পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । শেষ পর্ব ।
ঈমান
ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ঈমান ব্যতীত মানুষ তার কোন সৎ আমলের প্রতিদান
পরকালে লাভ করতে পারবে না। আবার ঈমানহীন মানুষ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে
চিরকাল। তাই ঈমানকে ইসলামের মূল খুঁটি বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ নিবন্ধে
ঈমান সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
ঈমানের আভিধানিক অর্থ : ঈমানের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, নিরাপত্তা দেওয়া, আশঙ্কা মুক্ত করা। এর বিপরীত হচ্ছে ভয়-ভীতি।[1] রাগেব আল-ইছফাহানী বলেন, ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া।[2]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে
স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস
পোষণ ও আমলের মাধ্যমে।[3]
ঈমানের শারঈ অর্থ :
পারিভাষিক অর্থে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট ঈমান হল মূল ও শাখাসহ
হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। প্রথম
দু’টি মূল ও শেষেরটি হ’ল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না।[4]
ঈমানের শারঈ অর্থে পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ যখনই সে পাঁচটি বিষয় তার জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই সে একজন ঈমানদার ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হবে, নচেৎ নয়।
(১) অন্তরের কথা অর্থাৎ অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস পোষণ করা। মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ، لَهُمْ مَا يَشَاءُوْنَ عِنْدَ رَبِّهِمْ ذَلِكَ جَزَاءُ الْمُحْسِنِيْنَ-
‘যারা সত্যসহ উপস্থিত হয়েছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে তারাই তো মুত্তাক্বী, তারা যা চাইবে সব কিছুই আছে তাদের প্রতিপালকের নিকট। এটাই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান’ (যুমার ৩৯/৩৩-৩৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوقِنِيْنَ ‘এমনিভাবেই আমিই ইব্রাহীমকে আসমান ও যমীনের রাজত্ব অবলোকন করিয়েছি, যাতে সে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (আন‘আম ৬/৭৫)।
তিনি আরো বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا- ‘তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করে না’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)।
মুমিন ব্যক্তির বিশ্বাসে কোন সন্দেহের লেশমাত্র থাকে না। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে এবং যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও পুণ্য বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে। আর যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে’।[5] হাদীছের অর্থ এই নয় যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ে বসে থাকবে। বরং অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল দ্বারাই একজন মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়। যা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দ্বারা বুঝা যায়।
(২) মুখে উচ্চারণ অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহর মুখে স্বীকৃতি প্রদান করা, উচ্চারণ করে পড়া এবং আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। মহান আল্লাহ বলেন,
قُولُواْ آمَنَّا بِاللهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالأسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ-
‘তোমরা বল, আমরা ঈমান রাখি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব এবং তাদের বংশধরের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং মূসা ও ঈসা-কে যা প্রাদান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য নবীগণকে তাদের প্রভু হ’তে যা দেয়া হয়েছিল। আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৩৬)।
মহান আল্লাহ বলেন, وَإِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ قَالُوا آمَنَّا بِهِ إِنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّنَا ‘যখন তাদের নিকট এটা আবৃত্তি করা হয় তখন তারা বলে, আমরা এতে ঈমান আনি। এটা আমাদের প্রতিপালক হ’তে আগত সত্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৩)। তিনি আরো বলেন, وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ مِنْ كِتَابٍ ‘বল, আল্লাহ যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস করি’ (শূরা ৪২/১৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, إِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ ‘তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে সত্যের সাক্ষ্য দেয় তারা ব্যতীত’ (যুখরুফ ৪৩/৮৬)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ ‘যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ এবং এই বিশ্বাসে অবিচল থাকে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (আহক্বাফ ৪৬/১৩)।
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মা‘বূদ নেই ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল। আর ছালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হ’তে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল। অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন হক থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত’।[6] উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াত এবং হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট হ’ল যে, ঈমান অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ ও তদনুযায়ী আমল করা। এই তিনটি বস্ত্তর সমন্বয়েই খাঁটি মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়।
(৩) অন্তরের আমল অর্থাৎ নিয়ত করা। কারণ সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাছ থাকা। কারণ ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করতে হবে। ভালবাসা, আনুগত্য, আশা-ভরসা ইত্যাদি সবই আল্লাহর জন্য হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ ‘আর যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে ঠেলে দিও না’ (আন‘আম ৬/৫২)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসাবে নয়, বরং তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায়’ (লাইল ৯৩/১৯-২০)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَاناً وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ-
‘নিশ্চয় মুমিনরা এরূপ যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সেই আয়াত সমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (আনফাল ৮/২)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوْا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে- এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে’ (মুমিনূন ২৩/৬০)।
উল্লিখিত আয়াত সমূহ থেকে এবং অন্যান্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর উপর ভরসা, ভয়-ভীতি, আশা-আকাংখা, বিনয়-নম্রতা, আল্লাহর দিকে রুজূ হওয়া ইত্যাদি অন্তরের আমল।
(৪) জিহবা বা মুখের মাধ্যমে আমল। কুরআন তেলাওয়াত, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাকবীর, দো‘আ-ইস্তেগফার ইত্যাদি মুখের ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّن تَبُورَ-
‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, ছালাত কায়েম করে, আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে তাদের এমন ব্যবসায়ের যার ক্ষয় নেই’ (ফাতির ৩৫/২৯)। তিনি আরো বলেন, وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ ‘তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট তোমার প্রতিপালকের কিতাব আবৃত্তি কর; তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউই নেই’ (কাহফ ১৮/২৭)।
অন্যত্র তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللهَ ذِكْراً كَثِيراً، وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর’ (আহযাব ৩৩/৪১-৪২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَاسْتَغْفِرُوا اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ‘তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (মুয্যাম্মিল ৭৩/২০)।
এসব দলীল এবং অন্যান্য আরো দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুখের মাধ্যমে উচ্চারণ করে বা পড়ে যেসব আমল করা হয় তা সবই মৌখিক ইবাদতের মধ্যে শামিল হবে।
(৫) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। রুকূ-সিজদা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা, মসজিদের দিকে ছালাতের জন্য রওয়ানা হওয়া, হজ্জ আদায় করা, ছিয়াম পালন করা, আল্লাহর দ্বীন সমুন্নত করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ইত্যাদি যত প্রকার আমল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা করা হয় সবই এর মধ্যে শামিল হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে (ছালাতে) দন্ডায়মান হও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ، وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা রুকূ কর, সিজদা কর, তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকর্ম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। আর আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত’ (হজ্জ ২২/৭৭-৭৮)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً-
‘আর রহমানের বান্দা তারাই যারা
(আল্লাহর) যমীনে বিনীতভাবে চলাফেরা করে এবং যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে
সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম (শান্তি)। আর তারা রাত্রি অতিবাহিত করে
তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদারত অবস্থায় ও দন্ডায়মান হয়ে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৪)। এ সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আরো অনেক দলীল বর্ণিত হয়েছে।[7]
ইমাম
মুহাম্মাদ হুসাইন আল-আজুর্রী বলেন, ঈমান হচ্ছে অন্তরের বিশ্বাস, মুখের
স্বীকৃতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি
বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে সে প্রকৃত ঈমানদার। এরপর তিনি বলেন, জেনে রেখ আল্লাহ
তোমাদের ও আমাদের উপর রহম করুন! মুসলমানদের আলেমগণ যে কথার উপর অটল আছেন
সেটা হ’ল, ঈমানের (অর্থ হচ্ছে) অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি,
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করা সকল সৃষ্টির উপর ওয়াজিব। অতঃপর তিনি
বলেন, জেনে রেখ, অন্তরের বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না
তার সাথে মুখের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তরের বিশ্বাস ও
মুখের স্বীকৃতি পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল
করবে। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান সেই প্রকৃত ঈমানদার
হ’তে পারবে। আর এর উপরেই কুরআন ও হাদীছের দলীল এবং মুসলমান আলেমদের কথা
প্রমাণিত রয়েছে।[8]
মোদ্দাকথা আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব সমূহের প্রতি, নবী-রাসূলদের প্রতি, পরকালের প্রতি, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনতে হবে।
ভ্রান্ত ফিরকাসমূহের দৃষ্টিতে ঈমান :
খারেজীগণ
তিনটি বিষয়কেই (অর্থাৎ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়ন)
ঈমানের মূল হিসাবে গণ্য করেন। সেকারণে কবীরা গোনাহগার ব্যক্তি তাদের মতে
কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী। মুরজিয়াদের বারোটি উপদলের মধ্যে কাররামিয়াগণ
বিশ্বাস ও আমল ছাড়াই কেবল মুখের ‘স্বীকৃতি’ ঈমানের জন্য যথেষ্ট মনে করেন।
সাধারণ মুরজিয়াগণ ‘বিশ্বাস ও স্বীকৃতি’কে ঈমান বলে থাকেন।[9] ইমাম আবু
হানীফা ও কিছু সংখ্যক ফক্বীহ ‘আমল’কে ঈমানের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেননি; বরং
‘ঈমানের বাস্তব পদ্ধতি’ (شرائع الإيمان) বলে মনে করেন।[10]
ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি :
কুরআন-হাদীছের বিভিন্ন দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, ঈমান বাড়ে ও কমে।
কুরআন থেকে দলীল :
(১) মহান আল্লাহ বলেন,
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُواْ لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَاناً وَقَالُواْ حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ-
‘যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, নিশ্চয়ই তোমাদের বিরুদ্ধে লোকজন সমবেত হয়েছে, অতএব তোমরা তাদেরকে ভয় কর। এতে তাদের বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি হয়েছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্ম বিধায়ক’ (আলে ইমরান ৩/১৭৩)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘নিশ্চয় মুমিনরা এরূপ যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে, আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হয় তখন সেই আয়াত সমূহ তাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (আনফাল ৮/২)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
وَإِذَا مَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُم مَّن يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَـذِهِ إِيمَاناً فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُواْ فَزَادَتْهُمْ إِيمَاناً وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ-
‘আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের মধ্যে কিছু লোক বলে, তোমাদের মধ্যে এই সূরা কার ঈমান বৃদ্ধি করল? অনন্তর যেসব লোক ঈমান এনেছে, এই সূরা তাদের ঈমানকে বর্ধিত করেছে এবং তারাই আনন্দ লাভ করেছে’ (তাওবা ৯/১২৪)।
হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) বলেন, এ
আয়াতটিই সর্বাধিক বড় দলীল যে, ঈমান বাড়ে এবং কমে। আর এটিই হচ্ছে অধিকাংশ
উত্তরসূরী ও পূর্বসূরী বিদ্বান এবং ওলামায়ে কেরাম ও আইম্মায়ে কেরামর মত।[11]
(২) হেদায়াত বৃদ্ধি : হিদায়াত হচ্ছে ঈমান। মহান আল্লাহ বলেন,
وَيَزِيدُ اللهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَاباً وَخَيْرٌ مَّرَدًّا-
‘আর
যারা সৎ পথে চলে আল্লাহ তাদেরকে অধিক হিদায়াত দান করেন এবং স্থায়ী সৎকর্ম
তোমার প্রতিপালকের পুরস্কার প্রাপ্তির জন্যে শ্রেষ্ঠ এবং প্রতিদান হিসাবেও
শ্রেষ্ঠ’ (মারিয়াম ১৯/৭৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَالَّذِينَ
اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى وَآتَاهُمْ تَقْواهُمْ ‘যারা সৎপথ অবলম্বন করে
আল্লাহ তাদের হিদায়াত বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে তাক্বওয়া দান করেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৭)।
আহলে কাহ্ফ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوْا بِرَبِّهِمْ
وَزِدْنَاهُمْ هُدًى ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি
বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম’ (কাহফ ১৮/১৩)। এ আয়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমান বাড়ে ও কমে।[12]
(৩) বিনয় ও নম্রতা বৃদ্ধি : আল্লাহ তা‘আলা বিনয়-নম্রতা বৃদ্ধির সংবাদ দিয়েছেন। আর এটি ঈমান। মহান আল্লাহ বলেন, وَيَخِرُّونَ لِلأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعاً ‘আর তারা (আল্লাহর ভয়ে) কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১০৯)। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বিনয়-নম্রতার কথা উল্লেখ করেছেন। আর বিনয়-নম্রতা বৃদ্ধি হয়। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, ঈমান বৃদ্ধি হয়। কেননা বিনয়-নম্রতা ঈমান। মহান আল্লাহ বলেন,قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ، الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ- ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ। যারা নিজেদের ছালাতে বিনয়-নম্র’ (মুমিনূন ২৩/১-২)।
মহান আল্লাহ বলেন, أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ ‘মুমিন লোকদের জন্য এখনও সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণ এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের হৃদয় বিনীত হবে’ (হাদীদ ৫৭/১৬)।
বনী ইসরাঈলের ১০৯নং আয়াতের ব্যাখ্যায়
ইবনে জারীর আত-ত্বাবারী বলেন, কুরআনের মধ্যে যে সমস্ত শিক্ষা, ওয়ায-নছীহত,
উপদেশ বর্ণনা করা হয়েছে সে সমস্ত আয়াতের মাধ্যমে মুমিন-মুসলমানদের (ঈমান) ও
বিনয়-নম্রতা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর আনুগত্যে তারা
বিনয়ী হয়। কেননা তারা তাতেই শান্তি লাভ করে থাকে।[13] অন্তরের আমল হ’ল
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসা, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা, তাঁর উপর আশা-ভরসা
করা, তাঁর জন্যই বিনয়ী ও নম্র হওয়া। অনুরূপ সকল কিছুই ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।
যা কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত হয়। আর এটাই এক মানুষ থেকে অপর ব্যক্তির
শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।[14]
(৪) এক মুমিন অপর মুমিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ : এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
لاَّ يَسْتَوِي الْقَاعِدُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ غَيْرُ أُوْلِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِيْنَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِيْنَ دَرَجَةً وَكُـلاًّ وَعَدَ اللهُ الْحُسْنَى وَفَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْراً عَظِيماً-
‘মুমিনদের মধ্যে যারা কোন দুঃখ-কষ্ট ব্যতীতই গৃহে বসে থাকে, আর যারা স্বীয় জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারা সমান নয়। মহান আল্লাহ জান-মাল দ্বারা জিহাদকারীগণকে উপবিষ্টগণের উপর মর্যাদায় গৌরবান্বিত করেছেন এবং সকলকেই আল্লাহ কল্যাণপ্রদ প্রতিশ্রুতি দান করেছেন। আর উপবিষ্টগণের উপর জিহাদকারীগণের মহা প্রতিদানে গৌরবান্বিত করেছেন (নিসা ৪/৯৫)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
لَا يَسْتَوِيْ مِنْكُم مَّنْ أَنفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَقَاتَلَ أُوْلَئِكَ أَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِيْنَ أَنفَقُوْا مِن بَعْدُ وَقَاتَلُوْا وَكُلاًّ وَعَدَ اللهُ الْحُسْنَى وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيرٌ-
‘তোমাদের মধ্যে যারা (মক্কা) বিজয়ের পূর্বে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে (তারা উভয়ে কখনই) সমান নয়। তারা মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ তাদের অপেক্ষা যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও সংগ্রাম করেছে। তবে মহান আল্লাহ উভয়কেই কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’ (হাদীদ ৫৭/১০)। আল্লাহ আরো বলেন, وَلَقَدْ آتَيْنَا دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ عِلْماً وَقَالَا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي فَضَّلَنَا عَلَى كَثِيرٍ مِّنْ عِبَادِهِ الْمُؤْمِنِينَ ‘আমি অবশ্যই দাঊদ ও সুলাইমানকে জ্ঞান দান করেছিলাম এবং তাঁরা বলেছিলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যই যিনি আমাদেরকে তাঁর বহু মুমিন বান্দার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন’ (নামল ২৭/১৫)। মহান আল্লাহ বলেন,
وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ-
‘আর যেসব মুহাজির ও আনছার (ঈমানের দিক দিয়ে) অগ্রবর্তী ও প্রথম, আর যেসব লোক একান্ত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুগামী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তিনি তাদের জন্যে এমন জান্নাত প্রস্ত্তত করে রেখেছেন যার তলদেশ দিয়ে নহর সমূহ প্রবাহিত। তাতে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। সুতরাং এটাই হচ্ছে মহা সাফল্য’ (তওবা ৯/১০০)।
বর্ণিত আয়াতগুলো থেকে সুস্পষ্ট
হ’ল যে, ঈমান কমে ও বাড়ে। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হ’ল যে, এক মুমিন অপর
মুমিন থেকে ঈমানের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে। এজন্যই শক্তিশালী
ঈমানদার আল্লাহর নিকট দুর্বল ঈমানদারের চেয়ে অধিক প্রিয়।[15]
(৫) জান্নাতে মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধি : যার যত বেশী সৎ আমল রয়েছে, সে ব্যক্তি ঈমানের দিক থেকে তত বেশী শক্তিশালী এবং এর ফলশ্রুতিতে জান্নাতেও তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, أُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَّهُمْ دَرَجَاتٌ عِندَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ ‘তারাই সত্যিকারের ঈমানদার। এদের জন্যেই রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট উচ্চমর্যাদা। আরও রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা’ (আনফাল ৮/৪)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, انظُرْ كَيْفَ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَلَلآخِرَةُ أَكْبَرُ دَرَجَاتٍ وَأَكْبَرُ تَفْضِيلاً ‘লক্ষ্য কর, আমি কিভাবে তাদের একদলকে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম, পরকাল তো নিশ্চয়ই মর্যাদায় মহত্তর ও গুণে শ্রেষ্ঠতর’ (বনী ইসরাঈল ১৭/২১)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)।
(৬) পূর্ণাঙ্গ দ্বীন : পূর্ণাঙ্গ দ্বীন থেকে কিছু ছেড়ে দেওয়া হ’লে সেটা অপূর্ণাঙ্গ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيناً-
‘আজ
তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার
অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। ইমাম বুখারী বলেন, পূর্ণ জিনিস থেকে কিছু বাদ দেয়া হ’লে তা অপূর্ণ হয়।[16]
অতএব আমাদের উপর আল্লাহ তা‘আলা যে ঈমান ওয়াজিব করেছেন তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি হয়, যেমনভাবে পবিত্র কুরআন ধীরে ধীরে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর দ্বীন এভাবেই ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।[17] অতএব ঈমান বাড়ে এবং কমে এবং মুমিন ব্যক্তিরাও ঈমানের দিক দিয়ে সবাই সমান নয়; বরং তাদের মধ্যে মর্যাদায় পার্থক্য রয়েছে।
(৭) অন্তরের প্রশান্তি : মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে বলেন,
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِـي الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَـكِن لِّيَطْمَئِنَّ قَلْبِيْ-
‘আর
যখন ইবরাহীম বলেছিলেন, হে আমার প্রভু! আপনি কিরূপে মৃতকে জীবিত করেন তা
আমাকে দেখান। তিনি বললেন, তবে কি তুমি বিশ্বাস কর না? তিনি (ইবরাহীম)
বললেন, হ্যঁা; তবে এটা কেবল আমার আত্মিক প্রশান্তির জন্য’ (বাক্বারাহ ২/২৬০)। আয়াতটি থেকে বুঝা যায় ঈমান বৃদ্ধি হয়।[18]
প্রকাশ থাকে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সৎ আমল করে এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী তা সম্পন্ন করে থাকে, সে তার অন্তরে অবশ্যই প্রশান্তি লাভ করবে। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবে আল্লাহর ওয়াদা। সুতরাং বান্দা যখন আল্লাহকে বেশী বেশী ডাকে, সৎ আমল বেশী বেশী করে তখন তার ঈমান বেড়ে যায়।
(৮) আল্লাহর প্রতি মুমিনদের ঈমান আনা : মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ آمِنُواْ بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِيَ أَنزَلَ مِن قَبْلُ-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূলের প্রতি এবং ঐ কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং ঐ কিতাবের প্রতি যা পূর্বে অবতীর্ণ করেছিলেন’ (নিসা ৪/১৩৬)।
তিনি আরো বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَآمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِن رَّحْمَتِهِ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তিনি তাঁর অনুগ্রহে তোমাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিবেন’ (হাদীদ ৫৭/২৮)।
মুমিন
ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর যখন তাঁর আনুগত্য করে, বেশী বেশী সৎ
আমল করে তখন তার ঈমান বাড়ে। এভাবে তারা আল্লাহর প্রতি আরো দৃঢ় বিশ্বাসী হয়
এবং তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবের প্রতি, তাঁর রাসূলদের প্রতি,
পরকালের প্রতি ঈমান আনে। অতএব যে যত বেশী আল্লাহকে ভয় করে এবং সৎ আমল করে,
তার ঈমান তত বাড়তে থাকে।[19]
(৯) মুমিনদের স্তর : মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। এ থেকে বুঝা যায় ঈমান বাড়ে এবং কমে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِيْنَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ-
‘অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করলাম আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি। তবে তাদের মধ্যে কেউ নিজের প্রতি যুলুম করেছে, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে, কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণের কাজে অগ্রসর হয়েছে। এটাই (মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে) মহা অনুগ্রহ’ (ফাতির ৩৫/৩২)।
এখানে
মহান আল্লাহ ঈমানের দিক দিয়ে মুমিন বান্দাদের তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন।
এদের মধ্যে যারা কল্যাণের পথে অগ্রসর হয়, তারা ওয়াজিব ও মুস্তাহাব কাজ সমূহ
সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করে এবং হারাম বিষয় সমূহ ও অপসন্দীয় বিষয়াবলী থেকে
বিরত থাকে, তারাই নৈকট্য প্রাপ্ত। যারা মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী, তারা তাদের
উপর অর্পিত ওয়াজিব বিষয় সমূহ সঠিক পদ্ধতিতে আদায় করে থাকে এবং হারামকৃত
বিষয় থেকে বিরত থাকে। আর যারা নিজের আত্মার প্রতি যুলুম করেছে, তারা কিছু
হারাম কাজে পতিত হয় এবং কিছু ওয়াজিব বিষয় সমূহ আদায়ে ত্রুটি করে। কিন্তু
তাদের সাথে প্রকৃত ঈমান আছে। ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধির এটাই হচ্ছে সব থেকে বড়
প্রমাণ।[20]
(১০) পাপের কারণে মানুষের অন্তর থেকে ঈমান আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকে। এমনকি তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন,كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘না এটা কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরের উপর মরিচারূপে জমে গেছে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১৪)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
এরশাদ করেন, ‘অবশ্যই কোন মুমিন ব্যক্তি যখন পাপ কাজে পতিত হয় তখন তার
অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর সে পাপ থেকে তওবা-ইস্তেগফার করলে অন্তর
থেকে দাগটি উঠিয়ে নেওয়া হয়। ফলে তার অন্তর মসৃণ উজ্জ্বল হয়ে যায়। কালো দাগ
বাড়তে থাকলে (পাপ বাড়লে) তার সম্পূর্ণ অন্তর ঘিরে ফেলে। এ মরীচিকা
সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন, ‘না এটা কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে
মরিচারূপে জমে গেছে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১৪)।[21]
উপরে বর্ণিত আয়াত এবং হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈমান কমে ও বাড়ে।[22]
[চলবে]
হাফেয আব্দুল মতীন
লিসান্স ও এম.এ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।
[1]. জাওহারী, আছ-ছিহাহ ৫/২০৭১; ফিরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত, পৃঃ ১১৭৬।
[2]. আল-মুফরাদাত, পৃঃ ৩৫।
[3]. আছ-ছারেম আল-মাসলূল, পৃঃ ৫১৯।
[4]. ইবনু মান্দাহ, কিতাবুল ঈমান ১/৩৩১; আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৯৭।
[5]. বুখারী হা/৪৪।
[6]. বুখারী হা/২৫; মুসলিম হা/২২।
[7]. দ্রঃ হাফেয আল-হাকামী, মা‘আরিজুল কুবূল (দার ইবনুল জাওযী, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৬হিঃ), ২/৭৩৫-৭৪০; আব্দুর রাযযাক আল-বদর, যিয়াদাতুল ঈমান ওয়া নুক্বছানিহি (দার কুনূয ইশবীলিয়া, ৩য় সংস্করণ, ১৪২৭ হিঃ), পৃঃ ৩৭-৪০।
[8]. আশ-শারী‘আহ, পৃঃ ১১৯, তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ হামেদ ফেকী; লালকাঈ, শারহু ই‘তিকাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ২/৯১১, তাহক্বীক্ব : ড. আহমাদ বিন সাঈদ গামিদী, ৮ম সংস্করণ, ১৪২৪ হিঃ।
[9]. ইবনু মানদাহ, কিতাবুল ঈমান, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৮-৩৩৯।
[10]. আহলেহাদীছ আন্দোলন, পৃঃ ৯৭।
[11]. তাফসীর ইবনে কাছীর (কায়রো : দারুল হাদীছ, ১৪২৩ হিঃ), ৪/২৫৪।
[12]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৫/১৪৬।
[13]. ইবনে জারীর, তাফসীর আত-ত্বাবারী, ৯/১৮১।
[14]. কিতাবুল ঈমান, পৃঃ ১৮৩।
[15]. মুসলিম হা/২৬৬৪ ‘ক্বদর’ অধ্যায়।
[16]. বুখারী, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৩৩।
[17]. ইবনে তাইমিয়া, শারহুল আক্বীদা ইছফাহানিয়্যাহ, পৃঃ ১৩৯।
[18]. ইবনু বাত্তা, আল-ইবানাহ, ২/৮৩৩।
[19]. ঐ ২/৮৩৪।
[20]. আব্দুর রহমান নাছের আস-সা‘দী, তানবীহাত লত্বীফাহ, পৃঃ ৫০; তাফসীর আস-সা‘দী, পৃঃ ৬৮৯; ইবনে কাছীর ৬/৫৬৮।
[21]. তিরমিযী ৫/৪৩৪; ইবনে মাজাহ হা/৪২৪৪; আহমাদ ২/২৯৭, সনদ ছহীহ।
[22]. যিয়াদাতুল ঈমান ওয়া নুক্বছানিহি, পৃঃ ৫৪-৮০।