শত্রু-মিত্র : জানা এবং হুঁশিয়ার হয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সমাজের সবার সাথে সকলের সদ্ভাব-সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব থাকে না। অনেকের সাথে আন্তরিকতা ও সুসম্পর্ক থাকে। কারো সাথে অমিল, মনোমালিন্য থাকতে পারে। অনেকে আছে যারা অপরের কল্যাণ দেখে ভ্রূকুঞ্চিত করে। আবার কেউ নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করে। সুতরাং এ ধরনের মানুষ চিনে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। বিপদে তাদের সাহায্য নিতে হবে এবং তাদের সমস্যায় পাশে দাঁড়াতে হবে। এতে সমাজ সুন্দর হবে। পক্ষান্তরে যারা অসৎ, শঠ, দ্বীন থেকে দূরে তাদের সংশ্রব ও সাহচর্য পরিহার করতে হবে। কেননা মানুষ তার সঙ্গী-সাথীর রীতিনীতি গ্রহণ করে। ফলে অসৎ ও বেদ্বীনের সাহচর্যে থেকে দ্বীন মানা ও ভাল থাকা যায় না। তাই সদা সাবধান-হুঁশিয়ার থাকতে হবে। আর সকল বন্ধুত্ব, ভালবাসা, আন্তরিকতা কিংবা বিচ্ছেদ-বিয়োগ, দূরত্ব, কাউকে কিছু দেওয়া বা না দেওয়া সবকিছু আল্লাহর জন্য হতে হবে।[1] যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব ভালবাসা মুমিন-মুত্তাক্বীর সাথে গড়ে উঠবে তখন দ্বীনী কাজ করা, আমল-ইবাদতে অগ্রণী হওয়া সর্বোপরি ঈমান সুদৃঢ় বা মযবূত করা সম্ভব হবে।
ন্যায়বিচার বা আদল প্রতিষ্ঠা : ন্যায়বিচারের আরবী প্রতিশব্দ ‘আদল’, ‘ক্বিস্ত’, ‘ইনছাফ’। কুরআনে আদল ও ক্বিস্ত শব্দ এসেছে। মুসলিম দেশগুলোতে আজ ন্যায়বিচারের অভাব যেন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। অফিস-আদালতে অনুসন্ধান করলে এ কথার সত্যতা কম-বেশী মিলবে। অথচ কুরআন হাদীছ মেনে চললে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কুরআন ও হাদীছ বিচারকদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আদেশ দেয়। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى، ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সত্য সাক্ষ্য দানে অবিচল থাক এবং কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে অবিচারে প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়বিচার কর, যা আল্লাহভীতির সর্বাধিক নিকটবর্তী’ (মায়েদাহ ৫/৮)।
একবার একটি চুরির মোকদ্দমায় চোরের হাত না কাটতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে সুপারিশ করা হয়। যে চুরি করেছিল সে ছিল উচ্চ বংশীয়। এ সুপারিশের জন্য তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং খুৎবা দেন। যার শেষে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত তবে সেজন্য আমি তার হাত কেটে দিতাম। কারও সম্পদ অন্যায়ভাবে কুক্ষিগত করার জন্য আদালতে মামলা-মুকদ্দমা দায়ের করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ وَتُدْلُوا بِهَا إِلَى الْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا فَرِيقًا مِنْ أَمْوَالِ النَّاسِ بِالْإِثْمِ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ، ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ ভক্ষণ করো না এবং অন্যের সম্পদ অন্যায় পন্থায় গ্রাস করার জন্য জেনে-শুনে তা বিচারকদের নিকট পেশ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৮)।
যথাযথ ও সত্য সাক্ষ্য দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِالْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ، ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়’ (নিসা ৪/১৩৫)।
ধনী হোক কিংবা দরিদ্র, আল্লাহ তাদের নিকটজন। সুতরাং তোমরা প্রবৃত্তির তাবেদারী করে (ধনীর পক্ষ নিয়ে দরিদ্রের বিরুদ্ধে অথবা দরিদ্রের পক্ষ নিয়ে ধনীর বিরুদ্ধে) এলোমেলো সাক্ষ্য দিও না, বরং সুবিচার কায়েম রেখো। যাদের সাক্ষী মানা হবে তাদের সাক্ষ্য দানের জন্য ডাকা হ’লে অস্বীকার করা চলবে না। ঋণের দলীল লেখক ও সাক্ষীকে হয়রান-পেরেশান করা যাবে না। আবার সাক্ষ্য না দিয়ে তা গোপন করাও পাপের কাজ। মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কবীরা গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেন। বিচারক ও সাক্ষ্যদাতার জন্য ঘুষ গ্রহণ হারাম ও জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলা হয়েছে। আমরা যদি ইসলামের পুনর্জীবন ঘটাতে চাই তাহ’লে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ইনছাফ কায়েম করতে হবে। স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি, সম্প্রদায়প্রীতির নামে অবিচার করলে ইসলামের প্রতিই অবিচার করা হবে। মুসলিমদের হাতে ইনছাফ প্রতিষ্ঠিত হ’লে তার সুফল ব্যক্তি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সকলেই ভোগ করবে। অমুসলিমরাও দ্বীন ইসলামের ইনছাফে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণে এগিয়ে আসবে।
চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন ও দোষ-ত্রুটি পরিহার : ইসলামের বড় সৌন্দর্য চরিত্র। চরিত্র দুই প্রকার। সচ্চরিত্র ও অসচ্চরিত্র বা ভালো চরিত্র ও মন্দ চরিত্র। সচ্চরিত্র গ্রহণীয় ও অসচ্চরিত্র বর্জনীয়। কুরআন ও হাদীছে দু’প্রকার চরিত্রই গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে। সচ্চরিত্রের মাহাত্ম্য ও উপকারিতা এবং অসচ্চরিত্রের দুর্গতি ও অপকারিতা উভয়ই হাদীছে বলা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَكْمَلُ المُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا، وَخَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِنِسَائِهِمْ، ‘ঐ মুমিন ঈমানে পরিপূর্ণ, যার চরিত্র সর্বোৎকৃষ্ট। তোমাদের মধ্যে নিজ স্ত্রীদের সাথে যাদের ব্যবহার উত্তম তারাই শ্রেষ্ঠ।[2] তিনি বলেন, ‘ক্বিয়ামত দিবসে মুমিনের পাল্লায় সচ্চরিত্র থেকে ভারী আর কিছু হবে না। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ বেহায়া কটূভাষীকে ভালোবাসেন না। ঈমান থাকলে ভালো চরিত্রের দরুন মানুষ জান্নাতী হবে। পক্ষান্তরে ঈমান থাকলেও মন্দ চরিত্রের দরুন মানুষকে জাহান্নামী হ’তে হবে। মানুষের কথায়, আচার-আচরণে ও ভাব-ভঙ্গিতে চরিত্র ভালো না মন্দ তা ফুটে ওঠে। চরিত্র ভালো করার জন্য হাদীছে বহু তাকীদ এসেছে। হাদীছের প্রায় প্রত্যেক গ্রন্থে ‘কিতাবুল আদাব’ বা শিষ্টাচার অধ্যায় অথবা ‘কিতাবুল বিররি ওয়াচ্ছিলাহ’ বা ‘সদাচার ও আত্মীয়তা’ অধ্যায় নামে একটি অধ্যায় আছে। তাছাড়াও ‘রিক্বাক্ব’ বা হৃদয়ের কোমলতা নামে একটি অধ্যায় কোন কোন হাদীছ গ্রন্থে আছে। দরকার এগুলো অধ্যয়নের সাথে সাথে চরিত্রে তা রূপায়ন করা।
বস্ত্তত মানুষে মানুষে অসহিষ্ণুতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, শত্রুতা, হানাহানি, যুদ্ধ ইত্যাদির পিছনে সাধারণত অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্ষোভ, লোভ, দুর্নীতি, কপটতা, প্রতারণা, নিপীড়ন, শোষণ ইত্যাদি অসৎ গুণাবলী দায়ী। অপরদিকে মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করতে চাইলে দয়া, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, পরমত সহিষ্ণুতা, ন্যায়পরায়ণতা, পরোপকারিতা, পরার্থপরতা, সম্পদে-বিপদে সহযোগিতা ইত্যাদি সৎ গুণাবলীর বিকাশ আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ، وَلاَ تَحَسَّسُوا، وَلاَ تَجَسَّسُوا، وَلاَ تَحَاسَدُوا، وَلاَ تَدَابَرُوا، وَلاَ تَبَاغَضُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا، ‘তোমরা কুধারণা করা থেকে দূরে থাকো। কেননা কুধারণা করা জঘন্যতম মিথ্যা। তোমরা দোষ তালাশ করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, পরস্পর হিংসা পোষণ করো না, একে অপরের সাথে শত্রুতা করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না; বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে থাকো’।[3]
সমাজস্থ প্রতিটি মানুষের সাথে প্রতি পর্যায়ে ভালো আচরণ করলে, হাসিমুখে তাদের কাজ করে দিলে মানুষ তার চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হবে। এরূপ চরিত্রবান মানুষ নিজে যেমন ইসলামের উপর থাকতে পারবে তেমনি অন্যদেরও ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করতে পারবে। সুন্দর চরিত্রের মানুষ ষড়রিপু দমন ও গুণাহের পথ পরিহার করতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ।
অমুসলিমদের মাঝে দরদমাখা মন নিয়ে দ্বীন প্রচার : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সারা বিশ্বের মানুষের নবী। তিনি মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর অনুসারী প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব অমুসলিমদের নিকট দ্বীন প্রচার। আল্লাহ বলেন,قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي، ‘তুমি বল এটাই আমার পথ। আমি ও আমার অনুসারীগণ ডাকি আল্লাহর দিকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে’ (ইউসুফ ১২/১০৮)।
সুতরাং যারা মুসলিম তাদেরই কর্তব্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ধারায় অমুসলিমদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান। তিনি যেমন ভালোবেসে ধৈর্য ধরে অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতী কাজ চালিয়েছেন, আল্লাহর কাছে তাদের হেদায়াত চেয়ে দো‘আ করেছেন, তাদের ইসলাম গ্রহণের পর যথাসাধ্য আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দিয়েছেন, তাদের দ্বীন শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন, তেমনি তাঁর অনুসারী হিসাবে মুসলমানদেরও এসব কাজ করতে হবে।
একটা কথা স্মরণীয় যে, মানুষ বাপ-দাদা থেকে প্রাপ্ত নিজের ধর্মকে সহজে ত্যাগ করতে চায় না। আরব মুশরিকদের এহেন মানসিকতার কথা কুরআনে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। হিনদুদের ধর্মগ্রন্থ গীতায় বলা হয়েছে, ‘শ্রেয়ান স্বধর্ম বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরধর্ম ভয়াবহঃ’। অর্থাৎ স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হ’লেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট। স্বধর্ম সাধনে যদি মৃত্যু হয়, তাও মঙ্গলজনক, কিন্তু অন্যের ধর্মের অনুষ্ঠান করা বিপজ্জনক’। ইহূদী ও খৃষ্টানদেরও অধিকাংশ হক জানার পরও খোদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ঈমান আনতে রাযী হয়নি। সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরানের একটা বড় অংশে তাদের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। এখনও সে অবস্থার হেরফের হয়নি। কাজেই সহজে কেউ বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করতে চাইবে না। ইসলাম যে তাদেরও ধর্ম, আল্লাহ যে তাদেরও একমাত্র মা‘বূদ ও স্রষ্টা এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে তাদেরও রাসূল সে কথা তাদের ভালো করে বুঝাতে পারলে এবং বরাবর তাদের সঙ্গে লেগে থাকলে আল্লাহ পাকের দয়ায় তাদের হেদায়াত নছীব হ’তে পারে।
প্রায় প্রত্যেক ধর্মীয় গ্রন্থে আল্লাহর একত্ববাদ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ পরিচয় রয়েছে। বিকৃতি সত্ত্বেও তাতে এখনো কিছু সত্য রয়ে গেছে। সেগুলো তুলে ধরলে অনেকে সঠিক বুঝ পেতে পারে। রোগ-শোক, অভাব-অভিযোগ, পারিবারিক, সামাজিক ইত্যাদি সমস্যা অনেকের থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তাদের পাশে দাঁড়ালে সম্পর্ক নিবিড় হয়। সদাচরণের প্রভাব তাদের অন্তরে পড়া স্বাভাবিক। ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ, সাধু-সন্ত ও পাদ্রীদের ভোগ-বিলাস, শোষণ-নির্যাতন ও বিকৃত যৌনাচারের কথাও ক্ষেত্র বিশেষে তুলে ধরা যেতে পারে। যাহোক, হৃদয় জয় করার লক্ষ্যে কথা বলতে হবে, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ান যাবে না। দ্বীন প্রচারে ভূমিকা পালনের মধ্যে আত্মতৃপ্তি রয়েছে। আল্লাহর ওয়াস্তে ইসলামের জন্য কাজ করার আনন্দই আলাদা। কিন্তু সত্য এই যে, সক্রিয়ভাবে পরিকল্পনা মাফিক দ্বীন প্রচারে আমাদের কোন ভূমিকা বর্তমানে চোখে পড়ে না।
পরোপকার সাধন : পরোপকার ইসলামের মূল ভিত্তি বললে অত্যুক্তি হবে না। ছাহাবীগণ মক্কা ও মদীনার প্রাথমিক জীবনে বৈরী পরিবেশে যথাসাধ্য একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অত্যাচারিতদের সান্ত্বনা দিয়েছেন, শুশ্রূষা করেছেন। মিনা উপত্যকাস্থ বন্দিদশা সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করেছেন। হিজরতের পর মক্কা ও অন্যান্য এলাকার যারা হিজরত করে মদীনায় গিয়েছেন মদীনাবাসীগণ তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। নিজেদের সম্পত্তি ও টাকা-পয়সা তাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। ফলে বাস্ত্তত্যাগীদের নাম হয় মুহাজির এবং আশ্রয়দাতাদের নাম হয় আনছার। উপরন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন। এখানে পরোপকারের যে নযীর স্থাপিত হয় তার দৃষ্টান্ত মেলা ভার। শুধু এখানেই নয় বরং বরাবরের জন্য ইসলাম যে কোন ধরনের উপকার নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেছে। কুরআন ও হাদীছে এ সম্পর্কে বহু বর্ণনা এসেছে।
যাকাত, ওশর ফরয দান। ছাদাক্বাতুল ফিতর ওয়াজিব দান। এছাড়া নফল দান তো রাত দিন করার কথা রয়েছে। আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ سِرًّا وَعَلَانِيَةً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ، ‘যারা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে রাত্রে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৪)।
নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের উপর তাদের (মুহাজির ভাইদের) প্রাধান্য দেন। তারা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যয় করবে? তুমি বল, অতিরিক্ত সম্পদ। আল্লাহর নবী (ছাঃ) তো প্রত্যেক ধর্মের লোকদের মাঝে দান করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা সকল ধর্মের লোককে দান করো। অর্থ-সম্পদ উচ্চাঙ্গের দান। এতে সহজে মানুষের নানাবিধ প্রয়োজন মেটে। অর্থ বাদেও যে কোন প্রকার উপকার ও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হাদীছে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের পার্থিব কোন দুঃখ-কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্টসমূহ থেকে একটি দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন’।[4] যে ব্যক্তি পাওনা পরিশোধে কোন অভাবী হাত খাটো মানুষের প্রতি কোমল হবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার প্রতি কোমল হবেন। যে মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দাকে ততক্ষণ সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ সে তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় মানুষ সেই, যে মানুষের বেশী বেশী উপকার করে। আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কাজ এই যে, তুমি কোন মুসলিমের হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার করবে, অথবা তার থেকে কোন দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, অথবা তার একটা ঋণ পরিশোধ করবে, অথবা তার ক্ষুধা দূর করবে। আর অবশ্যই আমার এক ভাইয়ের কোন প্রয়োজনে তার সাথে হেঁটে যাওয়া আমার নিকট এই মসজিদে অর্থাৎ মদীনার মসজিদে এক মাস ই‘তিকাফ করা থেকে প্রিয়’।[5]
ঝড়, বন্যা, মহামারি, অগ্নিকান্ড, শৈত্যপ্রবাহ, তাপপ্রবাহ, দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা ইত্যাদি অবস্থায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে এসব আয়াত ও হাদীছ মুসলিমদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। জনগণকে অশিক্ষা-কুশিক্ষা থেকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং মানুষকে দ্বীনমুখী করার মতো পরোপকার দ্বিতীয়টি নেই। সমাজসেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও পরোপকারের অন্তর্ভুক্ত। খৃষ্টানরা তাদের ধর্মের প্রচার-প্রসারের জন্য নিজেদের আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংক প্রতি মাসে দান করে। তা দিয়ে মিশনারিরা দেশে দেশে মানব সেবার নামে খৃষ্টধর্ম প্রচার করে। আমাদের হাত উপুড় করার অভ্যাস বলতে গেলে নেই। দ্বীনের স্বার্থে আমাদেরও পরোপকারে এগিয়ে আসা যে কোন সময়ের থেকে বর্তমানে আরও বেশী যরূরী।
বিবিধ : বস্ত্তত আল্লাহ যে আছেন, আর তিনি একজনই, তাঁর দেওয়া নিয়ম-নীতি মেনেই বিশ্বজগৎ চলছে এবং মানব জাতির কল্যাণও কেবল তাঁর বিধান মেনে চলার মধ্যে নিহিত সে কথা অবধারিত সত্য। কুরআন, হাদীছ ও আল্লাহর অস্তিত্ব বিষয়ক মনীষীদের রচিত বই-পুস্তক পড়লে এ উপলব্ধি ভালোমতো জাগ্রত হবে। মানুষ সৃষ্টির কুরআনিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানতে ও বুঝতে পারলে এবং বিবর্তনবাদের ভ্রান্তি অপনোদিত হ’লে ইসলাম ও তাওহীদের সত্যতা সকলের চোখে উন্মোচিত হবে। সেক্ষেত্রে সত্য গ্রহণের মানসিকতা থাকলে আল্লাহর রহমতে সত্য দ্বীনের অনুসারী হওয়াও অসম্ভব নয়। বস্ত্তত আল-কুরআনে বিশ্ব সৃষ্টি ও মানব সৃষ্টি সংক্রান্ত অনেক আয়াত আছে। নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাবমূলক আয়াতও রয়েছে প্রচুর। পুনরুত্থান বা ক্বিয়ামত প্রসঙ্গে বৃষ্টির পানিতে ফসল উৎপাদন ও বৃক্ষ জন্মানোর উদাহরণ এসেছে। আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণে এ জাতীয় আয়াত জ্ঞাণী-গুণী লোকদের জন্য অবশ্যই গবেষণার খোরাক হ’তে পারে। কুরআনও বারবার সে আহবান জানিয়েছে।
শেষ কথা : মুসলিম সমাজ বর্তমানে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে শিথিলতা তনমধ্যে অন্যতম। এ শিথিলতার পিছনে যেসব কারণ এখানে তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো ছাড়াও অবশ্যই আরও কারণ রয়েছে। আবার অনেকের নিকট উল্লিখিত কোন কোন কারণ যথার্থ মনে নাও হ’তে পারে। তবে বিষয়ের গুরুত্ব নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন। অধমের ইচ্ছা, আমরা যেন কারণগুলো পর্যালোচনা করি, তা থেকে উদ্ধার পেতে সম্মিলিত প্রয়াস গ্রহণ করি এবং আমাদের যোগ্য লোকেরা এ বিষয়ে লেখনী ও আলোচনা নিয়ে এগিয়ে আসি। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে শিথিলতা কাটিয়ে আমরা যেন আমাদের ঈমান ও বিশ্বাসকে কুরআন ও সুন্নাহর মানদন্ডে মযবূত করতে পারি। আমাদের এসব ইচ্ছা ফলপ্রসূ করার তাওফীক্ব ও সামর্থ্যদাতা কেবল মাত্র মহান আল্লাহ।
[1]. আবু দাউদ হা/৪৮৮১; মিশকাত হা/৩০; ছহীহাহ হা/৩৮০।
[2]. তিরমিযী হা/১১৬২।
[3]. বুখারী হা/৬০৬৪।
[4]. মুসলিম হা/২৬৯৯।
[5]. ছহীহাহ হা/৯০৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৬।