জনৈক ব্যক্তি ভারতের রাজস্থান প্রদেশে অবস্থিত আজমীরে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (১১৩৮-১২৩৫ খৃ.)-র মাযার দেখতে গিয়েছে। সেখানে একটা ছোকরা এসে খাজার কাছে ভিক্ষা চাইল। তখন লোকটি তাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে তার হাতে দু’টি টাকা দিয়ে বলল, ভাগ এখান থেকে! খাজা তো কবরে। তিনি কি দেখতে পান, না শুনতে পান? উনি তোকে কিভাবে দিবেন? তখন ছেলেটি খুশী হয়ে বলল, মেরা খাজা কেৎনাহী গরীবে নেওয়ায হ্যায় কে ওহ খোদ ভী দেতা হ্যায়, লোগুঁ সে দেলা ভী দেতা হ্যায়। অর্থাৎ ‘আমার খাজা কতইনা গরীবের বন্ধু যে, তিনি নিজেও দেন, অন্যের থেকেও দিয়ে দেন’। অর্থাৎ তার ধারণায় ভাল-মন্দ সবকিছুর মালিক খাজা। খাজা মরেননি, কবরে বেঁচে আছেন। তিনি সবই শুনছেন, সবই দেখছেন এবং ভক্তের আবেদন পূরণ করছেন।

পৃথিবীর প্রথম রাসূল নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে শেষ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল মানুষকে অন্যের গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর গোলামীতে ফিরিয়ে আনার জন্য দাওয়াত দিয়ে গেছেন। আর এটাই হ’ল ‘তাওহীদ’। এই দাওয়াত পৃথিবীর যেখানেই পৌঁছেছে, সেখানেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে মানবতার দুশমনদের মধ্যে হৃৎকম্পন শুরু হয়েছে। সাথে সাথে তাওহীদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। ইব্রাহীম (আঃ)-এর বিরুদ্ধে নমরূদের শত্রুতা, মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ফেরাঊনের অভিযান, ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে তৎকালীন সম্রাটের হত্যা প্রচেষ্টা, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে গোটা আরবের কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সম্মিলিত উত্থান- এ সবকিছুই আমাদেরকে উপরোক্ত কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য, মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাওহীদ বিশ্বাস অপরিহার্য।

প্রশ্ন হ’ল, মুঈনুদ্দীন চিশতী বা কোন পীর-আউলিয়া কি কবরে যিন্দা আছেন? তিনি বা কোন মূর্তি-প্রতিকৃতি কি ভক্তের আহবান শুনতে পান? আর শুনলেও কি এজন্য তাঁদের কিছু করার ক্ষমতা আছে? আল্লাহ বলেন, ‘(হে মুহাম্মাদ!) নিশ্চয়ই তুমি শুনাতে পারোনা কোন মৃতকে’ (নম্ল ২৭/৮০)। ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে’ (যুমার ৩৯/৩০)। ‘বল, আমি আমার নিজের ক্ষতি বা উপকারের মালিক নই, যতটুকু আল্লাহ চান ততটুকু ব্যতীত’ (ইউনুস ১০/৪৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সকল কর্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়’ (মুসলিম হা/১৬৩১; মিশকাত হা/২০৩)।

বস্ত্ততঃ কবরপূজা বা অসীলাপূজার মূলে রয়েছে দু’টি কারণ। একটা হ’ল নৈরাশ্য বা Frustration এবং দ্বিতীয়টি হ’ল বাঁচার আকুতি। মানুষ যখন কোন কাজে ব্যর্থ হয় কিংবা কোন উদ্দেশ্য হাছিলে বিলম্ব হয়, তখন সে অধৈর্য হয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে সে হতাশ হয়ে কোন মাধ্যম তালাশ করে। তাছাড়া প্রত্যেক মানুষের অবচেতন মনে একটা আধ্যাত্মিক ক্ষুধা রয়েছে। যা সর্বদা একজন উচ্চতর সত্তার নিকট আত্মসমর্পণের জন্য ব্যাকুল থাকে। যখন এই আত্মসমর্পণ আল্লাহর নিকটে হয়, তখন সে হয় ‘মুসলমান’। আর যখন সেটি শয়তানী প্ররোচনায় কোন প্রাণহীন ব্যক্তি বা বস্ত্তর অসীলায় মুক্তির পথ খোঁজে, কুরআনের ভাষায় তখন সে হয় কাফের বা মুশরিক। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে... আল্লাহ সেই মিথ্যাবাদী ও কাফেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন না’ (যুমার ৩৯/৩)।

অনেকে কুরআনের অন্য একটি আয়াত ‘অবতাগূ ইলায়হিল অসীলাহ’ দ্বারা অসীলাপূজাকে অপরিহার্য বলতে চান। অথচ এর অর্থ ‘তোমরা আল্লাহর নৈকট্য সন্ধান করো’ (মায়েদাহ ৫/৩৫)। আর মানুষের নেক আমল এবং আল্লাহর রহমত হ’ল তাঁর নৈকট্য হাছিলের একমাত্র মাধ্যম। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতএব যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহ্ফ ১৮/১১০)।

মুসলমান তার কালজয়ী কালেমা ‘লা-ইলাহা’ দিয়ে প্রথমে যাবতীয় ভক্তির প্রতিমা এবং অসীলার ইলাহগুলিকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। অতঃপর সেখানে কেবল আল্লাহর উবূদিয়াত তথা দাসত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। আর আল্লাহ কেবল এজন্যই জিন-ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন (যারিয়াত ৫১/৫৬)। অতঃপর এক আল্লাহর উপর সে ভরসা করে ও তার নিকটে সিজদাবনত হয়ে যাবতীয় নৈরাশ্য ও হতাশা হ’তে মুক্তি লাভ করে। বস্ত্ততঃ দৈনিক পাঁচবার খোদ মালিকের নিকট যখন মুসলমান হাযিরা দেয়, তখন কোন কবরে বা তীর্থস্থানে ধর্ণা দেওয়ার কোন যুক্তি থাকতে পারে কি? কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি সেটা করি, তবে তখন আমরা ‘মুশরিক’ হয়ে যাই। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করে, আল্লাহ অবশ্যই তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হয় জাহান্নাম’ (মায়েদাহ ৫/৭২)।

এর চাইতে শিরকের বড় উদাহরণ আর কি হ’তে পারে যে, আজমীরের মসজিদে ছালাতে দাঁড়িয়ে ‘ইইয়াকা না‘বুদু ওয়া ইইয়াকা নাস্তা‘ঈন’ (আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং কেবল তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি) বললাম। অতঃপর ছালাত শেষে খানকাহর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বা সিজদায় পড়ে কাতর কণ্ঠে নিজের ও অন্যদের জন্য দো‘আ চেয়ে বললাম, ইয়া খাজা! এমদাদ কুন! এমদাদ কুন! (হে খাজা! সাহায্য করো, সাহায্য করো)। অথবা ‘দে বাবা খাজা! দে দেলা দে! (হে বাবা খাজা, দাও! বা অন্যের থেকে দিয়ে দাও!)।

বস্ত্ততঃ সৃষ্টিজগতের ভরকেন্দ্র হ’ল ‘তাওহীদ’। যার অর্থ একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনিই আদি, তিনিই অন্ত, তিনি চিরঞ্জীব ও সবকিছুর ধারক। তিনি রূযীদাতা, তিনিই সাহায্যদাতা, তিনিই পালনকর্তা, তিনি বিধানদাতা ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ আমাদের শর্তহীন আনুগত্য ও উপাসনা পাবার যোগ্য নয়। তিনি ব্যতীত অন্য কারু নিকটে মানুষের উন্নত মস্তক অবনত হবেনা। নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্ব অতদিন বজায় থাকবে, যতদিন তারা তাওহীদের উপরে দৃঢ় থাকবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাওহীদের প্রকৃত মর্ম অনুধাবনের তাওফীক দান করুন-আমীন! (স.স.)।






গিনিপিগ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পার্থক্যকারী মানদন্ড - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অহি-র বিধান বনাম মানব রচিত বিধান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জাতীয় সংসদ নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ডেঙ্গুজ্বর : আসুন! অন্যায় থেকে তওবা করি ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের উপায় - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
চেতনার সংকট - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুসলিম ও আহলেহাদীছ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মে‘রাজুন্নবী (ছাঃ) - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ছিয়াম দর্শন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
জবাবদিহিতার অনুভূতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বানরবাদ ও ট্রান্সজেন্ডার, এরপর কি? - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.