অন্যদের মাঝে সঞ্চারণশীল কল্যাণের প্রতিদান কিভাবে শ্রেষ্ঠ

(১) ঈমান : আল্লাহ তা‘আলা যা কিছুর উপর ঈমান রাখতে আদেশ দিয়েছেন সে সকল কিছু সত্য বলে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকার করা সে অনুযায়ী আমল করার নাম ঈমান।

(২) আমলে ছালেহ : আমলে ছালেহ-এর মধ্যে সব রকমের ভাল কাজ শামিল রয়েছে, চাই তা প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, আল্লাহর হক সংক্রান্ত হোক কিংবা বান্দার হক সংক্রান্ত, ফরয হোক কিংবা নফল হোক। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যেকোন ভাল কর্মই আমলে ছালেহ।

(৩) হকের উপদেশ : এখানে হক হ’ল ঈমান ও আমলে ছালেহ। অর্থাৎ লোকেরা একে অপরকে ঈমান ও আমলে ছালেহ-এর উপদেশ দিবে, তাকে ঈমান ও আমলে ছালেহ-এর প্রতি উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করবে।

(৪) ছবরের উপদেশ : আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা, তাঁর অবাধ্যতা থেকে সর্বদা দূরে থাকা এবং আল্লাহ নির্ধারিত তাক্বদীর অনুসারে কষ্টে পতিত অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করার জন্য পরস্পরকে উপদেশ দেওয়ার নাম পারস্পরিক ছবরের উপদেশ।

প্রথম দু’টি কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে পূর্ণ করে এবং শেষের দু’টি কাজ দ্বারা অন্যদের পূর্ণ করে। এই চারটি জিনিসের পূর্ণতার মাধ্যমে মানুষ ক্ষতি হ’তে রক্ষা পাবে এবং মহাপ্রাপ্তি লাভ করবে ইনশাআল্লাহ।[1] অতএব ক্ষতি থেকে ব্যক্তির মুক্তি নির্ভর করে অন্যদের উপকার করা এবং তাদের হক ও ছবরের নছীহত করার উপর।

২. নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, মানুষের বেশী বেশী উপকারকারী মানুষই শ্রেষ্ঠ মানুষ। জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الْمُؤْمِنُ يَأْلَفُ وَيُؤْلَفُ، وَلَا خَيْرَ فِيمَنْ لَا يَأْلَفُ، وَلَا يُؤْلَفُ، وَخَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ- ‘মুমিন ভালবাসার বন্ধনে অন্যকে যুক্ত করে এবং তাকেও ভালবাসার বন্ধনে যুক্ত করা হয়। যে ভালবাসার বন্ধনে অন্যকে যুক্ত করে না এবং তাকেও ভালবাসার বন্ধনে যুক্ত করা হয় না তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। আর সেই মানুষই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে মানুষের কল্যাণে বেশী অগ্রগামী’।[2]

মুনাবী (রহঃ) বলেন, ‘সেই মানুষই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে মানুষের কল্যাণে বেশী অগ্রগামী’ (خَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ) এ কথার অর্থ- সে তার ধন-সম্পদ ও পদমর্যাদা দিয়ে জনগণের উপকার করে। সে ভাবে, সকল মানুষ আল্লাহর বান্দা। এজন্য তারা তার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। ‘মানবকুলের কল্যাণে সবচেয়ে বেশী অগ্রণী’ অর্থ সে মানবকল্যাণে তুলনামূলকভাবে অন্য মানুষদের থেকে বেশী এগিয়ে। তার কাছে যেসব নে‘মত বা আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ আছে তা সে জনকল্যাণে বিলিয়ে দেয়, কিংবা তাদের কোন বিপদাপদ দেখা দিলে তা দূর করে, চাই এসব কিছু জাগতিক হোক কিংবা দ্বীনী-ধর্মীয় হোক। তবে দ্বীনী উপকারই বেশী মর্যাদাপূর্ণ।[3]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন,دَلَّ الْعَقْلُ وَالنَّقْلُ وَالْفِطْرَةُ وَتَجَارِبُ الْأُمَمِ، عَلَى اخْتِلَافِ أَجْنَاسِهَا وَمِلَلِهَا وَنِحَلِهَا، عَلَى أَنَّ التَّقَرُّبَ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ، وَطَلَبِ مَرْضَاتِهِ، وَالْبِرِّ وَالْإِحْسَانِ إِلَى خَلْقِهِ مِنْ أَعْظَمِ الْأَسْبَابِ الْجَالِبَةِ لِكُلِّ خَيْرٍ، وَأَضْدَادَهَا مِنْ أَكْبَرِ الْأَسْبَابِ الْجَالِبَةِ لِكُلِّ شَرٍّ، فَمَا اسْتُجْلِبَتْ نِعَمُ اللهِ، وَاسْتُدْفِعَتْ نِقْمَتُهُ، بِمِثْلِ طَاعَتِهِ، وَالتَّقَرُّبِ إِلَيْهِ، وَالْإِحْسَانِ إِلَى خَلْقِهِ، ‘কুরআন-সুন্নাহ, বিবেক-বুদ্ধি, স্বভাব এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবীয় অভিজ্ঞতা বলে যে, সৃষ্টিকুলের প্রতিপালকের নৈকট্য অর্জন, তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে সদাচরণ এবং তাদের উপকার সাধন সকল প্রকার কল্যাণ বয়ে আনে। এর বিপরীতে মানুষের সঙ্গে অসদাচরণ এবং তাদের অপকার করলে তা সব রকমের অনিষ্টের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলত আল্লাহর নে‘মতরাজি প্রাপ্তি এবং তাঁর গযব ও শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য ও তাঁর সৃষ্টির উপকার সাধনের বিরাট ভূমিকা রয়েছে’।[4]

৩. ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ، وَأَحَبُّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ سُرُورٌ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ أَوْ تَكْشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً أَوْ تَقْضِى عَنْهُ دَيْناً أَوْ تَطْرُدُ عَنْهُ جُوْعاً، وَلأَنْ أَمْشِىَ مَعَ أَخِى الْمُسْلِمِ فِى حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِى هَذَا الْمَسْجِدِ يَعْنِيْ مَسْجِدَ الْمَدِيْنَةِ شَهْرًا، وَمَنْ كَفَّ غَضْبَهُ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُّمْضِيَهُ أَمْضَاهُ مَلَأَ اللهُ قَلْبَهُ رِضًا يَّوْمَ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ مَّشَى مَعَ أَخِيْهِ الْمُسْلِمِ فِى حَاجَةٍ حَتَّى يَقْضِيَهَا لَهُ أَثْبَتَ اللهُ قَدَمَهُ يَوْمَ تَزِلُّ الْأَقْدَامُ (১) আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের সবচেয়ে বেশী উপকার করে। (২) আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় নেক আমল হ’ল কোন মুসলিমকে আনন্দিত করা অথবা তার কোন বিপদ, কষ্ট বা উৎকণ্ঠা দূর করা, অথবা তার ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া অথবা তার ক্ষুধা দূর করা। তিনি বলেন, (৩) আমার কোন ভাইয়ের সাহায্যের জন্য তার সাথে হেঁটে যাওয়া আমার নিকট এই মসজিদে (মসজিদে নববীতে) এক মাস ই‘তিকাফ করার চেয়েও প্রিয়। (৪) যে ব্যক্তি তার ক্রোধ সংবরণ করবে, আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। নিজের ক্রোধ কার্যকর করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তা দমন করবে, ক্বিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার হৃদয়কে সন্তুষ্টি দিয়ে ভরে দিবেন। (৫) যে ব্যক্তি তার কোন ভাইয়ের সাথে গিয়ে তার কোন প্রয়োজন মিটিয়ে দিবে, ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে যেদিন পুলছিরাতের উপর সকলের পা পিছলে যাবে, সেদিন আল্লাহ তার পা দৃঢ় রাখবেন’।[5]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী,لَأَنْ أَمْشِيَ مَعَ أَخٍ لِي فِي حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِي هَذَا الْمَسْجِدِ شَهْرًا يعني فِي مَسْجِدِ الْمَدِينَةِ ‘আমার কোন ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে তার সাথে হেঁটে যাওয়া এই মসজিদে অর্থাৎ মদীনার মসজিদে আমার একমাস ই‘তিকাফ করা থেকে আমার নিকট বেশী প্রিয়’[6] এজন্য যে, ই‘তিকাফের উপকার ই‘তিকাফকারীর নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে তার সাথে হাঁটার উপকার অন্য মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, ফলে তা জনগণের জন্য নিশ্চিতভাবেই বেশী উপকারী।

শায়খ ওছায়মীন (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মুসলিমদের প্রয়োজন পূরণার্থে ই‘তিকাফকারীর জন্য টেলিফোনে যুক্ত হওয়া জায়েয হবে কি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, হ্যঁা, মুসলিমদের কোন বিশেষ প্রয়োজন পূরণে ই‘তিকাফকারীর জন্য টেলিফোনে যুক্ত হওয়া জায়েয হবে। যখন টেলিফোনটি তার ই‘তিকাফকৃত মসজিদে থাকবে। কারণ সে তো মসজিদ থেকে বাইরে যাচ্ছে না। আর যদি টেলিফোন মসজিদের বাইরে হয় তাহ’লে সে ফোন করতে মসজিদের বাইরে যাবে না। আর মুসলিমদের প্রয়োজন পূরণে যদি এই ব্যক্তিই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহ’লে সে ই‘তিকাফ করবে না। কেননা মুসলিমদের প্রয়োজন পূরণ ই‘তিকাফ থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রয়োজন পূরণের উপকার অন্যের মধ্যে সঞ্চারণশীল। আর সঞ্চারণশীল উপকার ব্যক্তির নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ উপকার থেকে উত্তম। তবে ব্যক্তির নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ উপকারমূলক আমল যখন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় আমল হবে তখন সেটাই হবে শ্রেয়।[7]

৪. জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ إِلاَّ كَانَ لَهُ بِهِ صَدَقَةٌ ‘কোন মুসলিম গাছ লাগালে আর সে গাছ থেকে কোন মানুষ, কিংবা পশু কিংবা পাখি খেয়ে গেলে তা তার জন্য ক্বিয়ামত অবধি ছাদাক্বা বলে গণ্য হবে।[8]

যে কোন মুসলিম ফলজ বৃক্ষ রোপন করবে তা থেকে যা কিছু খাওয়া হয় তা তার জন্যে দান স্বরূপ, যা কিছু চুরি হয় তাও দান স্বরূপ, বন্য জন্তু যা খেয়ে নেয় তাও দান স্বরূপ। পাখী যা খেয়ে নেয় তাও দান স্বরূপ। আর কেউ কিছু নিয়ে গেলে তাও তার জন্যে দান স্বরূপ।

মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا إِلاَّ كَانَ مَا أُكِلَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةٌ وَمَا سُرِقَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةٌ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ مِنْهُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ وَمَا أَكَلَتِ الطَّيْرُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ وَلاَ يَرْزَؤُهُ أَحَدٌ إِلاَّ كَانَ لَهُ صَدَقَةٌ- ‘কোন মুসলিম যখন কোন ফলদ গাছ লাগায় আর তা থেকে যা কিছু খাওয়া হয় তা তার জন্য দান বলে গণ্য হয়, যা কিছু চুরি হয় তাও তার জন্য দান বলে গণ্য হয়, বন্য পশু যা খেয়ে নেয় তা তার জন্য দান বলে গণ্য হয়, পাখিতে যা খেয়ে নেয় তা তার জন্য দান বলে গণ্য হয় এবং তা কেউ নিয়ে গেলেও তা তার জন্য দান বলে গণ্য হয়’।[9]

আবুদ্দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি দামেশক শহরে একটা গাছ লাগাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবী হয়েও এ কাজ করছেন! তিনি বললেন, তুমি আমার বিষয়ে মন্তব্য করতে তাড়াহুড়া কর না। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, مَنْ غَرَسَ غَرْساً لَمْ يَأْكُلْ مِنْهُ آدَمِىٌّ وَلاَ خَلْقٌ مِنْ خَلْقِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ كَانَ لَهُ صَدَقَةً- ‘যে ব্যক্তি কোন ফলদ গাছ লাগায় আর তা থেকে কোন লোক কিংবা আল্লাহর কোন সৃষ্টি খেয়ে নেয় তবে তা তার জন্য ছাদাক্বা বলে গণ্য হয়’।[10]

ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এসব হাদীছে বৃক্ষরোপণ ও কৃষিকাজের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। বৃক্ষ ও ফসল যতদিন থাকবে এবং তা থেকে উৎপাদন বহাল থাকবে ততদিন রোপণকারী ও চাষী ছওয়াব পেতে থাকবে। এভাবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তারা ছওয়াব পেতে থাকবে। এসব হাদীছ থেকে এ কথাও জানা যাচ্ছে যে, মানুষের সম্পদ চুরি হয়ে গেলে কিংবা পশু-পাখি কিংবা অন্য কিছুতে বিনষ্ট করলেও সে ছওয়াবের অধিকারী হবে।[11]

এ কারণে কোন কোন আলেমের মতে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের চেয়ে চাষাবাদ উত্তম কাজ। কারণ চাষাবাদের উপকার বহুমুখী, এমনকি তা থেকে মানুষ ছাড়াও চতুষ্পদ প্রাণী, পাখ-পাখালি ও কীট-পতঙ্গ পর্যন্ত উপকৃত হয়ে থাকে। ইমাম নববী এ কথাকে যথার্থ বলেছেন।[12]

৫. জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ ‘সকল ভাল কাজই ছাদাক্বা’।[13]

৬. আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সূর্য উদিত হয় এমন প্রতিটা দিন প্রত্যেক ব্যক্তির তরফে তার জানের উপর ছাদাক্বা আবশ্যক হয়। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কোত্থেকে দান করব, আমাদের তো ধন-দৌলত নেই। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই ছাদাক্বার শ্রেণীতে রয়েছে আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজের নিষেধ করা, লোক চলাচলের রাস্তা থেকে কাঁটা, হাড়-হাড্ডি ও পাথর সরিয়ে দেওয়া, অন্ধকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া, কালা ও বোবা যাতে বুঝতে পারে সেভাবে তাদেরকে শোনানো, কোন প্রয়োজন পূরণের জন্য ঠিকানা তালাশকারীকে ঠিকানা জানা থাকলে তা বলে দেওয়া, সাহায্যের জন্য চিৎকারকারীকে সাহায্য করার জন্য দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাওয়া, অসহায়-দুর্বলকে দু’বাহুর শক্তিতে তুলে ধরা। এসবের প্রত্যেকটিই তোমার তরফে তোমার জানের উপর ছাদাক্বা। এমনকি তোমার স্ত্রীর সাথে তোমার মিলনেও তুমি ছওয়াব পাবে। আবু যার বললেন, আমার কামনা পূরণেও কিভাবে আমার ছওয়াব হবে? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, বল তো তোমার যদি একটা ছেলে হয়, আর সে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তুমি তার থেকে উপকার ভোগের আশা কর, কিন্তু ইত্যবসরে সে মারা যায়, তুমি কি তার থেকে ছওয়াব প্রত্যাশা করো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি তাকে সৃষ্টি করেছিলে? তিনি বললেন, না, বরং আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বললেন, তবে কি তুমি তাকে সৎপথে কায়েম রেখেছিলে? তিনি বললেন, না, বরং আল্লাহ তাকে সৎপথে কায়েম রেখেছিলেন। তিনি বললেন, তবে কি তুমি তাকে খাওয়া-পরা দিয়েছিলে? তিনি বললেন, না, বরং আল্লাহ তাকে খাওয়া-পরা দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, এভাবেই ছওয়াব হবে। তুমি তোমার জননাঙ্গকে আল্লাহর হালালের মধ্যে ব্যবহার করো এবং হারাম থেকে তাকে দূরে রাখো। আল্লাহ চাইলে তাকে জীবিত রাখবেন অথবা তাকে মৃত্যু দিবেন। উভয় অবস্থাতেই তুমি ছওয়াব পাবে’।[14]

৭. আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,كُلُّ سُلاَمَى مِنَ النَّاسِ عَلَيْهِ صَدَقَةٌ كُلَّ يَوْمٍ تَطْلُعُ فِيهِ الشَّمْسُ، يَعْدِلُ بَيْنَ الاِثْنَيْنِ صَدَقَةٌ، وَيُعِينُ الرَّجُلَ عَلَى دَابَّتِهِ، فَيَحْمِلُ عَلَيْهَا، أَوْ يَرْفَعُ عَلَيْهَا مَتَاعَهُ صَدَقَةٌ، وَالْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ، وَكُلُّ خَطْوَةٍ يَخْطُوهَا إِلَى الصَّلاَةِ صَدَقَةٌ، وَيُمِيطُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ صَدَقَةٌ- ‘সূর্য উদিত হয় এমন প্রতিটা দিন প্রত্যেক ব্যক্তির তরফে তার গ্রন্থিজোড়ের উপর ছাদাক্বা আবশ্যক হয়। দু’জন মানুষের মাঝে ইনছাফ কায়েম করা ছাদাক্বা। কোন লোককে তার পশুর পিঠে চড়তে সাহায্য করা কিংবা তার মাল-পত্র তার পশুর পিঠে তুলে দেওয়া ছাদাক্বা। একটা ভাল কথা বলা ছাদাক্বা। ছালাতের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ ছাদাক্বা এবং রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়া ছাদাক্বা’।[15]

অতএব পরোপকারার্থে মানুষ যে ভাল কাজটা করবে তাতে সে দানের ছওয়াব পাবে এবং যে দান ছাদাক্বায়ে জারিয়া, তার ছওয়াব মৃত্যুর পরেও মৃত ব্যক্তি পেতে থাকবে।

৮. আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,سَأَلْتُ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَىُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ، قَالَ إِيمَانٌ بِاللهِ، وَجِهَادٌ فِى سَبِيلِهِ. قُلْتُ فَأَىُّ الرِّقَابِ أَفْضَلُ قَالَ أَغْلاَهَا ثَمَنًا، وَأَنْفَسُهَا عِنْدَ أَهْلِهَا. قُلْتُ فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ. قَالَ تُعِينُ صَانِعًا أَوْ تَصْنَعُ لأَخْرَقَ. قَالَ فَإِنْ لَمْ أَفْعَلْ. قَالَ تَدَعُ النَّاسَ مِنَ الشَّرِّ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ تَصَدَّقُ بِهَا عَلَى نَفْسِكَ- ‘আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, কোন আমল শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার পথে জিহাদ। আমি বললাম, কোন শ্রেণীর দাস মুক্ত করা উত্তম? তিনি বললেন, যার মূল্য বেশী এবং যে তার মনিবেরর নিকট আকর্ষণীয়। আমি বললাম, আমি যদি তা করতে না পারি? তিনি বললেন, তুমি কর্মরত কোন ব্যক্তিকে সাহায্য করবে অথবা কোন অক্ষম বেকারের হয়ে কাজ করে দেবে। তিনি বললেন, আমি যদি তাও করতে না পারি? তিনি বললেন, মানুষকে ক্ষতি করা থেকে দূরে থাকবে। সেটাই হবে তোমার পক্ষ থেকে তোমার জানের ছাদাক্বাহ।[16]

৯. আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! বান্দাকে জাহান্নাম থেকে কিসে মুক্ত করবে? তিনি বললেন, আল্লাহর প্রতি ঈমান। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঈমানের সাথে আমলও লাগবে? তিনি বললেন, আল্লাহ তাকে যে জীবিকার সামগ্রী দিয়েছেন তা থেকে দান করবে। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, যদি লোকটি দরিদ্র হয়, দান করার মত কিছু না থাকে, তার ক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন? তিনি বললেন, সে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করবে। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! লোকটির কথায় জড়তা থাকায় যদি সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ করতে না পারে তবে তার ক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন? তিনি বললেন, যে কাজ করতে পারে না এমন লোকের সে কাজ করে দেবে। আমি বললাম, সে যদি নিজেই কাজ করতে না পারা লোক হয় তবে তার ক্ষেত্রে আপনি কি মনে করেন? তিনি বললেন, মযলূমকে সাহায্য করবে। আমি বললাম, সে যদি এমন দুর্বল হয় যে, মযলূমকে সাহায্য করার মতো সঙ্গতি তার নেই? তিনি বললেন, তুমি কি তোমার সাথীর মধ্যে কোন ভাল কিছু আছে বলে আশা করতে পারছ না? সে মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যখন সে এ কাজ করবে তখন কি সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে? তিনি বললেন, যখন কোন মুসলিম এই কাজগুলোর কোন একটা করবে তখন সেটি তার হাত ধরে তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে’।[17] এ হাদীছ নির্দেশ করে যে, জনকল্যাণমুখী কাজে অবদান রাখার দরুন মুমিনের জানণাতপ্রাপ্তি ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।

৯. ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ الْأَعْمَالِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: إِدْخَالُكَ السُّرُورَ عَلَى مُؤْمِنٍ أَشْبَعْتَ جَوْعَتَهُ، أَوْ كَسَوْتَ عُرْيَهُ، أَوْ قَضَيْتَ لَهُ حَاجَةً- ‘নবী করীম (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, আমলসমূহের মধ্যে কোন আমল সর্বোত্তম? তিনি বললেন, তোমার দ্বারা কোন মুমিনের মনে আনন্দ সঞ্চার করা। হয়তো তুমি তার ক্ষুধা দূর করবে অথবা বস্ত্রহীন অবস্থা থেকে উদ্ধারে তুমি তাকে বস্ত্র দেবে অথবা তুমি তার কোন প্রয়োজন পূরণ করবে’।[18]

১০. নবী করীম (ছাঃ) তো প্রত্যেক মুসলিমকে তার মুসলিম ভাইয়ের যে ধরনের উপকার করা তার পক্ষে সম্ভব সেই ধরনের উপকার করতে বলেছেন। তিনি বলেন,مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يَنْفَعَ أَخَاهُ فَلْيَفْعَلْ ‘তোমাদের মধ্যে যেকোন ব্যক্তি তার ভাইকে কোন উপকার করতে সমর্থ হ’লে সে যেন তা করে’।[19]

উপকার করার ধরন অনেক। যখনই যে আমল বান্দার জন্য অধিক কল্যাণকর হবে তখনই তা আল্লাহর নিকট শ্রেয় বলে গণ্য হবে। এজন্য যেসব আমল সার্বজনীন ও অধিক উপকারী সেসব আমলে আগ্রহী হওয়া মুমিনের জন্য বাঞ্ছনীয়।  [ক্রমশঃ]

-মূল (আরবী) : মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ

-অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[1]. তায়সীরুল কারীমির রহমান, পৃ. ৯৩৪।

[2]. ত্বাবারানী আওসাত্ব হা/৫৯৪৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪২৬।

[3]. ফায়যুল ক্বাদীর ৩/৪৮১।

[4]. আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ. ০৯।

[5].ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৬০২৬; ছহীহাহ হা/৯০৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৬২৩।

[6]. মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৩৭০৮; ছহীহাহ হা/৯০৬

[7]. ওছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২০/১২৬।

[8]. মুসলিম হা/১৫৫৩; ছহীহাহ হা/৮।

[9]. মুসলিম হা/৩৮৬০।

[10]. আহমাদ হা/২৭৫৪৬; আলবানী, ছহীহুত তারগীব হা/২৬০০।

[11]. নববী, শরহ মুসলিম ৫/৩৯৬।

[12]. নববী, শরহ মুসলিম ৫/৩৯৬।

[13]. বুখারী হা/৬০২১।

[14]. ইবনু হিববান হা/৩৩৭৭; আহমাদ হা/২১৫২২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৫৭৫।

[15]. বুখারী হা/২৯৮৯।

[16]. বুখারী হা/২৫১৮।

[17]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৫০৮১; ছহীহুত তারগীব, হা/৮৭৬

[18]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৫০৮১; ছহীহুত তারগীব, হা/২৬২১।

[19]. মুসলিম হা/৫৬২২।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (২য় কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
জান্নাতের পথ - ড. নূরুল ইসলাম
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মুসলমানদের রোম ও কন্সটান্টিনোপল বিজয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
দাফনোত্তর দলবদ্ধ মুনাজাতের বিধান - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইলম অন্বেষণও শিক্ষাদানের গুরুত্বও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
দাওয়াতের ক্ষেত্র ও আধুনিক মাধ্যম সমূহ - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
দো‘আর আদব বা শিষ্টাচার সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
গাদ্দাফী, সাম্রাজ্যবাদ ও লিবিয়ার রক্তাক্ত জনগণ - ফাহমীদুর রহমান
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (৪র্থ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৮ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত - মুযাফফর বিন মুহসিন
আরও
আরও
.