ভূমিকা :
আদম সন্তানের নারীদের প্রতিমাসে ঋতুবতী হওয়া, এটা আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এটা তাঁর সৃষ্টিকৌশলের অন্যতম। এ সময় মহিলাদের কষ্ট হয়। যে বিষয়ে পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে (বাক্বারাহ ২/২২২)। ফলে এ অবস্থায় তাদের জন্য ইসলামের কিছু বিধান হারাম করা হয়েছে এবং কিছু শিথিল করা হয়েছে। নিম্নে সেসব উল্লেখ করা হ’ল।-
১. ঋতুবতী মহিলার জন্য ছালাত-ছিয়াম নিষিদ্ধ :
ঋতুবতী মহিলাদের জন্য ছালাত-ছিয়াম আদায় করা নিষিদ্ধ। আর আদায় করলেও তা সিদ্ধ হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ. قُلْنَ بَلَى ‘মহিলা কি এমন নয় যে, ঋতুবতী হ’লে ছালাত পড়বে না, ছিয়াম রাখবে না’? তারা বলল, হ্যাঁ’।[1]
ঋতুবতী অবস্থায় যেসব ছিয়াম ছুটে যাবে, পবিত্রতা অর্জনের পর সেই ছিয়ামের কাযা আদায় করতে হবে, তবে ছালাতের কাযা আদায় করতে হবে না। হাদীছে এসেছে,
عَنْ مُعَاذَةَ، قَالَتْ: سَأَلْتُ عَائِشَةَ فَقُلْتُ: مَا بَالُ الْحَائِضِ تَقْضِي الصَّوْمَ، وَلَا تَقْضِي الصَّلَاةَ. فَقَالَتْ: أَحَرُورِيَّةٌ أَنْتِ؟ قُلْتُ: لَسْتُ بِحَرُورِيَّةٍ، وَلَكِنِّي أَسْأَلُ. قَالَتْ: كَانَ يُصِيبُنَا ذَلِكَ، فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ، وَلَا نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلَاةِ،
মু‘আযাহ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ঋতুবতীর ব্যাপারটা কি এরকম যে, সে ছাওম কাযা করবে অথচ ছালাত কাযা করবে না? তিনি বললেন, তুমি কি হারূরিয়্যা? আমি বললাম, আমি হারূরিয়্যা নই, বরং আমি (কেবল জানার জন্য) জিজ্ঞেস করছি। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আমাদের এরূপ হ’ত তখন আমাদেরকে কেবল ছাওম কাযা করার নির্দেশ দেয়া হ’ত, ছালাত কাযা করার নির্দেশ দেয়া হ’ত না।[2]
২. বায়তুল্লাহর তওয়াফ করা :
ঋতুবতী নারীর জন্য বায়তুল্লাহর তওয়াফ করা হারাম। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الطَّوَافُ صَلاَةٌ ‘নিশ্চয়ই তওয়াফ হচ্ছে ছালাত’।[3] বিদায় হজ্জের সময় তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে বলেছিলেন,فَافْعَلِى مَا يَفْعَلُ الْحَاجُّ، غَيْرَ أَنْ لاَ تَطُوفِى بِالْبَيْتِ حَتَّى تَطْهُرِى، ‘হজ্জ সম্পাদনকারী ব্যক্তি যা করে তুমিও তা করতে থাক। তবে পবিত্র কা‘বা ঘর তওয়াফ ব্যতীত যতক্ষণ না তুমি পবিত্রতা অর্জন করবে’।[4]
৩. পবিত্র কুরআন স্পর্শ করা :
ঋতুবতী নারী পবিত্র কুরআন মাজীদ ধরবে না। কারণ এ অবস্থায় তারা অপবিত্র থাকে। আল্লাহ বলেন,لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ، ‘পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ একে স্পর্শ করেনি’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭৯)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইয়ামনবাসীর নিকট প্রেরিত পত্রে লিখেছিলেন, أَنْ لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌ، ‘পবিত্র ব্যক্তি ব্যতীত কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না’।[5] তবে মাছহাফ স্পর্শ না করে ঋতুবতী মহিলা কুরআন মুখস্থ তেলাওয়াত করতে পারে। ইবনে আববাস অপবিত্র ব্যক্তির জন্য কুরআন পাঠ করাকে কোন দোষের কাজ মনে করতেন না। নবী করীম (ছাঃ) সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকির করতেন।[6] অতএব স্পর্শ না করে জুনূবী অবস্থায় মুখস্থ কুরআন পড়তে পারবে। উল্লেখ্য যে, ঋতুবতী ও জুনূবী কুরআন পড়তে পারে না মর্মে বর্ণিত হাদীছটি মুনকার ও বাতিল।[7] আর ঋতুবতীর দো‘আ, তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল ইত্যাদি পাঠ করতে কোন অসুবিধা নেই।
৪. মসজিদে অবস্থান করা :
ঋতুবতী অবস্থায় মহিলারা অপবিত্র থাকে। এজন্য ঋতুবতীর জন্য মসজিদে অবস্থান করা নিষেধ। আল্লাহ বলেন,وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوا، ‘আর নাপাক অবস্থায় ছালাতের নিকটবর্তী হয়ো না যতক্ষণ না গোসল কর; তবে যদি তোমরা পথ চলা অবস্থায় থাক (সেটি স্বতন্ত্র কথা)’ (নিসা ৪/৪৩)।
তবে মসজিদ থেকে কোন জিনিস নেয়ার দরকার থাকলে তা নিতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা আয়েশা (রাঃ)-কে বললেন,نَاوِلِينِي الْخُمْرَةَ مِنَ الْمَسْجِدِ، قَالَتْ فَقُلْتُ: إِنِّي حَائِضٌ، فَقَالَ: إِنَّ حَيْضَتَكِ لَيْسَتْ فِي يَدِكِ، ‘মসজিদ থেকে (আমার) চাদরটি এনে দাও। তিনি বললেন, আমি তো ঋতুবতী? তিনি জবাবে বললেন, তোমার হাতে তো হায়েয লেগে নেই’।[8]
৫. ই‘তিকাফ করা :
পুরুষ বা মহিলা কারো জন্যই জুম‘আ মসজিদ ছাড়া বাড়ীতে ই‘তিকাফ করা সিদ্ধ নয়।[9] মহিলাদের জন্য মসজিদে পৃথক জায়গা থাকলে এবং যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলে কোন জুম‘আ মসজিদে গিয়ে ই‘তিকাফ করতে পারবে। রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণ মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন।[10] মসজিদে অবস্থানের জন্য যেহেতু পবিত্রাবস্তা আবশ্যক, সেকারণ ঋতুবতী মহিলারা ঋতু অবস্থায় ই‘তিকাফ করতে পারবে না।
৬. ঋতুবতী মহিলার সাথে সহবাসে লিপ্ত হওয়া :
ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে মিলন করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّى يَطْهُرْنَ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ، ‘আর লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে মহিলাদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে। তুমি বল, ওটা কষ্টদায়ক বস্ত্ত। অতএব ঋতুকালে তোমরা স্ত্রীমিলন হ’তে বিরত থাক। তাদের নিকটবর্তী হয়ো না পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত। অতঃপর যখন তারা ভালভাবে পবিত্র হবে, তখন তোমরা তাদের নিকটে গমন কর, যেভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/২২২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَتَى حَائِضًا أَوِ امْرَأَةً فِىْ دُبُرِهَا أَوْ كَاهِنًا فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُوْلُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ- ‘যে ব্যক্তি কোন ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে কিংবা তার পায়ুপথে সঙ্গম করে অথবা গণকের কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করল’।[11]
ঋতুস্রাব অবস্থায় যদি কেউ স্ত্রীমিলনে লিপ্ত হয় তবে তার ওপর এই পাপের কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। ঋতুকালে স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে কাফফারা দিতে হবে।
নবী করীম (ছাঃ) এমন ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন,الَّذِيْ يَأْتِيْ امْرَأَتَهُ وَهِىَ حَائِضٌ قَالَ يَتَصَدَّقُ بِدِيْنَارٍ أَوْ نِصْفِ دِيْنَارٍ- ‘যে ব্যক্তি ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে সহবাস করে, সে যেন এক অথবা অর্ধ দীনার ছাদাক্বা করে’।[12] উল্লেখ্য যে, ১ ভরি সমান ১১.৬৬ গ্রাম। হাদীছে বর্ণিত এক দীনার সমান ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ। আর অর্ধ দীনার সমান ২.১২৫ গ্রাম স্বর্ণ।
তালাক প্রদানের জন্য মহিলাকে হায়েয ও নেফাস থেকে পবিত্র থাকতে হয়। কারণ উক্ত অবস্থায় তালাক দিলে তা পতিত হবে না। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ، ‘হে নবী! যখন তোমরা স্ত্রীদের তালাক দাও, তখন তাদেরকে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দাও’ (তালাক ৬৫/১)।
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে তাঁর স্ত্রীকে হায়েয অবস্থায় তালাক দেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, مُرْهُ فَلْيُرَاجِعْهَا، ثُمَّ لِيُمْسِكْهَا حَتَّى تَطْهُرَ ثُمَّ تَحِيضَ، ثُمَّ تَطْهُرَ، ثُمَّ إِنْ شَاءَ أَمْسَكَ بَعْدُ وَإِنْ شَاءَ طَلَّقَ قَبْلَ أَنْ يَمَسَّ، فَتِلْكَ الْعِدَّةُ الَّتِى أَمَرَ اللهُ أَنْ تُطَلَّقَ لَهَا النِّسَاءُ ‘তাকে নির্দেশ দাও, সে যেন তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় এবং নিজের কাছে রেখে দেয় যতক্ষণ না সে মহিলা পবিত্র হয়ে আবার ঋতুবতী হয় এবং আবার পবিত্র হয়। অতঃপর সে যদি ইচ্ছা করে, তাকে রেখে দিবে আর যদি ইচ্ছা করে তবে সহবাসের পূর্বে তাকে তালাক দেবে। আর এটাই তালাকের নিয়ম, যে নিয়মে আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রীদের তালাক দেয়ার বিধান দিয়েছেন’।[13]
উল্লেখ্য, নিফাস বা সন্তান প্রসবোত্তর রক্ত প্রাবাহিত অবস্থায়ও উপরোক্ত বিধান সমূহ প্রযোজ্য।
উপসংহার :
ইসলাম মানবতার জন্য এক কল্যাণকর বিধান। এটা পালন করা তাদের জন্য সহজ করা হয়েছে। আল্লাহ মানুষের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিধান বিধিবদ্ধ করেছেন এবং অকল্যাণকর বিষয়াবলী নিষিদ্ধ করেছেন। যেন তা পালন করে বান্দা ইহকাল ও পরকালে উপকৃত হ’তে পারে। তাই আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর বিধানসমূহ পালন করার তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৩০৪, ১৯৫১; মিশকাত হা/১৯।
[2]. মুসলিম হা/৩৩৫; আবূদাউদ হা/২৬২; নাসাঈ হা/৩৮২।
[3]. আহমাদ হা/১৫৪৬১, ১৬৬৬৩; ইরওয়া হা/১২১, সনদ ছহীহ।
[4]. বুখারী হা/৩০৫; ও মুসলিম হা/১২১১।
[5]. দারা-কুতনী হা/৪৩৯; মিশকাত হা/৪৬৫; ইরওয়া হা/১২২, সনদ ছহীহ।
[6]. বুখারী ‘ঋতু’ অধ্যায়, ‘ঋতুবতী নারী ত্বাওয়াফ ব্যতীত হজ্জের যাবতীয় বিধান পালন করবে’ অনুচ্ছেদ।
[7]. তিরমিযী হা/১৩১; মিশকাত হা/৪৬১।
[8]. মুসলিম হা/২৯৮; আবূদাউদ হা/২৬১; মিশকাত হা/৫৪৯।
[9]. বাক্বারাহ ১৮৭; আবূদাউদ হা/২৪৭৩; মিশকাত হা/২১০৬, ‘ই‘তিকাফ’ অনুচ্ছেদ।
[10]. বুখারী হা/২০৪১, ২০৪৫; মিশকাত হা/২০৯৭।
[11]. ইবনু মাজাহ হা/৬৩৯; তিরমিযী হা/১৩৫; মিশকাত হা/৫৫১, হাদীছ ছহীহ।
[12]. আবূদাঊদ হা/২৬৪; মুসনাদে আহমাদ হা/২১২১, সনদ ছহীহ।
[13]. বুখারী হা/৫২৫১; মিশকাত হা/৩২৭৫।