যে বাবা-মা একসময়ে নিজে না খেয়ে সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায়, কেমন আছেন, সেই খবর নেয়ার সময় যার নেই, তার নিজের সন্তানও হয়তো একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। বিভিন্ন উৎসবে, যেমন ঈদের দিনেও যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের বাবা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যান, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাপনের পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। কোন পিতা-মাতার ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হ’তে হবে। প্রত্যেক বাবা-মার জন্য তৈরি করতে হবে একটি নিরাপদ ও সুন্দর আশ্রয়। প্রতিটি বাড়ি যেন হয় উন্নত মানের বৃদ্ধাশ্রম। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, বৃদ্ধাশ্রম থেকে বৃদ্ধ মা-বাবার চিঠি তার ব্যস্ত সন্তানদের কাছে। হাযারো আবেগ অভিমানের চিঠি পড়লে চোখে পানি এসে যায়। তারপরও সন্তানদের একটু সময় হয় না সেই চিঠিগুলোর উত্তর লেখার। হয়তো চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় থেকেই অনেক বৃদ্ধ বাবা-মা পৃথিবীর হিসাব-নিকাশের খাতাটা বন্ধ করে পরপারে পাড়ি জমান। হয়ত এক সময়ে সন্তান ভুল বুঝতে পারবে কিন্তু তখন আর কোন উপায় থাকবে না। তাই নিম্নে কিছু গল্প সংযোজন করা হ’ল।-
(১) এক বৃদ্ধা মা তার ছেলে, ছেলের বউ ও ছয় বছরের এক নাতীর সাথে বসবাস করত। বৃদ্ধা মা খুবই দুর্বল ছিলেন। তিনি ঠিকভাবে হাঁটতে পারতেন না, চোখে কম দেখতেন, তার হাত কাঁপতো, ঠিক মতো কিছু ধরতে পারতেন না। পরিবারের সকলে যখন একসাথে খেতে বসতেন তখন প্রায়ই কোন না কোন অঘটন ঘটে যেত। কোন দিন হাত কাঁপতে কাঁপতে দুধের গ্লাস ফেলে টেবিল নষ্ট করতেন, আবার কোনদিন ফ্লোরে তরকারী ফেলে দিতেন। প্রতিদিন খাওয়ার সময় এরকম ঝামেলা হওয়ায় ছেলে তার মায়ের জন্য আলাদা টেবিল বানিয়ে ঘরের কোণায় সেট করে দিল। বৃদ্ধা মা সেখানে একা বসে খেতেন আর একা একা চোখের পানি ফেলতেন। ছোট নাতীটি এসব নীরবে দেখছিল। একদিন বৃদ্ধা মা কাঁচের প্লেট ভেঙ্গে ফেললেন। এজন্য ছেলেটি তার মাকে একটি কাঠের প্লেট বানিয়ে দিল।
একদিন বিকেলে বৃদ্ধার ছেলেটি দেখল তার বাচ্চা ছেলেটি কাঠের টুকরা দিয়ে কি যেন বানাতে চাচ্ছে। বাবা তার ছেলের কাছে জানতে চাইল, বাবা কি করছো? তখন শিশুটি বলল, আমি একটি টেবিল ও কাঠের প্লেট বানাচ্ছি। যখন আম্মু বুড়ো হবে তখন কিসে খাবে! তাই আগে থেকেই বানিয়ে রাখছি। একথা শুনে ছেলে তার ভুল বুঝতে পারল যে, বৃদ্ধ হ’লে তার সন্তানও তার সাথে এমন আচরণ করবে। তাই সে তার স্ত্রীকে বলল, এখন থেকে আমরা দু’জন প্রতিদিন মাকে খাওয়ায়ে তারপর খাব। প্রতিদিনের মতো খাবারের সময় হ’ল, ছেলে মাকে আনতে মায়ের বিছানায় গেল। কিন্তু গিয়ে দেখল, তার গর্ভধারিনী মা ইহকাল পাড়ি দিয়ে পরপারে চলে গেছেন (ইন্নালিল্লাহ)। তাদের আর ভাগ্যে হ’ল না একত্রে বসার।
(২) ম্যানেজার আবু শরীফ একটি গল্প শুনালেন। তিনি বলেন, জনৈক ছেলে তার বৃদ্ধা মাকে বাড়ির বোঝা মনে করে ঝাকায় করে এক জঙ্গলে২২র ধারে ফেলে দিয়ে আসল। সেখান থেকে এসে হাতের ঝাকাটা ফেলে দেওয়ার জন্য পাশের নর্দমার দিকে যাচ্ছিল। তার ছোট্ট ছেলে বলল, বাবা ওটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? বাবা বলল, এটার কাজ শেষ হয়েছে তাই ফেলে দিতে যাচ্ছি। ছেলে বলল, না বাবা ওটা ফেলে দিও না বরং যত্ন করে রেখে দাও। তোমরা বৃদ্ধ হ’লে তো ওটা আমার লাগবে। কথা শুনে লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল এবং বুঝতে পারল যে, আমরাও বৃদ্ধ হ’লে হ’তে পারে এমন অবস্থা। তাই দৌঁড়ে গিয়ে সযত্নে মাকে বাসায় ফিরিয়ে আনল।
(৩) অসহায় মা তার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বাস করেন শহরে। ছেলে জ্ঞানবুদ্ধি হওয়া অবধি দেখে আসছে তার মায়ের একটা চোখ নেই। এজন্য মাকে দেখতে কুৎসিত দেখায়। এ নিয়ে স্কুলে তার বন্ধুরা হাসাহাসি করে। একদিন মা স্কুলের পাশ দিয়ে কোথাও যাওয়ার সময়, ছেলেকে দেখতে স্কুলে গেলেন। ছেলে লজ্জায় অন্ধ মায়ের সাথে দেখা করতে এল না। মা কিছু না বলে ফিরে এলেন। ছেলে এক সময় বড় হ’ল। পড়ালেখা শেষ করে চাকুরি নিল। বিয়ে শাদী করে আলাদা হয়ে গেল। মায়ের সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখল না। খোঁজ-খবরও নিল না। অনেক দিন পর ছেলে তার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনীর দাওয়াত পেয়ে আসল। কি মনে করে সে আগের এলাকা দেখতে এলো। এই ফাঁকে মা কেমন আছে সেটাও দেখা হয়ে যাবে। যে ভাড়া বাড়িতে মা থাকতেন সেখানে এসে দেখল, এখন সেই বাড়িতে অন্য ভাড়াটিয়া থাকে। পাশের বাড়ির মায়ের বয়সী এক মহিলা ছেলেটিকে দেখে বের হ’লেন। ছেলেটিকে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, এটা তোমার মা মারা যাওয়ার আগে তোমাকে দিতে বলে গেছেন। চিঠিটাতে লেখা ছিল,
‘বাবা! আমি জানি আমার একটা চোখ না থাকাতে আমাকে ভারি কুৎসিত দেখাতো। সেজন্য অন্যদের মতো তুমিও আমাকে পসন্দ করতে না। আমার চোখ না থাকার কারণটা জানলে নিশ্চয়ই তুমি আর আমাকে ঘৃণা করতে পারতে না। তুমি তখন ছোট। তোমার আববা, আমি আর তুমি অন্য এক শহরে থাকতাম। একদিন এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তোমার আববা মারা যান। আমিও গুরুতর আহত হই। আর তোমার একটা চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তখন আমার একটি চোখ তোমাকে দিয়ে দিই। এরপর আমরা এই শহরে চলে আসি। এই ঘটনা আর কেউ জানে না, আমি আর কাউকে বলিনি।
হায়! এমনই হয় মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এতো একটি উদাহরণ মাত্র। মায়ের ভালোবাসা সন্তানের জন্য হাযারগুণ বেশী। এমন মাকেও মানুষ ভুলে যায়। বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। হায় মানবতা! হায়রে মানুষ!! আমরা কেন বুঝি না, আজকের যুবক ক’দিন পরেই বার্ধক্যে পা দেবে। এটাই জীবনের ধর্ম। আমি কি ভেবে দেখেছি, আমি বৃদ্ধ হ’লে আমার আশ্রয় কোথায় হবে, যখন আমি আমার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখেছি। তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক আমাদের সবার ঠিকানা।
(৪) বাবা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে গ্রামের নদীর উপর তৈরী বাঁশের সাঁকো পার হচ্ছিলেন। মেয়ের জন্য বাবা ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি মেয়েকে বললেন, ‘মা! শক্ত করে আমার হাত ধর’। মেয়ে উত্তর দিল: ‘না বাবা, বরং আপনিই আমার হাত ধরুন’। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোমার হাত ধরা আর তুমি আমার হাত ধরার মধ্যে পার্থক্য কী? তুমি ধরলে যা হবে, আমি ধরলেও তো তাই হবে। মেয়ে বাবাকে বলল, ‘অনেক বড় পার্থক্য বাবা! যদি আমি আপনার হাত ধরি এবং সাঁকো পার হ’তে গিয়ে আমার কিছু হয়, তাহ’লে আমি ভয়ে আপনার হাত ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু আপনি যদি আমার হাত ধরেন, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যা-ই ঘটুক না কেন, জীবন গেলেও আপনি আমার হাত ছাড়বেন না!
আমরা যে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখছি শৈশবে তারাই কিন্তু ছিলেন আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল। গল্পের মেয়েটির মত আমরাও কিন্তু বাবা-মায়ের কোলে নিজেকে সবচেয়ে বেশী নিরাপদ মনে করতাম। আর আজ কি-না আমাদের সেই বাবা-মায়ের ঠিকানা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। তারাই আমাদের নিকট সবচেয়ে বেশী অনিরাপদ।
চ) আইনের প্রয়োগ : যে সকল পিতা মাতা সন্তানদের দ্বারা অবহেলিত তাদের ব্যপারে আইন প্রয়োগ করতে হবে। ২০১৩ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২৫ পৃষ্ঠা ব্যপী ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন’-এর খসড়া উপস্থান করেন। তাতে বিধিমালার বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এখানে পিতা-মাতা ও সন্তানের কিছু আচরণ বিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন:
পিতা-মাতার আচরণ বিধি :
১) নিজেদের প্রয়োজন ও অনুভূতিগুলো সন্তানদের একত্রিত করে অথবা আলাদাভাবে অবহিত করবেন।
২) উদ্ভূত কোন সঙ্কটের ক্ষেত্রে সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
৩) আলোচনায় সঙ্কটের সুরাহা না হ’লে পরিবার, বর্ধিত পরিবারের সদস্য বা স্থানীয় ভরণ-পোষণ সহায়ক কমিটির সহায়তা নেবেন।
৪) পরিবারের সব সদস্যদের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ এবং শিশুসহ সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করবেন।
৫) নিজস্ব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ সুরক্ষার চেষ্টা করবেন।
৬) নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য সঞ্চয় করবেন।
৭) নিজ নিজ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা বিষয়ক শিক্ষা সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবেন।
৮) শারীরিক সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের সেবা-যত্ন নিজেরাই নেওয়ার চেষ্টা করবেন।
৯) কোন প্রয়োজন সন্তান যদি তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে না পারে বা দেরি হ’লে যথাসম্ভব ধৈর্য্য ধারণ করবেন।
সন্তানের আচরণ বিধি:
১) পিতা-মাতার সঙ্গে সব সময় মর্যাদাপূর্ণ আচরণ ও যত্নসহকারে দেখভাল করতে হবে।
২) পিতা-মাতার মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।
৩) পিতা-মাতার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সেবা-শুশ্রুষা, পথ্য ও অন্যান্য উপকরণ যথাসম্ভব দ্রুত সরবরাহ করবে।
৪) পিতা-মাতার নিজস্ব সম্পদ বিনষ্ট করবে না এবং পিতা-মাতার আইনানুগ অধিকার সমুন্নত রাখবে।
৫) পিতা-মাতার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ নিশ্চিত করবে।
৬) ছলচাতুরির মাধ্যমে পিতা-মাতার সম্পদের যথেচ্ছা ব্যবহার করবে না।
৭) পিতামাতার সম্পদে অন্য উত্তরাধিকারদের অংশ আত্মসাতের চেষ্টা করবে না।
৮) পিতা-মাতার নিজস্ব সম্পদ না থাকলে তাদের দোষারোপ করবে না।
৯) পিতা-মাতার সুনাম, মর্যাদা ও পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে।
১০) আয়-রোজগারের সক্ষমতা অনুসারে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার লক্ষ্যে আপদকালীন সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করবে।
১১) পিতা-মাতার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে।
এছাড়াও
পিতা-মাতার অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা সেবার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকবে।
অন্যথায় পিতামাতা প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ জানালে উপযুক্ত প্রক্রিয়া
গ্রহণ করে ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।[1]
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বাধ্যতামূলক বিল পাশ করেছে সংসদে। তাদেরকে ভরণ-পোষণ না করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দুই মাস জেল। এ ধরনের অপরাধ যামীন অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। বর্ণিত বিলের আইন অনুযায়ী বাবা-মা আলাদা বসবাস করলে সন্তানের আয়ের ১০% বাবা-মাকে দিতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশ শুধু বাংলাদেশে নয় ভারতের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের আইনে উল্লেখ করেছেন, যেসব সরকারী কর্মচারীরা মা-বাবার দেখাশুনার ভার না নিবে তাদের বেতনের একটা অংশ কেটে নিয়ে তাদের পিতা-মাতার ব্যয়ভার বহন করা হবে।[2] কোন পরিচিত জনের দ্বারা পিতা-মাতার অবহেলার সংবাদ পেলে তাকে আইনের ব্যপারে অবহিত করতে হবে এতে কাজ না হ’লে আইন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। আইনটি বেশি বেশি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে, ফেইসবুকে শেয়ার করে গণ সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। বার্ধক্য ও প্রবীণদের সেবা বিষয়ক পোষ্টার, লিফলেট, সাময়িকী, জার্নাল, বই, পত্রিকা, গবেষণা প্রতিবেদন ইত্যাদি মুদ্রণ, প্রকাশ ও বিতরণ করতে হবে। বার্ধক্যবিষয়ক পরামর্শ সভা, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সম্মেলন ও সমাবেশের আয়োজন করতে হবে।
বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা :
বাংলাদেশে ষাট বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর অধিকাংশই মহিলা তথা জননী ‘যার পদতলেই সন্তানের জান্নাত’। আমাদের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২ বছর ৩ মাস ১৮ দিন। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ প্রবীণ।[3] দৈনিক কালের কন্ঠের এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণেরই কোন না কোন সন্তান বাইরে থাকে। এদের সাথে পিতামাতার যোগাযোগ খুব কম হয়। বাংলাদেশের শতকরা ২০ জন হয় একাকী থাকেন, না হয় বৃদ্ধ স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকেন। এদের দরিদ্র প্রবীণদের সংখ্যা শতকরা ৩৭ জন।[4] সামাজিক-পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধির ফলে তাঁদের জন্য ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। বাস্তবে এসব জননীকুলের অনেকের অবস্থা খুবই অসহায়, সন্তান পরিত্যক্তা। আমাদের বহুমুখী কর্মব্যস্ততায় পারস্পরিক দায়বদ্ধতা লোপ পাচ্ছে, আর মা-বাবা তথা প্রিয়জনের প্রতি বাড়ছে উপেক্ষা। সংসারের শতসহস্র সহযোগিতা, উপকার, মায়া-মমতা, ভালবাসা, সেণহ-সম্মান ভরা কোলাহলযুক্ত পরিবেশ যখন প্রতিকুলতার স্রোতে ভেসে চলে তখন তার পরিণতি হয় চরম দুঃখজনক ও লজ্জাকর। এমন পরিস্থিতিতে একজন মা-বাবা ঠাঁই হারায় নিজ পরিবারের নিকট থেকে। তার উপায় হয় বৃদ্ধাশ্রম নামক করাগারে। আমরা একসময় এটা আপত্তিকর ও আতঙ্কের স্থান মনে করতাম। এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। যখন গণমাধ্যমে হাইলাইট হয় ‘মেয়ে তীব্র শীতেই অমানবিকভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিল মা-বাবাকে।[5] ‘মাকে রেল স্টেশনে ফেলে গেলন বিসিএস কর্মকর্তা ছেলে’।[6] ‘ছেলে মেয়ে অস্ট্রেলিয়া আর মায়ের জায়গা বৃদ্ধাশ্রমে’।[7] ‘জমি লিখে নিয়ে বৃদ্ধা মাকে তাড়িয়ে দিল ছেলে’।[8] ‘গৌরনদী উপযেলার টরকী বাস স্ট্যান্ডে রাস্তার ধারে মাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় কুমিল্লার দুই কুলাঙ্গার সন্তান’।[9] ‘মা শ্যামলীকে সিরাজগঞ্জ স্টেশনে ফেলে রেখে পালিয়েছে ছেলে মেয়েরা’।[10] ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কেউ না নিয়ে পুত্র ও পুত্রবধু মিলে বাঁশবাগানের ভিতর ফেলে রাখে ৮৬ বছর বয়সী মা হুজলা বেগমকে’।[11] ইত্যাদি লোমহর্ষক হেড লাইন দেখে মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজনীয়তা হাসপাতালের মতই বরং তার চেয়েও বেশী।
এছাড়াও নিঃশ্ব, একাকী, পরিবারের স্বজনহারাদের ঠাঁই পেতেও বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন উন্নত পশ্চিমাবিশ্বে বৃদ্ধাশ্রম আছে। সেগুলোতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের লালন-পালন করা হয়। সার্বিক সেবা প্রদান করা হয়। কারণ পাশ্চাত্য দেশসমূহে ছেলে-মেয়ের বয়স ১৮ পেরিয়ে যাবার পর পিতা-মাতার সঙ্গে থাকার বা সম্পর্ক রাখার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। উপার্জন করে সে অর্থ পিতা-মাতাকে দেয়ার কোন বাধ্য বাধকতা নেই। কেউ তার মা-বাবার সঙ্গে থাকলে কিংবা টাকা-পয়সা দিলে দিতে পারে। এটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। ফলে সেখানকার প্রবীণরা জীবনের এক পর্যায়ে এসে চরম হতাশা ও অসহায়ত্বের শিকার হন। এ কারণেই বৃদ্ধাশ্রমের উদ্ভব ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক। যাদের কেউ নেই, কোন স্বজন নেই, তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম কাম্য ও প্রত্যাশিত।
বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ :
চারিদিকে অসংখ্য গাছ-বৃক্ষে আবৃত্ত ছায়ায় ঘেরা, মায়ায় ভরা গাযীপুরের বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেদ্রে অভাব নেই কোন কিছুর। একশত বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই কেন্দ্রটিতে রয়েছে উপযুক্ত খাবার, নিজস্ব পুকুরের মাছ, ফলজ বৃক্ষরাজী, চিকিৎসা, বিনোদন, বিশ্রামাগার, ইবাদতখানাসহ সকল প্রকার ব্যবস্থা। নিরাপত্তা প্রাচীরসহ বারশত লোক থাকার মত মহিলা পুরুষের আলাদা ভবন। পরিচ্ছন্ন কক্ষগুলোতে সারি সারি সাজানো আছে সিঙ্গেল খাট। বারান্দায় পাতা আছে এক সারি করে বেঞ্চ। সকল স্তরে সহযোগিতায় রয়েছে প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। সকল কিছুর ব্যয়ভার বহন করেন প্রতিষ্ঠাতা মুকুল চৌধুরী। এসব জায়গায় সকল কিছু পর্যাপ্ত থাকলেও শুধু অভাব মা-বাবা বা দাদা-দাদী বলে ডাকার মত একজন খোকা-খুকির। যার জন্য তারা এই সময়টা প্রবল মানসিক যন্ত্রণা ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অতিবাহিত করেন।
কেমন হওয়া উচিৎ বৃদ্ধাশ্রম :
১) শতভাগ সেবামূলক : অনেক সময় শোনা যায় বৃদ্ধাশ্রমে নানা ধরনের কষ্টের শিকার হয় প্রবীণরা। খাবারের মান খারাপ, বাসস্থান খারাপ, সুচিকিৎসার অভাবসহ নানা রকম সমস্যায় ভোগেন বৃদ্ধরা। বিশেষ করে সরকারী আশ্রমগুলোতে সমস্যা প্রচুর বলে জানা যায়। তারপরও আশ্রম ওয়ালারা হয় তো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। কিন্তু তাদের প্রদর্শিত ভালবাসা প্রবীণদের কাছে পরম কাম্য নয়। কারণ ওরা আপন নয়, ওরা পর। এরা যা প্রদর্শন করে তা কৃত্রিম। খাঁটি ও প্রাণোৎসারিত নয়। স্বজনদের ভালবাসাই তাদের কাম্য। বৃদ্ধাশ্রম শুরু থেকেই একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তাই বৃদ্ধাশ্রম গুলো যেন শতভাগ সেবামূলক হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসায়ী মনোভাব কিংবা দায়সারাভাব যেন বৃদ্ধাশ্রমের এ সেবামূলক কাজের স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট না করে দেয়।
বৃদ্ধাশ্রম যেহেতু বৃদ্ধ ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল, তাই সেবক-সেবিকারা যেন তাদের সাথে মমতা ও সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ করেন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। আসলে আমরা যদি এভাবে চিন্তা করি, এখানে যারা অবহেলিত হয়ে এসেছেন তারা তো অবশ্যই কোন না কোন সন্তানের পিতা-মাতা। আর আমরা যারা এখানে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছি কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে সেবার কাজে নিয়োজিত আছি আমরাও কিন্তু পিতা-মাতারই সন্তান। তাদের সাথে সন্তানসূলভ আচরণ করা এ শুধু সৌজন্যই নয় বরং মানবতার দাবীও বটে। তাই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে সেবার মান উন্নত হওয়া দরকার।
বৃদ্ধাশ্রম মানবতার কলঙ্কিত কারাগার, বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি এক নির্মম উপহাস- এ কথাগুলো যেমন সত্য তেমনি একথাও সত্য যে, বৃদ্ধাশ্রম বর্তমান সময়ের এক তিক্ত বাস্তবতা। সামাজিক, মানসিক ও আদর্শিক নানা পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। অবহেলিত হচ্ছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা।
এতে করে তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছেন। অবশেষে তাদের ঠাঁই নিতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে। তাই যারা সমাজের এই তিক্ত বাস্তবতাকে সামনে রেখে অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের জন্য নিজের উদ্যোগে, নিজ খরচে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করছেন, ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে বৃদ্ধদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। এক্ষেত্রেও দ্বীনদার বিত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার। সমাজে অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে তাদের জীবনের শেষ দিনগুলোতে একটু ভালবাসা, মায়া-মমতা ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে তারাও হ’তে পারেন অনেক বড় নেকীর অধিকারী। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللَّهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ.
‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের পার্থিব
কষ্টসমূহের একটি দূর করে দেয়, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট
দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে, আল্লাহ তা‘আলা
তার দুনিয়া ও আখেরাতের অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের
দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সহায়তায় থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহায়তায়
থাকে’।[12]
যারা অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধদের পিছনে নিজের অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয় করবে, এই হাদীছের মর্মের ব্যাপকতায় তারাও শামিল হবেন ইনশাআল্লাহ। যারা অসহায় বৃদ্ধদের কিংবা সন্তানদের কাছে অবহেলিত পিতা-মাতার সেবার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করছেন তাদের উচিত, এক সন্তানের কাছে অবহেলিত বাবা-মায়ের শেষ দিনগুলো যেন বৃদ্ধাশ্রমে ‘আরেক সন্তানের ঘরে’র মতই কাটে। বৃদ্ধাশ্রমগুলো যেন বাস্তব অর্থেই শেষ সময়ে তাদের আরাম-আয়েশের ভরসাস্থল হয়। সে দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
২) ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তোলা : বৃদ্ধাশ্রমে যারা আসেন তারা যেহেতু জীবনের শেষ সময়টা এখানে কাটান, তাই তাদের এই শেষ সময়টা যেন দ্বীনী পরিবেশে, ইবাদত-বন্দেগীতে ও তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমেই কাটে সে দিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। বৃদ্ধাশ্রমে যদি দ্বীনী পরিবেশ কায়েম করা যায় তাহ’লে এর মাধ্যমে তারা আত্মিক প্রশান্তিও লাভ করবেন। আত্মিক প্রশান্তি মানুষকে হতাশা, দুঃখ ও বেদনা থেকে মুক্তি দেয়। মানুষ কষ্টের মাঝেও এক অনাবিল সুখ খুঁজে পায়। এজন্য বৃদ্ধাশ্রমকে যদি দ্বীনী তা‘লীম ও ইবাদতের উপযোগী করে তোলা যায় তাহ’লে অন্তত শেষ জীবনে হ’লেও তারা নিজেদেরকে আখেরাতমুখী করে ঈমান-আমল নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারবেন। এতো একজন মুসলমানের জন্য মহা সফলতা।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাছরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জীবনের শেষ সময়ে আল্লাহ তা‘আলার হামদ ও তাসবীহ এবং বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফারের আদেশ করে উম্মতকে এ শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যেন জীবনের শেষ সময়ে বেশী বেশী আল্লাহ তা‘আলার হামদ ও তাসবীহ, যিকির-আযকার করেন, ইবাদত-বন্দেগীতে রত থাকেন। আল্লাহ তা‘আলার দরবারে বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার করেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা কর ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল’ (নাছর ৩)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,كُلُّ بَنِيْ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ، ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী। আর উত্তম ভুলকারী হচ্ছে তওবাকারীগণ’।[13] আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِيْنَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِيْنَ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদেরকে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে’ (বাক্বারাহ ২/২২২)।
বৃদ্ধ বয়সের অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে নিম্নের দো‘আ পাঠ করা যরূরী।- মুস‘আব ইবনু সা‘দ ও আমর ইবনু মায়মূন হ’তে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেন,
كَانَ سَعْدٌ يُعَلِّمُ بَنِيْهِ هَؤُلاَءِ الْكَلِمَاتِ كَمَا يُعَلِّمُ الْمُكَتِّبُ الْغِلْمَانَ وَيَقُوْلُ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَتَعَوَّذُ بِهِنَّ دُبُرَ الصَّلَاةِ-
‘সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) তার সন্তানদেরকে নিম্নোক্ত বাক্যগুলো এমনভাবে শিক্ষা দিতেন, যেমনভাবে মক্তবে শিক্ষক শিশুদেরকে শিক্ষা দেন। আর তিনি বলতেন, রাসূল (ছাঃ) ছালাতের পর এগুলো দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُ بِكَ مِنْ الْجُبْنِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ الْبُخْلِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ أَرْذَلِ الْعُمُرِ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا وَعَذَابِ الْقَبْرِ-
‘হে আল্লাহ! তোমার কাছে আমি ভীরুতা হ’তে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে কৃপণতা হ’তে আশ্রয় চাই, তোমার কাছে অতি বার্ধক্যে পৌঁছার বয়স হ’তে আশ্রয় চাই এবং তোমার কাছে দুনিয়ার ঝগড়া-বিবাদ ও কবরের শাস্তি হ’তে আশ্রয় চাই।[14]
উপসংহার :
বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবা শিশুদের মতো হয়ে যান। শিশুসুলভ আচরণ করেন। তারা যেমন করে আমাদেরকে শৈশব থেকে শুরু করে শত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে মানুষ করেছেন। আমাদেরও কতর্ব্য সেই মানুষগুলোকে জীবনের শেষ সময়টুকুতে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে না রেখে নিজের কাছে রেখে সেবা করা। মনে রাখা সমীচিন যে, আমরাও একদিন বৃদ্ধ হব। আমরা যদি আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি, আমাদের সন্তানরাও হয়তো একদিন আমাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। সুতরাং আমাদের উচিত বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে না রেখে নিজেদের কাছে রাখা, তাদেরকে ভালোবাসা, আমাদের শৈশবে তারা যেমনটি করেছিলেন। অতএব বৃদ্ধাশ্রম নয় নিজ আবাসস্থলই হোক মা-বাবার শেষ আশ্রয়স্থল। পিতা-মাতার মত এত অকৃত্রিম বন্ধু ও পরম দয়াবান আর কেউ নেই পৃথিবীতে। অন্যদের বন্ধুত্ব ও দয়ায় কোন স্বার্থ থাকলে থাকতেও পারে; কিন্তু পিতা-মাতার স্নেহ-মায়া ও দান-দয়ায় কোন স্বার্থ নেই। কোন কৃত্রিমতা ও লৌকিকতা নেই। সন্তানের প্রতি তাদের দরদ স্নেহ ও দয়া হয় নিখাঁদ, নির্মল, নিষ্কলুষ ও খাঁটি। সৃষ্টির মধ্যে তাদের মত দরদি আর কেউ থাকার প্রশ্নই আসে না। তারা নিজেদের খাওয়া-পরা, আরাম-আয়েশের চিন্তা না করে সন্তানের খাওয়া-পরা, আরাম-আয়েশের ফিকির করেন। এজন্য পরিশ্রম করেন। জীবনবাজি রাখেন। আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে ও জীবনের পরতে পরতে তাদের এত বিপুল অনুগ্রহ ও অবদান বিদ্যমান, যা কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। এর দাবী এটাই যে- আমরা তাদের ভালোবাসব, সম্মান করব, খেদমত করব। আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা করব। পবিত্র কুরআন-সুন্নাহও সেবা-যত্ন করে তাদের মন জয় করতে বলেছে। সন্তান তার পিতা-মাতার খেদমত করবে, তাদের ভরণ-পোষণ ও দেখভাল করবে, সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে- এটাই স্বভাব ও প্রকৃতির চাহিদা। মানবতার দাবী। ইসলামের বিধান ও স্রষ্টার নির্দেশ।
সন্তান যত বড় শিক্ষিত, জ্ঞানীগুণী আধুনিক আর প্রগতিশীলই হোক- সে যদি তার পিতা-মাতাকে মর্যাদা না দেয়, খেদমত না করে, খোঁজ-খবর না রাখে সে তো মানুষ নামের কলঙ্ক। অন্যান্য বহুবিধ গুণ তার থাকলেও মনুষ্যত্ব বা মানবতার গুণ থেকে সে বঞ্চিত। সন্তানের কাছে এমন অসদগুণ থাকা অবাঞ্ছিত ও অপ্রত্যাশিত। সন্তান কর্তৃক জনক-জননীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত খেদমতই মূল বিষয়। যে সেবার মধ্যে স্নেহ-মমতা আছে, সম্মান-শ্রদ্ধা আছে, সংবেদনশীল দরদ আছে- সেটিই খেদমত। সেটিই প্রত্যাশিত। যে সেবা এসব থেকে মুক্ত, সেটা খেদমত নয়। এমন খেদমতে পিতা-মাতা শান্তি পান না। সন্তুষ্ট হন না। নিজেদের বরং পরনির্ভরশীল, অন্যের ঘাড়ে বোঝা মনে করে কষ্ট পান। সন্তানের কাছ থেকে বর্ণিত অর্থে খেদমত পাওয়া- এ তো সন্তানের ওপর মা-বাবার অধিকার, হক্কুল ইবাদ। এটা সন্তানের কোন অনুগ্রহ নয়, দয়া-দাক্ষিণ্য নয়। এটা আদায় না করলে আল্লাহর আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে। তাই আসুন, বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করে পিতা-মাতা বা বৃদ্ধদের প্রতি সদাচরণ করি মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!!
[1]. http://www.sharebusiness 24.com; ৭ই জুলাই, ২০১৮।
[2] আলোকিত বাংলাদেশ, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭।
[3]. ইনকিলাব, ২৮ জুন ’১৯।
[4]. কালের কন্ঠ, ১৭ মে ২০১৭।
[5]. যমুনা টিভি, ৬ জানুয়ারী ১৮।
[6]. কালের কন্ঠ, ১ এপ্রিল ১৮।
[7]. স্বাধীন বাংলা, ২৭ নভেম্বর ১৭।
[8]. দৈনিক যুগান্তর ৮ আগস্ট ১৭।
[9]. দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ ফেব্রুয়ারী ১৪।
[10]. নতুন সময় টিভি, ২৯ এপ্রিল ১৯।
[11]. নয়াদিগন্ত ২৮/০৯/২০১৮।
[12]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮৬৭।
[13]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৫১; তিরমিযী হা/২৪৯৯, সনদ হাসান।
[14]. বুখারী হা/২৮২২।