২০শে নভেম্বর’১৩ বুধবার বিকাল ৪-৩০ মিনিট। মোট ১০টি মিথ্যা মামলার সর্বশেষ হত্যা মামলায় বিচারকের মুখ দিয়ে বের হওয়া একটি শব্দ ‘খালাস’। সাথে সাথে বের হ’ল একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস। মুখে উচ্চারিত হ’ল আলহামদুলিল্লাহ। কেউ খুশীতে বলে উঠলেন আল্লাহু আকবর। সত্যের জয় হ’ল। সবাই আদায় করল সিজদায়ে শুক্র। দীর্ঘ নয় বছর ধরে চলা একটি নিকৃষ্ট অপবাদের বিচারিক সমাপ্তি। বুক থেকে নেমে গেল নিরুদ্ধ যন্ত্রণার এক দুঃসহ বোঝা। ২০০৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২-টায় মারকাযের বাসা থেকে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে আমাদের বিরুদ্ধে সপ্তাহকালব্যাপী চালানো তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের পেটুয়া মিডিয়া ও সেই সাথে সেক্যুলার পত্রিকাগুলির লাগামহীন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আত-তাহরীক মার্চ’০৫ সংখ্যায় ‘মিথ্যাচার ও সাংবাদিকতা’ শিরোনামে যে সম্পাদকীয় লিখে গিয়েছিলাম, সেখানে তৃতীয় প্যারায় বলেছিলাম ‘তথ্য সন্ত্রাসের এই যুগে একটি মিথ্যাকে শতকণ্ঠে বলিয়ে গোয়েবল্সীয় কায়দায় সত্য বলে প্রমাণিত করার যে কোশেশ চলছে, তার দ্বারা পাঠক সমাজ সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হবে, সমাজ বিনষ্ট হবে। কিন্তু দেরীতে হলেও চূড়ান্ত বিচারে সত্যই জয়লাভ করবে। এটাই স্বাভাবিক ও চিরন্তন সত্য। সমাজ সংস্কারকগণের জীবনে চিরকাল আমরা এটাই দেখে এসেছি’। সেদিনের সেই কথাগুলি দেরীতে হলেও অবশেষে বাস্তবায়িত হ’ল দেখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।

আজ যে প্রশ্নটি জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা হয়ে মনের আয়নায় বারবার ভেসে উঠছে, সেটি এই যে, ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন হাজতের নামে যা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, তা কি সরকার ফেরৎ দিতে পারবেন? একই মামলায় যারা পুরা ৯ বছর কারাগারে থেকে নিঃস্ব ও রিক্ত অবস্থায় বেকসুর খালাস হয়ে বের হচ্ছে, তাদের কাছে সরকার ইহকালে ও পরকালে কি জবাবদিহি করবে? দেশে ও বিদেশে আমাদের ব্যাপারে যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এবং অনেকের মধ্যে যে মিথ্যা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে, সেগুলি সরকার কি দূর করতে পারবে? এছাড়াও আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষতির তো কোন সীমা-পরিসীমা নেই। আমাদের যে চল্লিশ-এর অধিক নেতাকর্মীকে পুলিশী নির্যাতন ও কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে, এদের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ও নীরব কান্না ও তাদের পরিবারবর্গ ও নিকটজনদের বুকফাটা আর্তনাদ এবং ভক্ত অনুসারীদের অশ্রুভেজা দো‘আ সবই আল্লাহর কাছে জমা আছে। সাময়িক ক্ষমতার অহংকারে স্ফীত যালেমদের যেদিন নতমস্তকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে, আর তাদের হাতে নির্যাতিত মযলূমদের আবেদন যখন আল্লাহ শুনবেন, তখন কি জবাব দিবেন কথিত গণতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদী এবং তথাকথিত ইসলামী মূল্যবোধের সরকার ও তাদের অন্ধ অনুসারীরা? কি জবাব দিবেন স্বঘোষিত বস্ত্তনিষ্ঠ (?) সাংবাদিকরা এবং সত্য প্রকাশে আপোষহীন (?) পত্রিকার মালিক ও কলাম লেখকরা? যারা কখনোই আমাদের পক্ষে সাহস করে দু’টো লাইন লেখেননি।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৭টি কারাগারে থাকবার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। সব জায়গায় কারা কর্মকর্তাদের মন্তব্য অনুযায়ী কারাগারে নিক্ষিপ্ত প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ নিরপরাধ। মিথ্যা মামলায় ও অন্যায় বিচারে তারা জেলে আছে। অধিকাংশই দলীয় সরকার ও তাদের নেতা-পাতিনেতাদের হিংসা ও প্রতিহিংসার শিকার। স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার জন্য বৃটিশ সরকারের উর্বর মস্তিষ্কে হাজতের নামে যে নিবর্তনমূলক আইনটি তৈরী হয়েছিল, সেই কালো আইনের যাঁতাকলে ফেলে আজ স্বাধীন দেশের নিরপরাধ নাগরিকদের অন্যায়ভাবে কারা নির্যাতন করা হচ্ছে। ফলে বছরের পর বছর হাজতের নামে জেলের ঘানি টানছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ কথিত জনগণের সরকারের হাতে। তরুণ বয়সে এমনকি শিশুকালে হাজতের নামে জেলে ঢুকে বৃদ্ধ বয়সে বেকসুর খালাস পেয়ে বেরিয়ে আসছে। এমনকি বিনা বিচারে জেলখানায় ধুঁকে ধুঁকে অবশেষে মৃত্যুবরণ করছে। অথচ সে জানে না তার অপরাধ কি? এমন নযীরও এই সভ্য (?) দেশে আছে। তাহ’লে কিজন্য তৈরী হয়েছে রাষ্ট্র? কিজন্য সরকার? কিজন্য এত আইন-আদালত? এর চাইতে জঙ্গলের জীবন তো অনেক ভাল? সেখানে পশুদেরও একটা মূল্যবোধ আছে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সমাজে সেই মূল্যবোধটুকুও নেই। এই সমাজের নেতারা পারে না হেন কোন অপকর্ম নেই। যার সরাসরি শিকার আমরা নিজেরা।

আমাদের কোন রাজনৈতিক শত্রু থাকার কথা নয়। কেননা আমরা কারু ভোটের বাক্সের প্রতিদ্বন্দ্বী নই। আমরা কারু ব্যবসায়ের ভাগিদার নই। আমরা কারু পদ ও পদমর্যাদার অংশীদার নই। তবে কেন নেমে এল রাষ্ট্রীয় নির্যাতন? কারণ খুঁজতে গেলে যেতে হবে অনেক গভীরে। আর সেটি হ’ল এই যে, আমরা গতানুগতিকতার বাইরে মানুষকে আহবান করেছি লওহে মাহফূয থেকে আগত অভ্রান্ত সত্যের দিকে। মানুষকে ডেকেছি উদাত্ত কণ্ঠে- আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি। আসুন! ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী ইসলাম বুঝি। তখন জনগণের সার্বভৌমত্বের নামে যারা মানুষের উপর নিজেদের প্রভুত্ব চাপিয়ে দিয়েছে, মানুষকে ক্রীতদাসের চাইতে নিকৃষ্টভাবে শোষণ-নির্যাতন করে যাচ্ছে, তাদের কলিজায় আগুন ধরে গেল। অন্য দিকে যারা ইসলামকে নিজেদের মনের মত করে মিকশ্চার বানিয়ে তাকে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের হাতিয়ার বানিয়েছে, এমনকি স্বাধীন মানুষকে আল্লাহকে ছেড়ে কবরে সিজদা ও প্রার্থনা করিয়ে তাদের পকেট ছাফ করার ব্যবসায়ে রত আছে, তাদের গাত্রদাহ হ’ল। অতঃপর সত্যের আহবান শুনে বাঁধনহারা মানুষ যখন ছুটতে শুরু করল তার পরকালীন জীবনের চিরস্থায়ী শান্তির খোঁজে। বিভিন্ন মাযহাব, মতবাদ ও তরীকার বেড়াজাল ছিন্ন করে যখন মানুষ ছুটলো ইসলামের আদিরূপের সন্ধানে জান্নাতুল ফেরদৌসের সুগন্ধি পেয়ে, তখনই কুচক্রীরা তাদের শেষ অস্ত্র নিক্ষেপ করল আমাদের উপরে। আমরা আমাদের সকল অভিযোগ ও দুঃখ-বেদনা আমাদের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে পেশ করেছিলাম। তাঁর কাছেই নিজেদেরকে সোপর্দ করেছিলাম। আমাদের নিয়তে কোন ত্রুটি ছিল না। আমাদের নির্ভরশীলতায় কোন শরীক ছিল না। আল্লাহ সেটারই পরীক্ষা নিয়েছেন দীর্ঘ নয় বছরে। অবশেষে তিনি আমাদের সাথীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমরা চাই আখেরাতের সর্বোচ্চ প্রতিদান এবং সেটাই আমাদের একমাত্র কাম্য। সেখানে যেন আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন- আমীন!

পরিশেষে মিথ্যা মামলায় কারা নির্যাতিত সকল নেতা-কর্মীর প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আল্লাহর নিকটে তাদের জন্য উত্তম প্রতিদান প্রার্থনা করছি। সেই সাথে যারা আমাদের জন্য সাধ্যমত সবকিছু দিয়ে সাহায্য করেছেন, কষ্ট স্বীকার করেছেন ও দো‘আ করেছেন, তাদের সকলের জন্য আল্লাহর নিকটে সর্বোত্তম পারিতোষিক কামনা করছি। অতঃপর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে প্রাণভরা দো‘আ করছি ‘আন্দোলন’-এর সাবেক কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক ভাই হাফীযুর রহমানের জন্য। যিনি তাঁর বিরুদ্ধে পত্রিকায় গ্রেফতারী পরোয়ানা পাঠ করে তৎক্ষণাৎ হার্টফেল করে আমাদের ঢাকা অফিসে মৃত্যুবরণ করেন ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর শনিবার দিবাগত রাতে। আল্লাহ তুমি তাকে এবং ইতিমধ্যে যেসব নির্যাতিত ও শুভাকাংখী ভাই ও বোন মারা গেছেন তাদের সকলকে ক্ষমা কর এবং তাদেরকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দান কর- আমীন! (স.স.)। [মামলা সমূহের বিস্তারিত খবর আগামী সংখ্যায় দ্রষ্টব্য।-সম্পাদক]







বিষয়সমূহ: দণ্ডবিধি
আহলেহাদীছের বৈশিষ্ট্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান কাম্য - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আসন্ন রামাযান - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ভেসে গেল স্বপ্নসাধ! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
হে ছায়েম অনুধাবন কর! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
উপযেলা নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে পরামর্শ - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পর্ণোগ্রাফী নিষিদ্ধ করুন! - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
111
আমেরিকার নির্বাচন - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আরও
আরও
.