শিশুর লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষায় পিতা-মাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। জীবনের কোন নির্দিষ্ট স্তরের সাথে পিতা-মাতার ভূমিকা সীমাবদ্ধ নয়। শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে কৈশোর, যৌবন অতঃপর সেখান থেকে বাকী জীবন বাবা-মায়ের শেখানো পথেই সে চলতে থাকে। সে চিন্তাধারাই লালন করে যা তার মানসপটে এঁকে দিয়েছেন বাবা মা। এজন্য সন্তান প্রতিপালনে প্রত্যেক বাবা-মাকে আরো সচেতন হ’তে হবে। তৈরি করতে হবে নিজের সন্তানের উপযোগী এক রূপরেখা। তার আলোকেই সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে সচেষ্ট হ’তে হবে।
সন্তানের প্রতিপালনের জন্য প্রত্যেক পিতা-মাতার নিজস্ব একটি শিক্ষাক্রম থাকা দরকার। এটিকে ঘরোয়া সিলেবাসও বলা যায়। প্রতিষ্ঠান সবসময় সবকিছু শেখাতে পারে না। অনেক শিক্ষা এমন রয়েছে, যা মানুষকে তার নিজ ঘর থেকেই গ্রহণ করতে হয়। এটাকে আমরা পারিবারিক শিক্ষা বলি। এই সিলেবাসটি শিশুর মানবীয় নানা চাহিদা, তার বিকাশের বিভিন্ন স্তর, তার যোগ্যতা, তার ঝোঁক বা প্রবণতা ও ক্ষমতা বিবেচনা করে প্রণয়ন করা হবে। যাতে শিশুর মধ্যে সঠিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। পিতা-মাতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিশুকে পরিপক্ক মুসলিম হিসাবে গড়ে তোলা। অতএব পিতা-মাতাকে সন্তানদের লালন-পালনের কিছু মূলনীতি মেনে অগ্রসর হ’তে হবে এবং সেগুলো তাদের মাঝে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হ’তে হবে। আর এই বিশেষ শিক্ষাগুলো সন্তানকে পূর্ণরূপে প্রদান করাই এই সিলেবাসের মূল লক্ষ্য। আমরা এখানে একটি রূপরেখা অাঁকতে চেষ্টা করবো, যে গুণগুলো সকল শিশুর মাঝে থাকা একান্ত যরূরী।
(ক) ঈমানের যত্ন নেওয়া : প্রতিটি মানব শিশু ইসলামের উপর জন্মলাভ করে। পরবর্তীতে সেই শিশু পিতা-মাতার ধর্মের অনুগামী হয়। সেজন্য জীবনের প্রারম্ভেই শিশুর ঈমানের পরিচর্যা করতে হবে। ঈমানের মূলনীতি, ইসলামের ফরয বিধান, হালাল-হারাম, শিরক-কুফর, সুন্নাত-বিদ‘আত ইত্যাদি বিধান শিক্ষা দিতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে ভালোবাসার পদ্ধতি শেখানো, কুরআন তেলাওয়াত, কুরআনের অর্থ অনুধাবন এবং নবী করীম (ছাঃ) ও সালাফে ছালেহীনের সীরাতের উপর জীবন পরিচালনার তাকীদ প্রদানের মাধ্যমে সন্তানদের ঈমানী দিক সজীব করার গুরু দায়িত্ব পিতা-মাতা পালন করবেন। খেয়াল রাখতে হবে, সন্তানকে শেখানো আক্বীদা যেন অবশ্যই সঠিক হয়। তাকে শেখাতে হবে, আল্লাহ সাত আসমানের ওপরে আরশে রয়েছেন। তাকে শেখাতে হবে, আমাদের শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) মাটির মানুষ ছিলেন ইত্যাদি।
(খ) চরিত্র গঠনের উপর গুরুত্বারোপ : চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। চারিত্রিক অধঃপতন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। সেজন্য শিশু অবস্থায় স্বীয় সন্তানদের হৃদয়-মনে উত্তম চরিত্র গঠনের মূলমন্ত্র গেঁথে দেওয়া পিতা-মাতার অবশ্য কর্তব্য। চারিত্রিক শিক্ষা মূলত নৈতিক, আচরণিক ও আবেগিক গুণাবলীর সমষ্টি। শিশুর বোধ-বুদ্ধি হওয়া থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অবধি তাকে এসব গুণ অবশ্যই আয়ত্ত্ব করতে হবে এবং অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। পিতা-মাতা তার সন্তানদের মিথ্যাচার, চুরি করা, গালিগালাজ করা, বেপরোয়াভাব দেখানো, বাজে ব্যবহার, নেশায় আসক্তি, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইত্যাদি নিকৃষ্ট ও কদর্য কাজ থেকে রক্ষা করবেন। তাকে সর্বদা শিক্ষা দিবেন, এসব কাজ আমাদের ধর্মবিরোধী। এসব কাজের পরিণাম জাহান্নাম। তাকে শিক্ষা দিবেন, নমনীয়তা ও কোমলতা। শোনাবেন নবী করীম (ছাঃ)-এর কোমলতার গল্প। সালাফে ছালেহীনের দুনিয়া বিমুখতার দাস্তান। কারণ মহানুভবতা তাদের মাঝেই আসে যারা আখেরাতকে বিশ্বাস করে। যারা হয় দুনিয়াবিমুখ।
(গ) চারপাশের মানুষকে ভালোবাসা : সন্তানদের মধ্যে সদাচরণ, সুসম্পর্ক স্থাপন ও পরোপকারের ন্যায় মানবিক মূল্যবোধ রোপণের মাধ্যমে তাদের চারপাশের মানুষকে ভালোবাসতে শেখাতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, অসহায়জন প্রভৃতি মানুষের সঙ্গে সদাচরণ, উত্তম সাহচর্য ও ভদ্রতাপূর্ণ ব্যবহারের যে আদেশ দিয়েছেন তা শিখিয়ে দিয়ে অন্যদের প্রতি ভালোবাসা তৈরী করতে হবে। এই আচার-ব্যবহার শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পিতার থেকে মায়ের ভূমিকা বেশী। সন্তানকে শেখাতে হবে, কিভাবে পরোপকার করতে হয়। শেখাতে হবে, কিভাবে মানুষের উপকার করে এর প্রতিদান আল্লাহর কাছে আশা করতে হয়। তাদেরকে দেখাতে হবে আমাদের পূর্বসুরীরা মানুষকে ভালোবাসা ও পরোপকারের ক্ষেত্রে কেমন নমুনা ছিলেন।
(ঘ) শরীরচর্চা শিক্ষা দান : শিক্ষার নানা দিকের মধ্যে শারীরিক শিক্ষা খুবই গুরুত্ববহ। সন্তান যাতে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় ইসলাম তাকে সেভাবে প্রতিপালনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিপদ-আপদ ও রোগব্যাধি থেকে শরীর যাতে নিরাপদ থাকে এবং শক্তিশালী দেহ গঠন হয় ইসলাম তা নিশ্চিত করতে বলে। যাতে অদূর ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিত্বের অধিকারী যুবসমাজ উম্মাহর ক্রান্তিকালে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পারে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ، ‘শক্তিধর ঈমানদার দুর্বল ঈমানদারের তুলনায় আল্লাহর নিকটে উত্তম ও অতীব পসন্দনীয়’।[1] হাল যামানায় এই বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমরা যেভাবে দিন দিন উন্নতির নামে ঘরমুখী হ’তে শুরু করেছি তাতে খুব অল্প দিনেই আমরা দুনিয়ায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠব। আজ আমাদের সন্তানরা ঘরের বাইরে বের হয় না। ঘরে ঘরে থাকতে থাকতে অনেকেরই বাইরের রোদ, গরম, ঠান্ডা অসহ্য হ’তে শুরু করেছে। তাই আবহাওয়ার সাথে আমাদের সন্তানদের মানিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের বাইরে যেতে দিতে হবে। খেলাধুলা করতে দিতে হবে। তবেই তারা একটি সুস্থ দেহ নিয়ে বড় হ’তে পারবে।
(ঙ) বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধন : বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধনের অর্থ, শারঈ ও জাগতিক যে সকল বিদ্যা সমাজের জন্য উপকারী তা ইসলামী শিক্ষাক্রম অনুসারে অর্জনের চিন্তা শিশুর মনে জাগিয়ে তোলা। ফলে এ শিক্ষা শারঈ আইনের মূল নীতিমালার কোনটির সাথে বিরোধ ঘটাবে না এবং ইসলামের মৌলিক ভিত্তিতে ফাটল ধরাবে না। পিতা-মাতাকে অবশ্যই তার সন্তানদের সামনে ইলম অন্বেষণের গুরুত্ব এবং ইসলামী জ্ঞান ও বিদ্বানদের মর্যাদা তুলে ধরতে হবে। যেমন আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষার জন্য কোন পথ তালাশ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের একটি পথ সহজ করে দিবেন’।[2] তিনি আরও বলেছেন, ‘তারকারাজির উপর যেমন চাঁদের মর্যাদা তেমনি একজন আবেদের উপর একজন আলেমের মর্যাদা।[3] বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে দু’টি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রথমত দ্বীন শেখার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ আমাদের সালাফগণ যেভাবে বুঝেছেন সেই বুঝের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ রাখতে হবে। হকপন্থী বিদ্বানদের থেকে ইসলামের সঠিক ইতিহাসের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ইসলাম শুরু থেকে অদ্যাবধি যেসব পর্যায় মাড়িয়ে এসেছে এবং মুসলিমদের কি কি পরীক্ষা ও বিপদাপদের মোকাবিলা করতে হয়েছে সে সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষের গৃহীত প্রাচীন ও আধুনিক পরিকল্পনা এবং ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের চলমান ব্যবস্থা সম্পর্কে শিশুদেরকে সচেতন রাখা পিতা-মাতার মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতার আরেকটি অধ্যায়। পিতা-মাতা উম্মাহর সমস্যাগুলো সন্তানদের অন্তরের গভীরে জায়গা করে দিবেন। শত্রুরা যেখানে ধরাবক্ষ থেকে ইসলামী আক্বীদা -বিশ্বাস নিশ্চিহ্ন করে দিতে মুসলিম প্রজন্মের মনোভূমিতে অবিশ্বাস ও কুফরের বীজ বপনে বদ্ধপরিকর, সেখানে তাদের এসব মারাত্মক চক্রান্ত রুখে দিতে সন্তানদের সেভাবেই প্রস্ত্তত করতে হবে।
(চ) সুন্দরভাবে মিলেমিশে বসবাসের রীতি শিক্ষাদান : কিভাবে সমাজের সদস্য ও ব্যক্তিবর্গের সাথে সুন্দরভাবে মিলেমিশে বাস করা যায় এবং কিভাবে সমাজের শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষা করা যায় সে তত্ত্ব সন্তানদের শিক্ষা দিতে হবে। সমাজের সদস্যদের সাথে সুন্দরভাবে মিলেমিশে থাকা, তাদের কল্যাণ কামনা করা এবং তাদের প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসার জন্য সন্তানদেরকে; তাদের বেড়ে ওঠা থেকে অভিজ্ঞতা ও পরিপক্কতা অর্জনের নানা স্তরের ফাঁকে ফাঁকে পিতা-মাতাকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। কেননা নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ ‘আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয় যে মানুষের সবচেয়ে বেশী উপকার করে’।[4]
সেই সাথে সৎকাজের আদেশ করা, অসৎ কাজের নিষেধ করা, কাউকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা, বিদ্রোহ, সীমালঙ্ঘন, হস্তক্ষেপ, ঠাট্টা-মশকরা ইত্যাদি অন্যায় থেকে হাত ও মুখ (ভাষা ও আচরণ) নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের সচেতন করবেন। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‘প্রকৃত মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে’।[5] সমাজের সদস্যদের প্রতি যেসব সদাচার করা এবং সদ্ভাব বজায় রাখা আবশ্যক সন্তানদের সেই শিক্ষা দিবেন। যেমন- বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা ইত্যাদি। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيرِنَا ‘যারা আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান করে না তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[6] অনুরূপভাবে দ্বীন, সমাজ ও উম্মাহর কল্যাণে তাদের শক্তি ব্যয় করতে সন্তানদের দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন।
শেষকথা : সন্তান আমাদের জীবনের অর্জন। এটা যেমন ছাদাক্বায়ে জারিয়া হ’তে পারে তেমনই গুনাহে জারিয়াও হ’তে পারে। সুতরাং সন্তানকে ইসলামের ছায়াতলে আল্লাহভীরু করে গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। আমরা নিজেদের স্থান থেকে তাদের সর্বদা মুত্তাক্বী হওয়ার নছীহত করবো এবং তাদের জীবন গঠনের সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। পিতা-মাতা হিসাবে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এই গুরু দায়িত্ব পালনে আমরা সর্বদা সচেষ্ট হব। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
[1]. মুসলিম হা/২৬৬৪; ইবনু মাজাহ হা/৭৯; মিশকাত হা/৫২৯৮।
[2]. মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪।
[3]. তিরমিযী হা/২৬৮২; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; আবুদাউদ হা/৩৬৪১।
[4]. তাবারাণী কাবীর, ছহীহাহ হা/৯০৬।
[5]. বুখারী হা/১০, ৬৪৮৪; আবূদাউদ হা/২৪৮১; তিরমিযী হা/২৬২৭।
[6]. আহমাদ হা/৬৭৩৩; ছহীহুত তারগীব হা/১০০।