ঢাকার বস্তীবাসীদের জীবন সম্বন্ধে যাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে, তাদের মধ্যে কোমল হৃদয়ের লোকেরা ব্যথিত না হয়ে পারে না। মানবেতর জীবন বলতে যা বুঝায়, বস্তীবাসীদের জীবন তদ্রূপ। জীবন বাঁচানোর তাকীদে এরা স্বামী-স্ত্রী মিলে দিনভর নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। মহিলারা সাধারণতঃ শহরে ধনীশ্রেণীর লোকদের বাড়ীতে পরিচারিকার কাজ করে। এদের অনেকেই একই দিনে বিভিন্ন বাড়ীতে কাজ করে থাকে।
জামীলার দু’টি মেয়ে সন্তান। ছোট সন্তানের দেখা-শুনার দায়িত্বে বড় মেয়েকে রেখে জামীলা কাজ করতে যায়। সন্তানহীন এক বাড়িতে সে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে আসছে। বাড়ীর গৃহকর্তী বেশ কোমল হৃদয়ের মহিলা। নাম জেসমীন। সে একদিন লক্ষ্য করল যে, জামীলা কেমন যেন স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল, গর্ভধারণের জন্য জামীলার এ অবস্থা। তাকে দেখে জেসমীন তাকে নরম সুরে বকাবকি করল। স্বামীর ইচ্ছা, তাদের ঘরে একটি পুত্র সন্তান আসুক। স্বামীর ইচ্ছা পূরণে তাকে গর্ভধারণ করতে হয়েছে। নইলে এত কষ্টের জীবনে জামীলার সন্তান নেওয়ার ইচ্ছাই ছিল না। একজন বস্তিবাসিনী হয়ে জামীলা বুঝে, কেবল সন্তান নিলেই তো হবে না, তাকে মানুষ করতে হবে। সে কাজটি বস্তীবাসীদের জীবনে সুদূরপরাহত।
সন্তান লাভের ব্যাপারে মানুষের কোনই হাত নেই। সন্তান ছেলে হবে, না মেয়ে হবে সেটা কেবল আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। এজন্যই দেখা যায়, মানুষ পুত্র সন্তান লাভের আশায় অনেক মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। জামীলাদের ক্ষেত্রেও তাই হ’ল। যথাসময়ে সে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করল। পরের বাড়ীতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে নবজাত শিশুটিকে দুধ পান করিয়ে থাকে। এতে তার পরিশ্রমের মাত্রাটা বেড়ে যায়। গৃহকর্মী নবজাত শিশুকে তার বাড়ীতে রেখে কাজ করতে অনুমতি দেয়। এতে সে অনেকটা স্বস্তিবোধ করে। শিশুটি দেখতে সুন্দর হয়েছে। জেসমীন মাঝে-মধ্যে শিশুটিকে কোলে নিয়ে আদর-সোহাগ করে। এরূপ করতে করতে তার মনে শিশুটির মা হবার বাসনা জাগে। তাই সে একদিন জামীলাকে মনের ইচ্ছার কথা জানায়। জামীলা স্বামীর অনুমতি নিয়ে জেসমীনকে জানাতে চায়। জেসমীন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। জামীলা স্বামীকে বুঝিয়ে মতামত আদায় করে। জামীলা বুঝতে পারে, সে যদি তার মেয়েকে জেসমীনের হাতে তুলে দেয়, তাহ’লে তার মেয়ের ভাগ্য প্রসন্ন হ’তে পারে। জেসমীনের আশা পূরণ হওয়ায় সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। এখন থেকে শিশুটি জামীলার নয়, জেসমীনের। সে জামীলাকে কিছু টাকা-পয়সা দিতে চায়। এতে জামীলা অস্বীকার করে। তার মনে একথাটাই প্রবল হয়ে দেখা দেয় যে, তার মেয়ে অন্ততঃ সুখে থাকবে। এটাই তার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
জগতে সব পিতা-মাতাই চায়, তাদের সন্তানেরা সুখে থাক। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি সব মানুষের ভাগ্যে সুখ মিলাতে সাহায্য করে না। সন্তান লাভের পর জেসমীনের স্বামী অন্যত্র বদলি হয়ে যায়। জামীলা দীর্ঘদিন ধরে সন্তানের দর্শন হ’তে বঞ্চিত থাকে। জগতে অনেক কিছু থেমে থাকলেও সময় থেমে থাকে না। তাই দেখতে দেখতে পনের/ষোল বছর কেটে গেল। এরপর জেসমীনরা আগের জায়গায় ফিরে এল। এতদিনে মেয়েটি বেশ বড় হয়েছে। আগের থেকে আরো সুন্দর হয়েছে। তাকে লেখাপড়াও শিখানো হয়েছে। জেসমীন মেয়েটিকে অকৃত্রিম মাতৃস্নেহেই মানুষ করেছে।
এ জগতে পরের ছেলে কিংবা মেয়েকে নিজের করে নেওয়ার ইতিহাস অনেক। তাই দেখা যায়, নিজ পিতা-মাতাকে বাদ দিয়ে অন্য মানুষকে শিশুরা মাতা-পিতার আসনে বসিয়ে থাকে। পালক মাতা-পিতারা শিশুর কাছে পালিত মাতা-পিতা বলে পরিচয় দেয় না। কারণ এতে ফল শুভ হয় না। জামীলা তার মেয়েকে সহজেই চিনে ফেলে। কিন্তু শুধু নীরব দর্শক হয়ে দেখা করে চলে আসে। সে যে আশা নিয়ে মেয়েকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে, তার সে আশা পূরণ হয়েছে। এতেই সে খুব খুশী।