ভুমিকা : গাঢ় আলিঙ্গন, উষ্ণ আন্তরিকতা, মায়া-মমতা ও শিক্ষার এক উন্মুক্ত দুয়ার হচ্ছে মা। তিনি পুষ্টি জোগানিয়া, তিনি চিকিৎসক, তিনি সান্ত্বনাদানকারিনী, তিনি নার্স, তিনি বেবিসিটার, তিনি জননী, তিনি সৎপরামর্শক, তিনি শিক্ষক, তিনি রক্ষক, তিনি জান্নাতের শ্রেষ্ঠ তোরণ। তিনি সহানুভূতিশীল, তিনি মমতাময়ী। সন্তানের সুখে তিনি সুখী, সন্তানের দুঃখে তিনি দুঃখী। এই তো হ’ল মা। সন্তান লালন-পালনে সে মায়ের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত সে কথাগুলো আমরা বক্ষ্যমাণ আলোচনায় তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
সন্তান প্রতিপালনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ : শিশুর জীবন পরিচালনা ও দিকনির্দেশনায় মা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র। অন্য যে কারও তুলনায় শিশুর সাথে মায়ের যোগাযোগই সবচেয়ে বেশী। মা ও শিশুর মাঝে কোন বাধা থাকে না। ফলে কোন বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই মা তার সন্তানদের নানা ধরনের শিক্ষা দিতে পারেন। তাই প্রথমে মাকে নিয়ে কথা বলা বাঞ্ছনীয়। তাতে মা হবেন তাদের শিক্ষার ভিত্তি, পৃষ্ঠপোষক ও শুভানুধ্যায়ী পরিচালক।
হে পুণ্যশীলা জননী! আপনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস রাখুন যে, শিশুকাল হচ্ছে মানুষের ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্ব গঠনকাল। সুতরাং এ সময়টার প্রতি আপনি পরিপূর্ণ মনোযোগ দিন। শৈশবই ভবিষ্যতের সূতিকাগার। সন্তানদের সামনে সর্বদা ভাল কথা বলুন। কারণ তাদের সামনে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই ঘটুক তারা তা স্মৃতিপটে জমিয়ে রাখে এবং সেগুলো শিখে ফেলে।
শিশু মাত্রই অনুকরণপ্রিয়। সুতরাং আপনাকে শিশুদের সাথে মিথ্যা বলা থেকে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। আপনার বলা মিথ্যা কথা শুনে শুনে তাদের মধ্যেও মিথ্যা বলার অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে। একবার এ অভ্যাস গড়ে উঠলে পরে তা বদলানো দুরূহ হয়ে পড়বে। এজন্য যখনই তাদের মুখ থেকে কোন মিথ্যা কথা শুনতে পাবেন তখনই তাকে সাবধান করবেন এবং সত্য বলতে আদেশ করবেন।
শিক্ষামূলক ধারণাগুলো তাদের উপযোগী পদ্ধতিতে উপস্থাপন করবেন। এতে করে তাদের মধ্যে ইতিবাচক মূল্যবোধ সুদৃঢ় হবে এবং নেতিবাচক মূল্যবোধ থেকে তারা সুরক্ষা পাবে। তবে শর্ত এই যে, শিশুরা যেন তাদের মায়েদের থেকে প্রদত্ত শিক্ষার বিপরীত কিছু দেখতে না পায়। যদি তারা মায়ের কথা ও কাজে অমিল পায় তবে মায়ের কথা তাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
সন্তানরা যাতে মাতা-পিতার অনুকরণ করতে পারে সেজন্য তাদের প্রিয় সন্তানদের সামনে ভালো কাজ করা মাতা-পিতার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ‘রোল মডেল’ শিক্ষার একটি বড় ধাপ এবং শিক্ষাদানের সহজতম কৌশলের অন্যতম। এ এক নিঃশব্দ দাওয়াত। শিখানোর ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম।
হে শ্রদ্ধেয় মা! আপনাকে অবশ্যই সন্তানদের যত্ন ও লালন-পালনের জন্য আবশ্যকীয় বিদ্যা শিখতে হবে। আপনি সন্তানদের কিভাবে লালন-পালন করেছিলেন, সে প্রশ্নের উত্তর আল্লাহর সামনে যখন আপনাকে দিতে হবে তখন আপনি যেন নিষ্কৃতি পান সে উপায় আপনাকে অবশ্যই রপ্ত করতে হবে। বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যেভাবে চেয়েছেন, ঠিক সেভাবে আপনাকে মাথায় নিতে হবে এবং বাস্তবে সন্তানদের মধ্যে তা কার্যকর করতে হবে। যখন আপনার দ্বারা এ কাজ পুরোপুরি অর্জিত হবে তখন বুঝা যাবে আপনি বিষয়টি যথার্থ বুঝেছেন। এতে করে আপনার সন্তানেরা নেককার ও যোগ্য হয়ে গড়ে উঠবে এবং তাদের সততা ও সাফল্য আপনার জন্য সুখ-শান্তির ফল্গুধারা বয়ে আনবে ইনশাআল্লাহ।
আপনি নবীপত্নীদের জীবনী পড়ুন, সে সকল মহীয়সী ও নেককার নারীর জীবনচরিত অধ্যয়ন করুন, যারা তাদের প্রজন্মকে আল্লাহপ্রেমিক ও উত্তম মানুষ রূপে গড়ে রেখে গেছেন। সেখান থেকে আপনি আপনার প্রকৃত কাজ সম্পর্কে জানতে পারবেন। জানতে পারবেন সেই দায়িত্বের কথা, যা আপনার উপর অর্পিত হয়েছে। আপনি নিজের দায়িত্ব পালনে তুষ্ট হ’তে পারেন, কিন্তু আপনার কাজটি সঠিক হচ্ছে নাকি বেঠিক হচ্ছে, সেটা আপনি জানেন না। আপনি যদি শুরুতেই জীবনী বিষয়ক কিছু বই পড়েন তাহ’লে আপনি সেখানে এমন খোরাক পাবেন, যা দ্বারা আপনি সঠিক পথ চিনতে পারবেন। যদি আপনার সন্তানের প্রতি এ দায়িত্ব পালনে আপনি গা ছাড়া ভাব অবলম্বন করেন, তাহ’লে আপনার দৃশ্যমান নানা কাজে ও কর্তব্যেও আপনি গা ছাড়া ও কর্তব্যবিমুখ থেকে যাবেন। যা মুসলিমা হিসাবে আপনার কাছে কখনই কাম্য হ’তে পারে না।
সুতরাং আপনার নাড়িছেঁড়া ধনদের সৎ ও যোগ্য মানুষরূপে গড়ে তোলাই নিজের প্রথম প্রকল্প হিসাবে গ্রহণ করুন। আপনার আবশ্যকীয় এ দায়িত্ব পালনের জন্য পরিকল্পনা করুন! চিন্তা-ভাবনা করুন! অন্যদের সাথে কথা বলুন! সঠিক পন্থায় কি করে সন্তান পালন করতে হবে তা নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করুন। যখন আপনার মাধ্যমে সন্তানাদি কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক পথে লালিত-পালিত হবে, তখনই বলা যাবে আপনি স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। সুতরাং আপনি এ কাজকে আপনার প্রধান ভাবনা হিসাবে গ্রহণ করুন। তবেই আপনার বুকের মানিকরা হবে আপনার স্মারক। যার বিনিময় আপনি আল্লাহর কাছে পাবেন ইনশাআল্লাহ।
মনে রাখবেন, আপনার নয়নমণিদের শৈশব থেকেই ছহীহ আক্বীদা শিক্ষা দেওয়া আপনার অন্যতম গুরুদায়িত্ব। যেমন তোমার ‘রব’ কে? তোমার ‘দ্বীনে’র নাম কি? তোমার ‘নবী’ কে? আপনি আক্বীদার এ জাতীয় মৌলিক বিষয়গুলোর তা‘লীম দিবেন। আপনার ছোট্ট সোনামণি আপনার মুখ থেকে এগুলো শুনতে শুনতে মুখস্থ করে নেবে। সে এগুলো জানতে জানতে প্রতিপালিত হবে এবং মুখে মুখে আওড়াবে। শুরুতে সে এগুলোর অর্থ না বুঝলেও পরে বুঝতে পারবে। একদিন দেখবেন আপনার নয়নমণি আল্লাহর অনুগ্রহে একজন সৎ ও সংস্কারক হিসাবে গড়ে উঠেছে।
তাদেরকে ছোটবেলা থেকেই কিছু উত্তম আচার-আচরণে অভ্যস্ত করে তোলা আপনার কর্তব্য। যেমন ভাল কাজে ডান হাত ব্যবহার করা। কোন কিছু খাওয়ার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ ও পরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা। হাঁচি দিলে আওয়ায করে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা এবং হাঁচির জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা। কাজ শেষে শোকর বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কোথাও প্রবেশকালে ‘সালাম’ দেওয়া। প্রাণীর ছবি অঙ্কিত অথবা বাজে কিছু লেখা পোষাক পরা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো যেন তার রুচির সাথে মিশে যায়। এ জাতীয় আদব-আখলাকের শিক্ষা পেলে শিশু ধীরে ধীরে ইসলামী আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এবং জীবন চলার পথে তা মেনে চলবে।
আপনার হৃদয়ের স্পন্দনতুল্য সন্তানকে প্রাত্যহিক পাঠ্য দো‘আগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শিখাবেন। বাড়িতে প্রবেশকালীন দো‘আ, বাড়ি থেকে বের হওয়ার দো‘আ, পানাহারকালীন দো‘আ, সকাল-সন্ধ্যার দো‘আ, ঘুমানোর দো‘আ, জাগরণের দো‘আ, ওয়াশরুমে যাওয়া-আসার দো‘আ ইত্যাদি শিখাবেন। সাথে সহজে পালনযোগ্য কিছু নফল আমলে তাকে অভ্যস্ত করবেন। এসবই আপনার জন্য ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ। হ’তে পারে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যেও আপনার এ কাজের ধারা অব্যাহত থাকবে।
আপনার সন্তানদের জন্য মহান মালিকের নিকট দো‘আ কবুলের সময়ে বেশী বেশী দো‘আ করুন। অনেক সময় তারবিয়াত ব্যর্থ হ’লেও দো‘আ সফলতা বয়ে আনে। দো‘আয় ক্লান্ত হবেন না, বিরক্তি বোধ করবেন না। বার বার দো‘আ করতে থাকুন! নাছোড়বান্দা হয়ে দো‘আ করুন। বিশ্বাস রাখুন, দেরিতে হ’লেও রবের নিকট আপনার দো‘আ কবুল হবেই।
ঘর-সংসারে অনেক সময় ঝগড়াঝাটি ঘটে যায়। রাগ-অভিমান হয়। সবকিছুর মাঝে খেয়াল রাখতে হবে, মা যেন তার কলিজার টুকরাগুলোর বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করা থেকে বিরত থাকেন। কারণ মায়ের দো‘আ সাধারণত বিফলে যায় না। আল্লাহর দরবারে কোন বদ দো‘আ মঞ্জুর হয়ে গেলে তার পরিণাম শুভ হবে না। এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। সুতরাং দ্রুত রেগে যাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। বদ দো‘আ করার আগে অবশ্যই পরিণাম সম্পর্কে ভাবতে হবে।
দো‘আর পাশাপাশি মাতা-পিতা দু’জনকেই ধার্মিক ও সৎকর্মপরায়ণ হ’তে হবে। সন্তানদের ধার্মিক বানানোর এটাই সবচেয়ে কার্যকরী পথ। মাতা-পিতা যদি অধার্মিক ও দ্বীন বিরোধী হয় তবে সন্তানরাও দ্বীন বিমুখ থেকে যাবে। অবশ্য আল্লাহ দ্বীনদার করতে চাইলে সেটা ভিন্ন কথা। সুতরাং আপনারা উভয়েই সন্তানদের অনুসরণীয় আদর্শ হ’তে সচেষ্ট হবেন। প্রতিদানে আল্লাহ আপনাদের জান্নাত দিবেন। মহান প্রভুর সমীপে তারা আপনাদের পদচিহ্ন হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকবে।
ছেলে-মেয়েরা কথায়-কাজে যেন ইতিবাচক হয়, সেজন্য তাদের উৎসাহ যোগানো স্নেহময়ী মায়েদের অবশ্য কর্তব্য। কেননা ইতিবাচক প্রতিটি উৎসাহ আরেকটি ইতিবাচক উৎসাহের জন্ম দেয়। এভাবেই একের পর এক ইতিবাচক দিকের দেখা মেলে। সুতরাং এভাবে উৎসাহ যোগানো যেন আপনার স্থির কর্মসূচিতে পরিণত হয়। নবী করীম (ছাঃ) তাঁর ছাহাবীগণকে এমনি করে সর্বদা উৎসাহ যোগাতেন। যেমন তিনি আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, আবদুল্লাহ কতই না ভালো মানুষ! যদি সে রাত জেগে ছালাত আদায় করত![1] সুতরাং আপনার সন্তানদের উৎসাহ দানের বিষয়টি আপনি কখনো বিস্মৃত হবেন না।
স্নেহময়ী মায়েদের চোখের মণিদের ভবিষ্যৎ সামাজিক ও কর্মজীবন কেমন হওয়া উচিৎ, জীবনযুদ্ধে তাদের কি কি বাঁধা আসতে পারে এবং কিভাবে তার মোকাবেলা করতে হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা খুবই যরূরী। এসব কথায় শিশুর মগযে তার ভবিষ্যতের প্রস্ত্ততির চিন্তা জেঁকে বসবে। সুতরাং মাঝে মাঝেই এ আলোচনাগুলো করতে হবে।
মেয়েদের ঋতুকালীন বিধিবিধান শিক্ষা দেওয়া স্নেহময়ী মায়েদের বিশেষ কর্তব্য। এ ধরনের ঘটনা যে স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে, মা তার আদরের দুলালীকে তা আগেভাগে স্পষ্ট করবেন। সাথে সাথে এ সময়ে করণীয় ও বর্জনীয় শারঈ দিকনির্দেশনা সম্পর্কে তাকে অবহিত করবেন। অনেক সময় দেখা যায়, কোন কিশোরীর মাসিক হয়েছে, কিন্তু অজ্ঞতার কারণে সে দীর্ঘকাল এ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলে না। তাই মমতাময়ী মাকে অবশ্যই তার নন্দিনীকে সময়কালে আগেভাগেই বিষয়টি জানিয়ে-বুঝিয়ে রাখতে হবে।
শেষ কথা : প্রিয় আম্মাজী! পার্থিব জীবনের জৌলুস ও চাকচিক্যে মশগূল হয়ে আপনার আসল দায়িত্বকে দূরে ঠেলে দিবেন না। এই সন্তানেরা আপনার অধীনস্থজন। তাদের বিষয়ে আপনি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবেন। তখন মনগড়া আবোল-তাবোল প্রমাণ কোন কাজে আসবে না। সুতরাং আপনার উপর অর্পিত দায়িত্বের খোঁজ-খবর এ জগতেই রাখুন, যাতে পরজগতে আপনার জবাবদিহি আসান হয়। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন।-আমীন!
সংকলনে : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
[1]. বুখারী হা/১১২১, ১১২২, ১১৫৬, ৭০২৮; মুসলিম হা/৬২৬৪।