ভুল ধারণা-২ :

আহলেহাদীছরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানে বেয়াদবী করে :

আহলেহাদীছদের সম্পর্কে দ্বিতীয় ভুল ধারণা বা অপবাদ এই যে, তারা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে সম্মান করে না। অনেকে অজ্ঞতাবশতঃ আহলেহাদীছদেরকে রাসূলকে অসম্মানকারী মনে করে। এমনকি কোন কোন আলেম তো আহলেহাদীছের আক্বীদা সম্পর্কে এতটাই অজ্ঞ যে, তারা স্পষ্টভাবে বলে, ‘আহলেহাদীছরা রাসূল (ছাঃ)-কে মানে না’।

অথচ বাস্তবতা এই যে, আহলেহাদীছদের নিকটে মুহাম্মাদ (ছাঃ) সমস্ত মাখলূকের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত। তাঁর মর্যাদা সমস্ত নবী ও রাসূলের চেয়ে বেশী। আমাদের এই আক্বীদার ভিত্তি স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)-এর নিম্নোক্ত বাণী-أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ فَخْرَ وَبِيَدِى لِوَاءُ الْحَمْدِ وَلاَ فَخْرَ وَمَا مِنْ نَبِىٍّ يَوْمَئِذٍ آدَمُ فَمَنْ سِوَاهُ إِلاَّ تَحْتَ لِوَائِى ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি সমস্ত বনু আদমের নেতা হব। এতে আমার কোন গর্ব নেই। প্রশংসার ঝান্ডা আমার হাতে থাকবে। এতে গর্বের কিছু নেই। যে কোন নবী চাই তিনি আদম হোন বা অন্য কেউ, সেদিন সবাই আমার ঝান্ডার নীচে থাকবে’।[1]

ক্বিয়ামতের দিন সকল নবীর সর্দার হওয়া অন্য নবীদের উপর তার শ্রেষ্ঠত্বের দলীল। একথা আহলেহাদীছের নিকট স্বীকৃত।

১. আহলেহাদীছগণ নবী (ছাঃ)-কে তাঁর প্রকৃত মর্যাদা দানে বাড়াবাড়ি করে না :

নবী করীম (ছাঃ) যেখানে আমাদেরকে স্বীয় মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, সেখানে একথাও জোর দিয়ে বলেছেন যে, আমরা যেন তাঁকে সম্মান করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকি এবং তাঁর সম্মানের ক্ষেত্রে খ্রিষ্টানদের মত সীমাতিক্রম না করি। যেমন- রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ ‘তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি কর না’।[2] যেমনটি নাছারারা মারইয়াম তনয়ের প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করেছে। বস্ত্ততঃ আমি আল্লাহর একজন বান্দা। অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল বল’।[3]

খ্রিষ্টানরা হযরত ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী ছিল। ঈসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনা সত্ত্বেও তারা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। নাছারাদের ভ্রষ্টতা কি ছিল? তারা ঈসা (আঃ)-কে বান্দার মর্যাদার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে মা‘বূদের আসনে বসিয়েছিল। তারা ঈসা (আঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে এত বেশী সীমালংঘন করেছিল যে, আল্লাহর যাত (সত্তা) ও ছিফাতে (গুণাবলী) তাঁকে আল্লাহর শরীক বানিয়ে দিয়েছিল। কেউ কেউ তাঁকে আল্লাহর পুত্র বলে অভিহিত করেছিল। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَنُ وَلَدًا، لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا، تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا، أَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمَنِ وَلَدًا، وَمَا يَنْبَغِي لِلرَّحْمَنِ أَنْ يَتَّخِذَ وَلَدًا، إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِي الرَّحْمَنِ عَبْدًا-

‘তারা বলে, দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা এক ভয়ংকর কথা বলেছ। এতে যেন আকাশ সমূহ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, পৃথিবী খন্ড-বিখন্ড হবে এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পতিত হবে। যেহেতু তারা দয়াময়ের উপর সন্তান আরোপ করেছে। অথচ সন্তান গ্রহণ করা দয়াময়ের জন্য শোভনীয় নয়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের নিকটে উপস্থিত হবে না দাস রূপে’ (মারইয়াম ১৯/৮৮-৯৩)। আবার কেউ তাকে আল্লাহই আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ বলেছেন,لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ ‘যারা কুফরী করেছে তারা বলেছে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ হ’ল মাসীহ ইবনে মারইয়াম’ (মায়েদা ৫/১৭)। তারা ঈসা (আঃ)-কে মানার পরেও কাফের হয়ে গেছে।

আল্লাহর নবী (ছাঃ) মুসলিম উম্মাহকে নাছারাদের মত বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। সেকারণ নবী (ছাঃ)-এর নির্দেশ পালনার্থে আহলেহাদীছদের আক্বীদা এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যে আল্লাহর বান্দা তা মন থেকে উধাও করা যাবে না। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَيُّهَا النَّاسُ عَلَيْكُمْ بِتَقْوَاكُمْ وَلاَ يَسْتَهْوِيَنَّكمُ الشَّيْطَانُ أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ وَاللهِ مَا أُحِبُّ أَنْ تَرْفَعُونِى فَوْقَ مَنْزِلَتِى الَّتِى أَنْزَلَنِى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা নিজেদেরকে রক্ষা কর। অবশ্যই শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে। আমি আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ। আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আল্লাহর কসম! আমি এটা পসন্দ করি না যে, আল্লাহ আমাকে যে মর্যাদা[4] দিয়েছেন তোমরা তাঁর ঊর্ধ্বে আমাকে উঠাবে’।[5]

এখানে দু’টি বিষয় জানা গেল-

(১) স্বয়ং নবী করীম (ছাঃ)-এর এ ব্যাপারটি অপসন্দীয় যে, তাঁকে তাঁর প্রকৃত অবস্থানের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হবে।

(২) শয়তানের এটা খুব পসন্দ যে, সে মুসলমানদেরকে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত করে পথভ্রষ্ট করবে।

সেজন্য যে দরজা দিয়ে শয়তান প্রবেশের সম্ভাবনা আছে এবং সর্বদা থাকবে, আহলেহাদীছগণ সেই চোরা দরজার প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রেখে যাচ্ছেন। যাতে তারা উম্মতে মুহাম্মাদীকে বাড়াবাড়ির এই রোগ থেকে রক্ষা করতে পারেন, যে রোগে খ্রিষ্টানরা আক্রান্ত হয়েছে। যার দরুন তারা অহির বাহক হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমন হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন,

 وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ، اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ-   

‘ইহূদীরা বলে ওযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং নাছারারা বলে মসীহ ঈসা আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা মাত্র। এরা তো পূর্বেকার কাফেরদের মতই কথা বলে (যারা বলত ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে)। আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন! ওরা (তাওহীদ ছেড়ে) কোথায় চলেছে? তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র এক উপাস্যের ইবাদত করবে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তারা যাদেরকে শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি সেসব থেকে পবিত্র’ (তওবা ৯/৩০-৩১)

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

 وَإِذْ قَالَ اللهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُونِ اللهِ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ إِنْ كُنْتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَا أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ، مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُوا اللهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ، إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ-

‘(স্মরণ কর) যেদিন আল্লাহ বলবেন, হে মরিয়াম-তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদের একথা বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাকে দুই উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করে নাও? সে বলবে, আপনি (এসব অংশীবাদ থেকে) পবিত্র। আমার জন্য এটা শোভা পায় না যে, আমি এখন কথা বলি যা বলার কোন এখতিয়ার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে তা অবশ্যই আপনি জানেন। আপনি আমার মনের কথা জানেন, কিন্তু আমি আপনার মনের কথা জানি না। নিশ্চয়ই আপনি অদৃশ্য বিষয় সমূহ সর্বাধিক অবগত। আমি তাদেরকে কিছুই বলিনি এটা ব্যতীত যা আপনি আমাকে আদেশ করেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। আর আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু যখন আপনি আমাকে আপনার নিকট উঠিয়ে নিয়েছেন, তখন থেকে আপনিই তাদের তত্ত্বাবধায়ক। আর আপনি সকল বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী। যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহ’লে তারা আপনার বান্দা। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তাহ’লে আপনি মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (মায়েদা ৫/১১৬-১১৮)। 

কোন কোন আলেম আহলেহাদীছদেরকে উদ্ধত প্রমাণ করতে গিয়ে কিছু দৃষ্টান্তস্বরূপ কথা বলে থাকেন। যেমন- আহলেহাদীছরা রাসূল (ছাঃ) নূরের তৈরী বলে মানে না। বরং তাঁকে মানুষ মনে করে। আহলেহাদীছরা নবী করীম (ছাঃ)-কে গায়েবজান্তা বলে মনে করে না এবং আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য তাঁকে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করেন না প্রভৃতি।

আসুন! দেখা যাক এসব কথার সত্যতা কতটুকু?

(১) নূর ও মানুষ-এর মাসআলা : কোন কোন ব্যক্তির আক্বীদা হল নবী করীম (ছাঃ) নূরের তৈরী। তাদের দলীল কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটি, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ ‘অবশ্যই তোমাদের নিকটে আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে’ (মায়েদাহ ৫/১৫)

ইবনুল জাওযী (রহঃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় নূর সম্পর্কে দুটি মত উল্লেখ করেছেন।

(এক) নূর দ্বারা স্বয়ং আল্লাহর নবী (ছাঃ) উদ্দেশ্য।

(দুই) এর দ্বারা ইসলাম উদ্দেশ্য ।

কিন্তু নবী কি সৃষ্টিগতভাবে নূর, নাকি তিনি অন্ধকারে লুক্কায়িত সত্যকে প্রকাশ্যে উন্মোচনকারী হিসাবে নূর? মুফাসসিরগণ এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।

ইবনু জারীর ত্বাবারী (রহঃ) বলেন,يعني بالنور محمدًا صلى الله عليه وسلم الذي أنار الله به الحقَّ، وأظهر به الإسلام، ومحق به الشرك، فهو نور لمن استنار به يبيِّن الحق. ومن إنارته الحق، تبيينُه لليهود كثيرًا مما كانوا يخفون من الكتاب ‘এখানে নূর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’লেন নবী করীম (ছাঃ)। যাঁর মাধ্যমে আললাহ তা‘আলা হক্বকে প্রকাশ করেছেন, ইসলামকে বিজয়ী করেছেন এবং শিরককে ধ্বংস করেছেন। এজন্য তিনি সেই ব্যক্তির জন্য নূর, যে তাঁর নিকট থেকে জ্যোতি হাছিল করতে চায়। তিনি সত্যকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন। আর তাঁর হক উন্মোচন করার এটাও একটা দিক যে, তিনি এমন অনেক বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ইহূদীরা তাদের কিতাব থেকে যা গোপন করত।[6]

যদি এ আয়াতটি সম্পূর্ণ পড়া হয়, তাহ’লে ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাবে। পুরো আয়াতটি হল-

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ، يَهْدِي بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ-

‘হে আহলে কিতাবগণ! তোমাদের কাছে আমাদের রাসূল এসেছেন, যিনি বহু বিষয় তোমাদের সামনে বিবৃত করেন, যেসব বিষয় তোমরা তোমাদের কিতাব থেকে গোপন কর। আরও বহু বিষয় তিনি এড়িয়ে যান (অর্থাৎ প্রকাশ করেন না)। বস্ত্ততঃ তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হ’তে এসেছে একটি জ্যোতি ও আলোকময় কিতাব। তা দ্বারা (অর্থাৎ কুরআন দ্বারা) আল্লাহ ঐসব লোকদের শান্তির পথ সমূহ প্রদর্শন করেন, যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তিনি তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে (কুফরীর) অন্ধকার হ’তে (ঈমানের) আলোর দিকে বের করে আনেন। আর তিনি তাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন’ (মায়েদাহ ৫/১৫-১৬)

এখানে একথাও লক্ষ্যণীয় যে, আহলেহাদীছগণ নবী (ছাঃ)-কে সাধারণ মানুষ নয় বরং সর্বশ্রেষ্ট মানুষ গণ্য করেন। যদি তাঁকে মানুষ মনে করা তাঁর শানে বেয়াদবী হয়, তাহ’লে কেবল এটুকু দেখে নিন যে, স্বয়ং নবী (ছাঃ)-এর সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী ও উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ)-এর আক্বীদা কী ছিল? আয়েশা (রাঃ) বলেন, كان بشرا من البشر ‘আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একজন মানুষই ছিলেন’।[7]

এখন হযরত আয়েশা (রাঃ)-কেও কি রাসূলের শানে বেয়াদবীকারিনী বলা যাবে? না, কখনোই নয়। অতএব নিজেদের আক্বীদা সংশোধন করতে হবে।

৩. অদৃশ্যের জ্ঞানের মাসআলা :

আহলেহাদীছগণ এটা মানেন যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবী (ছাঃ)-কে কখনও কখনও এমন সব বিষয় জানিয়েছেন যা গায়েব বা অদৃশ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জান্নাত, জাহান্নাম, আসমান, যমীন, অতীত ও ভবিষ্যতের এমন অনেক সংবাদ যা তিনি জানতেন না, সেগুলি তাকে বলা হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এজন্য এ বিষয়ে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর আক্বীদা এবং এর সাথে তাঁর ফৎওয়াও শুনুন! আয়েশা (রাঃ) বলেন,مَنْ زَعَمَ أَنَّهُ يُخْبِرُ بِمَا يَكُونُ فِي غَدٍ، فَقَدْ أَعْظَمَ عَلَى اللهِ الْفِرْيَةَ والله يقول: قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللهُ ‘যে ব্যক্তি এ দাবী করবে যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আগামী দিনে কি হবে তা বলে দিতেন, তাহলে সে ব্যক্তি আল্লাহর উপর বড় মিথ্যারোপ করবে’।[8] কারণ স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘বলে দাও, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে না আল্লাহ ব্যতীত’ (নামল ২৭/৬৫)।[9]

যেই আক্বীদা বা বিশ্বাস হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ছিল,  সেই আক্বীদাই হ’ল আহলেহাদীছদের আক্বীদা। এই আক্বীদার ভিত্তিতে কোন মুসলমান কি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিশুদ্ধ আক্বীদায় আপত্তি করার দুঃসাহস দেখাতে পারে? যদি না পারে, তাহ’লে কিসের ভিত্তিতে আক্বীদার কারণে সেই আহলেহাদীছদেরকে অপরাধী বলা হয়? গভীরভাবে চিন্তার বিষয় হ’ল, হযরত আয়েশা (রাঃ) স্বীয় আক্বীদার সমর্থনে কুরআনের আয়াত থেকেও দলীল সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং এটাকে স্রেফ তার নিজস্ব মত বলাটাও ভুল হবে।

৪. অসীলার মাসআলা :

আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ এটাও উত্থাপন করা হয় যে, তারা নবী করীম (ছাঃ)-কে অসীলা হিসাবে গ্রহণ করে না। এ অভিযোগের উত্তর এই যে, আহলেহাদীছদের নিকটে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের একমাত্র উপায় হ’ল আক্বীদা ও আমলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ করা। আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভের একমাত্র ও নিশ্চিত অসীলা বা মাধ্যম হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসরণ। যে ব্যক্তি রাসূলের সুন্নাত সমূহের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে মনগড়া তরীকা আবিষ্কার করবে এবং সেটাকে অসীলা মেনে আল্লাহর নিকট কল্যাণ প্রাপ্তির আশা করবে, তাহ’লে এটা স্রেফ অর্থহীন আমলই হবে না; বরং সেটা হবে বিদ‘আত এবং পরকালে আল্লাহর শাস্তি লাভের কারণ।

অসীলা সম্পর্কে ছাহাবীদের কর্মপদ্ধতি কি ছিল? সুপথ প্রাপ্ত খলীফা হযরত উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর আদর্শের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে, নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর ছাহাবীগণ কি তাঁর যাত বা সত্ত্বার অসীলায় দো‘আ করতেন, না করতেন না?

আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন,أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ  رضى الله عنه كَانَ إِذَا قَحَطُوا اسْتَسْقَى بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا-قَالَ فَيُسْقَوْنَ  ‘অনাবৃষ্টির সময় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব এর অসীলায় বৃষ্টির জন্য দো‘আ করতেন এবং বলতেন, হে আল্লাহ! আমরা আমাদের নবী করীম (ছাঃ)-এর অসীলা দিয়ে দো‘আ করতাম এবং আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর চাচার অসীলা দিয়ে দো‘আ করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তারা বৃষ্টি প্রাপ্ত হ’ত’।[10]

হযরত ওমর (রাঃ)-এর উক্তি ‘পূর্বে আমরা আমাদের নবীর অসীলা গ্রহণ করতাম’ এর অর্থ হচ্ছে তিনি নবীর দো‘আর অসীলা গ্রহণ করেছেন, তাঁর যাত বা সত্ত্বার অসীলা গ্রহণ করেননি। কেননা নবী (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরেও যদি তাঁর যাতের অসীলায় দো‘আ করা জায়েয হ’ত তাহ’লে হযরত উমার (রাঃ) নবী (ছাঃ)-এর সত্ত্বাকে পরিহার করে আববাস (রাঃ)-কে নির্বাচন করতেন না। বরং তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর কবরের পাশে গিয়ে তাঁর যাতের অসীলায় দো‘আ করতে পারতেন। সুতরাং প্রমাণিত হ’ল যে, এ অসীলা তাঁর যাত বা সত্ত্বার নয়, বরং তাঁর দো‘আর অসীলা ছিল। যা তাঁর মৃত্যুর পর এখন আর নেই। বাস্তব সত্য এই যে, ছাহাবীদের মাঝে কারো নাম বা যাতের অসীলায় দো‘আ করার রীতি ছিলই না, বরং এর পরিবর্তে কোন সৎ ব্যক্তির মাধ্যমে দো‘আ করানোর পদ্ধতি চালু ছিল। এজন্য ওমর (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পর তাঁর চাচার মাধ্যমে দো‘আ করিয়েছেন।

এখানে একথাও স্পষ্ট হ’ল যে, নবী করীম (ছাঃ)-এর কবরের পাশে গিয়ে তাঁর নিকটে দো‘আর দরখাস্ত করার রীতিও ছাহাবীদের মাঝে ছিল না। থাকলে ওমর (রাঃ) এক্ষেত্রে অবশ্যই তা করতেন। অতএব আহলেহাদীছগণ এই তরীকার উপরেই আমল করছেন। যা স্বয়ং হযরত ওমর (রাঃ) থেকে প্রমাণিত যে, জীবিত উপস্থিত নেক ব্যক্তির মাধ্যমে দো‘আ করানো যাবে। কিন্তু এর বিপরীতে তাদের নাম নিয়ে তাদের যাতের অসীলায় দো‘আ করানো এমন একটি আমল, যা না কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত, আর না ছাহাবীদের আমল দ্বারা।

ভুল ধারণা-৩ :

আহলেহাদীছরা ছাহাবায়ে কেরামকে মানে না এবং তাঁদেরকে অবজ্ঞা করে :

আহলেহাদীছদের সম্পর্কে তৃতীয় ভুল ধারণা এই যে, আহলেহাদীছরা ছাহাবায়ে কেরামকে মানে না, তাঁদের কথা গ্রহণ করে না এবং তাদের শানে বেয়াদবী করে।

বাস্তব সত্য এই যে, আহলেহাদীছদের নিকটে ছাহাবায়ে কেরাম আক্বীদা ও আমল উভয় ক্ষেত্রেই আদর্শ ও দলীল।

১. যারা নবী (ছাঃ) ও ছাহাবীদের পথে আছেন তারাই আহলেহাদীছদের নিকট হক্বপন্থী। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلَّا مِلَّةً وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي ‘আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। এদের সবাই জাহান্নামে যাবে শুধু একটি দল ব্যতীত। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! সেটি কোন দল? উত্তরে তিনি বললেন, যারা আমার ও আমার ছাহাবীদের পথের উপরে থাকবে’।[11]

পরবর্তী যুগে সৃষ্ট নানা মতভেদের সময় আহলেহাদীছদের নিকট হক্ব ও হক্বপন্থীদেরকে চেনার একমাত্র মাপকাঠি হ’ল ছাহাবীগণ। যে ব্যক্তি নবী (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও ছাহাবীদের নীতির অনুসারী হবেন তিনিই আহলেহাদীছদের নিকটে হক্বপন্থী। যেসব আলেম কুরআন ও সুন্নাহর মনগড়া ব্যাখ্যাকে দলীলের মর্যাদা প্রদান করে উম্মতের ভিতরে বিদ‘আত ও কুসংস্কার সৃষ্টি করে, তাদের প্রত্যুত্তরে আহলেহাদীছগণ ছাহাবীদের পথ ও পদ্ধতি এবং মূলনীতি সমূহকে দলীল হিসাবে পেশ করে থাকেন।

এসব প্রমাণ থাকার পরেও জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আহলেহাদীছদেরকে কটাক্ষ করা এবং তাদের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা সর্বদা কিছু লোকের কাজ। এটা ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু প্রমাণহীন অপবাদ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জন্য নিজেই যথেষ্ট।

২. ছাহাবীগণকে মন্দ অভিহিতকারী রাসূল (ছাঃ)-এর লা‘নতের হকদার : আহলেহাদীছদের নিকটে ছাহাবীগণকে গাল-মন্দকারী, তাদের মর্যাদাহানিকারী এবং তাঁদের উপর থেকে উম্মতের নির্ভরতাকে প্রশ্নবিদ্ধকারী লা‘নতের হকদার। কারণ স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এমন ব্যক্তিকে ‘অভিশপ্ত’ আখ্যা দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَبَّ أَصْحَابِي فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ، وَالْمَلَائِكَةِ، وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ ‘যে ব্যক্তি আমার ছাহাবীদেরকে গালি দিবে তার উপর আল্লাহ, ফেরেশতামন্ডলী এবং সকল মানুষের লা‘নত’।[12]

৩. ছাহাবীগণ নবী করীম (ছাঃ)-এর বিপরীতে খোলাফায়ে রাশেদীনের কথাও পরিত্যাগ করতেন। প্রত্যেক ছাহাবীর মর্যাদা ও সম্মান সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু অনেক বড় ব্যক্তিত্বও দলীলের চেয়ে বড় হ’তে পারেন না। দলীল-প্রমাণাদির ওযন সর্বদা ব্যক্তিত্বের চাইতে বেশী হয়ে থাকে।

ছাহাবীদের নিকটে খোলাফায়ে রাশেদীন সম্মানের পাত্র ছিলেন। তারা তাঁদের নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত মেনে নিতেন। কিন্তু ছাহাবীগণ নবী (ছাঃ)-এর কথার বিপরীতে অনেক বড় ব্যক্তির কথাও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতেন। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে বেয়াদবী করতেন না। কিন্তু তারা তাদেরকে সম্মান করার নামে তাদের কথাকে কিতাব ও সুন্নাতের উপরে প্রাধান্য দানকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।

হযরত আলী (রাঃ)-এর একটি ফায়ছালা এবং সে সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যা থেকে উক্ত বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

ইকরিমা (রহঃ) বলেন,أُتِيَ عَلِيٌّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ بِزَنَادِقَةٍ فَأَحْرَقَهُمْ، فَبَلَغَ ذَلِكَ ابْنَ عَبَّاسٍ، فَقَالَ: لَوْ كُنْتُ أَنَا لَمْ أُحْرِقْهُمْ، لِنَهْيِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لاَ تُعَذِّبُوا بِعَذَابِ اللهِ وَلَقَتَلْتُهُمْ، لِقَوْلِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ بَدَّلَ دِيْنَهُ فَاقْتُلُوْهُ ‘হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকটে কিছু যিন্দীককে (নাস্তিক) নিয়ে আসা হ’ল। তিনি তাদের সবাইকে পুড়িয়ে মারলেন। এ সংবাদ হযরত ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিকটে পৌঁছলে তিনি বললেন, যদি আমি তার জায়গায় ফায়ছালাকারী হতাম তাহ’লে তাদেরকে পোড়ানোর হুকুম দিতাম না। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরূপ করতে নিষেধ করে বলেছেন, তোমার আল্লাহর শাস্তি দিয়ে মানুষকে শাস্তি দিয়ো না। আর আমি তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিতাম। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে স্বীয় দ্বীন পরিবর্তন করবে তাকে হত্যা করো’।[13]

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, فَبَلَغَ ذَلِكَ عَلِيًّا، فَقَالَ: صَدَقَ ابْنُ عَبَّاسٍ ‘ইবনু আববাসের এমন মন্তব্য হযরত আলী (রাঃ)-এর নিকট পৌঁছলে তিনি বলেন, ইবনু আববাস ঠিক বলেছেন’।[14]

এই ঘটনায় একদিকে যেমন হযরত ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হক্ব কথা বলার দৃষ্টান্ত রয়েছে, তেমনি অন্য দিকে হযরত আলী (রাঃ)-এর হক্বকে মেনে নেওয়ার নমুনাও বিদ্যমান রয়েছে। ইবনু আববাস (রাঃ) আলীর ফায়ছালার বিপরীতে নবীর হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, আমি হ’লে কখনো এরূপ করতাম না। ইবনু আববাস (রাঃ) এটা বলেননি যে, আলী যা করেছেন সে বিষয়ে তাঁর নিকটে অবশ্যই কোন না কোন দলীল রয়েছে। বরং যে সত্য স্বয়ং তাঁর নিকটে ছিল তার আলোকে আলীর ফায়ছালার ব্যাপারে তার ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। হযরত আলী (রাঃ)ও তাঁর এ কাজকে ভুল, গোমরাহী বা বেয়াদবী বলেননি। বরং তিনি নিজে স্পষ্ট ভাষায় তাঁর মতামতকে সত্যায়ন ও সমর্থন করেছেন।

৪. ছাহাবীগণ রাসূল (ছাঃ)-এর বিপরীতে কারো কথা মানতেন না।

এ ব্যাপারে খোদ হযরত আলী (রাঃ)-এর নীতিও এর বিপরীত ছিল না। তিনিও এ মূলনীতির অনুসারী ছিলেন যে, যত বড় ব্যক্তিই হোক না কেন তার কথা ও কাজ রাসূলের কথা ও কাজের মোকাবিলায় অনুসরণযোগ্য নয়। এর একটি উদাহরণ ছহীহ বুখারীর একটি বর্ণনায় মওজুদ রয়েছে।

মারওয়ান বিন হাকাম বলেন,شَهِدْتُ عُثْمَانَ، وَعَلِيًّا رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا وَعُثْمَانُ يَنْهَى عَنِ المُتْعَةِ، وَأَنْ يُجْمَعَ بَيْنَهُمَا، فَلَمَّا رَأَى عَلِيٌّ أَهَلَّ بِهِمَا، لَبَّيْكَ بِعُمْرَةٍ وَحَجَّةٍ، قَالَ: مَا كُنْتُ لِأَدَعَ سُنَّةَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِقَوْلِ أَحَدٍ ‘আমি সেই সময় হযরত ওছমান ও আলী (রাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত ছিলাম, যখন হযরত ওছমান (রাঃ) হজ্জে তামাত্তু থেকে নিষেধ করে বলছিলেন, হজ্জ ও ওমরাকে একত্রিত করা উচিত নয়। যখন হযরত আলী (রাঃ) এ ব্যাপারটি লক্ষ করলেন তখন বললেন, لَبَّيْكَ بِعُمْرَةٍ وَحَجَّةٍ এবং বললেন, আমি কারো কথার উপর ভিত্তি করে  নবীর সুন্নাতকে ছেড়ে দিতে পারি না’।[15] 

আলী (রাঃ) নবীর সুন্নাতের মোকাবিলায় ওছমান (রাঃ)-এর ফায়ছালা গ্রহণ করেননি। উল্লেখিত দু’টি বর্ণনায় হযরত ইবনু আববাস ও আলী (রাঃ)-এর কর্মপদ্ধতি থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, স্বয়ং ছাহাবীগণ খোলাফায়ে রাশেদীনের যে মতটি রাসূলের কথা ও কাজের সাথে সাংঘর্ষিক হত তা মেনে নিতেন না। এটাই আহলেহাদীছদের মূলনীতি।

সামগ্রিকভাবে ছাহাবীদের কথা দলীল। কিন্তু যখন তাঁদের পরস্পরের মধ্যে কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিবে তখন এমতাবস্থায় সেই মতটিকে প্রাধান্য দিতে হবে যার স্বপক্ষে দলীল মওজুদ থাকবে। আর কিতাব ও সুন্নাতের মোকাবিলায় কারো কোন কথা গ্রহণ করা যাবে না।

উল্লেখিত ঘটনা দু’টিতে একথাও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কখনো কখনো বড় বড় ছাহাবীদের নিকটেও রাসূলের কোন বাণী পৌঁছত না। এর ফলেও কখনো কখনো তাদের দ্বারা রাসূলের কথা ও কাজের বিপরীত ইজতিহাদ সংঘটিত হয়ে যেত। এরূপ পরিস্থিতিতে অন্য ছাহাবীগণ কল্যাণকামিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদেরকে সতর্ক করে দিতেন।       


[1]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৫৪৬; সুনানে তিরমিযী হা/৩১৪৮; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০৮; ছহীহুল জামে হা/১৪৬৮।

[2]. আবূ সাঈদ হতে ইবনুত তীন বলেন,مَعْنَى قَوْلِهِ لَا تُطْرُونِي لَا تَمْدَحُونِي كَمَدْحِ النَّصَارَى حَتَّى غَلَا بَعْضُهُمْ فِي عِيسَى فَجَعَلَهُ إِلَهًا مَعَ اللهِ وَبَعْضُهُمُ ادَّعَى أَنَّهُ هُوَ الله وَبَعْضهمْ بن الله ইবনুত তীন নবী (ছাঃ)-এর উক্তি ‘আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি কর না’-এর সম্পর্কে বলেছেন, খ্রিষ্টানদের মত তোমরা আমার প্রশংসা কর না। এমনকি তাদের কেউ কেউ ঈসা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল। তারা তাকে আল্লাহর সাথে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছিল। আর তাদের কতিপয় এই দাবী করেছিল যে, ঈসা হলেন আল্লাহ। আর কেউ দাবী করেছিল যে, তিনি আল্লাহর পুত্র। (ফাতহুল বারী, ‘দন্ডবিধি’ অধ্যায়)।

[3]. বুখারী হা/৩৪৪৫, ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়, উমার (রাঃ) হতে

[4]. মুসনাদে আহমাদ হা/১০৯৭; ছহীহা হা/১০৯৭, আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে

[5]. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِى الدِّينِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمُ الْغُلُوُّ فِى الدِّينِ ‘হে লোক সকল! তোমরা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা হতে বেঁচে থাকো। কেননা তোমাদের পূর্বে যারা দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে’ (ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ছহীহুল জামে হা/২৬৮০, ছহীহ; শব্দগুলি ইবনু মাজাহ-এর, ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৪৫৫; ছহীহা হা/১২৮৩)।

[6]. জামিউল বায়ান ১০/১৪৩, তাহক্বীক্ব : আহমাদ শাকের

[7]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৬২৩৭, শু‘আইব আরনাঊত্ব একে ছহীহ বলেছেন।    

[8]. মুসলিম হা/১৭৭।

ومَنْ زَعَمَ أَنَّهُ يعلم مَا فِي غَدٍ، فَقَدْ أَعْظَمَ الْفِرْيَةَ ‘আর যে ধারণা করল যে, তিনি আগামী দিনে কি হবে তা জানেন সে (আল্লাহর উপর) কঠিনভাবে মিথ্যারোপ করল ‘তাফসীরুল কুরআন’ অনুচ্ছেদ হা/৩০৬৮, ছহীহ)।    

[9]. أعظم الفرية على الله من قال : إن محمداً صلى الله عليه وسلم رأى ربه وإن محمداً صلى الله عليه و سلم كتم شيئاً من الوحي وإن محمداً صلى الله عليه و سلم يعلم ما في غد ‘আল্লাহর উপর বড় মিথ্যাচার সে করল যে বলল, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ) তার রবকে দেখেছেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ) অহীর কিছু অংশ গোপন করেছেন এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ) আগামীতে কি হবে তা জানেন’ (আত-তা‘লীক্বাতুল হিসান হা/৬০, ছহীহ)।

[10]. ছহীহ বুখারী হা/১০১০, ‘জুম‘আ’ অধ্যায়     

[11]. তিরমিযী হা/৫৩৪৩; ছহীহুল জামে হা/৫৩৪৩, হাদীছ হাসান    

[12]. ছহীহুল জামে হা/৬২৮৫, সনদ হাসান, ইবনু আববাস (রাঃ) হতে।     

[13]. ছহীহুল বুখারী, হা/৬৯২২।       

[14]. তিরমিযী হা/১৪৫৮, হাদীছ ছহীহ।        

[15]. ছহীহুল বুখারী হা/১৫৬৩



চিন্তার ইবাদত (২য় কিস্তি) - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আকাঙ্ক্ষা : গুরুত্ব ও ফযীলত (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
ধন-সম্পদ : মানব জীবনে প্রয়োজন, সীমালংঘনে দহন (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৭ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
ইসলামে দাড়ি রাখার বিধান (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
বিদায়ের আগে রেখে যাও কিছু পদচিহ্ন (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মোবাইল ব্যবহারের আদব ও সতর্কতা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৫ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
রামাযান ও ছিয়াম সম্পর্কে কতিপয় যঈফ ও জাল বর্ণনা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আরও
আরও
.