প্রকৃত ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ কারা?
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ যেহেতু হক্বপন্থী এবং মুক্তিপ্রাপ্ত দল হিসাবে স্বীকৃত, সেজন্য ইসলামের নামে খন্ড-বিখন্ড হওয়া অনেক দলই দাবী করে যে, তারাও এই হক্বপন্থী দলভুক্ত। যেমন ভারত উপমহাদেশের ব্রেলভী সম্প্রদায় অসংখ্য শিরক-বিদ‘আতের ধারক ও বাহক হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ দাবী করে। সুতরাং মৌখিক দাবী গ্রহণযোগ্য নয়; বরং কারা প্রকৃতপক্ষে এই দলভুক্ত হবে বা হবে না, তা যথাযথ মূলনীতির ভিত্তিতে যাচাই করা আবশ্যক।
ড. নাছের আশ-শায়খ বলেন, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতভুক্ত
তারাই হবেন, যারা কিতাব ও সুন্নাতকে মযবূতভাবে ধারণকারী এবং কথা ও কাজে
এতদুভয়ের যথাযথ অনুসারী। তাদের আক্বীদা ও বিশ্বাস কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক
এবং সেই মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত যে মানহাজের অনুসারী ছিলেন ছাহাবায়ে
কেরাম, তাবেঈগণ ও জনসমাজে প্রভূত সুখ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনকারী তাঁদের
উত্তরসূরী ইমামগণ। একই সাথে যারা বিদ‘আতী আখ্যা পাননি এবং খারেজী, রাফেযী,
ক্বাদারিয়া, মুরজিয়া, জাবারিয়া, মু‘তাযিলা, কার্রামিয়া প্রভৃতি নিন্দিত
অভিধায় ভূষিত হননি।[1]
স্মর্তব্য যে, ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর দু’টি অর্থ হয়। যেমন সাধারণভাবে পরিভাষাটি রাফেযী শী‘আদের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই অর্থ মোতাবেক শী‘আ ব্যতীত সকল সম্প্রদায়ের মুসলমানই ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর অন্তর্ভুক্ত। তবে বিশেষার্থে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝায় যারা কুরআন ও সুন্নাহর সনিষ্ঠ অনুসারী এবং যাবতীয় বিদ‘আত পরিহারকারী। যারা আক্বীদার ক্ষেত্রে যাবতীয় সন্দেহ ও সংশয়ের পথ থেকে বেঁচে থাকে। সুতরাং যারা এদের বিপরীতে বিদ‘আতকে প্রশ্রয় দেয় এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা এই দল বহির্ভূত। ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর এই বিশেষ অর্থটিই বিদ্বানগণের নিকট প্রসিদ্ধ।
যেমন ইমাম ইবনু তায়মিয়া
(৬৬১-৭২৮হিঃ) বলেন, فَلَفْظُ "أَهْلِ السُّنَّةِ" يُرَادُ بِهِ مَنْ
أَثْبَتَ خِلَافَةَ الْخُلَفَاءِ الثَّلَاثَةِ، فَيَدْخُلُ فِيْ ذَلِكَ
جَمِيْعُ الطَّوَائِفِ إِلَّا الرَّافِضَةَ، وَقَدْ يُرَادُ بِهِ أَهْلُ
الْحَدِيثِ وَالسُّنَّةِ الْمَحْضَةِ، فَلَا يَدْخُلُ فِيهِ إِلَّا مَنْ
يُثْبِتُ الصِّفَاتِ لِلَّهِ تَعَالَى وَيَقُولُ: إِنَّ الْقُرْآنَ غَيْرُ
مَخْلُوقٍ، وَإِنَّ اللَّهَ يُرَى فِي الْآخِرَةِ، وَيُثْبِتُ الْقَدْرَ،
وَغَيْرَ ذَلِكَ مِنَ الْأُصُولِ الْمَعْرُوفَةِ عِنْدَ أَهْلِ الْحَدِيثِ
وَالسُّنَّةِ ‘আহলুস সুন্নাহ’ অর্থ হ’ল, যারা (প্রথম) তিন খলীফার খিলাফতকে
স্বীকৃতি প্রদান করে। এই সংজ্ঞায় রাফেযী ব্যতীত সকল সম্প্রদায়ই
অন্তর্ভুক্ত। আর এর অর্থ এটাও হয় যে, তারা হ’ল ‘আহলুল হাদীছ ও সুন্নাহ’ তথা
কুরআন ও সুন্নাহর নিঃশর্ত অনুসারী। এই দলে কেবল তারাই অন্তর্ভুক্ত হ’তে
পারে যারা আল্লাহর গুণসমূহকে স্বীকার করে এবং বলে যে, কুরআন আল্লাহর
মাখলূক্ব বা সৃষ্টবস্ত্ত নয় এবং পরকালে আল্লাহকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা
যাবে। যারা তাক্বদীরকে স্বীকার করে এবং আরও স্বীকার করে সে সমস্ত বিষয় যা
‘আহলুল হাদীছ ওয়াস সুন্নাহ্’র স্বীকৃত মূলনীতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।[2]
সুতরাং ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ তারাই হবেন, যারা রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের গৃহীত মানহাজের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। যারা রাফেযী নন এবং খারেজী, মুরজিয়া, ক্বাদারিয়া, মু‘তাযিলা প্রবৃত্তির অনুসারী ও বিদ‘আতী দল-উপদলসমূহের আক্বীদা-বিশ্বাস থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত।
‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র বিভিন্ন নাম এবং অভিধাসমূহ :
‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’ নির্দিষ্ট কোন দলের নাম নয়। নয় নির্দিষ্ট কোন সময় বা স্থানে সীমাবদ্ধ কোন সম্প্রদায়ের নাম। বরং প্রত্যেক যে ব্যক্তি আহলে সুন্নাতের বৈশিষ্ট্যধারী হবে এবং তাদের গৃহীত মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সে-ই ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ হিসাবে গণ্য হবে। নিম্নে এই জামা‘আতের বিভিন্ন নাম ও অভিধাগুলো উল্লেখ করা হ’ল।-
(ক) সালাফ :
শাব্দিক অর্থ : আরবী
السلف শব্দটি السالف শব্দের বহুবচন। যার অর্থ পূর্ববর্তী। অর্থাৎ যে
বস্ত্ত স্বীয় অস্তিত্বে অন্যের পূর্বে হয়। ইবনুল আছীর (৫৫৫-৬৩০হিঃ) বলেন,
سلف الإنسان বলতে বুঝায় কোন ব্যক্তির পূর্বসূরী পিতা-মাতা বা অন্যান্য
আত্মীয়-স্বজন, যারা মৃত্যুবরণ করেছেন। এজন্য তাবেঈদের মধ্যে যারা প্রথম
সারির, তাদেরকে ‘সালাফে ছালিহীন’ বলা হয়।[3] পবিত্র
কুরআনে ‘সালাফ’ শব্দটি এই অর্থেই এসেছে। যেমন আল্লাহ বলেন, فَجَعَلْنَاهُمْ
سَلَفًا وَمَثَلًا لِلْآخِرِينَ ‘আমি তাদেরকে পরবর্তীদের জন্য অতীত নমুনা ও
দৃষ্টান্তস্বরূপ করে রাখলাম’ (যুখরুফ ৫৬)। অনুরূপভাবে রাসূল
(ছাঃ)-এর যবানীতেও একই অর্থে শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন রাসূল (ছাঃ)
মৃত্যুকালে ফাতিমা (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন,وَلاَ أَرَى الْأَجَلَ
إِلَّا قَدِ اقْتَرَبَ، فَاتَّقِي اللهَ وَاصْبِرِي، فَإِنِّي نِعْمَ
السَّلَفُ أَنَا لَك ‘আমার মনে হয়, আমার চিরবিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
সুতরাং (তোমার প্রতি উপদেশ হ’ল) তুমি আল্লাহকে ভয় করে চলবে এবং বিপদে
ধৈর্যধারণ করবে। নিশ্চয়ই আমি তোমার জন্য উত্তম অগ্রগামী (পূর্বসুরী)’।[4]
পারিভাষিক অর্থ :
‘সালাফ’ কারা- এ বিষয়ে বিদ্বানদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যেমন :
তবে
কেবলমাত্র ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈগণই নন বরং পরবর্তীকালে যারাই
দ্বীনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রশংসিত তিন যুগের অনুসৃত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত
থেকেছেন, তাদেরকে বিদ্বানগণ সালাফী বা সালাফদের অনুসারী হিসাবে গণ্য
করেছেন। যেমন ইমাম আল-আজুর্রী (২৮০-৩৬০হিঃ) তাদের পরিচয় ব্যক্ত করে বলেন,
علامة من أراد الله به خيرا: سلوك هذا الطريق كتاب الله، وسنن رسول الله
صلى الله عليه وسلم وسنن أصحابه ومن تبعهم بإحسان، وما كان عليه أئمة
المسلمين في كل بلد إلى آخر ما كان من العلماء مثل الأوزاعي وسفيان الثوري
ومالك بن أنس، والشافعي، وأحمد بن حنبل، والقاسم بن سلام، ومن كان على مثل
طريقتهم، ومجانبة كل مذهب يذمه هؤلاء العلماء ‘আল্লাহ যাদের কল্যাণ চান,
তাদের নিদর্শন হ’ল, তাদের চলার পথ হবে- আল্লাহর কিতাব, রাসূল (ছাঃ)-এর
সুন্নাত, ছাহাবীদের সুন্নাত এবং তাদেরকে যারা যথাযথভাবে অনুসরণ করেন এবং যে
নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বিভিন্ন শহরের মুসলিম ইমামগণ তথা আওযাঈ,
সুফিয়ান ছাওরী, মালেক বিন আনাস, শাফেঈ, আহমাদ বিন হাম্বল, কাসেম বিন সালাম
প্রমুখ বিদ্বান এবং যারা তাদের অনুরূপ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং উক্ত
বিদ্বানগণ কর্তৃক নিন্দিত মাযহাব ও মতাদর্শসমূহ থেকে দূরত্ব বজায় রাখে’।[7]
ইমাম
যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮হিঃ) তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’তে হাদীছ
বর্ণনাকারীদের পরিচয় দানকালে অনেক স্থানেই বলেছেন, তিনি ‘সালাফদের মাযহাব
অনুসরণকারী’ বা ‘সালাফী’ বা অনুরূপ কিছু বাক্যসমূহ। যেমন তিনি ইমাম আবূদাউদ
(২০২-২৭৫হিঃ)-এর জীবনীতে লিখেছেন, وكان على مذهب السلف في اتباع السنة
والتسليم لها، وترك الخوض في مضائق الكلام ‘তিনি ছিলেন সুন্নাতের অনুসরণে ও
সুন্নাতের প্রতি আত্মসমর্পণে এবং কালাম বা বিতর্কশাস্ত্রের অলিগলিতে বিচরণ
পরিত্যাগে সালাফদের মাযহাবের উপর প্রতিষ্ঠিত’।[8]
অনুরূপভাবে
তিনি ইমাম দারাকুৎনী (৩০৬-৩৮৫হিঃ)-এর জীবনীতে লিখেছেন, لم يدخل الرجل أبدا
في علم الكلام ولا الجدال، ولا خاض في ذلك، بل كان سلفيا، ‘এই ব্যক্তি
কখনও ইলমুল কালাম ও তর্কশাস্ত্রের বেড়াজালে নিপতিত হননি। কখনও এতে মগ্ন
হননি। বরং তিনি ছিলেন একজন সালাফী।[9]
তিনি
অন্যত্র বলেন, فإن أحببت يا عبد الله الإنصاف فقف مع نصوص القرآن والسنن
ثم انظر ما قاله الصحابة والتابعون وأئمة التفسير في هذه الآيات وما حكوه
من مذاهب السلف فإما أن تنطق بعلم وإما أن تسكت بحلم، ‘হে আল্লাহর বান্দা!
যদি তুমি ন্যায়পরতাকে ভালবাসো, তবে কুরআন ও সুন্নাহর নছগুলো পাঠ কর। অতঃপর
দেখ ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাফসীর শাস্ত্রের ইমামগণ সে সকল আয়াত সম্পর্কে কি
বলেছেন এবং সালাফদের মাযহাবের অনুসারীরা সে বিষয়ে কি বর্ণনা করেছেন। তুমি
হয় জ্ঞানের সাথে কথা বল, নতুবা ধৈর্যের সাথে চুপ থাক’।[10]
এখানে বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, তিনটি প্রশংসিত যুগের ব্যক্তি হ’লেই যে তিনি সালাফ এবং অনুসরণযোগ্য হবেন তা নয়; কেননা প্রথম তিনটি যুগেও বিদ‘আতপন্থী ও প্রবৃত্তিপরায়ণ ব্যক্তিদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। সুতরাং এই প্রশংসিত তিন যুগের সালাফ বলতে তাদেরকেই বুঝাবে যারা কুরআন এবং সুন্নাতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। অন্যথায় কুরআন ও সুন্নাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তিনি মোটেও সালাফ হবেন না, যদিও তিনি প্রশংসিত যুগ সমূহের সমসাময়িক ব্যক্তি হন না কেন।
সুতরাং
সালাফী মানহাজের সংজ্ঞা হ’ল- এটি এমন একটি পথ যে পথের অনুসরণে রাসূল (ছাঃ)
এবং তাঁর ছাহাবীদের অনুসৃত নীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা যায় বা রাসূল
(ছাঃ)-এর অনুসরণ ও তাঁর সুন্নাতের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য ছাহাবীদের
অনুসৃত পথই সালাফী মানহাজ।[11]
শামসুদ্দীন
আস-সাফারীনী (মৃ. ১১৮৮হিঃ) সালাফী মানহাজের সবচেয়ে উপযুক্ত সংজ্ঞা দিয়ে
বলেন,المراد بمذهب السلف ما كان عليه الصحابة الكرام رضوان الله عليهم
وأعيان التابعين لهم بإحسان وأتباعهم وأئمة الدين ممن شهد له بالإمامة،
وعرف عظم شأنه في الدين، وتلقى الناس كلامهم خلف عن سلف، دون من رمي ببدعة،
أو شهر بلقب غير مرضي مثل الخوارج والروافض والقدرية والمرجئة والجبرية
والجهمية والمعتزلة والكرامية، ونحو هؤلاء ‘সালাফদের মাযহাব অর্থ হ’ল সেই
মাযহাব যার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাবে-তাবেঈগণ ও তাঁদের
উত্তরসূরী ইমামগণ, যারা কিনা দ্বীনের ক্ষেত্রে উচ্চমর্যাদা ও ব্যাপক
গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। সেই সাথে যারা বিদ‘আতী আখ্যা পাননি এবং খারেজী,
রাফেযী, ক্বাদারিয়া, মুরজিয়া, জাবারিয়া, জাহমিয়া, মু‘তাযিলা, কার্রামিয়া
প্রভৃতি নিন্দিত অভিধায় ভূষিতও হননি’।[12]
সুতরাং প্রথমত ছাহাবী, তাবেঈ এবং কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী তাদের অনুবর্তী তাবে-তাবেঈগণ হ’লেন সালাফে ছালেহীন। অতঃপর পরবর্তীকালে তাদের পদাংক অনুসারীগণ এবং কুরআন ও সুন্নাহ অনুধাবনে তাদের পদ্ধতি ও মানহাজ অনুসরণকারীরাও সালাফী।
পূর্বকাল থেকেই বিদ্বানগণ ছাহাবী এবং তাঁদের পদাংক অনুসারীদেরকে চিহ্নিত করতে সালাফী পরিভাষাটি ব্যবহার করতেন। যেমন :
‘সালাফী’ হিসাবে নিজেকে পরিচয় দেয়াকে কোন বিদ্বান নিন্দা করেননি; বরং প্রশংসা করেছেন। যেমন ইবনু তায়মিয়া (৬৬১-৭২৮হিঃ) বলেন,لا عيب على من أظهر مذهب السلف وانتسب إليه واعتزى إليه بل يجب قبول ذلك منه بالاتفاق. فإن مذهب السلف لا يكون إلا حقا، ‘কোন ব্যক্তির সালাফদের মানহাজকে প্রকাশ করা এবং নিজেকে সালাফদের প্রতি সম্পৃক্ত ও সম্বন্ধিত করায় দোষের কিছু নেই। বরং তার এই কর্ম সর্বসম্মতভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়াই আবশ্যক। কেননা সালাফদের মাযহাব হক্ব বৈ কিছু নয়’।[16]
বিদ্বানদের
অনেকেই নিজেকে সালাফী হিসাবে পরিচয় দিয়েছেন। যেমন ইমাম সাম‘আনী
(৫০৬-৫৬২হিঃ), ইবনুল আছীর (৫৫৫-৬৩০হিঃ) প্রমুখ অনুরূপ অনেকের নাম উল্লেখ
করেছেন, যারা নিজেদের নামের সাথে ‘সালাফী’ লক্বব ব্যবহার করেছেন।[17]
বর্তমান যুগেও শায়খ আব্দুর রহমান আল-মু‘আল্লিমী (১৮৯৪ -১৯৬৬খ্রি.), শায়খ নাছেরুদ্দীন আলবানী (১৯১৪-১৯৯৯খ্রি.), শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (১৯১০-১৯৯৯খ্রি.) প্রমুখ বিদ্বানগণ নিজেদেরকে সালাফী হিসাবে অভিহিত করেছেন।
সর্বোপরি
এটাই চিরন্তন সত্য যে, সালাফদের গৃহীত মানহাজই সর্বোত্তম মানহাজ। তাঁরা যে
ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, সেই ইসলামই হ’ল বিশুদ্ধ ইসলাম। অতএব তাঁদের
অনুসরণের মাঝেই হক্ব নিহিত রয়েছে। কোন জ্ঞানপাপী ব্যতীত কেউ তা অস্বীকার
করতে পারে না। ইবনু তায়মিয়া (৬৬১-৭২৮হিঃ) যথার্থই বলেছেন, ‘যারা কুরআন ও
সুন্নাতকে নিয়ে যথাযথভাবে চিন্তা-গবেষণা করে এবং যে বিষয়ে ‘আহলে সুন্নাত
ওয়াল জামা‘আত’ একমত তা হ’ল- কথায়, কর্মে এবং বিশ্বাসে মুসলিম উম্মাহর
শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম ছিলেন প্রথম প্রজন্মের মুসলমানরা। অতঃপর হাদীছের বর্ণনা
মোতাবেক পর্যায়ক্রমে তাদের যারা নিকটবর্তী যুগের ছিলেন, যেমনভাবে রাসূল
(ছাঃ)-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা জ্ঞান, আমল, প্রজ্ঞা, দ্বীনদারী,
সত্যবাদিতা, ইবাদত তথা মর্যাদায় ও গুণাবলীতে সর্বদিক থেকে ‘খালাফ’ তথা
পরবর্তীদের চেয়ে উত্তম ছিলেন। প্রতিটি ধর্মীয় সমস্যার সমাধানে তাঁরাই বেশী
অগ্রগণ্য। দ্বীনের অবশ্য জ্ঞাতব্য বিষয়গুলিকে অস্বীকারকারী ব্যতীত কারো
পক্ষে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।[18]
সবশেষে
ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, من كان منكم
متأسيا فليتأس بأصحاب محمد صلى الله عليه وسلم؛ فإنهم كانوا أبر هذه الأمة
قلوبا وأعمقها علما وأقلها تكلفا وأقومها هديا وأحسنها حالا، قوما اختارهم
الله تعالى لصحبة نبيه صلى الله عليه وسلم، فاعرفوا لهم فضلهم واتبعوهم في
آثارهم؛ فإنهم كانوا على الهدى المستقيم- ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি
অনুসরণকারী হ’তে চায় সে যেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের অনুসরণ করে।
কেননা তাঁরা ছিলেন মন-মানসিকতায় এ উম্মতের সর্বাধিক পুণ্যবান, গভীর জ্ঞানের
অধিকারী, সর্বাধিক কৃত্রিমতা পরিহারকারী, হেদায়াতের উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং
সর্বোত্তম অবস্থা সম্পন্ন। তাঁরা ছিলেন এমন সম্প্রদায় যাদেরকে আল্লাহ তাঁর
নবীর ছাহাবী হিসাবে মনোনীত করেছেন। অতএব তাদের মর্যাদা সম্পর্কে অবগত হও
এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। কেননা তাঁরা সঠিক হেদায়াতের উপরে প্রতিষ্ঠিত
ছিলেন’।[19]
সুতরাং ‘সালাফ’ এবং ‘সালাফ’দের অনুসরণকারী অর্থে ‘সালাফী’ অভিধাটি ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত’-এর সমার্থক লক্বব হিসাবে সুবিদিত।
(ক্রমশঃ)
[1]. ড. নাছের হাসান, আক্বীদাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, ১/২৯ পৃঃ।
[2]. ইবনু তায়মিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২১।
[3]. ইবনুল আছীর, আন-নিহায়াতু ফী গারীবিল হাদীছ, ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৯০।
[4]. বুখারী হা/৬২৮৫; মুসলিম হা/২৪৫০; ইবনু মাজাহ হা/১৬২১।
[5]. ছালেহ আদ-দাখীল, খাছায়েছু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ১২৬-১২৭।
[6]. বুখারী হা/৩৬৫১; মুসলিম হা/২৫৩৩।
[7]. আবূবকর আল-আজুর্রী, আশ-শারী‘আহ, ১/৩০০ পৃঃ।
[8]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৩/২১৬ পৃঃ।
[9]. প্রাগুক্ত, ১৬/৪৫৭ পৃঃ।
[10]. শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, আল-উলু লিল আলিইল আকবার, পৃঃ ১৩।
[11]. ড. মুহাম্মাদ বিন ওমর বাযমূল, আল-মানহাজুস সালাফী তা‘রীফুহু ওয়া সিমাতুহু ওয়া দাওয়াতুহুল ইছলাহিয়াহ, পৃঃ ৪।
[12]. শামসুদ্দীন আস-সাফারীনী, লাওয়ামিঊল আনওয়ার আল-বাহিয়াহ, ১/২০ পৃঃ।
[13]. মুকাদ্দামা ছহীহ মুসলিম, ১/১৬ পৃঃ।
[14]. আবূবকর আল-আজুর্রী, আশ-শারী‘আহ, ২/৬৭৩ পৃঃ।
[15]. প্রাগুক্ত, ১/৪৪৫ পৃঃ।
[16]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৪/১৪৯ পৃঃ।
[17]. আব্দুল করীম আস-সাম‘আনী, আল-আনসাব, ২/২৬০ পৃঃ; ইবনুল আছীর, আল-লুবাব ফী তাহযীবীল আনসাব, ২/১২৬ পৃঃ।
[18]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘উল ফাতাওয়া, ৪/১৫৭-১৫৮ পৃঃ।
[19]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/৯৪৭ পৃঃ।