বিশ্ব
মানবতার মুক্তি ও কল্যাণে ইসলাম সর্বজনস্বীকৃত আল্লাহ মনোনীত একমাত্র জীবন
ব্যবস্থা। সেকারণ ইসলাম শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ধর্ম। অপরদিকে
আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ সর্বশেষ ওহী আল-কুরআনে সকল সমস্যার
সমাধান বর্ণিত হয়েছে। সমাজে শান্তি ও কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের
অন্যতম বিভাগ হচ্ছে বিচার বিভাগ। যে সমাজে জনগণের ফরিয়াদ শুনে তার
প্রতিকারের জন্য সঠিক বিচার ব্যবস্থা নেই, সে সমাজ কখনই মানুষের
বসবাসোপযোগী সমাজ হ’তে পারে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন আল্লাহর মনোনীত
রাসূল ও কাযী বা বিচারক। বিচারক হিসাবে তিনি পৃথিবীতে যে ন্যায় বিচারের
দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তার কল্যাণকামিতা সার্বজনীন।
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে যে বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠে তাই ইসলামী বিচার ব্যবস্থা। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের প্রধানতঃ তিনটি বিভাগ থাকে। (ক) আইন বিভাগ (খ) নির্বাহী বা শাসন বিভাগ ও (গ) বিচার বিভাগ। সাধারণ বিচার ব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আইন প্রণয়ন করে থাকেন। পক্ষান্তরে ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় এর কোন সুযোগ নেই। ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় আইনের উৎস মূলতঃ তিনটি। (১) পবিত্র আল-কুরআন (২) ছহীহ হাদীছ ও (৩) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ইজতিহাদ বা গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত। মহান আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ-
‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেছি কিতাব ও মীযান। যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। এটা এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে না দেখে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (হাদীদ ৫৭/২৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ يَقُصُّ الْحَقَّ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِيْن ‘হুকুম দেওয়ার মালিক স্রেফ আল্লাহ। তিনি (তাঁর রাসূলের নিকট) সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়ছালাকারী’ (আন‘আম ৬/৫৭)।
আল্লাহ
আরও বলেন,إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ
بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللهُ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا
‘নিশ্চয়ই আমরা তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি সত্যসহকারে। যাতে তুমি সে
অনুযায়ী লোকদের মধ্যে ফায়ছালা করতে পার, যা আল্লাহ তোমাকে জানিয়েছেন। আর
তুমি খেয়ানতকারীদের পক্ষে বাদী হয়ো না’ (নিসা ৪/১০৫)। এ প্রসঙ্গে
আল্লাহ আরও বলন,وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ إِنَّ
اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ ‘আর যদি বিচার কর, তবে ইনছাফপূর্ণ বিচার
করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদের ভালবাসেন’ (মায়েদাহ ৪২)।
ইসলামী বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি : ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থা পৃথিবীতে বিদ্যমান। শরী‘আতে যেকোন বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সিদ্ধান্তকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করা ইসলামী বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। যা নিম্নের দায়িত্বগুলো পালন করে থাকে।
১. সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করা।
২. সমাজের সকল প্রকার ক্ষতিকর বিষয়গুলো প্রতিহত করা।
৩. সরকার ও জনগণের মধ্যে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি।
ইসলামী বিচার ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : বিশ্ব মানবতার মুক্তি ও কল্যাণে সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা করে স্থায়ী ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা সাধন এবং শান্তি, স্বস্তি ও নিশ্চিন্ততা বিধানকল্পে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
ইসলামী বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : সমাজে বসবাসরত জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মীমাংসার জন্য বিচারকার্য পরিচালনা করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কেননা এ কাজটি সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন করার উপরই নির্ভর করে মানুষের মাঝে পারস্পরিক মিলমিশ, আন্তরিকতা, সৌহার্দ ও সম্প্রীতি বজায় রেখে সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতি অব্যাহত রাখা। ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রে বসবাসকারী নাগরিকদের সকল প্রকার অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়। সেকারণ এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
মানুষের শুধু বিচার নয়, প্রয়োজন সুবিচারের। আর ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল এটা সম্ভব। সেজন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন।
১. মানব সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে ইনছাফ বা ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
২. ইনসানিয়াত বা মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে স্থায়ী ও স্থিতিশীল সমাজ গঠন করা।
৩. সমাজে বিরাজিত সকল প্রকার যুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচারের আগ্রাসন রোধ করা।
৪. জীবন ও স্বাধীনতার পূর্ণ নিশ্চয়তা দান করা।
৫. জীবন ও সম্মানের পূর্ণ অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৬. নাশকতামূলক সকল প্রকার কর্মকান্ডের সম্পূর্ণ মূলোৎপাটন করা।
৭. সর্বোপরি সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, অশ্লীলতার মূলে কুঠারাঘাত করা।
ইনছাফ বা ন্যায়বিচার মুসলমানদের কাছে ঈমান আনয়নের পর অবশ্য পালনীয় ফরয সমূহের মধ্যে একটি ফরয কাজ। কেননা আসমান ও যমীন ন্যায়বিচারের মাধ্যমে টিকে আছে। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে একজন ন্যায়বিচারক হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তাঁর নবীকে সুবিচারের নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেন, وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللهُ إِلَيْكَ، ‘আর আমরা নির্দেশ দিচ্ছি যে, তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফায়ছালা করবে এবং তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবে না। আর তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো যেন তারা তোমাকে আল্লাহ প্রেরিত কিছু বিধানের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে না ফেলে’ (মায়েদাহ ৫/৪৯)।
কোন জাতির শ্রেষ্ঠ কীর্তিমালার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তার ভিত্তি ন্যায়বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা হযরত দাঊদ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন,يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ- ‘হে দাঊদ! আমরা তোমাকে পৃথিবীতে শাসক নিযুক্ত করেছি। অতএব তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়বিচার কর। এ বিষয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না। তাহ’লে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’ (ছাদ ৩৮/২৬)।
ইসলামে বিচারকের দায়িত্ব ও কর্তব্য : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় বিচারকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী ও কর্মনীতি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন-
১. রাগান্বিত অবস্থায় বিচার না করা :
চিকিৎসা বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ক্রোধের সময় রক্ত উত্তপ্ত হয়ে
উঠে। ফলে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায় এবং সে তখন ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য
করতে পারে না। এজন্য ইসলামী শরী‘আতে রাগান্বিত অবস্থায় বিচার-ফায়ছালা করতে
নিষেধ করা হয়েছে। আব্দুর রহমান ইবনে আবু বাকরাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি
বলেন যে,كَتَبَ أَبُو بَكْرَةَ إِلَى ابْنِهِ، وَكَانَ بِسِجِسْتَانَ،
بِأَنْ لاَ تَقْضِيَ بَيْنَ اثْنَيْنِ وَأَنْتَ غَضْبَانُ، فَإِنِّي
سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ : لاَ
يَقْضِيَنَّ حَكَمٌ بَيْنَ اثْنَيْنِ وَهُوَ غَضْبَانُ- ‘আবু বাকরাহ
সিজিস্তানে অবস্থানকারী তার পুত্রকে লিখে পাঠান যে, তুমি রাগান্বিত অবস্থায়
লোকদের মাঝে বিচার-ফায়ছালা করবে না। কেননা আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে
শুনেছি যে, কোন বিচারক রাগান্বিত অবস্থায় দু’জনের মধ্যে বিচার-ফায়ছালা করবে
না’।[1]
২. বাদী-বিবাদী উভয়ের কথা শ্রবণ করা :
ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় বাদী-বিবাদী উভয়ের কথা শ্রবণ করার পর বিচারক
ফায়ছালা দিবেন। এক পক্ষের বক্তব্যের উপর নির্ভর করে রায় প্রদান করতে
শরী‘আতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا تَقَاضَى إِلَيْكَ
رَجُلاَنِ فَلاَ تَقْضِ لِلأَوَّلِ حَتَّى تَسْمَعَ كَلاَمَ الآخَرِ
فَسَوْفَ تَدْرِى كَيْفَ تَقْضِى- ‘তোমার নিকট যখন দু’জন লোক বিচারের জন্য
আবেদন করে, তখন তুমি দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে না শুনেই প্রথম
পক্ষের কথার উপর ভিত্তি করে রায় প্রদান করবে না। তুমি খুব শীঘ্রই জানতে
পারবে, তুমি কিভাবে ফায়ছালা করেছ’।[2] তিনি আরো বলেন,إِذَا جَلَسَ إِلَيْكَ
الْخَصْمَانِ فَلاَ تَقْضِ بَيْنَهُمَا حَتَّى تَسْمَعَ مِنَ الآخَرِ
كَمَا سَمِعْتَ مِنَ الأَوَّلِ فَإِنَّكَ إِذَا فَعَلْتَ ذَلِكَ تَبَيَّنَ
لَكَ الْقَضَاءُ ‘তোমার নিকট যখন দু’জন লোক বিচারের জন্য বসে, তখন তুমি
তাদের মাঝে ফায়ছালা করবে না, যতক্ষণ না দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য শুনবে
যেভাবে তুমি প্রথম পক্ষের কথা শুনেছ। যখন তুমি এরূপ করবে, তখন তোমার কাছে
ফায়ছালার বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে’।[3]
৩. বাদী-বিবাদী উভয়ের প্রতি বিচারকের সম আচরণ করা : ইসলামের দৃষ্টিতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষ বিচারকের নিকটে সম অবস্থানে থাকবে। বিচারক বসার ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে সমতা বিধান করবেন। উভয়ের দিকে সমভাবে দৃষ্টিপাত করবেন। কোন অবস্থাতেই এক পক্ষকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। এটা এজন্য করতে হবে, বাদী-বিবাদী কোন পক্ষই যেন এ ধারণা না করে যে, বিচারক কোন এক পক্ষের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। এমন অবস্থা হ’লে বিচারকের নিকট থেকে ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহের সৃষ্টি হবে।
অনুরূপভাবে বিচারক
আল্লাহর বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রে অর্থাৎ বিচার-ফায়ছালা করার সময় ধনী-গরীব,
ছোট-বড়, দাস-মনিব, রাজা-প্রজা এবং উচ্চ বর্ণ-নিম্ন বর্ণের মধ্যে কোন প্রকার
পার্থক্য করতে পারবেন না। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন,إِنَّمَا النَّاسُ
كَالإِبِلِ الْمِائَةُ لاَ تَكَادُ تَجِدُ فِيهَا رَاحِلَةً ‘নিশ্চয়ই
মানুষ এমন একশত উটের মত, যাদের মধ্য থেকে তুমি একটিকেও বাহনের উপযোগী পাবে
না’।[4]
এর অর্থ হ’ল ইসলামে সকল মানুষই সমান। যেমন একশত উটের মধ্যে সবগুলোর মর্যাদা সমান। তেমনি মানুষের মধ্যে ধনী-গরীব, সাদা-কালো, আশরাফ-আতরাফ সকলের মর্যাদা সমান।
৪. কোন পক্ষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ পূর্বক বিচার না করা : ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় বিচারক যেন কোন অবস্থাতেই কোন পক্ষের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করে বিচার কার্য পরিচালনা না করে সে বিষয়ে আল-কুরআনে কঠোর হুঁশিয়ারী ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ- ‘কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির অধিকতর নিকটবর্তী। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (মায়েদাহ ৫/৮)।
৫. ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে বিচার না করা :
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঘুষের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী সতর্ক করা
হয়েছে। কেননা ইসলামী শরী‘আতে ঘুষ প্রথা আদান-প্রদান সম্পূর্ণরূপে হারাম। তা
গ্রহণ করে অন্যায় বিচার করা যেমন হারাম, তেমনি ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে
অন্যায়ভাবে নিজের পক্ষে রায় বাগিয়ে নেওয়াও হারাম। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে
বর্ণিত তিনি বলেন,لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الرَّاشِى
وَالْمُرْتَشِى فِى الْحُكْمِ ‘বিচারের ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষ
প্রদানকারীকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অভিসম্পাত করেছেন’।[5]
৬. পদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ না করা : ইসলামে কোন দায়িত্ব বা পদ চেয়ে নেয়ার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। চাই তা প্রশাসনিক হোক বা বিচার বিভাগের হোক। যোগ্যতার মানদন্ডে যোগ্যতম ব্যক্তির উপর দায়িত্ব অপর্ণের বিধান হ’ল ইসলামী বিধান। আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيْرًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত সমূহকে তার যথার্থ হকদারগণের নিকটে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বোত্তম উপদেশ দান করছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা ৪/৫৮)।
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) আব্দুর রহমান বিন সামুরাহকে বললেন,يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ
سَمُرَةَ لاَ تَسْأَلِ الإِمَارَةَ، فَإِنَّكَ إِنْ أُوتِيتَهَا عَنْ
مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا، وَإِنْ أُوتِيتَهَا مِنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ
أُعِنْتَ عَلَيْهَا، ‘হে আব্দুর রহমান ইবনে সামুরাহ! নেতৃত্ব বা পদ চেয়ে
নিয়ো না। কেননা তোমার চাওয়ার কারণে যদি তা দেয়া হয়, তাহ’লে তা তোমার উপর
ন্যস্ত করা হবে। আর যদি তা তোমার চাওয়া ব্যতীত প্রদান করা হয়, তবে তুমি
সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’।[6]
ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষ্য দান : বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্যের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী। সাক্ষ্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন বাদীর দাবী প্রমাণিত হ’তে পারে, অপরদিকে তেমনি সেটা বিবাদীর পক্ষে বা বাদীর দাবী অসত্যও প্রমাণিত হ’তে পারে। এজন্য বাদী ও বিবাদী বিচারকার্যে নিজ নিজ পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে থাকে। কেননা বিচারের কাজটি সাক্ষীর সাক্ষ্যদানের উপরেই নির্ভরশীল। সাক্ষীর সত্য সাক্ষ্যের মাধ্যমে বিচারকার্য সঠিক হয়, মিথ্যা সাক্ষ্যের দরুন আবার অন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামে এ ব্যাপারটির উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কুরআন মজীদে এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহ ঘোষণা করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِيْنَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِيْنَ إِنْ يَكُنْ غَنِيًّا أَوْ فَقِيرًا فَاللهُ أَوْلَى بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوا وَإِنْ تَلْوُوا أَوْ تُعْرِضُوا فَإِنَّ اللهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপরে প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হৌক বা গরীব হৌক (সেদিকে ভ্রুক্ষেপ কর না)। কেননা তোমাদের চাইতে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাংখী। অতএব ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ। আল্লাহ তোমাদের সকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত’ (নিসা ৪/১৩৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ... ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্য দানে অবিচল থাক এবং কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে’ (মায়েদাহ ৫/৮)।
বর্ণিত
আয়াতদ্বয়ে সাক্ষ্যদাতাকে আল্লাহ তা‘আলা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শক্ত
হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্ব মানবতার মুক্তি ও কল্যাণে ন্যায়
বিচারের স্বার্থে সাক্ষ্যদাতাকে সত্য সাক্ষ্য দিতে হবে। এজন্য কুরআনের
বক্তব্যের দৃষ্টিতে সাক্ষীদেরকে আল্লাহর সাক্ষী হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে;
কোন বিশেষ পক্ষের সাক্ষী নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়
বিচারককে যেমন ন্যায়পন্থী হওয়া যরূরী; তেমনি সাক্ষীকেও ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া
আবশ্যক। যায়দ ইবনে খালিদ জুহানী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ)
বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِخَيْرِ الشُّهَدَاءِ الَّذِى يَأْتِى
بِشَهَادَتِهِ قَبْلَ أَنْ يُسْأَلَهَا ‘তোমাদের কি আমি উত্তম সাক্ষীদের
সম্পর্কে জানাব না? উত্তম সাক্ষী হ’ল সেই ব্যক্তি, যে সাক্ষ্য প্রদান করে
তাকে সাক্ষ্যের জন্য আহবানের আগেই’।[7]
অপরদিকে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে শরী‘আতে কবীরাহ গুনাহ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ سُئِلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْكَبَائِرِ قَالَ الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَشَهَادَةُ الزُّورِ-
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত
তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-কে কবীরাহ গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি
বলেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা
এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া’।[8]
পবিত্র কুরআনে যারা মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান না করে তাদেরকে আল্লাহর খাঁটি বান্দা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ ‘(আল্লাহর খাঁটি বান্দাহ তারাই) যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না’ (ফুরক্বান ২৫/৭২)।
অনুরূপভাবে সাক্ষ্যদানে কোন কিছু গোপন করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন কর না। যে ব্যক্তি তা গোপন করে, তার হৃদয় পাপিষ্ঠ। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত’ (বাক্বারাহ ২/২৮৩)।
বিচারকের পদের গুরুত্ব ও মর্যাদা : ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় বিচারকের পদের গুরুত্বও অত্যন্ত বেশী। বিচারকের পদ, তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য ও জবাবদিহিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কঠোরতা আরোপ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’ুতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ وَلِىَ الْقَضَاءَ فَقَدْ ذُبِحَ بِغَيْرِ سِكِّينٍ ‘যে ব্যক্তি বিচারকের পদে বা যাকে জনগণের বিচারক নিযুক্ত করা হ’ল, সে যেন বিনা ছুরিতে যবেহ হ’ল’।[9]
ইবনে
বুরায়দাহ থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেন,الْقُضَاةُ ثَلاَثَةٌ وَاحِدٌ فِى الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِى النَّارِ
فَأَمَّا الَّذِى فِى الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ
وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِى الْحُكْمِ فَهُوَ فِى النَّارِ
وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِى النَّارِ ‘বিচারক তিন
প্রকার। একপ্রকার বিচারক জান্নাতী এবং অপর দু’প্রকার বিচারক জাহান্নামী।
জান্নাতী হ’ল সেই বিচারক, যে সত্যকে জেনে-বুঝে তদানুযায়ী বিচার-ফায়ছালা
করে। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে যুলুম করে সে জাহান্নামী
এবং যে বিচারক অজ্ঞতাবশত ফায়ছালা দেয় সেও জাহান্নামী’।[10]
বিচারক
বিচারকার্যে কঠোর প্রচেষ্টার পর যথাযথ সমাধানে উপনীত হোন অথবা ভুল করেন
উভয় অবস্থাতেই প্রতিদান পাবেন। আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন,إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ
ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ
أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ ‘যদি কোন বিচারক যথাযথ চিন্তা-গবেষণার পর সঠিক
বিচার করেন তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার। আর যদি গভীরভাবে
চিন্তা-গবেষণার পরও যদি তিনি ভুল করেন তবুও তার জন্য রয়েছে একটি পুরস্কার’।[11]
ইসলামী
বিচার ব্যবস্থায় বিচারকের মর্যাদা অত্যন্ত বেশী। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর
ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُقْسِطِينَ
عِنْدَ اللهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ عَنْ يَمِينِ الرَّحْمَنِ عَزَّ
وَجَلَّ وَكِلْتَا يَدَيْهِ يَمِينٌ الَّذِينَ يَعْدِلُونَ فِى حُكْمِهِمْ
وَأَهْلِيهِمْ وَمَا وَلُوا ‘নিশ্চয়ই ন্যায়পরায়ণ বিচারকগণ (ক্বিয়ামতের
দিন) আল্লাহর নিকটে নূরের মিম্বরসমূহে মহামহিম দয়াময় প্রভুর ডান পার্শ্বে
মিম্বরের উপর অবস্থান করবেন। তাঁর উভয় হাতই ডান হাত। যারা তাদের শাসনকার্যে
তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে এবং তাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব সমূহের
ব্যাপারে সুবিচার করে’।[12]
ইসলামী বিচার ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত : ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় আল্লাহর বিধানানুযায়ী রায় বাস্তবায়নে দুর্বলতা প্রকাশ কিংবা দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন তো দূরের কথা মনে তা উদ্রেক হওয়াও নিষিদ্ধ। ব্যভিচারীদের শাস্তি কার্যকর করণে মহান আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা, الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ- ‘ব্যভিচারী নারী ও পুরুষের প্রত্যেককে তোমরা একশ’ বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর এই বিধান বাস্তবায়নে তাদের প্রতি যেন তোমাদের হৃদয়ে কোনরূপ দয়ার উদ্রেক না হয়; যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের এই শাস্তি প্রত্যক্ষ করে’ (নূর ২৪/২)।
ইসলামী শরী‘আত
অনুযায়ী আল্লাহ নির্ধারিত শাস্তি (হদ্দ) কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার
সুফারিশ করা এবং সেই সুফারিশ গ্রহণ করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। আব্দুল্লাহ
ইবনে আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ
করেন,تَعَافَوُا الْحُدُودَ فِيمَا بَيْنَكُمْ فَمَا بَلَغَنِى مِنْ حَدٍّ
فَقَدْ وَجَبَ ‘তোমরা আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি (হদ্দ) কার্যকর হওয়ার
যোগ্য অপরাধ পারস্পরিক পর্যায়ে ক্ষমা করতে পার। অন্যথা এ ধরনের অপরাধের
অভিযোগ আমার নিকটে পৌঁছলে অবশ্যই তার শাস্তি বাস্তবায়িত হবে’।[13]
এ
প্রসঙ্গে মাখযূমিয়া নাম্নী কুরাইশ বংশের এক মহিলার চুরি সংক্রান্ত ঘটনা
উল্লেখযোগ্য। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, মাখযূমিয়া চুরি
করে অপরাধী সাব্যস্ত হ’লে কুরাইশরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ)-এর নিকটে কে এ ব্যাপারে সুফারিশ করবে সে বিষয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত
হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)-এর পক্ষে এ
কাজ সম্ভব। তাই তিনি (উসামা) রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে দন্ড মওকূফের ব্যাপারে
সুফারিশ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অত্যন্ত ধমকের সুরে
বললেন, أَتَشْفَعُ فِى حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللهِ ‘হে উসামা! তুমি কি মহান
আল্লাহ ঘোষিত নির্ধারিত শাস্তি মওকূফের সুফারিশ করছ? অতঃপর তিনি দাঁড়িয়ে
ভাষণ দান করলেন যে,أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ
قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ
وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ
اللَّهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ
يَدَهَا ‘হে লোকসকল! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতি এজন্য ধ্বংস হয়েছে
যে, তাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত কেউ চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর দুর্বল
কেউ চুরি করলে তার উপর শাস্তি (হদ্দ) কার্যকর করত। আল্লাহর কসম!
মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করত তাহ’লে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে
দিতাম’।[14]
বিশ্ব মানবতার কল্যাণে ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় ইসলামী আদালতের রায় তথা আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তি কার্যকর করার ব্যাপারে শরী‘আতের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা কঠোর তা এ ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়।
ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় শাস্তি (দন্ড) বাস্তবায়নের ক্ষমতা : ইসলামী শরী‘আতের বিধান মোতাবেক রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে কোন অবস্থাতেই কোন রায় বাস্তবায়ন করা যাবে না। শাস্তি (হদ্দ) বা দন্ডবিধি কার্যকর করার ক্ষমতা কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের। যে কেউ যখন তখন যেখানে ইচ্ছা এই বিধান কার্যকর করলে একটি দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামো ধ্বংস হবে। সাথে সাথে সুষ্ঠু সমাজের স্বাভাবিক সুখ-শান্তি বিপর্যস্ত হবে। ফলে শাস্তির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। অর্থাৎ অপরাধীকে শাস্তি দানের মাধ্যমে অন্যদের শিক্ষা প্রদান পূর্বক সমাজ থেকে অপরাধ সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে। ফলে পরবর্তীতে শাস্তির মূল উদ্দেশ্য- সমাজের শান্তি-শৃংখলা ও সমৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ সাধিত হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হ’লে সমাজের সর্বস্তরে সার্বিক শান্তি ও কল্যাণের ফলগুধারা প্রবাহিত হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সমাজে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করুন- আমীন!!
[1]. বুখারী হা/৭১৫৮; মুসলিম হা/৪৩৮২; আবূদাঊদ হা/৩৫৮৯; তিরমিযী হা/১৩৩৪।
[2]. তিরমিযী হা/১৩৩১; ছহীহুল জামে হা/৪৩৫।
[3]. আহমাদ হা/৮৮২; ছহীহুল জামে হা/৪৭৮; ছহীহাহ হা/১৩০০।
[4]. বুখারী হা/৬৪৯৮।
[5]. তিরমিযী হা/১৩৩৬; ইবনু মাজাহ হা/২৩১৩, সনদ ছহীহ।
[6]. বুখারী হা/৬৬২২; মুসলিম হা/১৬৫২; মিশকাত হা/৩৬৮০।
[7]. মুসলিম হা/১৭১৯; আবুদাঊদ হা/৩৫৯৬; মিশকাত হা/৩৭৬৬।
[8]. বুখারী হা/২৬৫৩-৫৪; মুসলিম হা/৮৭।
[9]. আবূদাঊদ হা/৩৫৭১-৭২; তিরমিযী হা/১৩২৫।
[10]. আবূদাঊদ হা/৩৫৭৩।
[11]. বুখারী হা/৭৩৫২; মুসলিম হা/১৭১৬; আবূদাঊদ হা/৩৫৭৪।
[12]. মুসলিম হা/১৮২৭; নাসাঈ হা/৫৩৭৯; মিশকাত হা/৩৬৯০।
[13]. আবূদাঊদ হা/৪৩৭৬; নাসাঈ হা/৪৮৮৫; মিশকাত হা/৩৫৬৮; ছহীহাহ হা/১৬৩৮।
[14]. বুখারী হা/৬৭৮৭, ৬৭৮৮; মুসলিম হা/৪৩০২, ৪৩০৩; আবূদাঊদ হা/৪৩৭৩, ৪৩৭৪, ৪৩৭৫।