আত্মসমর্পণ একটি সর্বজনবিদিত ও পরিচিত শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হ’ল সম্পূর্ণরূপে অন্যের কাছে নতি স্বীকার করা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে আল্লাহর নিকট নিজেকে সমর্পণ করা বা উৎসর্গ করা। অবশ্য উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, তাদের মৌলিক অর্থ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মোটামুটি সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে আত্মসমর্পণের প্রথম অর্থ নতি স্বীকার সম্পূর্ণরূপে পার্থিব জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে এর কার্যক্রম স্পষ্টতঃই সীমাবদ্ধ। পৃথিবীর প্রাচীন জ্ঞানী-গুণী পন্ডিতগণ তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল হ’তে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াকে শান্তি ও মীমাংসার প্রয়াসে  আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করেন। এর ফলশ্রুতিতেই পৃথিবীর বুকে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক রক্তক্ষয় অপেক্ষাকৃত হ্রাস পায় এবং সন্ধি-চুক্তির পথ সহজতর হয়। এর ফলে সাধারণত দুর্বলরা সবল বা শক্তিশালীদের অধীনস্থ থেকে কালাতিপাত করে। এমনকি কোন কোন সময় সমঝোতার অভাবে বা একে অন্যের ভুল বোঝাবুঝির এক পর্যায়ে প্রচন্ড যুদ্ধ-বিগ্রহ বেধে যায় এবং শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী দলের নিকট দুর্বল দল আত্মসমর্পণ করে। এ প্রক্রিয়ায় দুর্বল বা অত্যাসন্ন পরাজিত দল আত্মরক্ষার মানসে বিজয়ী দলের সম্মুখে প্রকাশ্যভাবে দু’হস্ত উত্তোলনপূর্বক সর্বান্তকরণে আত্মসমর্পণ করে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে চরম উত্তেজনার বিশাল রণক্ষেত্রে শান্তির ছায়া নেমে আসে। এতদসঙ্গে স্তব্ধ হয় শত্রুতার যাবতীয় কলা-কৌশল ও প্রতিহিংসার নির্মম ছোবল। শান্তির প্রয়াসে শুরু হয়ে যায় মানবিক আচরণবিধির প্রয়োগ ও তার উত্তম বাস্তবায়ন।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে আত্মসমর্পণের অর্থ হচ্ছে এক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টা ও মা‘বূদ মহান আল্লাহর পদতলে নিজেকে অকৃত্রিমভাবে বিলিয়ে দেয়া। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উৎসের সন্ধানে গবেষণা চালালে, সৃষ্টির গোড়াতেই তার সূচনার প্রমাণ পাওয়া যাবে। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সকল সৃষ্ট বস্ত্তকে আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ায় আবদ্ধ করার লক্ষ্যে, তাঁর প্রিয় সৃষ্টি আদম (আঃ)-কে সিজদা করার জন্য ফেরেশতা মন্ডলীকে আদেশ করেন এবং তাঁর আদেশে আত্মসমর্পণ করে সকল ফেরেশতাই সিজদা করেন। কিন্তু ইবলীস সিজদা করল না। অর্থাৎ সে আত্মসমর্পণ না করে আল্লাহর আদেশ অমান্য করল। আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে ইবলীস তার ব্যক্তিগত পান্ডিত্যের অহংকারে উক্ত প্রক্রিয়ার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে। কালের চক্রে তা বহু রূপধারণ করে এবং অসংখ্য কৃত্রিমতার সংযোজন ঘটায়। আলোচ্য প্রবন্ধে বিষয়বস্ত্তর অনুকূল ও প্রতিকূল বিষয়াদির সম্ভাব্য আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

আমরা  অবগত  আছি যে,  সৃষ্টির  শ্রেষ্ঠ মানব জাতির জন্যই আত্মসমর্পণ প্রণালীর উদ্ভব ঘটান হয়েছে। যদিও মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে তা মহাপরীক্ষারূপে প্রবর্তিত হয় এবং পরে তা সমগ্র মানব জাতির প্রতি আদেশরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেহেতু আমাদের জ্ঞানে আত্মসমর্পণ হ’ল মানব জাতির জন্য এক আল্লাহর প্রতি আত্মার ও সমুদয় দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিনীত, নত, অবনত, সিজদাবনত সহ যে কোন অনুগত অবস্থার বাস্তব অবয়ব। আত্মসমর্পণের একটি অন্যতম পন্থা হচ্ছে আল্লাহর সকাশে নতজানু হয়ে বিনীতভাবে লুটিয়ে পড়া বা সিজদা করা। মানুষ ও জিন সহ পৃথিবীর ও আকাশের সবকিছুই মহান আল্লাহর সম্মুখে সিজদাবনত হয়। এ বিষয়ে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে সবিস্তার আলোচনা পেশ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, وَللهِ يَسْجُدُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مِنْ دَآبَّةٍ وَّالْمَلآئِكَةُ وَهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُوْنَ. ‘আকাশ ও পৃথিবীর সকল বিচরণশীল জীব ও ফেরেশতাগণ আল্লাহকে সিজদা (আত্মসমর্পণ) করে, তারা অহংকার করে না’ (নাহল ৪৯)। একই মর্মার্থে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَللهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ طَوْعًا وَّكَرْهًا وَظِلاَلُهُم بِالْغُدُوِّ وَالآصَالِ. ‘আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে আছে ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় এবং তাদের প্রতিছায়াও সকাল-সন্ধ্যায়’ (রা‘দ ১৫)

মহানবী (ছাঃ)-কে সম্বোধন করে প্রত্যাদেশ করা হয় যে,

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُوْمُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيْرٌ مِّنَ النَّاسِ وَكَثِيْرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ وَمَنْ يُّهِنِ اللهُ فَمَا لَهُ مِن مُّكْرِمٍ إِنَّ اللهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ.

‘আপনি কি দেখেননি যে, আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও যা কিছু আছে ভূমন্ডলে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ। আর অনেকের উপর অবধারিত হয়েছে শাস্তি। আল্লাহ যাকে  লাঞ্ছিত করেন, তাকে কেউ সম্মান দিতে পারে না। আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন’ (হজ্জ ১৮)

উপরোক্ত আয়াত তিনটি দ্বারা মহিমাময় আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সৃষ্টি জগতের আত্মসমর্পণের ব্যাখ্যা প্রতিভাত হয়েছে। এখানে কেউ উক্ত প্রক্রিয়ার বহির্ভূত নয়। কিন্তু শেষোক্ত আয়াতে মানুষের একটা দলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অপর একটা দলকে বাদ দেয়া হয়েছে। এর কারণ হিসাবে ইবলীস-এর প্ররোচনাই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে ইবলীসের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করার প্রয়াসে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার বুকে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা সবাই এ নশ্বর জগতের অনেক অবুঝ, অবোধ ও পথহারা মানুষকে আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ ও নিজেদের আদর্শ দ্বারা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের দিকে ধাবিত করতে সমর্থ হয়েছেন। আবার কখনো অনেক মানুষ তাঁদের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যারা নবী-রাসূলগণের অনুসরণে আত্মসমর্পণ করেছে তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে এবং পরকালে তাদের জন্যই রয়েছে নাজাত ও পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত।

মানুষকে হেদায়াত দিতে ও আত্মসমর্পণে অনুপ্রাণিত করতে আল-কুরআন নাযিল হয়েছে। এখানে আল্লাহ সাধারণ মানুষকে ও রাসূলকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ হওয়ার এবং আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন,

 قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّيْنَ، وَأُمِرْتُ لِأَنْ أَكُوْنَ أَوَّلَ الْمُسْلِمِيْنَ، قُلْ إِنِّيْ أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّيْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيْمٍ-

‘বলুন, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি। আরও আদিষ্ট হয়েছি, সর্বপ্রথম আত্মসমর্পণকারী হওয়ার জন্য। বলুন, আমি আমার পালনকর্তার অবাধ্য হ’লে এক মহাদিবসের শাস্তির ভয় করি’ (যুমার ১১-১৩)

অন্যত্র তিনি বলেন,

قُلْ أَغَيْرَ اللهِ أَتَّخِذُ وَلِيًّا فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَهُوَ يُطْعِمُ وَلاَ يُطْعَمُ قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَكُوْنَ أَوَّلَ مَنْ أَسْلَمَ وَلاَ تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُشْرِكَيْنَ-

‘আপনি বলে দিন, আমি কি আল্লাহ ব্যতীত যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা এবং যিনি সবাইকে আহার্য দান করেন ও তাঁকে কেউ আহার্য দান করে না, অপরকে সাহায্যকারী স্থির করব? আপনি বলে দিন, আমি আদিষ্ট হয়েছি যে, সর্বাগ্রে আমিই আত্মসমর্পণকারী হব। আপনি কদাচ অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’ (আন‘আম ১৪)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ- لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَاْ أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ- ‘আপনি বলুন, আমার ছালাত, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব পালনকর্তা আল্লাহরই জন্য। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম’ (আন‘আম ১৬২-১৬৩)

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসাবে অমর হয়ে আছেন। তাঁর অনুপম চরিত্র, সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা-চেতনা, ন্যায়পরায়ণতা, দূরদর্শিতা ইত্যাদি তাঁকে পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত করেছে। অতঃপর একই কারণে তিনি শ্রেষ্ঠ আল্লাহ ভীরুরূপেও বিশ্বনিয়ন্তার দরবারে মর্যাদা বা সম্মান লাভ করেন। তাঁর অভূতপূর্ব আল্লাহভীতি তাঁকে সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মসমর্পণকারীর স্থলাভিষিক্ত করেছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা এই মহানবী (ছাঃ)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার জন্য পৃথিবীবাসীকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় বান্দাগণকেও একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণের জন্য পুনঃপুনঃ আহবান জানিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوْتُنَّ إِلاَّ وَأَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ.

‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না’ (আলে ইমরান ১০২)। ঈমানদারগণের অনুকূলে ও সন্দেহ পোষণাকারীদের সংশোধনের প্রয়াসে পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা মহানবী (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন যে,

فَإنْ حَآجُّوْكَ فَقُلْ أَسْلَمْتُ وَجْهِيَ لِلّهِ وَمَنِ اتَّبَعَنِ وَقُل لِّلَّذِيْنَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ وَالأُمِّيِّيْنَ أَأَسْلَمْتُمْ فَإِنْ أَسْلَمُوْا فَقَدِ اهْتَدَواْ وَّإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلاَغُ وَاللهُ بَصِيْرٌ بِالْعِبَادِ.

‘যদি তারা আপনার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় তবে বলে দিন, আমি এবং আমার অনুসারীগণ আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেছি। আর আহলে কিতাবদের এবং নিরক্ষরদের বলে দিন, তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ? তখন যদি তারা আত্মসমর্পণ করে, তবে নিশ্চয়ই তারা সরল পথ প্রাপ্ত হ’ল, আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে তোমার দায়িত্ব হ’ল শুধু পৌঁছে দেয়া। আর আল্লাহ বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা’ (আলে ইমরান ২০)

পার্থিব জগতের প্রতি অবহেলা পোষণকারী এবং আখেরাতের প্রতি যত্নশীল ব্যক্তিগণই মূলতঃ অকৃত্রিম আত্মসমর্পণকারী হয়ে থাকে। এ সকল ঈমানদারগণের পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِيْنَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِيْنَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِيْنَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِيْنَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِيْنَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِيْنَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِيْنَ فُرُوْجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِيْنَ اللهَ كَثِيْراً وَّالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَّأَجْراً عَظِيْماً.

‘অবশ্যই আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, ছিয়াম পালনকারী পুরুষ ও ছিয়াম পালনকারী নারী, লজ্জাস্থান হেফাযতকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থান হেফাযতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্ত্তত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার’ (আহযাব ৩৫)

আল্লাহর মহাক্ষমতা দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছুর উপর বিদ্যমান এবং তাঁর জ্ঞান সব জিনিসকেই পরিব্যাপ্ত করে রয়েছে। তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানব সম্প্রদায়কে সদা প্রস্ত্তত থাকতে হয়। এজন্য অসংখ্য প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ড রয়েছে। আলোচিত আত্মসমর্পণ তন্মধ্যে অন্যতম। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

قَالَتِ الْأَعْرَابُ آمَنَّا قُل لَّمْ تُؤْمِنُوْا وَلَكِنْ قُوْلُوْا أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ الْإِيْمَانُ فِيْ قُلُوْبِكُمْ وَإِنْ تُطِيْعُوْا اللهَ وَرَسُوْلَهُ لاَ يَلِتْكُمْ مِّنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئاً إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ.

‘আরববাসীগণ বলে, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। বলুন, তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করনি, বরং বল, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। এখনও তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি। যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তবে তোমাদের কর্ম বিন্দুমাত্রও নিষ্ফল করা হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ১৪)

আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে সর্বাধিক ভালবাসেন। এ ভালবাসার কোন তুলনা নেই। আর আল্লাহ মানুষের মধ্যে তাদেরকে অধিক ভালবাসেন, যারা তাঁর নিকটে আত্মসর্পণ করে, তাঁর বিধানকে অবনত মস্তকে মেনে নেয় এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়। এসব মানুষের কল্যাণে বহু আয়াতের অবতারণা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 وَأَنِيْبُوْا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوْا لَهُ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَّأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لاَ تُنْصَرُوْنَ.

‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ কর, তোমাদের নিকট শাস্তি আসার পূর্বে। এরপর তোমারে কে সাহায্য করা হবে না’ (যুমার ৫৪)

মূলতঃ পবিত্র কুরআনের সকল বাণী আল্লাহর তা‘আলার আহবান। এখানে কোন বিকল্প চিন্তার সুযোগ নেই। মানুষকে শুধু আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করানো ও তাঁর নিকটে নত হওয়াই তাঁর কাম্য। আর অকৃত্রিম আত্মসমর্পণকারীই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে।

প্রকৃত ও যথার্থ আত্মসমর্পণের জন্য দ্বীনী ইলম যরূরী। এজন্য কুরআন ও হাদীছের সঠিক জ্ঞানার্জন করতে হবে। মানুষকে এ জ্ঞান দানের জন্যই কুরআনের অবতরণ। এ উম্মতের ন্যায় অন্যান্য জাতিকেও জ্ঞান দানের জন্য কিতাব দেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে পুবত্র কুরআনে বলা হয়েছে,

الَّذِيْنَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِهِ هُمْ بِهِ يُؤْمِنُوْنَ، وَإِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ قَالُوْا آمَنَّا بِهِ إِنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّنَا إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلِهِ مُسْلِمِيْنَ-

‘এর (কুরআনের) পূর্বে আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছিলাম, তারা এতে বিশ্বাস করে। যখন তাদের কাছে এটা পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। এটা আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত সত্য। আমরা এর পূর্বেও আত্মসমর্পণকারী ছিলাম’ (ক্বাছাছ ৫২-৫৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, حم، عسق، كَذَلِكَ يُوْحِيْ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ اللهُ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ. ‘হা-মীম, আইন, সীন, ক্বাফ। এমনিভাবে পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ আপনার প্রতি ও আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি অহি প্রেরণ করেন’ (শূরা ১-৩)

তিনি আরো বলেন, إِنَّا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ كَمَا أَوْحَيْنَا إِلَى نُوْحٍ وَّالنَّبِيِّيْنَ مِنْ بَعْدِهِ، ‘আমি আপনার প্রতি অহি পাঠিয়েছি, যেমন করে অহি পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং সে সমস্ত নবী-রাসূলের প্রতি যাঁরা তাঁর পরে প্রেরিত হয়েছেন’ (নিসা ১৬৩)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَلَقَدْ آتَيْنَا مُوْسَى الْكِتَابَ وَقَفَّيْنَا مِنْ بَعْدِهِ بِالرُّسُلِ- ‘অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তারপরে পর্যায়ক্রমে রাসূল পাঠিয়েছি’ (বাক্বারাহ ৮৭)

নবী-রাসূলগণের মত সাধারণ মানুষের কাছেও কখনও কখনও আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ إِلاَّ رِجَالاً نُّوْحِيْ إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُواْ أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ- ‘আপনার পূর্বে আমি অনেক মানুষ প্রেরণ করেছি, যাদের কাছে আমি অহি পাঠাতাম। অতএব তোমরা যদি না জান, তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর’ (আম্বিয়া ৭)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলার একত্ব, মহত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, দয়া, রহমত, ক্ষমা, আদেশ-নিষেধ, উপদেশ, পুরস্কার-শাস্তি ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়ের বর্ণনা ঘুরে ফিরে নানাভাবে নানা পর্যায়ে উল্লেখিত হয়েছে। আত্মসমর্পণ সম্পর্কেও বহু আয়াতের অবতারণা হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, মানুষের মত জিনরাও আল্লাহর সৃষ্টি। তারাও আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে ও আল্লাহর ইবাদত করে। পবিত্র কুরআনে জিনদের এই আত্মসমর্পণ কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় কতিপয় জিন ঘটনাক্রমে একদিন তাদের যাত্রাপথে ছালাত আদায়রত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনতে পায়। অতঃপর তারা মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ করে এবং বিগলিত চিত্তে ঘরে ফিরে এসে নিজেদের মধ্যে তা উত্তমরূপে উপস্থাপন করে। তারা রাসূলের প্রতি ঈমান আনে এবং আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদের এই আত্মসমর্পণে সন্তুষ্ট হয়ে বিষয়টি উম্মতে মুহাম্মাদীর হেদায়াত কল্পে অহিরূপে অবতীর্ণ করেন। নিম্নবর্ণিত আয়াতে জিনদের কথোপকথনই প্রতিধ্বনিত হয়েছে,

وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدَى آمَنَّا بِهِ فَمَنْ يُّؤْمِنْ بِرَبِّهِ فَلَا يَخَافُ بَخْساً وَّلاَ رَهَقاً، وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُوْنَ وَمِنَّا الْقَاسِطُوْنَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُوْلَئِكَ تَحَرَّوْا رَشَداً، وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَباً-

‘আমরা যখন সুপথের নির্দেশ শুনলাম, তখন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব যে তার পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তার কোন ক্ষতি ও অন্যায়ের আশংকা করে না। আমাদের কিছু সংখ্যক আত্মসমর্পণকারী এবং কিছু সংখ্যক  সীমালংঘনকারী; যারা আত্মসমর্পণকারী হয়, তারা সুচিন্তিত ভাবে সৎপথ বেছে নিয়েছে’ (জিন ১৩-১৫)

আল্লাহর অসীম রাজত্বে অগণনীয় আজ্ঞাবহ সৃষ্টি রয়েছে। যারা অহর্নিশি আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ আকাশের বুকে নানাজাতীয় পাখী এক স্থান হ’তে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে বেড়ায়। তারাও স্রষ্টার ইবাদতে নিয়োজিত। মানুষ তাদের আসল অবস্থা ওয়াকিফহাল নয়। মানুষের অবগতিকল্পে এ বিষয়েও মহান আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন,

 أَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِيْ جَوِّ السَّمَاءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلاَّ اللهُ إِنَّ فِيْ ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ-

‘তারা কি উড়ন্ত পাখীকে দেখে না? এগুলো আকাশের অন্তরীক্ষে আত্মসমর্পণকারী হয়ে রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া কেউ এগুলোকে আগলে রাখে না। নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে’ (নাহল ৭৯)

এ আয়াতে উড়ন্ত পাখীর কথা বলা হ’লেও বিশ্বজগতের সকল পাখী এর অন্তর্ভুক্ত। শুধু পাখী নয়, অন্যান্য অসংখ্য পশু, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা, তৃণলতা, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, নদ-নদী, বন-জঙ্গল ইত্যাদিও আল্লাহর ভয়ে  আত্মসমর্পণকারী হয়ে রয়েছে। এগুলোর কোনটিরই সংখ্যা মানুষের সংখ্যা অপেক্ষা কম হবে না। এত অগণিত সৃষ্ট বস্ত্তর আত্মসমর্পণ সমগ্র মানব জাতির জন্য নিঃসন্দেহে বিষ্ময়ের বিষয়। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের জন্য পরকালীন জগতে মুক্তির অভিন্ন লক্ষ্যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ইহজগতের বিভিন্ন গঠনমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন এবং ভিত্তিহীন কর্মের প্রত্যাখান আবশ্যক।

এক নির্ধারিত সময়ে আল্লাহর হুকুমে বিশ্বজগত সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং যাবতীয় সৃষ্টি জীব মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর কিছুকাল পর পুনরায় জীবিত হয়ে পরকালে ক্বিয়ামতের মাঠে সমবেত হবে। ক্বিয়ামত হবে একটা কঠিন দিবস, যার ভয়াবহতা বর্ণনা করা অসম্ভব। ঐ দিনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সকল মানব সম্প্রদায়কে ভীত-সন্ত্রস্ত, নত, বিনীত ও আত্মসমর্পণকারী করে তুলবে। তবে যারা পৃথিবীতে আত্মসমর্পণকারী ছিল, তারা আল্লাহর দয়ায় নিরাপদে আরশের ছায়াতলে অবস্থান করবে। পক্ষান্তরে যারা এ পার্থিব জগতে আত্মসমর্পণকারী হয়নি, তারা চরম বিপদ ও আতঙ্কে আযাবের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। তখন তারা সবাই আত্মসমর্পণকারী বনে যাবে, কিন্তু তা গৃহীত হবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَلْقَوْاْ إِلَى اللهِ يَوْمَئِذٍ السَّلَمَ وَضَلَّ عَنْهُم مَّا كَانُوْا يَفْتَرُوْنَ- ‘সেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) তারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং তারা যে মিথ্যা অপবাদ দিত তা বিস্মৃত হবে’ (নাহল ৮৭)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,  إِنَّ اللهَ هُوَ رَبِّيْ وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوْهُ هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيْمٌ، فَاخْتَلَفَ الْأَحْزَابُ مِنْ بَيْنِهِمْ فَوَيْلٌ لِّلَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مِنْ عَذَابِ يَوْمٍ أَلِيْمٍ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহই আমার পালনকর্তা ও তোমাদেরও পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। এটাই সরল পথ। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন দল মতভেদ সৃষ্টি করল। সুতরাং যালেমদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক দিবসের আযাব’ (যুখরুক ৬৪-৬৫)

পবিত্র কুরআনে অবিশ্বাসী ও উদ্ধতদের শাস্তি ও আযাবের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি বিশ্বাসী ও আল্লাহভীরুদের সুসংবাদও একইভাবে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,

الْأَخِلاَّءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِيْنَ، يَا عِبَادِ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُوْنَ، الَّذِيْنَ آمَنُوْا بِآيَاتِنَا وَكَانُوْا مُسْلِمِيْنَ، ادْخُلُوا الْجَنَّةَ أَنْتُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ تُحْبَرُوْنَ-

‘বন্ধুবর্গ সেদিন একে অপরের শত্রু হবে মুত্তাক্বীগণ ব্যতীত। হে আমার বান্দাগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিতও হবে না, যারা আমার আয়াতসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলে এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী ছিলে। জান্নাতে প্রবেশ কর তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীগণ সানন্দে’ (যুখরুফ ৬৭-৭০)

অন্যত্র তিনি বলেন, إِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ، أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِيْنَ كَالْمُجْرِمِيْنَ- ‘মুত্তাক্বীদের জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে নে‘মতপূর্ণ জান্নাত। আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের ন্যায় গণ্য করব?’ (কলম ৩৪-৩৫)

মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী এবং নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের মধ্যে সর্বাধিক ক্ষমতার দাবীদার। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাও মানুষকে সৃষ্টির সেরা প্রাণী ও প্রতিনিধি হিসাবে সৃষ্টি করে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। অতঃপর মানুষকে তাঁর আদেশ-নির্দেশমত সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভের পরও মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় অনেক ভুল কাজ করে। শয়তানের প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে যারা ভাল কাজ করে এবং আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী হয় তারাই সফলকাম হবে।

ক্বিয়ামতের দিন মানুষের সঙ্গে তাদের একমাত্র পালনকর্তা ও মা‘বূদ আল্লাহর সাক্ষাৎ ও কথোপকথন হবে। সে সময় তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারীরা নিষ্কৃতি লাভ করে উৎফুল্লভাবে জান্নাতে চলে যাবে। আর যারা আত্মসমর্পণকারী নয় তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَ يَسْتَطِيْعُوْنَ، خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ تَرْهَقُهُمْ ذِلَّةٌ وَقَدْ كَانُوْا يُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ وَهُمْ سَالِمُوْنَ، فَذَرْنِيْ وَمَنْ يُّكَذِّبُ بِهَذَا الْحَدِيْثِ سَنَسْتَدْرِجُهُم مِّنْ حَيْثُ لاَ يَعْلَمُوْنَ-

‘স্মরণ কর সে দিনের (ক্বিয়ামতের) কথা, যেদিন পায়ের গোছা উম্মোচন করা হবে, সেদিন তাদেরকে সিজদা করতে আহবান জানানো হবে। অতঃপর তারা সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি অবনত থাকবে, তারা লাঞ্ছনাগ্রস্ত হবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিল, তখন তাদেরকে সিজদা করতে আহবান জানানো হ’ত। অতএব যারা এই কালামকে মিথ্যা বলে তাদেরকে আমার হাতে ছেড়ে দিন, আমি এমন ধীরে ধীরে তাদেরকে ধরব যে, তারা জানতে পারবে না’ (কলম ৪২-৪৪)

এখানে পরকালীন শাস্তি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক ও সজাগ করার লক্ষ্যে একটি হাদীছ পেশ করা হ’ল। আবু ওয়ায়েল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উসামাকে বলা হ’ল, আপনি কেন এ ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলছেন না? তিনি বললেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বলেছি। তবে এতটুকু বলিনি যাতে ফিতনা সৃষ্টির প্রথম উদ্যোক্তা আমি হই। কোন ব্যক্তি দুই বা ততোধিক ব্যক্তির আমীর নির্বাচিত হয়েছে এমন ব্যক্তিকেও আমি ‘আপনি ভাল’ একথা বলতে রাযী নই। কেননা আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ক্বিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে, অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং গাধা চক্রাকারে ঘুরে যেমন গম পিষে তেমনিভাবে তাকে দোযখে পিষ্ট করা হবে (শাস্তি দেয়া হবে)। অতঃপর (তার ভীষণ শাস্তি দেখে) জাহান্নামবাসীরা তার চতুষ্পাশের্ব জড়ো হয়ে জিজ্ঞেস করবে, হে অমুক! তুমি কি আমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করতে না? (তোমার এ অবস্থা কেন?) সে বলবে, আমি তো ভাল কাজের আদেশ করতাম, কিন্তু নিজে তা করতাম না। আর মন্দ কাজের নিষেধ করতাম। কিন্তু আমি নিজেই মন্দকাজ করতাম’ (বুখারী)

পরিশেষে আমরা সকলের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাতে চাই যে, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার জন্য দ্বীন ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি ও ভালবাসায় আবদ্ধ হ’তে চাইলে, সর্বপ্রথম এক আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক আত্মসমর্পণ করতে হবে। কারণ খাঁটি ঈমানদার ও মুমিন হওয়ার জন্য আত্মসমর্পণের কোন বিকল্প নেই। তাই আসুন! জীবনের সকল ভুল-ভ্রান্তি পরিহার করে এক আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন- আমীন!

রফীক আহমাদ

শিক্ষক (অবঃ), বিরামপুর, দিনাজপুর।






সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দুই প্রধান কারণ (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
করোনার নববী চিকিৎসা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আলেমে দ্বীনের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
যাকাত সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত (৪র্থ কিস্তি) - মুযাফফর বিন মুহসিন
কুরবানীর মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (তৃতীয় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ওযূতে ঘাড় মাসাহ করা সুন্নাত নাকি বিদ‘আত
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
লাইলাতুল মি‘রাজ রজনীতে করণীয় ও বর্জনীয় - আত-তাহরীক ডেস্ক
মুহাররম ও আশূরা : করণীয় ও বর্জনীয় - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
দো‘আর আদব বা শিষ্টাচার সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু শয়তান (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আরও
আরও
.