শুরুর কথা : বহুল প্রচলিত একটি দৈনিকের ‘তারুণ্য জরিপ-২০১৯’ অনুযায়ী এ দেশের ৩৭.৩ শতাংশ তরুণ দিনে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেন। ১১.২ শতাংশ দিনে দুই এক ওয়াক্ত পড়েন। শুধু শুক্রবারে জুম‘আর ছালাত আদায় করেন এমন তরুণের সংখ্যা ২১.৫ শতাংশ। সাক্ষাৎকার পর্বে প্রতি ১৪ জন তরুণের ১০ জনই বলেছেন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আড্ডা এসব কারণে তরুণেরা ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এছাড়া পরিবার থেকে যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা না করা, তরুণদের পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের ইচ্ছা ইত্যাদি কারণেও অনেকে ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন অনেক তরুণ ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুক্তি খোঁজে, প্রশ্ন তোলে এবং শেষ পর্যন্ত ধর্মচর্চা বাদ দেয়। অবশ্য মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা এখনো ধর্মের ব্যাপারে আগ্রহী। তারা খুব বেশী ধর্মচর্চা না করলেও অন্তত জুম‘আর ছালাত আদায় করেন।[1]
তরুণদের থেকে বয়স্কদের অবস্থা যে খুব একটা পৃথক তা কিন্তু মোটেও নয়। তারাও আংশিকভাবে ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে অভ্যস্ত। এরূপ আংশিক ধর্ম পালন কি কুরআন-সুন্নাহ সম্মত? আল্লাহ তা‘আলা তো ইসলামে পুরোপুরি প্রবেশ করতে আদেশ করেছেন। তিনি বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না’ (বাক্বারাহ ২/২০৮)। আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থের কিছু মানলে এবং কিছু না মানলে তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছনাময় জীবনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন,أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ- ‘তাহ’লে কি তোমরা আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস করবে আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করবে? তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে, তাদের ফলাফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ব্যতীত কিছুই নেই। আর ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে’ (বাক্বারাহ ২/৮৫)।
আমাদের সমাজে ইসলাম মানার চিত্র কিন্তু সেই লাঞ্ছিত জীবনের দিকেই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যতই ইসলামী জীবনাচার পরিত্যাগ করছি এবং পশ্চিমা রীতি-নীতি ও সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হচ্ছি ততই আমাদের সমাজে অপরাধ প্রবণতা ও অস্থিরতা বেড়ে চলছে। বাপ-দাদার ধর্ম হিসাবে যদিও আমরা অনেকেই ইসলামের কিছু ইবাদত-বন্দেগী পালন করি বটে, কিন্তু আমাদের অন্তরে বর্তমানে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে কম-বেশী শিথিলতা দেখা দিচ্ছে।
কুরআন ও হাদীছের আলোকে আল্লাহর পরিচিতি :
মহামহিম আল্লাহর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি এমন এক আবশ্যিক সত্তা, যিনি যাবতীয় পূর্ণাঙ্গ গুণের অধিকারী। কোন প্রকার অপূর্ণতা তাঁর মধ্যে নেই। তাঁর অনেক গুণবাচক নাম আছে। তিনি মহাবিশ্ব ও তার মধ্যস্থিত সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, সংহারকর্তা ও মালিক। তিনি একমাত্র ইলাহ বা মা‘বূদ। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তার কোন শরীক নেই, স্বামী, স্ত্রী, সন্তানাদি কিছুই নেই। তিনি অনাদি, তিনি অনন্ত, তিনি প্রথম, তিনি শেষ, তিনি প্রকাশ্য, তিনি গুপ্ত। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, কারও থেকে জন্মও নেননি। তাঁর মতো কেউ নেই। তিনি কিছু করতে চাইলে ‘হও’ বললেই তা হয়ে যায়। যাবতীয় সৃষ্টির তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। তিনি ব্যতীত আর সবই তাঁর সৃষ্টি। সকল সৃষ্টির অস্তিত্ব লাভ থেকে লয়প্রাপ্তি পর্যন্ত সার্বিক প্রতিপালন তিনিই করেন। এজন্যই তিনি রব। রাজ্য ও ক্ষমতার মালিক তিনি। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দেন, যার থেকে ইচ্ছা তা ছিনিয়ে নেন। তিনি চিরঞ্জীব, অমর এবং সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। সমগ্র বিশ্বের রক্ষণাবেক্ষণে তিনি মোটেও ক্লান্ত হন না।[2]
সবকিছুর তিনি খবর রাখেন। কোন কিছুই তাঁর জানার বাইরে নেই। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি তিন মা‘বূদের একজন নন। যেমনটা খৃষ্টানরা বিশ্বাস করে। তিনি তেত্রিশ কোটি কিংবা অসংখ্য দেব-দেবীর একজন নন। যেমনটা হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মূর্তিপূজারীরা বিশ্বাস করে। তাঁর কোন মূর্তি নেই। কাজেই মূর্তিপূজারীরা যেভাবে তাঁর মূর্তি কল্পনা করে পূজা করে তিনি তার থেকে পবিত্র। এমনও নয় যে, তাঁর কোন অস্তিত্ব নেই। যেমনটা কাফের নাস্তিকরা বলে থাকে। তাঁর সঙ্গে দুনিয়াতে মানুষের সরাসরি দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ নেই। নবুঅতের সিলসিলা জারী থাকাকালে অহি-র মাধ্যমে তাঁর সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। অহিপ্রাপ্ত সেসব মনীষী ছিলেন নবী ও রাসূল। তারাই আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছেন। নবুঅতের ধারায় সর্বশেষ রাসূল ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ)। তিনি ক্বিয়ামত অবধি বিশ্বের সকল জাতির সকল মানুষের নবী। তাকে মহান আল্লাহ তাঁর যে গ্রন্থ দিয়ে সম্মানিত করেছেন তার নাম আল-কুরআন। আল-কুরআন ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল জাতি ও মানুষের জন্য হেদায়াতনামা। কুরআনে এমন সূরা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে আল্লাহর সত্তাবাচক অথবা গুণবাচক নাম ও তাঁর ক্ষমতার কথা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আলোচিত হয়নি।
কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাঁর পরিচয় যে শব্দে যেভাবে এসেছে আক্ষরিক অর্থেই তিনি তেমন। এক্ষেত্রে কোন ব্যাখ্যা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে ছহীহ সূত্রে জানা গেলে তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। কোন আলেম, দরবেশ, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, অধ্যাপক বা যে কেউ আল্লাহ সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ পরিপন্থী কোন কথা কিংবা ব্যাখ্যা বললে তা গৃহীত হবে না।
সমগ্র কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহর পরিচিতি, গুণাবলী, ক্ষমতা ও কার্যাবলীর বর্ণনা ছড়িয়ে আছে। তাঁর পরিচিতি প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারার ২৫৫ নম্বর আয়াত- ‘আয়াতুল কুরছি’, সূরা নূরের ৩৫ নম্বর আয়াত, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত এবং সূরা ইখলাছ পড়ে বুঝে নিলে জ্ঞানীদের জন্য তা একেবারে কম হবে না। কিন্তু এসবই নির্ভর করে মুসলিম হিসাবে সাদা মনে কুরআন-হাদীছ পঠন ও তা বিশ্বাসে নেওয়ার মধ্যে। অন্যথা আল্লাহ সম্পর্কে যেমন বিশ্বাসের ভিন্নতা আসবে তেমনি অন্যান্য ঈমানী বিষয়ের বিশ্বাসেও পার্থক্য সূচিত হবে।
পৃথিবীর অনেক জাতি-ধর্মের লোকেরা মহান আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না; অথবা বিশ্বাস করলেও তাঁর সাথে আরও অনেক দেব-দেবী ও মানুষকে তাদের উপাস্য, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করে। মুসলমানরা আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করলেও অমুসলিমদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাসের কিছু প্রভাব তাদের উপর এসে পড়ছে। ফলে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে মুসলিমদের মধ্যেও কিছুটা শিথিলতা দেখা দিচ্ছে। কেন এ প্রভাব পড়ছে তা জানতে যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি-ধর্মের লোকদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের একটি চিত্র দেখা যেতে পারে।
যুগে যুগে আল্লাহ তথা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস :
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ শুরুর আগে পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। সে সময় বরং সারা বিশ্বের মানুষ যে কোন ধর্মের অধীন থেকে তাদের কল্পনামত বহু সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করত। তখন ইসলামের অনুসারীগণ ব্যতীত খুব কম লোকই এক আল্লাহর আরাধনায় বিশ্বাসী ছিল। সেকালে লোকেদের এক প্রভুতে চলত না। সেজন্য তারা মনগড়া অসংখ্য প্রভু বানিয়ে নিয়েছিল। ভারতের হিন্দুরা তো তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজারী বলে খ্যাত। বৌদ্ধ ধর্ম স্রষ্টায় বিশ্বাসী না হ’লেও খোদ বুদ্ধ এ ধর্মে স্রষ্টার আসন নিয়েছেন। আদিকাল থেকে প্যাগোডাগুলোতে তার মূর্তি অবাধে পূঁজিত হচ্ছে। আসমানী ধর্মের দাবীদার ইহুদী ও খৃষ্টানরা পর্যন্ত এক আল্লাহকে বিশ্বাস করে মনে তৃপ্তি পায়নি। তারা এযরা (উযাইর) ও যিশুকে (ঈসা আঃ) প্রভুপুত্র এবং যিশুর মা মেরি (মারিয়াম আঃ)-কে প্রভুপত্নী বানিয়ে সিনাগগে ও গির্জায় তাদের পূজা-অর্ঘ্য দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতিরা পর্যন্ত তাদের বিশ্বাসমত বিভিন্ন উপাস্য ও স্রষ্টা বানিয়ে নিয়েছিল। যাকে আজকের সমাজবিজ্ঞান টেবু, টোটেম, মনা ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করেছে। এমনকি শক্তিশালী রাজা-বাদশাহরা দেবতাদের পূজা বাদেও নিজেদের পূজা করতে কড়া নির্দেশ দিত। মিশরের ফেরআউন ও ইরাকের নমরূদের প্রভুত্ব দাবীর কথা তো খোদ কুরআনেই রয়েছে।
কুরআনে সূরা নূহে হযরত নূহ (আঃ)-এর জাতির মূর্তিপূজার সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। তিনি ছিলেন আদম (আঃ) পরবর্তী রাসূল। তাঁর জাতি ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াউক ও নাছর নামক মূর্তিসমূহের পূজা করত। তিনি তাদের এসব মূর্তির পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বললে তারা তা মানেনি। ফলে তারা আল্লাহর মহা শাস্তিতে পতিত হয়েছিল। নূহ (আঃ)-এর জাতি থেকে মূর্তিপূজার সূচনা হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। মোটকথা বলা চলে যে, মানুষ সৃষ্টির কিছুকাল পর থেকে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসে সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহ তো ছিলেনই, বরং একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসই ছিল তাদের মহা অসুবিধার। এক স্রষ্টায় বিশ্বাসকে তারা কোনভাবেই মেনে নিতে পারত না। মক্কার কাফের কুরাইশদের এ মনোভাবের কথা কুরআনে এভাবে এসেছে,وَعَجِبُوا أَنْ جَاءَهُمْ مُنْذِرٌ مِنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ، أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ، وَانْطَلَقَ الْمَلَأُ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوا وَاصْبِرُوا عَلَى آلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ، مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي الْمِلَّةِ الْآخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلَّا اخْتِلَاقٌ- ‘আর তারা বিস্ময়বোধ করে যে, তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকেই একজন সতর্ককারী আগমন করেছে। ফলে অবিশ্বাসীরা বলে, এ ব্যক্তি একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী। সে কি বহু উপাস্যের বদলে একজন উপাস্য সাব্যস্ত করতে চায়? নিশ্চয়ই এটাতো এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তাদের নেতারা চলে যায় আর বলে যে, চলো তোমরা তোমাদের উপাস্যদের উপর অবিচল থাক। নিশ্চয় (তাওহীদের) এই দাওয়াতের মধ্যে কোন দূরভিসন্ধি আছে। আমরা তো এ বিষয়ে আমাদের পূর্ববর্তী ধর্ম-সমাজে কিছুই শুনিনি। অতএব এগুলি বানোয়াট ছাড়া কিছুই নয়’ (ছোয়াদ ৩৮/৪-৭)।
বস্ত্তত সে সময় মূর্তিপূজারী ইহূদী, অগ্নিপূজারী খৃষ্টান, ছাবিয়ীন, প্রকৃতিপূজারী যারাই ছিল তারা এক উপাস্যে বিশ্বাসী ছিল না। সেজন্যই নবী করীম (ছাঃ)-এর তাওহীদ বা একত্ববাদের প্রচারকে তারা মেনে নিতে প্রস্ত্তত ছিল না।
মানবজাতির উপর আল্লাহর বড় অনুগ্রহ যে, তিনি সৃষ্টির শুরু থেকে ইসলামকে দ্বীন হিসাবে তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং এজন্য অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে এই তাওহীদী দ্বীন বা ধর্ম ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। তাঁর জীবদ্দশাতেই এই দ্বীনের দাওয়াত এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মাটিতে পৌঁছে যায়। বর্তমানে এটি বিশ্বের সর্বাধিক সম্প্রসারণশীল দ্বীন। এক সময় এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ইসলামী খেলাফত কায়েম ছিল। তখন এক আল্লাহ ও তাঁর ইবাদতে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যাও ছিল যেমন বেশী তেমনি তাদের মর্যাদাও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু স্পেন ও ভারতে ইউরোপীয়দের হাতে মুসলমানদের পরাজয় বরণ এবং ভারতে ইংরেজদের কলোনী প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধীরে ধীরে মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য কমতে থাকে। এক পর্যায়ে প্রায় সকল মুসলিম দেশ ইউরোপের কলোনীতে পরিণত হয়। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও আইন-কানূন তারা মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেয়। ফলে তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানরা আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহীদের শিক্ষা ভুলতে থাকে।
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে শিথিলতার সূচনা :
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে এসে যখন ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটল, বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কারে পৃথিবীর চেহারা পাল্টে গেল, দার্শনিকদের নানা মতবাদ স্রষ্টায় বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সেক্যুলারিষ্টরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে ধর্মকে ব্যক্তিগত পালনীয় বিষয় বানিয়ে দিল তখন থেকে একাধিক প্রভু নয় বরং এক প্রভুর উপর বিশ্বাসও শিথিল হ’তে থাকে। এ সময় থেকে নাস্তিকতার হাওয়াও পৃথিবী জুড়ে প্রবলভাবে বইতে শুরু করে। মানুষ আল্লাহ বা উপাস্যকে বিশ্বাস না করায় কোন জবাবদিহিতা নেই বরং অনেক দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তবুদ্ধি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধর্মচর্চাকে ব্যক্তিগত বিষয় আখ্যা দেওয়ায় প্রগতিশীল ও আধুনিকতার বুলি কপচানো মানুষেরা ধর্মকে জীবন থেকে নির্বাসন দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তাদের আর নৈতিকতার ধার ধারতে হচ্ছে না, আবার সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে ইবাদত-বন্দেগীও করতে হচ্ছে না। বরং অবস্থা এখন এতটাই পাল্টে গেছে যে, বর্তমানে আস্তিক হওয়ার থেকে নাস্তিক হওয়ার মধ্যে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশী। আস্তিক কোন মুসলমান ইসলামের বিধি-বিধান পুরোপুরি মেনে চললে তাকে মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, গোঁড়া, অন্ধবিশ্বাসী, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। দেশ-বিদেশে কোন বোমাবাজি, গোলাগুলি হ’লে চোখ বুঁজে বলে দেওয়া হচ্ছে এটা মুসলিম জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের কাজ। এজন্য কোন যাচাই-বাছাই ও তদন্তের প্রয়োজন পর্যন্ত দরকার মনে হচ্ছে না।
সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনা, মুসলমানরা যার বলি :
১. ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটের গোধরায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ৫৫জন করসেবক হিন্দু আগুনে পুড়ে মারা গেল। দোষ দেওয়া হ’ল মুসলমানদের। গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মারা গেল দুই হাযার মুসলমান। গৃহহারা ও লুটতরাজের শিকার হ’ল লক্ষ লক্ষ মুসলমান। অথচ ২০০৪ সালে এসে তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে দেখা গেল, এটা ছিল নিছক দুর্ঘটনা। কোন মানুষের দেয়া আগুন এটা ছিল না।
২. ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে আমেরিকার নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা তো সারা বিশ্ব তোলপাড় করে ফেলেছিল। টুইন টাওয়ার কে বা কারা ধ্বংস করল আজও তার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। অথচ ঘটনার দিনেই আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ বলে দিয়েছিল এটা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার কাজ। আর সেই অপরাধে বুশ দখল করে নিয়েছিল লাদেনকে আশ্রয়দাতা অত্যন্ত দরিদ্র দেশ আফগানিস্তান। আর শুরু করেছিল কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধ। দাবী করা হয়েছে যে, দু’টি প্লেন সরাসরি টুইন টাওয়ারের আশি ও ষাট তলায় আঘাত হানে। ফলে প্লেনের ধাক্কায় ও জ্বালানি তেলের আগুনে একশ’ দশ তলা বিল্ডিংটি পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে প্লেন আঘাত করেছিল ঠিকই কিন্তু তা আসলে কি কারসাজি ছিল না? ইউটিউবে গেলে এখনও দেখা যাবে, বিল্ডিংটি আগুনে পুড়ে মোমের মতো গলে গলে পড়ছে। কোন কিছু ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে গেলে তো তা ভগ্ন স্থান থেকে কাত হয়ে একটি কৌণিক রেখা তৈরি করে ভেঙ্গে পড়ার কথা। অথচ টুইন টাওয়ার সেভাবে ভেঙে পড়েনি। জ্বালানি তেলের আগুনে গলে পড়া সঠিক হ’লে আরো প্রশ্ন জাগে, দু’টো প্লেনে কত জ্বালানি ছিল? আঘাত লাগল মাঝে, আর সে আঘাতের আগুন সাথে সাথে উপর তলা অবধি পৌঁছে সেখান থেকে কী করে অতবড় বিল্ডিংটি পুড়ে পুড়ে নীচতলা পর্যন্ত বসে গেল? একটুও হেলেদুলে পড়ল না। বার্তা আছে যে, ঐ বিল্ডিয়ে যত ইহূদী কাজ করত তারা সেদিন একজনও কাজে আসেনি। তারা কি আগে থেকেই সব জানত?
৩. ২০২১ সালের ৩১শে আগস্ট তারিখে আমেরিকান সৈন্যদের কাবুল ত্যাগ এবং ১৫ই আগস্ট তালেবান কর্তৃক পুনরায় আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মাধ্যমে এ অসম যুদ্ধ আপাতত শেষ হয়েছে। তাতে ২০ বছরে নিহত হয়েছে আড়াই হাযার মার্কিন সৈন্য, ন্যাটোর সৈন্য যোগে এ সংখ্যা তিন হাযার পাঁচশ’ ছিয়াশি এবং নিহত হয়েছে দশ লাখের বেশী সাধারণ আফগান নাগরিক।[3] নয়া দিগন্তে মাসুম খলিলী ‘তালেবানের জয়ের পর আফগানিস্তান কোথায়’ শিরোনামে লিখেছেন, এই যুদ্ধে প্রাণহানি ঘটেছে দুই লাখ ৪১ হাযার লোকের, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সৈন্য রয়েছে ৩ হাযার ৫৮৫ জন। আফগানিস্তানের সেনা ও পুলিশ সদস্য ৭৮ হাযার ৩১৪ জন, তালেবান ও সরকারের বিপক্ষের যোদ্ধা রয়েছে ৮৪ হাযার ১৯১ জন এবং বেসামরিক নাগরিক ৭১ হাযার ৩৪৪ জন।[4] আহত ও পঙ্গু হয়েছে যে কত লক্ষ তার কোন হিসাব নেই।
বাড়ি-ঘর, স্থাপনা যে কি পরিমাণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার হিসাবই বা কতজন রাখে। ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, সিরিয়া, ইরাক সব জায়গা যারা দখল করে মুসলমানদের রক্ত ঝরাচ্ছে তারা হচ্ছে নিরীহ গোবেচারা। আর যারা মার খেয়ে প্রতিবাদ, আন্দোলন করছে তাদের ভাষায় তারা হয়ে যাচ্ছে জঙ্গি, সন্ত্রাসী। দখলদাররা সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাসী তারা যারা নিজ দেশের আযাদীর জন্য লড়াই করে। এমন একপেশে ও একদেশদর্শী ভাবনা ভয়ঙ্কর শয়তান প্রকৃতির লোকেরা ছাড়া কেউ ভাবতে ও করতে পারে বলে মনে হয় না।
একনিষ্ঠ মুসলিম হওয়ার ঝুঁকি :
এমতাবস্থায় মুসলিম হয়ে, ইসলামের একজন নিবেদিত অনুসারী হয়ে জীবনযাপন যে একান্তই ঝুঁকিপূর্ণ তা দিবালোকের চেয়েও সত্য। তাই এক শ্রেণীর মুসলমানও ইসলামের বিধিবিধান ছেড়ে নিষ্ক্রিয় মুসলিমে পরিণত হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’-এর মতই মুসলিম দেশগুলোর ইলেক্ট্রোনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার মুসলিম নামধারী লেখক, সাংবাদিকগণ কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন-যাপনকারী মুসলিমদের ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, গোঁড়া, মৌলবাদী ইত্যাদি অসম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করে। তাদের এই হীন প্রচার-প্রপাগান্ডা ও ইসলামী শিক্ষার অভাবে মানুষের মনে ইসলামের আকর্ষণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। তাদের কথায় দেশে যেন এখন শান্তির ফলগুধারা আর সুখের নহর বইছে। গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের অধীনে দেশ শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করছে।
ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে তথাকথিত মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীদের নতুন নতুন বুদ্ধি গজাচেছ। সেখানে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা চৌদ্দশ’ বছরের পুরনো অচল ধর্ম এনে দেশটাকে চেŠদ্দশ’ বছর পেছনে ঠেলে দিতে চাইছে।
বস্ত্তত এরা কুরআন-সুন্নাহর শাসন চায় না। এরা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধিকে ইহূদী-খৃষ্টান-হিন্দু-বৌদ্ধদের নিকট ইজারা দিয়ে রেখেছে। মিথ্যার বেসাতিই এখন তাদের ধর্ম। কুরআন-হাদীছের এক কানাকড়ি পরিমাণ মূল্য দিতেও তারা নারায। কুরআনী শাসন তো দূরের কথা এদেশের কিছু মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবীদের কাছে আযানের আওয়াজ পর্যন্ত অসহ্য, এমনকি নিষিদ্ধ নারীদের খদ্দের আহবানের সাথে তুল্য। নাউযুবিল্লাহ। এভাবেই আজ মুসলিম সন্তানরা তাওহীদ ছেড়ে আল্লাহতে অবিশ্বাসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
[ক্রমশঃ]
[1]. প্রথম আলো, ২৬/১২/২০১৯।
[2]. আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে দ্র. বাক্বারাহ ২৫৫; হাশর শেষ ৩ আয়াত; সূরা ইখলাছ প্রভৃতি।
[3]. হাসান ফেরদেŠস, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধের অবসান, প্রথম আলো, ঢাকা, ০১/৯/২০২১।
[4]. ১৭ই আগস্ট ২০২১।