সন্তান প্রতিপালন অন্যতম গুরুদায়িত্ব। এটি একটি বিদ্যা, যার কিছু মূলনীতি ও কায়দা-কানুন রয়েছে। সন্তান প্রতিপালনে কোন ভুলভ্রান্তি হ’লে তা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য মারাত্মক কুফল বয়ে আনে। সেজন্য সন্তান প্রতিপালনে পিতা-মাতাকে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। অনেক সময় সতর্কতা সত্ত্বেও সন্তান লালন-পালনে পিতা-মাতা অনেক ভুল-ভ্রান্তি করে থাকেন। এ সমস্ত ভুল-ভ্রান্তি বর্জন করলে আদর্শ সন্তান গড়ে তোলা অসম্ভব কিছুই নয়। নিম্নে সন্তান লালন-পালনে বর্জনীয় কাজগুলো উল্লেখ করা হ’ল-

(১) পিতা-মাতা ও সন্তানদের মাঝে যোগাযোগের অভাব :

অনেক পিতা-মাতা ছেলে-মেয়েদের সাথে যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা বলার গুরুত্ব বুঝতে চান না। বরং তারা আলাপচারিতাকে মূল্যহীন ভাবেন। ফলে পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরে। এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ তৈরী হয়। কখনো কখনো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব দেখা দেয় এবং বয়সকালে এসে পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। শিশুর কথার প্রতি যখন গুরুত্ব দেওয়া হয় না তখন সে সহজেই খারাপ সাথীদের সাথে মিশে যায়। সে এমন কাউকে চায়, যে তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে, তাকে ও তার কথাকে মূল্যায়ন করবে এবং তার মনঃকষ্ট দূর করবে। মূলত এমন কাউকে তালাশ করতে গিয়ে সে খারাপ সাথীদের পাল্লায় পড়ে যায়।

তাদের সাথে আলাপ করতে গিয়ে, তাদের মনের কথা জানতে গিয়ে আরো কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যেমন, বয়সভেদে আলাপের বিষয়বস্ত্ত নির্ধারণ করা। বড়দের সাথে আলাপের বিষয় এবং ছোটদের সাথে আলাপের বিষয় এক হবে না। ঠিক তেমনই মেয়ের সাথে যে আলাপ করা হবে তা ছেলের সাথে করা হবে না। অনেক পিতা আছেন যারা ছেলে-মেয়েদের উপর নিজেদের মত জোর করে চাপিয়ে দেন। এটা সঠিক নয়। আমাদের বুঝা দরকার, প্রত্যেক প্রজন্মের পৃথক পৃথক সংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনা ও চাহিদা রয়েছে। ইমাম আলী (রহঃ) কতই না সুন্দর বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের তোমাদের যুগের শিষ্টাচার শেখানোর উপর সীমাবদ্ধ থেকো না। কেননা তারা তোমাদের যুগ থেকে পৃথক যুগের জন্য সৃষ্ট।[1]

(২) ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে গুরুত্ব না দেওয়া :

আল্লাহ তা‘আলা নানা ঝোঁক, খেয়াল ও মেযাজের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানব সৃষ্টির মাঝে এমনই রহস্য নিহিত আছে। তিনি বলেন,وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ، إِلَّا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ، ‘বস্ত্ততঃ যদি তোমার প্রতিপালক চাইতেন, তবে সকল মানুষকে একই দলভুক্ত করে দিতেন। কিন্তু তারা সর্বদা মতভেদ করতেই থাকবে। কেবল তারা ব্যতীত যাদের উপর তোমার প্রতিপালক অনুগ্রহ করেন। আর এজন্যেই তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তোমার প্রভুর বাণী পূর্ণতা লাভ করবে যে, অবশ্যই আমি জাহান্নাম পূর্ণ করব জিন ও ইনসান সবাইকে দিয়ে’ (হূদ ১১/১১৮-১১৯)। এ কারণে ইসলাম বুদ্ধির সক্ষমতা ও অনুধাবনের পারঙ্গমতা বিবেচনা করে মানুষের মাঝে আলোচনা তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ করেছে। যা তাদের রুচি ও মেজাযের অনূকুল হবে। ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, مَا أَنْتَ بِمُحَدِّثٍ قَوْمًا حَدِيثًا لَا تَبْلُغُهُ عُقُولُهُمْ، إِلَّا كَانَ لِبَعْضِهِمْ فِتْنَةً ‘যখন তুমি কোন সম্প্রদায়ের কাছে এমন কোন হাদীছ বর্ণনা করবে, যা তাদের বুঝে আসে না তখন তা তাদের কারো কারো পক্ষে ফিতনা হয়ে দাঁড়াবে’।[2]

ইসলাম তাই বিভিন্ন ব্যক্তির মাঝে পার্থক্য স্বীকার করে। এ কথা যেমন পুরো মুসলিম সমাজের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি পুরো পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সুতরাং পিতা-মাতাকে জানতে হবে যে, তাদের সন্তানরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাদের কেউ হয়তো দ্রুত ডাকে সাড়া দেয়, আবার কেউ ধীরগতির, কেউ আবার চঞ্চলমতির। সুতরাং সকল সন্তান একভাবে কাজ করবে না এবং সবার থেকে এক পদ্ধতিতে কাজ চাইলে পাওয়া যাবে না।

(৩) শিশুর বয়স বিবেচনায় না রাখা :

পিতা-মাতাকে সন্তানের বয়সের স্তরের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। তারা সকল সন্তানের সাথে এক ধারার আচরণ করতে যাবেন না। শৈশবের দোলনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা সকল ছেলে-মেয়ের ক্ষেত্রে এই একই কথা প্রযোজ্য। প্রত্যেকের সাথে তাদের স্তর উপযোগী আচরণ করতে হবে এবং তারা ভুল করলে স্তর মাফিক শাস্তি বা সংশোধনী প্রয়োগ করতে হবে। কখনো তাদেরকে মারার প্রয়োজন হয়। আবার কখনো শুধু গলার আওয়ায একটু উঁচু করলে কিংবা ধমক দিলেই সে সোজা হয়ে যায়। আবার তরুণ-তরুণীরা একটি প্রীতিপূর্ণ কথাতেই পিতা-মাতার বাধ্য হয়ে যায়। সুতরাং সব বয়সী ছেলে-মেয়েকে একই ধারায় শাসন করা যাবে না।

এজন্য ছোটরা যখন ছালাত আদায়ে অলসতা করে তখন ইসলাম তাদের প্রহার করার অনুমতি দেয়। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে তোমরা ছালাত আদায়ের হুকুম দাও। দশ বছর বয়সে এজন্য প্রহার কর এবং তাদের প্রত্যেকের পৃথক বিছানার ব্যবস্থা করো।[3] কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। সুতরাং বয়সের তারতম্যের কারণে আচরণেরও তারতম্য হবে।

(৪) অন্যের সাথে তুলনা করা :

অনেক পিতা-মাতা সন্তান প্রতিপালন করতে গিয়ে এক সন্তানকে অন্য সন্তানের সাথে তুলনা করেন। হ’তে পারে সে তুলনা নিজেরই কোন সন্তানের সাথে অথবা অন্যের সন্তানের সাথে। আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রত্যেক শিশুর স্বকীয় সামর্থ্য, দক্ষতা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যের থেকে আলাদা। তাকে অন্যের সাথে তুলনা করলে অনেক সময় তার মধ্যে হতাশা ও হীনমন্যতা জন্ম নেয়। ফলে শিশু নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। এমনকি সব সময় এরূপ তুলনা শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি বয়ে আনে। তার ব্যক্তিত্ব গঠনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সবকিছুতেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো ছাড়া সে নিজ থেকে ভাল কিছু করতে পারে না।

আসলে শিশুর মানসিকতা বড়দের মানসিকতার মতই। আপনি যখন তাকে তার থেকে অগ্রসর অথবা মেধাবী অথবা শান্ত কোন ভাই কিংবা বোনের সাথে তুলনা করেন তখন সে ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়। এ জাতীয় তুলনা শিশুর মধ্যে মানসিক অশান্তি ও গোলযোগ বয়ে আনে এবং তার ব্যক্তিত্ব দুর্বল করে দেয়। সে ভাবে, তার ভাই যা করতে পারছে তা সে করতে পারছে না, অথবা জীবনে আদৌ করতে পারবে না। অথচ দেখা যাবে, সেও এমন কোন কাজ নিশ্চয়ই করতে পারে যা তার ঐ ভাই করতে পারে না। সে তো আদতে তার ভাইয়ের অনুলিপি বা কার্বন কপি না। সুতরাং এই বিষয়টি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

(৫) সন্তানদের মধ্যে সমতা ও ইনছাফ বজায় না রাখা :

সন্তানদের মধ্যে সমতা ও ইনছাফ বজায় না রাখার ফলে তাদের মধ্যে হিংসা, শত্রুতা, অবাধ্যতা ও পারস্পরিক ঘৃণা জন্ম নেয়। সেজন্য পিতা-মাতাকে সন্তানদের মধ্যে পারস্পরিক আচরণ, কথা-বার্তা এবং সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অবশ্যই সমতা নিশ্চিত করতে হবে। কোন সন্তানকে অধিক স্নেহে সম্পদের অংশ বেশী দেয়া এবং অন্য সন্তানকে বঞ্চিত করার মত বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন ও অশ্লীলতা, অন্যায় ও অবাধ্যতা হ’তে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর’ (নাহল ১৬/৯০)।

নুমান বিন বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তার মা রাওয়াহার কন্যা তার পিতার (বাশীরের) নিকট স্বীয় পুত্রের জন্য তার সম্পদ থেকে একটা কিছু উপহার দাবি করেন। কিন্তু দিচ্ছি-দেই করে তিনি এক বছর কাটিয়ে দেন। তারপর তিনি দিতে সম্মত হ’লেন। তখন নুমানের মা বলে বসলেন, তুমি আমার ছেলেকে যা উপহার দেবে তার উপর যতক্ষণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সাক্ষী না রাখবে ততক্ষণ আমি তাতে রাজি হব না। (রাবী বলেন,) আমি ছিলাম তখন বালক বয়সী। আমার পিতা আমার হাত ধরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এর মা রাওয়াহার কন্যা চাচ্ছে যে, আমি তার ছেলেকে যে উপহার দেব তাতে আপনি সাক্ষী থাকবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে বাশীর, এছাড়া কি তোমার আরও সন্তান আছে? তিনি বললেন, হাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি তাদের সবাইকে এর মতো উপহার দিয়েছ? তিনি বললেন, না। তিনি বললেন, فَلَا تُشْهِدْنِي إِذًا، فَإِنِّي لَا أَشْهَدُ عَلَى جَوْرٍ ‘তবে তুমি আমাকে সাক্ষী রেখো না। কেননা, আমি কোন জোর-যুলুমের কাজে সাক্ষী হই না’।[4] বুখারীর অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমার সকল সন্তানকে কি এই সন্তানের মতো দিয়েছ? তিনি বললেন, না। তখন তিনি বললেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তানদের মধ্যে ইনছাফ বজায় রাখো। তিনি (নুমান) বলেন, ফলে তিনি ফিরে গেলেন এবং তার প্রদত্ত উপহার ফেরৎ নিলেন।[5]

(৬) সন্তানকে দায়িত্ব না দেয়া :

সন্তানকে কোন কাজের দায়িত্ব না দিয়ে বেকার বসিয়ে রেখে লালন-পালন করা সন্তান প্রতিপালনের একটি মারাত্মক ভুল। দেখা যায়, পিতাই পরিবারের সকল কিছুর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। তিনি সকল প্রকার কাজ করে যান। সন্তান বয়স্ক ও নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাকে কোন দায়িত্ব দিতে চান না। তিনি বুঝতে চান না, এর ফলে সন্তানের ব্যক্তিত্ব দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার যে একটা পৌরুষ আছে তা সে বুঝতে পারছে না।

নবী করীম (ছাঃ) সন্তানকে পৌরুষদীপ্ত ও দায়িত্বশীল করে গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছেন।

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি কিশোরদের সাথে খেলছিলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে এসে আমাদেরকে সালাম দিলেন। তারপর তিনি আমার হাত ধরলেন এবং আমাকে একটা প্রয়োজনে পাঠালেন। তাঁর নিকট আমার ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি একটা দেয়াল বা প্রাচীরের ছায়ায় বসে ছিলেন। যে বার্তা পৌঁছে দিতে তিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন আমি তা পালন করলাম। আমি যখন আমার মা উম্মে সুলাইমের নিকট আসলাম তিনি বললেন, তোমার দেরি হ’ল কেন? আমি বললাম, নবী করীম (ছাঃ) আমাকে তাঁর একটা দরকারে পাঠিয়েছিলেন। তিনি বললেন, কী সে দরকার? আমি বললাম, এটা গোপনীয়। তিনি বললেন, احْفَظْ سِرَّ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর গোপনীয় বিষয়ের হেফাযত করো’। আনাস (রাঃ) বলেন, পরবর্তীতে আমি কাউকে তা বলিনি।[6] প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আনাস (রাঃ) ঐ সময়ে বালক ছিলেন। ঐ বয়সেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে উক্ত গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন।

(৭) অতিরিক্ত আদর-স্নেহ :

সন্তানকে অতিরিক্ত আদর-স্নেহ দেওয়া, চোখের আড়াল হ’তে না দেওয়া। বিশেষত মায়ের পক্ষ থেকে বেশী আদর-আহ্লাদ সন্তানের মানসিকতা ও আচরণের উপর মারাত্মক খারাপ প্রভাব ফেলে। এর ফলে সন্তানের মধ্যে লাজুকতা, অন্তর্মুখিতা, অধিক ভীতি, আত্মবিশ্বাসে দুর্বলতা, সাথী-সঙ্গীদের সংস্রব থেকে দূরে থাকার প্রবণতা তৈরী হয়। সে হয়ে পড়ে আলালের ঘরের দুলাল।

বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট করেছেন যে, অতি আদরে নষ্ট সন্তান অস্থিরমতি হয়। সে সব কাজে তাড়াহুড়ো করে। বিভিন্ন কাজে চিন্তা-ভাবনা না করেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সে কাম্য ও প্রার্থিত কার্যকর পর্যায়ে উঠতে পারে না। অতি আদরে নষ্ট সন্তানের উপর অনেক সময় আমিত্ব বা আত্মঅহমিকা ভর করে। সে নিজেকে তার ভাই-বোনদের থেকে আলাদা মনে করে। তাদের উপর ক্ষমতা খাটাতে পসন্দ করে এবং তাদের সাথে কঠোর আচরণ করে।

ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) যখন সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন তার পিতা তাকে ইলমে দ্বীন ও ফিক্বহ অধ্যয়নের মানসে মদীনা মুনাওয়ারায় পাঠিয়েছিলেন। ছালেহ বিন কায়সান তার গৃহশিক্ষক, সার্বক্ষণিক দেখভালকারী, পরামর্শদাতা ও নির্দেশনাদাতা নিযুক্ত হয়েছিলেন। একদিন এই শিক্ষক জানতে পারলেন যে, ওমর বিন আবদুল আযীয ছালাতের জামা‘আতে যোগ দেননি। তিনি কী ঘটেছে তা জানতে তার নিকট গেলেন এবং জিজ্ঞাসা সূত্রে বললেন, তোমার জামা‘আতে যোগদান না করার কারণ কী? তিনি বললেন, আমি কেশ পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিলাম। ছালেহ অবাক বিস্ময়ে বললেন, শুধুই চুল আঁচড়ানোর দরুন তুমি জামা‘আতে যোগ দিতে পারলে না! তিনি এ কথা পিতা আব্দুল আযীয বিন মারওয়ানকে লিখে পাঠালেন। পিতা আর কি করবেন! এ কাজের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেজন্য তিনি শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ শেখানোর মানসে ছেলের মাথা ন্যাড়া করে দিতে হুকুম দিলেন।[7]

উল্লেখিত ঘটনা থেকে বুঝা যায়, সে যুগে ‘আদব বা শিষ্টাচার’ শিক্ষার একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বিষয় ছিল। অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের আদব শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের নিকট পাঠাতেন। তারা তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধান করতেন, হাতে-কলমে আদব শিখাতেন এবং নেতিবাচক কিছু পেলে নিজেদের পদক্ষেপের সাথে অভিভাবকদের সহায়তা নিতেন। দুঃখের বিষয়, আজ শিক্ষার শত শত বিষয় উদ্ভাবিত হয়েছে কিন্তু আদব বা শিষ্টাচার নামে কোন বিষয় আজ আর কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসায় পড়ানো হয় না। তাই সমাজে আদবওয়ালার তুলনায় বেয়াদবের সংখ্যা বেশী। এই পরিস্থিতির গোড়ায় রয়েছে সন্তানদের জন্য মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ।

(৮) মাত্রাতিরিক্ত নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও নির্দয়তা :

অতিরিক্ত স্নেহ-আদর যেমন শিশুর উপর খারাপ ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তেমনিভাবে মাত্রাতিরিক্ত নিষ্ঠুরতাও তার উপর একই রকম কুপ্রভাব ও খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। অতিরিক্ত নির্মমতা শিশুর অনুভূতি ভোঁতা করে দেয়, তাকে কাপুরুষ ও ব্যক্তিত্বহীনে পরিণত করে। ফলে সে নিজের হক পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না, কিংবা কোন মযলুমের সাহায্যার্থে তার পাশে দাঁড়াতে পারে না। উল্টো অনেক সময় শিশুর মধ্যে একগুঁয়েমি ও প্রতিশোধপরায়ণতা জন্ম নেয়। মাত্রাতিরিক্ত নিষ্ঠুরতা ত্রুটি-বিচ্যুতির কোন সমাধান নয় এবং তা সন্তানদের সংশোধনের কোন পন্থাও নয়। সন্তানদের প্রতি নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণের মাত্রা অনেক অভিভাবকের ক্ষেত্রে এতটাই সীমা ছাড়িয়ে যায় যে, হিংস্র প্রাণীদেরও তাদের তুলনায় বেশী দয়ালু হ’তে দেখা যায়।

মাতাপিতাদের জানতে হবে, কঠোরতা ও নির্মমতা ওষুধের মতো, যা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়। সংশোধনের নমনীয় নানা উপায়-পদ্ধতি যখন কোন কাজ দেবে না তখন শেষ চিকিৎসা হিসাবে অভিভাবক কঠোরতা আরোপ করতে পারেন।

জারীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ، يُحْرَمِ الْخَيْرَ ‘যে কোমলতা থেকে বঞ্চিত, সে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত’।[8] আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হে আয়েশা, ‘আল্লাহ কোমল, তিনি কোমলতা ভালবাসেন। তিনি কোমলতার ভিত্তিতে যা দেন কঠোরতার ভিত্তিতে তা দেন না। অনেক কিছু আছে যা কোমলতা ছাড়া তিনি দেনই না’।[9] আরেক হাদীছে আয়েশা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ ‘নিশ্চয়ই কোন জিনিসের মধ্যে কোমলতা থাকলে সে তাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। আর কোমলতা কোন জিনিস থেকে তা তুলে নেওয়া হ’লে তাকে কলুষিত করে’।[10]

শেষকথা : সন্তান দুনিয়াবী জীবনে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সন্তানকে সুসন্তান হিসাবে গড়ে তোলা এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য মূল্যবান সম্পদে পরিণত করা প্রতিটি পিতা-মাতার সর্বোচ্চ দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে তারা দুনিয়া ও আখেরাতে অশেষ মর্যাদার অধিকারী হবেন। অন্যদিকে তা পালনে ব্যর্থ হ’লে লাঞ্ছনার শিকার হ’তে হবে। এজন্য সন্তানের প্রতি সুদৃষ্টি রাখা এবং তাদেরকে সৎ, আদর্শবান ও দ্বীনদার হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা প্রত্যেক পিতা-মাতার আবশ্যকীয় দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন!


[1]. উসামা বিন মুনকিয, লুবাবুল আদাব, পৃ. ৭০।

[2]. মুসলিম ১/১১, হা/৫-এর আলোচনা দ্র.।

[3]. আহমাদ হা/৬৬৮৯; আবুদাউদ হা/৪৯৫।

[4]. বুখারী হা/২৬৫০; মুসলিম হা/১৬২৩।

[5]. বুখারী হা/২৫৮৭।

[6]. আহমাদ হা/১৩৪৯৪; ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৫৫২১; বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১১৩৯।

[7]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৯/১৩৩।

[8]. মুসলিম হা/২৫৯২।

[9]. মুসলিম হা/২৫৯৩।

[10]. মুসলিম হা/২৫৯৪।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও
আরও
.