পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।

কোন মানুষকে প্রকৃত ঈমানদার হ’তে হ’লে তিনটি ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক (একক) বলে বিশ্বাস করতে হবে। (১) তাওহীদুর রুবূবিয়াহ (সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও পরিচালক হিসাবে আল্লাহকে একক মানা), (২) তাওহীদুল ইবাদাহ (ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক মানা) ও (৩) তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত (আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে এক মানা)।

ইহুদী, খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ যাদেরকে আমরা কাফের সাব্যস্ত করি তারাও আল্লাহকে বিশ্বাস করে। কিন্তু তাদের বিশ্বাস শুধুমাত্র তাওহীদুর রুবূবিয়াতের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ তারাও আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, সকল কিছুর মালিক এবং সব কিছুর পরিচালক হিসাবে বিশ্বাস করে। কিন্তু তারা বাকী দুই প্রকার তাওহীদে বিশ্বাসী নয়। বিশেষ করে তাওহীদুল ইবাদাহ-এর ক্ষেত্রে তারা আল্লাহকে এক (একক) মানতে পারেনি। অথচ তা প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন এবং আসমানী কিতাব সমূহ নাযিল করেছেন। তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে বিভিন্ন কিছুকে শরীক করেছে। তারা কেউ মূর্তিপূজার মাধ্যমে আললাহর নৈকট্য হাছিল করতে চাচ্ছে, আবার কেউ শিবলিঙ্গ পূজা, গাছ পূজা, গরুর পূজা ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করতে চাচ্ছে। আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُوْنَا إِلَى اللهِ زُلْفَى- ‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, (তারা বলে) আমরা তো এদের পূজা এজন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছিয়ে দিবে’ (যুমার ৩৯/৩)

কাফেরেরা যেমন বিভিন্ন কিছুকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করে তাদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করতে চাচ্ছে, তেমনি অধিকাংশ মুসলমানও আজ কাফেরদের ঈমানের সাদৃশ্য অবলম্বন করে পীর ও কবরকে অসীলা বানিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য হাছিল করতে চাচ্ছে। কাফেরেরা যেমন বিশ্বাস করে দুর্গাপূজা না করলে স্বর্গে যাওয়া যাবে না, মুসলমানরাও তেমনি বিশ্বাস করে দর্গা (মাযার) পূজা না করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না। কাফেরেরা যেমন দেবতার সামনে মাথা নুইয়ে প্রণাম করাকে পুণ্যের কাজ মনে করে, মুসলামানরা তেমনি কবরে সিজদা করা ও পীর বাবার পায়ে সিজদা করা, চুমু খাওয়াকে নেকীর কাজ মনে করে। কাফেরেরা যেমন বিশ্বাস করে দেবতাকে খুশি করতে না পারলে অমঙ্গল হবে; মুসলমানরাও তেমনি বিশ্বাস করে পীর বাবাকে খুশি করতে না পারলে  অমঙ্গল হবে।  আর  তাইতো  পীর  বাবাকে খুশি করার জন্য অনেক মানুষ তার বহু কষ্টে উপার্জিত সম্পদ পীর বাবার হাতে তুলে দিতে মোটেই দ্বিধাবোধ করে না। কাফেরেরা যেমন বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতার কাছে যায়; মুসলমানরাও তেমনি বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মৃত ও জীবিত পীরের কাছে যায়। কাফেরেরা যেমন রোগমুক্তির জন্য তাদের দেবতার কাছে যায়; মুসলমানরা তেমনি রোগমুক্তির জন্য বিভিন্ন বাবার কাছে যায়। নিজেকে মুসলিম দাবী করেও আমাদের কর্ম ও বিশ্বাস যদি এরূপ হয় তাহ’লে কাফেরদের সাথে আমাদের ঈমানের পার্থক্য থাকল কোথায়? আমরা নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করি, অথচ আমাদের সার্বিক জীবন পরিচালনার মানদন্ড কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ খুলে তার সাথে মিলিয়ে দেখি না কেন? যেখানে কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহকে ডাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُوْنِيْ أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِيْنَ يَسْتَكْبِرُوْنَ عَنْ عِبَادَتِيْ سَيَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دَاخِرِيْنَ- ‘আর তোমাদের রব বলেছেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই যারা অহঙ্কারবশতঃ আমার ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (গাফের ৪০/৬০)। তিনি অন্যত্র বলেন,

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِيْ عَنِّيْ فَإِنِّيْ قَرِيْبٌ أُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لِيْ وَلْيُؤْمِنُوْا بِيْ لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُوْنَ-

‘আর যখন আমার বান্দা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করে (তখন তাদেরকে বলে দাও), নিশ্চয়ই আমি সন্নিকটবর্তী। কোন আহবানকারী যখনই আমাকে আহবান করে তখনই আমি তার আহবানে সাড়া দেই। সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে। তাহ’লেই তারা সুপথপ্রাপ্ত হ’তে পারবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৬)। তিনি অন্যত্র বলেন, وَلَا تَدْعُ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِيْنَ- ‘আর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও ডাকবে না, যা তোমার কোন উপকারও করতে পারে না, কোন ক্ষতিও করতে পারে না। বস্ত্ততঃ যদি এরূপ কর তাহ’লে তুমি এমতাবস্থায় যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (ইউনুস ১০/১০৬)। তিনি অন্যত্র বলেন,

إِنْ تَدْعُوْهُمْ لَا يَسْمَعُوْا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوْا مَا اسْتَجَابُوْا لَكُمْ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُوْنَ بِشِرْكِكُمْ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيْرٍ-

‘তোমরা তাদেরকে আহবান করলে তারা তোমাদের আহবান শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের আহবানে সাড়া দিবে না। তোমরা তাদেরকে যে শরীক করেছ তা তারা ক্বিয়ামত দিবসে অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞের (আল্লাহর) ন্যায় কেউই তোমাকে অবহিত করতে পারে না’ (ফাতির ৩৫/১৪)। তিনি অন্যত্র বলেন, إِنَّكَ لَا تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلَا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِيْنَ-

‘নিশ্চয়ই তুমি মৃতকে শোনাতে পারবে না এবং তুমি বধিরকে আহবান শোনাতে পারবে না, যখন তারা পিঠ দেখিয়ে চলে যায়’ (নামল ২৭/৮০)

উল্লিখিত আয়াত সমূহ ছাড়াও আরো বহু আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোন অসীলা বা মাধ্যম ধরে নয়; বরং সরাসরি আল্লাহকে ডাকতে হবে। কাফেরদের পূজনীয় মূর্তি যেমন তাদের কোন উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না; মুসলমানদের পূজনীয় মৃত পীর, অলী, দরবেশও তেমনি মানুষের কোন উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। পীর, দরবেশ তো দূরের কথা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় বংশধরকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা দেননি। বরং ছাফা পাহাড়ের পাদদেশে সবাইকে ডেকে তিনি দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন,

يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ كَعْبِ بْنِ لُؤَىٍّ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ مَنَافٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ هَاشِمٍ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا بَنِىْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ أَنْقِذُوْا أَنْفُسَكُمْ مِنَ النَّارِ يَا عَبَّاسُ بْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ لاَ أُغْنِى عَنْكَ مِنَ اللهِ شَيْئًا يَا فَاطِمَةُ بِنْتُ مُحَمَّدٍ أَنْقِذِىْ نَفْسَكِ مِنَ النَّارِ فَإِنِّىْ لاَ أَمْلِكُ لَكُمْ مِنَ اللهِ شَيْئاً غَيْرَ أَنَّ لَكُمْ رَحِماً سَأَبُلُّهَا بِبَلاَلِهَا -

‘হে কুরায়েশগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু কা‘ব বিন লুআই! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আবদে মানাফ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু হাশেম! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে বনু আব্দিল মুত্ত্বালিব! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! হে আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব! আমি তোমাকে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষায় কোনই কাজে আসব না। হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও! কেননা আমি তোমাদের কাউকে আল্লাহর পাকড়াও হ’তে রক্ষা করতে পারব না। তবে তোমাদের সঙ্গে আত্মীয়তার যে সম্পর্ক রয়েছে, তা আমি (দুনিয়াতে) সদ্ব্যবহার দ্বারা সিক্ত করব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, يَا فَاطِمَةُ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَلِيْنِىْ مَا شِئْتِ مِنْ مَالِىْ وَلاَ أُغْنِى عَنْكِ مِنَ اللهِ شَيْئًا ‘হে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা! তুমি আমার মাল-সম্পদ থেকে যা খুশী নাও। কিন্তু আল্লাহর পাকড়াও থেকে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব না’।[1]

সম্মানিত পাঠক! যেখানে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর বংশধর এমনকি তাঁর কলিজার টুকরা, নয়নের পুত্তলি স্বীয় কন্যা ফাতেমা (রাঃ)-কে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর নিশ্চয়তা দিতে পারেননি; সেখানে শয়তানের শিখন্ডী একজন পীর কিভাবে ভক্তদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে? তারা আপনার কোনই উপকারে আসবে না। বরং তারা ক্বিয়ামতের দিন আপনার ভক্তিকে অস্বীকার করবে। অতএব সাবধান হে মুসলিম সমাজ! আপনি এমন কোন বিশ্বাস করবেন না যা আপনার ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়।

অনেকেই বলে থাকেন, যেহেতু আমরা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ সেহেতু ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্যই পীর ধরে থাকি। কেননা আল্লাহ বলেছেন,فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ- ‘আর জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা না জেনে থাক’ (নাহল ১৬/৪৩)

জবাবে বলব, অবশ্যই আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে পারদর্শী আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর অর্থ পীর ধরা অথবা নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ করা নয়। বরং এর অর্থ হ’ল, অজ্ঞ ব্যক্তিরা কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে যেকোন যোগ্য আলেমের নিকট জিজ্ঞাসা করবে। যেমন আব্দুল্ল­াহ ইবনু আববাস (রাঃ) অন্যান্য ছাহাবীদেরকে রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও সুন্নাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। অনুরূপভাবে ছাহাবীগণ রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ)-এর স্ত্রীগণকে বিশেষ করে আয়েশা (রাঃ)-কে তাঁর বাড়ির অভ্যন্তরের কাজ-কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। ফক্বীহগণের মধ্যেও অনুরূপ বিষয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন ইমাম শাফেঈ (রহঃ)  ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-কে বলেছেন,

يَا أَبَا عَبْدِ اللهِ أَنْتَ أَعْلَمُ بِالْحَدِيْثِ مِنِّيْ، فَإِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَأَعْلِمْنِيْ حَتَّى أَذْهَبَ إِلَيْهِ شَامِيًّا كَانَ أَوْ كُوْفِيًّا أَوْ بَصْرِيًّا-

‘হে আবু আব্দুল্ল­াহ! আপনি আমার চেয়ে হাদীছ সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখেন। কাজেই যখন ছহীহ হাদীছ পাবেন, তখন তা আমাকে জানাবেন। যাতে আমি তার কাছে যেতে পারি। চাই তিনি শাম, কূফা অথবা বছরার লোক হন’।[2]

অতএব দ্বীনের অজানা বিষয় যেকোন যোগ্য আলেমের নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। দ্বীন শিক্ষার দোহাই দিয়ে পীর ধরা, পীরের পায়ে চুমু খাওয়া, কবরে সিজদা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলামের নামে এগুলি ধোঁকাবাজি। এটা সরলমনা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের পকেট ছাফ করার অপকৌশল মাত্র। যা থেকে বেঁচে থাকা এবং এগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সকল মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।

অনেকেই বলে থাকেন যে, পীর বা অসীলা না ধরলে জান্নাত পাওয়া যাবে না। দলীল হিসাবে সূরা মায়েদার ৩৫ নং আয়াত পেশ করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا اتَّقُوْا اللهَ وَابْتَغُوْا إِلَيْهِ الْوَسِيْلَةَ وَجَاهِدُوْا فِيْ سَبِيْلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-  ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর (অসীলা) নৈকট্য অন্বেষণ কর এবং তাঁর পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (মায়েদাহ ৫/৩৫)

সম্মানিত পাঠক! উক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘অসীলা’-র অর্থ পীর ধরা নয়; বরং এর অর্থ হ’ল, ‘তোমরা সৎ কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ কর’। ক্বাতাদাহ (রহঃ) বলেন, উক্ত আয়াতের অর্থ হচ্ছে ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য ও যে কাজে তিনি সন্তুষ্ট হন, সে সকল কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ কর’। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন যে, ‘এই ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই’।[3] অতএব পীর পূজা ও কবরপূজা নয়; বরং ঈমান, ছালাত, যাকাত, হজ্জ, ছিয়াম সহ কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ স্বীকৃত যাবতীয় সৎকর্ম আপনার জান্নাতে যাওয়ার অসীলা।

উল্লেখ্য যে, আমরা অনেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় বিভিন্ন কিছুর অসীলায় দো‘আ করে থাকি। কেউবা তার পীর বাবাকে অসীলা করে দো‘আ করে থাকি। আবার কেউ বুযুর্গানে দ্বীনের অসীলায় দো‘আ করে থাকি। আবার কেউ সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলা দিয়ে দো‘আ করে থাকি। তাই আমাদের জানতে হবে কোন কোন অসীলা ইসলামী শরী‘আতে জায়েয? আর কোনগুলো নাজায়েয।

জায়েয ও নাজায়েয অসীলা সমূহ

তিনটি অসীলা দিয়ে দো‘আ করা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা স্বীকৃত, যে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হ’ল।-

(১) আললাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী উল্লেখ করে দো‘আ করা: যেমন আমরা দো‘আ করার সময় বলতে পারি, হে আল্লাহ! তুমি ‘রহমান’ তুমি ‘রহীম’ তুমি আমার উপর রহম কর। হে আল্লাহ! তুমি ‘গাফূরুর রহীম’ তুমি আমাকে ক্ষমা কর ইত্যাদি। এরূপ অসীলা জায়েয। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوْهُ بِهَا وَذَرُوْا الَّذِيْنَ يُلْحِدُوْنَ فِيْ أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- 

‘আর আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, সুতরাং তোমরা তাঁকে সেই সব নামেই ডাক এবং তাদেরকে বর্জন কর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে। সত্বরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেয়া হবে’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)

(২) নিজের পালনকৃত সৎ আমল উল্লেখ করে দো‘আ করা : যেমন আমরা দো‘আ করার সময় বলতে পারি, হে আল্লাহ! আমি তোমার প্রতি ঈমান এনেছি। এই ঈমানের অসীলায় তুমি আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একটি ছিয়াম পালন করেছি, তুমি এই ছিয়ামের অসীলায় আমাকে ক্ষমা কর ইত্যাদি। এরূপ অসীলা জায়েয। যেমন কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন,اًلَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ- ‘যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আমরা ঈমান এনেছি, অতএব তুমি আমাদের পাপ সমূহ ক্ষমা করে দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর’ (আলে-ইমরান ৩/১৬)। তিনি আরো এরশাদ করেন,

رَبَّنَا آمَنَّا بِمَا أَنْزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُوْلَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِيْنَ-

‘হে আমাদের রব! আপনি যা নাযিল করেছেন তার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা রাসূলের অনুসরণ করেছি। অতএব আমাদেরকে সাক্ষ্যদাতাদের তালিকাভুক্ত করুন’ (আলে-ইমরান ৩/৫৩)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিন জন সফরকারীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যারা পথিমধ্যে কোন এক গুহায় আশ্রয় নিলে হঠাৎ পাহাড় হ’তে এক খন্ড পাথর পড়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারা কোনভাবেই গুহা থেকে বের হ’তে পারছিলেন না। তখন তারা নিজেদের সৎ আমলের অসীলা করে আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছিলেন, যাতে গুহার মুখ হ’তে পাথর সরে গিয়েছিল।

প্রথম ব্যক্তি বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতা খুব বৃদ্ধ ছিলেন। আমি কখনো তাদের আগে আমার পরিবার-পরিজনকে কিংবা দাস-দাসীকে দুধ পান করাতাম না। একদিন কোন একটি জিনিসের তালাশে আমাকে অনেক দূরে চলে যেতে হয়। কাজেই আমি তাঁদের ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বে ফিরতে পারলাম না। আমি তাঁদের জন্য দুধ দোহন করে নিয়ে এলাম। কিন্তু তাঁদেরকে ঘুমন্ত পেলাম। তাদের আগে আমার পরিবার-পরিজন ও দাস-দাসীকে দুধ পান করতে দেয়াটাও আমি পসন্দ করিনি। তাই আমি তাঁদের জেগে উঠার অপেক্ষায় পেয়ালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এভাবে ভোরের আলো ফুটে উঠল। তারপর তাঁরা জাগলেন এবং দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এ কাজ করে থাকি, তবে এ পাথরের কারণে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা আমাদের হ’তে দূর করে দাও। ফলে পাথর সামান্য সরে গেল। কিন্তু তাতে তারা বের হ’তে পারল না।

দ্বিতীয় ব্যক্তি  বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আমার এক চাচাতো বোন ছিল। সে আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি তার সাথে দৈহিক মিলনে লিপ্ত হ’তে চাইলাম। কিন্তু সে বাধা দিল। তারপর এক বছর ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সে আমার কাছে (সাহায্যের জন্য) আসল। আমি তাকে একশত বিশ দীনার দিলাম এ শর্তে যে, সে আমার সাথে একান্তে মিলিত হবে, তাতে সে রাযী হ’ল। আমি যখন সম্পূর্ণ সুযোগ লাভ করলাম, তখন সে বলল, আমি তোমাকে অবৈধভাবে মোহর ভাঙ্গার (সতীত্ব হরণের) অনুমতি দিতে পারি না। ফলে সে আমার সর্বাধিক প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আমি তার সাথে মিলিত হওয়া পাপ মনে করে তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম এবং আমি তাকে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম, তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করে থাকি, তবে আমরা যে বিপদে পড়েছি তা দূর কর। তখন সেই পাথরটি (আরো একটু) সরে পড়ল। কিন্তু তাতে তারা বের হ’তে পারছিল না।

তৃতীয় ব্যক্তি বলেছিলেন, হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন দিনমজুর নিয়োগ করেছিলাম এবং আমি তাদেরকে তাদের মজুরীও দিয়েছিলাম। কিন্তু একজন লোক তার প্রাপ্য না নিয়ে চলে গেল। আমি তার মজুরীর টাকা কাজে খাটিয়ে তা বাড়াতে লাগলাম। তাতে প্রচুর ধন-সম্পদ অর্জিত হ’ল। কিন্তু কিছুকাল পর সে আমার নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে আমার মজুরী দিয়ে দাও। আমি তাকে বললাম, এসব উট, গরু, ছাগল ও গোলাম যা তুমি দেখতে পাচ্ছ, তা সবই তোমার মজুরী। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আমার সাথে বিদ্রূপ না করে আমার মজুরী দিয়ে দাও। তখন আমি বললাম, আমি তোমার সাথে মোটেই বিদ্রূপ করছি না। তখন সে সবই গ্রহণ করল এবং নিয়ে চলে গেল। তা হ’তে একটাও ছেড়ে গেল না। হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজ করে থাকি, তবে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা দূর কর। তখন সে পাথরটি সম্পূর্ণ সরে পড়ল। তারপর তারা বেরিয়ে এসে পথ চলতে লাগল।[4]

(৩) জীবিত সৎ ব্যক্তির অসীলায় দো‘আ : কোন উপস্থিত জীবিত সৎ ব্যক্তির নিকট দো‘আ চাওয়া জায়েয। দো‘আ করার সময় এরূপ বলা জায়েয হবে যে, হে আল্লাহ! আমি অমুক সৎ ব্যক্তিকে আমার জন্য দো‘আ করতে বলেছি, তুমি তার দো‘আ কবুল কর। পক্ষান্তরে সরাসরি কোন জীবিত পীর-দরবেশ বা কোন সৎ ব্যক্তির অসীলায় দো‘আ করা জায়েয নয়। যেমন- দো‘আ করার সময় এমন কথা বলা জায়েয হবে না যে, হে আল্লাহ! অমুক পীর বা সৎ ব্যক্তির অসীলায় আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। এমন অসীলা শিরক, যা অবশ্যই বর্জন করতে হবে।

মোদ্দাকথা, সরাসরি কোন ব্যক্তির অসীলায় দো‘আ করা শরী‘আতসম্মত নয়; চাই সে জীবিত হোক বা মৃত হোক। পক্ষান্তরে জীবিত সৎ ব্যক্তির নিকট দো‘আ চাওয়া জায়েয। উক্ত দো‘আ আল্লাহ কবুল করলে সেটাই তার জন্য অসীলা হয়ে যাবে। কিন্তু মৃত ব্যক্তির নিকট দো‘আ প্রার্থনা করা শিরক। অর্থাৎ কোন কবরের নিকট গিয়ে কিছু চাওয়া বা প্রার্থনা করা শিরক। আর এই কারণেই রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে ওমর (রাঃ) তাঁর (রাসূল) নিকট বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আর আবেদন না করে তাঁর চাচা আববাস ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের নিকট বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ করতে বলেছিলেন। হাদীছে এসেছে, আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ওমর (রাঃ) অনাবৃষ্টির কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে আববাস ইবনু আবদুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)-এর মাধ্যমে বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا صلى الله عليه وسلم فَتَسْقِيْنَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ ‘হে আল্লাহ! (অনাবৃষ্টি দেখা দিলে) আমরা আমাদের নবী (ছাঃ)-এর (দো‘আর) অসীলায় তোমার কাছে দো‘আ করতাম, তখন তুমি বৃষ্টি বর্ষণ করতে। এখন আমরা আমাদের নবী (ছাঃ)-এর চাচার (দো‘আর) অসীলায় বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ করছি, তুমি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর। তখন বৃষ্টি হয়।[5]

উল্লিখিত হাদীছের ব্যাখ্যায় মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ) বলেন, হাদীছে বর্ণিত ওমর (রাঃ)-এর দো‘আ, إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا صلى الله عليه وسلم ‘অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমরা আমাদের নবী (ছাঃ)-এর অসীলায় তোমার কাছে দো‘আ করতাম’ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, নবী করীম (ছাঃ)-এর দো‘আর অসীলা। অর্থাৎ যে কোন প্রয়োজনে তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট দো‘আ চাইতেন। আর তিনি দো‘আ করতেন। যেমন- একদা রাসূল (ছাঃ) মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুৎবা দেওয়ার সময় এক ব্যক্তি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! (অনাবৃষ্টির কারণে) গবাদি পশু ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাগুলোতে চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। সুতরাং আপনি আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন, যেন তিনি আমাদের বৃষ্টি দেন। তখন রাসূল (ছাঃ) উভয় হাত তুলে দো‘আ করলেন, اَللَّهُمَّ اسْقِنَا، اللَّهُمَّ اسْقِنَا، اللَّهُمَّ اسْقِنَا ‘হে আল্লাহ! বৃষ্টি দিন। হে আল্লাহ! বৃষ্টি দিন। হে আল্লাহ! বৃষ্টি দিন।... আনাস (রাঃ) বলেন, ফলে আল্লাহ এত বৃষ্টি বর্ষণ করলেন যে, ৬ দিন পর্যন্ত সূর্য দেখা যায়নি। অতঃপর পরবর্তী জুম‘আর দিনে রাসূল (ছাঃ)-এর খুৎবা চলাকালীন সময় এক ব্যক্তি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাটও বন্ধ হয়ে গেল। কাজেই আপনি আল্লাহর নিকট বৃষ্টি বন্ধের জন্য দো‘আ করুন। তখন রাসূল (ছাঃ) উভয় হাত তুলে দো‘আ করলেন, اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلاَ عَلَيْنَا، اللَّهُمَّ عَلَى الآكَامِ وَالْجِبَالِ وَالآجَامِ وَالظِّرَابِ وَالأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ ‘হে আল্লাহ! আমাদের আশেপাশে, আমাদের উপরে নয়; টিলা, পাহাড়, উচ্চভূমি, মালভূমি, উপত্যকা এবং বনভূমিতে বৃষ্টি বর্ষণ করুন। আনাস (রাঃ) বলেন, এতে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা (মসজিদ থেকে বেরিয়ে) রোদে চলতে লাগলাম।[6]

অনুরূপভাবে হাদীছে বর্ণিত ওমর (রাঃ)-এর দো‘আوَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا ‘আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর চাচা আববাস (রাঃ)-এর অসীলায় বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ করছি’ দ্বারা উদ্দেশ্যে হ’ল, আববাস ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)-এর দো‘আর আসীলা। অর্থাৎ তাঁকে বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ করতে বলা এবং অন্যেরা তাঁর দো‘আয় শরীক হওয়া।[7]

শায়খ উছায়মীন (রহঃ) আরো বলেন, وتوسلهم بالنبي صلى الله عليه وسلم كان بطلبهم الدعاء منه، ولهذا جاء في بعض الروايات: أن عمر كان يأمر العباس فيقوم فيدعو. ‘তাদের (ছাহাবায়ে কেরাম) নবী করীম (ছাঃ)-এর অসীলা গ্রহণ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, তারা তাঁর নিকট থেকে দো‘আ চাইতেন। আর এজন্যেই কিছু বর্ণনায় এসেছে, ওমর (রাঃ) আববাস (রাঃ)-কে নির্দেশ দিতেন। অতঃপর তিনি দাঁড়াতেন এবং দো‘আ করতেন।[8]

অতএব ওমর (রাঃ) কখনোই সরাসরি আববাস (রাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করেননি; বরং তাঁর নিকট বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ প্রার্থনা করেছেন। বর্তমানেও যেকোন সৎ ব্যক্তির নিকট দো‘আ চাওয়া যায়। আল্লাহর নিকট কবুল হ’লে এটাই তার জন্য অসীলা হবে।

শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন,

معنى قول عمر : إنا كنا نتوسل إليك بنبينا صلى الله عليه وسلم وإنا نتوسل إليك بعم نبينا أننا كنا نقصد نبينا صلى الله عليه وسلم ونطلب منه أن يدعو لنا ونتقرب إلى الله بدعائه والآن وقد انتقل صلى الله عليه وسلم إلى الرفيق الأعلى ولم يعد من الممكن أن يدعو لنا فإننا نتوجه إلى عم نبينا العباس ونطلب منه أن يدعو لنا وليس معناه أنهم كانوا يقولون في دعائهم : اللهم بجاه نبيك اسقنا ثم أصبحوا يقولون بعد وفاته صلى الله عليه و سلم : اللهم بجاه العباس اسقنا لأن مثل هذا دعاء مبتدع ليس له أصل في الكتاب ولا في السنة ولم يفعله أحد من السلف الصالح-

ওমর (রাঃ)-এর কথা ‘অনাবৃষ্টি দেখা দিলে আমরা আমাদের নবী (ছাঃ)-এর অসীলায় তোমার নিকট দো‘আ করতাম এবং আমরা আমাদের নবী (ছাঃ)-এর চাচা আববাস (রাঃ)-এর অসীলায় বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ করছি’-এর অর্থ হ’ল, আমরা আমাদের নবী (ছাঃ)-এর নিকট যেতাম ও তাঁকে আমাদের জন্য দো‘আ করতে বলতাম এবং তাঁর দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করতাম। কিন্তু এখন তিনি মহান প্রভুর দরবারে চলে গেছেন। তিনি ফিরে এসে আমাদের জন্য দো‘আ করা অসম্ভব। তাই আমরা আমাদের নবী (ছাঃ)-এর চাচা আববাস (রাঃ)-এর শরণাপন্ন হয়েছি এবং তাঁর নিকট আমাদের জন্য দো‘আর আবেদন করছি। পক্ষান্তরে তাদের (ছাহাবায়ে কেরাম) দো‘আর অর্থ এই নয় যে, তারা তাদের দো‘আয় বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার নবীর মর্যাদার অসীলায় বৃষ্টি বর্ষণ কর। অতঃপর নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে বলতেন, হে আল্লাহ! আববাস (রাঃ)-এর মর্যাদার অসীলায় আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ কর। কেননা এরূপ দো‘আ বিদ‘আত। কুরআন ও সুন্নাহতে এর কোন ভিত্তি নেই এবং সালাফে ছালেহীনের কেউ এরূপ দো‘আ করেননি’।[9]

অতএব উক্ত হাদীছ পীরতন্ত্রের বৈধতার প্রমাণ বহন করে না; বরং পীরতন্ত্রের অবৈধতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। উক্ত হাদীছ যেমনভাবে মৃত পীরকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, তেমনিভাবে জীবিত পীরকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। কেননা মানুষ পীরের নিকট শুধুমাত্র দো‘আ চাওয়ার জন্য যায় না; বরং পীরকেই অসীলা হিসাবে গ্রহণ করে, যা বড় শিরক। অনুরূপভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর থেকে দো‘আ প্রার্থনা করাও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

উপরোল্লেখিত তিনটি অসীলা দিয়ে দো‘আ করা শরী‘আতসম্মত। এ ব্যতীত যে সকল অসীলায় মানুষ দো‘আ করে থাকে তা প্রত্যাখ্যাত।

রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করার হুকুম : সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করা অথবা তাঁর নিকট সাহায্য চাওয়া, তাঁর থেকে রোগমুক্তি কামনা করা ইত্যাদি বড় শিরক। যেমন কেউ যদি বলে, হে আল্লাহ! তুমি রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা কর, আমাকে আরোগ্য দান কর ইত্যাদি তাহ’লে শিরক হবে। যদি রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করা জায়েয হ’ত, তাহ’লে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় বৃষ্টি বর্ষণের দো‘আ করতেন। কিন্তু তিনি তা না করে আববাস ইবনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাধ্যমে দো‘আ করেছেন। উল্লিখিত হাদীছ যার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, চার ইমামের কেউ-ই রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করেননি এবং দো‘আ করাকে জায়েয বলেননি।

তবে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ করা এবং তাঁকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসার অসীলা করে দো‘আ করা জায়েয। যেমন কেউ যদি বলে, হে আল্লাহ! আমি রাসূল (ছাঃ)-এর উপর পূর্ণ ঈমান এনেছি। অতএব তুমি রাসূলের প্রতি ঈমানের অসীলায় আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা কর। হে আল্লাহ! আমি রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের যথাযথ অনুসরণ করার চেষ্টা করি; অতএব তুমি এই অসীলায় আমাকে আরোগ্য দান কর। হে আল্লাহ! আমি রাসূল (ছাঃ)-কে দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভালবাসি; অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর ইত্যাদি। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ করা, তাঁকে ভালবাসা ইত্যাদি সৎ আমলের অন্তর্ভুক্ত। আর নিজের সৎ আমলের অসীলায় দো‘আ করা জায়েয, যা তিনজন ব্যক্তির গুহায় আটকে পড়া ও তাদের সৎ আমলের অসীলায় দো‘আ করে গুহা থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ), শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ), শায়খ মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রহঃ)ও অনুরূপ ফৎওয়া প্রদান করেছেন।[10]

পক্ষান্তরে কোন মৃত মানুষের অসীলায় দো‘আ করা জয়েয নয়। রাসূল (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেছেন। এখন তিনি বারযাখী জীবন তথা কবরের জীবন লাভ করেছেন। দুনিয়াবী জীবনের সাথে বারযাখী জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। তাইতো ওমর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করেননি; বরং তাঁর চাচা আববাস (রাঃ)-এর মাধ্যমে দো‘আ করেছেন। এক্ষণে যদি রাসূল (ছাঃ)-এর অসীলায় দো‘আ করা জায়েয না হয়, তাহ’লে মৃত পীর, দরবেশ, অলী-আউলিয়ার অসীলায় দো‘আ করা কিভাবে জায়েয হতে পারে? এটা কখনোই জায়েয নয়। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!

 [চলবে]

মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম

লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; প্রধান দা‘ঈ, বাংলা বিভাগ, আল-ফুরক্বান সেন্টার, হূরা, বাহরাইন।


[1]. বুখারী হা/২৭৫৩; মুসলিম হা/২০৪, ২০৬; আহমাদ হা/৮৭১১; মিশকাত হা/৫৩৭৩ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়-২৬।

[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ২/১৬৪ পৃঃ।

[3]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা মায়েদা ৩৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[4]. বুখারী হা/২২৭২।

[5]. বুখারী হা/১০১০, ৩৭১০; মিশকাত হা/১৫০৯।

[6]. বুখারী হা/১০১৩, ১০১৪; মুসলিম হা/৮৯৭।

[7]. ফাতাওয়া উছায়মীন ২/২৭৭ পৃঃ।

[8]. উছায়মীন, আল-ক্বাওলুল মুফীদ আলা কিতাবিত তাওহীদ ২/৫১২ পৃঃ।

[9]. নাছিরুদ্দীন আলবানী, আত-তাওয়াস্সুল, পৃঃ ২৬।

[10]. ফাতাওয়া বিন বায ৫/২২২-২২৩ পৃঃ; ফাতাওয়া উছায়মীন ২/২৪৩-২৪৪ পৃঃ; ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১/৩৪৮ পৃঃ।






হকের পথে বাধা : মুমিনের করণীয় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আহলেহাদীছ আন্দোলন-এর পাঁচ দফা মূলনীতি : একটি বিশ্লেষণ (শেষ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
সঠিক আক্বীদাই পরকালীন জীবনে মুক্তির উপায় - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (শেষ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
মানবাধিকার ও ইসলাম (১২তম কিস্তি) - শামসুল আলম
নফল ছিয়াম সমূহ - -আত-তাহরীক ডেস্ক
মানবাধিকার ও ইসলাম (১১তম কিস্তি) - শামসুল আলম
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
হজ্জ সম্পর্কিত ভুল-ত্রুটি ও বিদ‘আত সমূহ - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
জামা‘আতে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব, ফযীলত ও হিকমত (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
ইবাদতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আরও
আরও
.