জামা‘আতবদ্ধভাবে দাওয়াতের গুরুত্বও ফযীলত :

জামা‘আতবদ্ধ দাওয়াত যেমন অধিক কার্যকর, ফলপ্রসু ও প্রভাব বিস্তারকারী তেমনি সংঘবদ্ধ বা জামা‘আতবদ্ধভাবে দা‘ওয়াত প্রদানের বহু উপকারিতা রয়েছে। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল।-

১. সম্মিলিত প্রচেষ্টা :

জীবনে সমবেত প্রচেষ্টার এক বিশেষ গুরুত্ব আছে। সকলে মিলে যে কোন কাজ সহজেই সমাধা করা যায়। এজন্য বলা হয়, ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’ কিংবা ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। ব্যক্তির একক শক্তিকে একত্রিত করলে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে একার পক্ষে যে কাজ করা কষ্টসাধ্য, অনেকে মিলে করলে সে কাজ সহজেই সম্পন্ন করা যায়। তেমনি দাওয়াতী কাজ সাংগঠনিকভাবে করলে সহজেই তা সম্পন্ন করা যায়। আর সাংগঠনিকভাবে দাওয়াত দেওয়া আল্লাহর নির্দেশ। তিনি বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ، ‘আর তোমাদের মধ্যে একটা দল থাকা চাই, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে, তারা মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল সফলকাম’ (আলে ইমরান ৩/১০৪)

অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, بَلِّغُوْا عَنِّىْ وَلَوْ آيَةً ‘একটি আয়াত হ’লেও তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও’।[1] এখানেও একাকী নয়, বরং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দাওয়াতী কাজ সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

২. মেধা ও দক্ষতা বিনিময় :

সাংগঠনিকভাবে যে কোন কাজ করলে তাতে বহু মানুষের বুদ্ধি-মেধা ও দক্ষতার সমন্বয় ঘটে। ফলে যে কোন কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়। যেমন কবি বলেন,

ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল

গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।

মুহূর্ত নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,

রচে যুগ-যুগান্তর অনন্ত মহান।

বিন্দু বিন্দু পানি যেমন বিশাল বারিধি তৈরী করে, তেমনি বহু মানুষের বুদ্ধি ও দক্ষতায় দাওয়াতী কাজ অধিক সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও ফলপ্রসু হয়।

৩. পরামর্শ ভিত্তিক দাওয়াত :

সাংগঠনিকভাবে দাওয়াতী কাজ করলে অনেকের সাথে পরামর্শ

করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়। আর কাজের ব্যাপারে পরামর্শ করা আল্লাহর নির্দেশ। তিনি স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ ‘যরূরী বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘(মুমিনরা) নিজেদের মধ্যে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে’ (শূরা ৪২/৩৮)। তাই সংগঠনের কর্মীদের সাথে পরামর্শ করে সময়োপযোগী ও পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী দাওয়াতের পদ্ধতি ও মাধ্যম নির্বাচন করা যায় এবং দক্ষ দাঈ নিযুক্ত করা যায়। ফলে দাওয়াত সর্বজনগ্রাহ্য হয়। সুতরাং একাকী বা বিচ্ছিন্নভাবে দাওয়াত দিলে যতটুকু ফলপ্রসু হয়, সাংগঠনিক ভাবে দাওয়াত দিলে তদপেক্ষা অধিক কার্যকর ও ফলপ্রসু হয়।

৪. পারস্পরিক সহযোগিতা :

অনেকের অংশগ্রহণে যে কোন কাজে সহযোগিতা পাওয়া যায়। তেমনি দাওয়াতী কাজ সাংগঠনিকভাবে করা হ’লে পরস্পরকে সহযোগিতা করা সম্ভব হয়। আর নেকীর কাজে সহযোগিতার মাধ্যমে সকলে ছওয়াবের অধিকারী হয়। আল্লাহ বলেন,وَتَعَاوَنُوْا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ، ‘তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর এবং পাপ ও সীমালংঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না’ (মায়েদাহ ৫/২)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يَرُدُّ مُشِدُّهُمْ عَلَى مُضْعِفِهِمْ وَمُتَسَرِّعُهُمْ عَلَى قَاعِدِهِمْ، ‘প্রত্যেক মুসলিম তার প্রতিপক্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে অন্য মুসলিমকে সাহায্য করবে। যার শক্তিশালী ও দ্রুত গতিসম্পন্ন সওয়ারী আছে, সে দুর্বল ও ধীর গতিসম্পন্ন সওয়ারীর অধিকারী ব্যক্তির সাথে থেকে চলবে’।[2] এ হাদীছেও একত্রিত চলার এবং পারস্পরিক সহযোগিতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং দাওয়াতী কাজও একে অপরের সহযোগিতায় সম্পন্ন করার চেষ্টা করতে হবে।

৫. প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করা সহজ হয় :

দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিরোধী পক্ষ সামনে এসে দাঁড়ায় এবং তারা দাওয়াতী কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে একক ব্যক্তির পক্ষে বিরোধীদের মোকাবেলা করা কিংবা তাদের মোকাবেলায় দাওয়াতী কাজ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে সাংগঠনিকভাবে দাওয়াতী কাজ করলে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরী হয়। তখন বিরোধীরা দূরে থাকে এবং সহসা কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বিরোধীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাছাড়া বিরোধী কেউ থাকলে সাংগঠনিকভাবে তাদের মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।

৬. দাওয়াতের স্থায়ী ভিত্তি স্থাপন :

ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করলে সাধারণতঃ ব্যক্তি মৃত্যুর সাথে সাথে তার কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সাংগঠনিক দাওয়াতের ফলে একই আদর্শের অনুসারী একদল দাঈ ইলাল্লহ তৈরী হয়। ফলে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটলেও তার অনুসারীদের তৎপরতায় তার দাওয়াত অব্যাহত থাকে।

৭. সময় সাশ্রয় :

এককভাবে কাজ করতে গেলে একটা কাজে বহু সময় ব্যয় হয়ে যায়। আর সেই কাজ অনেকে মিলে করলে তা সহজে ও স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। তদ্রূপ সাংগঠনিকভাবে দাওয়াতী কাজ করলে অল্প সময়ে এক সাথে অনেককে দাওয়াত দেওয়া যায়। এতে করে সময় বাঁচে। আবার অল্প সময়ে বিভিন্ন স্থানে দাওয়াত পৌঁছে যায়। সাংগঠনিকভাবে এক ময়দানে সমবেত জনতার সামনে অনেকে এসে বক্তব্য দিতে পারেন। ফলে সমবেত জনতা অনেকের আলোচনায় অধিক উপকৃত হয়।

৮. উত্তম উপকরণ ব্যবহার :

ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগৃহীত উপকরণ অপেক্ষা সামষ্টিকভাবে সংগৃহীত উপকরণ সুন্দর হয়। কারণ অনেকের সাথে পরামর্শ করে ও বহুজনের সহযোগিতায় আধুনিক ও মানসম্পন্ন এবং যুগোপযোগী উপকরণ সংগ্রহ করা সহজ হয়। তাছাড়া সব উপকরণের ব্যবহারবিধি একার পক্ষে আয়ত্ত করা দুঃসাধ্য। কিন্তু সংগঠনভুক্ত একদল কর্মীর একেকজন একেকটি উপকরণের ব্যবহার রপ্ত করবে ও ব্যবহার করবে। এতে ব্যবস্থাপনা সহজ, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল হবে।

৯. বহু মানুষের অংশগ্রহণ :

সাংগঠনিকভাবে দাওয়াত দিলে সেখানে বহু মানুষ অংশ গ্রহণ করতে পারে। ফলে দাওয়াতী কাজে যেমন অনেকের অংশগ্রহণে বিভিন্নমুখী দাওয়াত দেওয়া যায়, তেমনি বহু শ্রোতার সমাবেশ ঘটানো যায়। এতে উভয় শ্রেণীর মানুষ উপকৃত হয়।

১০. সুন্দর সমাপন :

যে কোন কাজ অনেকের অংশগ্রহণে সুন্দর ও সহজসাধ্য হয়ে ওঠে। কারণ সেখানে থাকে বহু মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটে। ফলে কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়। তাই দাওয়াতী কাজ জামা‘আতবদ্ধভাবে করা অধিক ফলপ্রসু ও কার্যকর।

১১. দাওয়াতের ব্যাপক প্রসার :

ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা অপেক্ষা জামা‘আতবদ্ধভাবে দাওয়াত দিলে তা ব্যাপকভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনীতে। তাঁর মাক্কী জীবনে হাতে গণা কিছু ছাহাবী ইসলাম কবুল করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মাদানী জীবনে তিনি পৃথিবীর সর্বত্র ইসলামের সুমহান বাণীকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ছাহাবীদের মাধ্যমে।

১২. আল্লাহর রহমত লাভ :

জামা‘আতের উপরে আল্লাহর রহমত রয়েছে। সুতরাং জামা‘আতবদ্ধভাবে দাওয়াতী কাজ করলে সেখানে অবশ্যই আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হবে। ফলে এ কাজে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।

১৩. লক্ষ্যে পৌঁছা সহজ হয় :

বহু মানুষ একই লক্ষ্যে কাজ করলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা বা উদ্দেশ্য হাছিল করা সহজ হয়। অনেক মানুষ একই আদর্শের কথা প্রচার করলে দাওয়াত গ্রহণকারীর মনে সে বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস তৈরী হয়। ফলে তারা সে দাওয়াত গ্রহণ করে। এজন্য জামা‘আতবদ্ধ দাওয়াত অত্যধিক ফলপ্রসু ও কার্যকর।

পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের প্রতিটি ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে তা সংঘবদ্ধভাবে সম্পন্ন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে দাওয়াতী কাজের এই গুরু দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও তা সাংগঠনিকভাবে করা যরূরী। এতে দাওয়াতী কাজে সফলতা লাভ করা যাবে এবং তা কার্যকরী ও ফলপ্রসু হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সংঘবদ্ধভাবে দাওয়াতী খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!


[1]. বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮।

[2]. আবূ দাঊদ হা/২৭৫১; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৭১২।






নববী চিকিৎসা পদ্ধতি - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
দ্বীনী ইলমের গুরুত্ব ও ফযীলত - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
বৃদ্ধাশ্রম : মানবতার কলঙ্কিত কারাগার (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা (শেষ কিস্তি) - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
হজ্জ সফর (১ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি আমাদের কর্তব্য (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
মিথ্যার ধ্বংসাত্মক প্রভাব - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
হজ্জের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ আমল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
খেয়াল-খুশির অনুসরণ (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.