পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।
মানবিক
গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, হক ও বাতিল বুঝার দ্বীনী জ্ঞান যদি কোন সমাজের
মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহ’লে সেটাকে সভ্য সমাজ বলা যায় না। তখন সেটা হয়
আর এক মানব নেকড়ের চারণভূমি। নেকড়ের কাছে যেমন অন্যসব প্রাণীর নিরাপত্তা
আশা করা যায় না। তেমনি ঐ সমাজেও দ্বীনদার মানুষ নিরাপদ নয়। কেননা নেকড়ে
সুযোগ পেলেই অন্যদের অধিকার ও অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়। কারণ তার মাঝে
হক-বাতিল, ন্যায়-অন্যায় বুঝার জ্ঞান নেই। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যখন দুনিয়ায়
আগমন করেন, তখন তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ছিল সে রকমই পশু প্রকৃতির, যেখানে
ন্যায়-নীতি, মানবতা এবং আমানতদারিতা বিলুপ্ত হয়েছিল। মহান আল্লাহ সেই
অধিপতিত আরব জাতিসহ গোটা বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থাকে পতন দশা থেকে মুক্তির
উদ্দেশ্যে শেষ নবী হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বিশ্ববাসীর নিকটে রাসূল
হিসাবে প্রেরণ করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,وَأَنْذِرْ
عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ ‘তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক কর’ (শু‘আরা ২৬/২১৪)।
এ
নির্দেশ প্রাপ্তির পর তিনি একদিন ছাফা পাহাড়ে আরোহণ করে ‘ইয়া ছাবাহাহ’
(يَا صَبَاحَاهْ) ‘হায় সকাল’ বলে ডাক দিলেন! অতঃপর কুরাইশগণ তাঁর কাছে
একত্রিত হ’লে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমি যদি বলি শত্রুবাহিনী সকাল বা
সন্ধ্যায় তোমাদের উপর আক্রমণ করতে প্রস্ত্তত, তবে কি তোমরা আমার কথা
বিশ্বাস করবে? তখন তারা সবাই বলেছিল, নিশ্চয়ই! কিন্তু যখন তিনি আসন্ন কঠিন
শাস্তি সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করলেন, তখন আবু লাহাব বলে উঠল, تَبًّا لَكَ
أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا ‘তুমি ধ্বংস হও! এজন্যই কি তুমি আমাদেরকে একত্রিত
করেছ’? এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে আল্লাহ তা‘আলা আবু লাহাবের জন্য বিনাশবাণী
নাযিল করে বললেন, تَبَّتْ يَدَا أَبِى لَهَبٍ ‘আবু লাহাবের দু’হাত ধ্বংস
হোক’।[1]
আল্লাহ তা‘আলা সফলতার মাধ্যম ‘আমানত’ বিস্তীর্ণ আকাশ, পৃথিবী ও পাহাড়কে গ্রহণ করার জন্য বললে তারা সবাই অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতার কথা ভেবে আদম (আঃ) তা কাঁধে তুলে নেন।[2] মূলতঃ আদম (আঃ) থেকে শেষ নবী পর্যন্ত সকলেই ছিলেন এ আমানতের প্রচারক, সমাজ সংস্কারক ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) দাওয়াতের মাধ্যমে এমন বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন যার ফলে আরবের মরুচারী বর্বর, চির দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অভ্যস্ত মানুষগুলির নাঙ্গা তরবারি কোষবদ্ধ হয়ে যায়। সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরী হয়। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার পরিধি ও আমানতদারী ব্যাপকতা লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণে শিথিলতার ফলে জাহেলিয়াতের সেই ফেলে আসা ত্রাস ও খুনরাঙ্গা সমাজ ব্যবস্থা পুনরায় ফিরে এসেছে। এখন অবস্থা এমন যে, একটি পশু নিজেকে নিরাপদ মনে করলেও সামাজিক জীব মানুষ আজ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদা তটস্থ-শঙ্কিত।
রাসূল (ছাঃ)-এর তাওহীদের দাওয়াতকে সেদিন আবু লাহাব প্রত্যাখ্যান করে তার দুনিয়া ও আখেরাত ধ্বংস করেছিল। পক্ষান্তরে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দাওয়াত কবুল করে নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলতঃ যুগে যুগে আবু লাহাব ও তার দোসররা ইতিহাসে ঘৃণিত ও অপমানিত ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে এবং থাকবে।
এক্ষণে বাঁচার পথ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত আমানতকে গ্রহণ করে দুনিয়া ও আখেরাতকে নিরাপদ করা। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার মারাত্মক অবনতি স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। এতে সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। দেশ ও জাতির পতনদশা থেকে বাঁচতে হ’লে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আমাদের আহবান! আমানতকে সর্বত্র সর্বতোভাবে কায়েম করুন। তাহ’লে বিশ্ববাসী সুখে-শান্তিতে ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারবে। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা আমানতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
আমানতের সংজ্ঞা :
‘আমানত’ (الأمانة) আরবী শব্দ, যার অর্থ বিশ্বস্ততা, আস্থা, নিরাপত্তা ইত্যাদি। প্রখ্যাত অভিধানবেত্তা ইবনু মানযূর বলেন, الأمانة : ضد الخيانة অর্থাৎ আমানত শব্দটি الخيانة (খেয়ানত) বা বিশ্বাসঘাতকতার বিপরীত। أمانة -এর বহুবচন أمانات যার অর্থ হ’ল, বিশ্বস্ততা, আস্থা, নিরাপত্তা, তত্ত্বাবধান, রক্ষা, হেফাযত ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا ‘যখন আমরা কা‘বা গৃহকে মানব জাতির জন্য সুরক্ষিত স্থান ও মানুষের জন্য মিলনস্থল করলাম’ (বাক্বারাহ ২/১২৫)।
যদি বলা হয়ে থাকে লোকটি আমানতদার ও বিশ্বস্ত, তাহ’লে তার থেকে কেউ জান ও মালের নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে না।
পরিভাষিক অর্থে আমানত :
আবুল
বাকা আইয়ূব বিন মূসা আল-কাফাবী (মৃঃ ১০৯৪ খ্রিঃ) বলেন, الأمانة : كل ما
افترض على العباد فهو أمانة كالصلاة والزكاة والصيام وأداء الدين- ‘আমানত
হ’ল প্রত্যেক ঐ জিনিস যা বান্দার উপর ফরয করা হয়েছে। যেমন- ছালাত, ছিয়াম,
যাকাত ও ঋণ পরিশোধ করা’। অন্যত্র তিনি বলেন, كل ما يؤتمن عليه من أموال
وحُرْم وأسرار فهو أمانة- ‘আমানত হ’ল এমন সম্পদ, নিষিদ্ধ বিষয়াবলী ও গোপন
কথা, যা কারো রক্ষিত থাকে’।[3]
আমানত আরশে আযীম হ’তে বান্দার প্রতি আরোপিত দায়িত্ব :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالْجِبَالِ فَأَبَيْنَ أَنْ يَحْمِلْنَهَا وَأَشْفَقْنَ مِنْهَا وَحَمَلَهَا الْإِنْسَانُ إِنَّهُ كَانَ ظَلُومًا جَهُولًا- ‘আমরা তো আসমান, যমীন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত অর্পণ করেছিলাম, তারা এটা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শংকিত হ’ল। কিন্তু মানুষ ওটা বহন করল। সে তো অতিশয় যালিম, অতিশয় অজ্ঞ’ (আহযাব ৩৩/৭২)।
আমানত দ্বারা উদ্দেশ্য :
ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থে আমানতের ব্যাখ্যায় বিদ্বানগণের কিছু বক্তব্য তুলে ধরেছেন। যেমন-
১. আতিয়্যাহ আওফী ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, আয়াতে উল্লিখিত ‘আমানত’ অর্থ طاعة বা আনুগত্য।
২. আলী ইবনু আবী ত্বালহা (রহঃ) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমানত’ দ্বারা الفرائض বা নির্ধারিত বিষয়াবলী বুঝানো হয়েছে।
৩. ইবনু জারীর (মৃঃ ৩১০ হিঃ) বর্ণনা করেন যে, মুজাহিদ, সাঈদ ইবনু যুবাইর, যাহহাক এবং হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, إن الأمانة هى الفرائض ‘আমানত’ হচ্ছে ফারায়েয বা (শরী‘আত) নির্ধারিত বিষয়াবলী।
৪. ওবাই ইবনু কা‘ব বলেন, من الأمانة أن المرأة أوتمنت على فرجها ‘আমানত হ’ল, নারীদের সতীত্বকে তাদের নিকট আমানত হিসাবে রাখা হয়েছে’।
৫. ক্বাতাদাহ বলেন, الأمانة الدين والفرائض والحدود ‘আমানত হ’ল দ্বীন, ফরয সমূহ এবং নির্ধারিত দন্ড সমূহ।
৬.
মালেক (রহঃ) যায়েদ ইবনু আসলাম হ’তে বর্ণনা করেন, الأمانة ثلاثة : الصلاة
والصوم والإغةسال من الجنابة- ‘আমানত হ’ল তিনটি বিষয়। যথা- ছালাত, ছিয়াম ও
শারীরিক অপবিত্রতা থেকে গোসল করা’।[4]
৭. রবী‘ বিন আনাস বলেন,هي الأمانات فيما بينك وبين الناس ‘সেটা হচ্ছে তোমার ও মানুষের মধ্যেকার বিশ্বস্ততা’।
৮. ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ বলেন, الخيانة (খিয়ানত)-এর বিপরীত শব্দ হ’ল الأمانة (আমানত)। যার বর্ণনা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করে বলেন, إِنَّا عَرَضْنَا الْأَمَانَةَ عَلَى السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ... (আহযাব ৩৩/৭২)। আয়াতটি উল্লেখ করার পর তিনি বলেন, وللعلماء عدة أقوال فى معناها وهى ترجع إلى قسمين ‘আমানতের অর্থের ব্যাপারে বিদ্বানগণের কয়েকটি মতামত রয়েছে। আর তা দু’ভাগে বিভক্ত।
(১) তাওহীদ (التوحيد) : এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, فإنه أمانة عند العبد وخفى فى القلب ‘আর তা (আল্লাহর একত্বের বিষয়টি) বান্দার নিকট আমানত এবং হৃদয়ে অন্তর্নিহিত বা লুক্কায়িত’।
(২) আমল (العمل) বা
কর্ম : এ বিষয়ে ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ويدخل فى جميع أنواع الشريعة،
وكلها أمانة عند العبد ‘এতে শরী‘আতের সমস্ত বিষয়াদি শামিল করে এবং তার
সবগুলিই বান্দার নিকট আমানত’। এরপর তিনি বলেন,فالأمانة هى التكليف، وقبول
الأوامر، واجتناب النواهى، ‘অতঃপর আমানত হ’ল অর্পিত দায়িত্ব, নির্দেশ সমূহ
মেনে নেয়া এবং নিষিদ্ধ বিষয়াবলী থেকে দূরে থাকা’।[5]
ইবনু
কাছীর (রহঃ) ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহর মতামত ব্যতীত অন্য সকলের মতামত তুলে
ধরার পর বলেন, আসলে উপরোক্ত মতামতের বিষয়ে কোন অসঙ্গতি নেই। সব মতামতে এটাই
বুঝানো হয়েছে যে, আমানত হ’ল এমন একটি দায়িত্ব, যে ব্যক্তি তা পালন করবে
তার জন্য আছে পুরস্কার; আর যে ব্যক্তি তা মানবে না তার জন্য রয়েছে কঠোর
শাস্তি। অতঃপর শারীরিকভাবে দুর্বল, অজ্ঞ ও ন্যায়পরায়ণ না হওয়া সত্ত্বেও
মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে আমানতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। কিন্তু আল্লাহ যাকে
তাওফীক দেন তার জন্য এটা সহজ হয়ে যায়। আমরা আল্লাহর নিকট আমানতের হক
পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছি।[6]
আমানত রক্ষা করার ক্ষেত্রে মানুষের শ্রেণী বিভাগ :
আধুনিক সুফাসসির আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী (১৩০৭-৭৬ হিঃ) বলেন, আমানত রক্ষার ক্ষেত্রে মানুষ তিন প্রকার। যথা-
(১) منافقون বা মুনাফিকরা। এদের বৈশিষ্ট্য হ’ল, قاموا بها ظاهرا لا باطنا ‘তারা বাহ্যিকভাবে আমানত সম্পাদন করে, আন্তরিকভাবে নয়’। অর্থাৎ ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি কর্মগুলি দুনিয়ার স্বার্থে করে থাকে, আখেরাতের স্বার্থে নয়।
(২) مشركون বা মুশরিকরা। তাদের অবস্থা হ’ল تركوها ظاهرا وباطنا ‘তারা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে তা বর্জন করে। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নবুঅত লাভের পর তা প্রচার করতে গেলে মূলতঃ মুশরিকদের সাথে সর্বপ্রথম দ্বন্দ্ব ও সংঘাত লেগে যায়। তারা প্রকাশ্যভাবে ইসলামের বিরোধিতা করতে থাকে। ফলে তাদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু মুনাফিকরা বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করলেও অন্তরে কপটতা পোষণ করে বলে তাদেরকে সহজে চেনা যায় না। বস্ত্ততঃ তাদের দ্বারাই দেশ, জাতি ও ধর্মের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
(৩)
مؤمنون বা মুমিনগণ। তাদের বৈশিষ্ট্য হ’ল, قائمون بها ظاهرا وباطنا ‘তারা
প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে আমানত সম্পাদন করে থাকে’। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা
উল্লিখিত তিন শ্রেণীর লোকদের আমলের প্রতিদান ও শাস্তি প্রদান প্রসঙ্গে
বলেন, لِيُعَذِّبَ اللهُ الْمُنَافِقِيْنَ وَالْمُنَافِقَاتِ
وَالْمُشْرِكِيْنَ وَالْمُشْرِكَاتِ وَيَتُوْبَ اللهُ عَلَى
الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَكَانَ اللهُ غَفُوْرًا رَحِيْمًا-
‘পরিণামে আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক
নারীকে শাস্তি দিবেন। আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ
ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আহযাব ৩৩/৭৩)।[7]
রাসূলগণের উপর আরোপিত আমানতের হাল-চিত্র :
আল্লাহ তা‘আলা পথভ্রষ্ট মানুষদেরকে দ্বীনের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য নবী ও রাসূলগণকে প্রেরণ করেছিলেন। তাঁদের দাওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মানুষের গোলামীর শিকল ছিন্ন করে এক আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা। সমাজপতি ও কথিত ধর্ম নেতাদের বাধা-বিপত্তি, নির্যাতন ও অনেকের স্বদেশ থেকে বিতাড়ন, এমনকি বহুসংখ্যক নবীদের হত্যা সত্ত্বেও তাঁরা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তথা দ্বীনের প্রচার-প্রসার থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। তাঁদের সমাজ সংস্কারের কৌশল, ধৈর্য ও ত্যাগ ইতিহাসে জীবন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তাঁদের উপর আরোপিত দায়িত্ব যে তাঁরা সঠিকভাবে পালন করেছিলেন, তা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন সূরায় বর্ণনা করেছেন। আমরা কেবল তাঁদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত ঘটনা এখানে পেশ করছি।
১. নূহ (আঃ) :
আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-কে সাড়ে নয়শত বছরের দীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় স্বীয় কওমের নিকটে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। তিনি দ্বীন প্রচারের আমানতকে যথার্থভাবে পালন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ نُوحٌ أَلَا تَتَّقُوْنَ، إِنِّيْ لَكُمْ رَسُولٌ أَمِيْنٌ، فَاتَّقُوا اللهَ وَأَطِيْعُوْنِ، وَمَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، فَاتَّقُوا اللهَ وَأَطِيْعُوْنِ-
‘যখন তাদের ভ্রাতা (নূহ) তাদের বলল, তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি তো তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত (আমানতদার) রাসূল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর ও আমার আনুগত্য কর’ (শু‘আরা ২৬/১০৬-১১০)।
আল্লাহ তা‘আলা নূহ (আঃ)-এর দাওয়াত প্রসঙ্গে আরো বলেন,
إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ أَنْ أَنْذِرْ قَوْمَكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ، قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّيْ لَكُمْ نَذِيْرٌ مُبِيْنٌ، أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاتَّقُوْهُ وَأَطِيْعُوْنِ، يَغْفِرْ لَكُمْ مِنْ ذُنُوْبِكُمْ وَيُؤَخِّرْكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى إِنَّ أَجَلَ اللهِ إِذَا جَاءَ لَا يُؤَخَّرُ لَوْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ-
‘আমরা নূহকে তার কওমের নিকটে প্রেরণ করলাম তাদের উপরে মর্মান্তিক আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বেই সতর্ক করার জন্য। নূহ তাদেরকে বললেন, হে আমার জাতি! আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী। এ বিষয়ে যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহর নির্ধারিত সময় যখন এসে যাবে, তখন তা পিছানো হবে না। যদি তোমরা তা জানতে’ (নূহ ৭১/১-৪)।
নূহ (আঃ) তাঁর কওমকে মূর্তিপূজার অসারতা ব্যাখ্যা করেন এবং বান্দার উপর আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য অনুগ্রহ ও অগণিত নে‘মতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দাওয়াত দিতে থাকেন। তিনি বলেন,
أَلَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللهُ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا، وَجَعَلَ الْقَمَرَ فِيْهِنَّ نُوْرًا وَجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا، وَاللهُ أَنْبَتَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ نَبَاتًا، ثُمَّ يُعِيْدُكُمْ فِيْهَا وَيُخْرِجُكُمْ إِخْرَاجًا، وَاللهُ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ بِسَاطًا، لِتَسْلُكُوْا مِنْهَا سُبُلًا فِجَاجًا-
‘তোমরা কি লক্ষ্য কর না, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। সেখানে তিনি চন্দ্রকে রেখেছেন আলো রূপে এবং সূর্যকে রেখেছেন প্রদীপ রূপে। আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি থেকে উদগত করেছেন। অতঃপর তাতে ফিরিয়ে নিবেন এবং আবার পুনরুত্থিত করবেন। আল্লাহ তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা সদৃশ। যাতে তোমরা চলাফেরা করতে পার প্রশস্ত রাস্তাসমূহে’ (নূহ ৭১/১৫-২০)।
নূহ (আঃ) তাঁর জাতিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী দাওয়াত দেওয়ার পরেও হাতেগণা কিছু লোক ব্যতীত গোটা জাতি তার দাওয়াত অস্বীকার করলে তিনি তাদের জন্য বদদো‘আ করে বললেন,رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِيْنَ دَيَّارًا، إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا- ‘হে প্রভু! পৃথিবীতে একজন কাফের গৃহবাসীকেও তুমি ছেড়ে দিয়ো না। যদি তুমি ওদের রেহাই দাও, তাহ’লে ওরা তোমার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করবে এবং ওরা পাপাচারী ও কাফের ব্যতীত কোন সন্তান জন্ম দিবে না’ (নূহ ৭১/২৬-২৭)।
তাঁর জাতির পাপাচার এবং দাওয়াত কবুল না করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে প্লাবনে ধ্বংস করেছিলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,مِمَّا خَطِيئَاتِهِمْ أُغْرِقُوْا فَأُدْخِلُوْا نَارًا فَلَمْ يَجِدُوْا لَهُمْ مِنْ دُوْنِ اللهِ أَنْصَارًا- ‘তাদের গোনাহসমূহের কারণে তাদেরকে নিমজ্জিত করা হয়েছিল। অতঃপর তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হয়েছে। কিন্তু তারা নিজেদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সাহায্যকারী পায়নি’ (নূহ ৭১/২৫)।
২. হূদ (আঃ) :
তাঁর দাওয়াত ও আমানতদারী প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُوْدًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُوْنَ، قَالَ الْمَلَأُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِيْ سَفَاهَةٍ وَإِنَّا لَنَظُنُّكَ مِنَ الْكَاذِبِيْنَ، قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِيْ سَفَاهَةٌ وَلَكِنِّيْ رَسُوْلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِيْن، أُبَلِّغُكُمْ رِسَالَاتِ رَبِّيْ وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِيْنٌ-
‘আর আদ জাতির নিকট (পাঠানো হয়েছিল) তাদের ভাই হূদকে। সে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন মা‘বূদ নেই। তোমরা কি (এখনো) সাবধান হবে না? তখন তার জাতির কাফের লোকদের নেতারা বলল, আমরা তোমাকে নির্বোধ দেখছি এবং আমরা তো তোমাকে নিশ্চিতরূপে মিথ্যাবাদী ধারণা করছি। সে (হূদ) বলল, হে আমার জাতি! আমি নির্বোধ নই; বরং আমি হ’লাম সারা জাহানের প্রতিপালকের মনোনীত রাসূল। আমি আমার প্রতিপালকের পয়গাম তোমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি। আর আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত (আমানতদার) হিতাকাঙ্খী’ (আ‘রাফ ৭/৬৫-৬৮)।
হূদ (আঃ)-এর জাতির নেতাদের হঠকারিতা, বিলাসিতা ও তাদের নবীর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করার ফলে তাদের উপর আল্লাহর গযব ও অভিশাপ নেমে আসে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা আদ জাতিকে ধ্বংস করে দেন’ (শু‘আরা ২৮/১২৮-১৩৯)।
এমনিভাবে ছালেহ, লূত ও শু‘আয়েব (আঃ) প্রত্যেকে ছিলেন আমানতদার। আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভাষায় বলেন, إِنِّيْ لَكُمْ رَسُوْلٌ أَمِيْنٌ ‘আমি তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসূল’ (শু‘আরা ২৬/২৬, ১২৫, ১৪৩, ১৬১, ১৭৮; দুখান ৪৪/১৮)।
৩. জিব্রাঈল (আঃ) :
জিব্রাঈল (আঃ) আল্লাহর অহী সঠিকভাবে রাসূলগণের নিকটে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে ছিলেন আমানতদার। তিনি তাঁর দায়িত্ব যথার্থভাবে পালন করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্পর্কে বলেন,وَإِنَّهُ لَتَنْزِيْلُ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، نَزَلَ بِهِ الرُّوْحُ الْأَمِيْنُ، عَلَى قَلْبِكَ لِتَكُوْنَ مِنَ الْمُنْذِرِيْنَ ‘নিশ্চয়ই ওটা (আল-কুরআন) জগৎসমূহের প্রতিপালক হ’তে অবতারিত। জিবরীল ওটা নিয়ে অবতরণ করে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারী হ’তে পার’ (শু‘আরা ২৬/১৯২-৯৪)।
৪. মুহাম্মাদ (ছাঃ) :
রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) তাঁর জাতির কাছে নবুঅত লাভের পূর্ব থেকেই বিশ্বস্ত ও আমানতদার
হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মানুষ তাঁর নিকট পার্থিব সম্পদ গচ্ছিত রাখত। অতঃপর
যথাসময়ে তিনি প্রকৃত হকদারের নিকট তা বুঝিয়ে দিতেন। এসব ছিল নবুঅত
প্রাপ্তির পূর্বের ঘটনা। অতঃপর তাঁর উপর অর্পিত আমানত তথা দ্বীনের
প্রচার-প্রসার প্রসঙ্গে বিদায় হজ্জের সময় উপস্থিত ছাহাবীগণের উদ্দেশ্যে
আল্লাহ তা‘আলাকে সাক্ষি রেখে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেক, আমার উপর
অর্পিত আমানত আমি পৌঁছে দিয়েছি’।[8]
আব্দুল্লাহ
ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আবু সুফিয়ান (রাঃ) আমাকে খবর
দিয়েছেন যে, হিরাক্লিয়াস তাকে বলেছিলেন, سَأَلْتُكَ مَاذَا يَأْمُرُكُمْ
فَزَعَمْتَ أَنَّهُ أَمَرَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَالصِّدْقِ وَالْعَفَافِ
وَالْوَفَاءِ بِالْعَهْدِ وَأَدَاءِ الأَمَانَةِ. قَالَ وَهَذِهِ صِفَةُ
نَبِىٍّ ‘তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি (নবী ছাঃ) তোমাদের কী কী আদেশ
করেন? তুমি বললে যে, তিনি তোমাদেরকে ছালাতের, সত্যবাদিতার, পবিত্রতার,
ওয়াদা পূরণের ও আমানত রক্ষার আদেশ দেন। হিরাক্লিয়াস বললেন, এটাই একজন নবীর
বৈশিষ্ট্য’।[9]
[চলবে]
[1]. বুখারী হা/৪৮০১; মুসলিম হা/২০৮; আহমাদ হা/২৮০২; তাফসীর ইবনে কাছীর (কুয়েত : এহয়াউত তুরাছ আল-ইসলামী), সূরা শু‘আরা ২১৪ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[2]. তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা আহযাব ৭২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[3]. কাফাবী, কিতাবুল কুল্লিয়াত, পৃঃ ১৭৬।
[4]. তাফসীর ইবনে কাছীর, সূরা আহযাব ৭২-৭৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[5]. ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ, আশরাতুস সা‘আহ (সঊদী আরব : দারু ইবনুল জাওযী, ১৬তম সংস্করণ, মুহাররম ১৪২৩ হিঃ), পৃঃ ১২৮।
[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৩/৬৮৯ পৃঃ সূরা আহযাব ৭২-৭৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[7]. আব্দুর রহমান বিন নাছের আস-সা‘দী, তায়সীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরিল কালামিল মান্নান (বৈরূত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৬ হিঃ/১৯৯৬ খ্রিঃ), পৃঃ ৬২০।
[8]. আর-রাহীকুল মাখতূম (কুয়েত : ইহয়াউত তুরাছ আল-ইসলামী), পৃঃ ৪৬২।
[9]. বুখারী হা/২৬৮১।