আমলকারীদের (বিচার দিবসে) বলবেন,اذْهَبُوْا إِلَى الَّذِيْنَ كُنْتُمْ تُرَاءُوْنَ بِأَعْمَالِكُمْ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوْا هَلْ تَجِدُوْنَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً- ‘যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তোমরা দুনিয়াতে আমল করতে তাদের কাছে যাও এবং দেখো, তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কি-না’।[8]
ইখলাছের সাথে পূর্বসূরীদের সম্পর্ক :
আমাদের পূর্বসূরীগণ ইখলাছ সম্পর্কিত কিছু আয়াত পাঠ কিংবা কিছু হাদীছ প্রচারকেই যথেষ্ট মনে করতেন না। বরং ইখলাছের সাথে তাদের সম্পর্ক এতটাই গভীর ও নিবেদিত ছিল যে, অন্যদের মধ্যে তা দেখা যায় না। তাদের জীবনটাই ছিল ইখলাছে ভরা এক একটা প্রদীপ-যারা অনুসরণীয় ও বরণীয়। কারণ তারা ইখলাছের মর্ম ও গুরুত্ব ভালোমত অনুধাবন করেছিলেন। ফুযাইল বিন ইয়ায (রহঃ) বলেন, إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْكَ نِيَّتَكَ وَإِرَادَتَكَ ‘আল্লাহ তো তোমার কাছে তোমার নিয়ত ও উদ্দেশ্য দেখতে চান’।[9]
ইখলাছকে বরণ করতে গিয়ে পূর্বসূরীগণ যে কী চূড়ান্ত কষ্ট ভোগ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তারা লোকদের সে কথা জানিয়েছেনও।
সাহল বিনু আব্দুল্লাহ আত-তাস্তারীকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, أَيُّ شَيْءٍ أَشَدُّ عَلَى النَّفْسِ؟ فَقَالَ: الْإِخْلَاصُ؛ لِأَنَّهُ لَيْسَ لَهَا فِيْهِ نَصِيْبٌ ‘নফসের উপর কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভারী? তিনি বললেন, ইখলাছ। কেননা এতে নফসের কোনই অংশ নেই’।[10]
ইউসুফ বিন আসবাত্ব (রহঃ) বলেন,تَخْلِيصُ النِّيَّةِ مِنْ فَسَادِهَا أَشَدُّ عَلَى الْعَامِلِينَ مِنْ طُولِ الِاجْتِهَادِ- ‘ভেজাল নিয়তকে নির্ভেজাল করার প্রয়াস একজন আমলকারীর জন্য দীর্ঘকাল ধরে ইজতিহাদ বা গবেষণা করা থেকেও কঠিন’।[11]
প্রিয় পাঠক! আমাদের পূর্বসূরীরা ইখলাছ নিয়ে কেমনটি ভাবতেন সে সম্পর্কে আপনার সামনে কিছু নমুনা তুলে ধরা হ’ল। হয়ত আপনি এ থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন এবং তাদের পথ অনুসরণ করবেন।
নিজেকে মুখলিছ মনে না করা :
পূর্বসূরীরা যখন জেনেছেন যে, মানুষ তার জীবনে যত পরিস্থিতির মুখোমুখী হয় তন্মধ্যে ইখলাছ অত্যন্ত গুরুতর, আর তা অর্জনে একজন মুসলমানকে প্রকৃত জিহাদই চালিয়ে যেতে হয় তখন তারা নিজেদের জীবনে ইখলাছকে অস্বীকার করেছেন। তারা যে নিষ্ঠাবান মুখলিছ মানুষ, নিজেদের বেলায় তা সাব্যস্ত করেননি। প্রখ্যাত হাদীছ বর্ণনাকারী হিশাম আদ-দাস্ত্তওয়াই (রহঃ) বলেন,وَاللهِ مَا أَسْتَطِيْعُ أَنْ أَقُوْلَ إِنِّيْ ذَهَبتُ يَوْماً قَطُّ أَطْلُبُ الحَدِيْثَ، أُرِيْدُ بِهِ وَجْهَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ- ‘আল্লাহর কসম একদিনের জন্যও যে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হাদীছের তালাশে গিয়েছি তা বলতে পারি না’।[12]
এই হিশাম আদ-দাস্ত্তওয়াই- যিনি হাদীছ তালাশে নিজেকে অভিযুক্ত করছেন তাকে কি আপনারা চেনেন? ইনি সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ (রহঃ) বলেছেন, مَا أقول إنّ أحدًا يطلب الحديث يريد بِهِ وجه الله تعالى إلا هشام الدستوائي ‘হিশাম আদ-দাস্ত্তওয়াই ছাড়া আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন বলে আমি বলতে পারি না’।
তাঁর সম্পর্কে শায়খ ইবনু ফাইয়ায (রহঃ) বলেছেন, بَكَى هِشَامٌ الدَّسْتُوَائِيُّ حَتَّى فَسَدَتْ عَيْنُهُ، ‘হিশাম কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ নষ্ট করে ফেলেছিলেন। হিশাম তাঁর নিজের সম্পর্কে বলতেন, যখন থেকে আমি (চোখের) আলো হারিয়েছি তখন থেকে আমি কবরের অন্ধকার স্মরণ করি। তিনি আরো বলতেন, عَجِبْتُ لِلْعَالِمِ كَيْفَ يَضْحَكُ؟ ‘একজন আলেম কিভাবে হাসতে পারে তা ভেবে আমি অবাক হই’।[13]
সুফিয়ান (রহঃ) বলেন, আমার নিয়ত নিয়ে আমি যত মুশকিলে পড়েছি আর কোন কিছু নিয়ে আমি তত মুশকিলে পড়িনি। কারণ আমার নিয়ত বারবার পাল্টে যায়।[14]
ইউসুফ ইবনুল হুসাইন বলেন,أَعَزُّ شَيْءٍ فِي الدُّنْيَا، الإِخْلاَصُ. وَكَمْ أَجْتَهِدُ فِيْ إِسْقَاطِ الرِّيَاءِ عَنْ قَلْبِي. فَكَأَنَّهُ يَنْبُتُ عَلَى لَوْنٍ آخَرَ- ‘দুনিয়াতে ইখলাছের থেকে কঠিন কিছুই নেই। কতবার যে আমি আমার মন থেকে রিয়া বা লৌকিকতা মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ভিন্নভাবে তা আবার জন্ম নেয়’।[15]
মুতার্রিফ ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) তাঁর দো‘আয় বলতেন,اللهُمَّ إِنِّي أَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا تُبْتُ إِلَيْكَ مِنْهُ ثُمَّ عُدْتُ إِلَيْهِ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا جَعَلْتُهُ لَكَ عَلَى نَفْسِيْ ثُمَّ لَمْ أُوَفِّ بِهِ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا زَعَمْتُ أَنِّيْ أَرَدْتُ بِهِ وَجْهَكَ فَخَالَطَ قَلْبِيْ فَيْهِ مَا قَدْ عَلِمْتَ- ‘হে আল্লাহ! যে গুনাহ থেকে আমি তোমার নিকটে তওবা করেছি অতঃপর পুনরায় তা করেছি সে গুনাহ থেকে আমি তোমার নিকটে ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছি। আমি তোমার জন্য আমার নিজের উপর যে কাজ নির্ধারণ করে নিয়েছিলাম, কিন্তু তা পূরণ করতে পারিনি তা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং যে কাজ আমার ধারণা ছিল যে, আমি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করছি কিন্তু আমার মনের ইচ্ছা তাতে মিশে গিয়ে তা অন্য রকম করে দিয়েছিল আমি তা থেকে তোমার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’।[16]
এরা ছিলেন জাতির অনুসরণীয় নেতৃবর্গ। অথচ দেখুন এরাই নিজেরা নিজেদেরকে কীভাবে দোষারোপ করেছেন।
সংগোপনে আমল :
আমাদের পূর্বসূরী মনীষীগণ গোপনে আমল করতে যে কতটা সচেষ্ট ছিলেন সে সম্পর্কে ইমাম হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, একজন লোক (দীর্ঘদিন ধরে) কুরআনের অনুলিপি করছে অথচ তার প্রতিবেশী সে সম্পর্কে কিছুই জানে না। একজন ফিক্বহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে চলেছে কিন্তু লোকেরা তা মোটেও টের পায়নি। কারো বাড়ি মেহমানে ভরা-সে বাড়িতে দীর্ঘ সময় ধরে ছালাত আদায় করছে অথচ মেহমানরা তা টের পাচ্ছে না। আমি এমন বহু লোক পেয়েছি যারা পৃথিবীর বুকে গোপন করা সম্ভব এমন আমল কোন দিন প্রকাশ্যে করেননি।
মুসলমানরা আল্লাহর দরবারে দো‘আ করতে খুবই সচেষ্ট থাকতেন। কিন্তু তাদের সে দো‘আর কোন শব্দ কানে আসত না- তা ছিল কেবলই তাদের এবং তাদের রবের মাঝে নিঃশব্দ আওয়ায। কারণ আল্লাহ বলেছেন,ادْعُوْا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ডাকো বিনীতভাবে ও চুপে চুপে’ (আ‘রাফ ৭/৫৫)।[17]
স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের থেকে আমল লুকানো :
হাসসান বিন আবী সিনানের স্ত্রী নিজ স্বামী সম্পর্কে বলেছেন, ‘সে বাড়ি এসে আমার সঙ্গে আমার বিছানায় প্রবেশ করত, তারপর মা যেমন দুধের শিশুকে রেখে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে যায় (অথচ শিশু টের পায় না), ঠিক তেমনি করে সে আমাকে বুঝতে না দিয়ে বিছানা থেকে উঠে যায়। যখন তার মনে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তখন আস্তে করে বিছানা থেকে বেরিয়ে যায় এবং ছালাতে দাঁড়িয়ে যায়। একদিন আমি তাকে বললাম, হে আব্দুল্লাহর পিতা! তোমার নফসকে আর কত শাস্তি দিবে? তোমার জীবনের উপর দয়া করো। সে বলল, আহ! চুপ করো। অচিরেই হয়ত আমি এমন ঘুম ঘুমাব যে কোন কালে আর উঠব না’।[18]
এমনিভাবে দাঊদ ইবনু আবু হিন্দ চল্লিশ বছর ছিয়াম পালন করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পরিবার তা জানত না। তিনি তাঁর সকালের খাবার তাদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় দান করে দিতেন। আবার সন্ধ্যায় ফিরে এসে তাদের সাথে ইফতার করতেন।[19]
জিহাদের মাঝে গোপনীয়তা অবলম্বন :
জিহাদে লোক দেখানো কাজ এবং ইখলাছ শূন্যতার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যারাই জিহাদে অস্ত্র ধরুক এবং মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করুক তারা প্রত্যেকেই যে মুখলিছ হবে এমন কোন কথা নেই। ইতিপূর্বে কিছু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যাতে জিহাদে ইখলাছ ও নিয়তের গুরুত্ব জোরালোভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের নেককার পূর্বসূরীগণ জিহাদে ইখলাছ বজায় রাখতে আত্মপরিচয় গোপন রাখার ব্যবস্থা নিতেন, যাতে তাদের চেনা না যায়। প্রিয় পাঠক! আপনি নিচের ঘটনা দু’টি থেকে তা বুঝতে পারবেন।
প্রথম ঘটনা : আবাদা ইবনু সুলায়মান (রহঃ) বলেন, আমরা রোম দেশে একটি অভিযানে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সাথে ছিলাম। আমরা শত্রুর মুখোমুখি হ’লাম। যখন দু’দল পরস্পরের সামনাসামনি হ’ল তখন শত্রুপক্ষের এক লোক এসে মল্লযুদ্ধের আহবান জানাল। ফলে মুসলমানদের মধ্য হ’তে একজন বেরিয়ে এসে তাকে আক্রমণ করল এবং বল্লমের আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করল। পুনরায় তাদের একজন বেরিয়ে এসে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। এবারও সেই লোকটি তার দিকে এগিয়ে গেল এবং তাকে হত্যা করল। এবার এল তৃতীয়জন। এবারও সে তাকে আক্রমণ করল এবং বর্শার আঘাতে হত্যা করল। তখন এই বীরযোদ্ধাকে চেনার জন্য লোকদের ভিড় জমে গেল। দেখা গেল লোকটি চোখ বাদে তার সারা মুখ ঢেকে রেখেছে। আবাদা বলেন, আমিও তাকে দেখার জন্য ভিড়কারীদের মধ্যে ছিলাম। আমি তার জামার আস্তিন ধরে টান দিলাম তখন দেখলাম তিনি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক। এ সময় যে তাঁর মুখের আবরণ খুলে দিয়েছিল তাকে ভৎর্সনা করে তিনি বললেন, ওহে আবু আমর! তুমি আমাদের এমন অপদস্থ করতে পারলে?[20]
দ্বিতীয় ঘটনা (সুড়ঙ্গওয়ালা বাহিনী) :
একবার মুসলিম বাহিনী শত্রুপক্ষের একটি দুর্গ অবরোধ করে। কিন্তু শত্রুপক্ষের তীরবৃষ্টিতে তাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। তখন মুসলমানদের একজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে দুর্গের মধ্যে প্রবেশের জন্য সুবিধামত একটি সুড়ঙ্গ খনন করে। সে সুড়ঙ্গ পথে দুর্গে ঢুকে পড়ে এবং দ্বাররক্ষীদের সঙ্গে লড়াই করে দুর্গের ফটক খুলে দিতে সমর্থ হয়। তখন মুসলিম বাহিনী দুর্গে প্রবেশ করে তা দখল করে নেয়। কিন্তু কে যে এই সুড়ঙ্গওয়ালা তা জানা গেল না। তখন মুসলিম সেনাপতি মাসলামা ইবনু আব্দুল মালিক (খলীফা আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ানের ছেলে) তাকে পুরস্কৃত করার জন্য খোঁজ করলেন। কিন্তু তাকে না পাওয়ায় তিনি সৈন্যদের মাঝে আল্লাহর কসম দিয়ে বললেন, সুড়ঙ্গওয়ালা যেই হোক সে যেন আমার কাছে আসে। রাতের বেলায় একজন আগন্তুক সেনাপতির কাছে গেলেন এবং তাকে একটি শর্ত কবুলের আবেদন জানালেন। শর্তটি এই যে, তিনি যখন সুড়ঙ্গওয়ালার পরিচয় জানতে পারবেন তখন কোন দিন যেন তার অনুসন্ধান না করেন। সেনাপতি অঙ্গীকার করলেন। এবার তিনি সুড়ঙ্গওয়ালার পরিচয় তাঁকে জানালেন। এরপর থেকে মাসলামা দো‘আ করতেন,اللَّهُمَّ احْشُرْنِيْ مَعَ صَاحِبِ النَّفَقِ ‘হে আল্লাহ! আখিরাতে তুমি ঐ সুড়ঙ্গওয়ালার সাথে আমার হাশর করো’।[21]
একজন মরুচারী ছাহাবী ও যুদ্ধলব্ধ গণীমত :
শাদ্দাদ ইবনুল হাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক মরুবাসী বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে ঈমান আনল এবং তাঁর অনুসরণ করতে লাগল। কিছুকাল পর সে নবী করীম (ছাঃ)-কে বলল, আমি আপনার কাছে হিজরত করে আসতে চাই। ফলে নবী করীম (ছাঃ) তাঁর একজন ছাহাবীকে তার সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দিলেন। ইতিমধ্যে একটি যুদ্ধে নবী করীম (ছাঃ) কিছু বন্দীকে গণীমত হিসাবে পেলেন। তিনি বন্দীদেরকে ভাগ করে দিলেন। ঐ বেদুঈন ছাহাবীকেও এক ভাগ দিলেন। তার ভাগটা তিনি তার সাথীদের হাতে দিলেন। লোকটি পশুপাল চরাত। পশুপাল চরিয়ে ফিরে এলে তারা গণীমতের সম্পদ (বন্দী) তাকে দিল। সে বলল, এসব কী? তারা বলল, তোমার গণীমতের ভাগ, নবী করীম (ছাঃ) তোমাকে দিয়েছেন। সে তা নিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, এসব কী? তিনি বললেন, আমি তোমাকে ভাগ হিসাবে দিয়েছি। সে বলল, আমি তো এগুলোর জন্য আপনার অনুসরণ করছি না। সে তার কণ্ঠনালীর দিকে ইশারা করে বলল, আমি বরং এজন্য আপনার অনুসরণ করছি যে, আমার এখানটায় তীরবিদ্ধ হয়ে আমি মারা যাব, তারপর জান্নাতে প্রবেশ করব। তিনি বললেন, যদি তুমি আল্লাহকে সত্য বলে থাক তাহ’লে তিনি তোমাকে সত্যে পরিণত করবেন। এভাবে অল্প কিছুদিন গেল। তারপর মুসলিম বাহিনী একটি যুদ্ধে লিপ্ত হ’ল। যুদ্ধে ঐ মরুচারী বেদুঈন ছাহাবী (রাঃ) নিহত হন। তাকে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসা হ’ল। সে যে জায়গায় ইশারা করেছিল ঠিক সেখানটাতেই তীর লেগেছিল। নবী করীম (ছাঃ) দেখে বললেন, এই কি সেই? তারা বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, সে আল্লাহকে সত্য বলেছিল, তাই আল্লাহ তাকে সত্যে পরিণত করেছেন। তারপর নবী করীম (ছাঃ) নিজের জামা দিয়ে তাকে কাফন দেন এবং তার জানাযার ছালাতে ইমামতি করেন। তার ছালাতে যেটুকু তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন তন্মধ্যে এ দো‘আ ছিল-
اللَّهُمَّ هَذَا عَبْدُكَ خَرَجَ مُهَاجِرًا فِىْ سَبِيْلِكَ فَقُتِلَ شَهِيْدًا أَنَا شَهِيْدٌ عَلَى ذَلِكَ-
‘হে আল্লাহ! এ তোমার বান্দা। মুহাজির হয়ে এসে তোমার রাস্তায় বের হয়েছিল। অতঃপর শহীদ হিসাবে সে নিহত হয়েছে। আমি এ ঘটনার সাক্ষী’।[22]
সাজ-গোজ ও সৌন্দর্য চর্চার ভয় :
সাধক আলী ইবনু বাক্কার বছরী (রহঃ) বলেন, অমুকের সাথে সাক্ষাতের তুলনায় আমি শয়তানের সাথে সাক্ষাৎকে বেশি পসন্দ করি। আমার ভয় হয় যে, আমি তার জন্য সাজ-গোজ করে যাব, ফলে আমি আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি থেকে ছিটকে পড়ব।[23] সালাফে ছালেহীন তো এভাবে সৌন্দর্য চর্চা করতেও ভয় পেতেন।
বিদ্যা-বুদ্ধি প্রকাশ না করা :
ইবনু ফারিস আবুল হাসান আল-কাত্ত্বান (রহঃ) সম্পর্কে বলেন যে, তিনি বলেছেন, ‘আমার দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা যে, আমি সফরের অবস্থায় বেশী বেশী কথা বলি, যার শাস্তি হিসাবে এমনটা ঘটেছে’। তার ধারণা, তার বিদ্যা মানুষের সামনে তুলে ধরার কারণে তার এ অসুখ হয়েছে।
যাহাবী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! তিনি সঠিক কথাই বলেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছা ও বিশুদ্ধ নিয়ত থাকা সত্ত্বেবও তাঁরা কথা-বার্তা ও জ্ঞান-গরিমা প্রকাশে ভয় পেতেন। কিন্তু আজকের (যাহাবীর যুগের) অবস্থা দেখুন! বিদ্যার স্বল্পতা ও নিয়তের খারাবী সত্ত্বেও লোকেরা বেশী বেশী কথা বলে। আল্লাহ তো তাদের অপদস্থ করবেনই। সেই সঙ্গে তাদের মূর্খতা, কুপ্রবৃত্তি ও জ্ঞাত বিদ্যার মাঝে দোদুল্যমানতা যাহির করে দিবেন।[24]
কান্না লুকানো :
হাম্মাদ ইবনু যায়েদ (রহঃ) বলেন, আইয়ূব হাদীছ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়শই ব্যথিত হয়ে পড়তেন। তার দু’চোখে অশ্রু দেখা দিত আর কান্না ঠেলে বের হয়ে আসতে চাইত। কিন্তু তিনি সর্দি ঝাড়তেন আর বলতেন, কী কঠিন সর্দিরে। কান্না গোপন করতে গিয়ে তিনি সর্দির কথা প্রকাশ করতেন।[25]
হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, দেখা গেল, ব্যক্তি বিশেষ কোন মজলিসে বসেছে, তারপর তার কান্না চলে এল। পরে সে চেষ্টা করে তা রোধ করল। আর যদি রোধ করতে না পারে তাহ’লে উঠে চলে গেল।[26]
মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াসি‘ বলেন, এক ব্যক্তি বিশ বছর যাবৎ কান্নাকাটি করত অথচ তার সাথে থেকেও তার স্ত্রী বিষয়টা জানত না।[27]
তিনি আরো বলেছেন, আমি এমন লোকের দেখা পেয়েছি যে একই বালিশে মাথা রেখে স্বামী-স্ত্রী শুয়ে আছে, স্বামীর চোখের পানিতে তার গন্ডদেশের নিচের বালিশ ভিজে গেছে অথচ স্ত্রী তার খবরই পায়নি। আবার অনেক লোক জামা‘আতের কাতারে দাঁড়িয়ে চোখের পানিতে গাল ভিজিয়ে ফেলছে অথচ তার পাশে দাঁড়ানো লোকটি তা অনুভবই করতে পারেনি।[28]
ইমাম আল-মাওয়ার্দী ও তাঁর রচনাবলী :
গ্রন্থ প্রণয়নে ইখলাছ অবলম্বনের ক্ষেত্রে ইমাম আল-মাওয়ার্দীর ঘটনা বড়ই অদ্ভূত। তিনি তাফসীর, ফিক্বহ প্রভৃতি বিষয়ে অনেক বই লিখেছিলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় কোনটিই জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি। বইগুলো তিনি রচনা শেষে এমন স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানত না। মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তিনি তাঁর একজন বিশ্বস্ত লোককে বলেন, ‘অমুক জায়গায় রক্ষিত সকল বই আমার রচিত। আমি খাঁটি নিয়তে বইগুলো রচনা করেছি কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ থাকায় বইগুলো প্রকাশ করিনি। এক্ষণে যখন আমার মৃত্যু সন্নিকটবর্তী হবে এবং আমি মুমূর্ষু দশায় পতিত হব তখন তুমি তোমার হাত আমার হাতে রেখো। যদি আমি তোমার হাতটা মুঠি পাকিয়ে ধরতে পারি এবং তাতে চাপ দিতে পারি তাহ’লে তুমি বুঝবে যে, আমার কোন কিছুই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়নি। তুমি তখন বইগুলো নিয়ে রাতের অাঁধারে দজলা নদীতে ফেলে দিয়ো। আর যদি আমার হাত প্রসারিত করি কিন্তু তোমার হাত আমি যদি মুঠিবদ্ধ করতে না পারি তাহ’লে তুমি বুঝবে যে, সেগুলো আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে এবং আল্লাহর দরবারে আমার যে চাওয়া-পাওয়া ছিল তা পূর্ণ হয়েছে। ঐ ব্যক্তি বলেন, অতঃপর তার মৃত্যু যখন আসন্ন হ’ল তখন আমি আমার হাত তার হাতে রাখলাম। তিনি হাত প্রসারিত করে আমার হাত মুঠিবদ্ধ করতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না। তখন আমি বুঝলাম এটা তার বইগুলোর কবুল হওয়ার আলামত। তারপর আমি তার বইগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করলাম।[29]
আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ) ও রাতের দান :
যায়নুল আবিদীন আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ) রাতের অাঁধারে আটা পিঠে করে গরীব-মিসকীনদের তালাশ করে ফিরতেন। তিনি বলতেন, রাতের অাঁধারের দান প্রভুর রাগ স্তিমিত করে। মদীনা শহরে এমন অনেক লোক ছিল, যাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা কোথা থেকে হ’ত তারা তা জানত না। আলী ইবনুল হুসাইন মারা গেলে ঐ লোকগুলোর রাতের পাওয়া খাদ্য-খানা বন্ধ হয়ে গেল, তখন তারা বুঝতে পারল কোথা থেকে এগুলো আসত। তিনি এভাবে একশ’ পরিবারের ব্যয় বহন করতেন। মারা যাওয়ার পর লোকেরা আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ)-এর পিঠে কড়া পড়ার চিহ্ন দেখতে পায়। রাতে রুটির আটা বহন করতে করতে তাঁর পিঠে কড়া পড়ে গিয়েছিল।[30] এসব ঘটনার নায়কেরা যদিও তা গোপন রাখার চেষ্টা করতেন তবুও আল্লাহ তা‘আলা তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। যাতে তারা নেতা হিসাবে বরিত হ’তে পারেন। আল্লাহ বলেছেন, وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا ‘আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ বানাও’ (ফুরক্বান ৭৪)। অন্যত্র এসেছে وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا ‘আর আমরা তাদেরকে নেতা করেছিলাম। যারা আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে পথ প্রদর্শন করত’ (আম্বিয়া ৭৩)।
[চলবে]
[1]. আবুদাঊদ হা/৩৬৬৪; ইবনু মাজাহ হা/২৫২; আহমাদ হা/৮৪৩৮; মিশকাত হা/২২৭।
[2]. মুসলিম হা/১৯০৫।
[3]. তিরমিযী হা/২৩৮২; হাকেম হা/১৫২৭; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪০৮।
[4]. তিরমিযী হা/২৬৫৪; মিশকাত হা/২২৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/১০৬।
[5]. মুসলিম হা/২৯৮৫; মিশকাত হা/৫৩১৫।
[6]. নাসাঈ হা/৩১৪০; ছহীহাহ হা/৫২।
[7]. আবুদাঊদ হা/২৫১৬; মিশকাত হা/৩৮৪৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৩২৯।
[8]. আহমাদ হা/২৩৬৮৬; মিশকাত হা/৫৩৩৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২।
[9]. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১৩ পৃঃ।
[10]. মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২; জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১৭ পৃঃ।
[11]. জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১৩ পৃঃ।
[12]. যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৩/১৭৫; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/১৫২।
[13]. তারীখুল ইসলাম ৩/১৭৬; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/১৫২।
[14]. আল-ইখলাছু ওয়ান নিয়্যাতহ, পৃঃ ৬৫।
[15]. মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২।
[16]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৭১৬৭,৭১৬৮; হিলয়াতুল আওলিয়া ২/২০৭।
[17]. ইবনুল মুবারক, আয-যুহুদ, পৃঃ ৪৫-৪৬।
[18]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/১১৭; ছিফাতুছ ছাফওয়াহ ৩/৩৩৯।
[19]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৯৪।
[20]. তারীখু বাগদাদ ১০/১৬৭।
[21]. বুস্তানুল খতীব, পৃঃ ২৪।
[22]. নাসাঈ হা/১৯৫৩; হাকিম হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, যাহাবী বলেছেন, হাদীছটি মুসলিমের শর্ত মুতাবেক বর্ণিত।
[23]. হিলয়াতুল আওলিয়া ৮/২৭০।
[24]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১৫/৪৬৪-৪৬৫।
[25]. মুসনাদ ইবনুল জা‘দ, হা/১২৪৬, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৬/২০।
[26]. ইমাম আহমাদ, আয-যুহদ, পৃঃ ২৬২।
[27]. হিলয়াতুল আওলিয়া ২/৩৪৭।
[28]. হিলয়াতুল আওলিয়া ২/৩৪৭।
[29]. যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৭/১৬৯; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১৭/৬৬।
[30]. তাহযীবুল কামাল ২০/৩৯২; ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক ৪১/৩৮৩-৩৮৪।