দো‘আ একটি ইবাদত। আর যে কোন ইবাদতের জন্য শরঈ দলীল অপরিহার্য। দলীল না থাকলে ইবাদত হিসাবে প্রচলিত কোন আমল বিদ‘আতে পরিণত হয়, যা চুড়ান্তভাবে বর্জনীয়। বিদ‘আত এমন এক মারাত্মক ব্যাধি যার কারণে ঈমানদারদের সৎ আমলসমূহ বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঈমান আনার পরও জাহান্নামে যেতে হয়। বিদ‘আতের কারণে তওবার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, সুন্নাত উঠে যায় এবং শয়তান অত্যন্ত খুশি হয়। বিদ‘আতকারী হাউযে কাওছারের পানি পান থেকে বঞ্চিত হবে। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম বিদ‘আতের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক ও কঠোর ছিলেন। সুতরাং ইবাদত করতে গিয়ে তা যেন বিদ‘আতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদেরকে ব্যর্থ করে না দেয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সম্প্রতি দলবদ্ধ মুনাজাত নিয়ে একটি বিতর্ক আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং কেউ কেউ মত পেশ করেছেন, এটি একটি ইজতিহাদী আমল, যাকে খেলাফে সুন্নাত বলা গেলেও বিদ‘আত বলা যায় না। অতএব যদি কারো দৃষ্টিতে এটি জায়েয হয়, তবে তা করতে পারে। এ ব্যাপারে আপত্তি তোলা যাবে না। বিষয়টি কি আসলেই তাই? নিম্নে এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হ’ল।
মুনাজাতের পরিচয় :
‘মুনাজাত’ (مُنَاجَاةٌ) আরবী শব্দ। এর অর্থ : পরস্পর কানে কানে কথা বলা। শরী‘আতের পরিভাষায় মুনাজাত হ’ল, ছালাতের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুছল্লীর চুপি চুপি কথা বলা। বুখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে উক্ত অর্থেই মুনাজাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ أَحَدَكُمْ إَذاَ قَامَ فِىْ صَلاَتِهِ فَإِنَّهُ يُنَاجِىْ رَبَّهُ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কেউ যখন ছালাতে দাঁড়ায় তখন সে তার রবের সাথে মুনাজাত করে’।[1] অন্য হাদীছে এসেছে,إِنَّ الْمُؤْمِنَ إذاَ كَانَ فِىْ الصَّلَاةِ فَإِنَّهُ يُنَاجِىْ رَبَّهُ. ‘নিশ্চয়ই মুমিন যখন ছালাতের মধ্যে থাকে তখন সে তার রবের সাথে মুনাজাত করে’।[2] আরেক হাদীছে এসেছে, إِنَّ الْمُصَلِّىْ يُنَاجِىْ رَبَّهُ ‘মুছল্লী ছালাতে তার রবের সাথে মুনাজাত করে’।[3] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إِلى الصَّلَاةِ فَلَا يَبْصُقْ أَمَامَهُ فَإنَّمَا يُنَاجِىْ اللهَ مَادَامَ فِىْ مُصَلَّاهُ. ‘যখন তোমাদের কেউ ছালাতে দাঁড়াবে তখন সে যেন তার সামনে থুথু না ফেলে। কারণ সে যতক্ষণ মুছল্লাতে ছালাত রত থাকে ততক্ষণ আল্লাহর সাথে মুনাজাত করে’।[4] অতএব মুনাজাত বা আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে প্রার্থনা করার সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হ’ল ছালাত (বাক্বারাহ ২/৪৫)। ছালাতের সালাম ফিরানোর পর মুনাজাতের অস্তিত্ব শরী‘আতে নেই। উপরোক্ত ছহীহ হাদীছ দ্বারা তা-ই প্রমাণিত হয়।
ইজতিহাদের পরিচয় : ইজতিহাদ হ’ল সত্য অন্বেষণে শ্রম ব্যয় করা। আর পরিভাষায়, শরী‘আতের বিধান জানার জন্য শ্রম ব্যয় করা।[5]
ইজতিহাদী মাসআলার পরিচয় : ইজতিহাদী মাসআলা হ’ল এমন বিষয় যে বিষয়ে কুরআন, হাদীছ বা ইজমায় কোন দলীল নেই বা পরস্পর বিপরীতধর্মী দলীল রয়েছে কিংবা যঈফ দলীল রয়েছে যার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে ইখতিলাফ রয়েছে।[6]
কোন কোন মুহাদ্দিছ বলেন, ইজতিহাদী মাসআলা হ’ল المسائل الاجتهادية التي لا نص فيها، أو فيها نصوص متعارضة، أو فيها مجال سائغ للنظر، ‘ইজতিহাদী মাসআলা এমন বিষয় যে বিষয়ে কোন দলীল নেই বা পরস্পর বিরোধী দলীল রয়েছে বা যাতে গবেষণার সুযোগ রয়েছে’।[7] শায়খ বিন বায (রহ.) বলেন,المسائل الاجتهادية التي لا نص فيها يوضح الحكم الشرعي، ‘ইজতিহাদী মাসআলা হ’ল যে বিষয়ে এমন কোন দলীল নেই যা শরী‘আতের বিধানকে স্পষ্ট করে’।[8] মোটকথা, ইজতিহাদী মাসআলা হচ্ছে যে বিষয়ে স্পষ্ট দলীল নেই বা দলীল থাকলেও তা পরস্পর বিরোধী কিংবা এমন দলীল রয়েছে যাতে দুই ধরনের ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে।
ইজতিহাদের বৈধতা : রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম ইজতিহাদ করেছেন। মি‘রাজের সময় রাসূল (ছাঃ)-কে শরাব ও দুধের পেয়ালা পান করতে দেওয়া হয়েছিল। তিনি ইজতিহাদ করে দুধের পেয়ালা গ্রহণ করে তা থেকে পান করেন এবং শরাবের পেয়ালা বর্জন করেন। জিব্রাঈল (আঃ) বলেছিলেন, আপনি মদের পেয়ালা গ্রহণ করলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত’।[9] ছাহাবায়ে কেরামও বিভিন্ন মাসআলায় ইজতিহাদ করেছেন। কিন্তু তারা তখনই ইজতিহাদ করেছেন যখন কুরআন বা হাদীছে সমাধান পাননি। এ বিষয়ে শরী‘আতে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
عَنْ شُرَيْحٍ، أَنَّهُ كَتَبَ إِلَى عُمَرَ يَسْأَلُهُ، فَكَتَبَ إِلَيْهِ، أَنْ اقْضِ بِمَا فِي كِتَابِ اللهِ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللهِ فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللهِ، وَلَا فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَاقْضِ بِمَا قَضَى بِهِ الصَّالِحُونَ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللهِ، وَلَا فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَلَمْ يَقْضِ بِهِ الصَّالِحُونَ، فَإِنْ شِئْتَ فَتَقَدَّمْ، وَإِنْ شِئْتَ فَتَأَخَّرْ، وَلَا أَرَى التَّأَخُّرَ إِلَّا خَيْرًا لَكَ، وَالسَّلَامُ عَلَيْكُمْ-
শুরাইহ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি ওমর (রাঃ)-এর নিকট প্রশ্ন লিখলেন। জবাবে ওমর (রাঃ) তাঁকে লিখেন, তুমি আল্লাহর কিতাবে রয়েছে তা দ্বারা মীমাংসা কর। যদি আল্লাহর কিতাবে তা না থাকে, তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত দ্বারা। আর যদি ঐ বিষয়টি আল্লাহর কিতাব এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাতে পাওয়া না যায়, তবে নেক্কারগণ যে মীমাংসা করেছেন, তা দ্বারা মীমাংসা কর। আর যদি তা আল্লাহর কিতাবে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতে না থাকে এবং নেক্কার লোকেরাও এমন কোন মীমাংসা না দিয়ে থাকেন, তাহ’লে তোমার ইচ্ছা হ’লে সামনে অগ্রসর হবে, আর ইচ্ছা হ’লে স্থগিত রাখবে। আমার মতে, তোমার স্থগিত রাখাই উত্তম। তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হৌক।[10] আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়।[11] ছাহাবী মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বিচারক হিসাবে গমনকালে রাসূল (ছাঃ) অনুরূপ নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যার সনদ যঈফ হ’লেও মর্ম ছহীহ।[12]
ইজতিহাদের উদাহরণ :
আলকামা ও আসওয়াদ (রহ.) হ’তে বর্ণিত, তারা বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ)-এর নিকট এ মর্মে একটা মামলা উত্থাপিত হ’ল যে, এক ব্যক্তি জনৈক রমণীকে বিবাহ করেছে, অথচ সে তার কোন মোহর ধার্য করেনি। আর সে ব্যক্তি সহবাস করার পূর্বেই মারা গেছে। আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেন, রাসূলের মৃত্যুর পরে এমন জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি। তিনি বললেন, তোমরা অন্যের কাছে যাও। তারা এক মাস ধরে ফৎওয়া খুঁজে না পেয়ে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-কে বলল, এই ভূমিতে আমরা সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ এর সমাধান দিতে পারেনি। অতএব আপনি সমাধান দিন। তিনি বললেন, আমি আমার ইজতিহাদ অনুযায়ী বলছি, যদি তা সঠিক হয়, তবে তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে। আর যদি ভুল হয়, তবে তা শয়তানের পক্ষ থেকে। আর তার মোহর হ’ল তার মত রমণীদের মোহরের ন্যায়। তা হ’তে বেশীও হবে না এবং কমও হবে না। সে মীরাছ পাবে এবং তার ইদ্দত পালন করতে হবে। আশজা গোত্রের এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের এক মহিলার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমনই ফায়ছালা দেন, যার নাম ছিল বিরওয়া বিনতু ওয়াশিক। সে এক পুরুষকে বিবাহ করেছিল এবং সহবাসের পূর্বেই তার স্বামী মৃত্যুবরণ করে। তার জন্যও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার মত মহিলার মোহরের ন্যায় মোহর নির্ধারণ করেন। আর তার জন্য মীরাছ এবং ইদ্দত পালনও ধার্য করেন। একথা শুনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হস্তদ্বয় উত্তোলন করে তাকবীর দিলেন অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বললেন।[13]
ইজতিহাদী মাসআলার হুকুম : ইজতিহাদী মাসআলা পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না এবং তা পালন করতে কাউকে চাপও দেওয়া যাবে না। বরং ইলমী দলীল নিয়ে আলোচনা করবে। যখন এটি ছহীহ প্রমাণিত হবে তখন তার অনুসরণ করবে।[14]
ছালাত বা মজলিস শেষে সম্মিলিত মুনাজাত কি ইজতিহাদী মাসআলা?
এটি ইজতিহাদী মাসআলা নয়। কারণ ছালাতান্তে সালাম ফিরিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর ইবাদতগুলো সুস্পষ্টভাবে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। কুতুবুস সিত্তাহসহ হাদীছের সকল কিতাবে ইমামগণ সালাম ফিরানোর পর করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট অধ্যায় রচনা করেছেন। আল্লাহতা‘আলা বলেন, فإذَا قَضَيْتُمُ الصلَاةَ فَاذْكُرُوا اللهَ قِيَامًا وَقُعُوْدًا وَّعلَى جُنُوْبِكُمْ، ‘যখন তোমরা ছালাত শেষ করবে তখন আল্লাহর যিকির করো, দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে’ (নিসা ৪/১০৭)। বুখারী, মুসলিম, শারহুস সুন্নাহ, মুসনাদুশ শাফেঈ এবং মিশকাতে শিরোনাম করা হয়েছে ‘ছালাতের পর যিকির’ (الذكر بعد الصلاة) মর্মে। ইমাম নাসাঈ ও বায়হাক্বী (রহঃ) সালামের পর যিকির (الذِّكْرُ بَعْدَ التَّسْلِيمِ), ইস্তিগফার, তাসবীহ, তাহলীল, তাকবীর, তা‘আববুয উল্লেখ করেছেন। ইমাম নাসাঈ দুই স্থানে যিকিরের পর দো‘আ ও ইবনু খুযায়মা ‘সালামের পর দো‘আসমূহ’ পাঠের কথাও উল্লেখ করেছেন। তবে সম্মিলিত দো‘আ বা মুনাজাত নয়।
ইমাম আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ ‘সালামের পর মুছল্লী কী বলবে’(باب ما يقول الرجل إذا سلم) মর্মে অধ্যায় রচনা করেছেন। অতএব সুন্নাহ যেখানে স্পষ্ট বিদ‘আত সেখানে দূরীভূত। এজন্য ইবনু মাসঊদ ও আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, اقتصادٌ في سُنَّةٍ؛ خيرٌ من اجتهادٍ في بدعةٍ ‘সুন্নাতের উপর আমলের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা বিদ‘আতী বিষয়ে ইজতিহাদ করা অপেক্ষা উত্তম’।[15] হাসসান ইবনু আতিয়্যাহ (রহ.) বলেন,مَا ابْتَدَعَ قَوْمٌ بِدْعَةً إِلَّا نَزَعَ اللهُ مِنْ سُنَّتِهِمْ مِثْلَهَا لَا يُعِيدُهَا عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘কোন জাতি যখন দ্বীনের মধ্যে কোন বিদ‘আত সৃষ্টি করে, তখনই আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্য থেকে সে পরিমাণ সুন্নাত উঠিয়ে নেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ সুন্নাত আর তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না’।[16] ভারতীয় উপমহাদেশে এবং কিছু অনারব দেশে এই প্রথা চালু হওয়ার পিছনে বড় কারণ ছিল হাদীছকে সঠিকভাবে না বুঝা, জনগণ বা নিজ ভাষায় প্রশংসা করে আমীর বা নেতাদের খুশি করা এবং হাদীছের ছহীহ-যঈফের জ্ঞান না থাকা। বিশেষ করে কিছু জাল হাদীছের প্রচার-প্রসারের কারণে এবং সুন্নায় বর্ণিত আমলসমূহকে উঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই বিদ‘আতী প্রথা চালু করা হয়েছে।
প্রচলিত সম্মিলিত দো‘আ প্রসঙ্গে সর্বজনস্বীকৃত প্রাচীন ও সমকালীন বিদ্বানদের অভিমত :
ফরয ছালাতের পরে ইমাম-মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দু’হাত তুলে দো‘আ করার প্রচলিত নিয়মটি যে কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তা উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এক্ষণে এ বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামের মন্তব্য নিম্নে তুলে ধরা হ’ল-
ক. ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ)-এরঅভিমত:
ইমাম মালেকের অবস্থান সম্পর্কে ইমাম কারাফী (রহ.) বলেন,كَرِهَ مَالِكٌ وَجَمَاعَةٌ مِنْ الْعُلَمَاءِ لِأَئِمَّةِ الْمَسَاجِدِ وَالْجَمَاعَاتِ الدُّعَاءَ عَقِبَ الصَّلَوَاتِ الْمَكْتُوبَةِ جَهْرًا لِلْحَاضِرِينَ، ‘ইমাম মালেক (রহ.) ও একদল বিদ্বান মুছল্লীদের উপস্থিতিতে ফরয ছালাতের পরে স্বরবে মসজিদ ও জামা‘আতের ইমামদের পক্ষ থেকে দো‘আ করাকে অপসন্দ করতেন’।[17] আর তাদের অপসন্দ করাটা হারামের মতই ছিল।
ইবনু রুশদ বলেন, ইমাম মালেককে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে ছালাত শেষে দাঁড়িয়ে দো‘আ করে। তিনি বললেন, এটি সঠিক নয় এবং এরূপ করা কারো জন্য পসন্দ করি না। তাকে কুরআন খতমের পরে দো‘আ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, আমি মনে করি এ সময় দো‘আ করার বিধান নেই এবং এব্যাপারে পূর্বের লোকদের আমল আমার জানা নেই। তাকে আরো জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, কোন ইমাম এবং মুছল্লীরা সমবেত হ’ল এবং দো‘আ করার নির্দেশ দিল, আমি কি তাদের সাথে অবস্থান করব? তিনি বললেন, না। আর আমি এটা পসন্দ করি না যে এজন্য এটা করা হবে এবং এভাবে দো‘আ করা হবে’।[18]
ইয্যুদ্দীন বিন আব্দুস সালামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) সালামের পরে শরী‘আতে বর্ণিত যিকিরসমূহ পাঠ করতেন। তারপর তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ পাঠ করে মুছল্লীদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। ...মনে রাখা আবশ্যক যে, রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের মধ্যেই সকল কল্যাণ নিহিত।[19]
ইমাম শাতেবী (রহ.) প্রচলিত সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদ‘আত প্রমাণ করেছেন এবং এব্যাপারে বহু মালেকী বিদ্বানগণের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন,أَنَّ الدُّعَاءَ بِهَيْئَةِ الِاجْتِمَاعِ دَائِمًا لَمْ يَكُنْ مِنْ فِعْلِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؛ كَمَا لَمْ يَكُنْ مِنْ قَوْلِهِ وَلَا إِقْرَارِهِ. ‘নিয়মিতভাবে সম্মিলিত দো‘আ রাসূল (ছাঃ)-এর কর্ম ছিল না। এমনকি তাঁর বাণী এবং সমর্থনও ছিল না’।[20]
খ. ইমাম শাফেঈ (রহ.)-এর অভিমত : ইমাম শাফেঈ (রহ.) তার সংকলিত হাদীছ গ্রন্থে ‘ছালাতান্তে যিকির পাঠ সম্পর্কে অধ্যায়’ (بَابٌ: فِي الذِّكْرِ بَعْدَ الصَّلاةِ) রচনা করেছেন। এতে তিনি তাকবীর, তাহলীল, তাহমীদ পাঠের হাদীছগুলো বর্ণনা করেছেন। যা প্রমাণ করে যে, তৎকালীন এই বিদ‘আতী মুনাজাতের কোন অস্তিত্বকে তারা স্বীকৃতি দেননি।[21]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহ.) বলেন,و أما الاجةماع له، كما في الاسةسقاء، فبدعة ‘ইস্তিস্কার ছালাত ব্যতীত যেকোন বিপদে দো‘আর জন্য সমবেত হওয়া বিদ‘আত’।[22] অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম যে সকল স্থানে দো‘আর জন্য সমবেত হননি সে সকল স্থানে সমবেত হওয়া বিদ‘আত।
গ. ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর অভিমত : ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহ.) দো‘আর জন্য সমবেত হওয়াকে বিদ‘আত মনে করতেন। ফযল ইবনু মেহরান বললেন, আমাদের এলাকায় কিছু লোক সমবেত হয়ে দো‘আ করে, কুরআন তেলাওয়াত করে এবং আল্লাহর যিকির করে। আপনি এদের ব্যাপারে কি বলবেন? তিনি বললেন, তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে এবং মনে মনে আল্লাহর যিকির করবে...। আমি বললাম, আমি কি তাদেরকে এভাবে সম্মিলিত দো‘আ ও যিকির করতে নিষেধ করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, যদি গ্রহণ না করে? তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই গ্রহণ করবে। কারণ এটা বিদ‘আত। তুমি যেভাবে বর্ণনা দিলে সেভাবে সমবেত হওয়া বিদ‘আত। যদি তারা গ্রহণ না করে তাহ’লে আমি কি তাদেরকে বর্জন করব? তিনি তখন মুচকি হেসে চুপ থাকলেন। একই প্রশ্নের উত্তরে ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বললেন, হ্যাঁ তুমি তাদেরকে অবশ্যই বর্জন করবে’।[23]
ঘ.শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহ.)-এর অভিমত :
জগদ্বিখ্যাত মুজাদ্দিদ শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহ.)-এর কাছে প্রত্যেক ছালাতের পর করণীয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হ’লে তিনি ছালাতের পরের যিকির সংক্রান্ত অনেক দো‘আ উল্লেখ করেন। অতঃপর তিনি বলেন, وَأَمَّا دُعَاءُ الْإِمَامِ وَالْمَأْمُومِينَ جَمِيعًا عَقِيبَ الصَّلَاةِ فَلَمْ يَنْقُلْ هَذَا أَحَدٌ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘ছালাতের পরে ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দো‘আ করার বিষয়টি নবী করীম (ছাঃ) থেকে কেউই বর্ণনা করেননি’।[24] তিনি আরো বলেছেন,دُعَاءُ الْإِمَامِ وَالْمَأْمُومِينَ جَمِيعًا فَهَذَا الثَّانِي لَا رَيْبَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَفْعَلْهُ فِي أَعْقَابِ الْمَكْتُوبَاتِ كَمَا كَانَ يَفْعَلُ الْأَذْكَارَ الْمَأْثُورَةَ عَنْهُ إذْ لَوْ فَعَلَ ذَلِكَ لَنَقَلَهُ عَنْهُ أَصْحَابُهُ ثُمَّ التَّابِعُونَ ثُمَّ الْعُلَمَاءُ كَمَا نَقَلُوا مَا هُوَ دُونَ ذَلِكَ؛ ‘এতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ইমাম ও মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দো‘আর নিয়মে রাসূল (ছাঃ) ফরয ছালাত সমূহের পরে দো‘আ করেননি। যেমনটি তিনি অন্যান্য যিকিরসমূহ পাঠ করতেন। যদি তিনি এভাবে সম্মিলিত দো‘আ করতেন তাহ’লে তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করতেন। অতঃপর তাদের থেকে তাবেঈগণ এবং তাবেঈ গণের থেকে আলেমগণ অবশ্যই বর্ণনা করতেন। যেমনভাবে তারা (শরী‘আতের) অন্যান্য বিষয়গুলো বর্ণনা করেছেন’।[25]
অতঃপর ফরয ছালাতের পর সম্মিলিতভাবে দো‘আ করা জায়েয কি-না এ সম্পর্কে তিনি বলেন,أَمَّا دُعَاءُ الْإِمَامِ وَالْمَأْمُومِينَ جَمِيعًا عَقِيبَ الصَّلَاةِ فَهُوَ بِدْعَةٌ لَمْ يَكُنْ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَلْ إنَّمَا كَانَ دُعَاؤُهُ فِي صُلْبِ الصَّلَاةِ فَإِنَّ الْمُصَلِّيَ يُنَاجِي رَبَّهُ فَإِذَا دَعَا حَالَ مُنَاجَاتِهِ لَهُ كَانَ مُنَاسِبًا. وَأَمَّا الدُّعَاءُ بَعْدَ انْصِرَافِهِ مِنْ مُنَاجَاتِهِ وَخِطَابِهِ فَغَيْرُ مُنَاسِبٍ، ‘ছালাতের পরে ইমাম-মুক্তাদী সম্মিলিতভাবে দো‘আ করা বিদ‘আত। এটা রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না, বরং তাঁর দো‘আ ছিল ছালাতের ভিতরে। কেননা মুছল্লী ছালাতের ভিতরে তার প্রভুর সাথে মুনাজাত করে। সুতরাং যখন সে মুনাজাতের হালাতে তার জন্য দো‘আ করবে তখন সেটা ঐ ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত সময়। কিন্তু আল্লাহর সাথে মুনাজাত ও কথোপকথন থেকে সালাম ফিরিয়ে দো‘আ করা সঠিক নয়’।[26]
ঙ. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ.)-এর অভিমত :
প্রচলিত সম্মিলিত মুনাজাতের ব্যাপারে ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ.) তাঁর ‘যাদুল মা‘আদ’ গ্রন্থে বলেন,وَأَمَّا الدُّعَاءُ بَعْدَ السَّلَامِ مِنَ الصَّلَاةِ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ أَوِالْمَأْمُوْمِيْنَ فَلَمْ يَكُنْ ذلِكَ مِنْ هَدْيِهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أصْلًا وَلَا رُوِىَ عَنْهُ بِإِسْنَادٍ صَحِيْحٍ وَلَا حَسَنٍ. ‘ছালাতের সালাম ফিরানোর পর ক্বিবলার দিকে মুখ করে কিংবা মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে দো‘আ করা রাসূলুল্লাহ (ছা)-এর সুন্নাহর আদৌ অন্তর্ভুক্ত নয়। এই পদ্ধতি রাসূল (ছাঃ) থেকে ছহীহ বা হাসান কোন সনদে বর্ণিত হয়নি’।[27]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহ.) অন্যত্র বলেন,وَتَرْكِهِ الدُّعَاءَ بَعْدَ الصَّلَاةِ مُسْتَقْبِلَ الْمَأْمُومِينَ وَهُمْ يُؤَمِّنُونَ عَلَى دُعَائِهِ دَائِمًا بَعْدَ الصُّبْحِ وَالْعَصْرِ أَوْ فِي جَمِيعِ الصَّلَوَاتِ، ...وَمِنَ الْمُمْتَنِعِ أَنْ يَفْعَلَ ذَلِكَ وَلَا يَنْقُلُهُ عَنْهُ صَغِيرٌ وَلَا كَبِيرٌ وَلَا رَجُلٌ وَلَا امْرَأَةٌ أَلْبَتَّةَ، ‘রাসূল (ছাঃ) ছালাতের পরে মুক্তাদীদের দিকে মুখ করে দো‘আ করা এবং মুক্তাদীরা তার দো‘আয় ফজর ও আছর কিংবা সকল ছালাতের পরে সর্বদা আমীন আমীন বলা পরিত্যাগ করেন।... তিনি এভাবে সম্মিলিত দো‘আ করবেন আর তার থেকে এমন পদ্ধতি ছোট, বড়, পুরুষ ও মহিলা একজনও বর্ণনা করবেন না তা একেবারেই অসম্ভব’।[28]
চ. শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায(রহ.)-এর অভিমত :
শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহ.) বিদ‘আতের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। প্রচলিত সম্মিলিত মুনাজাতের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে বলেন, لم يصح عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه كان يرفع يديه بعد صلاة الفريضة ولم يصح ذلك أيضا عن أصحابه رضي الله عنهم فيما نعلم وما يفعله بعض الناس من رفع أيديهم بعد صلاة الفريضة بدعة لا أصل لها لقول النبي صلى الله عليه وسلم: من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد، ‘আমাদের জানা মতে, নবী করীম (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীগণ ফরয ছালাতান্তে হাত তুলে মুনাজাত করেছেন মর্মে কোন ছহীহ বর্ণনা নেই। ফরয ছালাতের পর কিছু লোক যে হাত তুলে সম্মিলিত দো‘আ করে তা বিদ‘আত। যার কোন ভিত্তি নেই। কারণ নবী করীম (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যে ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত’।[29]
তিনি অন্যত্র বলেন,لَمْ يَحْفَظْ عَنِ النَّبِىّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا عَنْ أصْحَابِهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ فِيْمَا نَعْلَمُ أَنَّهُمْ كَانُوْا يَرْفَعُوْنَ أَيْدِيَهُمْ بِالدُّعَاءِ بَعْدَ الصَّلَاةِ الْفَرِيْضَةِ وَبِذلِكَ يُعْلَمُ أَنَّهُ بِدْعَةٌ. ‘আমরা যা জানি তা হ’ল নবী করীম (ছাঃ) এবং ছাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত হয়নি যে, তারা ফরয ছালাতের পরে হাত তুলে দো‘আ করেছেন। এতে বুঝা যায় যে, এটা বিদ‘আত’।[30]
ছ. শায়খ উছায়মীন (রহ.)-এর অভিমত :
শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহ) ফরয ছালাতের পর মুছল্লীদের সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দো‘আ করা সম্পর্কে বলেন,أمَّا الدُّعَاءُ أدْبَارُ الصَّلَوَاتِ وَرَفْعُ الْيَدَيْنِ فِيْهِ فَإنْ كَانَ عَلَى وَجْهِ جِمَاعِىِّ بِحَيْثُ يَفْعَلُهُ الْإمَامُ وَيُوَمِّنُ عَلَيْهِ الْمَأْمُوْمُوْنَ فَهذَا بِدْعَةٌ بِلَا شَكٍّ. ‘ফরয ছালাতসমূহের পরে দো‘আ করা ও দু’হাত তোলা যদি সম্মিলিতভাবে হয় যেরূপ ইমাম দো‘আ করে আর তার দো‘আয় মুক্তাদীরা আমীন আমীন বলে তাহ’লে তা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত’।[31]
ছালাতের পর দো‘আ করা এবং দু’হাত তোলার হুকুম সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, لَيْسَ مِنَ الْمَشْرُوْعِ أنَّ الْإنْسَانَ إذَا أتَمَّ الصَّلَاةَ رَفَعَ يَدَيْهِ وَدَعَا، وإذَا كَانَ يُرِيْدُ الدُّعَاءَ فَإنَّ الدُّعَاءَ فِى الصَّلَاةِ أفْضَلُ مِنْ كَوْنِهِ يَدْعُوْ بَعْدَ أنْ يَّنْصَرِفَ مِنْهَا، وَلهِذَا أرْشَدَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إلىَ ذلِكَ فِىْ حَدِيْثِ اِبْنِ مَسْعُوْدٍ حِيْنَ ذَكَرَ التَّشَهُّدَ قَالَ: ثُمَّ لِيَتَخَيَّرْ مِنَ الْمَسْأَلَةِ مَا شَاءَ. ‘ছালাত শেষ করে লোকদের জন্য দু’হাত তোলা এবং দো‘আ করা শরী‘আতসম্মত নয়। যদি সে দো‘আ করতে চায় তাহ’লে সালাম ফিরানোর পর দো‘আ করার চেয়ে ছালাতের মধ্যে দো‘আ করাই উত্তম। এজন্য ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) এই দিকেই নির্দেশনা প্রদান করেছেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে তাশাহহুদ শিক্ষা দিয়ে বলেছিলেন, ‘অতঃপর তুমি (তাশাহহুদে) যা ইচছা তাই প্রার্থনা করবে’।[32] অন্যত্র সম্মিলিত দো‘আ সর্ম্পকে তিনি বলেন,حكمه أنه بدعة ‘এর বিধান হ’ল এটি বিদ‘আত’।[33]
জ. শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহ.)-এর অভিমত :
জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিছ আল্লামা শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) উক্ত পদ্ধতিতে দো‘আ করাকে বিদ‘আত সাব্যস্ত করেছেন এবং এর পক্ষে মুহাম্মাদ বিন মকবুল আহদাল রচিত রিসালার জওয়াব লিখে বলেন, مَا ذَهَبَ إِلَيْهِ مِنَ الْمَشْرُوْعِيَّةِ الرَّفْعِ الْمَذْكُوْرِ ... وَلَيْسَ فِيْهَا حَدِيْثٌ وَاحِدٌ ثَابِتٌ. ‘উল্লিখিত স্থানে (ফরয ছালাতের পর) হাত তোলার ব্যাপারে শরী‘আতে কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। ... এমনকি এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য একটি হাদীছও নেই’ (যঈফাহ ৩/৩১)। সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে তিনি বলেন,لا يوجد هناك أحاديث تدل على أن النبي صلى الله عليه وآله وسلم كان يدعو مثل هذا الدعاء الطويل العريض الذي يأتي به بعض أئمة المساجد، ‘এ মর্মে একটি হাদীছও পাওয়া যায় না যা প্রমাণ করে যে, নবী করীম (ছাঃ) এই রকম লম্বা ও দীর্ঘ দো‘আ করেছেন যেমনটি কিছু মসজিদের ইমামগণ করে থাকেন (আল-ফাতাওয়াল ইমারাতিয়া টেপ নং ০৮)। বক্তৃতা ও মাহফিলের পর সম্মিলিত দো‘আ সম্পর্কে তিনি বলেন, كل هذا يأتي من الجهل بالسنة، ونسأل الله أن يعلمنا ما ينفعنا، ‘সুন্না্হ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এগুলো চালু হয়েছে। আল্লাহর নিকট আমরা প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে উপকারী জ্ঞান দেন।[34]
ঝ. শায়খ ছালেহ আল-ফাওযানের অভিমত :
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মুজাদ্দিদ বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীন আলেমে দ্বীন ছালেহ আল-ফাওযান (হাফি.) সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদ‘আত বলেছেন। তিনি বলেন, أما الدعاء الجماعي بعد الصلاة فهو بدعة لأنه لم يرد عن النبي صلى الله عليه وسلم ولا عن صحابته ولا عن القرون المفضلة أنهم كانوا يدعون دعاءً جماعيًّا بأن يرفع الإمام يديه، ثم يرفعون أيديهم ويدعو، وهم يدعون معه، هذا من البدع. ‘ছালাতের পরে সম্মিলিত দো‘আ বিদ‘আত। কারণ নবী করীম (ছাঃ), তাঁর ছাহাবীগণ এবং শ্রেষ্ঠ যুগের কারো থেকে এমন বর্ণনা পাওয়া যায় না যে, ইমাম হাত উত্তোলন করেছেন এবং তার সাথে মুক্তাদীরাও হাত তুলেছেন এবং তারা একই সাথে সম্মিলিত দো‘আ করেছেন। এটা বিদ‘আতের অন্তর্গত’।[35]
ঞ. শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদের অভিমত :
সুনানু আবীদাউদের অন্যতম ব্যাখ্যাকার প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ শায়খ আব্দুল মুহসিন আল-আববাদ সম্মিলিত মুনাজাত সম্পর্কে বলেন, ورفع اليدين في الدعاء بعد الصلاة لم يثبت عن رسول الله صلى الله عليه وسلم؛ لأن النبي عليه الصلاة والسلام هو إمام الناس، وهو الذي كان يصلي بهم، ولم ينقل رفع اليدين بعد الصلاة من رسول الله صلى الله عليه وسلم وأصحابه رضي الله عنهم وأرضاهم، فدل هذا على أن ذلك لا يصلح؛ لأنه لم يفعل. ‘ছালাতের পর হাত তুলে দো‘আ করা রাসূল (ছাঃ) থেকে সাব্যস্ত হয়নি। কারণ নবী করীম (ছাঃ) লোকদের ইমাম ছিলেন। তিনি তাদের ছালাতে ইমামতি করতেন। অথচ রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর ছাহাবীগণ (রাঃ) থেকে ছালাতের পরে হাত তোলার বিষয়টি বর্ণিত হয়নি। এটি প্রমাণ করে যে, এভাবে সম্মিলিত দো‘আ সঠিক নয়। কেননা তিনি এমনটি করেননি’।[36]
ট. সউদী আরবের ফৎওয়া বোর্ড ‘ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা’র অভিমত :
সঊদী আরবের স্থায়ী ফৎওয়া র্বোড প্রচলিত দো‘আ সম্পর্কে বলেছে,هذا العمل عمل بدعي لا يجوز؛ لأن الدعاء الجماعي بعد الصلاة بدعة لا أصل لها في الشرع المطهر، ‘এটি বিদ‘আতী আমল, যা জায়েয নয়। কেননা ছালাতের পর সম্মিলিত দো‘আ বিদ‘আত। পবিত্র শরী‘আতে এর কোন ভিত্তি নেই’।[37]
অন্যত্র বলা হয়েছে,الدعاء الجماعي بعد الصلاة بدعة لا أصل له في الشرع، والمشروع الذكر، والدعاء بالوارد بعد السلام من كل مصل بمفرده. ‘ছালাতের পরে দলবদ্ধ দো‘আ বিদ‘আত, শরী‘আতে যার কোন ভিত্তি নেই। বরং শরী‘আতসম্মত হ’ল সালাম ফিরানোর পরে প্রত্যেক মুছল্লীর একাকী হাদীছে বর্ণিত দো‘আ ও যিকির পাঠ করা’।[38]
অন্যত্র আরো বলা হয়েছে,لَمْ يَثْبُتْ عَنِ النَّبِىّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْمَا نَعْلَمُ أنَّهُ رَفَعَ يَدَيْهِ بَعْدَ السَّلَامِ مِنَ الْفَرِيْضَةِ فِي الدُّعَاءِ، وَرَفَعَهُمَا بَعْدَ السَّلَامِ مِنَ صَلَاةِ الْفَرِيْضَةِ مُخَالِفٌ لِلسُّنَّةِ. ‘আমরা জানা মতে ফরয ছালাতের সালামের পরে হাত তুলে দো‘আ করা নবী করীম (ছাঃ) থেকে সাব্যস্ত হয়নি। তাই ফরয ছালাতের সালামের পরে দু’হাত তুলে দো‘আ করা সুন্নাত বিরোধী কাজ’।[39]
এছাড়াও উপমহাদেশের বড় বড় আহলেহাদীছ আলেম প্রচলিত সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদ‘আত বলেছেন।
ঠ. হানাফী মাযহাবের কতিপয় ওলামায়ে কেরামের অভিমত :
ছহীহ বুখারী ও তিরমিযীর ভাষ্যকার আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী।[40] উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী[41], আল্লামা ইউসুফ বিন্নূরী[42], আল্লামা রশীদ আহমাদ পাকিস্তানী[43], মুফতী ফয়যুল্লাহ হানাফী হাটহাজারী[44] প্রমুখ বিদ্বান এবং মাসিক আত-তাহরীক, সাপ্তাহিক আরাফাত, মাসিক পৃথিবী ইত্যাদি পত্রিকা সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদ‘আত বলেছেন।
উল্লেখ্য, উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা ‘দারুল উলূম দেওবন্দ এবং বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা হাটহাজারী চট্রগ্রাম সহ বহু হানাফী প্রতিষ্ঠান থেকে উক্ত প্রথা উঠে গেছে।
অন্যান্য প্রসঙ্গ :
ক. মাহফিল বা মজলিস শেষে সম্মিলিত মুনাজাত : কোন মজলিস বা দারস কিংবা বক্তব্য শেষে ইমাম বা শিক্ষক কর্তৃক দো‘আ পাঠ এবং উপস্থিত জনতা কর্তৃক আমীন সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
عَنْ ابْن عُمَرَ، قَالَ: قَلَّمَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُومُ مِنْ مَجْلِسٍ حَتَّى يَدْعُوَ بِهَؤُلَاءِ الدَّعَوَاتِ لِأَصْحَابِهِ: اللَّهُمَّ اقْسِمْ لَنَا مِنْ خَشْيَتِكَ مَا يَحُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مَعَاصِيكَ، وَمِنْ طَاعَتِكَ مَا تُبَلِّغُنَا بِهِ جَنَّتَكَ، وَمِنَ اليَقِينِ مَا تُهَوِّنُ بِهِ عَلَيْنَا مُصِيبَاتِ الدُّنْيَا، وَمَتِّعْنَا بِأَسْمَاعِنَا وَأَبْصَارِنَا وَقُوَّتِنَا مَا أَحْيَيْتَنَا، وَاجْعَلْهُ الوَارِثَ مِنَّا، وَاجْعَلْ ثَأْرَنَا عَلَى مَنْ ظَلَمَنَا، وَانْصُرْنَا عَلَى مَنْ عَادَانَا، وَلَا تَجْعَلْ مُصِيبَتَنَا فِي دِينِنَا، وَلَا تَجْعَلِ الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلَا مَبْلَغَ عِلْمِنَا، وَلَا تُسَلِّطْ عَلَيْنَا مَنْ لَا يَرْحَمُنَا
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কোন মজলিস (বৈঠক) হ’তে খুব কমই উঠতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার ছাহাবীগণের জন্য এ দো‘আ না করতেন, আল্লাহুম্মাকসিম লানা মিন খাশয়াতিকা... অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি আমাদের মধ্যে ঐ পরিমাণ তোমার ভীতি সঞ্চার করো যা দিয়ে তুমি আমাদের মাঝে ও তোমার নাফরমানীর মধ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। তোমার ইবাদত-আনুগত্যের ঐ পরিমাণ আমাদেরকে দান করো, যা দিয়ে তুমি আমাদেরকে তোমার জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং তোমার ওপর ঈমানের ঐ পরিমাণ দান করো যা দিয়ে তুমি দুনিয়ার বিপদাপদ সহজ করে দেবে। হে আল্লাহ! আমাদের উপকার সাধন করো আমাদের কানের মাধ্যমে, আমাদের চোখের মাধ্যমে ও আমাদের শক্তির মাধ্যমে, যতক্ষণ তুমি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখো। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের উত্তরাধিকারী জারী রাখো। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রতিশোধ-প্রতিরোধকে সীমাবদ্ধ রাখো তাদের ওপর, যারা আমাদের ওপর যুলম করেছে এবং আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করো তাদের বিরুদ্ধে, যারা আমাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করেছে। হে আল্লাহ! আমাদের দ্বীন সম্পর্কে আমাদেরকে কোন বিপদে ফেলো না এবং দুনিয়াকে আমাদের মৌলিক চিন্তার বিষয় ও জ্ঞানের পরিসীমা করো না। হে আল্লাহ! যারা আমাদের ওপর দয়া প্রদর্শন করবে না, তাদেরকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিও না’।[45]
তবে এই দো‘আতেও হাত উত্তোলনের কথা নেই। কারণ রাসূল (ছাঃ) ছালাতের বাইরে ইস্তিস্কা ব্যতীত অন্য কোথাও হাত তুলে সম্মিলিত মুনাজাত করেননি। যেমন আনাস (রাঃ) বলেন,كَانَ لَا يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِي شَيْءٍ مِنْ دُعَائِهِ إِلَّا فِي الِاسْتِسْقَاءِ، حَتَّى يُرَى بَيَاضُ إِبْطَيْهِ ‘নবী করীম (ছাঃ) ইসতিসক্বা (বৃষ্টি প্রার্থনার ছালাত) ছাড়া অন্য কোন দো‘আয় হাত উঠাতেন না। এ দো‘আয় তিনি এত উপরে হাত উঠাতেন যে তাঁর বগলের শুভ্রতা দেখা যেত।[46]
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বৈঠক শেষে, কিংবা ছালাত শেষে কিছু কালেমা পড়তেন। আমি একদা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! যখনই আপনি কোন বৈঠকে বসেন অথবা ছালাত আদায় করেন, তখনই এই কালেমাগুলি দ্বারা শেষ করেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ। কোন ব্যক্তি ভাল কথা বললে ঐ ভাল-র উপরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মোহরাংকিত করা হয়। আর কোন ব্যক্তি মন্দ কিছু করলে এই দো‘আ তার জন্য কাফ্ফারা হয়ে যায়। দো‘আটি হচ্ছে- سُبْحَانَكَ اللّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ اَشْهَدُ اَنْ لاَّ اِلهَ إلاَّ اَنْتَ اَسْتَغْفِرُكَ وَاَتُوْبُ إلَيْكَ- ‘সুবহা-নাকা আল্লা-হুম্মা ওয়াবিহামদিকা আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লা আনতা আসতাগফিরুকা ওয়া আতূবু ইলায়কা’। অর্থ: মহা পবিত্র হে আল্লাহ! আপনার প্রশংসার সাথে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আমি আপনার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকেই ফিরে যাচ্ছি বা তওবা করছি’।[47]
নাসাঈ স্বীয় عمل اليوم والليلة গ্রন্থে ما يختم تلاوة القران কথাটিও বর্ণনা করেছেন। যার অর্থঃ ‘যা দ্বারা তিনি কুরআন তেলাওয়াত শেষ করতেন’।[48] এজন্য আলবানী (রহ.)-কে মাহফিল বা মজলিস শেষে সম্মিলিত দো‘আ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, এগুলো লোকদের সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে চালু হয়েছে, এগুলো বিদ‘আত।[49]
আর সেজন্য ছাহাবীদের যুগে দো‘আর জন্য সমবেত হওয়াকে অপরাধ মনে করা হত। আবু উছমান আন-নাহদী বলেন, জনৈক গভর্নর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর নিকট এ মর্মে চিঠি লিখলেন যে, এখানে একদল লোক আছে যারা সমবেত হয় এবং আমীর ও মুসলমানদের জন্য সম্মিলিতভাবে দো‘আ করে। ওমর (রাঃ) চিঠির জবাবে লিখলেন, তুমি আমার কাছে আসো এবং সাথে করে তাদেরকেও নিয়ে এসো। তিনি আসলেন। ওমর (রাঃ) দ্বাররক্ষীকে বললেন, তুমি আমার জন্য একটি বেত প্রস্ত্তত কর। যখন তারা ওমরের নিকটে প্রবেশ করলেন। তখন তিনি তাদের নেতাকে সম্মিলিতভাবে দো‘আর আয়োজন চালু করার কারণে বেত্রাঘাত করলেন।[50]
খ. সম্মিলিত মুনাজাতের প্রমাণে পূর্ব থেকে চালু থাকার উদাহরণ পর্যালোচনা : পূর্ব থেকে কোন আমল চালু থাকা বা সৎকর্মশীল ব্যক্তি দ্বারা আমল হওয়া শরী‘আতের কোন দলীল নয়। কেউ না জেনে বা পূর্ব পুরুষদের কোন আলেমের ভুল ফৎওয়ার অনুসরণ করে কোন আমল করে থাকলে তিনি পাকড়াও থেকে রক্ষা পেয়ে যাবেন। কিন্তু কারো কাছে কোন বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও তার উপর যিদবশতঃ আমল করা বা সপক্ষে অবস্থান নেয়া মোটেই ঈমানদারীর পরিচয় নয়; বরং কাফির, মুশরিক ও যালেম শাসকদের কাজ। যেমন ফেরাউনের কাছে মূসা (আঃ) দাওয়াত নিয়ে আসার পরে ফেরাউন বলেছিল, فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الأُولَى؟ ‘তাহ’লে বিগত যুগের লোকদের অবস্থা কি’? (তোয়া-হা ২০/৫১)। অর্থাৎ যারা তোমাদের রব-এর উপাসনা করেনি।
এর মাধ্যমে ফিরাউনের দু’টি উদ্দেশ্য থাকতে পারে, ১. জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা, কারণ যদি মূসা (আঃ) বলতেন, তারা জাহান্নামী, তাহ’লেই তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার সূত্রপাত হ’ত, সাথে সাথে মূসা (আঃ) জনরোষে পড়ে কুপোকাত হ’তেন, কেউ তার কথা শুনত না।
২. আগের অবস্থাই ভালো প্রমাণ করা, কারণ আমাদের সমাজে কত সুন্দর নিয়ম চলে আসছিল, তুমি পূর্বের নিয়মকে তুলে দিয়ে ফিৎনা সৃষ্টি করতে যাচ্ছ কেন? যা প্রতিষ্ঠিত আছে তাকে থাকতে দাও। সমাজে প্রচলিত শিরক বিদ‘আতের ক্ষেত্রে হানাফী, ব্রেলভী ও হানাফী দেওবন্দীরা এমন উদারহণই দিয়ে থাকে। যখনই তাদেরকে কোন বিদ‘আত ছাড়তে বলা হয়, তখনই তারা পূর্বপুরুষ, পীর ছাহেব, মাওলানা, মুহাদ্দিছ, বড় হুজুর কিংবা আকাবির-বুযুর্গের দোহাই দিয়ে থাকে। এগুলো মূলত: প্রাচীন যুগের কাফির-মুশরিকদের আচরণের হুবহু বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেন,وَكَذلِكَ مَا أَرْسَلْنا مِنْ قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلاَّ قالَ مُتْرَفُوها إِنَّا وَجَدْنا آباءَنا عَلى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلى آثارِهِمْ مُقْتَدُونَ، ‘এমনিভাবে তোমার পূর্বে যখনই আমরা কোন জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি এক রীতির উপর এবং আমরা তাদের রীতির অনুসরণ করি’ (যুখরুফ ৪৩/২৩)। এ অবস্থায় মুসলমানদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ সে ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণের অবস্থান তুলে ধরে বলেন,أَوَلَوْ جِئْتُكُمْ بِأَهْدَى مِمَّا وَجَدْتُمْ عَلَيْهِ آبَاءَكُمْ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ، ‘আমি যদি তোমাদের নিকট তার চেয়ে উত্তম পথ নির্দেশ নিয়ে আসি, যার উপরে তোমরা তোমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছ? তারা বলে, তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ, আমরা ওসব প্রত্যাখ্যান করি’ (যুখরুফ ৪৩/২৩)।
সুতরাং পূর্বসুরীদের নিয়মনীতি দেখানো ও উদাহরণ প্রদান করা সালাফদের কাজ নয়। বরং অবাধ্যদের কাজ। যখন সুন্নাহর বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে তখন পূর্বপুরুষদের অজ্ঞতাবশত কোন আমলের উদারহণ দিয়ে তা অনুসরণ করা যাবে না। কারণ তারা হয়ত অজ্ঞতার কারণে নাজাত পেয়ে যাবেন কিন্তু পরবর্তীরা বিষয়টি জানার পরেও তার উপর টিকে থাকলে নাজাত পাবে না। আল্লাহ বলেন,وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جاءَهُمُ الْبَيِّناتُ وَأُولئِكَ لَهُمْ عَذابٌ عَظِيمٌ، ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি এসে যাওয়ার পরেও তাতে মতভেদ করেছে। এদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)।
গ. কোন মাসআলায় ইখতিলাফ থাকলেই কি সেটি ইজতিহাদী মাসআলা হয়?
কোন মাসআলায় মতবিরোধ থাকা অর্থই তা ইজতিহাদী মাসআলা নয়। কেননা সকল মতবিরোধ বৈধ নয়। সাধারণতঃ তিনটি ক্ষেত্রে মতবিরোধ বৈধ হ’তে পারে- (১) উভয় পক্ষে ছহীহ হাদীছ রয়েছে। এক্ষেত্রে করণীয় হ’ল- উভয় দলীলের মাঝে সমন্বয় করতে হবে এবং সম্ভবপর যে কোন একটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। নতুবা উভয়টির উপর আমল করা বৈধ হবে। (২) উভয় পক্ষে দলীল রয়েছে। কিন্তু এক পক্ষে ছহীহ হাদীছ রয়েছে, অন্য পক্ষে যঈফ হাদীছ রয়েছে। এক্ষেত্রে করণীয় হ’ল- ছহীহ হাদীছের উপর আমল করতে হবে এবং যঈফ হাদীছ বর্জন করতে হবে। এই প্রকারের মাসআলায় ছহীহ হাদীছ নিশ্চিত হওয়ার পর কোন মতবিরোধ গ্রহণযোগ্য নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়া ও তার ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, وقولهم مسائل الخلاف لا إنكار فيها ليس بصحيح، ‘তাদের মূলনীতি: ‘মতপার্থক্যপূর্ণ মাসায়েল অস্বীকার করা যাবে না’ কথাটি সঠিক নয়। হুকুমের ক্ষেত্রে হৌক বা আমলের ক্ষেত্রে হৌক তা যদি সুন্নাহ ও মীমাংসিত ইজমার বিরুদ্ধে হয় তাহ’লে তা প্রত্যাখ্যান করা আবশ্যক হবে’।[51]
(৩) যে বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট দলীল বর্ণিত হয়নি, সে বিষয়ের মতবিরোধ ও ইজতিহাদ বৈধ। তবে সেক্ষেত্রেও অধিকতর গ্রহণযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে একটিকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং অপরটিকেও নাকচ করা যাবে না বা কারো অন্ধ অনুকরণ করা যাবে না। এক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, إنَّ مِثْلَ هَذِهِ الْمَسَائِلِ الِاجْتِهَادِيَّةِ لَا تُنْكَرُ بِالْيَدِ وَلَيْسَ لِأَحَدِ أَنْ يُلْزِمَ النَّاسَ بِاتِّبَاعِهِ فِيهَا؛ وَلَكِنْ يَتَكَلَّمُ فِيهَا بِالْحُجَجِ الْعِلْمِيَّةِ فَمَنْ تَبَيَّنَ لَهُ صِحَّةُ أَحَدِ الْقَوْلَيْنِ تَبِعَهُ وَمَنْ قَلَّدَ أَهْلَ الْقَوْلِ الْآخَرِ فَلَا إنْكَارَ عَلَيْهِ، ‘এরূপ ইজতিহাদী মাসআলা পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না এবং কারো জন্য সমীচীন নয় যে সে লোকদের জন্য তা অনুসরণ করাকে আবশ্যক করে দিবে। বরং উক্ত বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ দলীল ভিত্তিক আলোচনা করবে। যার নিকট দু’টি বিষয়ের একটির বিশুদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে যাবে তার অনুসরণ করবে। আর সাধারণ লোকদের কেউ যদি দ্বিতীয় অভিমতের তাকলীদ করে তাহ’লে তা অস্বীকার করা যাবে না।[52]
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট যে, প্রচলিত হাত তুলে সম্মিলিত মুনাজাতকে কোন অবস্থাতেই ইজতিহাদী মাসআলা বলার সুযোগ নেই। কেননা এর সপক্ষে দূরতম কোন দলীলও নেই। সুতরাং এ বিষয়ে ইখতিলাফ বা মতবিরোধও বৈধ নয়।
উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, সুন্নাহর অনুসরণের মধ্যে যাবতীয় কল্যাণ রয়েছে। বিদ‘আত নিয়ে ইজতিহাদ করা অপেক্ষা সুন্নাহর অনুসরণ অধিক কল্যাণকর ও নিরাপদ। অন্যদিকে একটি বিদ‘আত অপরাপর বহু বিদ‘আতের জন্ম দেয়। রাসূল (ছাঃ) ছালাত শেষে, জানাযার পরে দাফন শেষে, জুমা‘আর ছালাত শেষে, মজলিস বা মাহফিল শেষে যেহেতু একটি বারও সম্মিলিত মুনাজাত করেননি। এমনকি সালাফে ছালেহীন তথা ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম বা চার ইমামও এই সম্মিলিত মুনাজাত করেননি। যা সালাফগণ করেননি সে আমলকে চালু করার জন্য আম হাদীছের উপর ইজতিহাদ করে হাদীছের স্থান, কাল ও প্রেক্ষাপট লক্ষ্য না করে জোড়া-তালি লাগিয়ে তা চালু রাখা বা চালু করার অপচেষ্টা করা স্পষ্ট সুন্নাহ বিরোধী কাজ। কারণ বিদ‘আত চালু হ’লেই অসংখ্য সুন্নাত উঠে যাবে, যার বাস্তবতা আমার প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করছি। এজন্য রাসূল (ছাঃ) সর্বদা সুন্নাতকে আঁকড়িয়ে ধরার জন্য জোরালো তাকীদ দিয়েছেন। অতএব বিদ‘আত চালু করে সুন্নাতকে প্রত্যাখ্যান করা সালাফে ছালেহীনদের মানহাজ বিরোধী কাজ। আল্লাহ আমাদের সকলকে সুন্নাতের প্রতি গভীর ভালোবাসা রাখা এবং সুন্নাতের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৪০৫।
[2]. বুখারী হা/৪১৩; মুসলিম হা/৫৫১।
[3]. আহমাদ হা/৫৩৪৯; মিশকাত হা/৮৫৬, সনদ ছহীহ।
[4]. বুখারী হা/৪১৬; মিশকাত হা/৭১০।
[5]. উছায়মীন, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৯/৩৮৬, ১১/৮০২।
[6]. ইবনু তায়মিয়া, আল-ফাতাওয়াল কুবরা ৩/১৬০; ইবনুল কাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ৩/২৫২।
[7]. আতিইয়া সালেম, শারহুল আরবাঈন ৭/৩০।
[8]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৯/২২৪।
[9]. বুখারী হা/৩৩৯৪; মিশকাত হা/৫৭১৬।
[10]. নাসাঈ হা/৫৩৯৯, সনদ ছহীহ।
[11]. নাসাঈ হা/৫৩৯৮; দারেমী হা/১৬৫।
[12]. আলবানী, যঈফাহ হা/৬৮১৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[13]. হাকেম হা/২৭৩৭; আবুদাউদ হা/২১১৯; মিশকাত হা/৩২০৭, সনদ ছহীহ।
[14]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩০/৮০।
[15]. ইবনু বাত্তা, আল-ইবানাহ হা/১৭৯; ছহীহাহ হা/২০৫-এর আলোচনা।
[16]. দারেমী হা/৯৮; মিশকাত হা/১৮৮; ইবনুল বাত্তাহ, আল-ইবানাহ ২২৮, সনদ হাসান।
[17]. আল-ফাওয়াকিহুদ দাওয়ানী ১/২১৪।
[18]. আল-বায়ান ওয়াত তাহছীল ১/৩৬২।
[19]. মাওয়াহিবুল জালীল ২/১২৭।
[20]. আল-ই‘তিছাম, পৃ. ৪৫৬-৬৫।
[21]. মুসনাদুশ শাফেঈ ১/২৮৮-৯০।
[22]. বাযলুল মাঊন ফী ফাযলিত-তাঊন ৩২৮পৃ.।
[23]. আল-আদাবুশ শারঈয়াহ ২/১০২।
[24]. মাজমূউল ফাতাওয়া, ২২/৫১৬।
[25]. মাজমূউল ফাতাওয়া, ২২/৫১৭; আল-ফাতাওয়াল কুবরা ২/২১৮; জামেউল মাসায়েল ৪/৩১৬।
[26]. মাজমূউল ফাতাওয়া ২২/৫১৯; আল-ফাতাওয়াল কুবরা১/৫৩।
[27]. যাদুল মা‘আদ ১/২৪৯।
[28]. ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন ২/২৮১।
[29]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/১৮৪; ফাতাওয়া ইসলামিয়া ১/৩১৯।
[30]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/১৬৭।
[31]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/২৫৮, ১৬/১১০।
[32]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/২৫৩-৫৪, ১৪/২৯৩, ১৬/৯৯; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম ৩৩৯ পৃ.।
[33]. ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব ৮/০২।
[34]. দুরূসুন লিশ-শায়খ আলবানী ৯/১৭।
[35]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২/৬৮০।
[36]. শারহু সুনানী আবীদাউদ ৮/২৫২।
[37]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২৪/১৬৫-১৬৬।
[38]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ২/২৪১।
[39]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ৭/১০৪।
[40]. আত-তাহরীক, ডিসেম্বর ’৯৮ সংখ্যা, প্রশ্নোত্তর ১৪/৪৯।
[41]. ফাতাওয়া আব্দুল হাই ১/১০০।
[42]. মা‘আরিফুস সুনান ৩/৪০৯।
[43]. আহসানুল ফাতাওয়া ৩/৬৮ পৃঃ; গৃহীতঃ সম্মিলিত মুনাজাত, পৃঃ ২৫।
[44]. আহকামুদ দাওয়াত আল-মুরাওয়াজাহ, পৃঃ ১০।
[45]. তিরমিযী হা/৩৫০২; মিশকাত হা/২৪৯২, সনদ হাসান।
[46]. বুখারী হা/১০৩১; মুসলিম হা/৮৯৫; মিশকাত হা/১৪৯৮।
[47]. তিরমিযী, নাসাঈ হা/১৩৪৪; মিশকাত হা/২৪৩৩, ২৪৫০; ছহীহুত তারগীব হা/১৫১৮; ছহীহাহ হা/৩১৬৪।
[48]. আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লাহ হা/৩০৮; নাসাঈ হা/১৩৪৩-এর টীকা।
[49]. দুরূসুন লিশ-শায়খ আলবানী ৯/১৭।
[50]. মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৬১৯১; ইবনু ওয়াযাহ, আল বিদউ হা/৩৬; সনদ হাসান।
[51]. ইবনু তায়মিয়াহ, ইকামাতুদ দলীল আলা ইবতালীল তাহলীল ১৮১ পৃ.; আল-ফাতাওয়াল কুবরা ৬/৯৬; ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন ৩/২২৩।।
[52]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া ৩০/৮০।