মানুষ
সমাজবদ্ধ জীব। সে একাকী জীবন যাপন করতে পারে না। নানা কারণে তাকে অন্যের
সাথে মিলে মিশে বসবাস করতে হয়। সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক
আচার-ব্যবহার সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যের সাথে চলাফেরা ও আচার-আচরণে তার
শিষ্টাচার কেমন হবে, সে বিষয়ে ইসলামে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। সেগুলি
পালন করলে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তার সম্পর্ক সুন্দর হবে, সমাজে
তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। সাথে সাথে সে অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হবে। আর
পরকালে পাবে অশেষ ছওয়াব। পক্ষান্তরে ঐ শিষ্টাচারগুলির অভাবে সমাজে যেমন সে
নিগৃহীত হয়, তেমনি তার সাথে অন্যের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে না। পরকালেও সে কোন
ছওয়াব পায় না। নিম্নে মানুষের সাথে আচার-আচরণের আদবগুলি উল্লেখ করা হ’ল।-
মানুষের সাথে আচার-ব্যবহারের আদবগুলি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ক. পালনীয় আদব খ. বর্জনীয় আদব।
ক. পালনীয় আদব সমূহ :
১. অন্যকে গুরুত্ব দেওয়া : সমাজের প্রতিটি সদস্যের গুরুত্ব আছে এবং প্রত্যেকের স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। তাই প্রত্যেককে স্ব স্ব অবস্থান অনুযায়ী গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। রাসূল (ছাঃ) সমাজের মানুষকে গুরুত্ব দিতেন। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একজন কালো মহিলা অথবা একটি যুবক (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) মসজিদে নববী ঝাড়ু দিত। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে দেখতে পেলেন না। তিনি সে মহিলা অথবা যুবকটির খোঁজ নিলেন। লোকেরা বলল, সে মৃত্যুবরণ করেছে। তিনি বললেন, তোমরা আমাকে জানালে না কেন? বর্ণনাকারী বলেন, লোকেরা এ মহিলা বা যুবকের বিষয়টিকে তুচ্ছ ভেবেছিল। তিনি বললেন, তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে আমাকে দেখাও। তারা তাঁকে তার কবর দেখিয়ে দিল। তখন তিনি তার ক্ববরে (কাছে গেলেন ও) জানাযার ছালাত আদায় করলেন। তারপর বললেন, এ কবরগুলো এর অধিবাসীদের জন্য ঘন অন্ধকারে ভরা ছিল। আর আমার ছালাত আদায়ের ফলে আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে আলোকিত করে দিয়েছেন’।[1] এখানে অন্যকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি ফুটে উঠেছে।
আরেকটি হাদীছে এসেছে, জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,دَخَلْتُ الْجَنَّةَ أَوْ أَتَيْتُ الْجَنَّةَ فَأَبْصَرْتُ قَصْرًا فَقُلْتُ لِمَنْ هَذَا، قَالُوا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَأَرَدْتُ أَنْ أَدْخُلَهُ فَلَمْ يَمْنَعْنِى إِلاَّ عِلْمِى بِغَيْرَتِكَ قَالَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ يَا رَسُوْلَ اللهِ بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى يَا نَبِىَّ اللهِ أَوَ عَلَيْكَ أَغَارُ. ‘আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম অথবা জান্নাতের নিকটে এসে একটি প্রাসাদ দেখতে পেলাম। অতঃপর জিজ্ঞেস করলাম, এটি কার প্রাসাদ? তাঁরা (ফেরেশতাগণ) বললেন, এ প্রাসাদটি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর। আমি তার মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু কেবল তোমার আত্মমর্যাদাবোধ আমাকে সেখানে প্রবেশে বাধা দিল, যা আমার জানা ছিল। এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! আপনার কাছেও আমি আত্মমর্যাদাবোধ প্রকাশ করব’?[2] এভাবে রাসূল (ছাঃ) অন্যকে গুরুত্ব দিতেন।
২.
দায়িত্ব সচেতন হওয়া : সমাজের প্রত্যেকে দায়িত্ব সচেতন হ’লে এবং নিজ নিজ
দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে সমাজ সুন্দর হয়। সমাজ পরিণত হয় শান্তি-সুখের
আকরে। এজন্য সকলকে সচেতন ও সজাগ হওয়া দরকার। নবী করীম (ছাঃ) এ ব্যাপারে
ছিলেন আদর্শের প্রতীক। তিনি মদীনায় হিজরতের পরে আনছার ও মুহাজিরদের
পরস্পরের সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। এতে নিঃস্ব ও আশ্রয়হীন
মুহাজিরদের জন্য আনছাররা পানাহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। আনাস
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) যখন মদীনায়
আসলেন, তখন নবী করীম (ছাঃ) তাঁর ও সা‘দ ইবনু রবী‘ আনছারী (রাঃ)-এর মধ্যে
ভ্রাতৃত্ব বন্ধন জুড়ে দিলেন। সা‘দ (রাঃ) তার সম্পদ ভাগ করে অর্ধেক সম্পদ
এবং দু’জন স্ত্রীর যে কোন একজন নিয়ে যাওয়ার জন্য আব্দুর রহমানকে অনুরোধ
করলেন। তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ আপনার পরিবারবর্গ ও ধন-সম্পদে বরকত দান
করুন। আমাকে এখানকার বাযারের রাস্তাটি দেখিয়ে দিন। তিনি মুনাফা হিসাবে কিছু
ঘি ও পনির লাভ করলেন। কিছুদিন পরে নবী করীম (ছাঃ) তার (আব্দুর রহমানের)
দেখা পেলেন। তিনি তখন তার গায়ে হলুদ রং-এর চিহ্ন দেখতে পেয়ে বললেন, হে
আব্দুর রহমান! ব্যাপার কি? তিনি বললেন, আমি একজন আনছারী মহিলাকে বিয়ে
করেছি। নবী করীম (ছাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তাকে কি পরিমাণ মোহর দিয়েছ? তিনি
বললেন, তাকে খেজুর বিচির পরিমাণ সোনা দিয়েছি। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন,
একটি বকরী দিয়ে হ’লেও ওয়ালীমা করে নাও’।[3]
আমাদেরকেও
স্ব স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হ’তে হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ
كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، ‘সাবধান! তোমরা
প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। তোমরা প্রত্যেকেই ক্বিয়ামতের দিন স্ব স্ব দায়িত্ব
সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[4]
৩. নিজের
ব্যক্তিত্বের প্রতি সজাগ থাকা : প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা
রয়েছে। তাই সকলকে নিজের আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে কাজ করা উচিত।
এক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ) ছিলেন অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন। নিজের ব্যক্তিত্ব যেমন
তিনি বজায় রাখতেন, তেমনি অন্যের আত্মসম্মানের প্রতিও বিশেষভাবে লক্ষ্য
রাখতেন। আবূ ইসহাক (রহঃ) হ’তে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি বারা ইবনু আযিব
(রাঃ)-কে বলল, আপনারা কি হুনায়নের যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে ময়দানে
রেখে পলায়ন করেছিলেন? বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেন, কিন্তু আল্লাহর রাসূল
(ছাঃ) পলায়ন করেননি। হাওয়াযিনরা ছিল সূদক্ষ তীরন্দায। আমরা সম্মুখ যুদ্ধে
তাদের পরাস্ত করলে তারা পালিয়ে যেতে লাগল। তখন মুসলমানরা তাদের পিছু ধাওয়া
না করে গনীমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন শত্রুরা তীর বর্ষণের
মাধ্যমে আমাদের আক্রমণ করে বসল। তবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্থান ত্যাগ
করেননি। আমি তাঁকে তাঁর সাদা খচ্চরটির উপর অটল অবস্থায় দেখেছি। আবূ সুফিয়ান
(রাঃ) তাঁর বাহনের লাগাম ধরে টানছেন; আর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)
বলছেন,وَالنَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ أَنَا النَّبِىُّ لاَ
كَذِبْ أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ. ‘আমি মিথ্যা নবী নই, আমি আব্দুল
মুত্তালিবের বংশধর’।[5]
রাসূল (ছাঃ) সর্বদা
অন্যের রাযী-খুশির প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,أَنَّ
رَجُلاً قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ أَيْنَ أَبِىْ قَالَ فِىْ النَّارِ
فَلَمَّا قَفَّى دَعَاهُ فَقَالَ إِنَّ أَبِىْ وَأَبَاكَ فِىْ النَّارِ.
‘একদা এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার পিতা কোথায়? তিনি
বললেন, তোমার পিতা জাহান্নামে। অতঃপর যখন সে পিঠ ফিরিয়ে চলে যেতে লাগলো তখন
তিনি বললেন, তোমার পিতা ও আমার পিতা জাহান্নামে’।[6]
৪.
অন্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা : অন্যের গোপনীয় বিষয় প্রকাশ না করা মুসলমানের
জন্য অবশ্য করণীয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,يَا مَعْشَرَ مَنْ قَدْ أَسْلَمَ
بِلِسَانِهِ وَلَمْ يُفْضِ الإِيْمَانُ إِلَى قَلْبِهِ لاَ تُؤْذُوْا
الْمُسْلِمِيْنَ وَلاَ تُعَيِّرُوْهُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوْا عَوْرَاتِهِمْ
فَإِنَّهُ مَنْ تَتَبَّعَ عَوْرَةَ أَخِيْهِ الْمُسْلِمِ تَتَبَّعَ اللهُ
عَوْرَتَهُ وَمَنْ تَتَبَّعَ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ وَلَوْ فِىْ
جَوْفِ رَحْلِهِ، ‘হে ঐ জামা‘আত, যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছ কিন্তু অন্তরে
এখনো ঈমান মযবূত হয়নি। তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিবে না, তাদের লজ্জা দিবে না
এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা যে লোক তার মুসলিম
ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবে আল্লাহ তা‘আলা তার গোপন দোষ প্রকাশ
করে দিবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ করে দিবেন তাকে অপমান
করে ছাড়বেন, সে তার উটের হাওদার ভিতরে অবস্থান করে থাকলেও’।[7]
কেউ
কোন মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখলে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার
দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন, وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا
سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ ঢেকে
রাখবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন’।[8] তিনি আরো বলেন,لاَ
يَسْتُرُ اللهُ عَلَى عَبْدٍ فِى الدُّنْيَا إِلاَّ سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ
الْقِيَامَةِ، ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন বান্দার দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ
তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন’।[9] তিনি আরো বলেন,مَنِ
اسْتَمَعَ إِلَى حَدِيثِ قَوْمٍ وَهُمْ لَهُ كَارِهُونَ صُبَّ فِى أُذُنِهِ
الآنُكُ، ‘যে ব্যক্তি কোন কওমের (গোপন) কথা শ্রবণ করবে, যা তারা অপসন্দ
করে, তার কানে শীশা ঢেলে দেওয়া হবে’।[10]
৫. মানুষের দেওয়া কষ্ট সহ্য করা : সমাজে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বিজ্ঞ-অজ্ঞ, জ্ঞানী-জ্ঞানহীন, দানশীল-বখীল, সুধারণা ও কুধারণার অধিকারী বিভিন্ন স্বভাব-প্রকৃতির লোক রয়েছে। তাদের আচার-ব্যবহারও ভিন্ন ভিন্ন। কাজেই তাদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করা মুমিনের কর্তব্য। মসজিদে পেশাবকারী বেদুঈন[11] এবং রাসূলের নিকটে বায়তুল মাল থেকে যাচ্ঞাকারী বেদুঈনের সাথে রাসূল (ছাঃ) যে অমায়িক আচরণ করেছিলেন,[12] তা থেকে মানুষের সাথে আমাদের আচার-ব্যবহার কিরূপ হবে সেটা সহজেই অনুমিত হয়।
আরেকটি
হাদীছে এসেছে, আবূ মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম
(ছাঃ)-এর নিকট মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী জি‘রানা নামক স্থানে অবস্থান
করছিলাম। তখন বেলাল (রাঃ) তাঁর কাছে ছিলেন। এমন সময়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর
কাছে এক বেদুঈন এসে বলল, আপনি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন তা কি পূরণ করবেন
না? তিনি তাঁকে বললেন, সুসংবাদ গ্রহণ কর। সে বলল, সুসংবাদ গ্রহণ কর কথাটি
তো আপনি আমাকে অনেকবারই বলেছেন। তখন তিনি ক্রোধ ভরে আবূ মূসা ও বেলাল
(রাঃ)-এর দিকে ফিরে বললেন, লোকটি সুসংবাদ ফিরিয়ে দিয়েছে। তোমরা দু’জন তা
গ্রহণ কর। তাঁরা উভয়ে বললেন, আমরা তা গ্রহণ করলাম। এরপর তিনি পানির একটি
পাত্র আনতে বললেন। তিনি এর মধ্যে নিজের উভয় হাত ও মুখমন্ডল ধুয়ে কুলি
করলেন। তারপর বললেন, তোমরা উভয়ে এ থেকে পান করো এবং নিজেদের মুখমন্ডল ও
বুকে ছিটিয়ে দাও। আর সুসংবাদ গ্রহণ কর। তাঁরা উভয়ে পাত্রটি তুলে নিয়ে
নির্দেশ মত কাজ করলেন। এমন সময় উম্মু সালামাহ (রাঃ) পর্দার আড়াল থেকে ডেকে
বললেন, তোমাদের মায়ের জন্যও অতিরিক্ত কিছু রাখ। কাজেই তাঁরা এ থেকে
অতিরিক্ত কিছু তাঁর [উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর] জন্য রাখলেন’।[13]
৬.
চুপ থাকা ও মনোযোগ সহকারে কথা শ্রবণ করা : অধিক কথা বলা বা বাচালতা করা
ভাল নয়। বরং অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকা ও চুপ থাকা মুমিনের
বৈশিষ্ট্য। আর পারলে সকলের জন্য কল্যাণকর উত্তম কথা বলা উচিত। অন্যথা চুপ
থাকা কর্তব্য। সেই সাথে মিথ্যা ও অশ্লীল কথা-বার্তা থেকে সর্বতোভাবে বিরত
থাকতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ
الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ، ‘যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে
বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে’।[14]
পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষের সাথে আলোচনা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ বলেন,الَّذِيْنَ يَسْتَمِعُوْنَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُوْنَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِيْنَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ، ‘যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে, অতঃপর তার মধ্যে যেটা উত্তম সেটার অনুসরণ করে। তাদেরকে আল্লাহ সুপথে পরিচালিত করেন ও তারাই হ’ল জ্ঞানী’ (যুমার ৩৯/১৮)।
৭. আওয়াজ নিম্ন করা এবং কণ্ঠস্বর উচ্চ না করা : কারো সাথে কথা বলার সময় উচ্চস্বরে কথা না বলে নিম্নস্বরে বলাই সমীচীন। আল্লাহ বলেন,وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ، ‘তুমি পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু কর। নিশ্চয়ই সবচেয়ে বিকট স্বর হ’ল গাধার কণ্ঠস্বর’ (লোক্বমান ৩১/১৯)।
৮.
হাসিমুখে কথা বলা : গোমড়া মুখে কথা বলা কেউ পসন্দ করে না। সদা
হাস্যোজ্জ্বল থাকা ও হাসিমুখে কথা বলা মানুষ পসন্দ করে। হাসিমুখে মুসলিম
ভাইয়ের সাথে কথা বলায় নেকী অর্জিত হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ تَحْقِرَنَّ
مِنَ الْمَعْرُوْفِ شَيْئًا وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ-
‘তোমরা কোন নেক কাজকে ছোট ভেবো না, যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিখুশী
মুখে সাক্ষাৎ করা হয়’।[15] তিনি আরো বলেন,تَبَسُّمُكَ فِىْ وَجْهِ أَخِيْكَ
لَكَ صَدَقَةٌ، ‘তোমার হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তোমার ভাইয়ের সামনে উপস্থিত
হওয়া তোমার জন্য ছাদাক্বা স্বরূপ’।[16]
৯. মানুষের সাথে উত্তম কথা বলা : ভাল কথা ছাদাক্বা স্বরূপ। তাই মানুষের সাথে উত্তম কথা বলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقُوْلُوْا لِلنَّاسِ حُسْنًا، ‘মানুষের সাথে উত্তম কথা বলবে’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ، ‘যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, অথবা চুপ থাকে’।[17] সুতরাং মন্দ কথা পরিহার করতে হবে। কেননা তা গোনাহ ব্যতীত কোন কল্যাণ বয়ে আনে না।
১০.
নম্র ব্যবহার করা : রুক্ষ্মতা ও কর্কশতা মানব চরিত্রের খারাপ গুণের
অন্যতম। এজন্য এসব পরিত্যাজ্য। বরং নম্রতা অবলম্বন করা যরূরী। কেননা বিনয়ী ও
নম্র মানুষকে সবাই ভালবাসে ও পসন্দ করে। তাই এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করা
সকলের জন্য কর্তব্য। হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একবার একদল
ইহূদী নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে সালাম দিতে গিয়ে বলল, ‘আস্সা-মু আলাইকা’।
তিনি বললেন, ‘ওয়া আলাইকুম’। কিন্তু আয়েশা (রাঃ) বললেন, ‘আসসা-মু আলাইকুম
ওয়া লা‘আনাকুমুল্লাহু ওয়া গাযিবা আলাইকুম’ (তোমরা ধ্বংস হও, আল্লাহ তোমাদের
উপর লা‘নত করুন, আর তোমাদের উপর গযব অবতীর্ণ করুন)। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বললেন,مَهْلاً يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ، وَإِيَّاكِ
وَالْعُنْفَ أَوِ الْفُحْشَ. قَالَتْ أَوَلَمْ تَسْمَعْ مَا قَالُوا قَالَ
أَوَلَمْ تَسْمَعِى مَا قُلْتُ رَدَدْتُ عَلَيْهِمْ، فَيُسْتَجَابُ لِىْ
فِيْهِمْ، وَلاَ يُسْتَجَابُ لَهُمْ فِىَّ- ‘হে আয়েশা! তুমি থামো, তুমি
নম্রতা অবলম্বন করো, আর তুমি কঠোরতা বর্জন করো। আয়েশা (রাঃ) বললেন, তারা কি
বলেছে আপনি কি শুনেননি? তিনি বললেন, আমি যা বলেছি, তা কি তুমি শুননি? আমি
তো তাদের কথাটা তাদের উপরই ফিরিয়ে দিলাম। কাজেই তাদের উপর আমার বদ দো‘আ
কবূল হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তাদের বদ দো‘আ কবুল হবে না’।[18]
আয়েশা
(রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,يَا عَائِشَةُ
إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ
يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ. ‘হে আয়েশা!
আল্লাহ তা‘আলা বিনম্র। তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন
কিছু দান করেন, যা কঠোরতার দরুন দান করেন না। আর অন্য কোন কিছুর দরুনও তা
দান করেন না’।[19]
বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা
সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ
أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ
حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا
وَالآخِرَةِ. ‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও
আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে
বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা
হয়েছে’।[20]
তিনি আরো বলেন, وَمَا تَوَاضَعَ
أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللهُ، ‘যে বান্দাহ আল্লাহর জন্য বিনীত হয়,
আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’।[21] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্যত্র
বলেন,إنَّ اللهَ إذَا أحَبَّ أهْلَ بَيْتٍ أدْخَلَ عَلَيْهِمُ الرِّفْقَ،
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন গৃহবাসীকে ভালবাসেন, তখন তাদের মাঝে নম্রতা প্রবেশ
করান’।[22] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا أَعْطَي أَهْلَ بَيْتٍ
الرِّفْقَ إِلاَّ نَفَعَهُمْ وَلاَ مَنَعُوْهُ إَلاَّ ضَرَّهُمْ، ‘আল্লাহ
কোন গৃহবাসীকে নম্রতা দান করে তাদেরকে উপকৃতই করেন। আর কারো নিকট থেকে তা
উঠিয়ে নিলে তারা ক্ষতিগ্রস্তই হয়’।[23]
তিনি
আরো বলেন,إنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيُعْطَي عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ
يُعْطَي عَلَى الْخُرْقِ، وَإِذَا أَحَبَّ اللهُ عَبْدًا أَعْطَاهُ
الرِّفْقَ، مَا مِنْ أَهْلِ بَيْتٍ يَحْرِمُوْنَ الرِّفْقَ إِلاَّ
حُرِمُوْا الْخَيْرَ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ নম্রতার মাধ্যমে যা দান করেন,
কঠোরতার কারণে তা করেন না। আল্লাহ কোন বান্দাকে ভালবাসলে তাকে নম্রতা দান
করেন। কোন গৃহবাসী নম্রতা পরিহার করলে, তারা কেবল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হয়’।[24]
১১.
আমানত রক্ষা করা : আমানত রক্ষা করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
খেয়ানতকারীকে কেউ পসন্দ করে না। তাই মানুষের গচ্ছিত আমানত রক্ষা করা অতীব
যরূরী। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَدِّ الأَمَانَةَ إِلَى مَنِ ائْتَمَنَكَ وَلاَ
تَخُنْ مَنْ خَانَكَ، ‘যে ব্যক্তি তোমার কাছে কিছু আমানত রেখেছে তাকে তা
ফেরত দাও। আর যে ব্যক্তি তোমার সাথে খিয়ানত করেছে তুমি তার সাথে খিয়ানত করো
না’।[25]
১২. রাগ নিয়ন্ত্রণ করা : প্রতিটি মানুষের মধ্যে রাগ আছে। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। অপর কোন মুসলিম ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় রাগান্বিত না হয়ে শান্তভাবে কথা বলা কর্তব্য। কোন কারণে রাগ হ’লেও তা দমন করা উচিত। মুত্তাক্বীদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِيْنَ الْغَيْظَ وَالْعَافِيْنَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ، ‘যারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৩৪)।
আবূ
হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলল, আমাকে
উপদেশ দিন। তিনি বললেন,لاَ تَغْضَبْ فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ لاَ
تَغْضَبْ. ‘তুমি রাগ করো না। সে লোকটি কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করল। তিনি
বললেন, ‘তুমি রাগ করো না’।[26]
আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় বলেন, ‘যখন তারা ক্রুদ্ধ হয় তখন ক্ষমা করে’ (শূরা ৪২/৩৭)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ
يُنْفِذَهُ دَعَاهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى رُءُوْسِ الْخَلاَئِقِ
يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُخَيِّرَهُ اللهُ مِنَ الْحُوْرِ مَا شَاءَ،
‘যে ব্যক্তি তার রাগ প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সংযত থাকে, ক্বিয়ামতের
দিন আল্লাহ তাকে সৃষ্টিকুলের মধ্য থেকে ডেকে নিবেন এবং তাকে হূরদের মধ্য
হ’তে তার পসন্দমত যে কোন একজনকে বেছে নিতে বলবেন’।[27] আরেক বর্ণনায় এসেছে,
জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এমন একটি
আমলের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বললেন, ‘তুমি রাগ
প্রকাশ করবে না, তোমার জন্য জান্নাত রয়েছে’।[28]
অন্যত্র
তিনি বলেন, ‘কোন বান্দা আল্লাহর সন্তোষ লাভের আকাঙ্ক্ষায় ক্রোধের ঢোক
গলধঃকরণ (সংবরণ) করলে, আল্লাহর নিকট ছওয়াবের দিক থেকে তার চেয়ে অধিক
মর্যাদাপূর্ণ কোন ঢোক আর নেই’।[29] ইবনু ওমর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে বলেন, কিসে আমাকে আল্লাহর ক্রোধ থেকে রক্ষা করবে? তিনি বললেন, তুমি ক্রোধ প্রকাশ করবে না।[30] এছাড়াও ক্রোধকে সকল অনিষ্টের মূল বলা হয়েছে।[31]
১৩.
মানুষের উপকার করা : এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। তারা মিলেমিশে
বসবাস করবে এবং একে অপরের উপকার করবে, এটা মানবতার অন্যতম গুণ-বৈশিষ্ট্য।
সেই সাথে সে অন্যের অপকার করা ও অনিষ্ট থেকে বিরত থাকবে। তাহ’লে সে ইহকালে ও
পরকালের কল্যাণ লাভে ধন্য হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى
اللهِ تَعَالَى أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ، ‘আল্লাহর নিকটে উত্তম হচ্ছে ঐ
ব্যক্তি যে মানুষের জন্য সর্বাধিক উপকারী’।[32] অন্যত্র তিনি বলেন,خَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ، ‘উত্তম ব্যক্তি হচ্ছে সে যে মানুষের জন্য সর্বাধিক উপকারী’।[33]
মানুষের
উপকার করার ফযীলত সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ
أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِىْ حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً
فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ،
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করে, আল্লাহ্ তার প্রয়োজন পূরণ করে
দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের কষ্ট দূর করে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্
তার কষ্ট দূর করে দিবেন’।[34]
তিনি আরো
বলেন,مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ
اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ
عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ
سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَاللهُ فِىْ
عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِىْ عَوْنِ أَخِيْهِ، ‘যে ব্যক্তি
কোন মুসলিমের কোন পার্থিব দুর্ভোগ দূরীভূত করবে, আল্লাহ তার ক্বিয়ামতের
দিনের দুর্ভোগসমূহের মধ্যে কোন একটি দুর্ভোগ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন
ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তির প্রতি সহজ করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার
প্রতি সহজ করবেন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার মুসলিম ভাইয়ের সহযোগিতা
করতে থাকে, আল্লাহও সে বান্দার সাহায্য করতে থাকেন’।[35]
১৪. মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া : মানুষ বিভিন্ন কারণে অপরাধ করে থাকে। কিন্তু অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে কিংবা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার থেকে প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া মহত্ত্বের পরিচয়। মানবীয় এ মহৎ গুণের অধিকারী মানুষই সমাজে নন্দিত হয়, সমাদৃত হয়। তাই ক্ষমাশীলতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মহান আল্লাহ বলেন,خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِيْنَ، ‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আ‘রাফ ৭/১৯৯)।
১৫. অপরের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দেওয়া : কোন লোকের মধ্যে কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হ’লে সংশোধনের উদ্দেশ্যে তাকে ব্যক্তিগতভাবে বলতে হবে। যাতে সে সংশোধিত হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন,الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ يَكُفُّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ وَيَحُوْطُهُ مِنْ وَرَائِهِ- ‘এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়না স্বরূপ। এক মুমিন অপর মুমিনের ভাই। তারা একে অপরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে রক্ষা করে’।[36] এতে তার সাথে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে।
১৬. অন্যকে উপদেশ দেওয়া : পার্থিব ও পরকালীন বিভিন্ন বিষয়ে মুসলমানদের একে অপরকে উপদেশ দেওয়া উচিত। যা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে পরিত্রাণের উপায় (আছর ১০৩/১-৩)। নছীহত করায় মুমিনের ইহ-পরকালীন কল্যাণ সাধিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِيْنَ، ‘আর তুমি উপদেশ দিতে থাক। কেননা উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসবে’ (যারিয়াত ৫১/৫৫)।
রাসূল
(ছাঃ) বলেন,الدِّيْنُ النَّصِيْحَةُ قُلْنَا لِمَنْ قَالَ لِلَّهِ
وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُوْلِهِ وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ
وَعَامَّتِهِمْ- ‘সদুপদেশ দেয়াই দ্বীন। আমরা আরয করলাম, কার জন্য উপদেশ?
তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের, মুসলিম শাসক এবং মুসলিম
জনগণের’।[37] রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا اسْتَنْصَحَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ
فَلْيَنْصَحْ لَهُ- ‘যখন তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের নিকট উপদেশ চাইবে, তখন সে
যেন তাকে উপদেশ দান করে’।[38]
১৭. অপরকে উপহার-উপঢৌকন প্রদান করা :
হাদিয়া বা উপহার আদান-প্রদান করা শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। এতে পরস্পরের
মধ্যে সম্প্রীতি-সদ্ভাব গড়ে ওঠে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,تَهَادُّوْا
تَحَابُّوْا، ‘তোমরা একে অপরকে উপঢৌকন দাও এবং ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হও’।[39]
১৮. সালাম দেওয়া ও উত্তর দেওয়া : বিভিন্ন জাতি-ধর্মে অভিবাদনের রীতি চালু আছে। ইসলামী অভিবাদন হচ্ছে সালাম বিনিময় করা। এতে উভয়ই নেকীর অধিকারী হয়। আর এর মাধ্যমে পারস্পরিক আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। গড়ে ওঠে সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন। তাই সালাম আদান-প্রদান করা ইসলামের নির্দেশ। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لاَ تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوْا وَتُسَلِّمُوْا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যদের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা তাদের অনুমতি নাও এবং গৃহবাসীদের প্রতি সালাম কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। সম্ভবতঃ তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে (তা মেনে চলার মাধ্যমে)’ (নূর ২৪/২৭)। অন্যত্র তিনি আরো বলেন,فَإِذَا دَخَلْتُمْ بُيُوْتًا فَسَلِّمُوْا عَلَى أَنْفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِنْ عِنْدِ اللهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ- ‘অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে তখন তোমরা পরস্পরে সালাম করবে। এটি আল্লাহর নিকট হ’তে প্রাপ্ত বরকতমন্ডিত ও পবিত্র অভিবাদন। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াত সমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন। যাতে তোমরা বুঝতে পার’ (নূর ২৪/৬১)।
সালামের উত্তর দেওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوْا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوْهَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَسِيْبًا- ‘আর যখন তোমরা সম্ভাষণ প্রাপ্ত হও, তখন তার চেয়ে উত্তম সম্ভাষণ প্রদান কর অথবা ওটাই প্রত্যুত্তর কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী’ (নিসা ৪/৮৬)।
খ. বর্জনীয় আদবসমূহ :
১.
অনর্থক কথা বলা পরিহার করা : অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কথা পরিহার করতে হবে।
কেননা এতে কোন উপকারিতা নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ
الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ- ‘মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য
হচ্ছে তার অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করা’।[40] এছাড়া মানুষের ব্যক্ত করা
কথাবার্তার কারণে তাকে শাস্তি পেতে হ’তে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
বলেন,إِنَّ الرَّجُلَ لَيَتَكَلَّمُ بِالْكَلِمَةِ مِنْ سَخَطِ اللهِ، لَا
يَرَى بِهَا بَأْسًا، فَيَهْوِيْ بِهَا فِيْ نَارِ جَهَنَّمَ سَبْعِيْنَ
خَرِيْفًا- ‘মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কথা বলে এবং তাকে দূষণীয় মনে করে
না। অথচ এই কথার দরুন সত্তর বছর ধরে সে জাহান্নামে পতিত হ’তে থাকবে’।[41]
২.
গালিগালাজ ও অশ্লীল বাক্য পরিহার করা : কোন মুসলমান ভাইকে গালি দেওয়া বা
তার সাথে অশ্লীল ভাষায় কথা বলা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। রাসূল (ছাঃ)
বলেন,سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوْقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ، ‘মুসলমানকে গালি
দেয়া ফাসিকী এবং তার সাথে লড়াই করা কুফরী’।[42] হাদীছে গালি দেওয়ার মন্দ
পরিণতি সম্পর্কে এসেছে, মা‘রূর (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার
রাবাযা নামক স্থানে আবূ যর (রাঃ)-এর সঙ্গে দেখা করলাম। তখন তাঁর পরনে ছিল
এক জোড়া কাপড় (লুঙ্গি ও চাদর) আর তাঁর ভৃত্যের পরনেও ছিল ঠিক একই ধরনের এক
জোড়া কাপড়। আমি তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, একবার আমি জনৈক
ব্যক্তিকে গালি দিয়েছিলাম এবং আমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছিলাম।
তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাকে বললেন, আবূ যার! তুমি তাকে তার মা সম্পর্কে
লজ্জা দিয়েছ? তুমি তো এমন ব্যক্তি, তোমার মধ্যে এখনো অন্ধকার যুগের স্বভাব
বিদ্যমান। জেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তা‘আলা
তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন
তাকে নিজে যা খায় তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই
পরায়। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দিও না, যা তাদের জন্য অধিক কষ্টদায়ক। যদি
এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহ’লে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে’।[43]
মন্দ কথা বলা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,لَا يُحِبُّ اللهُ الْجَهْرَ بِالسُّوْءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلاَّ مَنْ ظُلِمَ وَكَانَ اللهُ سَمِيْعًا عَلِيْمًا- ‘আল্লাহ কোন মন্দ কথা প্রকাশ করা পসন্দ করেন না। তবে কেউ অত্যাচারিত হ’লে সেটা স্বতন্ত্র। আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (নিসা ৪/১৪৮)। অনুরূপভাবে কোন মুসলমানকে অযথা কষ্ট দেওয়া গোনাহের কাজ। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوْا فَقَدِ احْتَمَلُوْا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِيْنًا- ‘অপরাধ না করা সত্ত্বেও যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে’ (আহযাব ৩৩/৫৮)।
৩. কানাকানি বর্জন করা : কোথাও তিনজন লোক থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দু’জনে কানাকানি করা ইসলামে নিষেধ। কেননা এতে তৃতীয় ব্যক্তি মনে কষ্ট পায়। ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়। আল্লাহ বলেন,أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ نُهُوْا عَنِ النَّجْوَى ثُمَّ يَعُوْدُوْنَ لِمَا نُهُوْا عَنْهُ، ‘তুমি কি তাদের দেখ না যাদেরকে কানাঘুষা করতে নিষেধ করা হয়েছিল। অতঃপর তারা সেই নিষিদ্ধ কাজেরই পুনরাবৃত্তি করে’(মুজাদালাহ ৫৮/৮)। তিনি আরো বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا تَنَاجَيْتُمْ فَلَا تَتَنَاجَوْا بِالْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَمَعْصِيَتِ الرَّسُوْلِ وَتَنَاجَوْا بِالْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ، إِنَّمَا النَّجْوَى مِنَ الشَّيْطَانِ لِيَحْزُنَ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيْسَ بِضَارِّهِمْ شَيْئًا إِلَّا بِإِذْنِ اللهِ وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন গোপন পরামর্শ কর, তখন পাপাচার সীমালংঘন ও রাসূলের অবাধ্যতার বিষয়ে শলা পরামর্শ করো না। বরং তোমরা কল্যাণকর কাজে ও আল্লাহভীরুতার কাজে পরামর্শ কর। আর আল্লাহকে ভয় কর, যার নিকটেই তোমরা সমবেত হবে। ঐ কানাঘুষা শয়তানের কাজ বৈ তো নয়, যা মুমিনদের দুঃখ দেওয়ার জন্য করা হয়। অথচ তা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারে না আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত। অতএব মুমিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা’ (মুজাদালাহ ৫৮/১০)।
আব্দুল্লাহ
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,إِذَا كُنْتُمْ
ثَلاَثَةً فَلاَ يَتَنَاجَى رَجُلاَنِ دُوْنَ الآخَرِ، حَتَّى
تَخْتَلِطُوْا بِالنَّاسِ، أَجْلَ أَنْ يُحْزِنَهُ، ‘যখন তোমরা তিনজন
থাকবে, তখন দুইজনে পৃথকভাবে গোপন পরামর্শ কর না। যতক্ষণ না তোমরা অন্যদের
সাথে মিশে যাও। কেননা এটি তৃতীয় জনকে দুঃখিত করবে’।[44] তবে তার অনুমতি
সাপেক্ষে করা যাবে। যেমন আবুর বরী‘ ও আবু কাসেম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে
রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا كُنْتُمْ ثَلاَثَةً فَلاَ يَتَنَاجَى اثْنَانِ
دُوْنَ الثَّالِثِ إِلاَّ بِإِذْنِهِ فَإِنَّ ذَلِكَ يُحْزِنُهُ، ‘যখন
তোমরা তিনজন থাকবে, তখন তৃতীয় জনকে ছেড়ে তোমরা গোপনে পরামর্শ করো না তার
অনুমতি ব্যতীত। কেননা সেটি তাকে দুঃখিত করবে’।[45]
৪. উপহাস না করা এবং মন্দ নামে না ডাকা : কোন মানুষকে উপহাস করা কিংবা মন্দ নামে ডাকা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ করণে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়, সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। যার পরিণতি হয় ভয়াবহ। তাই এসব মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُوْنُوْا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوْا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوْا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! কোন সম্প্রদায় যেন কোন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হ’তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। আর নারীরা যেন নারীদের উপহাস না করে। হ’তে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। তোমরা পরস্পরের দোষ বর্ণনা করো না এবং একে অপরকে মন্দ লকবে ডেকো না। বস্ত্ততঃ ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা হ’ল ফাসেক্বী কাজ। যারা এ থেকে তওবা করে না, তারা সীমালংঘনকারী’ (হুজুরাত ৪৯/১১)।
৫. গীবত ও চোগলখুরী না করা : পরনিন্দা, দোষচর্চা বা গীবত-তোহমত সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার। এ কাজ সমাজে হানাহানির পরিবেশ বৃদ্ধি করে। তাই এই ঘৃণ্য কর্ম থেকে বিরত থাকতে আল্লাহ আদশে দিয়েছেন। তিনি বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَحِيْمٌ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ করো না এবং একে অপরের পিছনে গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পসন্দ করে? বস্ত্ততঃ তোমরা সেটি অপসন্দ করে থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১২)।
রাসূল (ছাঃ)
বলেন,يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلِ الإِيْمَانُ
قَلْبَهُ لاَ تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِيْنَ وَلاَ تَتَّبِعُوْا
عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنِ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعِ اللهُ
عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعِ اللهُ عَوْرَتَهُ يَفْضَحْهُ فِىْ بَيْتِهِ.
‘হে ঐসব লোক যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে, কিন্তুঅন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি!
তোমরা মুসলমানদের গীবত করবে না ও দোষ-ত্রুটি তালাশ করবে না। কারণ যারা
তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজবেন। আর
আল্লাহ কারো দোষ-ত্রুটি তালাশ করলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্ত করে
ছাড়বেন’।[46]
চোগলখুরীর পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامٌ، ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[47] অন্যত্র তিনি বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।[48]
তিনি আরো বলেন,تَجِدُ مِنْ شَرِّ النَّاسِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عِنْدَ
اللهِ ذَا الْوَجْهَيْنِ، الَّذِىْ يَأْتِىْ هَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ
وَهَؤُلاَءِ بِوَجْهٍ، ‘ক্বিয়ামতের দিন তুমি আল্লাহর কাছে ঐ লোককে সব থেকে
খারাপ পাবে, যে দু‘মুখো। সে এদের সম্মুখে এক রূপ নিয়ে আসতো, আর ওদের
সম্মুখে অন্য রূপে আসত’।[49]
৬. অন্যের সম্পর্কে কু-ধারণা না করা : অন্য মুসলিম ভাইয়ের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে হবে। তার প্রতি অযথা কু-ধারণা পোষণ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اجْتَنِبُوْا كَثِيْرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ، ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। কেননা কোন কোন ধারণা পাপ’ (হুজুরাত ৪৯/১২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِيَّاكُمْ
وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيْثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوْا،
وَلاَ تَجَسَّسُوْا، وَلاَ تَحَاسَدُوْا، وَلاَ تَدَابَرُوْا، وَلاَ
تَبَاغَضُوْا، وَكُوْنُوْا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا- ‘তোমরা অনুমান করা
থেকে সাবধান হও। কেননা অনুমান অবশ্যই সর্বাপেক্ষা বড় মিথ্যা। আর তোমরা
অন্যের দোষ অন্বেষণ করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, পরস্পরের সাথে
ঝগড়া-বিবাদ করো না এবং পরস্পরের সাথে হিংসা করো না। পরস্পরের ক্ষতি করার
জন্য পেছনে লেগে থেকো না। আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই
ভাই হয়ে যাও’।[50]
অতএব মানুষের সাথে চলাফেরার ক্ষেত্রে উপরোক্ত আদব বা শিষ্টাচার সমূহ মেনে চলা যরূরী। এর ফলে সমাজের অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে এবং পরকালে অশেষ ছওয়াব হাছিল হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী আদব বা শিষ্টাচার মেনে চলার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৪৫৮; মুসলিম হা/৯৫৬; মিশকাত হা/১৬৫৯।
[2]. বুখারী হা/৫২২৬, ৩৬৭৯; মুসলিম হা/২৩৯৪; মিশকাত হা/৬০২৮।
[3]. বুখারী হা/৩৯৩৭, ২০৪৯।
[4]. বুখারী হা/৭১৩৮; মুসলিম হা/১৮২৯; মিশকাত হা/৩৬৮৫।
[5]. বুখারী হা/২৮৬৪, ২৮৭৪; তিরমিযী হা/১৬৮৮; মিশকাত হা/৪৮৯৫।
[6] . মুসলিম হা/২০৩; আবূদাঊদ হা/৪৭১৮।
[7]. তিরমিযী হা/২০৩২; ছহীহুত তারগীব হা/২৩৩৯।
[8]. বুখারী হা/২৪৪২, ৬৯৫১; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮।
[9]. মুসলিম হা/২৫৯০; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৭১২।
[10]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১১৫৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬০২৮।
[11]. বুখারী হা/২২০; নাসাঈ হা/৫৬; মিশকাত হা/৪৯১।
[12]. বুখারী হা/৩১৪৯; মুসলিম হা/১০৫৭; মিশকাত হা/৫৮০৩।
[13]. বুখারী হা/৪৩২৮; মুসলিম হা/২৪৯৭।
[14]. বুখারী হা/৬০১৮-১৯; মুসলিম হা/৪৭; মিশকাত হা/৪২৪৩।
[15]. মুসলিম হা/২৬২৬; মিশকাত হা/১৮৯৪।
[16]. তিরমিযী হা/১৯৫৬; ছহীহাহ হা/৫৭২; মিশকাত হা/১৯১১।
[17]. বুখারী হা/৬০১৮-১৯; মুসলিম হা/৪৭; মিশকাত হা/৪২৪৩।
[18]. বুখারী হা/৬৪০১; মুসলিম হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৪৬৩৮।
[19]. মুসলিম হা/২৫৯৩; মিশকাত হা/৫০৬৮।
[20]. তিরমিযী হা/২০১৩; মিশকাত হা/৫০৭৬; ছহীহাহ হা/৫১৯।
[21]. মুসলিম হা/২৫৮৮।
[22]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩, ১৭০৩; সিলসিলা ছহীহা ২/৫২৩।
[23]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৯৪২।
[24]. ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২৬৬৬।
[25]. আবূদাঊদ হা/৩৫৩৪; মিশকাত হা/২৯৩৪; ছহীহাহ হা/৪২৩০।
[26]. বুখারী হা/৬১১৬; মুসলিম হা/২৪৪৯; মিশকাত হা/৫১০৪।
[27]. আবূদাঊদ হা/৪৭৭৭; ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৬; মিশকাত হা/৫০৮৮।
[28]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/২৩৫৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৭৪৯।
[29]. ইবনু মাজাহ হা/৪১৮৯; আহমাদ হা/৬১১৪; মিশকাত হা/৫১১৬।
[30]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/২৯৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৭৪৭।
[31]. আহমাদ হা/২৩২১৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৭৪৬।
[32]. ছহীহাহ হা/৯০৬; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৬২৩।
[33]. ছহীহাহ হা/৪২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৬৬২।
[34]. মুসলিম হা/২৫৮০; আবূদাঊদ হা/৪৮৯৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৭০৭।
[35]. মুসলিম হা/২৬৯৯; তিরমিযী হা/১৪২৫; মিশকাত হা/২০৪।
[36]. আবূদাঊদ হা/৪৯১৮; মিশকাত হা/৪৯৮৫; ছহীহাহ হা/৯২৬।
[37]. বুখারী তা‘লীক; মুসলিম হা/৫৫; মিশকাত হা/৪৯৬৬।
[38]. বুখারী তা‘লীক; গায়াতুল মারাম হা/৩৩৩।
[39]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০০৪।
[40]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৬, ‘কলহ-বিপর্যয় চলাকালে রসনা সংযত রাখা’ অনুচ্ছেদ; তিরমিযী হা/২৩১৭-১৮; মিশকাত হা/৪৮৩৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৮৮১, সনদ ছহীহ।
[41]. তিরমিযী হা/২৩১৪; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭০; মিশকাত হা/৪৮৩৩; ছহীহাহ হা/৫৪০, ৮৮৮।
[42]. বুখারী হা/৪৮, ৬০৪৪, ৭০৭৬; মুসলিম হা/৬৪; মিশকাত হা/৪৮১৪।
[43]. বুখারী হা/৩০, ২৫৪৫, ৬০৫০; মুসলিম হা/১৬৬১।
[44]. বুখারী হা/৬২৯০; মুসলিম হা/২১৮৪; মিশকাত হা/৪৯৬৫।
[45]. মুসনাদ আহমাদ হা/৬৩৩৮।
[46]. আবূদাঊদ হা/৪৮৮০; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৯৮৪।
[47]. মুসলিম হা/১০৫; ছহীহ আত-তারগীব হা/২৮২১।
[48]. বুখারী হা/৬০৫৬; মুসলিম হা/১০৫; মিশকাত হা/৪৮২৩।
[49]. বুখারী হা/৬০৫৮, ৩৪৯৪; মুসলিম হা/২৫২৬।
[50]. বুখারী হা/৬০৬৪, ৬০৬৬; মুসলিম হা/২৫৬৩; মিশকাত হা/৫০২৮।