‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর পারিভাষিক অর্থ :
পূর্ব
আলোচনায় আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ‘সুন্নাত’ যেমন শরী‘আতের যাবতীয় বিশ্বাস ও
ইবাদতগত বিষয়বস্ত্তকে অন্তর্ভুক্ত করে, তেমনি বিদ‘আতমুক্ত আক্বীদা ও আমলকেও
বুঝানো হয়। অপরদিকে জামা‘আত বলতে বুঝায় ছাহাবী ও তাবেঈগণের জামা‘আত এবং
তাঁদের অনুসারী পরবর্তী সকল যুগের ওলামায়ে কেরাম, যারা কিতাব ও সুন্নাতে
বর্ণিত মানহাজকে সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকেন। সুতরাং ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল
জামা‘আত’ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল মুসলিম উম্মাহর সেই দল, যারা রাসূল (ছাঃ)-এর
সুন্নাতকে সর্বাবস্থায় আঁকড়ে ধরে থাকেন। যেমন ছাহাবী ও তাবেঈগণ, আর তাদের
অনুসারী পরবর্তী হক্বপন্থী মুজতাহিদ ইমামগণ ও ওলামায়ে কেরাম। অতঃপর
ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বাসে, কথায় ও আমলে তাঁদের পদাংক অনুসারী ব্যক্তিগণ।[1]
ইবনু
হাযম আন্দালুসী (রহঃ) (৩৮৪-৪৫৬ হিঃ) বলেন, وَأَهْلُ السُّنَّةِ الَّذِيْنَ
نَذْكُرُهُمْ أَهْلَ الْحَقِّ وَمَنْ عَدَاهُمْ فَأَهْلُ الْبَاطِلِ
فَإِنَّهُمُ الصَّحَابَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ وَكُلُّ مَنْ سَلَكَ
نَهْجَهُمْ مِنْ خِيَارِ التَّابِعِيْنَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ ثُمَّ
أَهْلُ الْحَدِيْثِ وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْفُقَهَاءِ جِيْلاً فَجِيْلاً
إِلَى يَوْمِنَا هذَا وَمَنِ اقْتَدَى بِهِمْ مِنَ الْعَوَامِ فِى شَرْقِ
الْأَرْضِ وَغَرْبِهَا رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ- ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল
জামা‘আত- যাদেরকে আমরা হক্বপন্থী ও তাদের বিরোধী পক্ষকে বাতিলপন্থী বলেছি,
তাঁরা হ’লেন (ক) ছাহাবায়ে কেরাম (খ) তাঁদের অনুসারী শ্রেষ্ঠ তাবেঈগণ (গ)
আহলেহাদীছগণ (ঘ) ফক্বীহদের মধ্যে যারা তাঁদের অনুসারী হয়েছেন যুগে যুগে
আজকের দিন পর্যন্ত (ঙ) এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐ সকল ‘আম জনসাধারণ, যারা
তাঁদের অনুসারী হয়েছেন। আল্লাহ তাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন’।[2]
ইবনু
তায়মিয়া (৬৬১-৭২৮হিঃ) বলেন,هم متمسكون بكتاب الله وسنة رسوله وما اتفق
عليه السابقون الأولون من المهاجرين والأنصار والذين اتبعوهم بإحسان. ‘তারা
হ’লেন আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী
ব্যক্তিগণ, যারা মুহাজির ও আনছারদের মধ্যকার প্রথম সারির ছাহাবীগণ এবং
তাঁদের যথাযথ অনুসারীদের গৃহীত ঐক্যবদ্ধ নীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত’।[3]
নামকরণের কারণ :
এই
জামা‘আতে অন্তর্ভুক্তদেরকে এজন্য ‘আহলুস সুন্নাহ’ বলা হয় যে, তারা
সুন্নাতকে ধারণকারী, সুন্নাতের বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সুন্নাত অনুসারে জীবন
পরিচালনাকারী। আর ‘আহলুল জামা‘আত’ বলা হয় এই কারণে যে, তারা হক্ব বা সঠিক
পথ ও পন্থাকে গ্রহণ করেছে, হক্বের উপর একতাবদ্ধ হয়েছে এবং মুসলমানদের সেই
জামা‘আতের পদাংক অনুসরণ করেছে, যারা সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছে। তারা
হ’লেন সকল ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাঁদের অনুসারীগণ। একই সাথে তারা তাদের
মধ্যকার মুসলিম নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ
মোতাবেক তারা তাদের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয় না। অর্থাৎ সুন্নাতের
যথাযথ অনুসরণ, হক্বের উপর ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং মুসলমানদের জামা‘আত থেকে
বিচ্ছিন্ন না থাকা তাদের মৌলিক নিদর্শন।[4]
এছাড়া
এই নামকরণের উদ্দেশ্য আরও সুস্পষ্ট হয় পরিভাষাটির বিপরীত শব্দযুগল থেকে।
অর্থাৎ সুন্নাহর বিপরীত হ’ল বিদ‘আত, আর জামা‘আতের বিপরীত হ’ল ফুরক্বাহ বা
বিচ্ছিন্নতা। যেহেতু এই দলটি বিদ‘আত এবং মুসলমানদের জামা‘আত থেকে
বিচ্ছিন্নতাকে সর্বতোভাবে পরিহার করে, এজন্য দলটি আহলে সুন্নাত ওয়াল
জামা‘আত হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।[5] ইবনু তায়মিয়াহ
(৬৬১-৭২৮হিঃ) যথার্থই বলেন,والبدعة مقرونة بالفرقة كما ان السنة مقرونة
بالجماعة فيقال أهل السنة والجماعة كما يقال أهل البدعة والفرقة ‘বিদ‘আতের
সাথে যেমন সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতার, তেমনি সুন্নাতের সাথে সম্পর্ক হ’ল
ঐক্যবদ্ধতার। এজন্য বলা হয়, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ’, যেমন এর বিপরীতে
বলা হয় ‘আহলুল বিদ‘আহ ওয়াল ফুরক্বাহ’।[6]
‘আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র প্রথম সারির দল হ’ল ছাহাবীগণ। কেননা তাঁরাই
সর্বপ্রথম রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে সুন্নাত শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং অপরকে
শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁরাই সুন্নাতের প্রতিরক্ষা দান করেছিলেন। সুতরাং
তাঁরাই প্রথম ‘আহলে সুন্নাত’ হিসাবে পরিগণিত। তারা ‘আহলুল জামা‘আহ’ এজন্য
যে তাদের যুগে ইসলামের মধ্যে কোন দল-উপদলের সৃষ্টি হয়নি। ইবনু তায়মিয়া
(রহঃ) বলেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ একটি প্রাচীন মাযহাব যা আবূ
হানীফা, মালেক, শাফেঈ, আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর জন্মেরও বহু পূর্ব থেকে
সুপরিচিত ছিল। সেটি হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের মাযহাব, যারা তাঁদের নবীর নিকট
থেকে সরাসরি জ্ঞান হাছিল করেছিলেন।[7]
অতঃপর
পরবর্তী যুগে যারা ছাহাবীগণের নিকট থেকে দ্বীন শিক্ষা লাভ করেছিলেন এবং
তাদের অনুসৃত পথে পরিচালিত হয়েছিলেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত যারা ছাহাবীদের
অনুসৃত নীতিতে পরিচালিত হবেন, তারা সকলেই আহলুস সুন্নাহ-এর অন্তর্ভুক্ত।
কেননা তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং দ্বীনের মধ্যে
নতুন পথ ও মতের আবির্ভাব ঘটান না। তারা মুমিনদের সর্বসম্মত কোন নীতি থেকেও
বিচ্যুত হন না।[8]
মূলতঃ ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ পৃথক কোন দল, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের নাম নয়, বরং ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসারীদেরই একটি বৈশিষ্ট্যগত পরিচয়। বিদ‘আতীদের থেকে পৃথকীকরণের জন্য তাদেরকে এই নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেন, ‘আহলে সুন্নাতের তরীক্বা (ভিন্ন কিছু নয়) বরং তা দ্বীন ইসলামই, যা নিয়ে মুহাম্মাদ (ছাঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর উম্মাত ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে এবং এগুলোর সবই জাহান্নামে যাবে কেবল একটি দল ছাড়া; আর সে দলটি হ’ল যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের অনুসৃত পথে পরিচালিত হবে- তখন ইসলামকে নিষ্কলুষ এবং পূর্ণাঙ্গভাবে ধারণকারীদের নাম হয়ে যায় ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ’...। এরাই হ’ল বিজয়ী দল...’।[9]
নামকরণের উৎপত্তি :
‘আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ একটি প্রাচীনতম পরিভাষা। ছাহাবীগণের জামা‘আতকে
সর্বপ্রথম এই নামে আখ্যায়িত করা হয়। মুসলিম সমাজে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ফিৎনার
আবির্ভাব শুরু হওয়ার পূর্বে মুসলমানদের ভিন্ন কোন পরিচয়ে ডাকা হ’ত না।
কিন্তু ফিৎনার আবির্ভাবের পর মুসলিম সমাজ নানা দল-উপদলে বিভক্ত হ’লে এই
পরিভাষাটির ব্যবহার শুরু হয়। এই নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল বাতিলপন্থীদের থেকে
হক্বপন্থীদেরকে পৃথক করা। যেমন বিশিষ্ট তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (মৃ.
১১০ হিঃ) বলেন, لم يكونوا يسألون عن الإسناد، فلما وقعت الفتنة قالوا: سموا
لنا رجالكم فينظر إلى أهل السنة فيؤخذ حديثهم، وينظر إلى أهل البدع فلا
يؤخذ حديثهم، ‘মানুষ ইতিপূর্বে ইসনাদ (তথ্যসূত্র) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত না।
কিন্তু যখন ফিৎনার যুগের আবির্ভাব ঘটল তখন তারা বলা শুরু করল, তোমরা
তোমাদের (তথ্যদাতা) রাবীদের নাম বল। অতঃপর যদি দেখা যেত যে, তারা
(তথ্যদাতাগণ) আহলুস সুন্নাহ বা সুন্নাহর অনুসারী তখন তাদের বর্ণিত
হাদীছসমূহ গৃহীত হ’ত। আর যদি দেখা যেত যে, তারা আহলুল বিদ‘আহ বা বিদ‘আতের
অনুসারী, তখন তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত না’।[10]
ছাহাবীগণও নামটি ব্যবহার করেছেন। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) يَوْمَ تَبْيَضُّ
وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ আয়াতটির তাফসীরে বলেন,فأما الذين ابيضت وجوههم
فأهل السنة والجماعة وأولو العلم، وأما الذين اسودت وجوههم فأهل البدع
والضلالة ‘সেদিন যাদের চেহারা উজ্জ্বল হবে- তারা হ’ল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল
জামা‘আত এবং এবং কৃষ্ণকায় চেহারা হবে বিদ‘আতী এবং পথভ্রষ্টদের’।[11]
অনুরূপভাবে আইয়ুব সাখতিয়ানী, সুফিয়ান ছাওরী, আহমাদ বিন হাম্বল, কুতায়বা ইবনু সাঈদসহ প্রাথমিক যুগের বহু বিদ্বান থেকে এই পরিভাষার ব্যবহার দেখা যায়।[12] হিজরী ৪র্থ/৫ম শতকের বিদ্বান ইমাম আবূ জা‘ফর আত-ত্বাহাভী (২৩৮-৩২১হিঃ) তাঁর সুবিখ্যাত ‘আক্বীদা ত্বাহাভিয়াহ’ গ্রন্থের শুরুতে লিখেছেন, هذا ذكر بيان عقيدة أهل السنة والجماعة ‘এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদার বিবরণী’। ইমাম আবুল কাসেম আল-লালকাঈ (মৃ. ৪১৮হিঃ) রচনা করেছেন, شرح أصول اعتقاد أهل السنة والجماعة ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআ‘ত কর্তৃক অনুসৃত আক্বীদার মূলনীতিসমূহ বিশ্লেষণ’।
নামকরণের শারঈ ভিত্তি :
এই পরিভাষাটি কুরআন, হাদীছ এবং সালাফদের আছার থেকে প্রমাণিত। যেমন :
প্রথমতঃ পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে রাসূল (ছাঃ)-কে অনুসরণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এবং তাঁর অবাধ্যতা করা ও তাঁর নির্দেশকে অগ্রাহ্য করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। সুতরাং পরিভাষাটির প্রথমাংশে যেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুসরণের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তা মূলতঃ এই কুরআনী নির্দেশেরই প্রতিফলন।
দ্বিতীয়তঃ
পরিভাষাটি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। যেমন তিনি বলেন,
عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي ‘তোমরা আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে থাক’।[13]
সেই সাথে তিনি মুসলিম উম্মাহকে ‘জামা‘আতে’র সাথে থাকার নির্দেশ দিয়ে
বলেছেন, وَأَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللهُ أَمَرَنِى بِهِنَّ
بِالْجَمَاعَةِ ‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি, যে বিষয়ে
আল্লাহ আমাকে নির্দেশ করেছেন। প্রথমটি হ’ল, জামা‘আতবদ্ধ থাকা...’। [14]
আর
যারা জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে তাদের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে
রাসূল (ছাঃ) বলেন,فَإِنَّهُ مَنْ خَرَجَ مِنَ الْجَمَاعَةِ قِيْدَ شِبْرٍ،
فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ، إِلَى أَنْ يَرْجِعَ،
‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণও বের হয়ে যাবে, সে যেন
তার কাঁধ থেকে ইসলামের রজ্জুকে অপসারণ করে ফেলল, যতক্ষণ না সে পুনরায়
(জামা‘আতে) ফিরে আসে’।[15]
অপরদিকে
নাজাতপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে তিনি বলেন,أَلَا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ
أَهْلِ الْكِتَابِ افْتَرَقُوْا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً،
وَإِنَّ هَذِهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ:
ثِنْتَانِ وَسَبْعُوْنَ فِي النَّارِ، وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ، وَهِيَ
الْجَمَاعَةُ، ‘জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব বাহাত্তর দলে
বিভক্ত হয়েছে। আর এই উম্মত বিভক্ত হবে তিহাত্তর দলে। এর মধ্যে বাহাত্তরটি
দলই হবে জাহান্নামী আর একটি দল হবে জান্নাতী। সেই দলটি হচ্ছে ‘আল-জামাআত’।[16]
রাসূল
(ছাঃ) আরও বলেন,وَإِنَّ بني إسرائيل تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ
وَسَبْعِيْنَ مِلَّةً، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِيْنَ
مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً، قَالُوا:
وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي،
‘বনী ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে আর আমার উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত
হবে। তন্মধ্যে একটি দল ছাড়া আর সবাই জাহান্নামী হবে। ছাহাবায়ে কেরাম
জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যারা আমি ও
আমার ছাহাবীগণের পথে (অবিচল থাকবে)’।[17]
তিনি
অন্যত্র বলেন, إِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِيْ فَسَيَرَى
اخْتِلَافًا كَثِيْرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ
الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ، تَمَسَّكُوْا بِهَا، وَعَضُّوْا
عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ،
فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ، ‘তোমাদের
মধ্যে যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অচিরেই বহু মতভেদ দেখবে। সে সময়
তোমাদের জন্য আবশ্যক হ’ল আমার সুন্নাহ ও আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের
সুন্নাহ অবলম্বন কর। তা মজবূতভাবে ধারণ কর এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধর।
আর নবাবিষ্কৃত বিষয়সমূহ থেকে অবশ্যই বেঁচে থেক। কেননা (দ্বীনের নামে
আবিষ্কৃত) সকল নতুন বিষয় বিদ‘আত আর সকল বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা’।[18]
এ সকল হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট যে, মুসলিম উম্মাহ দল-উপদলে বিভক্ত হবে এবং বহু পথ ও মতের অনুসারী হবে। এসময় নাজাতপ্রাপ্ত দল তারাই হবে যারা রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীদের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে থাকবে এবং মুসলমানদের জামা‘আতে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত রাখবে। বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করবে না। সুতরাং এই নাজাতপ্রাপ্তদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসাবে এই দলটিকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’ নামকরণ করা হয়েছে। সালাফ বিদ্বানগণের বিভিন্ন বর্ণনায় এই দলটির নাম এসেছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কিতাব ও সুন্নাতের প্রকৃত অনুসারীগণ প্রাথমিক যুগ থেকে এই নামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন।
ইবনু
তায়মিয়া (রহঃ) বলেন,وشعار هذه الفرق مفارقة الكتاب والسنة والإجماع فمن قال
بالكتاب والسنة والإجماع كان من أهل السنة والجماعة ‘(এ সকল) পথভ্রষ্ট
দলগুলোর বৈশিষ্ট্য হ’ল কিতাব, সুন্নাত ও ইজমার বিপরীতে অবস্থান করা।
পক্ষান্তরে যারা কিতাব, সুন্নাত ও ইজমার পক্ষাবলম্বন করে, তারাই হ’ল ‘আহলুস
সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’।[19]
প্রসিদ্ধি লাভের কারণ :
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ পরিভাষাটি প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণ হ’ল, রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর মুসলিম সমাজে আবির্ভূত হওয়া প্রথম বিদ‘আত তথা শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, বায়‘আত ভঙ্গ করা, মুসলিম সমাজকে খন্ড-বিখন্ড করা। খারেজী সম্প্রদায় প্রথম এই নীতি গ্রহণ করে যার ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত বিরোধী একটি নতুন মতবাদ ও চিন্তাধারার জন্ম হয়। তারা কবীরা গোনাহের কারণে একজন মুসলিমকে কাফির ঘোষণা করে এবং তার জান ও মালকে হালাল করে নেয়। এমনকি তারা আলী (রাঃ)-কে পর্যন্ত কাফের ঘোষণার মাধ্যমে হত্যা করে। এরই মাঝে আলী (রাঃ) এবং মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মাঝে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং মুসলিম উম্মাহর বন্ধন আরও শিথিল ও বিযুক্ত হ’তে থাকে। অতঃপর ৪১ হিজরীতে মুসলিম উম্মাহ আবারও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। অন্যদিকে খারেজীদের এই নবতর নীতি গ্রহণের পরপরই রাফেযী শী‘আদের আবির্ভাব ঘটে। তারা মিথ্যাচারের জন্য ব্যাপক কুখ্যাতি লাভ করে। অতঃপর আবির্ভাব ঘটে কাদারিয়া গোষ্ঠীর- যারা তাক্বদীরকে অস্বীকার করে মুসলিম সমাজে ব্যাপক বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। অতঃপর আবির্ভাব ঘটে জাহমিয়া এবং জাবরিয়া গোষ্ঠীর- যারা প্রচার করে যে, মানুষ স্বীয় কর্মে কোন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি রাখে না। সুতরাং মানুষ তার পাপকর্মের জন্য দায়ী নয়।
একের পর এক এ জাতীয় বাতিল ফেরক্বাগুলোর
আবির্ভাব ঘটতে থাকলে বিদ্বানদের একটি দল এদের আক্বীদাসমূহ খন্ডন করে গ্রন্থ
রচনা করতে শুরু করলেন। তাঁরা এ সকল গ্রন্থের নামকরণ করলেন ‘কুতুবুস
সুন্নাহ’ বা ‘সুন্নাহর কিতাব’। এসকল বিদ্বান সুন্নাহর প্রতি তাঁদের বিশেষ
আগ্রহ এবং সুন্নাহ সংরক্ষণের জন্য ছহীহ ও যঈফ হাদীছের মধ্যে পৃথকীকরণ
প্রচেষ্টার জন্য সুপ্রসিদ্ধি লাভ করলেন। তখন থেকে বিদ্বানদের এই দলটি ‘আহলে
সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ হিসাবে পরিচিতি পান। পরবর্তীকালে প্রত্যেক যে
ব্যক্তি সুন্নাহর যথাযথ অনুসারী এবং এর ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যকামী
হক্বপন্থীদের অনুসারী হ’লেন তাদের উপাধি হয়ে গেল ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল
জামা‘আত’।[20]
হিজরী
তৃতীয় শতকে মু‘তাযিলীদের আবিষ্কৃত ‘কুরআন সৃষ্ট’ মতবাদের বিরোধিতার অপরাধে
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১খ্রি.)-এর উপর যখন আববাসীয় খলীফা আল-মামূন
(১৭০-২১৮খ্রি.)-এর নির্মম শাস্তির খড়গ নেমে এল এবং ইমাম আহমাদ শত
নির্যাতনের মুখেও সুন্নাহর সুরক্ষায় দৃঢ়চিত্তে আদর্শের উপর অটল থাকার অনন্য
দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তখন সুন্নাহর চিরন্তন মর্যাদা মুসলমানদের নিকট
আরও একবার উদ্ভাসিত হয়। একই সাথে সেসময় ইমাম আহমাদের সম্মুখে খলীফা
আল-মামূনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার যথেষ্ট কারণও উপস্থিত হয়েছিল।
যেহেতু আল-মামূন একদিকে ‘কুরআন সৃষ্ট’-এই কুফরী আক্বীদা পোষণ করেছিলেন,
অপরদিকে তিনি ছিলেন অত্যাচারী শাসক। ইমাম আহমাদের বহু অনুসারী ছিল বাগদাদে।
তারা ইমামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কেন খলীফা আল-মামূনের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন না? তিনি বলেছিলেন, আমি মুসলমানদের জামা‘আতকে
ছিন্ন-ভিন্ন করতে পারি না।[21]
ইমাম আহমাদের গৃহীত এই অবস্থান থেকে দু’টি নীতি প্রকাশিত হয়। প্রথমতঃ হক্ব জানার পর তা প্রকাশে তিনি শাসকের শত অত্যাচারকেও পরোয়া করেননি। অপরপক্ষে তাঁর উপর শাসকের মর্মান্তিক নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেননি। কেননা তিনি চাননি তাঁর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হোক।
এভাবে
তাঁর মাধ্যমে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতে’র মানহাজ ও নীতিগত অবস্থান
সাধারণ মানুষের মধ্যে এভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, সুন্নাতের মর্যাদা কোন
অবস্থাতেই ভূলুণ্ঠিত হ’তে দেওয়ার নয় এবং শাসক বিদ‘আতী, ফাসিক বা অত্যাচারী
হ’লেও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা যাবে না, যতক্ষণ না তার মধ্যে
সুস্পষ্ট কুফরী প্রকাশ পায়। ফলে তিনি সর্বপ্রথম ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল
জামা‘আতে’র ইমাম হিসাবে উপাধি লাভ করেন।[22]
পরবর্তী যুগের ওলামায়ে কেরাম এই পরিভাষাটি বহুলভাবে ব্যবহার করেছেন। ইমাম ত্বাহাভী (২৩৮-৩২১হিঃ) এবং ইমাম আবুল কাসেম আল-লালকাঈ (মৃ. ৪১৮হিঃ) প্রমুখ ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র আক্বীদা-বিশ্বাস শিরোনামেই গ্রন্থ রচনা করেছেন।
(ক্রমশঃ)
[1]. মুহাম্মাদ বিন ছালিহ আল-উছায়মীন, মিনহাজু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ফীল আক্বীদাতি ওয়াল আমাল, পৃঃ ৭-৮; ছালিহ আল-ফাওযান, শারহুল আক্বীদাহ আল-ওয়াসিত্বিয়াহ, পৃঃ ১০।
[2]. ইবনু হাযম, আল-ফাছলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ২/৯০ পৃঃ।
[3]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/৩৭৫ পৃঃ।
[4]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/১৫৭ পৃঃ; ড. মুহাম্মাদ ইউসরী, ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, পৃঃ ২৩।
[5]. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল হামীদ আল-আছারী, আল-ওয়াজীয ফী আক্বীদাতিস সালাফিছ ছালিহ, পৃঃ ৩৯।
[6]. ইবনু তায়মিয়া, আল-ইস্তিকামাহ, ১/৪২ পৃঃ।
[7]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/১৫৯ পৃঃ।
[8]. ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ, পৃঃ ২৪।
[9]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/১৫৯ পৃঃ।
[10]. মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ, মুকাদ্দামা ছহীহ মুসলিম, ১/১৫ পৃঃ।
[11]. হিবাতুল্লাহ আল-লালকাঈ, শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদ, ১/৭৯ পৃঃ।
[12]. শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদ, ১/৬০, ৬৬, ৭১ পৃঃ।
[13]. আহমাদ হা/১৭১৪৫; আবূদাউদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; মিশকাত হা/১৬৫, সনদ ছহীহ।
[14]. আহমাদ হা/১৭২০৯, ১৭৮৩৩; তিরমিযী হা/১০৩৬, সনদ ছহীহ।
[15]. তদেব।
[16]. আহমাদ হা/১৬৯৩৭; আবূদাউদ হা/৪৫৯৭; মিশকাত হা/১৭২, সনদ ছহীহ।
[17]. তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১, সনদ হাসান।
[18]. আহমাদ হা/১৭১৪৫, আবূদাউদ হা/৪৬০৭; মিশকাত হা/১৬৫, সনদ ছহীহ।
[19]. মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৩/৩৪৬ পৃঃ।
[20]. ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ২৬-২৭; ছালিহ আদ-দাখীল, খাছাইছু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ : দিরাসাহ ওয়া বায়ান, পৃঃ ১১০।
[21]. ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ২৭-২৮।
[22]. ইলমুত তাওহীদ ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ২৭-২৮।