এ পৃথিবীর সকল বস্ত্তরই একটা নাম ও নিদর্শন রয়েছে। উক্ত নাম ও নিদর্শনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কও রয়েছে, যা তার পরিচয় বহন করে। প্রত্যেকের নিদর্শন দ্বারাই একে অপরকে চিনে, জানে ও বিশ্বাস করে। মানুষ ছাড়া যত প্রকারের চেনা-জানা প্রাণী বা গৃহপালিত ও বন্য পশু, হিংস্র-শান্ত জীব-জানোয়ার, কীট-পতঙ্গ রয়েছে, তাদেরকেও তাদের নিদর্শন দ্বারা চেনা সম্ভব। প্রাণীদের ন্যায়  উদ্ভিদরাজির বিভিন্ন নিদর্শন তাদের নামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে কোন প্রকারের কার্পণ্য করে না। অনুরূপভাবে আসমান-যমীন, সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র, তারকা, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, নদ-নদী, হরদ, সমভূমি, মরুভূমি, মালভূমি, বণ-জঙ্গল ইত্যাদিও তাদের নিজ নিজ নিদর্শন দ্বারা আত্মপ্রকাশ করে।

এতদ্ব্যতীত মানবজাতির বসবাসরত বড় বড় শহর-বন্দর, হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জ ইত্যাদির বড় বড় অট্টালিকা, প্রাসাদ, টাওয়ার, ভবন, মাঝারি বাড়ি-ঘর, ছোট ছোট বসতি, সরকারী বেসরকারী স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, অফিস-আদালত, ডাকঘর, মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ ইত্যাদিরও এক একটি পৃথক নিদর্শন আছে। আবার বিশ্বের দেশ বা রাষ্ট্রগুলো পৃথকভাবে নিজ নিজ ধন-সম্পদ, শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সমরশক্তি দ্বারা তাদের নিদর্শন প্রকাশ করে। সুতরাং নিদর্শনই হ’ল, যেকোন বস্ত্তর পরিচয় দানের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।

অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ তাঁর অস্তিত্ব, সবকিছু যে তাঁরই সৃষ্টি এবং সমগ্র সৃষ্টি যে তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে। এসব মানব মন্ডলীকে বুঝানোর জন্য অসংখ্য নিদর্শন পেশ করেছেন। এসবের মাধ্যমে তাঁকে জানা ও চেনা যায়। আল্লাহর এসব নিদর্শন জানা-শোনা, বোঝা ও বর্ণনার আগে তাঁর পরিচয় জানা দরকার। মহান আল্লাহ হ’লেন এক ও অদ্বিতীয় চিরঞ্জীব অসীম সত্তা। তিনি অসীম ও অনন্ত দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের বাদশাহ। নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী যাবতীয় বস্ত্তর তিনিই স্রষ্টা, তিনি মহাজ্ঞানী। তাঁর জ্ঞান, রাজত্ব, ক্ষমতা ও সৃষ্টির সীমা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তিনি এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়েছেন। অতঃপর যথাসময়ে তিনি সকলের সম্মুখে আবির্ভূত হবেন এবং হিসাব নিবেন। তাঁর সত্তা বা অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা-শোনা, বোঝা ও বিশ্বাসের জন্য তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে অসংখ্য নিদর্শন স্থাপন করেছেন। এগুলোর কিয়দংশ আমাদের দৃষ্টিসীমা ও জ্ঞানসীমার অন্তর্ভুক্ত। অবশিষ্ট অধিকাংশই জ্ঞানের বাইরে অদৃশ্য জগতে বিদ্যমান।

আধুনিক বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় মহাশূন্যে এমন নক্ষত্র মন্ডলের অস্তিত্বও আমাদের জানা হয়ে গেছে- যেসব নক্ষত্র থেকে আমাদের পৃথিবীতে আলো আসতে শত শত কোটি বছর লেগে  যাওয়ার কথা।  আরও জানা যায়,  পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ যে সূর্যের উপগ্রহ মাত্র- সেই সূর্যের মত শত সহস্র কোটি নক্ষত্র নিয়ে সে আলাদা একটা পরিপূর্ণ জগৎ রয়েছে, তাকে বলা হয় গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। ঐ সুদূর প্রান্তের ছায়াপথের বিরাটত্বের তুলনায় আমাদের সৌরজগৎ একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দু ছাড়া কিছুই নয়। ঐ ছায়াপথে যে সব নক্ষত্রের অবস্থান সে সবের পরিমন্ডল খুবই বৃহৎ। সেখানে দৃশ্যমান ছায়াপথের পুঞ্জিভূত নক্ষত্ররাজির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছতে সেই আলোর সময় লাগে প্রায় ৯০,০০০ (নববই হাযার) বছর।

আমরা যে গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের অন্তর্ভুক্ত, সেই ছায়াপথে নক্ষত্রের সংখ্যা আনুমানিক দশ হাযার কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, এর অর্ধেক নক্ষত্র আমাদের সূর্যের মত এবং সূর্যের মতই তাদের বিভিন্ন গ্রহ রয়েছে। শুধু তাই নয়, উপরোক্ত দশ হাযার কোটি নক্ষত্রের মধ্যে অন্তত ৫ হাযার কোটি নক্ষত্র আমাদের সূর্যের মতই ধীরে ধীরে আবর্তিত হচ্ছে। এর কারণ ঐসব নক্ষত্রের চারদিকে ঘিরে আছে বিভিন্ন গ্রহ। সেগুলো উপগ্রহের মতই স্ব স্ব কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে। ঐসব নক্ষত্র আমাদের থেকে এতদূরে অবস্থিত যে, তাদের গ্রহসমূহের অবস্থান আমাদের পর্যবেক্ষণের বাইরে।

নিম্নে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন সম্পর্কিত মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বহুসংখ্যক আয়াত হ’তে কয়েকটি উপস্থাপন করা হ’ল। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের উপাস্য এক উপাস্য। তিনি ছাড়া মহা করুণাময় দয়ালু কেউ নেই। নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকা সমূহের চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেছেন, তার দ্বারা মৃত যমীনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবরকম জীবজন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালায় যা তাঁরই হুকুমের অধীনে আসমান ও যমীনের মাঝে বিচরণ করে, নিশ্চয়ই সে সব বিষয়ের মাঝে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য’ (বাক্বারাহ ২/১৬৩-১৬৪)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আল্লাহ যিনি ঊধর্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে স্তম্ভ ব্যতীত। তোমরা সেগুলো দেখ, অতঃপর তিনি আরশে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে কর্মে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শন সমূহ প্রকাশ করেন। যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও’ (রা‘দ ১৩/২)

অন্যত্র তিনি আরো বলেন, وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعاً شِدَاداً- وَجَعَلْنَا سِرَاجاً وَّهَّاجاً- ‘আমি নির্মাণ করেছি তোমাদের মাথার উপর মজবুত সপ্ত আকাশ এবং সৃষ্টি করেছি একটি উজ্জ্বল প্রদীপ’ (নাবা ৭৮/১২-১৩)

অন্য আয়াতে একইভাবে এসেছে, ‘তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্রপুঞ্জ সৃজন করেছেন, যাতে তোমরা স্থল ও জলের অন্ধকারে পথপ্রাপ্ত হও।  নিশ্চয়ই  যারা  জ্ঞানী তাদের জন্য আমি নিদর্শনাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করে দিয়েছি’ (আন‘আম ৬/৯৭)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘তিনিই তোমাদের কাজে নিয়োজিত করেছেন রাত্রি, দিন, সূর্য এবং চন্দ্রকে। তারকা সমূহ তাঁরই বিধানের কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। নিশ্চয়ই এতে বোধশক্তি সম্পন্নদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (নাহল ১৬/১২)

আল্লাহর অগণিত বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিরাজিই হ’ল তাঁর অন্যতম নিদর্শন। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে ঊর্ধ্বজগতে সৃষ্ট আমাদের দৃষ্টিসীমাভুক্ত বস্ত্তগুলোর আশ্চর্যতম অবস্থান ও নিয়মানুবর্তিতার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তাঁর বৃহৎ সৃষ্টিরাজির মধ্যে যেমন অকল্পনীয় জ্ঞানের অপরিমেয় প্রযুক্তি রয়েছে, একইভাবে ক্ষুদ্র সৃষ্টির বিচিত্রতায়ও রয়েছে পর্বত প্রমাণ জ্ঞানের সমাহার। পবিত্র কুরআনে এগুলোর বিস্তৃত বিবরণ দেয়া হয়েছে। এসব মূল্যবান তথ্যগুলো উদাহরণ স্বরূপ নিম্নে উপস্থাপন করা হ’ল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহই বীজ ও অাঁটি থেকে অঙ্কুর সৃষ্টিকারী, তিনি জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন ও মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন। তিনি আল্লাহ, অতঃপর তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছ? তিনি প্রভাত রশ্মির উন্মেষক। তিনি রাত্রিকে আরামদায়ক করেছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসাবের জন্য রেখেছেন। এটি পরাক্রান্ত মহাজ্ঞানীর নির্ধারণ। তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্রপুঞ্জ সৃজন করেছেন যাতে তোমরা স্থল ও জলের অন্ধকারে পথপ্রাপ্ত হও। নিশ্চয়ই যারা জ্ঞানী তাদের জন্য আমি নিদর্শনাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করে দিয়েছি। তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অনন্তর একটি হচ্ছে তোমাদের স্থায়ী ঠিকানা ও একটি হচ্ছে গচ্ছিত স্থল। নিশ্চয়ই আমি প্রমাণাদি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি তাদের জন্য, যারা চিন্তা করে। তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। অতঃপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, অতঃপর আমি এথেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙ্গুরের বাগান, যয়তুন, আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত এবং সাদৃশ্যহীন। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি লক্ষ্য কর, যখন সেগুলো ফলন্ত হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি লক্ষ্য কর। নিশ্চয়ই এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদারদের জন্য’ (আন‘আম ৬/৯৫-৯৯)। তিনি আরো বলেন,

وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ يُرْسِلَ الرِّيَاحَ مُبَشِّرَاتٍ وَلِيُذِيْقَكُم مِّنْ رَّحْمَتِهِ وَلِتَجْرِيَ الْفُلْكُ بِأَمْرِهِ وَلِتَبْتَغُوْا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ-

‘তাঁর নিদর্শন সমূহের মধ্যে একটি এই যে, তিনি সুসংবাদবাহী বায়ু প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তাঁর অনুগ্রহ তোমাদের আস্বাদন করান এবং যাতে তাঁর নির্দেশে জাহাজ সমূহ বিচরণ করে এবং যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ তালাশ কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও’ (রূম ৩০/৪৬)

এ সূরারই অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন, জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন এবং ভূমির মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এভাবে তোমরা উত্থিত হবে। তাঁর নির্দশনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। এখন তোমরা মানুষ, পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছ। আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আরও নিদর্শন, রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তাঁর কৃপা অন্বেষণ। নিশ্চয়ই এতে মনোযোগী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর আরও নিদর্শন তিনি তোমাদেরকে দেখান বিদ্যুৎ, ভয় ও ভরসার জন্য এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তদ্বারা ভূমির মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। নিশ্চয়ই এতে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। তাঁর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত আছে। অতঃপর যখন তিনি মৃত্তিকা থেকে উঠার জন্য তোমাদের ডাক দিবেন, তখন তোমরা উঠে আসবে। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ’ (রূম ৩০/১৯-২৬)

নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সর্বত্র আল্লাহর নিদর্শন ব্যাপক। এই মহাসত্যের সমর্থনে পবিত্র আল-কুরআনে বহু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। সর্বব্যাপক মর্মার্থের এই আয়াতগুলো গভীর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে হৃদয়ঙ্গম করা দরকার। এ লক্ষ্যে আরো কিছু আয়াত উল্লেখ করা হ’ল। আল্লাহ বলেন, ‘হা-মীম, প্ররাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ কিতাব। নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে মুমিনদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। আর তোমাদের সৃষ্টিতে এবং চারদিকে ছড়িয়ে রাখা জীবজন্তুর সৃজনের মধ্যেও নিদর্শনাবলী রয়েছে বিশ্বাসীদের জন্য। দিবা-রাত্রির পরিবর্তনে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে রিযিক (বৃষ্টি) বর্ষণ করেন, অতঃপর পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করেন, তাতে এবং বায়ুর পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। এগুলো আল্লাহর আয়াত, যা আমি আপনার কাছে আবৃত্তি করি যথাযথরূপে। অতএব আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পর আর কোন কথায় তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করবে’? (জাছিয়া ৪৫/১-৬)

অন্যত্র আরো এসেছে, ‘আপনি কি দেখেন না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা এবং উড়ন্ত পক্ষীকুল তাদের পাখা বিস্তার করতঃ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই তার যোগ্য ইবাদত এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পদ্ধতি জানে। তারা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আপনি কি দেখেন না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন; অতঃপর আপনি দেখেন যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তূপ থেকে শিলাবর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎ ঝলক দৃষ্টিশক্তি যেন বিলীন করে দিতে চায়। আল্লাহ দিন-রাত্রির পরিবর্তন ঘটান। এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্নগণের জন্য চিন্তার উপকরণ (নিদর্শন) রয়েছে। আল্লাহ প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তাদের কতক বুকে ভর দিয়ে চলে, কতক দুই পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কতক চার পায়ে ভর দিয়ে চলে। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম। আমিও সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ অবতীর্ণ করেছি। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালনা করেন’ (নূর ২৪/৪১-৪৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, أَلَمْ يَرَوْاْ إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِيْ جَوِّ السَّمَاءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلاَّ اللهُ إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُوْنَ- ‘তারা কি উড়ন্ত পাখীকে দেখে না? এগুলো আকাশের   অন্তরীক্ষে আজ্ঞাধীন রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া কেউ এগুলোকে আগলে রাখে না। নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (নাহল ১৬/৭৯)

নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সর্বাধিক প্রিয় সৃষ্টি মানব জাতিকে এ পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব বা রাজত্ব দান করেছেন। অতঃপর পৃথিবীতে চলার মত সুন্দর জ্ঞান দান করেছেন, যে জ্ঞানের দ্বারা সে ভাল-মন্দ ও সত্য-মিথ্যা বিচার করে চলবে।

আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন দ্বারা গোটা মানবজাতিকে জ্ঞানদানের প্রয়াসে তাঁর সৃষ্ট বস্ত্তগুলোকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহাক্ষমতায় সৃষ্ট আকাশমন্ডলী তথা বিনা খুঁটিতে সপ্ত আকাশ ও মহা আরশ স্থাপনের কথা উল্লেখ করেছেন। সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র ও অসংখ্য তারকারাজির সৃষ্টি, বাতাস, মেঘ, ঝড়, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, শীলাবৃষ্টি, আলো-অন্ধকার ইত্যাদির মালিকানা ও এসবের বৈশিষ্ট্য সমূহও বর্ণনা করেছেন। যমীনের বুকে সৃষ্ট বিশাল জলরাশির উপর সর্বময় প্রভুত্ব, স্থলভাগের উপর উদ্ভিদ ও ফল ফসলাদি সৃষ্টিতে বাতাস, বৃষ্টি ও অনুকূল আবহাওয়ার সৃষ্টিও তাঁর মহানিদর্শন বলে ঘোষণা করেছেন। এতদ্ব্যতীত যমীনের বুকে সৃষ্ট মানব ও অন্যান্য প্রাণীর সৃষ্টি রহস্য বা সৃষ্টির বিচিত্রতার নিগূঢ় তথ্যও বর্ণিত হয়েছে পবিত্র গ্রন্থে।

আল্লাহর নিদর্শন সমূহের কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন নেই। সৃষ্টির প্রথম হ’তে অদ্যাবধি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর অসীম নিদর্শনাবলী চিরস্থায়ী। মহান আললাহ তা‘আলা মানবজাতিকে তাঁর জ্ঞানপূর্ণ উপদেশাবলী দ্বারা নিদর্শন সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আনুগত্যশীল হওয়ার পুনঃ পুনঃ আহবান জানিয়েছেন। এতদসত্তেবও আবহমানকাল ধরে মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাসী নয়, বরং কোন কোন যুগে আল্লাহর নিদর্শনকে অবহেলা, অবজ্ঞা, উপহাসাচ্ছলে অমান্য করে অনেক সম্প্রদায় আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়েছে।

পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, প্রাচীনকালের ঐসব পাপী ও সীমালংঘনকারী সম্প্রদায় আল্লাহর হুকুমে সমূলে ধ্বংস হয়েছে। ঐসব ধ্বংস ইতিহাস হ’তে শিক্ষা গ্রহণের জন্য এখানে সংক্ষেপে কিছু উদাহরণ পেশ করা হ’ল। পূর্ববর্তীদের ধ্বংসকাহিনী অবহিত করতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নবী (ছাঃ)-কে বলেন, ‘তারা কি দেখেনি যে, আমি তাদের পূর্বে কত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে এমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলাম, যা তোমাদের দেইনি। আমি আকাশকে তাদের উপর অনবরত বৃষ্টি বর্ষণ করতে দিয়েছি এবং তাদের তলদেশে নদী সৃষ্টি করে দিয়েছি। অতঃপর আমি তাদেরকে তাদের পাপের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তাদের পর অন্য সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছি’ (আন‘আম ৬/৬)

এ বিষয়ে আরো বর্ণিত হয়েছে, ‘সুনিশ্চিত বিষয়! সুনিশ্চিত বিষয় কি? আপনি কি জানেন সেই সুনিশ্চিত বিষয় কী? আদ ও ছামূদ গোত্র মহাপ্রলয়কে মিথ্যা বলেছিল, অতঃপর ছামূদ গোত্রকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রলয়কারী বিপর্যয় দ্বারা এবং আদ গোত্রকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা, যা তিনি প্রবাহিত করেছিলেন, তাদের উপর সাত রাত্রি ও আট দিবস পর্যন্ত অবিরাম। আপনি তাদেরকে দেখতেন যে, তারা অসার খর্জুর কান্ডের ন্যায় ভূপাতিত হয়ে রয়েছে। আপনি তাদের কোন অস্তিত্ব দেখতে পান কি? ফিরআউন, তার পূর্ববর্তীরা এবং উল্টে যাওয়া বস্তিবাসীরা গুরুতর পাপ করেছিল। তারা তাদের পালনকর্তার রাসূলকে অমান্য করেছিল। ফলে তিনি তাদেরকে কঠোর হস্তে পাকড়াও করলেন। যখন জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল, তখন আমি তোমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরোহণ করিয়েছিলাম, যাতে এ ঘটনা তোমাদের জন্য স্মৃতির বিষয় এবং কর্ণ এটাকে উপদেশ গ্রহণের উপযোগীরূপে গ্রহণ করে’ (আল-হাক্কাহ ৬৯/১-১২)

অপর এক বর্ণনায় আল্লাহ বলেন, ‘আমি কারূণ, ফেরআউন ও হামানকে ধ্বংস করেছি। মূসা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে আগমন করেছিলেন। অতঃপর তারা দেশে দম্ভ করেছিল, কিন্তু তারা জিতে যায়নি। আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারও প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তর সহ প্রচন্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছি নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি যুলুমকারী ছিলেন না, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছে’ (আনকাবূত ২৯/৩৯-৪০)

উপরে বর্ণিত জাতির ধ্বংসের কারণ হচ্ছে তাদের কার্যকলাপে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। যা আল্লাহ এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার করে বেড়ায় আমি তাদের দৃষ্টি আমার নিদর্শনাবলী থেকে ফিরিয়ে দিব। তারপর তারা আমার প্রত্যেকটি নিদর্শন দেখলেও তাঁতে বিশ্বাস করতে পারবে না। তারা সৎপথ দেখলেও তাকে পথ বলে গ্রহণ করবে না। কিন্তু ভ্রান্ত পথ দেখলেই সেই পথ তারা অনুসরণ করবে। এজন্য যে, তারা আমার নিদর্শন সমূহকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং এ সম্বন্ধে ওরা অমনোযোগী। তাদের কর্ম নিষ্ফল হবে যারা আমার নিদর্শন সমূহ ও পরকালের সাক্ষাৎকে মিথ্যা বলে। তারা যা করবে সেই মতো কি তাদের প্রতিফল দেওয়া হবে না’ (আ‘রাফ ৭/১৪৬-১৪৭)

[চলবে]

রফীক আহমাদ

শিক্ষক (অবঃ), বিরামপুর, দিনাজপুর।






হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
করোনার নববী চিকিৎসা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৭ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
মুহাসাবা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আহলেহাদীছ মসজিদে হামলা : ইসলামী লেবাসে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন (ফেব্রুয়ারী’২১ সংখ্যার পর) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
সত্যের সন্ধানে - মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম প্রধান
হেদায়াত লাভের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
ইস্রাঈলীদের মন্দ পরিণতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মাসিক আত-তাহরীক : ফেলে আসা দিনগুলি - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোন্টি? - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
আরও
আরও
.