পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

গ. ব্যক্তির দ্বীনের উপরে প্রভাব :

ব্যক্তির দ্বীনদারীর উপরেও পাপের প্রভাব পড়ে। ফলে ইহকাল ও পরকালে সে যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাপাচারের কারণে পাপের প্রতি আসক্তি তৈরী হয়, হেদায়াত ও রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। ঈমান বিনষ্ট হয়। এতে আল্লাহর কাছে লাঞ্ছিত হয় এবং মানুষের কাছেও ঘৃণিত হয়। নিম্নে পাপের কারণে দ্বীনের ক্ষেত্রে যে প্রভাব পড়ে তা উল্লেখ করা হ’ল।-

১. ঈমান বিনষ্ট হওয়া : পাপের কারণে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সে আরো পাপে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে এক সময় তার ঈমান চলে যায়। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا زَنَى الرَّجُلُ خَرَجَ مِنْهُ الْإِيمَانُ كَانَ عَلَيْهِ كَالظُّلَّةِ، فَإِذَا انْقَطَعَ رَجَعَ إِلَيْهِ الْإِيمَانُ ‘যখন কেউ ব্যভিচার করতে থাকে তখন তার থেকে ঈমান বের হয়ে তার (মাথার) উপরে ছায়ার ন্যায় অবস্থান করতে থাকে। অতঃপর যখন সে অবসর হয় তখন ঈমান তার নিকটে ফিরে আসে’।[1]

তিনি আরো বলেন,لاَ يَزْنِى الزَّانِى حِينَ يَزْنِى وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَسْرِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهْوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أَبْصَارَهُمْ حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهْوَ مُؤْمِنٌ ‘কোন ব্যভিচারী মুমিন অবস্থায় ব্যভিচার করে না এবং কোন মদ্যপায়ী মুমিন অবস্থায় মদ পান করে না। কোন চোর মুমিন অবস্থায় চুরি করে না। কোন লুটতরাজকারী মুমিন অবস্থায় এরূপ লুটতরাজ করে না যে, যখন সে লুটতরাজ করে তখন তার প্রতি লোকজন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে’।[2] এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন, এর অর্থ হ’ল, তার হ’তে ঈমানের নূর ছিনিয়ে নেয়া হয়।[3] মোল্লা আলী ক্বারী বলেন,أَنَّ الْإِيمَانَ إِذَا زَنَى الرَّجُلُ خَرَجَ مِنْهُ، ‘যখন কোন লোক ব্যভিচার করে তখন তার থেকে ঈমান বের হয়ে যায়’।[4]

২. হেদায়াত প্রাপ্তির পরে তা থেকে বিচ্যুৎ হওয়া : হেদায়াত বা সত্য পথের দিশা পাওয়ার পর কেবল পাপাচারের কারণে হেদায়াত থেকে দূরে সরে যায়। কেননা আল্লাহ পাপীকে হেদায়াত দান করেন না’ (মুনাফিকূন ৬৩/৬)। সুতরাং পাপী ব্যক্তি হেদায়াত থেকে দূরে চলে যায় বা হেদায়াত বঞ্চিত হয়। আল্লাহ বলেন,فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ، ‘অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি তাদের উপর আপতিত হবে’ (নূর ২৪/৬৩)

রাসূল (ছাঃ) বলেন,قَدْ تَرَكْتُكُمْ عَلَى الْبَيْضَاءِ لَيْلُهَا كَنَهَارِهَا، لَا يَزِيغُ عَنْهَا بَعْدِي إِلَّا هَالِكٌ، ‘আমি তোমাদেরকে আলোকিত দ্বীনের উপর রেখে যাচ্ছি, যার রাত দিনের মতই (উজ্জ্বল)। আমার পরে নিজেকে ধ্বংসকারীই কেবল এ দ্বীন ছেড়ে বিপথগামী হবে’।[5] আবুবকর (রাঃ) বলেন,لَسْتُ تَارِكًا شَيْئًا كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَعْمَلُ بِهِ إِلاَّ عَمِلْتُ بِهِ، فَإِنِّى أَخْشَى إِنْ تَرَكْتُ شَيْئًا مِنْ أَمْرِهِ أَنْ أَزِيغَ. ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যা আমল করতেন, তার কোন কিছুই আমি ছেড়ে দিতে পারি না। বরং আমি তা আমল করব। কেননা আমি আশংকা করি যে, যদি তাঁর কোন কথা আমি ছেড়ে দেই তাহ’লে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাব’।[6]

৩. পাপের প্রতি আসক্ত হওয়া এবং হৃদয় থেকে পাপের প্রতি ঘৃণা দূর হওয়া : মানুষ পাপ করতে করতে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এতে তার পাপকর্ম বৃদ্ধি পায়। এমনকি পাপের প্রতি কোন দ্বিধা-সংকোচ তার মনে স্থান পায় না। ফলে তার পাপাচার অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। আল্লাহ বলেন,وَآخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا، ‘আরও কিছু লোক রয়েছে, যারা তাদের অপরাধ সমূহ স্বীকার করেছে। তারা তাদের কর্মে ভাল ও মন্দ মিশ্রিত করেছে’ (তওবা ৯/১০২)। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنَّ الْفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلَى أَنْفِهِ. ‘ঈমানদার ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে এত বিরাট মনে করে, যেন সে একটা পর্বতের নীচে উপবিষ্ট আছে, আর সে আশঙ্কা করছে যে, সম্ভবত পর্বতটা তার উপর ধ্বসে পড়বে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তার গুনাহগুলোকে মাছির মত মনে করে, যা তার নাকে বসে চলে যায়’।[7]

৪. ক্ষমা থেকে মাহরূম হওয়া : মানুষ সাধারণত জনসম্মুখে পাপাচার করে না। তবে কিছু লোক এমন আছে যারা লোকলজ্জা থাকলেও আল্লাহকে ভয় ও লজ্জা করে না। এজন্য আল্লাহ বলেন,يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللهِ، ‘তারা লোকদের থেকে লুকাতে চায়, কিন্তু আল্লাহ থেকে লুকাতে চায় না’ (নিসা ৪/১০৮)। পক্ষান্তরে যারা পাপ করে এবং তা মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেয়, তারা মহান আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, كُلُّ أُمَّتِى مُعَافًى إِلاَّ الْمُجَاهِرِينَ، وَإِنَّ مِنَ الْمَجَانَةِ أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلاً، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللهُ، فَيَقُولَ يَا فُلاَنُ عَمِلْتُ الْبَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللهِ عَنْهُ আমার সকল উম্মাতকে মাফ করা হবে, তবে প্রকাশকারী ব্যতীত। আর নিশ্চয়ই এটা বড়ই অন্যায় যে, কোন লোক রাতের বেলা অপরাধ করল, যা আল্লাহ গোপন রাখলেন। কিন্তু সে সকাল হ’লে বলে বেড়াতে লাগল, হে অমুক! আমি আজ রাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ সে এমন অবস্থায় রাত কাটাল যে, আল্লাহ তার অপকর্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর সে ভোরে উঠে তার উপর আল্লাহর দেয়া আবরণ খুলে ফেলল’।[8]

৫. আল্লাহর নিকটে লাঞ্ছিত হওয়া : পাপের কারণে মানুষ আল্লাহর কাছে হীন হয়ে যায়। ফলে তার উপরে আল্লাহর আযাব অবধারিত হয়। তবে কখনও আল্লাহ পাপীকে সুযোগ দেন, যাতে সে তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসে। আর যদি সে ফিরে না আসে তাহ’লে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হয় এবং পরকালে তার জন্য শাস্তি অবধারিত হয়। আল্লাহ বলেন,وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ وَمَنْ يُهِنِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ إِنَّ اللهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ، ‘আর বহু মানুষ আছে তাদের উপর শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তাকে সম্মান দেওয়ার কেউ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা চান তাই-ই করেন’ (হজ্জ ২২/১৮)

ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ قَدْ أَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الجَاهِلِيَّةِ وَتَعَاظُمَهَا بِآبَائِهَا، فَالنَّاسُ رَجُلَانِ: بَرٌّ تَقِيٌّ كَرِيمٌ عَلَى اللهِ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ هَيِّنٌ عَلَى اللهِ، وَالنَّاسُ بَنُو آدَمَ، وَخَلَقَ اللهُ آدَمَ مِنْ تُرَابٍ ‘হে জনমন্ডলী! তোমাদের হ’তে আল্লাহ জাহেলী যুগের দম্ভ ও অহংকার এবং পূর্বপুরুষের গৌরব বাতিল করেছেন। অতএব মানুষ দুই ধরনের; একদল মানুষ নেককার, পরহেযগার, আল্লাহর নিকট প্রিয় ও সম্মানিত। অন্যদল পাপিষ্ঠ, দুর্ভাগা, আল্লাহর নিকট অত্যন্ত নিকৃষ্ট, নীচু ও ঘৃণিত। সকল মানুষই আদমের সন্তান। আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে মাটি হ’তে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ‘হে লোক সকল! তোমাদেরকে আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। যে লোক তোমাদের মাঝে বেশী পরহেযগার সে-ই আল্লাহ তা‘আলার নিকটে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত, সব খবর রাখেন’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)[9]

৬. শারঈ ইলম থেকে বঞ্চিত হওয়া : ইলম হচ্ছে নূর, যা আল্লাহ মানব হৃদয়ে প্রক্ষিপ্ত করেন। আর পাপাচার সেই নূরকে নিভিয়ে দেয়। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) যখন ইমাম মালেক (রহঃ)-এর সম্মুখে বসে হাদীছ পাঠ করলেন, তখন তার বিচক্ষণতা, মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে ইমাম মালেক অভিভূত হয়ে বললেন,إني أرى الله قد ألقى على قلبك نورا، فلا تطفئه بظلمة المعصية، ‘আমি দেখছি যে, আল্লাহ তোমার অন্তরে নূর প্রক্ষিপ্ত করেছেন। সুতরাং পাপাচারের যুলুমের মাধ্যমে তুমি তা নিভিয়ে ফেল না’।[10] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,

شَكَوْت إِلَى وَكِيع سوء حفظي* فأوصى لي إِلَى ترك الْمعاصِي

وأخبرني بأن العلم نور * ونور الله لا يهدى لعاصي

‘(আমার উস্তায) অকী‘য়ের নিকটে আমার বিস্মৃতির অভিযোগ করলাম। তিনি আমাকে পাপাচার পরিহারের উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই ইলম হচ্ছে নূর। আর অবাধ্যকে আল্লাহর নূর দান করা হয় না’।[11]

৭. কবীরা গোনাহের কারণে নেক আমল নিষ্ফল হওয়া : কবীরা গোনাহের কারণে কিছু নেক আমল বাতিল ও নিষ্ফল হয়ে যায়। যেমন কুফর ও শিরকের কারণে পূর্বের আমল বাতিল হয়ে যায়। আর রাসূলের তরীকা অনুযায়ী আমল না করলে তা কবুল হয় না (মুসলিম হা/১৭১৮)। আবার কারো প্রতি যুলুম-নির্যাতন করলে, সম্পদ জবরদখল করলে, গীবত করলে, তোহমত দিলে আমল নিষ্ফল হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘তবে যদি তারা শিরক করত, তাহ’লে তাদের সব সৎকর্ম বিফলে যেত’ (আন‘আম ৬/৮৮)। তিনি আরো বলেন,وَمَنْ يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ، ‘আর যে ব্যক্তি ঈমানের বদলে কুফরী করে, তার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (মায়েদাহ ৫/৫)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ ثَوْبَانَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ قَالَ: لَأَعْلَمَنَّ أَقْوَامًا مِنْ أُمَّتِي يَأْتُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِحَسَنَاتٍ أَمْثَالِ جِبَالِ تِهَامَةَ بِيضًا، فَيَجْعَلُهَا اللهُ هَبَاءً مَنْثُورًا، قَالَ ثَوْبَانُ: يَا رَسُولَ اللهِ صِفْهُمْ لَنَا، جَلِّهِمْ لَنَا أَنْ لَا نَكُونَ مِنْهُمْ، وَنَحْنُ لَا نَعْلَمُ، قَالَ: أَمَا إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ، وَمِنْ جِلْدَتِكُمْ، وَيَأْخُذُونَ مِنَ اللَّيْلِ كَمَا تَأْخُذُونَ، وَلَكِنَّهُمْ أَقْوَامٌ إِذَا خَلَوْا بِمَحَارِمِ اللهِ انْتَهَكُوهَا

ছাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা ক্বিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমলসহ উপস্থিত হবে। মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করবেন। ছাওবান (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় পরিষ্কারভাবে আমাদের নিকট বর্ণনা করুন, যাতে অজ্ঞাতসারে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই। তিনি বললেন, তারা তোমাদেরই ভ্রাতৃগোষ্ঠী এবং তোমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতই ইবাদত করবে। কিন্তু তারা এমন লোক যে, একান্ত গোপনে আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে’।[12]

অন্যত্র এসেছে, আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) একদিন ছাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟ قَالُوا: الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ، فَقَالَ: إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ، وَصِيَامٍ، وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ، ‘তোমরা কি জান, নিঃস্ব কে? তারা বলল, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যার কাছে কোন দিরহাম এবং কোন আসবাবপত্র নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে (প্রকৃত) নিঃস্ব তো সেই ব্যক্তি, যে ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের (নেকী) নিয়ে হাযির হবে। কিন্তু এর সাথে সাথে সে এ অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারো মাল (অবৈধভাবে) ভক্ষণ করেছে, কারো রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। তখন একে তার নেকী থেকে দেওয়া হবে, ওকে তার নেকী থেকে দেওয়া হবে। অতঃপর যদি অন্যদের দাবী পূরণ করার পূর্বেই তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তখন তাদের (মযলূমদের) পাপ থেকে নিয়ে তাকে দেওয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[13]

৮. দো‘আ কবুল না হওয়া : আল্লাহর নিকটে নেক আমল কবুল হওয়ার জন্য আক্বীদায়ে ছহীহাহ, তরীকায়ে ছহীহাহ ও ইখলাছুন নিয়তাহ আবশ্যক। তদ্রূপ রিযিক হালাল হওয়াও অতি যরূরী। কেননা হারাম ভক্ষণ করা আল্লাহর নাফরমানী। যার ফলে আল্লাহর নিকটে দো‘আ ও ইবাদত কবুল হয় না। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ وَقَالَ: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ ‘হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছু গ্রহণ করেন না। তিনি রাসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন একই নির্দেশ মুমিনদের প্রতিও জারী করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত হ’তে আহার কর এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর, সব বিষয়ে আমি অবগত’ (মুমিনূন ২৩/৫১)। তিনি আরও বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমরা তোমাদের যে রূযী দান করেছি, সেখান থেকে পবিত্র বস্ত্ত সমূহ ভক্ষণ কর’ (বাক্বারাহ ২/১৭২)। এরপর তিনি উল্লেখ করেন যে, الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟ জনৈক ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে ধূলিমলিন অবস্থায় দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দো‘আ করে, ইয়া রবব, ইয়া রবব! অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোষাক হারাম, সে পরিপুষ্ট হয়েছে হারাম খেয়ে, তাহ’লে তার দো‘আ কিভাবে কবুল হবে?’[14]

৯. রাসূল (ছাঃ) ও ফেরেশতাদের দো‘আ থেকে বঞ্চিত হওয়া : পাপীদের জন্য ফেরেশতারা দো‘আ করেন না। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পথে চলে, তাঁদের অবাধ্যতা ও নাফরমানী করে না তাদের জন্য ফেরেশতারা দো‘আ করেন। তাদের জন্য মাগফিরাত ও জান্নাত প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুমিনদের জন্য দো‘আ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করে ও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর তারা মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার অনুগ্রহ ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব যারা তওবা করে ও তোমার রাস্তায় চলে তাদেরকে তুমি ক্ষমা করো এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে তাদের রক্ষা কর! হে আমাদের প্রতিপালক! আর তুমি তাদের প্রবেশ করাও চিরস্থায়ী বসবাসের জান্নাতসমূহে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদের দান করেছ। আর তাদের বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয়ই তুমিই তো মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়। আর তুমি তাদেরকে সকল মন্দ কাজ হ’তে রক্ষা কর। আর যাকে তুমি মন্দ কাজ সমূহ থেকে রক্ষা করবে তাকেই তো তুমি ক্বিয়ামতের দিন অনুগ্রহ করবে (জান্নাতে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে)। আর সেটাই তো মহা সফলতা’ (মুমিন ৪০/৭-৯)। কিন্তু যারা মুমিন নয় কিংবা পাপাচারে লিপ্ত তারা ফেরেশতাগণের দো‘আ থেকে বঞ্চিত হয়।

১০. পাপীর প্রতি পশুদের অভিশাপ : পাপীর অবাধ্যতার কারণে পৃথিবীতে বৃষ্টি না হওয়ায় সব প্রাণী কষ্ট ভোগ করে। ফলে তারা পাপীর জন্য অভিশাপ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,فَمَا بَكَتْ عَلَيْهِمُ السَّمَاءُ وَالْأَرْضُ وَمَا كَانُوا مُنْظَرِينَ، ‘অতঃপর আকাশ ও পৃথিবী তাদের জন্য অশ্রুপাত করেনি এবং তাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়নি’ (দুখান ৪৪/২৯)। আর প্রাণীকূলের অভিশাপে তারা ধ্বংস হয়। পরকালে শাস্তি পায়।

১১. জাহান্নামী হওয়া : পাপের পরিণতি কখনও শুভ হয় না। বরং এর ভয়াবহ পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভোগ করতে হয়। তওবা না করে মারা গেলে পাপীকে জাহান্নামে যেতে হয়। আল্লাহ বলেন,لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ أَلَا سَاءَ مَا يَزِرُونَ، ‘ফলে ক্বিয়ামতের দিন ওরা পূর্ণমাত্রায় বহন করবে ওদের পাপভার এবং যাদেরকে ওরা অজ্ঞতা বশে বিভ্রান্ত করেছে তাদের পাপভার। দেখ কতই না নিকৃষ্ট ভার, যা তারা বহন করবে’ (নাহল ১৬/২৫)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَالَّذِينَ كَسَبُوا السَّيِّئَاتِ جَزَاءُ سَيِّئَةٍ بِمِثْلِهَا وَتَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ مَا لَهُمْ مِنَ اللهِ مِنْ عَاصِمٍ كَأَنَّمَا أُغْشِيَتْ وُجُوْهُهُمْ قِطَعًا مِنَ اللَّيْلِ مُظْلِمًا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ، ‘পক্ষান্তরে যারা মন্দ কাজ করে, তাদের মন্দের পরিণাম তদ্রূপই হবে। অপমান তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে। আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদের বাঁচাবার কেউ নেই। যেন তাদের চেহারা সমূহকে ঘোর অন্ধকার রাত্রির টুকরা দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলা হয়েছে। এরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (ইউনুস ১০/২৭)। তিনি আরো বলেন,وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَكُبَّتْ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ هَلْ تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ، ‘আর যে ব্যক্তি মন্দকর্ম নিয়ে আসবে, তাকে মুখে ভর দেওয়া অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তোমাদের কৃতকর্মের ফল ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান কি তোমরা প্রাপ্ত হবে’? (নামল ২৭/৯০)

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,بَلَى مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ، ‘হ্যাঁ, যারা পাপ করে এবং পাপ তাদের বেষ্টন করে ফেলে, তারা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৮১)

গোনাহগারের পরিণতির উদাহরণ দিয়ে হাদীছে বলা হয়েছে, إِيَّاكُمْ وَمُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ، فَإِنَّهُنَّ يَجْتَمِعْنَ عَلَى الرَّجُلِ حَتَّى يُهْلِكْنَهُ، وَإِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ضَرَبَ لَهُنَّ مَثَلًا: كَمَثَلِ قَوْمٍ نَزَلُوا أَرْضَ فَلَاةٍ، فَحَضَرَ صَنِيعُ الْقَوْمِ، فَجَعَلَ الرَّجُلُ يَنْطَلِقُ، فَيَجِيءُ بِالْعُودِ، وَالرَّجُلُ يَجِيءُ بِالْعُودِ، حَتَّى جَمَعُوا سَوَادًا، فَأَجَّجُوا نَارًا، وَأَنْضَجُوا مَا قَذَفُوا فِيهَا ‘তোমরা ছোট ছোট গোনাহ সমূহ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা যখন তা কোন ব্যক্তির মধ্যে জমা হয়, তখন তাকে ধ্বংস করে ছাড়ে। রাসূল (ছাঃ) ছোট ছোট গোনাহের উদাহরণ দিয়েছেন এভাবে যে, কোন সম্প্রদায় কোন মরুভূমিতে অবতরণ করল। অতঃপর প্রত্যেকে একটি করে কাঠ সংগ্রহ করায় বড় স্তূপে পরিণত হ’ল। এরপর তারা আগুন জ্বালালো। আর তাতে যা নিক্ষেপ করল, তা পাকানো হয়ে গেল’।[15]

ঘ. সমাজের উপরে প্রভাব

পাপিষ্ঠের পাপাচারের অশুভ প্রভাব সমাজের উপরেও পড়ে। ফলে সমাজের শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট হয়। সমাজে অস্থিতিশীলতা ও অশান্তি বিরাজ করে। ফলে তার কবল থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে সমাজের মানুষ’ (নিসা ৪/৭৫)। নিম্নে সমাজের উপরে পাপের প্রভাব উল্লেখ করা হ’ল।-

১. দুনিয়ার বরকত (কল্যাণ) দূরীভূত হয় : পাপাচার দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দূরীভূত করে এবং আল্লাহর পাকড়াওকে অবধারিত করে। আল্লাহ বলেন,وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ، ‘অথচ জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করল। ফলে তাদের কৃতকর্মের দরুণ আমরা তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)

অন্যত্র তিনি বলেন,وَضَرَبَ اللهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللهِ فَأَذَاقَهَا اللهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ، وَلَقَدْ جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِنْهُمْ فَكَذَّبُوهُ فَأَخَذَهُمُ الْعَذَابُ وَهُمْ ظَالِمُونَ، ‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন একটি জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও শান্ত। যেখানে প্রত্যেক স্থান থেকে আসত প্রচুর জীবনোপকরণ। অতঃপর তারা আল্লাহর নে‘মত সমূহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ ক্ষুধা ও ভীতির দূরবস্থার স্বাদ আস্বাদন করালেন। তাদের নিকট তো এসেছিল তাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। ফলে যালেম অবস্থাতেই তাদেরকে শাস্তি এসে গ্রাস করল’ (নাহল ১৬/১১২-১৩)

স্মর্তব্য যে, পাপীকে আল্লাহ কোন নে‘মত দিলেই এটা তার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির নিদর্শন নয়। বরং এটা হচ্ছে তাকে অবকাশ দেওয়া। হাদীছে এসেছে, عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا رَأَيْتَ اللهَ يُعْطِى الْعَبْدَ مِنَ الدُّنْيَا عَلَى مَعَاصِيهِ مَا يُحِبُّ فَإِنَّمَا هُوَ اسْتِدْرَاجٌ. ثُمَّ تَلاَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم (فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ فَتَحْنَا عَلَيْهِمْ أَبْوَابَ كُلِّ شَىْءٍ حَتَّى إِذَا فَرِحُوا بِمَا أُوتُوا أَخَذْنَاهُمْ بَغْتَةً فَإِذَا هُمْ مُبْلِسُونَ) ওকবা বিন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘বান্দা পাপে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও যদি দেখ যে আল্লাহ তার চাহিদা পূরণ করছেন তাহ’লে মনে করবে যে, এটা হ’ল তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবকাশ দেয়া। এরপর তিনি এই আয়াত তেলওয়াত করলেন, ‘অতঃপর যখন তারা ঐসব উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদের দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা তাদের জন্য প্রত্যেক বস্ত্তর (প্রবৃদ্ধির) দুয়ার সমূহ খুলে দিলাম। এভাবে তারা যখন নে‘মত সমূহ পেয়ে খুশীতে মত্ত হয়ে গেল, তখন তাদেরকে আমরা হঠাৎ পাকড়াও করলাম। ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়ল’ (আন‘আম ৬/৪৪)[16]

২. শত্রুদের কাছে পরাভূত হয় : মানুষ আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর নাফরমানী করলে তারা শক্তিহীন ও ভীরু হয়ে পড়বে। ফলে শত্রুদের কাছে পরাজিত হবে যাবে। আল্লাহ বলেন,وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيْحُكُمْ وَاصْبِرُوْا إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ، ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। আর আপোষে ঝগড়া করো না। তাহ’লে তোমরা শক্তিহীন হয়ে পড়বে ও তোমাদের প্রতিপত্তি উবে যাবে। তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন’ (আনফাল ৮/৪৬)

আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নাফরমানী করলে শত্রুদেরকে তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর তারা তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللهِ، وَعَهْدَ رَسُولِهِ، إِلَّا سَلَّطَ اللهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ، فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ، ‘যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ কেড়ে নেয়’।[17]

৩. পৃথিবীতে ভূমিকম্প ও ভূমিধ্বস হওয়া : পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সুনামী সহ নানা ধরনের দুর্যোগ হয়ে থাকে। আর এসবের মূল কারণ হ’ল মানুষের কৃতকর্মের পার্থিব ফল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَكُلًّا أَخَذْنَا بِذَنْبِهِ فَمِنْهُمْ مَنْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِ حَاصِبًا وَمِنْهُمْ مَنْ أَخَذَتْهُ الصَّيْحَةُ وَمِنْهُمْ مَنْ خَسَفْنَا بِهِ الْأَرْضَ وَمِنْهُمْ مَنْ أَغْرَقْنَا وَمَا كَانَ اللهُ لِيَظْلِمَهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ، ‘অতঃপর তাদের প্রত্যেককে আমরা তাদের পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম। ফলে তাদের কারো প্রতি আমরা প্রেরণ করেছিলাম প্রবল শিলাঝড়। কাউকে পাকড়াও করেছে প্রচন্ড নিনাদ। কাউকে আমরা ধ্বসিয়ে দিয়েছি ভূগর্ভে। কাউকে ডুবিয়ে মেরেছি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তাদের প্রতি যুলুম করেননি। বরং তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল’ (আনকাবূত ২৯/৪০)। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: فِي هَذِهِ الأُمَّةِ خَسْفٌ وَمَسْخٌ وَقَذْفٌ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ المُسْلِمِينَ: يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَتَى ذَاكَ؟ قَالَ: إِذَا ظَهَرَتِ القَيْنَاتُ وَالمَعَازِفُ وَشُرِبَتِ الخُمُورُ-

ইমরান ইবনু হুছাইন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘এ উম্মাতের মাঝে ভূমিধস, চেহারা বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণের আযাব হবে। জনৈক মুসলিম ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! কখন এসব আযাব সংঘটিত হবে? তিনি বললেন, যখন গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র বিস্তৃতি লাভ করবে এবং মদ্যপানের সয়লাব শুরু হবে’।[18] অন্যত্র তিনি বলেন, يَكُونُ فِي آخِرِ هَذِهِ الْأُمَّةِ خَسْفٌ وَمَسْخٌ وَقَذْفٌ، قَالَتْ قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَنَهْلِكُ وَفِينَا الصَّالِحُونَ؟ قَالَ: نَعَمْ إِذَا ظَهَرَ الخُبْثُ، ‘এই উম্মাতের শেষ পর্যায়ে ভূমিধস, শারীরিক অবয়ব বিকৃতি ও পাথর বর্ষণের শাস্তি আপতিত হবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের মাঝে সৎলোক বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কি আমাদের ধ্বংস করে দেয়া হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যখন ঘৃণ্য পাপাচারের প্রকাশ ও ব্যাপক প্রসার ঘটবে’।[19]

৪. নিরাপত্তা ও শান্তি বিদূরিত হওয়া : পাপাচার সমাজের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তি দূর করে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন একটি জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও শান্ত। যেখানে প্রত্যেক স্থান থেকে আসত প্রচুর জীবনোপকরণ। অতঃপর তারা আল্লাহর নে‘মত সমূহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ ক্ষুধা ও ভীতির দূরবস্থার স্বাদ আস্বাদন করালেন’ (নাহল ১৬/১১২)

৫. সমুদ্রে ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়া : মানুষের পাপাচারের কারণে পৃথিবীর সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ، ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে স্থলে ও জলে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের কিছু কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (আল্লাহর দিকে) ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)। বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, ফল-ফসল বিনষ্ট হওয়া, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি মানুষের পাপাচারেরই বিষময় ফল। এসব গযব দিয়ে আল্লাহ মানুষকে হকের পথে ফিরিয়ে আনতে চান।

৬. সমাজের সদস্যদের মাঝে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়া : পাপ সমাজের মানুষের মাঝে বিদ্বেষ ছড়ায়, ভ্রাতৃত্ব নষ্ট করে। ফলে তারা দলে দলে বিভক্ত হয়। আল্লাহ বলেন,وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ، الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ، ‘আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহা পরাক্রান্ত। তারা এমন লোক, যাদেরকে আমরা যদি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহ’লে তারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহরই অধিকারে রয়েছে সকল কাজের পরিণাম’ (হজ্জ ২২/৪০-৪১)

হাদীছে এসেছে, ইবনু ওমর (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, إِذَا تَبَايَعْتُمْ بِالْعِينَةِ، وَأَخَذْتُمْ أَذْنَابَ الْبَقَرِ، وَرَضِيتُمْ بِالزَّرْعِ، وَتَرَكْتُمُ الْجِهَادَ، سَلَّطَ اللهُ عَلَيْكُمْ ذُلًّا لَا يَنْزِعُهُ حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ ‘যখন তোমরা ঈনা[20] পদ্ধতিতে ব্যবসা করবে, গরুর লেজ অাঁকড়ে ধরবে, কৃষিকাজেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং জিহাদ ছেড়ে দিবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা ও অপমান চাপিয়ে দিবেন। তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ তোমাদেরকে এই অপমান থেকে মুক্তি দিবেন না’।[21]

তিনি আরো বলেন,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ فَإِنَّكُمْ أَهْلُ هَذَا الأَمْرِ مَا

لَمْ تَعْصُوا اللهَ فَإِذَا عَصَيْتُمُوْهُ بَعَثَ عَلَيْكُمْ مَنْ يَلْحَاكُمْ كَمَا يُلْحَى هَذَا الْقَضِيبُ، ‘হে কুরায়শ সম্প্রদায়! তোমরা নেতৃত্বের অধিকারী হবে যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর অবাধ্যতা কর। অতঃপর যখন তোমরা আল্লাহর অবাধ্যতা করবে, তখন তোমাদের প্রতি এমন কাউকে পাঠাবেন যারা তোমাদের চামড়া ছাড়িয়ে নিবে। যেমন গাছের ছাল তোলা হয়’।[22]

৭. সমাজের মানুষের মধ্যে মতানৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয় : পাপাচার বা আল্লাহর নাফরমানীর কারণে সমাজের মানুষের মাঝে মতানৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা তৈরী হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا تَوَادَّ اثْنَانِ فِي اللهِ، جَلَّ وَعَزَّ، أَوْ فِي الإِسْلاَمِ، فَيُفَرِّقُ بَيْنَهُمَا أَوَّلُ ذَنْبٍ يُحْدِثُهُ أَحَدُهُمَا. ‘দুই ব্যক্তি মহামহিম আল্লাহর জন্য অথবা ইসলামের সৌজন্যে পরস্পর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অতঃপর তাদের মধ্যকার কোন একজনের প্রথম অপরাধ তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়’।[23] আর এর ফলেই সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করে।

৮. প্রাণীকূল, গাছপালা ও সৃষ্টিজগতের উপরে পাপের প্রভাব পড়ে : আদম সন্তানের গোনাহের অশুভ পরিণতির শিকার হয় প্রাণীকূল, গাছপালা, উদ্ভিত ও সমগ্র সৃষ্টিজগৎ। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ، ‘আমরা এই কিতাবে মানবজাতির জন্য স্পষ্ট বিধান ও পথনির্দেশ সমূহ বিশদভাবে নাযিল করার পরও যারা সেগুলিকে গোপন করে, তাদেরকে লা‘নত করেন আল্লাহ ও লা‘নত করেন সকল লা‘নতকারীগণ’ (বাক্বারাহ ২/১৫৯)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাবেঈ মুজাহিদ (রহঃ) বলেন,إِنَّ الْبَهَائِمَ تَلْعَنُ عُصَاةَ بَنِي آدَمَ إِذَا اشْتَدَّتِ السَّنَةُ، وَأُمْسِكَ الْمَطَرُ، وَتَقُولُ: هَذَا بِشُؤْمِ مَعْصِيَةِ ابْنِ آدَمَ، ‘নিশ্চয়ই চতুষ্পদ প্রাণী পাপীষ্ঠ বনু আদমের জন্য অভিশাপ করে, যখন অত্যধিক খরা হয় এবং বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। আর তারা বলে, এসব হচ্ছে আদম সন্তানের পাপের অশুভ পরিণতি’।[24]

গোনাহগার ব্যক্তির অবাধ্যতার অশুভ পরিণতি থেকে অন্যান্য প্রাণী নিষ্কৃতি চায় মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى قَتَادَةَ بْنِ رِبْعِىٍّ الأَنْصَارِىِّ أَنَّهُ كَانَ يُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُرَّ عَلَيْهِ بِجِنَازَةٍ فَقَالَ مُسْتَرِيحٌ، وَمُسْتَرَاحٌ مِنْهُ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ مَا الْمُسْتَرِيحُ وَالْمُسْتَرَاحُ مِنْهُ قَالَ الْعَبْدُ الْمُؤْمِنُ يَسْتَرِيحُ مِنْ نَصَبِ الدُّنْيَا وَأَذَاهَا إِلَى رَحْمَةِ اللهِ، وَالْعَبْدُ الْفَاجِرُ يَسْتَرِيحُ مِنْهُ الْعِبَادُ وَالْبِلاَدُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ.

ক্বাতাদাহ ইবনু রিবঈ আনছারী (রাঃ) বর্ণনা করেন। একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পাশ দিয়ে একটি জানাযা নিয়ে যাওয়া হ’ল। তিনি বললেন, সে সুখী অথবা (অন্য লোকেরা) তার থেকে শান্তি লাভকারী। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ‘মুস্তারিহ’ ও ‘মুস্তারাহ মিনহু’-এর অর্থ কি? তিনি বললেন, মুমিন বান্দা দুনিয়ার কষ্ট ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে আল্লাহর রহমতের দিকে পৌঁছে শান্তি প্রাপ্ত হয়। আর গুনাহগার বান্দার আচার-আচরণ থেকে সকল মানুষ, শহর-বন্দর, বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু শান্তিপ্রাপ্ত হয়’।[25]

৯. পাপাচারে লিপ্ত জাতিকে আল্লাহ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করেন না: পাপের অতল গহবরে নিমজ্জিত জাতিকে আল্লাহ পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করেন না। তাদেরকে তিনি সুযোগ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন তাদের পাপাচার সীমা অতিক্রম করে তখন তাদেরকে পাকড়াও করেন। জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সমুদ্রের মুহাজিরগণ (হাবশায় হিজরতকারী প্রথম দল) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট প্রত্যাবর্তন করলে তিনি বলেন, তোমরা হাবশায় যেসব অনিষ্টকর বিষয় প্রত্যক্ষ করেছ তা কি আমার নিকট ব্যক্ত করবে না? তাদের মধ্য থেকে এক যুবক বলল, হ্যঁা, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! একদা আমরা উপবিষ্ট ছিলাম, আমাদের সম্মুখ দিয়ে সেখানকার এক বৃদ্ধা মহিলা মাথায় পানি ভর্তি কলসসহ যাচ্ছিল। সে তাদের এক যুবককে অতিক্রমকালে সে বৃদ্ধার কাঁধে হাত রেখে ধাক্কা দিলে বৃদ্ধা উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং তার কলসটি ভেঙ্গে যায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, হে দাগাবাজ! তুমি অচিরেই জানতে পারবে যখন আল্লাহ তা‘আলা ইনছাফের আসনে উপবিষ্ট হয়ে পূর্বাপর সকল মানুষকে সমবেত করবেন এবং হাত-পাগুলো তাদের কৃতকর্মের বিবরণ দিবে তখন তুমিও জানতে পারবে সেদিন তোমার ও আমার অবস্থা কি হবে। জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এই বৃদ্ধা সত্য কথাই বলেছে, সত্য কথাই বলেছে। আল্লাহ তা‘আলা সেই উম্মাতকে কিভাবে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন, যাদের সবলদের থেকে দুর্বলদের প্রাপ্য আদায় করে দেয়া হয় না’?[26]

উপসংহার : দুনিয়াতে যারা নানা পাপকর্মে লিপ্ত তাদের প্রতি চতুষ্পদ জন্তুও লা‘নত করে। তাদের থেকে সবাই আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ চায়। তাদের জন্য বদদো‘আ করে। ফলে দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের পরিণতি ভাল হয় না। তাই সকলের জন্য করণীয় হ’ল পাপ ও অবাধ্যতা পরিহার করা এবং মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ আমাদেরকে পাপ থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন-আমীন!


[1]. আবূদাউদ হা/৪৬৯০; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৯৪।

[2]. বুখারী হা/২৪৭৫, ৫৫৭৮, ৬৭৭২, ৬৮১০; মুসলিম হা/৫৭; মিশকাত হা/৫৩।

[3]. ঐ।

[4]. মিরক্বাতুল মাফাতীহ, (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১ম সংস্করণ, ১৪২২হিঃ/২০০২খ্রিঃ), ১/১২৪ পৃঃ।

[5]. আহমাদ হা/১৭১৮২; ইবনু মাজাহ হা/৪৩; ছহীহাহ হা/৯৩৭।

[6]. বুখারী হা/৩০৯৩।

[7]. বুখারী হা/৬৩০৮; তিরমিযী হা/২৪৯৭; মিশকাত হা/২৩৫৮।

[8]. বুখারী হা/৬০৬৯; মুসলিম হা/২৯৯০; মিশকাত হা/৪৮৩০।

[9]. তিরমিযী হা/৩২৭০; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৮৬৭।

[10]. ইবনুল কায়েমে আল-জাওযিয়াহ, আল-জওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আনিদ দাওয়াইশ শাফী, ১/৫২ পৃঃ।

[11]. মুহীউদ্দীন আল-হানাফী, আল-জাওহারুল মুযিয়্যা ফী ত্বাবাক্বাতিল হানাফিয়্যাহ, ২/৪৮৭ পৃঃ।

[12]. ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৫; ছহীহাহ হা/৫০৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৫০২৮।

[13]. মুসলিম হা/২৫৮১; মিশকাত হা/৫১২৭

[14]. মুসলিম হা/১০১৫; তিরমিযী হা/২৯৮৯; মিশকাত হা/২৭৬০;

[15]. আহমাদ হা/৩৮১৮, সনদ হাসান লি গায়রিহী।

[16]. আহমাদ হা/১৭৩৪৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪১৩।

[17]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; ছহীহাহ হা/১০৬।

[18]. তিরমিযী হা/২২১২; ছহীহাহ হা/১৬০৪।

[19]. তিরমিযী হা/২১৮৫; ছহীহাহ হা/৯৮৭।

[20]. প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ধারে অধিক মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় করা। যেমন কেউ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দশ টাকায় কিছু বিক্রি করল এবং ঐ সময় শেষ হওয়ার পর তা আট টাকায় কিনে নিল।

[21]. আবু দাউদ হা/৩৪৬২; ছহীহাহ হা/১১; ছহীহুল জামে‘ হা/৪২৩।

[22]. আহমাদ হা/৪৩৮০; ছহীহাহ হা/১৫৫২; ছহীহাহ হা/১৩৫৯।

[23]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪০১; ছহীহাহ হা/৬৩৭।

[24]. মুহীউস সুন্নাহ আল-বাগাভী, মা‘আলিমুত তানযীল ফী তাফসীরিল কুরআন (তাফসীরে বাগাভী), (বৈরূত : দারু ইহয়াইত তুরাছ আল-আরাবী, ১ম প্রকাশ, ১৪২০ হিঃ), ১/১৯৪; ইবনুল ক্বাইয়েম, আল-জওয়াবুল কাফী লিমান সাআলা আন দাওয়াইশ শাফী, ১/৫৮ পৃঃ।

[25]. বুখারী হা/৬৫১২-১৩; মুসলিম হা/৯৫০; মিশকাত হা/১৬০৩।

[26]. ইবনু মাজাহ হা/৪০১০, সনদ ছহীহ।






বিষয়সমূহ: পাপ
১৬ই ডিসেম্বর সারেন্ডার অনুষ্ঠানে জে. ওসমানী কেন উপস্থিত ছিলেন না? চাঞ্চল্যকর তথ্য - মোবায়েদুর রহমান
হকের পথে বাধা : মুমিনের করণীয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মুসলিম সমাজ ও মাওলানা আকরম খাঁ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মানুষের সাথে আচার-ব্যবহারের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
উত্তম মৃত্যুর কিছু নিদর্শন ও আমাদের করণীয় - ইহসান ইলাহী যহীর
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
রবার্ট ক্লাইভ : ইতিহাসের এক ঘৃণ্য খলনায়ক - ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
শরী‘আতের আলোকে জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
সার্ভকোয়াল মডেলের আলোকে শিক্ষা পরিষেবার গুণমান নির্ণয় - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.