পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭।

শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর উপর আরোপিত কিছু মিথ্যা অপবাদ ও অভিযোগ পর্যালোচনা

[নিম্নের নিবন্ধটি লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘বাদবান’ পত্রিকায় মুদ্রিত একটি সাক্ষাৎকারের জওয়াব। যে সাক্ষাৎকারে হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর বিরুদ্ধে নানা ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে। নিবন্ধটি ‘বাদবান’ ও ‘আল-ই‘তিছাম’ পত্রিকায় ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বসাধারণের উপকারের কথা ভেবে এখন তা অত্র বইয়ে সংযুক্ত করা হ’ল।-লেখক]

বিগত দিনে এক বন্ধু আমাকে ‘বাদবান’ পত্রিকার একটি সংখ্যা দিয়েছিলেন। তাতে আব্দুস সাত্তার নিয়াযী ছাহেবের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত সাক্ষাৎকারে নিয়াযী ছাহেব ধর্মীয় দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার মানসে চার দফা ফর্মুলা তুলে ধরেন। তাতে তিনি যে স্বীয় মাযহাব হানাফী ও দেওবন্দী আলেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন তা স্পষ্ট। আমরা সেদিকটা উপেক্ষা করে উক্ত সাক্ষাৎকারের একটি দিক নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। যা নিয়াযী ছাহেবের ভুল বর্ণনা তথা মিথ্যা অভিযোগ ও অপবাদের বেসাতির সাথে জড়িত।

উক্ত সাক্ষাৎকারে জিহাদ আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি, প্রাণপুরুষ ও নেতা শাহ ইসমাঈল শহীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে-তাই বলা হয়েছে। সাক্ষাৎকারের সেদিকটার ভাষা নিম্নরূপ- ‘শাহ অলিউল্লাহর খান্দান ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফৎওয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু তার খান্দানেরই ইসমাঈল নামক এক ব্যক্তি নাজদী দ্বীন গ্রহণ করেন। তিনি নবী (ছাঃ)-এর পবিত্র সত্তার উপর হামলা করেছিলেন। ১২৪৮ হিজরীতে এ নিয়ে এক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আহলে সুন্নাত তার মুকাবিলা করেছিল। তারপর এই ইসমাঈলই ইংরেজদের সহযোগিতা করতে আরম্ভ করেন। এটা ছিল সেই যুগ যখন ইসমাঈল ও দেওবন্দী আলেমগণ জিহাদের বিরুদ্ধে ফৎওয়া দিয়েছিলেন...। ইংরেজরা এই দুই শ্রেণীকেই ব্যবহার করেছিল’।

ধর্মীয় দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার আলোচনা আপাতত শিকেয় তুলে রাখুন। যিনি ঐক্যের আহবায়ক তিনিই যদি অন্য দলের মুরববী-আকাবেরদের বিরুদ্ধে কেবল ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষাই নয়; বরং সুস্পষ্ট মিথ্যাচার করেন, তবে কি এই ব্যক্তিকে ঐক্যের আহবানে আন্তরিক ভাবা যায়? আর তার আলোচিত ঐক্যের দফা সমূহের কি কোন গুরুত্ব অবশিষ্ট থাকে? যেখানে দু’পক্ষের ঐক্য স্থাপনে অন্তরে আঘাতকারী কথা থেকে বিরত থাকা, পরস্পরে মিথ্যারোপ ও অপবাদ দেওয়া থেকে বেঁচে থাকা এবং এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের নেতাদের সম্মান বজায় রাখা প্রথম শর্ত, সেখানে অবাক করা ব্যাপার হ’ল, ঐক্যের এই আহবায়কের ঐক্য সম্পর্কিত অ আ ক খ জ্ঞানও নেই।

যাহোক ঐক্যের এ আহবানকারী উক্ত সাক্ষাৎকারে নিম্নোক্ত মনগড়া মিথ্যা অভিযোগ সমূহ উত্থাপন করেছেন :

১. শাহ ইসমাঈল শহীদ নাজদী দ্বীন গ্রহণ করেছিলেন।

২. তিনি নবী (ছাঃ)-এর পবিত্র সত্তার উপর হামলা করেছিলেন।

৩. ১২৪৮ হিজরীতে এ বিষয়ে এক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।

৪. মুনাযারার পর থেকে তিনি ইংরেজদের সহযোগিতা করতে আরম্ভ করেছিলেন।

৫. ঐ একই সময় থেকে দেওবন্দী আলেমগণও ইংরেজদের সহযোগিতা করা শুরু করেন।

৬. ইংরেজ এই দুই শ্রেণীকেই তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল।

অভিযোগগুলির জওয়াব

১ম অভিযোগ সম্পর্কে সর্বপ্রথমে নিয়াযী ছাহেবের নিকট জিজ্ঞাস্য যে, ‘নাজদী দ্বীন’-এর পরিচয় কি? তার চৌহদ্দীই বা কি?

যদি তার এ কথার উদ্দেশ্য শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদীর সংস্কার আন্দোলন ও দ্বীন পুনরুজ্জীবিতকরণের দাওয়াত হয় এবং তা দ্বারা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর প্রভাবিত হওয়াকে বুঝায়, তাহ’লে প্রথমতঃ তার দাওয়াতে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর প্রভাবিত হওয়াটা কোন অপরাধ নয়। কেননা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের দাওয়াত কুরআন ও হাদীছের নির্ভেজাল দাওয়াত থেকে মোটেও পৃথক কোন দাওয়াত ছিল না। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব শরী‘আত বিরোধী রসম-রেওয়াজ, নানাবিধ বিদ‘আত, কবরপূজা এবং সমজাতীয় অন্যান্য অনৈসলামী আক্বীদা ও আমলের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। তিনি মুসলিম উম্মাহকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের যুগের খাঁটি ও নির্ভেজাল দ্বীনের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়তঃ ঐতিহাসিকভাবে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর নাজদী দাওয়াতে প্রভাবিত হওয়ার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেননা তারা সমসাময়িক ছিলেন না। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের সময়কাল ছিল ১১১৫ হিজরী থেকে ১২০৬ হিজরী পর্যন্ত এবং হযরত শাহ শহীদের সময়কাল ছিল ১১৯৩ হিজরী থেকে ১২৪৬ হিজরী পর্যন্ত। শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের মৃত্যুর সময় শাহ শহীদের বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। পরিচিত অর্থে এ বয়সকে সমসাময়িকতা ও শিক্ষালাভ কাল বলা চলে না।

উপরন্তু সে সময় এ যুগের মতো আমভাবে চিঠিপত্র ও বই-পুস্তক আদান-প্রদানের ব্যবস্থা ছিল না। এজন্যে এ কথাও বলার উপায় নেই যে, নাজদী আন্দোলনের সাহিত্য দ্বারা শাহ ইসমাঈল (রহঃ) প্রভাবিত হয়েছিলেন। হ্যঁা এ কথা অবশ্যই ঠিক যে, ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের দাওয়াত ও সংস্কারের বুনিয়াদ ছিল যেমন কুরআন ও হাদীছ, ঠিক একইভাবে হযরত শাহ শহীদের দাওয়াতের ভিত্তিও ছিল এই দু’টি বস্ত্ত। সেকারণ উভয়ের মৌলিক দাওয়াত ও চিন্তায় সাদৃশ্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। কুরআন ও হাদীছ সম্পর্কে যারা অনবহিত তারা এখানে এসেই হোঁচট খান এবং ভুল করে বসেন। আমরা এক্ষেত্রে নিজেদের পক্ষ থেকে বেশী কিছু না বলে চারিদিকের খবর রাখেন এমন এক বিদগ্ধজন মাওলানা মাসউদ আলম নাদভী মরহূমের একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরছি। এমনি ধরনের এক ভুল ভাঙাতে এ বিশ্লেষণ তিনি করেছিলেন। তিনি বলেন,

‘নাজদী আন্দোলন বা শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদী (১১১৫-১২০৬ হিঃ)-এর তাওহীদের দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কেবল সেই দু’টি পবিত্র বস্ত্ত, যাকে আমরা কিতাব ও সুন্নাহ নামে স্মরণ করি। শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদী (রহঃ) ছিলেন হযরত শাহ অলিউল্লাহ দেহলভীর (১১১৪-১১৭৬ হিঃ) সমসাময়িক। দু’জনেই দু’-চার বছর আগে-পিছে মসজিদে নববীতে শিক্ষালাভ করেছিলেন। দু’জনেই সময়ের অবর্ণনীয় প্রতিকূল অবস্থা দ্বারা জর্জরিত ছিলেন এবং দু’জনেই তা কাটিয়ে উঠতে একই ধরনের পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। অর্থাৎ দু’জনেই বিদ‘আত ও কুসংস্কারের ময়লা-আবর্জনা থেকে দ্বীন ইসলামকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। কিতাব ও সুন্নাতের নির্মল ঝর্ণাধারার দিকে আহবান জানাতেও দু’জন সমান ভাগীদার ছিলেন। গোঁড়া তাক্বলীদের শৃঙ্খল ভাঙতেও দু’জনে একই পথের পথিক ছিলেন।

এজন্য এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মূলনীতির দিক দিয়ে হিন্দুস্থানী ও নাজদী আন্দোলন এক ও অভিন্ন। এই অভিন্নতার কারণেই ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে এবং অনেকে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর সংস্কার ও জিহাদ আন্দোলনের ঝান্ডা নাজদের তাওহীদী দাওয়াতের সাথে একাকার করে ফেলেছেন। প্রোপাগান্ডা এতটাই বিস্তার লাভ করে যে, হজ্জের সময়ে নাজদী প্রচারকদের সাথে সাইয়েদ ছাহেবের সাক্ষাৎ এবং তাদের প্রচারে প্রভাবিত হওয়ার কল্পকাহিনী মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ এসব কথার পিছনে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকদের মস্তিষ্কপ্রসূত আবিষ্কার বৈ সত্য কিছু নেই। নাজদ ও হিন্দুস্থানের সংস্কার আন্দোলন স্ব স্ব স্থানে বৃদ্ধি লাভ করেছে এবং ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়েছে। হিন্দুস্থানের তাওহীদী দাওয়াত অর্থাৎ সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) ও মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর দাওয়াত শায়খুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদী (রহঃ)-এর দাওয়াত দ্বারা মোটেও প্রভাবিত হয়নি’।[1] তবে এই মৌলিক ঐক্য ও বাহ্যিক সাদৃশ্য সত্ত্বেও দুই আন্দোলনের মাঝে কিছু পার্থক্যও রয়েছে। স্থানীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি ও স্বভাব-প্রকৃতির তারতম্য হেতু এতটুকু পার্থক্য না হয়ে যায় না’।

সামনে গিয়ে তিনি আরো লিখেছেন, ‘এটাই সঠিক কথা যে, নাজদ ও ভারতের আন্দোলন এক নয়। তবে কিছু শাখা বা অমৌলিক বিষয়গত পার্থক্যের কারণে আমরা উভয়কে একে অপরের বিরোধীও মনে করি না। যখন তাওহীদের দাওয়াত দু’টি আন্দোলনেই মওজুদ রয়েছে এবং কিতাব ও সুন্নাতের অনুসরণে দু’পক্ষই দৃঢ়সংকল্প, তখন অমৌলিক বিষয়ের পার্থক্যকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কি আছে? আমাদের নিকটে ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আমীর ছান‘আনী (১০৯৯-১১৮২ হিঃ), হযরত শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হিঃ) ও শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদী (১১১৫-১২০৬ হিঃ) তিনজনই হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীতে মুহাম্মাদী আদর্শের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন। তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে তারা আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করেছেন। আপনি চাইলে তাদের ‘মুজাদ্দিদ’ বা সংস্কারকও বলতে পারেন। তারা সবাই আপন আপন পরিবেশে দ্বীনের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন। সুন্নাতে মুহাম্মাদীর নির্মল নিষ্কলুষ ঝর্ণাকে শিরক ও বিদ‘আতের আবর্জনা থেকে পরিচ্ছন্ন করেছেন। এ সকল পবিত্রাত্মাদের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের ফলশ্রুতিতেই আজ আমরা নিঃসঙ্কোচে কিতাব ও সুন্নাতের নাম উচ্চারণ করছি। কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে আমলকে আমাদের প্রতীক বা নিদর্শন বলতে পারছি। এই বুযর্গদেরই কাতারে আছেন তাদের থেকে উপকৃত ক্বাযী মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী (১১৭৩-১২৫০ হিঃ), সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী (১২০১-১২৪৬ হিঃ) ও মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ দেহলভী (১১৯৩-১২৪৬ হিঃ)।

উম্মতের এসব সংস্কারকদের চেষ্টা-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটাই। সকলেই ছিলেন রিসালাতের আলোর পতঙ্গ এবং কুরআন ও সুন্নাহর প্রেমিক। এখানে হয়তো কোথাও ইমাম ইবনু তায়মিয়াহর রঙের প্রাধান্য ছিল, কোথাও হিন্দুস্থানী তাছাউওফের চিহ্ন থেকে গিয়েছিল, কোথাও তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়ার প্রশিক্ষণ চলছিল, কোথাও শাহাদাত লাভের তামান্না অগ্রাধিকার পাচ্ছিল, কেউ গোঁড়া তাক্বলীদের বিরুদ্ধে খোলা তরবারির অবস্থানে ছিলেন, কারো মধ্যম মেযাজ ফিক্বহ থেকে তাছাউওফ পর্যন্ত সব কিছুতে সমন্বয় করে চলার পক্ষপাতী ছিল। ঝোঁকের তারতম্যের দরুন এমনটা হয়ে থাকে। এটা কোন মৌলিক মতপার্থক্য নয়। মেযাজ ও মতাদর্শের এতটুকু মামুলী পার্থক্যের জন্য একদলকে অপর দলের বিরোধী বলা যায় না। আর এক আন্দোলন কিংবা দাওয়াতের সাথে যুক্তদের জন্য অন্য আন্দোলন কিংবা দাওয়াতের সাথে সম্পর্ক রক্ষা হারাম গণ্য করা যেতে পারে না। একজন অলিউল্লাহী চিন্তাধারার অনুসারী ইমাম শাওকানী ও তার শিষ্যদের থেকে উপকৃত হ’তে পারেন। একজন নাজদী একজন অলিউল্লাহী চিন্তাধারার অনুসারীর ছাত্রত্ব অক্লেশে গ্রহণ করতে পারেন। অনুরূপভাবে একজন ইয়ামানী বিদ্যার লায়লার তালাশে নাজদের মরুবিয়াবানে ঠোক্কর খেয়ে বেড়ানোর কষ্ট সইতে পারেন। ইলম ও আমলের এই লেনদেনে লাভ ছাড়া লোকসানের কোন দিক তো আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। এ কথা আমাদের কোনক্রমেই বুঝে আসে না যে, একজন হিন্দুস্থানী যদি কোন ইয়ামানী কিংবা নাজদী আলেমের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেই থাকেন, তবে তাকে কেন এত অভিশপ্ত ও ঘৃণ্য গণ্য করতে হবে? ইসলাম কি এহেন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ভৌগলিক সীমাবদ্ধতার শিক্ষা দেয়?[2]

মোটকথা মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি নাজদী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিল বলে যে দাবী তোলা হয়, তার পিছনে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত কোন প্রমাণ নেই। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ)-এর জিহাদ আন্দোলন এবং শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রহঃ)-এর তাওহীদ কেন্দ্রিক দাওয়াত ও সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কুরআন ও হাদীছ। উভয় আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষ তাওহীদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরেছে। শিরক ও বিদ‘আত থেকে তওবা করে ইসলামের মূল রূপে ফিরে আসতে পেরেছে। কুরআন ও হাদীছের সাথে তাদের একাত্মতা ও সংযোগ মযবুত হয়েছে।

২য় অভিযোগ : তিনি নবী (ছাঃ)-এর পবিত্র সত্তার উপর হামলা করেছিলেন। আমরা মনে করি, ইসলামের ইতিহাসের এক মহান মনীষী ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব, যার আন্দোলন ও রচনাবলী থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হেদায়াতের আলো পেয়েছেন, তাঁকে নবী (ছাঃ)-এর শানে অভদ্র আচরণকারী আখ্যা দেওয়া ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার। হযরত শাহ শহীদ (রহঃ)-এর এই মযলূম অবস্থা সম্পর্কে মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদভীর মুক্তবর্ষী কলমে রক্তঝরা যে কথা উঠে এসেছে আমরা এখানে সেটা তুলে ধরছি।-

‘মাওলানা (শাহ ইসমাঈল শহীদ)-এর অন্যান্য মাহাত্ম্য এক পাশে থাক, কিন্তু তার শাহাদাত লাভ তো একটি স্বীকৃত বিষয়। আর শহীদগণ যে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ক্ষমাপ্রাপ্ত তাও স্বীকৃত বিষয়। অথচ ১২৪৬ হিজরীর ২৪শে যুলক্বা‘দাহ থেকে আজ পর্যন্ত কমবেশী ১৩৬ বছরের (বর্তমানে প্রায় ২০০ বছর) দীর্ঘ সময় ধরে সম্ভবতঃ এমন একটা সকালও যায়নি, যেদিন ইসলামের এই শহীদের নামে ‘কাফের ও পথভ্রষ্ট’ বলে ফৎওয়া প্রকাশ পায়নি। অভিশাপ ও গালাগালির কোন শব্দ তাকে লক্ষ্য করে বর্ষিত হয়নি। ফিক্বহ ও ফৎওয়ার এমন কোন দলীল নেই যা তাকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়নি। তিনি আবু জাহল, আবু লাহাবের চাইতেও ইসলামের বড় দুশমন, খারেজী ও মুরতাদদের চাইতেও বেশী ধর্মচ্যুত, ইসলাম থেকে খারিজ এবং ফেরাউন ও হামানের চাইতেও জাহান্নামের বেশী উপযুক্ত, কুফর ও গুমরাহীর প্রতিষ্ঠাতা, বেআদব ও অভদ্রদের দলনেতা, নাজদী শায়েখের মুক্বাল্লিদ ও শিষ্য ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষণ তার নামে অহরহ আরোপ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব ফৎওয়াবাযী ও গালাগালি তারা করেছেন, যাদের তুলতুলে শরীরে আজ অবধি আল্লাহর জন্য একটা কাঁটার আঁচড় লাগেনি, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে পায়ে একটা কাঁটা পর্যন্ত বিঁধেনি, সত্যিকার অর্থে ইসলামের খেদমত করতে গিয়ে এক বিন্দু ঘাম ঝরানোর সৌভাগ্য হয়নি। রক্ত ঝরানোর কথা আর কি বলব! এসব কথা তারাই বলেছেন, যাদের মা-বোন-বেটির ইয্যত রক্ষার্থে তিনি তার মাথা তলোয়ারের নিচে পেতে দিয়েছিলেন। এই কি ছিল তার অপরাধ? দুনিয়াতে এর চাইতে বড় কোন অকৃতজ্ঞতার নযীর আছে কি?

যে সময়ে পাঞ্জাবে মুসলমানদের দ্বীন-ঈমান, জান-মাল, ইয্যত ও আব্রু নিরাপদ ছিল না, শিখরা মুসলিম নারীদের ধরে ধরে এনে নিজেদের শয্যাসঙ্গিনী করছিল, মসজিদগুলোর বেইয্যতী করা হচ্ছিল এবং সেগুলিকে ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করা হচ্ছিল, সে সময়ে ইসলামের এই দাবীদারদের ঈমানী উত্তেজনা ও ইসলামী ক্ষোভ কোথায় ছিল’?[3]

হযরত শাহ শহীদ (রহঃ)-এর বিরোধিতাকারী, তার সঙ্গে শত্রুতাকারী এবং তার নামে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে অভদ্রতার অপবাদ দানকারীদের দৈর্ঘ-প্রস্থ ও চৌহদ্দী তো আপনাদের জানা হয়ে গেল। এখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তথাকথিত অভদ্রতাকারী সেই মানুষটির (অর্থাৎ হযরত শাহ শহীদ-এর) আক্বীদা ও ভালবাসার কিছু নমুনাও দেখুন, যা তিনি উর্দূ ও ফার্সী ভাষায় তার রচিত প্রশস্তিগাথায় রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি নিবেদন করেছেন। হযরত শাহ শহীদ (রহঃ) তার উর্দূ মছনবী ‘সাল্কে নূর’ বইয়ে আল্লাহর প্রশংসার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রশংসায় বলেন,

خصوصا جو اكمل انسان ٍٍ ہے + وه سارے صحيفوں كا عنوان ہے

وه انسان ا كمل ہے سنتے ہو كون + ہوئے مفتخر جس سے يہ دونوں كون

نبى البرايا رسول كريم + نبوتكے دربار كا درّ يتيم

حبيب خدا سيّد المرسلين + شفيع الورى ہادئ راه دين

محمد ہے نام اس كا احمد لقب + بياں ہو سكے منقبت اسكے كب

دل اس كا جو ہے مخزن سرّ غيب + مبرّا خطا سے ہےبےشك و ريب

زبان اس كى ہے ترجمانِ قدم + ہَوا باغ دين جس سے رشك اِرَمْ

بظاہر ہےجو مقطع انبياء + حقيقت مىں ہے مطلع اصفياء

(১) ‘বিশেষত যিনি পূর্ণতম মানব; যিনি সকল গ্রন্থের শিরোনাম (২) সেই পূর্ণতম মানব শুনেছ কি তিনি কে? ইহ-পরকাল যার গর্বে গর্বিত হয়েছে তিনি কে? (৩) সৃষ্টিকুলের নবী, রাসূলে করীম, নবুঅতের দরবারের অতুল্য মুক্তা (৪) আল্লাহর হাবীব, নবীকুলের সরদার, মাখলূকের সুফারিশকারী, দ্বীনের পথপ্রদর্শক (৫) মুহাম্মাদ তাঁর নাম, আহমাদ তাঁর লকব। তাঁর মর্যাদার বর্ণনা শেষ হ’তে পারে কবে? (৬) হৃদয় তাঁর অদৃশ্য রহস্যের ভান্ডার; সকল দোষ-ত্রুটি থেকে তিনি মুক্ত, তাতে নেই কোন দ্বিধা-সংশয়। (৭) তাঁর জিহবা মহান আল্লাহর ভাষ্যকার, দ্বীনের বাগিচা যাঁর জন্য হ’ল ঈর্ষাতুর। (৮) বাহ্যিক ভাবে তিনি শেষনবী, বাস্তবে তিনি সাধকদের প্রেরণা উৎস’।

ফার্সী ভাষায় তাঁর এমনই এক দীর্ঘ কবিতা রয়েছে, যা একান্তভাবেই কেবল নবী করীম (ছাঃ)-এর প্রশংসায় নিবেদিত।

হযরত শাহ শহীদ (রহঃ)-এর এ সকল উর্দূ ও ফার্সী রচনা ‘সমগ্র’ আকারে মুদ্রিত হয়েছে, যা পড়ে দেখা যেতে পারে।[4]

নবী করীম (ছাঃ)-এর পবিত্র শানে যিনি এহেন ভক্তির অর্ঘ এবং ভালবাসার ডালি উপহার দিতে পারেন, তাকেই নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে বেআদবী ও গোস্তাখী করার দায়ে দায়ী করা হঠকারিতা ও নির্লজ্জতার নিকৃষ্টতম বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কবির ভাষায়-

شرم تم كو مگرنہىں آتى

‘তারপরও তো তোমাদের শরম আসে না’!

৩য় অভিযোগ : ১২৪৮ হিজরীতে তাঁর সাথে বিতর্ক সভার কথা বলা হয়েছে। অথচ হযরত শাহ শহীদ (রহঃ) ১২৪৬ হিজরীতে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিলেন। অথচ তার উপর এ ধরনের যুলুম করা হয়েছে এবং এখনও অব্যাহত আছে। তার লেখা আগে-পিছে কেটে-ছেঁটে নিজেদের মর্যি মতো ভ্রান্ত অর্থ করা হচ্ছে। ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন গ্রন্থে তাদের এহেন কদর্য আচরণ পরিষ্কার ভাষায় বর্ণনা করেছেন। যেমন, আকমালুল বায়ান ফী তায়ীদে তাক্বভিয়াতিল ঈমান, তাহযীরুন্নাস মিন শার্রিল খান্নাস (কলকাতা থেকে প্রকাশিত), ছিয়ানাতুল ইনসান ‘আন লাম্মাতিশ শায়ত্বান (মাতবা‘ আহমাদী, ১৩০৩ হিজরী), ‘হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ আওর মু‘আনিদীনে আহলে বিদ‘আত কে এলযামাত’ প্রভৃতি গ্রন্থে এ প্রচেষ্টা দেখা যেতে পারে। যাতে অপবাদ দানকারীদের সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ও জাল-জোচ্চুরির পর্দা খুব ভালভাবে উন্মোচন করা হয়েছে। তাদের দলীল-প্রমাণ ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়েছে এবং বিদ‘আতীদের বেলুন থেকে সমস্ত হাওয়া বের করে দেওয়া হয়েছে। ফালিল্লাহিল হামদ, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

৪র্থ. ইংরেজদের সহযোগিতার অভিযোগ : এটি সত্য হ’লে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এত বড় জিহাদ আন্দোলন তাহ’লে কাদের বিরুদ্ধে ছিল? ইংরেজরাই বা এ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছাদেকপুরী আলেমকুল ও অন্যান্য মুজাহিদদের সাথে যেরূপ আচরণ করেছিল তা কেন করেছিল?[5] কোন গভর্ণমেন্ট কি তার অনুগত ও সাহায্যকারীদের শিরচ্ছেদ করে? তাদের কি জেলখানায় পুরে কষ্ট দেয়? তাদের সহায়-সম্পত্তি ধ্বংস ও বাযেয়াফ্ত করে? তাদেরকে উত্যক্ত ও হয়রানি করার জন্য বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসায়? রাষ্ট্রের অনুগতদের কি এমন অবস্থা হয়, যা ইংরেজ শাসনামলে ঐ মুজাহিদদের হয়েছিল? তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল, সাগর পার করে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, বুলডোজার দিয়ে সহায়-সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের জীবিকার পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল।

১৮৬৪-১৮৭১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের অজুহাতে তাদের নামে পাঁচটি বড় মামলা দায়ের করা হয়েছিল। যাতে হাযার হাযার মুজাহিদকে নানাবিধ সাজা দেওয়া হয়েছিল। ১৮৬৩ সালে আম্বালায় ইংরেজ সৈন্য ও মুজাহিদদের মধ্যে তুমুল সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধের প্রেক্ষিতে এবং মোকদ্দমা ও অন্যান্য কারণে ধর-পাকড় কালে মুজাহিদদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের যে তান্ডব চলেছিল, সেই বেদনাবিধুর কাহিনী যে কেউ পড়লে বা শুনলে ভয়ে ও বেদনায় তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। নিজেকে সংবরণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এগুলি ছিল মুজাহিদদের সেই অনমনীয় দৃঢ়তা ও অতুলনীয় সাহসের পরাকাষ্ঠা, যা তারা জিহাদের জায্বা এবং আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে সহ্য করেছিলেন। এত কষ্টের পরেও তাদের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা দেয়নি, মানসিক শক্তি অবদমিত হয়নি। তাদের উৎসাহে কোন ভাটা পড়েনি। কবি বলেন,

بناكر دندخوش رسمے بخاك وخون غلطيدن

خدا رحمت كند ايں عاشقانِ پاك طينت را

‘রক্তে-মাটিতে গড়াগড়ি যাওয়ার এক সুন্দর রেওয়াজের বুনিয়াদ তারা গড়েছিলেন। পাক-পবিত্র স্বভাবের এই প্রেমিকজনদের উপর মহান আল্লাহ রহম করুন’।

তাজ্জবের বিষয় যে, আজকের এই দল, যারা এখন ইসলামের ঐ মহান মুজাহিদদেরকে ইংরেজদের ভক্ত প্রমাণ করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন, তারা ঐ যুগে কেন আবির্ভূত হননি? তাহ’লে এই দল ইংরেজদের বুঝাতে পারতেন যে, রে মূর্খের দল, দুশমন মনে করে যাদের উপর তোমরা যুলুম-অত্যাচারের স্টীম রোলার চালাচ্ছ তারা তো আসলে তোমাদের অনুগত ভক্ত! তাহ’লে বেচারারা ইংরেজদের যুলুম থেকে তো অন্তত রক্ষা পেতেন!

আবার জিহাদ আন্দোলনের ফলে ইংরেজ সরকারের কি বিপদ হ’তে পারে, তা কতদূর গড়াতে পারে এবং হিন্দুস্থানী প্রজা সাধারণের মনোভাব কোন দিকে যেতে পারে, তা যাচাই ও তদন্তের জন্য তৎকালীন ইংরেজ সরকার তাদেরই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেই রিপোর্টই ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমান্স’ নামে উইলিয়াম হান্টার গ্রন্থাকারে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের উক্ত দলের কথা মতো জিহাদ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এ তদন্তও তো তাহ’লে এক আজীব ও নিষ্ঠুর তামাশা হবে।

ঐ রিপোর্টেও কিন্তু জিহাদ আন্দোলনের সাথে জড়িত ওহাবীদেরকে বার বার রাষ্ট্রবিরোধী ও বিদ্রোহী বলা হয়েছে এবং অবশিষ্ট সকল শ্রেণী ও মাযহাবের মুসলিমদের অনুগত ভক্ত বলা হয়েছে। কিন্তু একশত বছর পরে এসে আজ আবিষ্কার হ’ল যে, ইংরেজদের এই বিশেষ প্রতিনিধির চোখে দেখা রিপোর্টও ভুল ছিল এবং উইলিয়াম হান্টার যাদের ইংরেজদের একক দুশমন, বিদ্রোহী ও বিরোধী বলেছিলেন তারা আসলে ছিল ইংরেজভক্ত!

কবি কতই না সত্য বলেছেন,

خردكا نام جنوں ركھ ديا اور جنوں كا خرد

جو چا ہے آپ كا حسن كر شمہ سا زكرے

‘বুদ্ধিমানের নাম দিলেন পাগল, আর পাগলের নাম দিলেন বুদ্ধিমান। আপনার ক্যারিশম্যাটিক সৌন্দর্য যেভাবে ইচ্ছা যাহির করুন’।

৫ম ও ৬ষ্ঠ অভিযোগ : দেওবন্দী আলেমগণও ঐ একই সময় থেকে ইংরেজদের সহযোগিতা করা শুরু করেন এবং ইংরেজরা দুই শ্রেণীকেই তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল বলে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেক্ষেত্রে দেওবন্দী আলেমদের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ সঠিক কি-না তা তারাই স্পষ্ট করবেন। তবে এতটুকু কথা অবশ্যই বলব যে, ঐ সময়ে ‘ওলামায়ে দেওবন্দ’ নামে আদতে কোন বস্ত্ত ছিল না। দেওবন্দ মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপি ত হয়েছে ১৮৬৭ সালে। মাদ্রাসার একটা অবস্থান তৈরি হওয়া এবং তার সাথে জড়িতদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার লাভের জন্যও তো একটা সময় প্রয়োজন। যেখানে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) ১৮৩১ সালে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন, সেখানে ইংরেজরা কিভাবে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ) ও দেওবন্দী আলেমদের একই সময়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল তা বোধগম্য নয়। অভিযোগ আরোপকালে একটু হলেও তো আল্লাহর ভয়ে হুঁশ করে কথা বলা উচিত ছিল।

অভিযোগকারী যদি জিহাদ আন্দোলন দ্বারা শিখদের সাথে মুজাহিদদের সংঘর্ষের প্রতি ইঙ্গিত করেন এবং বুঝাতে চান যে, ইংরেজরা তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পরস্পরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিল এবং মুজাহিদরা ইংরেজদের পলিসি অনুসারে শিখদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, তাহ’লে সে কথাও ঐতিহাসিকভাবে সম্পূর্ণ ভুল। যারা সত্যকে বিকৃত করছেন এবং শাহ ইসমাঈল শহীদের বইয়ের ভাষা কাট-ছাঁট করে এসব কিছু প্রমাণের চেষ্টা করছেন তাদের আসল উদ্দেশ্য যে কি, তা মাওলানা গোলাম রসূল মেহের, মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদভীসহ আরো অনেকে পরিষ্কার করেছেন। সংবাদপত্রের পাতা এ আলোচনার জন্য যথেষ্ট নয়। উক্ত দু’জন মনীষী স্পষ্ট করেছেন যে, জিহাদ আন্দোলন ছিল একান্তভাবেই ইংরেজ কাফেরদের বিরুদ্ধে এবং খাঁটি ইসলামী সালতানাত প্রতিষ্ঠার জন্য। অন্য কোন উদ্দেশ্য মুজাহিদদের সামনে ছিল না।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত)

মূল (উর্দূ): হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ

পাকিস্তানের প্রখ্যাত আহলেহাদীছ আলেম, লেখক ও গবেষক; সাবেক সম্পাদক, আল-ই‘তিছাম, লাহোর, পাকিস্তান।

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ঝিনাইদহ।


[1]. বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: ‘আল-হারাকাতুল ওয়াহহাবিয়াতুল হিন্দিয়াতুস সিয়াসিয়াহ’; আয-যিয়া, ৪র্থ বর্ষ ৮ম সংখ্যা; ‘ওয়াহাবিয়াত এক দ্বীনী ওয়া সিয়াসী তাহরীক’, আল-হেলাল, পাটনা, এপ্রিল-জুন, ১৯৩৭; সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, পৃ. ২৩৭-২৪৩

[2]. মাওলানা সিন্ধী আওর উন কে আফকার ও খিয়ালাত পর এক নযর, পৃ. ১০২-১০৯, পাটনা, ইন্ডিয়া।

[3]. সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৫১-৪৫২।

[4]. মাজমূ‘আ কালামে শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহঃ), তারেক একাডেমী, ফয়ছালাবাদ, পাকিস্তান।

[5]. ‘হিন্দুস্তান কী পহেলী ইসলামী তাহরীক’ গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে






অল্পে তুষ্টি (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা : মুমিনের দুই অনন্য বৈশিষ্ট্য - ড. মুহাম্মাদ আব্দুল হালীম
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ : একটি পর্যালোচনা (জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী সংখ্যার পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ইসলামে তাক্বলীদের বিধান (৩য় কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
তাহরীকে জিহাদ : আহলেহাদীছ ও আহনাফ (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
দাওয়াতের ক্ষেত্র ও আধুনিক মাধ্যম সমূহ - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (৬ষ্ঠ কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
মাদরাসার পাঠ্যক্রম নিয়ে ষড়যন্ত্র - জাহাঙ্গীর আলম
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
পরকালে মানুষকে যেসব প্রশ্নের জওয়াব দিতে হবে - মীযানুর রহমান মাদানী
শান্তির ধর্ম ইসলাম - মুহাম্মাদ রশীদ, উনাইযা ইসলামিক সেন্টার, সঊদী আরব।
আরও
আরও
.