ভূমিকা : মানবসৃষ্টির আদিকাল থেকেই শাম একটি তাৎপর্য মন্ডিত স্থান। হাযারো নবী-রাসূলের পরশধন্য এ পবিত্র ভূখন্ড। হযরত ইবরাহীম ও মূসা (আঃ) সহ অনেক নবীর হিজরতের স্থান হ’ল শাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। এখান থেকেই রাসূল (ছাঃ)-এর মি‘রাজের সূচনা হয়। এখানে রয়েছে মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা ‘মসজিদুল আক্বছা’। এ মসজিদ ছিল অতীত কালের সকল নবী-রাসূলের ক্বিবলা। শাম দেশই হবে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দাদের মিলন মেলা। এ দেশেরই বিস্তৃত অঞ্চল হবে হাশরের ময়দান। আর এ পবিত্র ভূমিকে ফেরেশতাগণ তাদের ডানা দিয়ে আচ্ছাদন করে রেখেছেন। এ দেশেরই মুজাহিদেরা হকের উপর অবিচল বলে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। শামের আকাশ দিয়েই দামেশকের মসজিদে অবতরণ করবেন হযরত ঈসা (আঃ)। আর শামেই সংঘটিত হবে মালহামা বা কাফেরদের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ। এজন্য শামের মাটি ও মানুষের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। নিম্নে শাম দেশের গুরুত্ব ও সেখানে অবস্থানকারীদের মর্যাদা বর্ণনা করা হ’ল-
বরকতময় ভূমি শাম :
শাম দেশ বরকতময়। এ দেশে বহু নবী-রাসূলের আগমন। এ দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফলফলাদি ও স্থানের শপথ করে নাযিল হয়েছে কুরআনের একাধিক আয়াত। আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মি‘রাজের পূর্বে পবিত্র ভূমি বায়তুল মাক্বদাসে নিয়ে গেছেন এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বরকতময় হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন’ (ইসরা ১৭/০১)। তাছাড়া কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে শাম দেশকে বরকতময় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,وَأَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِينَ كَانُوا يُسْتَضْعَفُونَ مَشَارِقَ الْأَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا، ‘আর যাদেরকে দুর্বল ভাবা হ’ত সেই সম্প্রদায়কে (অর্থাৎ বনু ইস্রাঈলকে) আমরা উত্তরাধিকার দান করলাম পূর্ব ও পশ্চিমের। যাতে আমরা বরকত দান করেছি’ (আ‘রাফ ৭/১৩৭)।
অধিকাংশ তাফসীরকারকের মতে পূর্ব-পশ্চিম দ্বারা শামকে বুঝানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘আর আমরা তাকে ও (তার ভাতিজা) লূতকে উদ্ধার করে সেই দেশে (শামে) পৌঁছে দিলাম যেখানে আমরা বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ রেখেছিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৭১)। তিনি আরো বলেন, ‘আর আমরা প্রবল বায়ুকে সোলায়মানের অনুগত করে দিয়েছিলাম। যা তার নির্দেশ মতে পরিচালিত হ’ত সেই জনপদের দিকে, যেখানে আমরা কল্যাণ রেখেছিলাম। বস্ত্তত সকল বিষয়ে আমরা সম্যক অবহিত’ (আম্বিয়া ২১/৮১)।
১. শামের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দো‘আ :
আল্লাহ যেমন শামদেশকে বরকতময় হিসাবে ঘোষণা করেছেন তেমনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ দেশের বরকতের জন্য দো‘আ করেছেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
‘আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَامِنَا، اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا قَالُوا: وَفِي نَجْدِنَا؟ قَالَ: اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَامِنَا، اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য শামে বরকত দান করুন, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য ইয়ামানে বরকত দান করুন। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘আর আমাদের নাজদে?’ তিনি আবার বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য শামে বরকত দান করুন, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য ইয়ামানে বরকত দান করুন। ছাহাবায়ে কেরাম আবার বললেন, আর আমাদের নাজদে?’ তখন তিনি বললেন, هُنَاكَ الزَّلَازِلُ وَالْفِتَنُ، وَبِهَا يَطْلُعُ قَرْنُ الشَّيْطَانِ সেখানে (নাজদে) রয়েছে ভূমিকম্প ও ফিৎনা এবং সেখান থেকেই শয়তানের শিং উদয় হবে’।[1]
২. শামের নিরাপত্তায় ফেরেশতাগণ নিয়োজিত :
শামদেশ এমন বরকতময় ভূমি যে দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ফেরেশতারা নিজেদের ডানা বিছিয়ে রেখেছেন।
যায়েদ ইবনু ছাবেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে চামড়ার উপরে কুরআন সংকলন করছিলাম। সে সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, طُوبَى لِلشَّأْمِ সিরিয়ার জন্য মঙ্গল। আমরা বললাম, কেন হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন,لأَنَّ مَلاَئِكَةَ الرَّحْمَنِ بَاسِطَةٌ أَجْنِحَتَهَا عَلَيْهَا কেননা দয়াময় রহমানের ফেরেশতাগণ তার উপর নিজেদের ডানা বিস্তার করে রেখেছেন’।[2] মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, শাম ভূখন্ড ও তার অধিবাসীদেরকে কুফর থেকে রক্ষার জন্য ফেরেশতামন্ডলী তাদের ডানা বিছিয়ে দেন।[3] মানাবী (রহঃ) বলেন, এর অর্থ ফেরেশতাগণ ক্ষতিকর ও ধ্বংসকারী বস্ত্তকে দূরীভূত করা ও বরকত নাযিল করার মাধ্যমে শামকে সুরক্ষিত এবং পরিবেষ্টন করে রাখে।[4]
৩। শামে একত্রিত হওয়ার নির্দেশনা :
শামদেশ সার্বিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে শামদেশে অবস্থান করে কাফির-মুশরিক ও ইহুদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন হাদীছে এসেছে,
(১) আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,سَيَخْرُجُ نَارٌ مِنْ نَحْوِ حَضْرَ مَوْتَ، أَوْ مِنْ حَضْرَ مَوْتَ تُحْشَرُ النَّاسُ ‘ক্বিয়ামতের পূর্বে হাযরা মাউত হ’তে অথবা হাযরা মাউতের সাগরের দিক হ’তে শীঘ্রই একটি অগ্নুৎপাত হবে এবং তা লোকদেরকে একত্র করবে। ছাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন,يَا رَسُولَ اللهِ مَا تَأْمُرُنَا؟ হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তখন আমাদেরকে কী করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন, عَلَيْكُمْ بِالشَّام তোমরা শামে অবস্থান করাকে আবশ্যক করবে’।[5]
(২) আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, سَتَكُونُ هِجْرَةٌ بَعْدَ هِجْرَةٍ، فَخِيَارُ أَهْلِ الْأَرْضِ إِلَى مُهَاجَرِ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ، يَبْقَى فِيهَا شِرَارُ أَهْلِهَا، تَلْفِظُهُمُ الْأَرْضُ، وَتَقْذَرُهُمْ نَفْسُ اللهِ، فَيَبْعَثُ اللهُ عَلَيْهِمْ نَارًا تَحْشُرُهُمْ مَعَ الْقِرَدَةِ وَالْخَنَازِيرِ মদীনায় হিজরত সম্পন্ন হওয়ার পর আর একটি হিজরত সংঘটিত হবে। তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুসলমান হবে যারা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর হিজরতের স্থান আঁকড়ে ধরবে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে নিকৃষ্ট মুসলমানগণ অবস্থান করবে। পৃথিবী তাদেরকে নিজ ভূগর্ভ থেকে বের করে দিতে চাইবে, আল্লাহর নিকট তারা ধিকৃত হবে। একটি আগুন তাদেরকে বানর ও শূকরের সঙ্গে জমায়েত করে দেবে।[6]
মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, মদীনায় হিজরতের পর শামের দিকে আর একটি হিজরত সংঘটিত হবে। তূরবিশতী (রহঃ) বলেন, এটি হবে ফিৎনা বিস্তৃতির সময়। যখন মুসলিম বিশ্বে দ্বীনের ওপর অটল মুমিনের সংখ্যা কমে যাবে। অমুসলিম বিশ্ব ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে দখলদারিত্ব কায়েম করবে। ইসলামী বাহিনী শামে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। তারা বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে দাজ্জালকে হত্যা করা পর্যন্ত বিজয়ী শক্তি হিসাবে টিকে থাকবে। এ সময়ে যারা সেখানে হিজরত করবে, দ্বীন রক্ষা ও পরকালের সংশোধনের জন্য হিজরত কারী হিসাবে গণ্য হবে। আল্লাহর দ্বীনের ওপর অটল-অবিচল নেককার বান্দাদের বিশাল একটি দল সেখানে অবস্থান করবে।[7]
(৩) বাহয ইবনু হাকীম (রহঃ) হ’তে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত, তিনি (দাদা) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কোথায় যাওয়ার নির্দেশ দিবেন? আমার জন্য নির্বাচন করুন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শামের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, إِنَّكُمْ مَحْشُورُونَ رِجَالاً وَرُكْبَاناً وَتُجَرُّونَ عَلَى وُجُوهِكُمْ তোমাদেরকে পদব্রজে ও সওয়ারী অবস্থায় সমবেত করা হবে এবং কতককে মুখের উপর (উপুড় করে) হেঁচড়িয়ে হাযির করা হবে।[8] ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন,يأتي على الناس زمان لا يبقى فيه مؤمن إلا لحق بالشام، ‘মানুষের সামনে এমন একটি সময় আসবে, যখন পৃথিবীর সকল মুমিনরা শামে হিজরত করবে।[9]
৪। শামবাসী দ্বীনের পথে অদম্য অজেয় :
বর্তমান শামদেশ বিপর্যয়ের মুখে থাকলেও শামের যোদ্ধারা থাকবে অজেয়। ইবলীসের নেতারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে হাদীছ নিম্নোক্ত,
(১) আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا فَسَدَ أَهْلُ الشَّامِ فَلَا خَيْرَ فِيكُمْ، لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي مَنْصُورِينَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ‘যদি শামের জনগণ বিপথগামী হয়ে যায়, তাহ’লে তোমাদের মধ্যে কোন কল্যাণ থাকবে না। আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা বিজয়ী থাকবে। যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে, তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।[10]
(২) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَا يَزَالُ أَهْلُ الْغَرْبِ ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ، حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ‘পশ্চিম দেশীয়রা (শামবাসী) বরাবর হক্বের উপর বিজয়ী থাকবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত’।[11] হাদীছে উল্লিখিত পশ্চিম দেশীয়রা বলতে শামবাসীকে বুঝানো হয়েছে।[12]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,لَا تَزَالُ عِصَابَةٌ مِنْ أُمَّتِيْ يُقَاتِلُوْنَ عَلَىٰ أَبْوَابِ دِمَشْقَ، وَمَا حَوْلَهُ وَعَلَىٰ أَبْوَابِ بَيْتِ الْـمَقْدِسِ وَمَا حَوْلَهُ، لَايَضُرُّهُمْ خُذْلَانُ مَنْ خَذَلَـهُمْ ظَاهِرِيْنَ عَلَى الْـحَقِّ إِلَىٰ أَنْ تَقُوْمَ السَّاعَةُ، ‘আমার উম্মতের একটি দল দামেশকের ফটকে অথবা তার আশে-পাশে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের গেইটে অথবা তার চারপাশে জিহাদ করতে থাকবে। দুর্বৃত্তদের কোন প্রকার চক্রান্ত তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত সত্যের ওপর অবিচল থাকবে’।[13]
(৪) উমায়ের ইবনে হানী বলেন, ‘আমি মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ানকে এই মেম্বারের উপর খুৎবায় বলতে শুনেছি তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে বলতে শুনেছি যে, لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي قَائِمَةً بِأَمْرِ اللهِ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ أَوْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَهُمْ ظَاهِرُونَ عَلَى النَّاسِ فَقَامَ مَالِكُ بْنُ يَخَامِرٍ السَّكْسَكِيُّ، فَقَالَ: يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ سَمِعْتُ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ، يَقُولُ: وَهُمْ أَهْلُ الشَّامِ فَقَالَ مُعَاوِيَةُ: وَرَفَعَ صَوْتَهُ هَذَا مَالِكٌ، يَزْعُمُ أَنَّهُ سَمِعَ مُعَاذًا، يَقُولُ: وَهُمْ أَهْلُ الشَّامِ ‘আমার উম্মাতের একটি জামা‘আত আল্লাহর আদেশের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যারা তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবে বা বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোনই ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। এভাবে আল্লাহর আদেশ তথা কিয়ামত এসে পড়বে আর তারা তখনও লোকের উপর বিজয়ী থাকবে’। মালেক বিন ইখামের সাকসাকী দাঁড়িয়ে বললেন, হে আমীরুল মুমেনীন, আমি মু‘আয বিন জাবালকে বলতে শুনেছি, আর তারা হচ্ছে শামবাসী। তখন মু‘আবিয়া (রাঃ) উচ্চস্বরে বললেন, এই যে মালেক বলছে, সে মু‘আয (রাঃ) কে বলতে শুনেছে যে, তারা শামবাসী।[14]
৫। শাম মুমিনদের জন্য নিরাপদ স্থান :
শামদেশ মুমিনদের জন্য নিরাপদ বলে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে শামে মুমনিদের ঈমান নিরাপদ। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে,
(১) আব্দুল্লাহ ইবনু হাওয়ালাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,سَتَجِنُّوْنَ أَجْنَادًا، جُنْدًا بِالشَّامِ، وَجُنْدًا بِالْيَمَنِ، وَجُنْدًا بِالْعِرَاقِ তোমরা অচিরেই বিভিন্ন সেনাদলে বিভক্ত হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়ামনে, এবং একটি ইরাকে থাকবে। ইবনু হাওয়ালা (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে কোথায় থাকার পরামর্শ দিবেন?’ তিনি বললেন, عَلَيْكَ بِالشَّامِ، فَإِنَّهَا خِيرَةُ اللهِ مِنْ أَرْضِهِ، يَجْتَبِي إِلَيْهَا خِيرَتَهُ مِنْ عِبَادِهِ، فَإِنْ أَبَيْتُمْ فَعَلَيْكُمْ بِيَمَنِكُمْ، وَاسْقُوا مِنْ غُدُرِكُمْ، فَإِنَّ اللهَ تَوَكَّلَ لِي بِالشَّامِ وَأَهْلِهِ তোমরা শামে থাকো, কারণ এটি আল্লাহর পসন্দের ভূমি এবং সেখানে তিনি তাঁর পসন্দের বান্দাদের রাখবেন। তবে যদি তা সম্ভব না হয়, তাহ’লে ইয়ামানে থাকো এবং সেখানে তোমাদের পানির ব্যবস্থা কর। কারণ আল্লাহ আমাকে শামের এবং তার অধিবাসীদের বিষয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন’।[15]
(২) অন্য বর্ণনায় রয়েছে, জনৈক লোক বলল,يَا رَسُولَ اللهِ إِذَا كَانَ ذَلِكَ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَيْكَ بِالشَّامِ عَلَيْكَ بِالشَّامِ عَلَيْكَ بِالشَّامِ ثَلاَثاً، عَلَيْكَ بِالشَّامِ فَمَنْ أَبَى فَلْيَلْحَقْ بِيَمَنِهِ وَلْيَسْقِ مِنْ غُدُرِهِ فَإِنَّ اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى قَدْ تَكَفَّلَ لِى بِالشَّامِ وَأَهْلِهِ- ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে কোথায় থাকার পরামর্শ দিবেন?’ তিনি বললেন, তোমরা শামে থাকো, তোমরা শামে থাকো, তোমরা শামে থাকো, তিনি এ কথা তিনবার বললেন। আর যে শামে যেতে অস্বীকার করবে, সে যেন ইয়ামানে থাকে এবং সেখান থেকে তোমাদের পানির ব্যবস্থা করে। কারণ আল্লাহ আমাকে শামের এবং তার অধিবাসীদের বিষয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন’।[16]
(৩) সালামা ইবনু নুফায়ল কিন্দী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একদিন) আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি বললেন,يَا رَسُولَ اللهِ، أَذَالَ النَّاسُ الْخَيْلَ، وَوَضَعُوا السِّلَاحَ، وَقَالُوا: لَا جِهَادَ قَدْ وَضَعَتِ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ইয়া রাসূলাল্লাহ! লোকেরা ঘোড়ার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে, অস্ত্রশস্ত্র রেখে দিয়েছে এবং তারা বলছে, যুদ্ধ তার অস্ত্রশস্ত্র রেখে দিয়েছে (এখন আর জিহাদ নেই, জিহাদ শেষ হয়ে গেছে)। এ কথা শুনে তিনি তার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন,كَذَبُوا الْآنَ، الْآنَ جَاءَ الْقِتَالُ، وَلَا يَزَالُ مِنْ أُمَّتِي أُمَّةٌ يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ، وَيُزِيغُ اللهُ لَهُمْ قُلُوبَ أَقْوَامٍ، وَيَرْزُقُهُمْ مِنْهُمْ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ، وَحَتَّى يَأْتِيَ وَعْدُ اللهِ، وَالْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَهُوَ يُوحَى إِلَيَّ أَنِّي مَقْبُوضٌ غَيْرَ مُلَبَّثٍ، وَأَنْتُمْ تَتَّبِعُونِي أَفْنَادًا، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ، وَعُقْرُ دَارِ الْمُؤْمِنِينَ الشَّامُ তারা মিথ্যা বলছে। এখনই জিহাদের আদেশ এসেছে। আর সর্বদা আমার উম্মতের একটি দল দ্বীনের জন্য যুদ্ধ করতে থাকবে। এখনই আল্লাহ তাদের জন্য লোকের অন্তর ঘুরিয়ে দিবেন। আর আল্লাহ তাদেরকে ওদের দ্বারা রিযিক দান করবেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত। আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার ললাটের সাথে কল্যাণ ও মঙ্গলকে সম্পৃক্ত করে রেখেছেন। আমাকে এ কথা অহী দ্বারা জানানো হয়েছে যে, অচিরেই আমাকে তুলে নেয়া হবে (মৃত্যু হবে); (চিরদিন) আমাকে রাখা হবে না। আর তোমরা আমার পরে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। তোমরা একে অন্যের সাথে মারামারি কাটাকাটি করবে, এমন সময় ঈমানদারদের নিরাপদ ঠিকানা হবে শামে।[17]
৬। শাম হবে শেষ যামানায় মালহামা বা মহাযুদ্ধের ঘাটি :
শেষ যামানায় যে মালহামা বা মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে, সেই যুদ্ধে মুসলমানদের সেনাছাউনী হবে গূতা নামক একটি শহর, যা শামের সর্বোত্তম শহর দামেশকের নিকটবর্তী।[18]
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ فُسْطَاطَ الْمُسْلِمِيْنَ يَوْمَ الْمَلْحَمَةِ بِالْغُوْطَةِ إِلَى جَانِبِ مَدِيْنَةٍ يُقَالُ لَهَا دِمَشْقُ مِنْ خَيْرِ مَدَائِنِ الشَّامِ (দাজ্জাল ও তার বাহিনীর সাথে) যুদ্ধের দিন মুসলিমদের সমবেত স্থান (দুর্গ) হবে গূত্বাহ। তা দিমাশ্ক শহরের এক কিনারায় অবস্থিত। মূলতঃ শামের শহরসমূহের মাঝে দিমাশকই সর্বোত্তম শহর’।[19]
এই হাদীছের ব্যাখ্যায় আলকামী (রহঃ) বলেন, এ হাদীছের শেষ যামানায় দিমাশকের মর্যাদা ও তথাকার অধিবাসীর মর্যাদা প্রমাণিত হয়েছে। এ স্থান ফিৎনা থেকে রক্ষা পাওয়ার দুর্গ স্বরূপ। ইবনু আসাকির বলেন, ‘এর অন্যতম ফযীলত হ’ল এই যে, এখানে দশ হাযার ছাহাবী প্রবেশ করেছিলেন, যারা নবী করীম (ছাঃ)-কে দেখেছেন। নবী করীম (ছাঃ) সেখানে নবুঅতের আগে প্রবেশ করেছেন। আর পরে তাবুক যুদ্ধের সময় ও মি‘রাজের রাত্রিতে প্রবেশ করেন’।[20]
(২) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا وَقَعَتِ الْمَلَاحِمُ، بَعَثَ اللهُ بَعْثًا مِنَ الْمَوَالِي (من دمشق)، هُمْ أَكْرَمُ الْعَرَبِ فَرَسًا، وَأَجْوَدُهُ سِلَاحًا، يُؤَيِّدُ اللهُ بِهِمُ الدِّينَ ‘যখন বড় বড় যুদ্ধ সংঘটিত হবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা (দিমাশকের) মাওয়ালীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সেনাবাহিনী পাঠাবেন। তারা হবে সমগ্র আরবে সর্বাধিক দক্ষ অশ্বারোহী এবং উন্নততর সমরাস্ত্রে সজ্জিত। আল্লাহ তা‘আলা তাদের দ্বারা দ্বীন ইসলামের সাহায্য করবেন’।[21]
৭। দাজ্জাল ও ঈসা (আঃ)-এর আবির্ভাবস্থল :
শেষ যামানায় দাজ্জালের উত্থানও হবে এই এলাকায় এবং তার পরপরই আসবেন হযরত ঈসা (আঃ)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে’। অতঃপর তিনি বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহ ঈসা ইবনু মারিয়াম (আঃ)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেশকের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দু’জন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে, সে মারা যাবে, আর তাঁর দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন’।[22] রাসূল (ছাঃ) ঈসা (আঃ)-এর অবতরণস্থলের পরিচয় দিয়ে বলেন,إِذْ بَعَثَ اللهُ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ فَيَنْزِلُ عِنْدَ الْمَنَارَةِ الْبَيْضَاءِ شَرْقِيَّ دِمَشْقَ بَيْنَ مَهْرُودَتَيْنِ وَاضِعًا كَفَّيْهِ عَلَى أَجْنِحَةِ مَلَكَيْنِ ‘এ সময় আল্লাহ রাববুল আলামীন ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ)-কে প্রেরণ করবেন। তিনি দু’জন ফেরেশতার কাঁধের উপর ভর করে ওয়ারস ও জাফরান রং এর জোড়া কাপড় পরিহিত অবস্থায় দামেশক নগরীর পূর্ব দিকের উজ্জ্বল মিনারে অবতরণ করবেন’।[23]
৮। শামে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দাগণের মিলন মেলা :
ইসলামী বাহিনী শীঘ্রই কয়েকটি দলে বিভক্ত হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়ামেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ছাহাবী ইবনে হাওয়ালা (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি যদি সেই যুগ পাই, তখন আমি কোন দলটিতে যোগদান করব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,عَلَيْكَ بِالشَّامِ، فَإِنَّهَا خِيرَةُ اللهِ مِنْ أَرْضِهِ، يَجْتَبِي إِلَيْهَا خِيرَتَهُ مِنْ عِبَادِهِ، ‘তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে, কেননা তা আল্লাহর পসন্দনীয় ভূমির একটি। সেখানে তিনি তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট বান্দাদের একত্র করবেন’।[24]
৯। শামদেশ হবে হাশরের ময়দান :
শামের বিস্তৃত ভূমি হবে হাশরের ময়দান। পৃথিবীর এই ভূমি সীমাহীন হ’লেও ক্বিয়ামতের পূর্বে একটি আগুন বের হবে যা লোকদেরকে হাকিয়ে শামের ভূমিতে নিয়ে যাবে।
(১) আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে বায়তুল মাক্বদিসে ছালাত আদায় করা উত্তম, না মসজিদে নববীতে ছালাত আদায় করা উত্তম? তিনি বলেন, صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَرْبَعِ صَلَوَاتٍ فِيهِ، وَلَنِعْمَ الْمُصَلَّى فِي أَرْضِ الْمَحْشَرِ وَالْمَنْشَرِ وَلَيَأْتِيَنَّ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ وَلَقَيْدُ سَوْطٍ أَوْ قَالَ: قَوْسُ الرَّجُلِ حَيْثُ يَرَى مِنْهُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ خَيْرٌ لَهُ أَوْ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا جَمِيعًا এই মসজিদে ছালাত আদায় করা সেখানে চার ওয়াক্ত ছালাত আদায় অপেক্ষা উত্তম। হাশরের মাঠ এবং সকলের একত্রিত হওয়ার ময়দানের মুছাল্লা কতই না উত্তম। আর লোকদের উপর এমন একটি সময় আসবে যখন একটি চাবুকের ছড়ি বা তিনি বলেছিলেন, একজন মানুষের ধনুক পরিমাণ জায়গা যেখান থেকে পবিত্র ঘর বায়তুল মাক্বদিস দেখা যায় তার জন্য দুনিয়ার সকল কিছু অপেক্ষা উত্তম’।[25]
(২) অন্য বর্ণনায় এসেছে,يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى ثَلَاثِ طَرَائِقَ رَاغِبِينَ رَاهِبِينَ وَاثْنَانِ عَلَى بَعِيرٍ وَثَلَاثَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَأَرْبَعَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَعَشَرَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَيَحْشُرُ بَقِيَّتَهُمُ النَّارُ تَقِيلُ مَعَهُمْ حَيْثُ قَالُوا وَتَبِيتُ مَعَهُمْ حَيْثُ بَاتُوا وَتُصْبِحُ مَعَهُمْ حَيْثُ أَصْبَحُوا وَتُمْسِي مَعَهُمْ حَيْثُ أَمْسَوْا، ‘মানুষকে তিনভাবে একত্রিত করা হবে। (১) একদল লোককে আশা ও ভয় মিশ্রিত অবস্থায় হাঁকিয়ে নেয়া হবে। (২) দু’জনকে একটি উটের উপর, তিনজনকে একটি উটের উপর, চারজনকে একটি উটের উপর এবং দশজনকে একটি উটের উপর আরোহী অবস্থায় হাশরের দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। (৩) বাকী সব মানুষকে আগুন হাঁকিয়ে নিবে। মানুষ যেখানে দুপুরের বিশ্রাম নেয়ার জন্য অবস্থান করবে আগুনও সেখানে থেমে যাবে। মানুষ যে স্থানে রাত অতিবাহিত করার জন্য অবস্থান করবে আগুনও সেখানে থেমে যাবে। এরপর আবার তাদেরকে নিয়ে চলবে। তারা যেখানে সকাল করবে আগুনও সেখানে থেমে যাবে। তারা যেখানে বিকালে অবস্থান করবে আগুনও সেখানে অবস্থান করবে। এরপর আবার তাদেরকে হাঁকিয়ে নিবে’।[26]
নবী করীম (ছাঃ) বলেন,تَخْرُجُ نَارٌ مِنْ حَضْرَمَوْتَ فَتَسُوْقُ النَّاسَ ‘হাযরা মাওত থেকে একটি আগুন বের হবে অতঃপর মানুষকে হাঁকিয়ে নিবে’।[27] অন্য বর্ণনা এসেছে, আদানের গর্ত থেকে আগুন বের হবে এবং মানুষকে হাশরের দিকে তাড়িয়ে নিবে’।[28]
অন্য হাদীছে আছে, نَارٌ تَحْشُرُ النَّاسَ مِنْ الْمَشْرِقِ إِلَى الْمَغْرِب ‘একটি আগুন মানুষকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে জড়ো করবে’।[29] উক্ত হাদীছগুলোর মধ্যে এভাবে সমন্বয় করা সম্ভব যে, শাম হ’ল একত্রিত করার স্থান এবং এটি পূর্বের দেশগুলোর তুলনায় পশ্চিমে। অতএব ইয়ামানের আদানের গর্ত থেকে সর্বপ্রথম বের হবে। সেখান থেকে বের হয়ে পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়বে। অতঃপর পূর্বের বাসিন্দাদেরকে পশ্চিমে তথা শামে একত্রিত করবে। সুতরাং শাম হবে দুনিয়ার হাশরের যমীন। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, হাদীছগুলোর বর্ণনা প্রমাণ করে যে, এটি হবে আখেরী যামানায় দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমস্ত মানুষকে সিরিয়ার একটি স্থানে সমবেত করণ। তারা তিনভাগে বিভক্ত হবে। একশ্রেণীর লোক তখন পানাহার করবে, কাপড়-চোপড় পরিধান করবে এবং আরোহণ করবে। আরেক শ্রেণীর লোক কখনো পায়ে হেঁটে চলবে আবার কখনো আরোহণ করবে। তারা পালাক্রমে মাত্র একটি উটের উপর আরোহণ করবে। যেমন ছহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীছ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। দু’জন মিলে একটি উটের উপর আরোহণ করবে... তিনজন মিলে একটি উটের উপর আরোহণ করবে... দশজন একটি উটের উপর আরোহণ করবে। বাহন কম থাকায় এভাবেই তারা একই বাহনের উপর পালাক্রমে আরোহণ করবে। যেমনটি ইতিপূর্বে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে এবং হাদীছের শেষাংশে এসেছে যে, বাকীদেরকে আগুন হাঁকিয়ে নিবে। এ আগুনটি ইয়ামানের আদানের গর্ত থেকে বের হয়ে সমস্ত মানুষকে ঘেরাও করবে এবং প্রত্যেক দিক থেকে হাশরের যমীনের দিকে হাঁকিয়ে নিবে। যে কেউ পিছিয়ে থাকবে আগুন তাকে জ্বালিয়ে ফেলবে।[30]
১০। ঈমানের লালনভূমি শাম :
শামে ঈমান নিরাপদ থাকবে বলে একাধিক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنِّي رَأَيْتُ عَمُودَ الْكِتَابِ انْتُزِعَ مِنْ تَحْتِ وِسَادَتِي، فَنَظَرْتُ فَإِذَا هُوَ نُورٌسَاطِعٌ عُمِدَ بِهِ إِلَى الشَّامِ، أَلَا وَإِنَّ الْإِيمَانَ إِذَا وَقَعَتِ الْفِتَنُ بِالشَّامِ আমি (দিব্যদৃষ্টি বা স্বপ্নে) দেখলাম যে, কিতাবুল্লাহকে আমার বালিশের নীচ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমি স্পষ্টরূপে দেখলাম যে তা যেন এক উজ্জ্বল আলোতে রূপান্তরিত হ’ল, যা গিয়ে শামে স্থীর হ’ল। জেনে রেখো! যখন ফিৎনা ছড়িয়ে পড়বে তখন ঈমান শামেই অবস্থান করবে।[31] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘মি‘রাজের রাতে আমি মুক্তোর ন্যায় স্বেত-শুভ্র কিছু খুঁটি দেখতে পেলাম। যা ফেরেশতারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাঁদেরকে প্রশ্ন করলাম, আপনারা কি নিয়ে যাচ্ছেন? তারা জবাব দিলেন, ইসলামের খুঁটি। আমাদেরকে এটি শামে স্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[32]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,رَأَيْتُ عَمُودًا مِنْ نُورٍ خَرَجَ مِنْ تَحْتِ رَأْسِي سَاطِعًا حَتَّى اسْتَقَرَّ بِالشَّامِ،‘আমি (স্বপ্নে) দেখেছি, একটি আলোর খুঁটি আমার নীচ হ’তে বের হয়ে উপরে আলোকিত হয়েছে। অবশেষে তা শামে গিয়ে স্থির হয়ে গেছে’।[33]
১১। শামে খেলাফতের স্থানান্তর :
ক্বিয়ামতের পূর্বে খেলাফত শামে চলে যাবে। আব্দুল্লাহ বিন হাওয়ালা (রাঃ) বলেন, ‘একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার মাথার উপর স্বীয় হাত রেখে বললেন, يَا ابْنَ حَوَالَةَ، إِذَا رَأَيْتَ الْخِلَافَةَ قَدْ نَزَلَتْ أَرْضَ الْمُقَدَّسَةِ فَقَدْ دَنَتِ الزَّلَازِلُ وَالْبَلَابِلُ وَالْأُمُورُ الْعِظَامُ، وَالسَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنَ النَّاسِ مِنْ يَدِي هَذِهِ مِنْ رَأْسِكَ، ‘হে ইবনু হাওয়ালা! যখন তুমি দেখবে খেলাফত (মদীনা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে) পবিত্র ভূমিতে (শাম) পৌঁছে গেছে, তখন তুমি বুঝে নিবে যে, ভূমিকম্প, দুঃখ-দুর্দশা, বড় বড় নিদর্শনসমূহ খুবই কাছে এসে গেছে এবং আমার এই হাত তোমার মাথা থেকে যত নিকটে, ক্বিয়ামত সেদিন এটা অপেক্ষাও অতি নিকটবর্তী হবে’।[34]
উপসংহার : উপরোক্ত হাদীছগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, শামের ভূমি একটি বরকতময় পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি শুধু ইসলামের ঘাঁটি নয়, বরং এটি যেমন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমতের স্থান তেমনি এটিই হবে হাশরের ময়দান। শামের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে জানা আমাদের ঈমান ও ইসলামের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রেরণা যোগায়। আল্লাহ তা‘আলা শামকে হেফাযত করুন, আমাদেরকে শামের প্রতি ভালোবাসা দান করুন এবং তাঁর বরকত থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!
মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
[1]. বুখারী হা/৭০৯৪; মিশকাত হা/৬২৬২।
[2]. তিরমিযী হা/৩৯৫৪; ছহীহাহ হা/৫০৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩০৯৫।
[3]. মিরকাত ৯/৪০৩৯।
[4]. তুহফাতুল আহওয়াযী ১০/৩১৬।
[5]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৭৩০৫; ছহীহুত তারগীব হা/৩০৯৬।
[6]. আবূদাঊদ হা/২৪৮২; মিশকাত হা/৬২৬৬; ছহীহাহ হা/৩২০৩।
[7]. মিরকাতুল মাফাতীহ ৯/৪০৪০।
[8]. তিরমিযী হা/২৪২৪; ছহীহুত তারগীব হা/৩৫৮২।
[9]. হাকেম হা/৮৪১৩; ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৯৪৪৫।
[10]. তিরমিযী হা/২১৯২; ছহীহ মুসলিম হা/১০৩৭।
[11]. মুসলিম হা/১৯২৫; ছহীহাহ হা/৯৬৫।
[12]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ১৩/২৯৫; ছহীহাহ হা/৯৬৫-এর আলোচনা।
[13]. আবু ইয়া‘লা হা/৬৪১৭, আলবানী (রহ) এর সনদকে যঈফ বললেও মতন ছহীহ (যঈফাহ হা/৫৪১৯)।
[14]. আহমাদ হা/১৬৯৩২, সনদ ছহীহ।
[15]. আবুদাউদ হা/২৪৮৩; মিশকাত হা/৬২৬৭, সনদ ছহীহ।
[16]. আহমাদ হা/২০৩৭১; ছহীহুত তারগীব হা/৩০৮৮।
[17]. নাসাঈ হা/৩৫৬১; ছহীহাহ হা/১৯৩৫।
[18]. আবূদাউদ হা/৪২৯৮, সনদ ছহীহ।
[19]. মিরকাতুল মাফাতীহ ৯/৪০৪০; আবূদাঊদ হা/৪২৯৮; মিশকাত হা/৬২৭২; ছহীহুল জামে‘ হা/২১১৬)।
[20]. আযীমাবাদী, ‘আওনুল মা‘বূদ ১১/২৭৪।
[21]. ইবনু মাজাহ হা/৪০৯০; ছহীহাহ হা/২৭৭৭।
[22]. মুসলিম, হা/২৯৩৭।
[23]. মুসলিম হা/২৯৩৭; মিশকাত হা/৫৪৭৫।
[24]. আবূদাঊদ হা/২৪৮৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩০৮৭, সনদ ছহীহ।
[25]. ছহীহুত তারগীব হা/১৭৭৯।
[26]. বুখারী হা/৬৫২২; মিশকাত হা/৫৫৩৪।
[27]. আহমাদ হা/৪৫৩৬, সনদ ছহীহ।
[28]. আবুদাউদ হা/৪৩১১, সনদ ছহীহ।
[29]. বুখারী হা/৩৩২৯।
[30]. ইবনু কাছীর, আল-নিহায়াতু ফিল ফিতান ওয়াল মালাহিম ১/২৩০।
[31]. ছহীহুত তারগীব হা/৩০৯২।
[32]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৬৬৪৪, বর্ণনাকারীগণ ছিক্বাহ।
[33]. ত্বাবারানী, মুসনাদুশ শামেঈন হা/১৫৬৬; মিশকাত হা/৬২৭১, সনদ ছহীহ
[34]. আবুদাউদ হা/২৫৩৫; মিশকাত হা/৫৪৪৯, সনদ ছহীহ।