২০০৫ সালের ২৩শে
ফেব্রুয়ারীতে চার দলীয় জোট সরকারের ঐতিহাসিক মিথ্যাচারে আমরা আদৌ বিচলিত ও
ভীত ছিলাম না। কারণ আমাদের মনে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ছিল যে, ‘আমরা হকের
ওপরে আছি। মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই আমরা ঈমানী পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি। যার
ফল আমরা পরবর্তীতে পেয়েছি। এ অংশে বগুড়ার আদালত, জেলখানা সহ অন্যান্য কিছু
স্মরণীয় ঘটনা তুলে ধরা হ’ল।-
বগুড়ার কিছু স্মরণীয় ঘটনা :
মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে বগুড়া জেলখানায় ফাঁসির সেলে ফ্যানবিহীন ছোট একটি প্রাচীন কক্ষে রাখা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ১০ ফুট ও প্রস্থ ৬ ফুট। তথাকথিত ইসলামী মূল্যবোধের সরকার আমীরে জামা‘আতকে এখানে রাখার মাধ্যমে সম্ভবতঃ আমাদেরকে এ বার্তাই দিতে চেয়েছিল যে, এবার ডঃ গালিবকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাবার কেউ নেই। কিন্তু তাদের এ খাহেশ ও অপকৌশল আল্লাহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
এখানে ফাঁসির আসামীদের ও পাশের কক্ষগুলিতে আগত হাজতী আসামীদের হৈ চৈ ও নানা আচরণে তাঁর কষ্ট হ’ত। ফ্যান, চেয়ার-টেবিল পাওয়া তো দূরের কথা সামান্য মশারীও দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে প্রচন্ড গরমে ঐ ছোট কক্ষে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তিনি সবই হাসিমুখে ছবর করতেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। হাজতী-কয়েদীরা স্যারকে খুবই সম্মান করত। স্যারের সংস্পর্শে এসে অনেকে বিড়ি-সিগারেট ও নেশা ছেড়েছে। অনেকে নিয়মিত ছালাত আদায়ে অভ্যস্ত হয়েছে। তিনি প্রতিদিন সকালে তাদেরকে কুরআনের তাফসীর শুনাতেন এবং বিভিন্ন দো‘আ-দরূদ মুখস্ত করাতেন। অনেকে প্রকাশ্যে আহলেহাদীছ হয়ে গেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। শুধু এখানে নয়, যে জেলখানায় তিনি থেকেছেন, সেখানেই দাওয়াতী কাজ করেছেন এবং অনেকের মধ্যে এরূপ বিরাট একটা পরিবর্তন এসেছে। অনেক কারারক্ষী আজও স্যারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করেন। এমনকি আমরা তাদের অনেককে রাজশাহী মারকাযে এসে সরাসরি স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেখেছি।
(১) ৯.০৩.০৫ইং সকালে বগুড়া আদালতে প্রথম ওঠানোর দিন স্যারের যামিন আবেদনের জন্য কোন উকিল রাযী হয়নি। হাফীযুর ভাই উকিল বারে বসে সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু তারা বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যান। তখন অন্যান্যদের মধ্যে ১০/১২ জন উকিল একযোগে বলে ওঠেন, আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্যার সম্পর্কে আমরা ভালভাবেই জানি। তাঁকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছে। কেউ তাঁর পক্ষে না দাঁড়ালেও আমরা দাঁড়াবো। কোন পয়সা লাগবে না। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হিন্দু উকিল। তিনি জোরে শোরে বলেন, স্যার কখনো রাজনীতি করতেন না। অথচ আজ তিনি নোংরা রাজনীতির শিকার। আমরা তাঁর জন্য সাধ্যমত ফাইট করব’। একই কথা বলেছিলেন, পিরোজপুর যেলার কৌরিখাড়া মহিলা কলেজের জনৈক হিন্দু অধ্যাপক। যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন।
তরুণ উকিলদের এইরূপ ভক্তি ও ভালবাসা দেখে হাফীযুর ভাই তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ দেন।
(২) স্যারের মুক্তির দাবীতে বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’ মিছিল বের করবে। সেজন্য এসপি ছাহেবের কাছে তারা গিয়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোন পার্টি করেন? আপনাদের লীডার কে? জবাবে তারা স্যারের নাম করেন। তাতে এসপি ছাহেব খুশী হয়ে বলেন, আমি রিম্যান্ডে তাঁকে দেখেছি ও সামনা-সামনি তাঁর কথা শুনেছি। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। তাঁর সংগঠন প্রকৃত অর্থেই ইসলামী সংগঠন। আপনারা মিছিল করুন। আমরা জানি আপনারা গাড়ী ভাংচুর করবেন না। জনগণের জান-মালের কোন ক্ষতি করবেন না। আমাদেরও কোন পুলিশ লাগবে না। অন্যদল হ’লে তাদের ১০ জনকে সামাল দিতে আমাদের ২০ জন পুলিশ লাগে।
অতঃপর বিশাল মিছিল বের হয়। যা জেলখানা সহ শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে সাত মাথায় এসে জনসভায় মিলিত হয়। স্যারের ভক্ত জমাদার ও কারারক্ষীগণ মিছিলের এ দৃশ্য এবং শ্লোগান ও জনসভার খবর স্যারকে জানিয়ে দেন।
(৩) ২০০৬ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী। নতুন আইজি প্রিজন এসেছেন জেল পরিদর্শনে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ সুপারকে প্রশ্ন করলেন, এখানে ডঃ গালিব আছেন না? অতঃপর ফিরে এলেন ফাঁসির সেলে। আর্মী অফিসার তার নিজস্ব ঢংয়ে স্যারের সেলের সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করে বলেন, স্যার আপনার কি প্রয়োজন? তড়িঘড়ি করে স্যার বলেন, কয় দিন পরেই তো গ্রীষ্মকাল শুরু হবে। একটা ফ্যান হ’লে ভাল হয়। সাথে সাথে জেল সুপারকে নির্দেশ দিলেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফ্যান টাঙিয়ে দিতে। পরে সুপারের অনুমতি নিয়ে স্যারকে ফ্যান, মশারী, চেয়ার ও টেবিল কিনে দেওয়া হয়। ডেপুটি জেলার-এর ভাষ্য হ’ল আমার ২৯ বছরের চাকুরী জীবনে একজন হাজতী আসামীর জন্য আইজি প্রিজনের পক্ষ থেকে এরূপ সম্মান করার ঘটনা কখনো দেখিনি।
(৪) কারাগার লাইব্রেরীতে কিছু বই দিতে হবে। আমি ও বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি আব্দুর রহীম ভাই সংগঠনের কিছু বই নিয়ে গেলাম কারাগার লাইব্রেরীতে দেয়ার জন্য। জেল সুপার ছাহেব বইগুলো চেক করতে করতে স্যারের ডক্টরেট থিসিসটি (আহলেহাদীছ আন্দোলন উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ) তাঁর হাতে পড়ে গেল। তিনি চমকে উঠলেন। বললেন, ‘এই যে আন্দোলন, এটা আবার কি?’ বললাম, কেন? সমস্যা কোথায়? উনি বললেন, ‘আপনারা তাবলীগ করবেন, আন্দোলন কেন’? বিষয়টি আমরা তাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি যেন বুঝতে চান না। বরং তারা ‘আন্দোলন’ শব্দটাকেই ভয় পায়।
(৫) ২০০৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারীর ঘটনা। আমীরে জামা‘আতের মুক্তির দাবীতে বগুড়া আলতাফুন্নেসা খেলার মাঠে একটি সম্মেলন হবে। ড. মুছলেহুদ্দীন, মাওলানা আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ, আমীরে জামা‘আতের ছেলে নাজীব সহ কয়েকজন আমরা সকালে আখতার মাদানীর বাসায় অবস্থান করছি। আমার আশঙ্কা ছিল প্রশাসন আমাদের সম্মেলন করতে দিবে না। প্রথমে ডিসি ছাহেব আলতাফুন্নেসা খেলার মাঠে অনুমতি দিয়েছিলেন। পরক্ষণে তা বাতিল করে সাত মাথায় পৌরপার্কে অনুমতি দেন। ড. মুছলেহুদ্দীন ভাই বললেন, আপনি সম্মেলন স্থলে চলে যান। আমি গেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য। যেতে না যেতেই জানলাম, পুলিশ সম্মেলন বন্ধ করে দিয়েছে এবং মাইক খুলে নিয়ে চলে গেছে। সমাবেশস্থল পুলিশ ঘিরে রেখেছে। ভাবলাম, কি করা যায়? এদিকে হাযার হাযার মানুষ সমবেত হচ্ছে। দায়িত্বশীলসহ সকলকে বলা হ’ল কেউ যাবেন না এবং ধৈর্য হারাবেন না। দেখি কি করা যায়। বললাম, ডিসি অফিসে যেতে হবে। আমি, আব্দুর রহীম ভাই, আখতার মাদানী, ছহীমুদ্দীন গামা ভাইসহ বেশ কয়েকজন গেলাম ডিসি অফিসে। প্রথমে ডিসি’র পিএস-এর সাথে সবকিছু খুলে বলা হ’ল। বললাম, আমরা ডিসি ছাহেবের সাথে দেখা করতে চাই। উনি বললেন, স্যার ব্যস্ত। শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা চলছে। এখন দেখা করা যাবে না। অনেক কিছু বুঝিয়েও যখন আমাদের অনুরোধ রক্ষা করা হ’ল না। তখন জোরে চিৎকার করে পি.এস-এর টেবিল চাপড়িয়ে বললাম, ‘আপনার বসকে বলে দেন আমরা আমাদের নির্ধারিত প্রোগ্রাম করতে চললাম। পারলে পুলিশ বাধা দিয়ে বন্ধ করুক’! এই বলেই আমরা বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। উনি বললেন, হুযুর! হুযুর! আপনারা একটু থামুন, দেখি ডিসি স্যার কি বলেন! উনি ডিসি ছাহেবের কাছে গেলেন এবং হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এসে আমাদেরকে বললেন, ‘আপনারা ডিসি স্যারের সাথে দেখা করতে পারবেন, তবে ৩ জন যান। আব্দুর রহীম ভাই, আখতার ভাই ও আমি গেলাম। ডিসি ছাহেব আমাদেরকে দেখেই স্বাভাবিক হয়ে হাসিমুখে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে বসালেন। দেখলাম, একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ও আর একজন মিলে ভাইভা বোর্ড চলছে। আমাদের কথা বললাম এবং প্রোগ্রাম করতে চাইলাম। উনি বললেন, দেখেন তারেক জিয়া আজ আসার কথা আছে। আইন-শৃংখলা বিঘ্নিত হ’তে পারে। আমি বললাম, আমাদেরকে সম্মেলন করতে না দিলে বরং আইন-শৃংখলা আরও বেশী বিঘ্নিত হ’তে পারে। তাছাড়া আপনার লিখিত অনুমতি সাপেক্ষে আমরা শান্তি-শৃংখলার সাথে কেবল আমাদের নেতা প্রফেসর ড. গালিব স্যার সহ নেতৃবৃন্দের মুক্তির কথা বলতে চাই। অন্য কিছু নয়। বললাম, আমাদের উপর যুলুম-নির্যাতন চলছে। এদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের কথা দেশের মানুষের সামনে পেশ করতে পারব না, তা তো হ’তে পারে না? উনি আমাদের গঠনমূলক কথা শুনে ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে বললেন, ‘ঠিক আছে আপনারা সম্মেলন করেন’। এই বলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে এসপিকে ফোনে বলে দিলেন। উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা চলে আসলাম।
অতঃপর সুষ্ঠুভাবে সম্মেলন হ’ল। সেদিন অগ্নিঝরা বক্তব্য প্রদান করেন বক্তাগণ। আমি যখন বক্তব্য দিই তখন ড. মুছলেহুদ্দীন ভাই এবং মাওলানা আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ মঞ্চে উঠলেন। পরে উনারা আমাকে বললেন, আপনি এমন বক্তব্য দিতে পারেন, তা তো আগে জানতাম না। বাস্তবে আমি কোন বক্তা নই। বক্তব্য দিতেও জানি না। তবে সেদিনের বিষয়টি ছিল ভিন্ন। সত্যি সেদিন যেন আমাদের হৃদয়-মন থেকে যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাস্তব কথাগুলো নির্ভয়ে জাতির সামনে তুলে ধরার সাহস দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ। মুছলেহুদ্দীন ভাই বললেন, আজ আমীরে জামা‘আত গ্রেফতার হয়েছেন বটে; তবে এখন দেশে এমনি করে কেউবা বক্তা, কেউবা শিল্পী, কেউবা কবি, কেউবা প্রতিবাদী হয়ে ময়দানে নেমে সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া।
(৬) আমি ও স্যারের মেজ ছেলে নাজীব স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়ে কিছু খাবার দিচ্ছি। আমরা একটু তাড়াতাড়ি করছিলাম। ডেপুটি জেলার কিছুটা বিরক্তির সুরে বললেন, ‘আপনারা এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? ড. গালিব স্যার কোন সাধারণ মানুষ নন, উনি কেবল এদেশের নন, বরং আন্তর্জাতিক মানের একজন ব্যক্তিত্ব। উনি আমাদের জাতীয় সম্পদ। উনার জন্য আপনারা কি দিচ্ছেন, সেটা কি আমরা পরীক্ষা করে দেখব না? যদি তাঁর সামান্যতম ক্ষতি হয়, এর জন্য আমাদের চাকুরী থাকবে না।
(৭) বগুড়া কারাগারের কর্মকর্তাগণ আমাদের সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখতেন। একদিন এক জমাদার ভাইকে বললাম, ‘ভাই এখন তো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমরা এখনও যামিন পাচ্ছি না, কারণ কি? জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনাদের সম্পর্কে সবারই ধারণা খুবই ভাল। বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগ দিয়ে ড. গালিব স্যার সম্পর্কে ভিতরে-বাইরে নিখুঁতভাবে যাচাই করা হয়েছে। এমনকি এখনও হচ্ছে। মনে হয়, স্যার এখন সোনার চেয়েও খাঁটি। শুধু তাই নয় আমার মনে হয়, স্যার এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাল এবং নিখুঁত মানুষ। উনার ওপর আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে। দেখবেন খুব তাড়াতাড়ি উনি যামিনে বেরিয়ে আসবেন।
(৮) বগুড়ায় স্যারের মামলা পরিচালনাকারী উকিলদের উপর বিশেষ মহল থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এসময় জনৈক হিন্দু এ্যাডভোকেট-এর সাথে কোর্টে প্রায়ই দেখা হ’ত। উনি আমাদের খোঁজ-খবর নিতেন। একদিন তিনি বললেন, ‘জামায়াতে ইসলাম ড. গালিব স্যারকে ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা জানি তিনি একজন নির্দোষ ব্যক্তি। উনার মত একজন স্বনামধন্য মানুষকে ওরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি এবং পারবেও না। আপনারা কোন চিন্তা করবেন না’।
(৯) ২০০৫ সালের ২রা অক্টোবর থেকে ২০০৮ সালের ২৮শে আগস্ট যামিনে মুক্তি লাভের সময় পর্যন্ত স্যার অধিকাংশ সময় বগুড়া জেলেই থাকতেন। বিস্ফোরণ ও খুনের মামলা সহ তিনটি মামলায় হাযিরা দেওয়ার জন্য যখনই তাঁকে আদালতে আনা হ’ত, তখনই আদালত প্রাঙ্গণে ও বারান্দায় শত শত মানুষের ভিড় জমে যেত। রক্ষী পুলিশেরা প্রায়ই বলত, স্যারের লোকগুলি সবাই যেন একই রকম। যখন তিনি বারান্দা দিয়ে নেমে এসে পুলিশের গাড়ীতে উঠতেন, এটুকু সময়ের মধ্যে শত শত মানুষ একটু মুছাফাহা করার জন্য এবং এক নযর দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত। অনেকের চোখে থাকত পানি।
(১০) যেদিন স্যারের ছেলেরা দেখতে যেত, সেদিন জেল গেইটের সামনে বহু মানুষ জমে যেত গেইটের ফাঁক দিয়ে এক নযর দেখার জন্য। আদালত থেকে ফিরে জেল গেইটে প্রবেশের সময় একই অবস্থা হ’ত। রক্ষী পুলিশেরা এটা জানতেন। ফলে তারাও সম্মান করে একটু সুযোগ দিতেন। এমনকি শুনেছি যে, ফাঁসির সেল থেকে বেরিয়ে জেল গেইট পর্যন্ত আসার সামান্য দূরত্ব অতিক্রমের সময় জেলখানার বিভিন্ন ওয়ার্ডের হাজতী-কয়েদীরা স্ব স্ব গেইটের সামনে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকত স্যারকে দেখার জন্য। দূর থেকে তারা হাত উঁচু করে সালাম জানাত।
(১১) অন্য যারা ঐ সময় বগুড়া জেলে ছিলেন, তাদের কাছে শুনেছি বগুড়া জেলে প্রথম প্রবেশের কিছু পরে ঈদুল ফিৎরের ছালাতের জন্য সেল থেকে বের করে স্যারকে ময়দানে আনা হয়। তখন ইমাম ছাহেব ও অন্যান্য মুছল্লীদের অনুরোধে স্যারকে ইমামতি করতে বলা হয়। স্যার রাযী হ’লেন না। আহলেহাদীছ কয়েদীরা যিদ করলে তিনি তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, তাকবীর কমবেশী হ’লেও পরস্পরের পিছনো ছালাত আদায় করা জায়েয। আমি নিজেই ইমামের ইক্তেদা করব। তোমরাও ইক্তেদা কর। তখন তারা শান্ত হয়। ছালাত শেষে ইমাম ও সকলের অনুরোধে স্যার খুৎবা দেন। আরবীতে হামদ ও ছানা শেষে বাংলায় খুৎবা কিছুটা হ’তেই কারা কর্তৃপক্ষের ইঙ্গিতে স্যার দ্রুত খুৎবা শেষ করেন। অতঃপর আসার সময় হাজতী-কয়েদীরা স্যারের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং ভক্তি ভরে দো‘আ চায়। স্যারের আরবী খুৎবা ও তেলাওয়াত শুনে অনেকের উক্তি আজ যেন বগুড়া জেলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতা নাযিল হয়েছে’। পরে সুপার ছাহেব বললেন, স্যার আপনাকে কেন বাইরে আনি না এখন বুঝতে পারছেন কি? সরকার আপনাকে ভয় পায়। যদি আপনি আজকে পুরাপুরি খুৎবা দিতেন, তাহ’লে কালই সরকারের কাছে খবর হয়ে যেত এবং আমাদের চাকুরী যেত।
(১২) যামিন লাভের পর মামলায় হাযিরা দেওয়ার জন্য স্যার যখনই বগুড়া আদালতে যেতেন, তখনই বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার শত শত মানুষের ভিড় জমে যেত। এরই মধ্যে চোখে পড়ত কয়েকজন অতিবৃদ্ধ মানুষ। তারা হ’লেন, জনাব জসীমুদ্দীন, রামেশ্বরপুর, গাবতলী; যার বয়স ৯০-এর ওপরে। ২য় জন আববাস আলী মাস্টার, (বেড়েরবাড়ি, ধুনট) বয়স ১০০-এর উপর। ৩য় জন জনাব রহীমুদ্দীন, বয়স তখন ১০৮ বছর (বৃ-কুষ্টিয়া)। ঐ শরীর নিয়ে অতি কষ্টে তিনি ৩য় তলায় আদালত কক্ষের সামনে গিয়ে বসতেন। ২০১৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর ১১২ বছর বয়সে ইনি মৃত্যুবরণ করেন। ৪র্থ জন হ’লেন মাস্টার তোযাম্মেল হোসাইন, গাবতলী। ২০১৪ সালের ১৩ই আগস্ট ৭৯ বছর বয়সে তিনিও মারা যান। স্যার তাদের প্রত্যেককে নতুন জামা-কাপড় হাদিয়া দেন। ৩য় জনের মৃত্যুর পরে স্যার সেখানে যান ও তার কবর যিয়ারত করেন। ৪র্থ জনের মৃত্যুতে গাবতলী হাইস্কুল ময়দানে বৃষ্টিপাতের মধ্যে স্যার স্বয়ং তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন। স্যারের জন্য এঁদের কষ্ট, ত্যাগ ও প্রাণখোলা দো‘আ করা দেখে আমাদের মনে আরও সাহস ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হ’ত। আমরা মৃত-জীবিত সকলের জন্য প্রাণখোলা দো‘আ করি। আল্লাহ যেন ইহকাল ও পরকালে তাদেরকে এর উত্তম জাযা দান করেন।
(১৩) বগুড়ায় একজন ভক্ত ছিলেন এখনও আছেন। যিনি স্যারকে ‘স্পিরিট হাউজ’ বলেন। ১৯৮৯ সালের দিকে তিনি একবার রাজশাহী সাধুর মোড়ে স্যারের ভাড়া বাসায় আসেন। না বসেই তিনি চলে যেতে উদ্যত হ’লে স্যার তাকে আটকান। তখন তিনি বলেন, আমি আপনার গবেষণায় ক্ষতি করব না। কেবল দেখতে এসেছিলাম Spirit House ঠিক আছে কি না। কারণ সারা দেশে আহলেহাদীছ আন্দোলন চলছে এই হাউজ থেকেই’। আজও পর্যন্ত ঐ মহববত তিনি বজায় রেখে চলেছেন। হাযিরার প্রায় প্রতিটি দিনেই তাঁকে আমরা দেখতাম।
(১৪) আদালত থেকে স্যার জেল গেইটে নেমেছেন। এমন সময় বগুড়া শাহারপুকুর থেকে এক মুরববী তার ছেলেকে সাথে এনেছেন, স্যারের কাছ থেকে দো‘আ নেওয়ার জন্য। কারণ ছেলেটি চাকুরীর জন্য সিঙ্গাপুর যাবে। ছেলেটি ‘যুবসংঘে’র কর্মী। স্যার তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দো‘আ করলেন, বাবা যেখানেই থাক দ্বীনকে হাত ছাড়া করো না। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-কে ভুলো না। ঐ ছেলেটির নাম মো‘আযযাম। যার মাধ্যমে এখন সিঙ্গাপুরে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ তুঙ্গে অবস্থান করছে। ফালিল্লাহিল হামদ।
(১৫) ‘ডিভিশন’ লাভ :
ফখরুদ্দীন আহমাদের দু’বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আসেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সেক্যুলার শিক্ষকও গ্রেফতার হন। যারা ছিলেন স্যারের চাইতে অনেক জুনিয়র। তারা রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘ডিভিশন’ পান। এ বিষয়টি প্রমাণ হিসাবে পেশ করে আপিল করলে বগুড়া যেলা আদালত এক প্রকার বাধ্য হয়েই স্যারের জন্য ১৯শে সেপ্টেম্বর’০৭ থেকে ‘ডিভিশন’ মঞ্জুর করেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ স্যারকে ফাঁসির সেলেই রাখার চেষ্টা করেন। সংকীর্ণ সেলে চৌকি প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হওয়ায় অবশেষে পার্শ্ববর্তী বহু দিনের পরিত্যক্ত টিন শেড কিশোর ওয়ার্ডের এক পাশে তাঁকে রাখা হয়। যা ছিল মশার ডিপো। যার সামনের দিকে ছিল ৪তলা ওয়ার্ডের ২২টি টয়লেটের সারি। স্যার আপত্তি করেও কোন লাভ হয়নি। এখানে বসেই স্যার ‘তাফসীরুল কুরআন’-এর কাজ শুরু করেন । এখানে আসার প্রথম দিন বিকালে সামনের ৪তলা ওয়ার্ড থেকে কারাবন্দী ভাই আব্দুর রহীম (বগুড়া যেলা সভাপতি) স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পরবর্তীতে ১৬ই জানুয়ারী’০৮ বুধবার সন্ধ্যায় স্যারকে কারা মেডিকেলের দোতলায় স্থানান্তরিত করা হয়। যেখানে ‘ডিভিশন’ প্রাপ্ত বিভিন্ন এমপি-মন্ত্রীদের রাখা হয়। এখানেও আসার পরদিন আব্দুর রহীম ভাই স্যারকে দেখতে আসেন। এখানে বগুড়ার তিন তিনবারের এমপি হেলালুযযামান তালুকদার লালুকে তিনি কারাবন্দী হিসাবে পান। এখানেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় বেক্সিমকো-র ভাইস চেয়ারম্যান জনাব সালমান এফ রহমানের সাথে। যিনি ৩.০৫.০৮ইং শনিবার দিবাগত রাতে এসে ১০.০৫.০৮ইং শনিবার বিকালে পুনরায় কাশিমপুর কারাগারে চলে যান।
(১৬) ঈদুল ফিৎরের ছালাত থেকে বঞ্চিত :
১৪.১০.০৭ইং জেলখানায় ঈদুল ফিৎরের জামা‘আত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্যার ভাবছেন অন্যবারের ন্যায় এবারও তাঁকে জামা‘আতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু না। কর্তৃপক্ষের কোনরূপ সাড়া না পেয়ে অবশেষে নিজ কক্ষেই একাকী দু’রাক‘আত ঈদের ছালাত আদায় করেন। বস্ত্ততঃ এটাই ছিল তাঁর জীবনে প্রথম ঈদ, যা তিনি প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জামা‘আতে পড়তে পারেন নি।
ঈদুল আযহার ছালাতেও তাঁকে বাইরে জামা‘আতে নেওয়া হয়নি। তখন তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে কারারক্ষীদের সহায়তায় কিশোর ওয়ার্ডের ছেলেদের নিয়ে ওয়ার্ডের মধ্যে খোলা স্থানে নিজ ইমামতিতে ঈদের ছালাত আদায় করেন।
উল্লেখ্য যে, কিশোর ওয়ার্ড ছেড়ে মেডিকেলে যাওয়ার কয়েক কাশিমপুর কারাগার থেকে বগুড়া যেলা কারাগারে ট্রান্সফার করা হ’লে তাকে তিনদিন উক্ত কিশোর ওয়ার্ডে রাখা হয়। পরে এখান থেকে পুনরায় তাঁকে কাশিমপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।
(১৭) বগুড়াতে আমীরে জামা‘আতের তিনটি মামলা। একটি গাবতলীতে বোমা বিস্ফোরণ মামলা। অন্য দু’টি হ’ল শাহজাহানপুর থানার লক্ষ্মীকোলায় গানের প্যান্ডেলে বোমা হামলা ও মানুষ হত্যা মামলা। বোমা বিস্ফোরণ ও হত্যা মামলাকে দু’টি মামলায় পরিণত করা হয়েছে স্রেফ মামলাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য ও আসামীকে দীর্ঘ দিন কারাগারে রাখার জন্য। গাবতলী বোমা বিস্ফোরণ মামলায় স্যার বেকসুর খালাস পান ৩০.৯.১০ইং তারিখে। অতঃপর শাহজাহানপুর বিস্ফোরণ মামলায় বেকসুর খালাস পান ৩১.৭.১১ইং তারিখে। অথচ একই ঘটনায় পৃথকভাবে দায়েরকৃত হত্যা মামলায় তিনি বেকসুর খালাস পান ২০.১১.১৩ইং তারিখে। বিস্ফোরণেই যিনি নির্দোষ প্রমাণিত হ’লেন, সেখানে তিনি কিভাবে হত্যাকান্ড ঘটালেন? এই ভিত্তিহীন বিষয়টির বিচার করতে আদালতের লাগল প্রায় আড়াই বছর। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রিতা স্রেফ সরকারী ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ বিরোধী কুচক্রীমহল ও জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা স্যারকে ফাঁসাতে চেয়েছিল এই মামলাগুলোতেই। অবশেষে দেখা গেল মূল আসামী সরকার ধরতে পারেনি বা ইচ্ছাকৃতভাবে ধরেনি। কারণ জনশ্রুতি ছিল যে, সে ছিল একজন জেএমবি সদস্য। যে অন্য মামলায় কারাগারে ছিল এবং তার সাথীদের কাছে বিষয়টি জানিয়েছিল। অথচ নিরপরাধ মানুষগুলিকে নিয়ে বিচারের নামে সরকার প্রহসন করল এবং বাদী পক্ষ ও জনগণকে প্রতারণা করল।
অতিরিক্ত যেলা জজ আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসা গাবতলী থানার আই,ও’র বক্তব্য ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ ষড়যন্ত্রের শিকার এবং আমরা যা করেছি উপরের নির্দেশে করেছি মাত্র’। ডঃ গালিব স্যারের মত এমন একজন উঁচুমানের মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ প্রফেসরের সামনে তাঁরই বিরুদ্ধে আমাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে হ’ল’। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন।
পরবর্তীতে হাইকোর্ট বগুড়ার গাবতলী ও শাহজাহানপুর থানার দু’টি মামলায় ডাইরেকশনের (২০.০২.০৮ইং) মাধ্যমে যথাক্রমে ৩ মাস ও ৬ মাসের চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়। উক্ত সময়ের মধ্যে মামলা শেষ করতে না পারলে যেলা আদালত তাঁকে যামিন দিবে। পরে ঠিক সেভাবেই যামিন দিয়েছিল বগুড়ার যেলা আদালত।
হাইকোর্টে শুনানীর সময় জাস্টিস খাদেমুল ইসলাম এক পর্যায়ে বলেন, ‘ডঃ গালিব ইউনিভার্সিটির একজন সিনিয়র প্রফেসর হয়ে তিনি কি করে একটা যাত্রা মঞ্চে বোমা হামলা করতে পারেন ও মানুষ খুন করতে পারেন, এটা আমার বোধগম্য নয়। ধরে নিলাম বাংলা ভাই ও আব্দুর রহমান আহলেহাদীছ এবং এই অপরাধে তারা দোষী। কিন্তু এদেশে যে লক্ষ লক্ষ আহলেহাদীছ বাস করেন, তারা কি সকলে একই দোষে দোষী হ’তে পারে’? সেদিন সরকারী উচ্চ আইন কর্মকর্তাগণ মাথা নীচু করে চুপ থেকেছিলেন। প্রথম দিনে যামিন হবে কিন্তু জুনিয়র জাস্টিসের অস্বীকৃতির কারণে পারেননি। অতঃপর বেশ কয়েক দিন ধরে জোরালো শুনানীর পর এই ডাইরেকশন দিয়েছেন সম্মিলিতভাবে। যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে নিম্ন আদালত যামিন দিয়েছিল।
(১৮) যামিনে মুক্তি লাভ :
হাইকোর্টের ডাইরেকশন অনুযায়ী বিচার শেষ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে বগুড়া স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল স্যারের যামিন মঞ্জুর করেন। সকাল থেকে অগণিত নেতা-কর্মী জেল গেইটের অদূরে ও শহরের বিভিন্ন স্থানে জমা হয়েছেন। আমরা সবাই গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকিয়ে আছি কখন তিনি বের হবেন। ভয় হচ্ছে অন্য অনেকের মত জেল গেইট থেকে বের হওয়ার পরেই পুনরায় তাঁকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে ফিরিয়ে নেয় কি না। দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আমাদের তখন হার্টফেল করার মত অবস্থা। ইতিমধ্যে সাদা পোষাকে গোয়েন্দাদের উপস্থিতি ও গাড়ী দেখে পিলে চমকানোর মত অবস্থা। প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকলাম আর মহান আল্লাহর বারগাহে হৃদয় নিংড়ানো আকুতি জানাতে থাকলাম। অবশেষে সকল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হতাশাকে ছিন্ন করে স্যার বেরিয়ে আসলেন। আলহামদুলিল্লাহ। মনে হ’ল যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। মজার ব্যাপার হ’ল, সাদা পোষাকে আসা গোয়েন্দা সদস্যরাই এসকর্ট করে স্যারকে রাজশাহী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমীরে জামা‘আতের যামিনে মুক্তির সেই দিনটি আমাদের নিকট চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
(১৯) স্যারকে নিয়ে বগুড়া জেল গেইট থেকে সন্ধ্যার পর রওয়ানা হয়ে মাইক্রোতে শাকপালা পর্যন্ত এসেছি। চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে মোবাইল ফোনে এক মহিলার জিজ্ঞাসা, বাবা কি সত্যিই বেরিয়েছেন? আমরা বললাম, হ্যাঁ। মহিলার বিশ্বাস হয় না। অবশেষে স্যার মোবাইলে তাকে সালাম দিলেন। বৃদ্ধা মহিলা বললেন, বাবা তোমার জন্য মাগরিবের ছালাতের পর থেকে জায়নামাযে বসে আছি তুমি মুক্তি পেলে শুকরিয়ার ছালাত আদায় করবো বলে। বাবা তুমি ভাল থাক’।
(২০) যামিনে মুক্তি লাভের পর শুরু হ’ল বাকী আইনী লড়াই। সরকার চান শাহজাহানপুর থানার খুনের মামলায় জিতে গিয়ে তাঁকে পুনরায় কারাগারে নিতে। বগুড়ার স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক জনাব আনোয়ার হোসাইন-এর আদালতের ঘটনা। এখানে অনেক দিন ধরে উক্ত মামলার সাক্ষী চলছে। তবুও সরকারী পক্ষ সাক্ষী হাযির করতে পারছে না। মামলা দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা বার বার তারিখ পিছিয়ে দিতে বলেন। আমাদের উকিল সাক্ষী ক্লোজ করার আবেদন করেন। সে সময় শাহজাহানপুর থানা থেকে ওসির প্রতিনিধি এসেছিলেন সময় নেওয়ার জন্য। বিজ্ঞ বিচারক এবার পিপিকে বললেন, ‘আপনি সাক্ষী হাযির করেন না কেন? উনি বললেন, আমরা তো অনেক সাক্ষী নিয়ে এসেছি। জজ তখন বললেন, এ সাক্ষী তো আসামী পক্ষই নিয়ে এসেছে, আপনারা কি করেন? পিপি বললেন, মাননীয় আদালত সাক্ষী নিয়ে আসার দায়িত্ব আমার নয়, থানার ওসির। তখন পাশে অবস্থানরত এসআইকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার, সাক্ষী নিয়ে আসতে পারেন না কেন? তিনি মাথা নিচু করে থাকলেন। বিচারক সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন- ‘একে কাষ্টডিতে দাও’। মুহূর্তে তাকে কাঠ গড়ার মধ্যে কিছু সময় জেল খাটতে হ’ল। এই দৃশ্য দেখে কোর্টে অবস্থানরত সকলে হতবাক হয়ে গেল। অর্থাৎ বিচারক সেদিন বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, এভাবে একজন নিরীহ সম্মানিত ব্যক্তিকে আপনারা (প্রশাসন) আর কত দিন কষ্ট দিবেন?
এই দৃশ্য দেখে আমরা সেদিন বলেছিলাম, এখনও দেশে কিছু ভাল বিচারক আছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য পরবর্তী তারিখের আগেই তাঁকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়।
এরপর আসলেন আর এক বিচারক। তিনি মামলাটি আবার দীর্ঘায়িত করতে চাইলেন। ৩/৪ মাস পরপর তারিখ দেন। এক পর্যায়ে জানতে পারলাম, এ মামলা তিনি শেষ করবেন না। আমরা বললাম, মামলা এখান থেকে ট্রান্সফার করতে হবে। আবেদন অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত-৩-য়ে মামলা চলে গেল। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এখানে কোন জজ না থাকায় ১নং আদালতে এর সাক্ষী চলতে থাকে। ‘এই ১নং আদালতে ইতিপূর্বে আমীরে জামা‘আতের ২টি মামলার রায় হয়। জজ সাক্ষী ক্লোজ করলেন। কিন্তু রায় আর দেন না। শুনলাম উনিও রায় দিবেন না। বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। স্যারও বিরক্ত হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, দেখ আর কতকাল এভাবে এই মামলায় সময়, শ্রম, অর্থ নষ্ট হবে! এদেশে আইন বলে কি কিছু নেই। কিছুদিন পর নতুন জজ এল। ভাবলাম ভালই হ’ল। আমি পরপর দুই তারিখে যাইনি। সম্ভবতঃ ঢাকায় যরূরী কোন কাজে ছিলাম। শুনলাম নতুন জজ এসেও আবার দীর্ঘদিন পরপর তারিখ দিচ্ছে। জানা গেল তিনিও এই মামলার রায় দিবেন না। তিনিও নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করছেন। ভাবলাম এর জন্য আবার হাইকোর্টে যেতে হবে না কি?
(২১) সর্বশেষ মামলা থেকে খালাস : অবশেষে ২০.১১.১৩ইং বুধবার রায় ঘোষণার দিন ধার্য হ’ল। স্যার সহ আমরা সকলে উপস্থিত। শত শত মানুষের ভিড়। সকলের চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ। কারণ কি রায় হয়? তবে আমার মনের জোর ছিল, যেহেতু মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে কেউই স্যারের নাম উচ্চারণ করেনি, সেহেতু আল্লাহর ইচ্ছায় অবশ্যই আমাদের পক্ষে রায় হবে। রায়ের অপেক্ষায় সময় পার হ’তে লাগলো। অবশেষে দুপুর গড়িয়ে বিকাল ৪.১২ মিনিটে সকলের কাংখিত এই ঐতিহাসিক রায়টি ঘোষিত হ’ল। সংক্ষিপ্ত ৩ মিনিটে বিচারক রায়ের মূল অংশ পাঠ করে ঘোষণা করলেন, ‘ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব সহ অন্যান্য আসামীগণকে অত্র মামলা থেকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হ’ল’! আলহামদুলিল্লাহ। অতঃপর আদালতের মসজিদে গিয়ে সকলে শুকরিয়ার সিজদা করেন।
চারিদিকে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করল। শত শত মানুষ, সংগঠনের কর্মী, সুধী এবং আদালত পাড়ার উকিল, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আনন্দের দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নব বিজয়ের নিশান উড়ছে। আর এ বিজয় আমাদের অতীতের সকল কষ্ট-ক্লেশ দূর করে দিয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে চারদলীয় জোট সরকারের চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্তি পেলেন আমীরে জামা‘আত। কলংকমুক্ত হল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’। যা আনুষ্ঠানিকভাবে আজ (২০.১১.২০১৩) প্রমাণিত হ’ল দীর্ঘ ৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন আইনী লড়াইয়ের পর।
সেদিন এ আনন্দের খবর শুনে ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত স্যারের জ্যেষ্ঠ পুত্র আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব যে মেসেজটি আমার কাছে প্রেরণ করেছিল তা আমার হৃদয়ে দাগ কেটেছিল। তার মেসেজের সারকথা ছিল-
‘প্রফেসর ডঃ আসাদুল্লাহ আল-গালিব জোট সরকারের দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা সমূহ থেকে বেকসুর খালাস পাওয়াতে বাংলাদেশের আহলেহাদীছগণ যেন ঈদের আনন্দ অনুভব করছে। বিদেশে থেকেও আমরা তা পূর্ণভাবে অনুভব করছি। চিরকাল এভাবেই হক বিজয়ী হয়। ফালিল্লাহিল হামদ’।
এ সময় আদালতে উপস্থিত গাইবান্ধা-পশ্চিম যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রধান উপদেষ্টা জনাব নূরুল ইসলাম প্রধান স্যারের বেকসুর খালাসের খবর জানিয়ে ৪.৩৩ মিনিটে ছাকিবকে নিম্নোক্ত মেসেজ পাঠান-
we were anxiously waiting for a judgement which is expected to just fill our poor hearts with endless joy and pleasure and Alhamdulillah just now we have got it.
(‘আমরা গভীর উৎকণ্ঠার সাথে অপেক্ষা করছিলাম একটি রায়ের জন্য, যা আমাদের দুর্বল হৃদয়গুলিকে সীমাহীন আনন্দ ও খুশীতে ভরে দেবে। আলহামদুলিল্লাহ! এইমাত্র আমরা সেটা পেলাম’)।
এর উত্তরে ৪.৩৬ মিনিটে ‘ছাকিব’ নিম্নোক্ত জবাবটি প্রেরণ করে।- Alhamdulillah, Chacha! Thank you so much for your inspiring message. It just made us feel so delighted of having Allah beside us. May Allah be with us always and continue to guide us to the way of Jannah, and let us fulfill our duties to the Ummah as much as possible. Ameen!
(আলহামদুলিল্লাহ, চাচা! অনুপ্রেরণাদায়ক মেসেজটি পাঠানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এটি আমাদেরকে খুবই আনন্দিত করেছে এজন্য যে, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। আল্লাহ সর্বদা আমাদের সহায় থাকুন এবং আমাদেরকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করুন! তিনি যেন আমাদেরকে উম্মতের প্রতি আমাদের কর্তব্য সমূহ সাধ্যমত পালনের তাওফীক দান করেন- আমীন!)।
এত দ্রুত এত সুন্দর জওয়াব পাঠানোর জন্য প্রধান ছাহেব তার জন্য প্রাণভরে দো‘আ করেন।
দীর্ঘ দিন পর মামলার রায় হ’ল বটে। কিন্তু প্রকৃত আসামী ধরা পড়লো না। মাঝখানে স্যারকে প্রধান আসামী বানিয়ে তাঁর সাথে কয়েকজন নিরীহ মানুষকে কারা নির্যাতন ভোগ করানো হ’ল। বগুড়ার জয়নাল সরকার ও তার স্ত্রীকে যে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করা হ’ল। দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর যাবৎ পায়ে ডান্ডাবেড়ী পরিয়ে সীমাহীন কষ্ট দেওয়া হ’ল। গরীব ভ্যান চালক জয়নালকে সবকিছু হারিয়ে ভিটেসর্বস্ব করা হ’ল। এর শাস্তি হিসাবে সরকারের বিরুদ্ধে আদালত কোন রায় দেননি। তাহ’লে কি সরকার সকল কৈফিয়তের ঊর্ধ্বে? সরকারী নির্যাতনের শাস্তি কি তাহ’লে দুনিয়াতে নেই? সরকারকে যুলুম করার অবাধ লাইসেন্স দেওয়ার নামই কি তাহ’লে ‘গণতন্ত্র’? আমরা আজও দাবী করি লক্ষ্মীকোলার গানের প্যান্ডেলে হামলাকারী প্রকৃত খুনীকে গ্রেফতার করে বিচার করা হৌক ও তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হৌক। আমাদের উপরে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আরোপিত মিথ্যা অপবাদ এবং তাদের অবর্ণনীয় যুলুমের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে মামলা রইল।
উপসংহার :
সে সময়ে যারা কারা নির্যাতিত হয়েছেন আজ তাদের কথা স্মরণ করছি। বিশেষ করে ‘আন্দোলন’-এর আমেলা সদস্য জনাব গোলাম মুক্তাদির (খুলনা), জনাব ছদরুল আনাম (সাতক্ষীরা), জুবায়ের হুসাইন (বাগেরহাট), শফীকুল ইসলাম (জয়পুরহাট), আব্দুর রহীম (বগুড়া) প্রমুখ প্রায় ৪০ জন নিরীহ দায়িত্বশীল ও কর্মী, যাদের অন্যায় কারা নির্যাতনে আমরা দারুণভাবে ব্যথিত। আর মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনায় এবং অন্যান্য সকল কর্মকান্ডে যাদের কথা প্রায় স্মরণ করতে হয় তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে স্মরণ করি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সম্পাদক জনাব হাফীযুর রহমান ভাইকে (জয়পুরহাট)। যার অতুলনীয় মেধা ও নিঃস্বার্থ সেবা ‘আন্দোলন’-এর ইতিহাসে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। অতঃপর ঐ সময়কার ভারপ্রাপ্ত আমীর ডঃ মুছলেহুদ্দীন (টাঙ্গাঈল), কেন্দ্রীয় মুবাল্লিগ এস.এম. আব্দুল লতীফ (সিরাজগঞ্জ), মাসিক আত-তাহরীক সম্পাদক ডঃ সাখাওয়াত হোসাইন (কুমিল্লা), স্যারের দুই ছেলে আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ও আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব, আহলেহাদীছ যুবসংঘের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক মুযাফফর বিন মুহসিন (রাজশাহী), মারকাযের শিক্ষক ও আন্দোলন-এর অফিস সহকারী মোফাক্ষার হোসাইন (পাবনা), আব্দুর রহীম (বগুড়া), আখতার মাদানী (নওগাঁ), আল-রাযী (ঢাকা), মোশাররফ হোসাইন (ঢাকা), আফযাল হোসাইন (নওগাঁ), নওগাঁ বারের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রমুখকে। সবচেয়ে বেশী স্মরণ করতে হয় বগুড়া যেলা সংগঠনের দায়িত্বশীল ও কর্মীবৃন্দকে। কারণ বগুড়া জেলখানায় স্যারের দীর্ঘদিন অবস্থানের কারণে এবং যামিনের পর কোর্টে স্যার ও আমাদেরকে যেভাবে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষা আমাদের জানা নেই। মহান আল্লাহ সকলকে সর্বোত্তম জাযা দান করুন-আমীন!
আলোচ্য নিবন্ধে ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০০৫ থেকে ২০শে নভেম্বর ২০১৩ইং পর্যন্ত আদালত পাড়ার ও কারাগার সংশ্লিষ্ট কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হ’ল। তবে আদালত পাড়ার সেই আনন্দঘন মুহূর্ত কখনও ভুলতে পারি না। যখন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত যামিনে মুক্ত হ’লেন এবং সর্বশেষ মামলায় বগুড়া অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত-৩ থেকে বেকসুর খালাস পেলেন।