পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।
দেশ ও জাতির কল্যাণে আমানতদার নেতৃত্ব :
বিশ্বস্ত আমানতদার, যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তি বর্তমানে সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। পিতা-মাতার সীমাহীন ত্যাগে গড়ে ওঠা মেধাবী সন্তান আজ অযোগ্যদের টাকার কাছে ন্যায্য পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গন সহ সর্বত্র আজ অযোগ্য লোকদের দৌরাত্ম্য চলছে, যা দেশ ও জাতির ধ্বংসের অশনি সংকেত।
এ শ্রেণীর লোকেরাই আজ সামাজিকভাবে সমাদৃত ও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ) এই নিন্দিত বাস্তবতার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
إِذَا ضُيِّعَتِ الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ قَالَ كَيْفَ إِضَاعَتُهَا يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ إِذَا أُسْنِدَ الأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ، فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ-
‘যখন আমানত নষ্ট হয়ে যাবে, তখন ক্বিয়ামতের
অপেক্ষা করবে। রাবী বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমানত কিভাবে নষ্ট হয়ে
যাবে? তিনি বললেন, যখন অযোগ্য ব্যক্তিকে কোন দায়িত্ব দেয়া হবে, তখন
ক্বিয়ামতের অপেক্ষা করবে’।[1]
হুযায়ফা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে অযোগ্য ও ঈমানহীন লোক সম্পর্কে বর্ণনা করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ فِى بَنِى فُلاَنٍ رَجُلاً أَمِينًا وَيُقَالُ لِلرَّجُلِ مَا أَجْلَدَهُ مَا أَظْرَفَهُ مَا أَعْقَلَهُ وَمَا فِى قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةٍ مِنْ خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ-
‘অমুক বংশে একজন আমানতদার লোক আছে, সে
ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হবে যে, সে কতই না জ্ঞানী, কতই না হুঁশিয়ার, কতই না
বাহাদুর? অথচ তার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ ঈমান থাকবে না’।[2]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন,
إِنَّمَا النَّاسُ كَالإِبِلِ الْمِائَةُ لاَ تَكَادُ تَجِدُ فِيْهَا رَاحِلَةً-
‘নিশ্চয়ই মানুষ এমন শত উটের মত, যাদের মধ্য থেকে তুমি একটিকেও বাহনের উপযোগী পাবে না’।[3]
অর্থাৎ উটের কাজ হ’ল বোঝা বহন করা। আর যে উট বোঝা বহন করতে পারে না, সেটা নিজেই একটা বোঝা। অনুরূপভাবে মানুষ আজ নামে মাত্র মানুষ। তার দেহ সৌষ্ঠব সুন্দর হ’লেও শত মানুষের মাঝে মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও বলেন,
إِنَّهَا سَتَأْتِى عَلَى النَّاسِ سِنُونَ خَدَّاعَةٌ يُصَدَّقُ فِيهَا الْكَاذِبُ وَيُكَذَّبُ فِيهَا الصَّادِقُ وَيُؤْتَمَنُ فِيهَا الْخَائِنُ وَيُخَوَّنُ فِيهَا الأَمِينُ وَيَنْطِقُ فِيهَا الرُّوَيْبِضَةُ قِيلَ وَمَا الرُّوَيْبِضَةُ قَالَ السَّفِيهُ يَتَكَلَّمُ فِى أَمْرِ الْعَامَّةِ-
‘অতি শীঘ্রই মানুষের মাঝে এমন এক প্রতারণাপূর্ণ সময় আসবে, যখন তাদের মধ্যে মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করা হবে। আর সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করা হবে। খেয়ানতকারীর কাছে আমানত রাখা হবে এবং আমানতদার ব্যক্তি খিয়ানত করবে। আর সে সময় তাদের মধ্যে ‘রুওয়াইবিযাহ’ কথা বলবে। তাঁকে বলা হ’ল রুওয়াইবিযাহ কি? তিনি বললেন, নির্বোধ বা মূর্খ ব্যক্তি জনসাধারণের বিষয়ে কথা বলবে’।[4] অর্থাৎ হীন ও নিকৃষ্ট লোক জনসাধারণের নেতৃত্ব দিবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচিছ। ক্ষমতার উৎস বলে খ্যাত পার্লামেন্ট সদস্য পদ এখন অর্থের বিনিময়ে নির্ধারিত হয়, যেখানে যোগ্যতা ও সততা বিবেচ্য বিষয় নয়। অর্থের বিনিময়ে একজন মানুষ যখন ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন দেশ ও জাতি তার নিকট থেকে কিইবা প্রত্যাশা করতে পারে? সুশীল সমাজ আরও স্তম্ভিত হন, যখন সমাজের কুখ্যাত সন্ত্রাসী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। যাদের হাতে সমাজের কোন কিছুই নিরাপদ নয়। তারা দেশ ও সমাজের কি নিরাপত্তা দিবে? নেতৃত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ ‘আমানত’ অযোগ্য, অদক্ষ ও সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেলে দেশ জুড়ে অশান্তি, নৈরাজ্য, আইন-শৃংখলার অবনতি, প্রশাসনে দৈন্যদশা সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। যার প্রতিফল আমরা দেখতে পাচ্ছি।
গত ২২শে মে ২০১৫ইং সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এক পৃষ্ঠায় ৪৮টি শব্দের ভুল বানান পাওয়া যায়।[5] এটা সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ের চিত্র। অন্যসব বিভাগের অবস্থা এ থেকে সহজেই অনুমেয়। দলীয় রাজনীতির ফলে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নিজ দলীয় লোক অযোগ্য ও অদক্ষ হ’লেও তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জায়গা করে দেয়া হয়। অপরদিকে দলীয় না হ’লে তাদেরকে বিবেচনা করা হয় না। বিশ্ব রাজনীতি এমন এক নিন্দনীয় পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, বিরোধী শক্তিকে দমন করতে গিয়ে নিজ দেশের নাগরিকদেরকে জেল-যুলুম, অমানবিক নিপীড়ন, গুম-খুন সহ বুটের তলায় পিষ্ট করা হয়। আর এগুলিই হ’ল মানুষের তৈরী করা মতবাদে গড়ে ওঠা রাজনীতির জঘন্য রূপ। যেভাবেই হোক ক্ষমতায় একবার যেতে পারলে মসনদকে কিভাবে স্থায়ী করা যায়, নেতারা সেই চিন্তায় সর্বদা মগ্ন থাকে। তখন তাদের কাছে দেশের স্বার্থ ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা গৌণ আর ক্ষমতা হয় মুখ্য। ক্ষমতার কায়েমী চিন্তা যখন তাদের পেয়ে বসে, তখন নেতারা হয়ে যান দুর্বৃত্তপরায়ণ। ফলে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন ও দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, গত সাড়ে তিন বছরে দেশে ৯৬৮টি শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্র ও অনেক সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে ২০৯ এবং ২০১৩-২০১৪ সালে ৩৫০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। গত ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাত মাসে এ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯১ জনে।
নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাও ভয়ঙ্কর। গত ছয় মাসে সারাদেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দশ হাযার মামলা হয়েছে।[6] এখন খুনের টার্গেট করা হচ্ছে বিদেশী নাগরিকদের, যা দেশের পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গত ২৮শে সেপ্টেম্বর’১৫ ইটালিয়ান নাগরিক সিজার তাবেলাকে হত্যা করা হয় গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায়। এর পাঁচদিন পরেই ৩রা অক্টোবর জাপানী নাগরিক ৬৬ বছরের বৃদ্ধ হোশি কোনিওকে রংপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা মোটর সাইকেল যোগে পালিয়ে যায়।[7] এভাবে দেশের সর্বত্র সন্ত্রাস, খুন-খারাবী, হত্যা-গুম নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আদর্শ, সৎ ও আমানতদার নেতৃত্বই পারে এ দৈন্যদশা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে।
আমানতদারীর কতিপয় দৃষ্টান্ত :
এক্ষণে আমরা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ থেকে আমানতের এমন কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করব, যা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আমানত সম্পাদনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
(১) ফেরাঊন মূসা (আঃ)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে মূসা মিসর ছেড়ে মাদিয়ানে হিজরত করেন। ফেরাঊনের উক্ত চক্রান্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
وَجَاءَ رَجُلٌ مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ يَسْعَى قَالَ يَا مُوسَى إِنَّ الْمَلَأَ يَأْتَمِرُونَ بِكَ لِيَقْتُلُوكَ فَاخْرُجْ إِنِّي لَكَ مِنَ النَّاصِحِيْنَ-
‘এ সময় শহরের দূর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি ছুটে আসল এবং বলল, হে মূসা! রাজ্যের পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার শলা-পরামর্শ করছে। অতএব (এখান থেকে) তুমি বের হয়ে যাও। নিশ্চয়ই আমি তোমার হিতাকাংখী’ (ক্বাছাছ ২৮/২০)।
অতঃপর মিসর ছেড়ে মূসা মাদিয়ানে যাওয়ার পর পানি পানের আশায় একটি কূপের নিকট গেলে তিনি দেখতে পেলেন দু’জন মেয়ে তাদের তৃষ্ণার্ত পশুগুলিসহ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রয়োজন ও অসহায়ত্বের প্রতি কেউ দৃষ্টিই দিচ্ছে না। মূসা তখন নিজে অসহায় ও মাযলূম, তিনি মাযলূমের ব্যথা বুঝেন। তাদের এ অবস্থা দেখে তার হৃদয় দরদে উথলে উঠল। কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করলেও মেয়ে দু’টির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলেন। তারা উত্তরে বলল, রাখালরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করা শেষ না করা পর্যন্ত আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি পান করাতে পারি না। আর আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ মানুষ, তিনি আমাদের অপেক্ষায় থাকেন। অতঃপর মূসা (আঃ) তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে দিলে মেয়ে দু’টি অন্যান্য দিনের অনেক আগেই বাড়ীতে ফিরে আসে।
উল্লেখ্য যে, রাখালরা
পানি পান করানোর পর তাদের অভ্যাস মত একটি ভারী পাথর (যে পাথর দশজন মিলে
উত্তোলন করত) দিয়ে কূপের মুখ বন্ধ করে দিত। ফলে মেয়ে দু’টি উচ্ছিষ্ট পানি
পান করাত। অতঃপর মূসা (আঃ) সেই পাথরটি একাই কূপের মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে পানি
তুলে পশুপালকে পান করানোর ব্যবস্থা করেন। অতঃপর অনাহারে সহায়-সম্বলহীন
ক্ষুধার্ত মূসা অপরিচিত ভিন দেশে একটি গাছের ছায়ায় বসে নিজের অসহায়ত্বের
কথা আল্লাহর নিকট তুলে ধরে বললেন, رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنْزَلْتَ إِلَيَّ
مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তোমার পক্ষ হ’তে আমার প্রতি
কল্যাণ নাযিলের মুখাপেক্ষী’ (ক্বাছাছ ২৮/২৪)।[8]
মেয়রা অনেক আগে বাড়ীতে আসার কারণ ও বলিষ্ঠ মূসা সম্পর্কে তাদের পিতাকে জানালে পিতা মূসার কাজের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাকে প্রতিদান দেয়ার জন্য বাড়ীতে ডেকে আনার জন্য মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন।
উল্লেখ্য যে, মেয়েদের পিতা ছিলেন
বিখ্যাত নবী শো‘আয়েব (আঃ)। যিনি মাদায়েনবাসীর নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন।
মেয়েটি তাদের বাড়ীতে আসার জন্য মূসা (আঃ)-এর নিকট গেলে মূসা তাকে বললেন,
তুমি আমাকে আমার পিছন থেকে তোমাদের বাড়ী যাওয়ার পথ দেখিয়ে দাও। মূলতঃ
অসতর্ক দৃষ্টিপাত থেকে বাঁচার জন্য মূসা (আঃ) ঐ সতর্কাবস্থা গ্রহণ
করেছিলেন। মেয়েটি মূসার বলিষ্ঠতা ও আমানতদারীর প্রত্যক্ষ ধারণা পাওয়ার পর
পিতাকে বলল, বাবা আপনি তাঁকে কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ দিন। পিতা বললেন,
কর্মচারীর জন্য দু’টি গুণ থাকা দরকার তাহ’ল (১) শক্তি-সামর্থ্য (২)
আমানতদারী। তুমি এ দু’টির মধ্যে এমন কি দেখতে পেয়েছ? মেয়েটি বলল, পানি পান
করানোর সময় তাঁর শক্তি-সামর্থ্যের পরিচয় পেয়েছি। আর পথ চলার সময় আমাকে
পশ্চাতে রেখে পথ চলা দ্বারা তার বিশ্বস্ততা বা আমানতদারীতার প্রমাণ পেয়েছি।[9]
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন,
أفرس الناس ثلاثة: أبو بكر حين تفرس في عُمَر، وصاحب يوسف حين قال: أَكْرِمِي مَثْوَاهُ، وصاحبة موسى-
‘সর্বাধিক
দূরদর্শী লোক তিনজন : (১) আবুবকর (রাঃ), যিনি ওমর (রাঃ)-কে পরবর্তী খলীফা
নির্বাচন করেন। (২) ইউসুফকে ক্রয়কারী আযীযে মিসর, যখন তিনি তার স্ত্রীকে
বলেছিলেন, একে (ইউসুফকে) সম্মানের সাথে রাখ। (৩) মূসার স্ত্রী, যখন তিনি
তার পিতাকে বলেছিলেন,يَا أَبَتِ اسْتَأْجِرْهُ إِنَّ خَيْرَ مَنِ
اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ ‘হে পিতা! একে কর্মচারী নিযুক্ত করুন!
নিশ্চয়ই আপনার কর্মসহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও
বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/২৬)।[10]
ঘটনাটির কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ :
‘তখন মূসা সেখান থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বের হয়ে গেল এবং সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের হাত থেকে রক্ষা কর। ‘অতঃপর যখন সে মাদিয়ান অভিমুখে রওয়ানা করল, তখন বলল, নিশ্চয়ই পালনকর্তা আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করবেন। অতঃপর যখন সে মাদিয়ানের কূয়ার নিকটে পৌঁছল, তখন সেখানে একদল লোককে তাদের পশুপালকে পানি পান করাতে দেখল। আর তাদের পিছনে দু’জন নারীকে তাদের পশুগুলিকে সামলিয়ে রাখতে দেখল। মূসা গিয়ে তাদের বলল, তোমাদের কি অবস্থা? তারা বলল, আমরা পানি পান করাতে পারিনা যতক্ষণ না রাখালরা সরে যায়। অথচ আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ। তখন মূসা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করালো। অতঃপর ছায়ার নীচে ফিরে গেল এবং বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি তোমার পক্ষ হ’তে আমার প্রতি কল্যাণ নাযিলের মুখাপেক্ষী। অতঃপর বালিকাদ্বয়ের একজন লজ্জাবশত হয়ে তার কাছে এল এবং বলল, আমার আববা আপনাকে ডেকেছেন, যাতে আপনি আমাদের পশুগুলিকে যে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময় দিতে পারেন। তখন মূসা তার নিকটে গেল ও তাকে সকল ঘটনা খুলে বলল। (জবাবে) তিনি বললেন, ভয় পেয়োনা। তুমি যালেম সম্প্রদায়ের হাত থেকে বেঁচে গেছ। অতঃপর মেয়ে দু’টির একজন বলল, হে পিতা! একে কর্মচারী নিযুক্ত করুন! নিশ্চয়ই আপনার কর্মসহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ (ক্বাছাছ ২৮/২১-২৬)।
অতঃপর শো‘আয়েব (আঃ) তার এক মেয়েকে বিবাহের মোহরানা স্বরূপ আট বছর মযূরী খাটার শর্তে মূসার সাথে বিবাহ দেন। অতঃপর মূসা বিশ্বস্ততার সাথে তার অঙ্গীকার পূর্ণ করেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,
قَالَ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أُنْكِحَكَ إِحْدَى ابْنَتَيَّ هَاتَيْنِ عَلَى أَنْ تَأْجُرَنِي ثَمَانِيَ حِجَجٍ فَإِنْ أَتْمَمْتَ عَشْرًا فَمِنْ عِنْدِكَ وَمَا أُرِيدُ أَنْ أَشُقَّ عَلَيْكَ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللهُ مِنَ الصَّالِحِينَ-
‘তখন তিনি (পিতা) মূসাকে বললেন, আমি আমার এই মেয়ে দু’টির একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার (বাড়ীতে) কর্মচারী থাকবে। তবে যদি দশ বছর পূর্ণ কর, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা। আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসাবে পাবে’ (ক্বাছাছ ২৮/২৭)।
(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
‘এক
লোক অপর লোক হ’তে একখন্ড জমি ক্রয় করেছিল। ক্রেতা খরীদকৃত জমিতে একটা
স্বর্ণভর্তি কলস পেল। ক্রেতা বিক্রেতাকে বলল, আমার কাছ থেকে তোমার স্বর্ণ
নিয়ে নাও। কারণ আমি জমি ক্রয় করেছি, স্বর্ণ ক্রয় করিনি। জমিওয়ালা বলল, আমি
জমি এবং এতে যা কিছু আছে সবই তোমার নিকট বিক্রি করে দিয়েছি। অতঃপর তারা
উভয়েই অপর এক লোকের কাছে এর মীমাংসা চাইল। মীমাংসাকারী বললেন, তোমাদের কি
ছেলে-মেয়ে আছে? একজন বলল, আমার একটি ছেলে আছে। অন্যজন বলল, আমার একটি মেয়ে
আছে। মীমাংসাকারী বললেন, তোমার মেয়েকে তার ছেলের সঙ্গে বিবাহ দাও আর
প্রাপ্ত স্বর্ণের মধ্যে কিছু তাদের বিবাহে ব্যয় কর এবং বাকী অংশ তাদেরকে
দিয়ে দাও’।[11]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, বনী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির নিকট এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা কর্য চাইলে কর্যদাতা বলল, কয়েকজন লোক নিয়ে আস, আমি তাদেরকে সাক্ষী রাখব। গ্রহীতা বলল, ‘আল্লাহই সাক্ষী হিসাবে যথেষ্ট’। কর্যদাতা পুনরায় বলল, তবে একজন যামিনদার উপস্থিত কর! সে বলল, ‘আল্লাহই যামিনদার হিসাবে যথেষ্ট’। তখন কর্যদাতা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। তারপর সে নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা ধার দিল। অতঃপর সে (গ্রহীতা) সমুদ্রযাত্রা করল এবং তার (ব্যবসায়িক) প্রয়োজন পূরণ করল। পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসলে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল, যাতে নির্ধারিত সময়ে কর্যদাতার নিকট এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং কর্যদাতার নামে একখানা চিঠি ও এক হাযার দীনার ওর মধ্যে পুরে ছিদ্রটি বন্ধ করে দিল। তারপর ঐ কাষ্ঠখন্ডটা সমুদ্র তীরে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ! তুমি তো জান, আমি অমুকের নিকট এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা কর্য চাইলে সে আমার কাছ থেকে যামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই যামিনদার হিসাবে যথেষ্ট। এতে সে রাযী হয়ে যায় (এবং আমাকে ধার দেয়)। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি বলেছিলাম, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তাতে সে রাযী হয়ে যায়। আমি তার প্রাপ্য তার নিকট পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম, কিন্তু পেলাম না। আমি ঐ এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা তোমার নিকট আমানত রাখছি। এই বলে সে কাষ্ঠখন্ডটা সমুদ্রবক্ষে নিক্ষেপ করল। তৎক্ষণাৎ তা সমুদ্রের মধ্যে ভেসে চলে গেল। অতঃপর লোকটি ফিরে গেল এবং নিজের শহরে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে লাগল।
ইংরেজী অনুবাদক আবশ্যক
ওদিকে কর্যদাতা
(নির্ধারিত দিনে) এ আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়তবা ঋণগ্রহীতা তার পাওনা
টাকা নিয়ে কোন নৌযানে চড়ে এসে পড়েছে। ঘটনাক্রমে ঐ কাষ্ঠখন্ডটা তার নযরে
পড়ল, যার ভিতরে স্বর্ণমুদ্রা ছিল। সে তা পরিবারের জ্বালানির জন্য বাড়ী নিয়ে
গেল। যখন কাঠের টুকরাটা চিরল, তখন ঐ স্বর্ণমুদ্রা ও চিঠিটা পেয়ে গেল।
কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে (পাওনাদারের নিকট) এসে
হাযির হ’ল। সে বলল, আল্লাহর কসম! আমি তোমার (প্রাপ্য) মাল যথাসময়ে পৌঁছে
দেওয়ার উদ্দেশ্যে যানবাহনের খোঁজে সর্বদা চেষ্টিত ছিলাম। কিন্তু যে
জাহাযটিতে করে আমি এখন এসেছি এর আগে আর কোন জাহাযই পাইনি (তাই সময়মত আসতে
পারলাম না)। কর্যদাতা বললেন, তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা
বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোন জাহাযই পাইনি। অতঃপর ঋণদাতা
বলল, আল্লাহ পাক আমার নিকট তা পৌঁছিয়েছেন, যা তুমি পত্রসহ কাষ্ঠখন্ডে
পাঠিয়েছিলে। কাজেই এক হাযার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আনন্দচিত্তে ফিরে যাও। তখন
সে এক হাযার দীনার আনন্দচিত্তে নিয়ে ফিরে চলে গেল।[12]
(৪) সুওয়াইদ ইবনু গাফালা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সোলায়মান বিন রাবী‘আহ এবং যায়েদ বিন সোহানের সঙ্গে আমি এক যুদ্ধে শরীক ছিলাম। আমি একটি চাবুক পেলাম। তারা উভয়ে আমাকে এটা ফেলে দিতে বললেন। আমি বললাম, না। এর মালিক এলে এটা আমি তাকে দিয়ে দিব। নতুবা আমিই এটা ব্যবহার করব। আমরা ফিরে গিয়ে হজ্জ করলাম। এরপর যখন মদীনায় গেলাম, তখন ওবাই বিন কা‘ব (রাঃ)-কে (এ বিষয়ে) জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, নবী (ছাঃ) এর যুগে আমি একটি থলে পেয়েছিলাম। এর মধ্যে একশ’ দীনার ছিল। আমি এটা নবী (ছাঃ)-এর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, এক বছর পর্যন্ত তুমি এটার ঘোষণা দিতে থাক। কাজেই আমি এক বছর পর্যন্ত এর ঘোষণা দিলাম। এরপর আমি তাঁর কাছে এলাম। তিনি আরও এক বছর ঘোষণা দিতে বললেন। আমি আরও এক বছর ঘোষণা দিলাম। এরপর আমি আবার তাঁর কাছে এলাম। তিনি আবার এক বছর ঘোষণা দিতে বললেন। আমি আরও এক বছর ঘোষণা দিলাম। এরপর আমি চতুর্থবার তাঁর কাছে আসলাম। তিনি বললেন, থলের ভিতরের দীনারের সংখ্যা, বাঁধন এবং থলেটি চিনে রাখ। যদি মালিক ফিরে আসে তাকে দিয়ে দাও। নতুবা তুমি নিজে তা ব্যবহার কর।[13]
[1]. বুখারী হা/৬৪৯৬।
[2]. বুখারী হা/৬৪৯৭; মুসলিম হা/১৪৩।
[3]. বুখারী হা/৬৪৯৮; মুসলিম হা/২৫৪৭।
[4]. আহমাদ হা/৭৮৯৯, সনদ হাসান।
[5]. মাসিক আত-তাহরীক, জুলাই ২০১৫, পৃঃ ৪১।
[6]. দৈনিক ইনকিলাব ৬.৮.১৫ইং; মাসিক আত-তাহরীক, সেপ্টেম্বর ২০১৫ইং ১৮/১২, সম্পাদকীয় কলাম।
[7]. বাংলাদেশ প্রতিদিন ০৪.১০.২০১৫ইং পৃঃ ১।
[8]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বাছাছ ২১-২৪ আয়াত।
[9]. নবীদের কাহিনী, ২/২২-২৪।
[10]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ক্বাছাছ ২৫-২৮ আয়াত।
[11]. বুখারী হা/৩৪৭২, ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫৪; মুসলিম হা/১৭২১; আহমাদ হা/৮১৭৬।
[12]. বুখারী হা/২২৯১, ‘যামিন হওয়া’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১।
[13]. বুখারী হা/২৪৩৭ ‘পড়ে থাকা জিনিস উঠিয়ে নেওয়া’ অধ্যায়-৪৫।