[ক]
পড়ন্ত বিকেলে বৃষ্টি ভেজা দিনে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এনায়েতের চায়ের দোকানের আড্ডাটিও জমজমাট হয়ে উঠেছে। মাগরিবের আযান হ’তে তখনও মিনিট পনেরো বাকী আছে। বয়স পঞ্চাশোর্ধ আরাফাত সর্দার বাম হাতে চায়ের কাপ ও ডান হাতে জ্বলন্ত বিড়ি নিয়ে লম্বা টান মেরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কথাটি পাড়লেন, জানিস, এবার নাকি নাঈম মোড়ল কুরবানী দেবে না। আজকেই শুনলাম আনীসের মুখে।
পাশ থেকে ইমরান হাজী বলল, তাই নাকি! শালা এত টাকা রাখবে কোথায়? ও ভেবে নিয়েছে, শুধু ছালাত পড়ে জান্নাতে চলে যাবে।
বাবলু ওরফে আমানুল্লাহ বলল, বলিস কী রে ভাই! শুনলাম, গাঁয়ের উত্তরপাড়ার কালু, সে তো আবার ভিক্ষা করে খায়, সে পর্যন্ত এবার আড়াই হাযার টাকার ভাগা ধরেছে, আর মোড়ল বলছে, কুরবানী দিবে না। ঠিকই বলেছিস, শালা একটা আস্ত হাড়কিপটে।
বাবলু, এবার তুই কী কুরবানী দিচ্ছিস? ইমরান হাজী জিজ্ঞেস করল।
আমি তো সোনুদের সাথে দু’টি ভাগা ধরেছি। প্রায় সাত হাযার টাকা লাগল। এবার গরুর দাম আছে বাজারে। রবিবার হাটে গিয়েছিলাম। চবিবশ হাযার পাঁচশ’ টাকা দাম পড়ল। সবাই বলল, গোশত ভাল হবে। এক কুইন্টালের নীচে হবে না। তা তুমি কী কিনলা হে?
আর বলিস না ভাই। আমি তো খাসি দেবার জন্য তৈরি ছিলাম। কিনেও নিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িতে এসে সুরুজের মা রেগে একদম ফায়ার। বলছে, তুমি শুধু খাসি কুরবানী দিবে। খাসির গোশত আর কতটুকু হবে দু’দিনেই তো শেষ হয়ে যাবে। তখন তোমার ছেলেগুলো তাকিয়ে থাকবে নাকি? যাও! একটি গরুর ভাগা ধর।
অগত্যা আমীনদের সাথে একটা ভাগা ধরেছি।
গরম পানি দিয়ে কাপগুলি পরিষ্কার করতে করতে এনায়েত বলল, সর্দার ছাহেব! আজ মসজিদে মৌলবী ছাহেব খুৎবায় কী বলেছেন শোননি? তাহ’লে শুধু শুধু কেন নাঈমের গীবত গাইছ।
সর্দার বলল, কি বলেছিল তা আর অত মনে আছে? কুরবানীর জন্য বাড়ি-ঘর সব পরিস্কার করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই মসজিদে আসতে অনেক দেরী হয়েছিল। কী বলেছে শুনিনি।
এনায়েত বলল, মৌলবী ছাহেব বলেছেন, এই দশ দিন অর্থাৎ চাঁদ ওঠার পর আমলের ফযীলত অনেক। মহান আল্লাহর কাছে নাকি যিলহজ্জ মাসের দশ দিনের আমলের চাইতে আর কোন আমল অধিক পসন্দের নয় (দারেমী হা/১৭৭৪; ইরওয়া হা/৮৯০; ছহীহুত তারগীব হা/১২৪৮)। তাই বেশী বেশী নফল ছিয়াম, তওবা-ইসতেগফার, নফল ছালাত ও জোরে জোরে তাকবীর পড়তে হবে। তা না করে তোমরা গীবত করছ।
আরাফাত সর্দার, ইমরান হাজী ও বাবলু একসঙ্গে বলে উঠল, আমরা তো আর গীবত বলছি না, যা সত্যি তাই বলছি।
[খ]
নাঈম মোড়ল, ওরফে নাঈমুদ্দীন। শুধু নামেই মোড়ল। তাঁর দাদা ছিল আসল মোড়ল। জমিজমা ছিল অনেক। নাঈমেরা চার ভাই আর তিন বোন। পৈত্রিক সূত্রে সেই জমির কিছু ভাগ পেয়েছে। তাতে ধান, গম, সরিষা আর কখনও বা কালাইয়ের চাষ হয়।
কিন্তু এখন বাজারে ধানের যা দাম তাতে সংসারে নিত্য অভাব লেগেই থাকে। তাঁর একমাত্র ছেলে, সে কলকাতায় শিয়ালদহের কাছে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ে। বেলঘড়িয়ার একটি মেসে থাকে। তাঁর পেছনে মাসে চার-পাঁচ হাযার টাকা খরচ হয়। ছোট মেয়েটার অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। প্রতি মাসে ডাক্তার আর ওষুধের বিল নেহায়েত কম নয়। বড় মেয়েটার বিয়ে দিয়েছে। ভালো ঘরের জামাই পেয়েছে। এবছর মেয়েটা মোটর সাইকেলের আবদার করেছে। নাঈম বলেছে, বর্ষার ধান উঠলে তবেই দিতে পারবে। বড় মেয়ের বিয়ের জন্য ক’কাঠা জমি পর্যন্ত বন্ধক আছে। নাঈম সব দিক ম্যানেজ করে কষ্টে সংসার চালায়। কাউকে এই কষ্ট বুঝতে দেয় না।
চায়ের দোকানে বসে যারা গীবত-পরনিন্দা করে, তারা ক’জন এই সংসারের ভিতরের খোঁজ-খবর রাখে? তাছাড়া নাঈমের বয়স হয়েছে, ভারি কাজ সেরকম করতে পারে না। ছেলেটা চাকরি করবে এই আশায় আছে। কিন্তু এখন চাকরির আশা করা...
রাস্তার ধারে শতক পাঁচেক জমি আছে তাঁর। একেবারে নিষ্কণ্টক জায়গায়। দাম নেহাত কম নয়। সবার চোখ ওখানে। বেঁচে দিলে সেই টাকায় কতদিন চলবে নাঈমের এই চিন্তা! তাছাড়া জায়গাতো আর একটু একটু করে বেঁচে, সেই টাকায় সংসার চালানো আর কুরবানীর পশু কেনা যায় না। বেঁচতে হ’লে একসাথে দুই তিন শতক বেঁচতে হবে। অত টাকা হাতে পেয়ে কী করবে সে। ক’দিনেই তো শেষ হয়ে যাবে। মাঝখান থেকে জায়গাটুকুও হাতছাড়া হবে।
নাঈমের আশা ওখানে একটি বিল্ডিং করে ঘরগুলি ভাড়া দিলেও কিছু আয় হবে। কিন্তু বিল্ডিং করার মত পয়সা তাঁর কাছে নেই।
গাঁয়ে কত লোক চাকরি করে, কত লোক বড় ব্যবসা করে, তবুও তাদেরকে ছেড়ে নাঈমকে নিয়েই আলোচনা হয় বেশী। হাযার হোক মোড়ল বলে কথা!
[গ]
কুরবানীর দিন। নাঈম এই প্রথম কুরবানী দিতে পারেনি। তাই তার মন সকাল থেকে খারাপ। প্রতিবছরই তো কুরবানী দেয়, কিন্তু এবার হাতে একদমই টাকা নেই।
নাঈম ভেবেছিল ধার করে এবছর কুরবানী দেবে কিন্তু ছেলেটা শুনল না। বলল, আববা! তুমি কেন ধার করে কুরবানী দেবে? পাঁচ জনে পাঁচ কথা বলবে তাই তো? তাহ’লে তো তুমি লোককে খুশি করতেই কুরবানী কর; আল্লাহকে খুশি করতে নয়। তাছাড়া অধিকাংশ আলেম তো বলেন যে, কুরবানী দেওয়া সুন্নাত। তোমার যা পরিস্থিতি, তাতে কুরবানী না দিলেও তুমি গুনাহগার হবে না। বাকি থাকল লোকেদের কথা যে যা বলে বলুক, আল্লাহ তো তোমার অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। কথাটা মনে ধরেছিল নাঈমের। তাইতো, আমি কি লোককে দেখাবার জন্য কুরবানী করব, না কি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য?
ঈদের ছালাত পড়তে গিয়েও নিজেকে হীনমন্য মনে হয় নাঈমের। কি জানি! পাশের লোক মনে মনে বলছে বোধ হয়, ‘কুরবানী দেয়নি আবার ঘটা করে ঈদের ছালাত পড়তে এসেছে দেখ। কিন্তু হাদীছে তো আছে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন ঈদগাহে না আসে (ইবনু মাজাহ হা/৩১২৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪৯০)। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে যে, নাঈমের এবছর সত্যিই সামর্থ্য নেই।
ছালাত শেষে বাড়ি ফিরে রান্নাঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে উদাস মনে বসে আছে নাঈম। বেলা গড়ালে একে একে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী নাঈমের বাড়িতে গোশত নিয়ে হাযির। কুরবানীর ঈদের খুশিতো এটাই যে, নিজে খাবে এবং অপরকে খাওয়াবে। তবুও যেন নাঈমের কেমন কেমন মনে হয়। নাঈমের স্ত্রী রেগে গিয়ে বলল, ছিঃ! লজ্জায় আমার মাথাটা নিচু হয়ে গেল। কুরবানী দেইনি বলে ভিখারী ভেবে সবাই গোশত দিয়ে যাচ্ছে। কত করে বললাম, ধার করে হ’লেও অন্তত একটা ভাগা ধরো; কিন্তু আমার কথা শুনলেই তো বাপ-ব্যাটা মিলে ছিঃ! লজ্জা!
[ঘ]
বড় মসজিদের মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, যারা কুরবানী দেননি, মসজিদের সামনে চলে আসুন। নাম লিখিয়ে যান। যোহরের ছালাতের পরে গোশত বিতরণ করা হবে।
নাঈমের গিন্নি ব্যঙ্গ করে তাঁর ছেলেকে বলল, যা মসজিদে। ব্যাগ নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়া। শুনলিই তো মাইকে কি বলল।
নাঈম শুধু বলল, তুমি চুপ কর। সব কিছু জানোই তো, তাহ’লে শুধু শুধু কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছো।
যোহরের ছালাত পড়তে গিয়ে মসজিদে আরাফাত সর্দার নাঈমকে বলল, নাঈম! কুরবানী তো দাওনি; তা নামটা লেখাতে এলে না যে। লজ্জা লাগছে নাকি? ঠিক আছে, যাও আমি তোমার বাড়িতে গোশত পাঠিয়ে দেব।
নাঈম বলল, না গো! গোশত পাঠাতে হবে না। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনেরা দিয়েছে। আর মসজিদ থেকে নেব না।
এটা কি অহংকারী কথা হ’ল না তোমার। তুমি কুরবানী দাওনি, নাম না হয় লেখাতে লজ্জা করেছ, তা বলে বাড়ি দিয়ে আসব, তাও নেবে না? বলল আরাফাত সর্দার।
নাঈমের চোখ পানিতে ছল ছল করে। এত অপমান! কুরবানী না করার জন্য। গ্রামে মাতাল, জুয়াড়ি, বেনামাযী হরহামেশা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের তো অপমান করা হয় না। বিয়ের বাড়িতে ডি.জে বাজিয়ে, পণ নিয়ে ধুমধাম বিয়ে হচ্ছে, সর্দাররা কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে আসছে। কই তাদেরকে তো অপমান হ’তে হয় না। তারা তো হারাম কাজ করে, নিজেও কখনও অপমান বোধ করে না। তবে কুরবানী না দেওয়ার কারণে কেন এমন হচ্ছে?
ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরার পথে, রাস্তায় নাঈম শুনতে পেল, হাসীব ও এমাদের কথোপকথন। হাসীব বলছে, ‘কত গোশত হ’ল রে তোদের? এমাদ বলল, আর বলিস না ভাই! দারুন ঠকা এবছর। ভেবেছিলাম এক কুইন্টাল দশ-পনেরো কেজি হবে, তা না হয়ে মাত্র নববই কেজি। তা তোদেরটা কত হয়েছিল?
আমাদের প্রায় এক কুইন্টাল বিশ কেজির মত হয়েছিল।
তাহ’লে তো তোরা জিতে গেছিস! আমাদের অনুমান ঠিকঠাকভাবে করা হয়নি। শালা! ছাহেবকে সাথে নিয়ে হাটে যাওয়া বড় ভুল হয়েছিল। কত করে তাকে বললাম, এটা নিস না। কিন্তু আমার কথা শুনলই না।
বাড়ি ফিরে নাঈম ভাবতে থাকে। কুরবানী না দেওয়ার এই দুঃখ মৃত্যু পর্যন্ত মনে হয় হৃদয়ে গাঁথা থাকবে তার। সে ভাবছে আল্লাহকে খুশি করা দূরে থাক, লোক দেখানোর জন্যেও ধার করে কুরবানী করলে অন্তত এতটা অপমান সইতে হ’ত না। কারণ সমাজ তো এই সিস্টেমেই পরিচালিত।
হায় রে কুরবানী! আজ কোথায় ইব্রাহীমী চেতনা? কোথায় ইসমাঈলের আত্মত্যাগ? আর কোথায় মা হাজেরার ধৈর্য? কোথায় গেল কুরবানীর শিক্ষা? কোথায় গেল তাক্বওয়া অর্জন? আল্লাহ বলেছেন, আর আললাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত এবং না এগুলোর রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া’ (হজ্জ ২২/৩৭)।
নাঈম স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কুরবানী আল্লাহর বিশেষ ইবাদত হ’লেও এখন অনেকের কাছেই এটি একটি সামাজিক রীতি। তাইতো সমাজকে এত ভয়! নইলে...
জাবির হোসাইন
এম.এ (বাংলা), কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, সাগরদীঘি, মুর্শিদাবাদ, ভারত