রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে পানি পান এবং আধুনিক বিজ্ঞান

বলা হয় স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। আর স্বাস্থ্য গঠনে পানি হ’ল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পানি এমন একটি উপাদান যা ব্যতীত জীবন ধারণ অসম্ভব। মানুষের শরীরের ৬০-৭৫ ভাগ অংশ পানি দ্বারা গঠিত। আল্লাহ বলেন, أَلَمْ نَخْلُقْكُمْ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ ‘আমরা কি তোমাদেরকে সৃষ্টি করিনি নিকৃষ্ট পানি হ’তে?’ (মুরসালাত ৭৭/২০)। তিনি আরো বলেন,وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَرًا فَجَعَلَهُ نَسَبًا وَصِهْرًا وَكَانَ رَبُّكَ قَدِيرًا- ‘তিনিই মানুষকে পানি হ’তে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বিবাহগত সম্পর্ক নির্ধারণ করেছেন। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান’ (ফুরক্বান ২৫/৫৪)

আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিয়েছেন যে, পানি দ্বারাই মানুষের সৃষ্টি। তাই মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি, গঠন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যাদি সম্পাদনের জন্য পানি অপরিহার্য। আর পানযোগ্য পানির প্রধান উৎস হ’ল পাহাড়-পর্বত। আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ شَامِخَاتٍ وَأَسْقَيْنَاكُمْ مَاءً فُرَاتًا، ‘আর আমরা তাতে স্থাপন করেছি সুউচ্চ পর্বতমালা এবং তোমাদেরকে পান করিয়েছি সুপেয় পানি’ (মুরসালাত ৭৭/২৭)

আমরা সকলে জানি আমাদের বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। প্রশ্ন হ’ল- কেবল বিশুদ্ধ পানি পান করলেই কি শরীর সুস্থ থাকবে? নাকি সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম-পদ্ধতি মেনে পানি পান করতে হবে? ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে পৃথিবীতে সকল বস্ত্ত ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতি। পানি পান করারও রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম। আমরা যদি এই নিয়মের ব্যতিক্রম করি তবে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কিভাবে পানি পান করতে হয় তা শিখিয়েছেন। এক্ষণে আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতী পদ্ধতিতে পানি পান করলে কি উপকার লাভ হবে এবং না করলে কি ক্ষতির সম্মুখীন হ’তে হবে তা জানার চেষ্টা করব।-

দাঁড়িয়ে পানি পান না করা :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, نَهَى أَنْ يَشْرَبَ الرَّجُلُ قَائِمًا، ‘নবী করীম (ছাঃ) দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন।[1] অর্থাৎ দাঁড়িয়ে পানি পান করলে ক্ষতির সম্মুখীন হ’তে হবে। যেমন-

১. বদহজম : দাঁড়িয়ে পানি পান পরিপাকতন্ত্রকে ধ্বংস করতে পারে। কারণ আমরা যখন দাঁড়িয়ে পানি পান করি, তখন তা প্রচন্ড শক্তি ও গতির সঙ্গে খাদ্যনালীর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে এবং সরাসরি নীচের পেটে গিয়ে পড়ে, যা ক্ষতিকর। ফলে এর কারণে বদহজম হ’তে পারে।

২. ট্রিগার আর্থ্রাইটিস : দাঁড়িয়ে পানি পান করাবস্থায় স্নায়ুগুলি উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থায় থাকে, যা শরীরে তরলের ভারসাম্যকে ব্যাহত করে। যার ফলে শরীরে টক্সিন এবং বদহজম বৃদ্ধি পায়। এটি জয়েন্টগুলোতে তরল জমা করে এবং আর্থ্রাইটিসকে ট্রিগার করে। ডাঃ রুস্তগি বলেছেন, ‘দাঁড়িয়ে পানি পান করলে জয়েন্টে তরল জমা হ’তে পারে এবং বাতের সমস্যা এবং জয়েন্টের ক্ষতি হ’তে পারে’।

৩. ফুসফুসের ঝুঁকি বাড়ে : দাঁড়িয়ে পানি পান করলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও ভিটামিন লিভার ও পরিপাকতন্ত্রে সঠিকভাবে পৌঁছায় না। আমরা যখন দাঁড়িয়ে পানি পান করি তখন পানি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে খুব দ্রুত প্রবাহিত হয় এবং তা ফুসফুস এবং হার্টের কার্যকারিতাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলে। কারণ এইভাবে পানি পান করলে অক্সিজেনের মাত্রা ব্যাহত হয়।

৪. কিডনির সমস্যা : গবেষণায় জানা গেছে যে, আমাদের কিডনী বসে থাকা অবস্থায় ভাল ফিল্টার করে। দাঁড়িয়ে পানি পান করার সময়, উচ্চ চাপে তরল কোন পরিস্রাবণ ছাড়াই পেটের নীচের দিকে চলে যায়। এর ফলে পানির দূষিত কণা মূত্রাশয়ে জমা হয় এবং কিডনির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় মূত্রনালীতে পাথর জমতে পারে।[2]

উপরোক্ত সমস্যাগুলো হ’তে বাঁচতে হ’লে দাঁড়িয়ে নয়, বরং বসে পানি পান করতে হবে।

তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা :

তিন নিঃশ্বাসে অর্থাৎ ধীরে ধীরে পানি পান করতে হবে।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ إِذَا شَرِبَ تَنَفَّسَ ثَلاَثًا وَقَالَ‏ "‏هُوَ أَهْنَأُ وَأَمْرَأُ وَأَبْرَأُ ‘নবী করীম (ছাঃ) তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করতেন এবং বলতেন, এভাবে পানি পান করলে তৃষ্ণা উত্তমরূপে নিবারিত হয়, খাদ্য অধিক হজম হয় এবং স্বাস্থ্য ভাল থাকে’।[3]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করতে বলেছেন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে দৈনিক গড়ে ৩.৭ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। যা মূলতঃ সে সারাদিনে যত পরিমাণ স্বাভাবিক পান করে, যত ধরনের শরবত পান করে এবং যে খাদ্য সে ভক্ষণ করে তা হ’তে আসে। আবার একজন মানুষ যখন পানি গিলে খায়, সাধারণত প্রায় ৫০-১০০ মি.লি. পানি প্রতি ঢোকে গিলে খাওয়ার সাথে সাথে খাদ্যনালী এবং পেটে প্রবেশ করে। তবে চুমুকের আকার এবং গিলে ফেলার ধরনের উপর ভিত্তি করে এর পরিমাণ কমবেশী হয়। আবার কোনকিছু গিলার সময় ০.৫-১.৫ মিলি মুখের লালা খাদ্যনালী দিয়ে পেটে প্রবেশ করে। এই লালা খাদ্য হজমে সহায়তা করে।

লালায় অ্যামাইলেজ নামক এনজাইম রয়েছে, যা হজমের প্রাথমিক পর্যায়ে ভূমিকা পালন করে। অ্যামাইলেজ জটিল কার্বো-হাইড্রেটগুলিকে সহজ শর্করাতে ভেঙ্গে দেয়। যখন আমরা খাদ্য গ্রহণ করি, তখন লালা আমাদের মুখের খাবারের সাথে মিশে যায় এবং লালার মধ্যে থাকা অ্যামাইলেজ এনজাইম খাদ্যের মাল্টোজ এবং ডেক্সট্রিন নামক স্টার্চ ভেঙ্গে ফেলতে সহায়তা করে।

এই এনজাইমেটিক হজম খাদ্যের রাসায়নিক ভাঙ্গনের একটি অংশ যা পাকস্থলীতে পৌঁছানোর আগে মুখের মধ্যে ঘটে। একবার খাবার গিলে ফেলা হ’লে এটি পরিপাকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে চলে যায় এবং অন্যান্য পাচক এনজাইম এবং পাকস্থলীর অ্যাসিডের সাহায্যে পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্ত্রে আরো হজম ক্রিয়া চালাতে থাকে।

তাই পানি একেবারে পান না করে ধীরে ধীরে পান করা উচিত। যখন তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করা হবে, তখন পানি ধীরে ধীরে পেটে পৌঁছবে এবং এতে অধিক পরিমাণ লালা পেটে যাওয়ার সুযোগ পাবে। ফলে আমাদের হজম ক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে।[4]

বোতল জাতীয় পাত্রের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান না করা :

অনেকে পানি পান করার সময় বোতলের মুখে মুখ লাগিয়ে পান করে। এরূপভাবে পানি পান করতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, نَهَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الشُّرْبِ مِنْ فِي السِّقَاءِ وَعَنْ رُكُوبِ الْجَلاَّلَةِ وَالْمُجَثَّمَةِ، ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মশকের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতে, অপবিত্র বস্ত্ত ভক্ষণকারী জানোয়ারের পিঠে আরোহণ করতে এবং তীর বিদ্ধ পশুর গোশত ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন।[5]

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,نَهَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ اخْتِنَاثِ الأَسْقِيَةِ أَنْ يُشْرَبَ مِنْ أَفْوَاهِهَا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মশক উল্টিয়ে ধরে এর মুখে মুখ লাগিয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন’।[6]

আমরা জেনেছি যে, মুখের লালার গুরুত্ব এবং তা কিভাবে হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। যখন বোতলজাতীয় পাত্র উল্টিয়ে ধরে মুখে মুখ লাগিয়ে পানি পান করা হয় তখন পানি সরাসরী পাকস্থলিতে গিয়ে পড়ে এবং পানির সাথে মুখের লালার মিশ্রণ হয় না। এভাবে পানি পান করলে শরীরের ভিতরে উৎপন্ন হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাইরে বের হ’তে পারে না এবং তা পানির সাথে মিশে কার্বনিক এসিড তৈরী করে। ফলে খাদ্য হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। তাই মশক বা বোতল উল্টিয়ে ধরে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে পানি পান করা স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর।

পাত্রের মধ্যে ফুঁ না দেওয়া বা নিঃশ্বাস না ফেলা :

অনেকে পানি পান করার সময় পাত্রে নিঃশ্বাস ফেলে বা গরম পানীয় পান করার সময় বা গরম খাবার ঠান্ডা করার জন্য ফুঁ দিয়ে থাকে। এরূপ নিঃশ্বাস ফেলতে বা ফুঁ দিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, نَهَى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُتَنَفَّسَ فِي الإِنَاءِ أَوْ يُنْفَخَ فِيهِ ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পাত্রের মধ্যে শ্বাস ফেলতে এবং তাতে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন’।[7]

আমরা যখন পানি পান করি তখন পানিকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য ভিতর থেকে গ্যাস বের হয় যা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন পানিতে নিঃশ্বাস ফেলা হয় বা ফুঁ দেওয়া হয় তখন সেই নিঃশ্বাসে বা ফুঁ-এর সাহায্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বোনিক এসিড উৎপন্ন করে এবং এই এসিড পানির সাথে পেটে প্রবেশ করে। যখন এই কার্বোনিক এসিড পেটে প্রবেশ করে তখন পেটে গ্যাস উৎপন্ন হয়, যার ফলে পেট ফেঁপে যায়। যা আমাদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই এসিডের কারণে আমাদের হজম ক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং খাদ্য পাকস্থলি হ’তে ক্ষুদ্রান্ত্রে যেতে অনেক সময় নেয়। এসকল কারণে পেট ফেঁপে গিয়ে আমাদের অস্বস্থি অনুভূত হয়।

অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত মোতাবেক পানি পান করলে অর্থাৎ বসে, তিন নিঃশ্বাসে পানি পান করলে এবং পানির মধ্যে নিঃশ্বাস বা ফুঁ না দিলে এই পানি আমাদের হজমে সহায়তা করবে এবং স্বাস্থ্য ভাল থাকবে ইনশাআল্লাহ। অপরদিকে এইভাবে পানি পান না করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ত হবে না কিন্তু নিয়মিত এই সুন্নাত বিরোধী পদ্ধতিতে পানি পান করার কারণে তা একসময় বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন!


[1]. আবূদাউদ হা/৩৬৭৫

[2]. Dr. Vipul Rustgi, general physician, Apollo Spectra, Delhi.

[3]. আবূদাউদ হা/৩৬৮৫

[4]. The Economic Times, 18 march, 2018.

[5]. আবূদাউদ হা/৩৬৭৭

[6]. ছহীহ মুসলিম হা/৫১০০

[7]. আবূদাউদ হা/৩৬৮৬






ঈছালে ছওয়াব : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
চিন্তার ইবাদত (শেষ কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ইসলাম ও গণতন্ত্র - ডাঃ মুহাম্মাদ আব্দুল হাফীয, চাঁপাই নবাবগঞ্জ
মানবাধিকার ও ইসলাম (১২তম কিস্তি) - শামসুল আলম
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
কুরআনের বঙ্গানুবাদ, মুদ্রণ প্রযুক্তি ও ঊনিশ শতকের মুসলিম সমাজে এর প্রভাব - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (২য় কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামীদের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য (৪র্থ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
শায়খ আলবানীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু মন্তব্য (১ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (১ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.