পর্ব ১ । পর্ব ২ ।  পর্ব ৩ । পর্ব ৪  । পর্ব ৫  । পর্ব ৬ ।

পূর্বোক্ত আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, উদ্ধৃত ইমামগণ প্রত্যেকেই আহলুল হাদীছকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত’ তথা নাজী ফের্কা অর্থে গ্রহণ করেছেন। সুতরাং আহলুল হাদীছ পরিভাষাটি সংকীর্ণ অর্থে কেবল মুহাদ্দিছদের জন্য নির্দিষ্ট করা অবান্তর এবং সত্যের অপলাপ।

এর আরও প্রমাণ এই যে, বিদ‘আতীরা ‘আহলুল হাদীছ’ এবং ‘আহলুস সুন্নাহ’কে সর্বাধিক গালি প্রদান করে থাকে। অথচ মুফাসি্সর, ফক্বীহ, উছূলবিদ, ইতিহাসবিদ, বৈয়াকরণিক তথা শরী‘আতের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার বিশেষজ্ঞদেরকে কখনও গালি বা নিন্দাসূচক অভিধায় অভিহিত করা হয় না। যদি আহলুল হাদীছ বলতে কেবল মুহাদ্দিছই উদ্দেশ্য হ’ত, তবে গালি দেওয়ার কোন কারণ ছিল না। কেননা কোন বৈধ বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন বা জ্ঞানার্জন অপরাধ নয়। অথচ পূর্বযুগে আহলুল হাদীছকে মুজাসি্সমা, মুশাবিবহাহ, হাশাভিয়াহ, জাবরিয়াহ, নাছেবাহ প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে গালি দেয়া হ’ত। এগুলোর সবই ছিল আক্বীদাগত বিদ্বেষের কারণে।[1] আবার বর্তমান যুগেও তাদেরকে ওয়াহ্হাবী, জামী, মাদখালী, লা মাযহাবী প্রভৃতি লক্বব দেয়া হয়। এভাবে প্রত্যেক যুগেই বিদ‘আতীরা আহলুল হাদীছদেরকে গালি দিয়ে এসেছে। আর এটা কেবল এজন্য নয় যে, তারা হাদীছ বিশেষজ্ঞ; বরং তারা সঠিক আক্বীদা ও মানহাজের অনুসারী- এটাই তাদের বিদ্বেষের মূল কারণ।

আবূ উছমান আছ-ছাবূনী (মৃ. ৪৪৯হিঃ) এ বিষয়ে খ্যাতনামা মুহাদ্দিছ আবূ হাতিম আর-রাযী (১৯৫-২৭৭হিঃ)-এর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন,وكل ذلك عصبية، ولا يلحق أهل السنة إلا اسم واحد وهو أصحاب الحديث، ‘(আহলে সুন্নাতকে) এ সকল (বিকৃত নামে ডাকা) কেবল গোঁড়ামিরই বহিঃপ্রকাশ। আহলে সুন্নাতের একটি নামই রয়েছে আর তা হ’ল আছহাবুল হাদীছ’। অতঃপর তিনি নিজের বক্তব্যে বলেন,قلت أنا رأيت أهل البدع في هذه الأسماء التي لقبوا بها أهل السنة سلكوا معهم مسلك المشركين مع رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘আমি বলি যে, বিদ‘আতীরা আহলে সুন্নাতকে এ সকল নামে আখ্যা দিয়ে সে পথই অবলম্বন করেছে যে পথ অবলম্বন করেছিল মুশরিকরা রাসূল (ছাঃ)-এর ক্ষেত্রে (তাঁকে গালি দেয়ার মাধ্যমে)’।[2]

অতঃপর তিনি বলেন,

وأصحاب الحديث عصابة من هذه المعايب بريئة زكية نقية، وليسوا إلا أهل السنة المضية والسيرة المرضية والسبل السوية والحجج البالغة القوية، قد وفقهم الله جل جلاله لاتباع كتابه ووحيه وخطابه، والاقتداء برسوله صلى الله عليه وسلم في أخباره التي أمر فيها أمته بالمعروف من القول والعمل، وزجرهم فيها عن المنكر منهما، وأعانهم على التمسك بسيرته والاهتداء بملازمة سنته، وشرح صدورهم لمحبته، ومحبة أئمة شريعته، وعلماء أمته

‘আছহাবুল হাদীছ এমন একটি দল, যারা (বিদ‘আতীরা যেসব গালি দেয়) এসব দোষ-ক্রটি থেকে মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তারা আলোর পথের যাত্রী আহলে সুন্নাত ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। তারা তো সন্তোষভাজন পন্থার অনুসারী, সরল পথের দিশারী ও শক্তিশালী দলীলের ঝান্ডাবাহী। আল্লাহ তাদেরকে তাঁর কিতাব ও ওহীর বিধান অনুসরণের তাওফীক দিয়েছেন। আরও তাওফীক দিয়েছেন তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছসমূহ অনুসরণের, যাতে বর্ণিত হয়েছে উম্মাতের জন্য করণীয় ও বর্জনীয় হিসাবে যা কিছু তিনি বলেছেন ও করেছেন। তিনি আল্লাহ্ই তাদেরকে রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসৃত পথ এবং তাঁর সুন্নাতকে পথনির্দেশিকা হিসাবে গ্রহণে সহায়তা করেছেন। আর তাদের অন্তরকে রাসূল (ছাঃ) এবং তাঁর শরী‘আতের পাবন্দী উম্মতের ইমামগণ ও আলেম-ওলামাদের প্রতি ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন’।[3]

প্রায় একই ভাষায় বর্ণনা করেছেন আব্দুল ক্বাদির জীলানী (৪৭০-৫৬১হিঃ)। তিনি বলেন,

كل ذلك عصبية وغياظ لأهل السنة، ولا اسم لهم إلا اسم واحد: وهو «أصحاب الحديث». ولا يلتصق بهم ما لقبهم به أهل البدع، كما لم يلتصق بالنبي -صلى الله عليه وسلم- تسمية كفار مكة له ساحرًا وشاعرًا ومجنونًا ومفتونًا وكاهنًا ‘এ সকল (বিকৃত নামে ডাকা) কেবল গোঁড়ামি ও অন্তর্জালার বহিঃপ্রকাশ। কেননা আহলুস সুন্নাহর অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। আর সেটি হ’ল ‘আছহাবুল হাদীছ’। বিদ‘আতীদের এই সকল গালি প্রকৃতার্থে আহলেহাদীছদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন মক্কার কাফেরদের জাদুকর, কবি, পাগল, মাথা খারাপ, গায়েবজান্তা প্রভৃতি গালি রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য প্রযোজ্য ছিল না’।[4]

এমনকি অমুসলিম গবেষকগণ পর্যন্ত এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি যে, আহলেহাদীছ বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা আক্বীদা ও মানহাজগতভাবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত অনুসারী। যেমন Encyclopedia of Islam বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, AHL-i-HADITH, "the followers of the Prophetic tradition", is a designation used in India and Pakistan for the members of a Muslim sect, who profess to hold the same views as the early ashab alhadith or ahl-al-hadith (as opposed to ahl-al-ray). They do not hold themselves bound by taklid or obedience to any of the four recognized imams of the fikh-schools but consider themselves free to seek guidance in matters of religious faith and practice from the authentic traditions, which together with the Kur'an are in their view the only worthy guide for true Muslims. They disregard the opinions of the founders of the four schools when they find them unsupported by or at variance with traditions.

‘আহলুল হাদীছ’ তথা ‘রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসারী’, ভারত ও পাকিস্তানের মুসলমানদের একটি দলের উপাধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যারা হুবহু পূর্বযুগের আছহাবুল হাদীছ বা আহলুল হাদীছদের (আহলুর রায়ের বিপরীতার্থক) মত একই চিন্তাধারা পোষণ করে। তারা স্বীকৃত চারজন ফিক্বহী মাযহাবের ইমামের তাক্বলীদ তথা অন্ধ অনুসরণকে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক মনে করে না। বরং ধর্মীয় আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে ছহীহ হাদীছের পথনির্দেশ গ্রহণ করে থাকে। তারা কুরআন ও হাদীছকে যুগপৎভাবে প্রকৃত মুসলিমদের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথনির্দেশিকা মনে করে। তারা যদি চার মাযহাবের ইমামদের কোন মতামতের পিছনে হাদীছের সমর্থন না থাকে কিংবা তা হাদীছের বিপরীত হয়, তবে তা পরিত্যাগ করে।[5]

সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, The Ahl-i Hadith try to go back to first principles and to restore the original simplicity and purity of faith and practice. Emphasis is, accordingly, laid in particular on the reassertion of tawhid or the unity of Allah and the denial of occult powers and knowledge of the hidden things (Ilm al-ghayb) to any of his creatures. This involves a rejection of the miraculous powers of saints and of the exaggerated veneration paid to them. They also make every effort to eradicate customs that may be traced either to innovation (bid’a) or to Hindu or other non-Islamic systems ‘আহলেহাদীছগণ ইসলামের প্রাথমিক যুগের মূলনীতিসমূহের দিকে ফিরে যেতে সচেষ্ট থাকে এবং তারা আক্বীদা ও আমলের মৌলিক অবিমিশ্রতা ও বিশুদ্ধতাকে পুনরুদ্ধার করতে চায়। ফলে বিশেষত তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তারা গুরুত্বারোপ করে এবং সৃষ্টিজগতের কারো অলৌকিক শক্তি ও ইলমুল গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার বিষয়টিকে তারা অস্বীকার করে। এজন্য  তারা কোন ওলী বা সাধু ব্যক্তির অলৌকিক শক্তিকে অগ্রাহ্য করে এবং তাদের প্রতি অতিভক্তি প্রদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে। তারা সমাজে প্রচলিত বিদ‘আতী, হিন্দুয়ানী এবং অনৈসলামী রসম-রেওয়াজ ও রীতি-নীতিসমূহকে সমূলে উচ্ছেদ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে থাকেন’।[6]

The Oxford Dictionary of Islam বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, Ahl al-Hadith : People of the traditions (of the Prophet). Also ashab al-hadith. The characterization refers to the adherents of the powerful movement of the late second and third centuries of Islam (late eighth and ninth centuries C.E.) that insisted on the authority of the traditions (hadith) attributed to the Prophet Muhammad, as against the informed “opinions” (ray) on which many contemporary juristic schools based their legal reasoning. This movement played a critical role in the emergence of Sunni Islam. ‘আহলেহাদীছ অর্থ রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের অনুসারী। তাদেরকে আছহাবুল হাদীছও বলা হয়। এটি হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষভাগে এবং তৃতীয় হিজরী শতকে আবির্ভূত একটি শক্তিশালী আন্দোলন, যেটি তৎকালীন যুগের বিভিন্ন যুক্তিভিত্তিক ফিক্বহী মাযহাবসমূহের ভিত্তি তথা রায় বা মতামতের বিপরীতে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিল। এই আন্দোলনটি সুন্নী ইসলামের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল’।[7]         

মোটকথা আহলেহাদীছ পরিভাষাটি সর্বসম্মতভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সমার্থক পরিভাষা। এই পরিভাষা একাধারে যেমন মুহাদ্দিছদের উদ্দেশ্য করে, তেমনি বিদ‘আতীদের বিপরীতে সঠিক আক্বীদা ও মানহাজের অনুসারীদেরকেও উদ্দেশ্য করে। উপরে বর্ণিত পূর্বযুগ ও আধুনিক যুগের বিদ্বানদের উদ্ধৃত মন্তব্যে তা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। সুতরাং আধুনিক যুগে যারা আহলেহাদীছ বলতে কেবল মুহাদ্দিছদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে মনে করেন এবং এই ধারণা পোষণ করেন যে, মুহাদ্দিছ ব্যতীত অন্য কেউ আহলেহাদীছ হ’তে পারে না, তারা নিঃসন্দেহে ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছেন। আশাকরি উপরোক্ত আলোচনায় তা পরিষ্কার হয়েছে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিভিন্ন নাম ও অভিধাগুলির মাঝে সমন্বয় :

‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র উপরোক্ত নাম ও অভিধাগুলো থেকে অনেকের মনে প্রশ্নের উদয় হ’তে পারে যে, হক্বপন্থী এই দলটির এতগুলো নামের হেতু কি? এর উত্তর হ’ল, হক্ব ও বাতিলের পার্থক্য সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে নামগুলোর জন্ম হয়েছে। এর কিছু রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারাই সাব্যস্ত, আবার কিছু বিদ‘আতীদের বিপক্ষে ইসলামের সঠিক অবস্থান বর্ণনার জন্য বিদ্বানগণ কর্তৃক ব্যবহৃত। এগুলোর পরস্পরের মাঝে কোন বিরোধ নেই। বরং যদি এই নামগুলোর প্রতি আমরা লক্ষ্য করি তবে দেখা যাবে যে প্রতিটি নামই বিদ‘আতীদের বিরুদ্ধে ইসলামের সঠিক অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং প্রতিটি নাম একই উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। নামগুলি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি মৌলিক বিষয় প্রতিভাত হয়। যেমন :

এক. এই বিশেষণগুলো এমন অর্থ বহন করে যা মুসলিম উম্মাহর শুরুকাল থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলমানকেই শামিল করে, যারা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে ধারণ করতে চায় এবং দ্বীনের পথ অনুসরণে ও দাওয়াতের ময়দানে ছাহাবীদের অনুসৃত নীতিমালাকে অবলম্বন করতে চায়। কোন যুগের মুসলমানরাই এই দল থেকে বহির্ভুত নয়। কিন্তু অন্যান্য দলটি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে আবির্ভূত হয়েছে, যা কেবল সংশ্লিষ্ট লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। 

দুই. বিশেষণগুলো কিতাব ও সুন্নাত তথা ইসলামের সব কিছু তথা কুরআন ও সুন্নাহর সবটুকু ধারণ করে। এমন কোন রসম বা রেওয়াজ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হ’তে পারে না, যা স্বল্প বা বেশী হোক কিতাব ও সুন্নাতের বিপরীত।

তিন. বিশেষণগুলো রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কোন বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা ফের্কার প্রতি আহবান করে না। আহবান করে না কোন বিদ‘আত বা পাপাচারের দিকে। যখন বলা হয় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত, তখন তা সমগ্র পৃথিবীর বিশেষ আক্বীদা ও মানহাজসম্পন্ন একদল মুসলমানকে বুঝায়। কিন্তু অন্য কোন নাম ও পরিচিতি নিয়ে যে সকল দল ইসলামের মূল জামা‘আত থেকে বের হয়েছে তাদের মধ্যে এমন বৈশ্বিকতা দেখা যায় না। বরং তারা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা অঞ্চলকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ।

চার. সর্বোপরি অন্যান্য কোন দলের নাম ও বিশেষণকে ছাহাবীদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। যেমন ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, খারেজী, শী‘আ, মু‘তাযিলা প্রভৃতি দলগুলোর নাম ছাহাবীদের সাথে যুক্ত করা সম্ভব নয়। যেহেতু তারা কেউই এই সকল দলের নাম ও চিন্তাধারার সাথে সাদৃশ্য রাখেন না। কিন্তু ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র নাম ও অভিধাগুলি সবই সালাফে ছালেহীন তথা ছাহাবীদের জন্য প্রযোজ্য। যেমন তারা ছিলেন আহলুস সুন্নাহ, কেননা তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের অনুসারী ছিলেন। তারা ছিলেন জামা‘আত, কেননা তারা ছিলেন হক্বের উপর ঐক্যবদ্ধ। তারা ছিলেন আহলুল হাদীছ কেননা তারা হাদীছের অনুসরণ করতেন এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে তার উপর আমল করতেন। তারা ছিলেন নাজী ফের্কা এবং বিজয়ী দল যাদেরকে রাসূল (ছাঃ)-ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহান্নামী দল থেকে পৃথক করে দিয়েছেন। এই অভিধাটিও কেবল ছাহাবীদের জন্য এবং তাঁদের মানহাজের অনুসারীদের জন্যই প্রযোজ্য, অন্যদের জন্য নয়।[8] 

এজন্য ইবনু তায়মিয়া (মৃ. ৭২৮হিঃ) বলেন,

أهل السنة والجماعة وهم الجمهور الأكبر والسواد الأعظم. وأما الفرق الباقية فإنهم أهل الشذوذ والتفرق والبدع والأهواء ولا تبلغ الفرقة من هؤلاء قريبا من مبلغ الفرقة الناجية فضلا عن أن تكون بقدرها بل قد تكون الفرقة منها في غاية القلة. وشعار هذه الفرق مفارقة الكتاب والسنة والإجماع. فمن قال بالكتاب والسنة والإجماع كان من أهل السنة والجماعة

‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হ’ল সবচেয়ে বড় দল এবং বৃহত্তর গোষ্ঠী। বাকী যে ফের্কাগুলো রয়েছে সেগুলো অর্বাচিন, বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিদ‘আতী এবং স্বেচ্ছাচারী দল। যদি তুলনা করা হয় তবে ফের্কা নাজিয়াহর অনুসারীর সংখ্যার তুলনায় উক্ত দলগুলির অনুসারীর সংখ্যা সমপরিমাণ তো নয়ই; কাছাকাছিও হবে। বরং তা নিতান্তই কম সংখ্যক হবে। এই সকল ফের্কার বৈশিষ্ট্য হ’ল কিতাব, সুন্নাত ও ইজমা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকবে। আর যে ব্যক্তি কিতাব, সুন্নাত এবং ইজমার কথা বলে, সে ব্যক্তি ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র অন্তর্ভুক্ত।[9]

উপসংহার :

উপরোক্ত আলোচনায় আমরা বিদ্বানদের দৃষ্টিতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পরিচিতি, নামকরণের কারণ এবং এই দলটির বৈশিষ্ট্যসূচক বিভিন্ন নাম ও অভিধা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনার প্রয়াস পেয়েছি। এতে সুস্পষ্ট হয় যে, ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে চলে আসা ইসলামের অকৃত্রিম ও নির্ভেজাল বৈশিষ্ট্যধারী দলটির নাম হ’ল ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’। রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু পরবর্তী একশত বছরের মধ্যে মুসলিম সমাজে যখন নানা বিদ‘আতী দলের উদভব ঘটেছিল, তখন থেকে ইসলামের বিশুদ্ধ ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে এই সুন্নাতপন্থী দলের আবির্ভাব ঘটেছিল, যারা যুগে যুগে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, দ্বীনের বুঝ গ্রহণে ছাহাবায়ে কেরামের মানহাজকে সুরক্ষা দান করেছে এবং যাবতীয় অনৈসলামী রসম-রেওয়াজ ও শিরক-বিদ‘আতের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এই দলটিই ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী থাকবে এবং এই দলের অনুসারীগণই হবেন নাজী বা মুক্তিপ্রাপ্ত ফের্কার অন্তর্ভুক্ত। ছাহাবীদের যুগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় এই দলটি বিভিন্ন নামে পরিচিত হ’লেও দলটির মূল আদর্শ ও  বৈশিষ্ট্যে কোনরূপ পরিবর্তন ঘটেনি। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে কম সংখ্যক হ’লেও সুন্নাতের ধারক-বাহক হিসাবে এই দলটি সর্বদা বিরাজমান ছিল, রয়েছে এবং থাকবে। এই দলই হ’ল মুসলিম উম্মাহর মূল ধারা।

ভারত উপমহাদেশে কিছু নামধারী ফের্কা বা দল রয়েছে যারা সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ করে না এবং শরী‘আতের বুঝ গ্রহণে ছাহাবীদের নীতিও অনুসরণ করে না। বরং নানা শিরক ও বিদ‘আতে তারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত। অথচ তারা নিজেদেরকে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ বলে দাবী করে। নিঃসন্দেহে আহলে সুন্নাতের মূল আদর্শচ্যুত হয়ে নিজেদের আহলে সুন্নাত দাবী করার কোনই সুযোগ নেই। অতএব তাদের এই দাবী ভ্রান্ত।

আবার একদল মাযহাবী আলেম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র দ্বিতীয় কোন নাম বা অভিধাকে স্বীকার করেন না। যেমন সালাফ বিদ্বানদের বহুল ব্যবহৃত ‘আহলেহাদীছ’ পরিভাষাটি তারা কেবলমাত্র মুহাদ্দিছদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তারা ভারত উপমহাদেশে কোন আহলেহাদীছ ব্যক্তিকে দেখলে তাচ্ছিল্য করেন এই মর্মে যে, আহলেহাদীছ হ’তে গেলে অবশ্যই মুহাদ্দিছ হ’তে হবে। মুহাদ্দিছ ব্যতীত কেউ আহলেহাদীছ হ’তে পারে না। তাদের এই বক্তব্য যে স্রেফ বিদ্বেষপ্রসূত এবং সত্যকে আড়াল করার প্রচেষ্টা তা অস্পষ্ট নয়। কেননা তারা ভাল করেই জানেন যে, যখন কোন ব্যক্তি নিজেকে আহলেহাদীছ বলে, তখন সে নিজেকে মুহাদ্দিছ দাবী করে না, বরং সে নিজেকে হাদীছের যথার্থ অনুসারী তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হিসাবে দাবী করে। মূলতঃ মুহাদ্দিছ মাত্রই যেমন আহলেহাদীছ হওয়া শর্ত নয়; তেমনি আহলেহাদীছ হওয়ার জন্য মুহাদ্দিছ হওয়া আবশ্যক নয়। যা আমরা উপরোক্ত আলোচনায় বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।       

অন্যদিকে বর্তমানে আমাদের দেশসহ ভারত ও পাকিস্তানের কিছু উঠতি বয়সী নবীন দ্বীনদার যুবক ও সুধীবৃন্দ সঠিক আক্বীদা ও আমলধারী এবং শিরক-বিদ‘আত বর্জনকারী হওয়া সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে নিজেদেরকে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ বা ‘আহলেহাদীছ’ বা ‘সালাফী’ নামকরণ করতে রাযী নন। এমনিভাবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বিদ্বানদের মধ্যকার অনেকেই নিজেকে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হিসাবে উপস্থাপনের জন্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত কোন নামে নিজেকে পরিচিত না করে স্রেফ ‘মুসলিম’ হিসাবে উপস্থাপন করাকেই যথেষ্ট মনে করছেন এবং এ পথেই মানুষকে আহবান করছেন। এমনকি ঐ সকল পরিচয়ে পরিচিত হওয়াকে তারা সংকীর্ণতা বা ইসলামের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টির নামান্তর মনে করছেন। আমরা বলব, নিঃসন্দেহে এমন ধ্যান-ধারণা পোষণ করা অজ্ঞতার পরিচায়ক। কেননা ইসলামের ধর্মীয় বিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান থাকলে এমন বক্তব্য প্রদানের সুযোগ নেই। ইসলাম যে ৭৩ ভাগে বিভক্ত হবে এটি রাসূল (ছাঃ)-এরই ভবিষ্যদ্বাণী। মুসলিম সমাজে অসংখ্য দল-উপদলের সৃষ্টি হয়েছে এবং তাদের আক্বীদা-আমল কুরআন, হাদীছ ও সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত মূলনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থিত- এ এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। শিরক-বিদ‘আতে মুখরিত সমাজে বিশুদ্ধ ইসলামের অনুসারী একদল মানুষ চিরদিন থাকবে এটাও রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী। হক্বপন্থীদেরকে বাতিলপন্থীদের থেকে পৃথক করার জন্য সালাফ ওলামায়ে কেরাম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ কিংবা ‘আহলুল হাদীছ’ বা ‘সালাফী’ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগত নামে চিহ্নিত করেছেন, তাও কোন অজানা বিষয় নয়। অথচ এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেও যারা নিজেদেরকে স্রেফ ‘মুসলিম’ হিসাবে পরিচয় দেওয়াকে কর্তব্যজ্ঞান করেন এবং বৈশিষ্ট্যগত পরিচয়সমূহকে ফের্কাবন্দী মনে করেন তারা হয় অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন, নতুবা হঠকারিতা প্রকাশ করছেন। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

এদের মধ্যে আবার এমন অনেকেই আছেন যারা নিজেকে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের’ই অন্তর্ভুক্ত মনে করেন, কিন্তু এর সমার্থক পরিভাষা ‘আহলেহাদীছ’ বা ‘সালাফী’ পরিচয় দানে তাদের যত আপত্তি। অথচ বিদ্বানগণ একই অর্থে এসব পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, যা আমরা উপরের আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করেছি। সুতরাং তাদের এই আপত্তির কোন ভিত্তি নেই। হক্ব গ্রহণ করার পরও যারা অদ্যাবধি এই গোলকধাঁধাঁ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি, তাদের প্রতি আমাদের আহবান, আসুন! আমরা ইতিহাস সচেতন হই। অর্থহীন আবেগকে ত্যাগ করে নিজেকে জ্ঞানসমৃদ্ধ করি। আমাদেরকে অবশ্যই আত্মপরিচয়ের সংকট (Identity Crisis) থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা আমরা হক্বপন্থী হওয়ার পরও নিজেদেরকে চিনতে ব্যর্থ হয়ে যে কোন মুহূর্তে দিশা হারিয়ে ফেলতে বাধ্য। আত্মপরিচয় এবং আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অসচেতন ব্যক্তি কখনই আদর্শিকভাবে মজবুত থাকতে পারে না। পারে না সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ়তার সাথে অটল থাকতে। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের সকলকে ইসলামে বিশুদ্ধ আদর্শের উপর অটল ও অবিচল রাখুন এবং ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতে’র আক্বীদা ও মানহাজকে চেনা, বোঝা এবং এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন!


[1]. আবূ উছমান আছ-ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবুল হাদীছ, পৃ. ৩৬।

[2]. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭।

[3]. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৭।

[4]. আব্দুল কাদের আল-জীলানী, আল-গুনিয়াহ লি তালিবি ত্বরীকীল হাক্ব, ১/১৬৬ পৃ.।

[5]Editorial board, The Encyclopedia of Islam (Leiden : Brill, 1986), p. 1/259.

[6]Ibid, p. 1/259.

[7]Editorial board, The Oxford Dictionary of Islam, online edition.

[8]. দ্র. ছালেহ আদ-দাখীল, খাছায়েছু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃ. ১৫২-১৫৩।

[9]. ইবনু তায়মিয়া, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৩/৩৪৫-৩৪৬ পৃ.।





জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত ও হিকমত - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হজ্জ সফর (১ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বালা-মুছীবত থেকে পরিত্রাণের উপায় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
পারিবারিক অপরাধ : কারণ ও প্রতিকার (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (৩য় কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
ইসলামের কতিপয় সামাজিক বিধান - মুহাম্মাদ ইমদাদুল্লাহ
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঈমান (৪র্থ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
ইখলাছ (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.