স্থানীয় কারণ :
১. অতীতে ইসলামী শিক্ষার অভাব ২. সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ৩. শী‘আ মতের অনুপ্রবেশ ৪. ঔপনিবেশিক শাসন ও পাশ্চাত্যধারার শিক্ষার প্রভাব ৫. ইসলামী জ্ঞানে গভীরতার অভাব ৬. অসমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব ৭. ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার বহন ৮. হিন্দুয়ানী প্রভাব।
উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছে প্রধানতঃ দু’ভাবে। এক- ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযামের নেতৃত্বে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে এবং দুই- আরব বণিক ও মুহাদ্দিছ ওলামায়ে দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমে। একই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ইসলামের আগমন ঘটেছে ছাহাবায়ে কেরামের যুগে। পরবর্তীতে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০৬ খৃষ্টাব্দে অত্যাচারী ব্রাহ্মণ রাজা লক্ষ্মণ সেনের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। আফগান বিজেতা শিহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ ঘোরী (১১৮৬-১২০৬খৃ.)-এর তুর্কী গোলাম ও সেনাপতি এই ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী মাযহাবের দিক দিয়ে ছিলেন ‘হানাফী’। অপরদিকে নও মুসলিম মোগল শাসকরাও ছিলেন তুর্কীদেরই একটি শাখা। তাঁরা বিজেতা হ’লেও ইসলামের প্রকৃত নমুনা ছিলেন না। তাঁদের শাসন ব্যবস্থাও ইসলামী ছিল না। তাঁদের সঙ্গে আসা ভাগ্যান্বেষী পীর-ফকীরদের ত্যাগী চরিত্র ও অভিনব প্রচার কৌশলে এদেশের বহু লোক মুসলমান হয়ে যায়। কিন্তু এসব বিজেতাদের এবং তাঁদের অনুসরণীয় ছূফী ও দরবেশদের মাধ্যমে যে ইসলাম এ দেশে প্রচারিত হয়, তা ছিল মূল আরবীয় ইসলাম হ’তে বহু দূরে। এখানে যেমন ছিল রায় ও ক্বিয়াসের বাড়াবাড়ি, তদ্রূপ ছিল পীরপূজা, কবরপূজা সহ নানাবিধ শিরক ও বিদ‘আতের ছড়াছড়ি। আলেমদের প্রচারিত বিদ‘আতে হাসানাহর সুযোগে এখানে ইসলামের লেবাস পরে অনুপ্রবেশ করে প্রতিবেশী হিন্দু ও বৌদ্ধদের বহু রসম-রেওয়াজ। ফলতঃ মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজীর সামরিক বিজয়ের প্রায় পৌনে ৬শত বছর পূর্ব থেকে বাংলাদেশের মুসলমানরা যে মূল ও অবিমিশ্র আরবীয় ইসলামে অভ্যস্ত ছিল, তা থেকে তারা ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে এবং ছূফীদের ও শাসকদের চালু করা বিকৃত ইসলামকে যথার্থ ইসলাম ভাবতে শুরু করে। যদিও ব্যতিক্রম সে যুগেও ছিল, এ যুগেও আছে।
পূর্ববর্তী মুসলমানরা ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলতেন এবং তাতে অভ্যস্তও ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে মুসলমানরা ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে এবং খুব কম লোকেই ইসলামের বিধি-বিধান মানতে অভ্যস্ত।
আমাদের এহেন অবস্থা একদিনে হয়নি। এমনটা হওয়ার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে তা উদঘাটনের চেষ্টা করা দরকার। বাংলাদেশের মুসলিম মানসে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে শিথিলতার পিছনে উল্লিখিত সাধারণ কারণগুলোর সাথে স্থানীয় অনেক কারণও যুক্ত রয়েছে। এসব কারণের কিছু ঐতিহাসিক, কিছু শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক এবং কিছু মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগান্ডার সাথে জড়িত। নিম্নে সেগুলোর আলোচনা তুলে ধরা হ’ল।-
অতীতে ইসলামী শিক্ষার অভাব : ব্যবসায়ী ও ছূফী-সাধকদের নিকট যারা ইসলাম গ্রহণ করতেন তারা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাপক শিক্ষা এবং দেশীয় ভাষায় ইসলামকে জানার সুযোগ কমই পেতেন। জানা যায়, ১৭৬৫ সালে বাংলায় ৮০ হাযার মক্তব, মাদ্রাসা ও খানকা ছিল এবং এদের ব্যয় নির্বাহের জন্য দেশের এক চতুর্থাংশ জমি লাখেরাজভাবে (খাজনামুক্ত) বরাদ্দ ছিল। কিন্তু মক্তব, মাদ্রাসা ও খানকাগুলোতে তখন বাংলার বদলে আরবী-ফারসির চর্চাই ছিল বেশী। তাও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা দেওয়া হ’ত। উচ্চশিক্ষা এদেশে চালু ছিল না। ফারসি রাষ্ট্র ভাষা এবং আরবী কুরআন-সুন্নাহর ভাষা বলে এ দু’টির আলাদা কদর ছিল। বাংলা গদ্যের বিস্তার না ঘটায় সুলতানী, মোগল ও নবাবী আমলে বাংলা ভাষায় যেমন কুরআন, হাদীছ, ফিক্বহ, সীরাত ও অন্যান্য ইসলামী বই-পুস্তকের অনুবাদ হয়নি তেমনি প্রামাণ্য মৌলিক কোন গ্রন্থও বাংলায় রচিত হয়নি। ফলে এ দেশের সাধারণ মুসলিম জনগণ ইসলামী জ্ঞান অর্জন ও তাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারেনি। এজন্য মধ্যযুগের মুসলিম কবি-সাহিত্যিকগণ ধর্মীয় ভাবধারায় যেসব পুঁথি রচনা করেছেন তাতে সত্যের চেয়ে অসত্য তথ্যের পরিমাণই বেশী। যেমন, ইউসুফ-জুলেখা, হাতেম তাই, সোনাভান, মকতুল হোসেন, খয়রল হাশর, নূরনামা ইত্যাদি গ্রন্থে অনেক আজগুবি ও কাল্পনিক কথার ছড়াছড়ি রয়েছে। তৎকালীন শিক্ষিত কবিদেরই যদি ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞানের এই দশা হয় তাহ’লে সাধারণ লোকদের ঈমানী ও আমলি অবস্থা কেমন হ’তে পারে তা একবার ভেবে দেখুন। সেই থেকে বাংলার মুসলিম সমাজে কুরআন ও সুন্নাহর কার্যকর অনুশীলন এক রকম নেই বললেই চলে।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব : সুলতানী আমলে যারা বাংলা শাসন করেছেন তাদের মধ্যে প্রায় সবাই সুন্নী মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তারা ইসলামের প্রসার ও ইসলামী শিক্ষার বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেননি। আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ প্রমুখ সুলতান বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ইতিহাসে ব্যাপকভাবে নন্দিত। তাদের আমলে ও পৃষ্ঠপোষক-তায় রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, পুরাণ ইত্যাদি বাংলায় অনূদিত হয়। কিন্তু এই সুলতানরা বাংলার মুসলমানদের জন্য আরবী-ফারসী থেকে কুরআন, হাদীছ ও অন্যান্য প্রামাণ্য ইসলামী বই-পুস্তক অনুবাদের কথা একটুও মাথায় আনেননি। ফলে তাদের সাহিত্যকর্ম দ্বারা হিন্দুরা উপকৃত হয়েছে এবং মুসলমানদের উপর হিন্দুয়ানি প্রভাব বেড়েছে।
ফলতঃ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ মুসলিমদের কুরআন-সুন্নাহর একনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার সুযোগ আগাগোড়াই তেমন মেলেনি। যদিও এ কথা সত্য যে, শাসকগণ মসজিদ-মক্তবের জন্য জমি দান করতেন কিন্তু তারা বাংলাদেশে নিজামিয়া, আল-আযহার, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ মানের কোন মাদ্রাসা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন, ইতিহাস সে কথা বলে না। ভাসা ভাসা শিক্ষা দ্বারা কোন কালেই কুরআন-সুন্নাহর একনিষ্ঠ ও মযবূত অনুসারী হওয়া যায় না এবং অন্যদেরও তা করা যায় না।
শী‘আ মতের অনুপ্রবেশ : শী‘আ মতের অনুপ্রবেশও ইসলামের প্রতি অনাগ্রহ ও উদাসীনতা তৈরিতে কম-বেশী ভূমিকা রেখেছে। মোগল আমলে এসে উপমহাদেশে শী‘আদের প্রভাব ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে; যদিও এদেশের ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ এখন যেমন তখনও তেমন সুন্নী ছিল। সম্রাট হুমায়ুন যখন দ্বিতীয়বার দিল্লীর সিংহাসনে বসেন তখন তিনি ইরানের তৎকালীন সাফাভি বংশের কট্টর শী‘আ শাসকদের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন। শী‘আ মতের পৃষ্ঠপোষকতার শর্তে তিনি সাহায্য পেয়েছিলেন। ফলে মোগল আমলে এদেশে সুন্নীদের তুলনায় শী‘আ সম্প্রদায় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বেশী পেয়েছে। ফলে শী‘আরা ধীরে ধীরে দেশের নেতৃত্বের আসনে জেঁকে বসে।
সম্রাট হুমায়ুন তার নাবালক পুত্র সম্রাট আকবরের অভিভাবক নিযুক্ত করেছিলেন যে বৈরাম খাঁকে তিনি ছিলেন শী‘আ। সম্রাট আকবর ও সম্রাট জাহাঙ্গীর তো দ্বীন-ই-ইলাহী নামে একটা নতুন ধর্মই বানিয়ে নিয়েছিলেন এবং তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। মুজাদ্দিদ আলফে ছানী (রহঃ) চেষ্টা না করলে জাহাঙ্গীর ও পরবর্তী মোগল সম্রাটদের অবস্থা কী দাঁড়াত তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রধান স্ত্রী মেহেরুন্নেসা ওরফে নুরজাহান শী‘আ ছিলেন। অনুরূপভাবে দরবেশ সম্রাট আলমগীরের মা আরজুমন্দ বানু বেগম ওরফে মমতাজ মহলও ছিলেন শী‘আ। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১৭ খৃষ্টাব্দে ইব্রাহীম খান ফতেহ জঙ্গ নামে একজন শী‘আ কর্মচারীকে বাংলার সুবাদারিত্ব প্রদান করেন। তিনি অনেক শী‘আ সহকর্মীদের ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। বাংলার সুবাদার শাহ শুজা‘ সুন্নী হ’লেও মাতুল সম্প্রদায় শী‘আদের ব্যাপক সহায়তা করতেন। ১৭১৭ সালে মুর্শিদাবাদে নবাব মুর্শিদ কুলি খান স্বাধীন নবাব বংশের শাসন শুরু করলে বাংলায় মোগল আধিপত্যের একরকম অবসান ঘটে। তখন থেকে ১৮৮০ সাল পর্যন্ত তিনটি ধারাবাহিক নবাবী বংশ, নাছীরী, আফশার ও নাজাফী- বাংলা শাসন করেছিল এবং তারা সকলেই শী‘আ মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। এজন্য নবাব মুর্শিদ কুলি খান ১০ দিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন। শী‘আদের আক্বীদা-বিশ্বাস ও আমল সুন্নীদের থেকে অনেকাংশে পৃথক। শী‘আ-সুন্নী বৈরিতার ইতিহাসও কম প্রাচীন নয়। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও সাহায্য সহযোগিতাও খুব বেশী ছিল না। কাজেই নবাবী আমলে সুন্নী মুসলিমদের ইসলামী জ্ঞান বৃদ্ধির সম্ভাবনা মোটেও ছিল না।
ঔপনিবেশিক শাসন ও পাশ্চাত্যধারার শিক্ষার প্রভাব : ইংরেজ শাসনামলে ১৮৩৫ সাল থেকে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্তৃক লর্ড মেকলের প্রস্তাবিত পাশ্চাত্য তথা আধুনিক শিক্ষাধারার সূচনা হয়। সেই থেকে বাংলাসহ উপমহাদেশের সকল অঞ্চলে তারা এ শিক্ষা চালু করে। বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আইন কলেজ, মাধ্যমিক স্কুল, প্রাইমারী স্কুল, শিক্ষা প্রশাসন, টেকস্ট বুক প্রকাশনা বিভাগ ইত্যাদির যাত্রাও ইংরেজ আমলে। এ শিক্ষার অধিকারীরা ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীদের জীবনধারা, পারিবারিক জীবন, ক্যারিয়ার গঠন, পোষাক-পরিচ্ছদ, সভ্যতা-সংস্কৃতি, দেশ পরিচালনা, ধর্মপালনের মানসিকতা, চিন্তা, মনন ইত্যাদি দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। তাদেরকে তারা জীবনের রোলমডেল মনে করে। আধুনিক কালের সকল সুযোগ-সুবিধা এদের জন্য অবারিত। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনাও এদের হাতে। এ শিক্ষালাভকারীরা সরকারী-বেসরকারী নানা চাকুরি লাভে সক্ষম। এ শিক্ষা আধুনিক শিল্প-ব্যবসায়ে নিজেকে জড়িত করার সুযোগ করে দেয়। এ শিক্ষা বলতে গেলে এখন অধিকাংশ লোকের আরাধ্য। পার্থিব জীবনমান উন্নয়নে এর বিকল্প আছে বলে মনে করা হয় না। কিন্তু এ ধরনের শিক্ষিতদের অধিকাংশের কাছে ইহজগৎ মূখ্য, আখেরাত গৌণ। জীবনের নানা ক্ষেত্রে ইসলামী জীবনব্যবস্থার চিন্তা তারা মাথায় আনে না, বরং অনেকে বিরোধিতা করে। তারা ইসলামকে পবিত্র জ্ঞান করে এবং রাজনীতির ময়দানে নিয়ে এসে তাকে কলুষিত করতে চায় না।
কুরআন-সুন্নাহতে যে আইন-বিচার ও শাসনের কথা আছে সে সম্পর্কে হয় তারা চোখ বন্ধ করে থাকে অথবা তা মানার গরয বোধ করে না। মূলত এ শিক্ষা তাদের অতিমাত্রায় ইহজাগতিক ও বস্ত্তবাদী করে তোলে। ফলে তাদের কাছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ইসলামী বিধিবিধান পালন এবং আখেরাতের নিমিত্তে নেক আমল সাধন গৌণ হয়ে ওঠে।
ইসলামী জ্ঞানে গভীরতার অভাব : ইসলামী জ্ঞানে গভীরতার অভাবে আধুনিক শিক্ষাধারায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ইসলামী বিধি-বিধান পালনে তৎপর হ’তে মন থেকে প্রেরণা লাভ করেন না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সাংবাদিক, সামরিক-বেসামরিক অফিসার, কর্মচারী, এমপি, মন্ত্রী যারা বিভিন্ন পেশায় আছেন তাদের ইসলামের উপর একাডেমিক জ্ঞান খুবই সীমিত। প্রাইমারি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ইসলাম শিক্ষা নামে একটি বিষয় থাকলেও তা কতটুকু আর মনে আছে? ঐ পড়ার ভিত্তিতে তারা না পারেন কুরআন-সুন্নাহ বুঝতে, না পারেন তদনুসারে আমল করতে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ পড়েন তাদেরও বেশীর ভাগ ইসলাম জানার জন্য নয়; বরং অন্য ভালো সাবজেক্ট না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে পড়েন। এখানে ডিগ্রি অর্জন মূখ্য। তাহ’লে দেখা যাচ্ছে এসএসসি পাশের পর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া বাকি জীবনে ইসলাম শিক্ষা লাভের কোন ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সাংসারিক ও পেশাগত ব্যস্ততায় তাদের বেশীর ভাগের সে উদ্যোগ নেওয়া হয়ে ওঠে না। ফলে ইসলাম সম্পর্কে একাডেমিক জ্ঞানের অভাবে তাদের ইসলাম মানার উদ্যোগ আয়োজন গতানুগতিক ধারার ঊর্ধ্বে ওঠে না।
অসমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব : ইসলামী শিক্ষার সাথে সমন্বয় করে একমুখী আধুনিক শিক্ষা চালু করলে যে দেশের মানুষের ধর্মীয় ও জাগতিক চেতনা সমৃদ্ধ হ’ত জাতীয় পর্যায়ে সে চিন্তা কখনই করা হয়নি। বরং উল্টো মাদ্রাসা শিক্ষাকে ইংরেজি ধারার সাথে একাকার করার চেষ্টা চলছে। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষিতরাও এখন ইসলামের মূল স্প্রিট ভুলে অমুসলিমদের নিয়ম-নীতি ও কৃষ্টি-কালচার বরণ করতে দ্বিধা করছে না। এসব কারণেও দ্বীনের প্রতি উদাসীনতা বাড়ছে।
ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার বহন : ইংরেজরা এদেশ থেকে চলে গেলেও আমরা এখনও তাদের প্রবর্তিত আইন, বিচার, শাসন, কৃষ্টি ও শিক্ষাব্যবস্থার উত্তরাধিকার বহন করে চলছি। ইংরেজরা যে ইসলামী শাসন ও বিচার ব্যবস্থা মুসলিম শাসকদের থেকে পেয়েছিল সেদিকে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আমাদের নেই। এদেশের সাধারণ শিক্ষিতদের অনেকে তো বরং ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে পরিত্যক্ত ও ব্যাকডেটেড বলে উপহাস করে।
হিন্দুয়ানী প্রভাব : প্রাকবৃটিশ ও বৃটিশ আমলে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের উপর হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব ছিল। তারা যে দ্বীন-ধর্ম হিসাবে ইসলামকে খুব সঠিকভাবে জানতেন ও মানতেন তার প্রমাণ মেলা ভার। তৎকালীন শিক্ষিত কবি-সাহিত্যিকরা ইসলাম কেমন জানতেন, আর হিন্দু ধর্মই বা তাদের কাছে কেমন প্রিয় ছিল তার কিছু নমুনা ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ বই থেকে এখানে তুলে ধরা হ’ল।-
বর্তমানকালের সাহিত্যসেবী বুদ্ধিজীবীরা এদের লেখার ভূয়সী প্রসংসা করেন, কিন্তু বিষয়টি তলিয়ে দেখেন না। ইসলাম সম্পর্কে এদের জ্ঞান আহামরি কিছু ছিল না। শিক্ষিতজনদের হালই যদি এমন হয় তাহ’লে সাধারণ মানুষের ঈমানী অবস্থা ও আমল-আখলাক কেমন হ’তে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
ক. ‘নুরুন্নেহার ও কবির কথা’ নামক গীতিকাব্যের রচয়িতা লিখেছেন :
‘বিছমিল্লাহ ও শ্রী বিষ্ণু এক-ই কথা। আল্লাহ দুই অংশে বিভক্ত হইয়া রাম রহীম হইয়াছেন’।
খ. শ্রী চৈতন্য মুসলমানদের যবন, ম্লেচ্ছ, ন্যাড়া ইত্যাদি নামে ডাকতেন। এতে মুসলমানদের প্রতি তার ভালোবাসা না ঘৃণা, কোনটা ছিল তা ফুটে ওঠে। চৈতন্য ন্যাড়া আব্দুল্লাহ ওরফে হরিদাসকে একদিন জিজ্ঞেস করছেন,
একদিন প্রভু হরিদাসেরে মিলিলা।
তাঁরে লঞা গোষ্ঠী তাঁহারে পুছিলা।
হরিদাস! কলিকালে যবন অপার।
গো-ব্রাহ্মণ হিংসা করে মহা-দুরাচার।
ইহা সবার কোন মতে হইবে নিস্তার।
তাহার হেতু না দেখিয়ে, দুঃখ অপার।
হরিদাস কহে প্রভু! চিন্তা না করিহ।
যবনের সংসার দেখি, দুঃখ না ভাবিহ।
যবন সকলের মুক্তি, হবে অনায়াসে।
‘হারাম’! ‘হারাম’! বলি কহে নামাভাসে।
মহাপ্রেমে ভক্ত কহে, হারাম! হারাম!
যবনের ভাগ্য দেখ, লয় সেই নাম।
যদ্যপি অন্যত্র সংকেতে হয় নামাভাস।
তথাপি নামের তেজ না হয় বিনাশ।
মুসলমান ‘হারাম’ বলে যে ‘রাম নাম’ করে তাতেই তাদের মুক্তি হবে বলে ন্যাড়া হরিদাস তার প্রভু শ্রী চৈতন্যকে আশ্বস্ত করছে।
গ. মুসলিম হয়ে জন্মগ্রহণও কোন কোন কবির কাছে নিন্দনীয় অনুশোচনাযোগ্য বিষয় ছিল। ভক্ত কবি লাল মামুদ বৈষ্ণব সংস্রবে এসে ক্রমে ক্রমে তাদের ধর্মের প্রতি গভীর আস্থাবান হয়ে পড়েন। তিনি হিন্দুর মতো আচার-ব্যবহার করতে থাকেন। ... একটি বটবৃক্ষমূলে তুলসী গাছ স্থাপন করে রীতিমতো সেবা পূঁজা করতে থাকেন। ... যেদিন গোস্বামী প্রভু লালুর (লাল মামুদের) আশ্রমে এসেছিলেন সেদিন তার খসড়া হ’তে নিম্নলিখিত গানটি গেয়ে লাল মামুদ সকলকে কাঁদিয়ে দিয়েছিলেন।
দয়াল হরি কৈ আমার,
আমি পড়েছি ভব কারাগারে, আমার কে করে উদ্ধার।।
বড় রিপুর জ্বালা প্রাণে, সহ্য হয় না আর।
শত দোষের দোষী বলে, জন্ম দিলে যবন কুলে
বিফলে গেল দিন আমার।
আমি কুলধর্ম্মে পরম ধর্ম্ম বলে, যত করলাম কদাচার।।
যদিও তুমি আল্লা খোদা, তুমি লক্ষ্মী, তুমি সারোদা,
স্বত্ব, রজঃ ত্রিগুণের আধার
তবু হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ বলে ডাকতে প্রাণ কাঁদে আমার।
মনের খেদে বলিতেছি এবার
হরি বলে প্রাণ যায় যেন আমার।।
বৈষ্ণব ঠাকুর শ্রী চৈতন্যকে উদ্ধারকর্তা বিশ্বাস করে মরমী সাধক লালন শাহ গাইছেন:
পার কর চাঁদ গৌর আমার- বেলা ডুবিল,
আমার হেলায় হেলায় অবহেলায় দিন তো বয়ে গেল।
আছে ভব-নদীর পাড়ি
নিতাই চাঁদ কান্ডারি।
কুলে বসে বোধন করি।
ও চাঁদ গৌর এইসেছে,
ও চাঁদ গৌর হে কুলে বইসেছে।
আরও কুল-গৌরবিনী যারা কুলে থাকে তারা
ও কুল ধুইয়া কি জল খাইব?
ও চাঁদ গৌর যদি পাই,
ও চাঁদ গউর হে,
কুলে দিয়ে ছাই- ফকির লালন বলে- শ্রীচরণে দাসী হইব।
একইভাবে খিজিরকে উদ্ধারকর্তা বিশ্বাস করে মরমী কবি পাগলা কানাই (ঝিনাইদহ) গাইছেন-
দেওয়ান খেজের চাঁদ- ও আমায় দেও আসি আসান।
পাগলা কানাই ডাকে তোমায়- সামনে দেখি তুফান।।
ও তোমার নামের মহিমা আল্লা কোরানে বলে
আমি দেশ-বিদেশে ফিরত্যাছি ওই নামের-ই বলে
ওরে খেজের নামের জোরে যেমন আগুন হয় পানি
পানিতে সমুদ্রে বিপদে হয় আসানি...।
আধুনিক কবি-সাহিত্যিকরাও কিন্তু পীর-মুর্শিদের কাছে প্রার্থনায় কম যান না। যেমন- কবি জসীমুদ্দীন তার ‘পল্লিজননী’ কবিতায় লিখেছেন :
নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,
ছেলেরে তাহার ভালো করে দাও কাঁদে জননীর প্রাণ।
ভালো করে দাও আল্লা রসূল ভালো করে দাও পীর,
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর!
কবি শামসুর রাহমান ‘তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় লিখেছেন :
তোমার জন্যে,
ছগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্টদাস জেলেপাড়ার সেই সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাযী গাযী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে।
এই পল্লীজননী ও মতলব মিয়ারা কাল্পনিক চরিত্র। তারা এসব কবিদের জীবন দর্শন তথা বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করে। সন্তানের সুস্থতার জন্য দরগায় দান এবং রাসূল ও পীরের কাছে প্রার্থনা আর নদী পাড়ি দিতে গাযী গাযী বলা, যবন হরিদাস, লাল মামুদ, লালন শাহ ও পাগলা কানাইদের রকমফের মাত্র। শিরক ও কুসংস্কারের যে সংজ্ঞা আমরা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জানি তাতে এসব কথা ঈমান বিরোধীই বটে। বরং এসব কথা ও বিশ্বাসে ঈমান থাকে না।
মোটকথা, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞানের অভাব, পাশ্চাত্য জীবনধারার অন্ধ অনুকরণ, বিজাতীয় সংস্কৃতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ, যুগের চাহিদা পূরণে মাদ্রাসা শিক্ষার অপারগতা, ইসলামী শিক্ষার সাথে প্রচলিত শিক্ষার সমন্বয়ের অভাব, ইসলামপন্থীদের নীচু নযরে দেখা, জাগতিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত হওয়া, ভোগবাদি মানসিকতা, ইসলামী বিধিবিধানের পক্ষে সরকারী আনুকুল্যের অভাব ইত্যাদি কারণে আজ এ দেশের মুসলিম মানসে ইসলামী বিশ্বাসে শিথিলতা এবং ইসলামী বিধিবিধান পালনে অনাগ্রহ ও উদাসীনতা দেখা দিয়েছে।
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস সুদৃঢ়করণে মুসলিম হিসাবে করণীয় : আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে শিথিলতা এবং দ্বীনের বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালনে অলসতা ও অনীহা একটি বড় সমস্যা। এটি যত না ব্যক্তিগত সমস্যা তার থেকেও বেশী সামাজিক সমস্যা। একে সমস্যা হিসাবে উপলব্ধি করাও অত্যন্ত যরূরী। সমস্যা হিসাবে মনে করলে তখনই আসবে তা সমাধানের চিন্তা। যা কিছু লক্ষ্য অর্জনে বাধা সৃষ্টি করে তাই সমস্যা। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। এ লক্ষ্যে প্রত্যেককে কাজ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলাই সকল ক্ষেত্রে তাওফীক্ব দাতা। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, মানব সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে সকল মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অর্থ: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। আর গ্রন্থপ্রাপ্তরা তাদের কাছে সুনিশ্চিত জ্ঞান আসার পরেই কেবল যিদ বশত এ নিয়ে মতপার্থক্য করছে। ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। যারা অন্য জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তাদের আখেরাতে চরম মূল্য দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যে ইসলাম ব্যতীত অন্য দ্বীন তালাশ করবে তা তার থেকে কস্মিনকালেও গৃহীত হবে না। আর সে আখেরাতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)। যারা কেবল দুনিয়া চায় আখেরাতে তাদের কোনই অংশ মিলবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অনন্তর মানুষের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে কেবল দুনিয়াতে দাও। এই ধরনের লোকদের জন্য আখেরাতে কোনই অংশ নেই’ (বাক্বারাহ ২/২০০)। সুতরাং আখেরাত বরবাদ করে দুনিয়া নয়।
আবার যারা দুনিয়া ত্যাগ করে আখেরাতের ফিকিরে ব্যস্ত দুনিয়াপন্থীদের হাতে তাদের দ্বীন দুনিয়া উভয়ই সংকীর্ণ হয়ে পড়া অসম্ভব নয়। আমরা বাহ্যচোখে দেখি, বর্তমান দ্বীনবিমুখ ক্ষমতাধরগণ তাদের অধীনস্থ জনগণকে নিজেদের চাহিদা মতো দ্বীন পালন করতে দেয়। মুসলিম প্রধান অমুসলিম প্রধান উভয় দেশের সরকারের ক্ষেত্রে এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য।
যারা দুনিয়া আখেরাত উভয় জগতে সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা চায় এবং সে লক্ষ্যে যথোচিত কাজ করে দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য কেবল তাদের ভাগ্যে মিলবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তাদের মাঝে অনেকে বলে, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখেরাতে কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’ (বাক্বারাহ ২/২০১)। এই শ্রেণীর লোকই প্রকৃত সাফল্য ও কল্যাণের হকদার। তাই স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সকল শিক্ষিতজনসহ যাদের লেখাপড়ার সুযোগ মিলেছে কিংবা মেলেনি তাদের সবার নিকট আরয, আমরা যেন বুঝে-শুনে বিজ্ঞজনচিত আচরণ করি। অনুশীলনকারী মুসলিম হিসাবে আমাদের নিষ্ক্রিয় ও বিরুদ্ধবাদী মুসলিম ও অমুসলিম ভাই-বোনদের জন্য চেষ্টা-সাধনা করতে কুরআন-হাদীছের আলোকেই আমরা দায়বদ্ধ। আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব বুঝার চেষ্টা করি এবং তা পালনে সক্রিয় হই। আল্লাহই সকল কাজের তাওফীক্বদাতা।
[ক্রমশঃ]