
ইলমে ওহী শিক্ষা করার একটি হক, তা অপরের কাছে পৌঁছে দেয়া। এটাকেই তাবলীগ বলে। তাবলীগ বিভিন্ন পদ্ধতিতে হ’তে পারে। যেমন, কথার মাধ্যমে অপরকে দাওয়াত দেয়া। জুমআর খুৎবা, ওয়ায-মাহফিল, তা‘লীমী বৈঠক ইত্যাদি বিষয় গুলো কথার মাধ্যমে দাওয়াত প্রদানের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত হয়। আবার তাবলীগ লেখার মাধ্যমেও হ’তে পারে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, কিতাব রচনা, বুকলেট, লিফলেট ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সমাজে পুরুষদের দাওয়াতী অঙ্গন যতটা প্রশস্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে দাওয়াতী অঙ্গন ততটা প্রশস্ত নয়।
মহিলারা ওয়ায-মাহফিল করতে পারে না। ঘরোয়া পরিবেশ ছাড়া কোন তা‘লীমী বৈঠকের আয়োজন করতে পারে না। চাইলেই যাকে তাকে দাওয়াত দিতে পারে না। আবার ইলমে দ্বীন শিক্ষা করে সবাই সংসার জীবনে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগও করতে পারে না। মোটকথা, তারা কুরআন-হাদীছ পড়ে যা শিখে, যে চিন্তাধারা অর্জিত হয় সেটা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না। তাহ’লে তাদের দাওয়াতের জায়গাটা কোথায়? পদ্ধতি কি? বক্ষমান প্রবন্ধে এই বিষয়েই আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
আমরা মনে করি, মহিলাদের দাওয়াতী পদ্ধতির সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হচ্ছে লেখার মাধ্যমে দাওয়াত দেয়া। কারণ, এটা দাওয়াতের একটি শক্তিশালী এবং স্থায়ী মাধ্যম। লেখার মাধ্যমে দাওয়াত যতটা বিস্তৃতি লাভ করে এবং স্থায়ী হয়; অন্য কোন মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে অন্যান্য দাওয়াতী ময়দানগুলো সংকীর্ণ হ’লেও লেখালেখির অঙ্গনে রয়েছে বেশকিছু বাড়তি সুবিধা। তারা যদি লেখালেখির ময়দানে আসে তবে খুব দ্রুত এগিয়ে যাবে। কারণ, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বাড়িতে অবস্থান করে বেশি। সংসারের অভ্যন্তরীণ কাজগুলো ছাড়া তাদের তেমন কোন ব্যস্ততা থাকে না। ফলে তাদের চিন্তাগুলো এলোমেলো হয় না। পক্ষান্তরে পুরুষদের সারাদিন বিভিন্ন ব্যস্ততা শেষে যখন রাতে লিখতে বসে তখন চিন্তাগুলো গুছিয়ে আনতে সময় লাগে। প্রতিদিন সেটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।
তাদের সুবিধার আরেকটি দিক হ’ল, লেখালেখি আর দশটা শারীরিক পরিশ্রমের কাজের মত নয়। এখানে ধৈর্য ধরে বসে কাজ করতে হয়। একটা লাইনকে বারবার কেটে সম্পাদনা করতে হয়। এর জন্য বেশ ধৈর্য প্রয়োজন। যে ধৈর্য আল্লাহ তা‘আলা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অনেক বেশী দিয়েছেন। সুতরাং তারা তাদের সময়গুলো নিয়মিত লেখালেখির পেছনে ব্যয় করলে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠবে। এই বিষয়গুলো আমাদের সামনে থাকার জন্যই আমরা আমাদের আলেমাদের কাছে বেশ আশাবাদী। তারা লেখালেখির ময়দানে আরো বেশী সোচ্চার হবে, এটাই আমাদের কামনা।
আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করছি যেখানে দ্বীনের দাওয়াত অনেক বেশী। তবে সঠিক দ্বীনের দাওয়াতের বড়ই আকাল। কোন লেখাপড়া নেই, দ্বীন সম্পর্কে জানা শোনা নেই এমন অনেকেই এখানে নামমাত্র বক্তা হয়ে মানুষকে দাওয়াতের নামে পথভ্রষ্ট করছে। এমন দেশে সঠিক দ্বীনের শিক্ষা লাভ করা একজন আলেমা মাত্রই একজন কলম সৈনিক হবে। এমনটাই আমরা আশা করি। আমরা আশা করি, হয়তো সে লিখবে, নয়তো লেখা শিখবে। সে কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে! তার কাছে এই উম্মাহর কি কিছুই পাওয়ার নেই! রাসূল (ছাঃ)-এর ইন্তেকালের পরে আয়েশা (রাঃ) বিভিন্ন ছাহাবীর বেশকিছু কথা ও আমলের বিরোধিতা করেছেন। কারণ, তাদের মত ও আমল রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে মেলেনি। এগুলো আমাদের তো অজানা নয়। তাহ’লে এই ঘটনাগুলো থেকে আমরা কী শিখলাম! আমাদের সমাজেও তো কত ভুল প্রচলন। শিরক, বিদ‘আত ও অপসংস্কৃতি তো আছেই; আবার কুরআন-হাদীছের ভুল ব্যাখ্যারও বাজার রমরমা। সেগুলোর বিষয়ে আমাদের আলেমাদের অবস্থান কী! দেখুন! ইলমে ওহী শেখার পরে হাত গুটিয়ে বসে থাকাকে নিতান্ত অবহেলা এবং নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে অসচেতনতা আর কিইবা বলা যায়?
আপনি ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, বর্তমান জেনারেশনে দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি আক্রান্ত। কারণ, আমাদের মেয়েদের দ্বীনী জ্ঞানকে পরিচর্যা করা হচ্ছে না। একজন লেখক তো সেই বিষয়েই কলম ধরবেন যে বিষয়ে তিনি বেশী জানেন। লেখক যদি ছেলে হয় তার কলম থেকে ‘প্রিয় ভাই’ সম্বোধন আসবে। লেখিকা যদি মেয়ে হয় তবে তার কলম থেকে ‘প্রিয় বোন’ সম্বোধন আসবে এটাই স্বাভাবিক। এটা কোন নিয়মকে ফলো করে না। দুঃখজনক হ’লেও সত্য যে, ‘প্রিয় বোন’ সম্বোধনটি আমাদের আলোচনা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের কথা ভুলে যাচ্ছি। আর এই কারণেই আমাদের মেয়েরা দ্বীন থেকে আরো বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। বর্তমানে যে সমস্ত মহিলারা ইলমে ওহীর ধারক ও বাহক তারা কি এর দায় এড়াতে পারবে?
এবার আসুন একটু মাক্বাছিদে শরী‘আহ থেকে ঘুরে আসি। রাসূল (ছাঃ)-এর একাধিক বিয়ের কারণ আমাদের অজানা নয়। যার অনেকগুলো হিকমার ভেতরে অন্যতম হিকমাহ হচ্ছে, মহিলাদের মাঝে দ্বীন প্রচার করা। কারণ, ছাহাবায়ে কেরাম রাসূল (ছাঃ)-কে শুধু বাড়ির বাইরে সামনে পেতেন। কিন্তু বাড়ির ভেতরে তার কার্যক্রমগুলো কেমন ছিল এটা শুধু স্ত্রীরাই জানতেন। অনেক সময় মহিলা ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-কে এমন বিষয় জিজ্ঞেস করতেন যার উত্তর দিতে তিনি লজ্জাবোধ করতেন। তখন তাদের উত্তর উম্মাহাতুল মুমিনীন দিতেন। আর এটাই স্বাভাবিক। মহিলাদের অনেক ভেতরগত বিষয় থাকে যা একজন পুরুষের আলোচনায় আসা মানায় না। আর মহিলাদের মাসায়েলগত অনেক বিষয় থাকে যা পুরুষরা তেমনভাবে বোঝেও না। এখন মহিলারা যদি এই সকল দায়িত্ব পুরুষ দাঈদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদেরকে দায়িত্ব -মুক্ত মনে করে তবে তারা ইলমে দ্বীন শিক্ষা করে কী লাভ?
আমরা তো চাই, আমাদের মা-বোনরা কুরআন-হাদীছ গবেষণা করুক। লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করুক। তাদের মাধ্যমে শারঈ ফুনূনাতের বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন লেখা আসুক। তাদের লেখা দেশ হ’তে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক। আমাদের দাওয়াতী কাজ আরো বেগবান হোক। যুগের পরে যুগ তারাও তাদের লেখনীর মাধ্যমে অমর হয়ে থাকুক। তারা কেন একটি নির্দিষ্ট সীমায় সীমাবদ্ধ থাকবে! তাদের কুরআন-হাদীছের শিক্ষা কেন শুধু শেখার মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে! এগুলো তো আমাদেরকে কষ্ট দেয়। আল্লাহ আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ রাখুন। আমীন!
প্রিয় বোন! আপনাদের অনুরোধ করছি, সবাই নিজ জায়গা থেকে কলম ধরা শিখুন। সকল মহিলা মাদরাসাগুলোতে লেখালেখির কর্মশালার আয়োজন করুন। আমাদের অনেক লেখিকা দরকার। অনেক সিদ্ধহস্ত দাঈ প্রয়োজন। দেখুন! আপনি আজ উদ্যোগ নিলেই যে কাল লেখিকা বনে যাবেন বিষয়টা এমন নয়। এটা সাধনার বিষয়। সাধনার মাধ্যমেই তা অর্জিত হবে। লেখালেখির নিয়মগুলো মেনে নিয়মিত লিখতে থাকুন। যত দিন যাবে তত লেখা মার্জিত ও সুন্দর হ’তে থাকবে। এটাই এ পথের ধারা। আপনারা আজ যাত্রা শুরু করলে হয়ত কয়েক বছর পরে আমরা এর ফল পাবো।
এমনও হ’তে পারে, আপনার জীবনে আপনি ফল নাও দেখতে পারেন। তবে ফল কোন একসময় পাওয়া যাবেই। তা আপনারই কোন এক প্রজন্ম ভোগ করবে। আমরা আমাদের পরিবারে যে আম-কাঁঠাল খাই এ গাছগুলো একটিও আমাদের লাগানো নয়। সব গাছ আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানী, আববা-আম্মার লাগানো। আমরাও গাছ লাগাচ্ছি। তবে সেগুলোতে কোন ফল দেয় না। তবুও গাছ লাগাচ্ছি। কারণ, দাদারা গাছ না লাগালে আমরা ফল পেতাম না। আমরা যদি আজ গাছ না লাগাই তবে আমাদের নাতি-নাতনিরাও ফল পাবে না। এই ধারা অব্যাহত রাখতেই আমরাও চারা রোপণ করছি পরম যত্নে।
শেষ কথায় এতটুকুই বলতে চাই, সত্যিই বর্তমান প্রজন্ম দ্বীনী জ্ঞানের স্থানে চরম বিপর্যস্থ। সুতরাং আপনাদের দায়িত্বের জায়গাটা ভুলে যাবেন না। দেখুন! কুরআন-হাদীছের জ্ঞান আহরণের পরে যদি আপনার ভেতরে উম্মাহর প্রতি দরদ তৈরি না হয়, উম্মাহর পথভ্রষ্টতায় আপনার অন্তরে কোন অস্থিরতা কাজ না করে তবে বুঝবেন, ইলমের নামে আপনি শুধু কিছু শব্দার্থ শিখেছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে দিয়ে যখন একজন ইহূদীর জানাযা যাচ্ছিল তখন তিনি কিভাবে আফসোস করেছিলেন এটা আপনি জানেন না? তায়েফের লোকেরা যখন তাকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছিল, যখন তায়েফবাসীকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রস্তাবনা এসেছিল তখন তিনি কি উত্তর দিয়েছিলেন এটা আপনাকে কখনো ভাবায় না? প্রিয় বোন! সত্যিই দাওয়াতী ময়দান থেকে হাত ধুয়ে ফেলা আপনার মানায় না। সুতরাং সকল দ্বিধা ও অজুহাতের ময়লা ঝেড়ে ফেলে আজ থেকেই কলম ধরুন। উম্মাহর দূর্বলতাগুলো তুলে ধরুন। তাদের আমলগুলো কুরআন-হাদীছের আলোকে পর্যালোচনা করুন। ‘ওয়া বিহী ক্বালা হাদ্দাছানা’ থেকে অর্জিত আপনার মূল্যবান চিন্তাধারাকে মেলে ধরুন। আল্লাহ আপনার সহায় হৌন-আমীন!
সারওয়ার মিছবাহ
শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।