ভূমিকা :
অল্প আমলও ইখলাছের সাথে করা হ’লে তা কবুল হবে আর বেশী আমলে যদি ইখলাছ না থাকে তাহ’লে কোন লাভ নেই। মোটকথা আমল যতই কম হোক তা ইখলাছের সাথে করতে হবে।
ইখলাছ অবলম্বন বড় কঠিন কাজ। অনেক ক্ষেত্রে ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ও জিহাদের চেয়ে ইখলাছ অবলম্বন খুব কঠিন। কোন কাজের শুরুতে ইখলাছের উপর থাকার দৃঢ় সংকল্প করেও ইখলাছের উপর অটল থাকা যায় না।
এমনও দেখা গেছে যে, কোন ব্যক্তি ইখলাছ অবলম্বনের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলেন। পরে নিজেকে প্রশ্ন করলেন তুমি যে এত সুন্দর করে এতক্ষণ ইখলাছ সম্পর্কে বক্তব্য রাখলে তা কি ইখলাছের সাথে করেছ? না অন্য কোন নিয়ত ছিল? আমানতদারির সাথে এ প্রশ্নের উত্তর দিলে দেখা যাবে আসলে ইখলাছের এ আলোচনা ইখলাছের সাথে হয়নি। অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল; লোকেরা কমপক্ষে তাকে মুখলিছ ভাববে অথবা অন্য কাউকে জব্দ করা যাবে কিংবা উপস্থিত সুধীজন জানবে আমি এ বিষয়ে বেশ পন্ডিত ইত্যাদি ভাবনা তার ভিতর ক্রিয়াশীল ছিল।
কোন কাজের শুরুতে ইখলাছ অবলম্বন একটা কঠিন কাজ। আবার ইখলাছের মাধ্যমে নিয়তটা ঠিক করে নিলে এর উপর অটল থাকা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বার বার এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। একবার তিনি বললেন,
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِىْ مِنَ الْمَسِيْمِ الدَّجَّالِ؟ فَقُلْنَا بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: اَلشَّرْكُ الْخَضُّ أَنْ يَّقُوْمَ الرَّجُلُ فَيُصَلَّىَ فَيَزِيْدَ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظْرِ رَجُلٍ.
‘আমি কি তোমাদের এমন বিষয় সম্পর্কে অবহিত করব না যাকে আমি দাজ্জালের চেয়ে বেশী ভয় করি? আমরা বললাম, অবশ্যই আপনি আমাদের বলে দিবেন। তিনি বললেন, তা হ’ল সূক্ষ্ম শিরক, যা এমন যে, কোন ব্যক্তি ছালাত আদায় করতে দাঁড়িয়ে যায় আর খুব সুন্দর করে ছালাত আদায় করে কিন্তু মনে মনে অন্যকে দেখানোর ভাবনা লালন করে’।[1] দাজ্জালের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকা কত কঠিন! রিয়া বা লোক দেখানো ভাবনা থেকে মুক্ত থেকে ইখলাছের উপর অটল থাকা এর চেয়েও কঠিন।
ইখলাছের পরিচয় :
আভিধানিক অর্থে ইখলাছ হ’ল কোন বস্তুকে খালি করা বা পরিস্কার করা। শরী‘আতের পরিভাষায় ইখলাছ দ্বারা উদ্দেশ্য কি তা নির্ণয়ে বিজ্ঞ আলেমদের মত ও মন্তব্য ভিন্ন ভিন্ন। কেউ বলেছেন, ইখলাছ হ’ল ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ্কে একক বলে গ্রহণ করা। যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন, وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا- ‘সে যেন তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)।
কারো মত হ’ল অন্তরকে পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত করে, এমন যাবতীয় নোংরামী ও অসুস্থতা হ’তে অন্তরকে পবিত্র করা। কারো মতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আল্লাহর আনুগত্যে আত্মনিবেদন। আবার কারো মত এই যে, ইখলাছ হ’ল আল্লাহ যা নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তা পালন করা। আর যা নিষেধ করেছেন তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তা থেকে বিরত থাকা।
ভাষার পার্থক্য থাকলেও সংজ্ঞাগুলোর মূল বক্তব্য একটাই। যে মৌলিক নীতিমালাকে কেন্দ্র করে আলেমগণ ইখলাছের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন, তা হ’ল- ইবাদত-বন্দেগী, সৎকর্ম বলতে যা কিছু আছে, সবই একমাত্র আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার জন্য সম্পাদন করার নাম ইখলাছ। আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ইবাদত করলে তাকে ইখলাছ বলে গণ্য করা হবে না। এমনিভাবে সকল পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার উদ্দেশ্য হবে কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করা।
ইবাদত ও কর্মসম্পাদন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন ও ইখলাছ আনয়নের বিভিন্ন রূপ হ’তে পারে। কেউ কেউ আল্লাহর ইবাদত করেন তাঁর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা জ্ঞাপনার্থে। অপর কেউ ইখলাছকে ভাবেন আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রবেশিকা হিসাবে। কারো উদ্দেশ্য থাকে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভ। অপর কেউ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সুনিবীড় সম্পর্ক ও পরম আস্বাদ লাভে প্রয়াসী, কিংবা পরকাল দিবসে মহান আল্লাহর সাক্ষাত লাভে প্রত্যাশী, যেদিন আল্লাহর সাক্ষাতে সারিবদ্ধ হবে বান্দাগণ। কারো কারো ইবাদতের লক্ষ্য থাকে যে কোন প্রকার পুরস্কার প্রাপ্তি। আবার কারো ইবাদতের লক্ষ্য নির্দিষ্ট কোন ছওয়াব লাভ। কেউ কেউ আল্লাহর ভয়ে ভীত হন নির্দিষ্ট কোন আযাবের কথা স্মরণ করে, অপর কেউ নির্দিষ্ট কোন আযাবের কথা স্মরণ করে নয়, আললাহ্কে ভয় করেন তার যে কোন আযাবের ভয়াবহ পরিণতির কথা চিন্তা করে।
ইবাদতে মানুষের ইচ্ছাবৃত্তির বৈচিত্র্য এক বিশাল অধ্যায়, একেক সময় তার মাঝে ক্রিয়াশীল থাকে একেক ধরনের ইচ্ছা। কখনো সে প্রণোদনা লাভ করে একাধিক ইচ্ছার দ্বারা। কিন্তু ইচ্ছার এ বৈচিত্র্যও একক এক লক্ষ্যের প্রতি সতত ধাবিত। বান্দা তার কাজ-কর্ম ও যাবতীয় মনোবৃত্তির দ্বারা একমাত্র আল্লাহ্কে পাওয়ার আকাঙ্খাকে তীব্র করে তোলে, অন্য কাউকে নয়। এ সবই ইখলাছেরই সত্যায়ন। এসব ইচ্ছা যার মাঝে ক্রিয়াশীল, সে-ই ছিরাতে মুস্তাকীমের অধিকারী, হেদায়াত ও বিশুদ্ধ লক্ষ্যপানে ধাবিত। তবে বান্দার উচিৎ তার ইবাদতকে আল্লাহপ্রেম, ভীতি ও আশা থেকে কখনো বিযুক্ত করবে না। কারণ ইবাদতের প্রতিষ্ঠাই এই ত্রিমাত্রিক লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে।
ইখলাছের মর্যাদা
প্রকৃতপক্ষে ইখলাছই হ’ল ইসলাম ধর্মের মূল বিষয়। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
وَمَا أُمِرُوْا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَآءَ وَيُقِيْمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِيْنُ الْقَيِّمَةِ-
‘তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে (ইখলাছের সাথে) একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, ছালাত কায়েম করবে এবং যাকাত প্রদান করবে। এটিই সঠিক দ্বীন’ (বাইয়িনাহ ৯৮/৫)।
আল্লাহ আরো বলেন,
قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّيْنَ-
‘বলুন, আমি ইখলাছের সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি’ (যুমার ৩৯/১১)।
فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّيْنَ- أَلَا لِلَّهِ الدِّيْنُ الْخَالِصُ-
‘আপনি ইখলাছের সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন। জেনে রাখুন, ইখলাছপূর্ণ ইবাদতই আল্লাহর জন্য’ (যুমার ৩৯/২-৩)।
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইখলাছপূর্ণ ইবাদতকেই তার জন্য স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। অল্প হোক কিংবা বেশী, বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র, যে কোন ধরনের শিরক হ’তে মুক্ত হ’তে আয়াতগুলো স্পষ্ট ঘোষণা করে যে, ইসলাম ধর্মে ইখলাছ এক গুরুত্বপূর্ণ শর্তের নাম। তাবৎ আম্বিয়া এ প্রক্রিয়ারই স্বীকৃতি বহন করেন। দ্বীনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, শরী‘আতের প্রতিটি অনুঘটনায় ইখলাছের অনুসন্ধান প্রমাণ করে ইখলাছের মর্যাদা ও গুরুত্ব।
ইখলাছ নবী-রাসূলদের দাওয়াতের কুঞ্জিকা, যে নীতিমালা নিয়ে তারা আগমন করেছেন তা মহোত্তম স্থানের অধিকারী। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُوا اللّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ-
‘আল্লাহর ইবাদত করার ও তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি’ (নাহল ১৬/৩)।
ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, এ আদেশ নিয়ে রাসূলগণ পৃথিবীতে আগমন করেন। নূহ (আঃ) যে জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, সে জাতির মাঝেই সর্বপ্রথম যখন শিরকের উৎপত্তি হয়, তখন তাকে মানবজাতির জন্য প্রথম রাসূল হিসাবে প্রেরণ করা হয়। সে ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে নবী মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে। যার দাওয়াত বিস্তৃত ছিল জিন-ইনসান ও পৃথিবীর সকল জাতির জন্য। পৃথিবীতে রাসূলরূপে আগত সকলের দায়িত্ব ছিল আল-কুরআনের ভাষায়-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِن رَّسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِيْ إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُوْنِ-
‘আমি তোমার পূর্বে এ আদেশ ব্যতীত কোন রাসূল প্রেরণ করিনি যে, আমি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/২৫)।
এ তাওহীদ ও ইখলাছ হ’ল ক্বলব বা হৃদয়ের মাঝে সর্বোচ্চ স্তরের। এটাই বান্দার কর্মের উদ্দেশ্য ও পরিমাণে মর্যাদায় সর্ববৃহৎ।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বক্তব্যটির ব্যাখ্যায় বলেন, যদি অঙ্গ-প্রতঙ্গের দ্বারা দাসত্ব করা হয় কিন্তু অন্তর ইখলাছ ও তাওহীদ থেকে শূন্য থাকে তবে সে যেন একটি মৃতদেহ, যার কোন রূহ নেই। নিয়ত হ’ল অন্তরের আমল (ইবনুল কাইয়িম, বাদাইয়ুল ফাওয়ায়েদ)।
ইখলাছ হ’ল ইবাদত কবুলের দু’ শর্তের একটি। ইখলাছ ব্যতীত কোন ইবাদত কবুল হবে না।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِى بِهِ وَجْهُهُ-
‘আল্লাহ তা‘আলা শুধু সে আমলই গ্রহণ করেন, যা ইখলাছের সাথে এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে করা হয়’।[2]
যারা আল্লাহর ব্যাপারে ইখলাছ অবলম্বন করেছে আল্লাহ তাঁর কালামে প্রশংসার সাথে তাদের কথা আলোচনা করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আঃ)-এর প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেন,
وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مُوسَى إِنَّهُ كَانَ مُخْلِصاً وَكَانَ رَسُوْلاً نَّبِيّاً-
‘স্মরণ কর, এ কিতাবে মূসার কথা, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে ছিল রাসূল’ (মারইয়াম ১৯/৫১)।
এমনিভাবে তিনি ইউসুফ (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন,
كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوْءَ وَالْفَحْشَآءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِيْنَ-
‘আমি তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা হ’তে বিরত রাখার জন্য এভাবেই নিদর্শন দিয়েছিলাম। সে ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত (ইখলাছ অবলম্বনকারী) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত (ইউসুফ ১২/২৪)।
এমনিভাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে বলেছেন,
قُلْ أَتُحَآجُّوْنَنَا فِي اللّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ وَلَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُخْلِصُوْنَ-
‘বল, আল্লাহ সম্পর্কে তোমরা কি আমাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হ’তে চাও? যখন তিনি আমাদের ও তোমাদের প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের ও তোমাদের কর্ম তোমাদের এবং আমরা তার প্রতি একনিষ্ঠ’ (ইখলাছ অবলম্বনকারী) (বাক্বারাহ ২/১৩৯)।
এ সকল আয়াত থেকে বুঝা যায় নবীগণের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ইখলাছ বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা।
অপরদিকে ইখলাছশূন্য ব্যক্তির জন্য এসেছে কঠোর হুঁশিয়ারী ও শাস্তির সংবাদ। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَّشَآءُ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এ শিরক ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। (নিসা ৪/৪৮)।
যারা শিরক করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা,
وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَّنْثُوْراً-
‘আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি লক্ষ করব অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরকান ২৫/২৩)।
আয়াতটি উল্লেখের পর ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর মন্তব্য এই যে, এ আয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামীন ব্যর্থ কাজ বলতে ঐ সকল কাজকে বুঝিয়েছেন, যা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে করা হয়নি অথবা তার পদ্ধতিতে করা হয়েছিল তবে একনিষ্ঠভাবে (ইখলাছের সাথে) আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হয়নি (মাদারিজু সালেকীন)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, মুশরিকরা রক্ষা লাভ ও শুভপরিণতির আশায় পার্থিব জীবনে যে কর্মসম্পাদন করেছে, তা যারপরনাই মূল্যহীন। কারণ ইখলাছ অথবা আল্লাহ প্রণীত বিধানের প্রতি আনুগত্য-শরী‘আতের এ দু’টি আবশ্যকীয় শর্তের কোনটিই তাতে উপস্থিত নেই। যে সকল কাজ খালেছভাবে আল্লাহর জন্য করা হয় না কিংবা শরী‘আতের অনুমোদিত পন্থায় পালন করা হয় না, তা বাতিল বলে গণ্য (তাফসীর ইবনে কাছীর)।
হাদীছে এসেছে,
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ اللهُ تَعَالَى: أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ مَعِىَ فِيْهِ غَيْرِىْ تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি শরীকদের শিরক থেকে একেবারেই অমুখাপেক্ষী। যদি কোন ব্যক্তি কোন আমল করে এবং এতে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে তাহ’লে আমি তাকে ও তার শিরকী কাজকে প্রত্যাখ্যান করি’ (মুসলিম)।
অন্য একটি হাদীছে এসেছে,
قََالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيْبَ بِهِ عَرْضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِرِيْحَهَا يَعْنِى-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে জ্ঞান অর্জন করা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তা যদি কেউ পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে করে তাহ’লে সে কিয়মাত দিবসে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না’।[3]
হাদীছে আরো এসেছে,
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءِ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوْهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করবে আলেমদের উপর প্রাধান্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে অথবা মূর্খদের সাথে অহমিকা প্রদর্শনের জন্যে কিংবা মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[4]
সুতরাং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যাবতীয় ইবাদতের ক্ষেত্রেই ইখলাছ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বান্দার কিছু আমল হবে ইখলাছে পূর্ণ, কিছু হবে শূন্য, কিছু মু‘আমালায় ইখলাছ হবে তার আদর্শ, অপরকিছু মু‘আমালা হবে ইখলাছ হ’তে বিচ্যুত। এটা খুবই গর্হিত বিষয়, এটা কখনো শরী‘আত মোতাবেক স্বীকৃত নয়। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) ইখলাছের গুরুত্ব ও অবস্থান বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, ইখলাছ ও আনুগত্য শূন্য আমল তুলনীয় এমন মুসাফিরের সাথে, যে অকাজের ধুলোয় পূর্ণ করেছে তার থলে এবং প্রচুর কলান্তি ও ঘর্মাক্ত দেহে অতিক্রম করছে মরুভূমির পর মরুভূমি, তার জন্য এ সফর নিশ্চয়ই নিস্ফল ও শুভপরিণতি শূন্য (বাদাইয়ুল ফাওয়ায়িদ)।
ইখলাছ একটি কঠিন কাজ:
ইখলাছের গুরুত্ব ও মর্যাদা সত্ত্বেও আমরা বলব, নিঃসন্দেহে ইখলাছ নফসের জন্য কঠিন একটি বিষয়। কারণ নফস এবং প্রবৃত্তি ও নফসের আকাঙ্খার মাঝে ইখলাছ এক কঠোর দেয়াল ও বাধা হয়ে নিজেকে উপস্থিত করে। নিজ প্রবৃত্তি, সামাজিক অবস্থা ও শয়তানের কুমন্ত্রণা মুকাবিলা করে ইখলাছ ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর উপর অটল থাকতে সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। এ সংগ্রাম শুধু সাধারণ মানুষ করবে তা কিন্তু নয়; বরং আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, ইসলামী আন্দোলনের কর্মী, ইসলাম প্রচারক ও নেককার-মুত্তাকী সকলের প্রয়োজন। সূফইয়ান আছ-ছাওরী বলেন, আমার কাছে নিজের নিয়ত ঠিক করার কাজটা যত কঠিন মনে হয়েছে অন্য কোন কাজ আমার জন্য এত কঠিন ছিল না। কতবার নিয়ত ঠিক করেছি কিন্তু কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার পাল্টে গেছে (খতীব বাগদাদী, আল-জামে লি আখলাকির রাবী ওয়া আদাবুস সামে)।
ইউসুফ ইবনে হুসাইন রাযী বলেন, দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ হ’ল ইখলাছের উপর অটল থাকা। আমি আমার অন্তর থেকে রিয়া (লোক দেখানো ভাবনা) দূর করার জন্য কত প্রচেষ্টা চালিয়েছি, সে দূর হয়েছে বটে তবে আবার ভিন্ন আকৃতিতে, ভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়েছে। (ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম)।
সাহল ইবনু আব্দুল্লাহকে প্রশ্ন করা হ’ল, আপন প্রবৃত্তির নিকট কঠিনতম কর্ম কি? তিনি বললেন, ইখলাছ। কেননা প্রবৃত্তি কখনো ইখলাছ গ্রহণ করতে চায় না (ইবনুল জাওযী, সফওয়াতুস সাফওয়াহ)।
তাই মন্দকর্মে প্রণোদনাদাতা নফস বান্দার কাছে ইখলাছকে মন্দরূপে উপস্থাপন করে, দৃশ্যমান করে তোলে এমন রূপে, যা সে ঘৃণা করে মনেপ্রাণে। সে দেখায়, ইখলাছ অবলম্বনের ফলে তাকে ত্যাগ করতে হবে বিলাসী মনোবৃত্তির দাসত্ব, যে তোষামোদী স্বভাব ও মেনে নেয়ার দুর্বলতা মানুষকে সমাজের সকল শ্রেণীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ব্যাপক অবদান রাখে, তাও তাকে ছিন্ন করতে হবে আমূলে। সুতরাং বান্দা যখন তার আমলকে একনিষ্ঠতায় নিবিষ্ট করে, আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কেউ তার কর্মের উদ্দেশ্য হয় না, তখন বাধ্য হয়েই বিশাল একটি শ্রেণীর সাথে তাকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়, তারাও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, একে অপরের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়।
এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিকাংশ সময় এ দো‘আ পাঠ করতেন,
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِّ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَى دِيْنِكَ.
‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তর আপনার দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন’।৫
[চলবে]
ফয়ছাল বিন আলী আল-বাদানী
অনুবাদ : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
[1]. ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/৫৩৩৩, সনদ হাসান।
[2]. নাসাঈ হা/৩১৪০, হাদীছ ছহীহ।
[3]. আবূদাঊদ হা/৩৬৬৪; ইবনু মাজাহ হা/২৫২, হাদীছ ছহীহ।
[4]. তিরমিযী হা/২৬৫৪, হাদীছ হাসান।
৫. তিরমিযী হা/৩৫২২।