পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ ।
তৃতীয় প্রকার : توحيد الأسماء والصفات (তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত) তথা আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীর একত্ব :
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর অনেক সুন্দর সুন্দর ও সর্বোত্তম নাম ও
গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। যেগুলোর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা ঈমানের
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আল্লাহ বলেন, وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
فَادْعُوْهُ بِهَا ‘আর আল্লাহর রয়েছে সর্বোত্তম নাম সমূহ। সুতরাং তোমরা
তাঁকে সেই সব নামেই ডাকবে’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِيْنَ إِسْمَا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ
أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ- ‘আল্লাহর নাম সমূহের মধ্যে নিরানববই অর্থাৎ
এক কম একশটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি তা গণনা করবে বা মুখস্থ করবে সে
জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[1]
আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করার গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা : মাহান আল্লাহ আমাদেরকে আশরাফুল মাখলূকাতের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। দান করেছেন অফুরন্ত নে‘মতরাজী। যার কোন একটির শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা সম্ভব নয়। দিয়েছেন সুষ্ঠুভাবে জীবন পরিচালনার যাবতীয় উপকরণ। প্রস্ত্তত রেখেছেন তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য পুরস্কার স্বরূপ চীরস্থায়ী শান্তির আবাস জান্নাত। সেই আল্লাহ সম্পর্কে জানতে কার না ইচ্ছা হয়? প্রত্যেক মুমিন বান্দার অন্তর তাঁর সম্পর্কে জানার জন্য অধীর আগ্রহে ব্যকুল থাকে। যে যত বেশী আল্লাহকে চিনবে ও জানবে, সে তত বেশী আল্লাহর নৈকট্য হাছিলে সক্ষম হবে। সে সর্বদা একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করবে। ভয় করবে একমাত্র আল্লাহকেই। আল্লাহকে বাদ দিয়ে সে অন্য কারো সামনে মাথা নত করবে না। ফলে দুনিয়ার কোন কিছুই তাকে পরাজিত করতে পারবে না। আর তাঁর সম্পর্কে জানার অন্যতম মাধ্যম হ’ল, তাঁর নাম সমূহ ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। আল্লাহর নাম সমূহের একটি হ’ল الرزاق (আর-রায্যাক) তথা রিযিকদাতা। যে ব্যক্তি আল্লাহর এই নামটি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে, সে কেবল আল্লাহকেই রিযিকদাতা হিসাবে বিশ্বাস করবে। সে কখনোই রিযিক লাভের জন্য মূর্তির কাছে যাবে না। যাবে না কোন পীর, দরবেশ, অলী-আওলিয়ার কবরের কাছে সন্তান চাওয়ার জন্য। বরং একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইবে। আল্লাহর অপর একটি নাম হ’ল الشافي (আশ-শাফী) তথা আরোগ্য দানকারী। যে আল্লাহর এই নামটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে, সে কেবল আল্লাহকেই আরোগ্যদানকারী হিসাবে বিশ্বাস করবে এবং একমাত্র আল্লাহর কাছেই সুস্থতা কামনা করবে। এর জন্য কখনই ল্যাংটা বাবা, পানি বাবা, মাটি বাবা, চরমোনাই, আটরশী, শাহজালাল, শাহমখদুম ইত্যাদি বাবার কাছে যাবে না। অনুরূপভাবে আল্লাহ হ’লেন السميع والبصير তথা সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। যে ব্যক্তি আল্লাহকে সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা হিসাবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করবে, সে যাবতীয় প্রকাশ্য ও গোপনীয় পাপ থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হবে। কেননা সে যখনই কোন পাপে লিপ্ত হবে, তখনই স্মরণ করবে যে আল্লাহ তার সবকিছুই দেখছেন ও লিপিবদ্ধ করছেন। ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ সেই লিপিবদ্ধ আমলনামা হাতে দিয়ে বলবেন, اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا ‘তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর; আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট’ (বানী ইসরাইল ১৭/১৪)। তাই আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা এবং এক্ষেত্রে তাঁকে এক (একক) মানা অতীব যরূরী। কেননা যে তিনটি ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক (একক) না মানলে মুসলিম হওয়া যায় না, সে তিনটির একটি হ’ল,توحيد الأسماء والصفات (তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত) তথা আল্লাহকে তাঁর নাম সমূহ ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে এক (একক) মানা।
আসমাউছ ছিফাত সম্পর্কিত কতিপয় মূলনীতি
১. আল্লাহর সকল নামই حسنى ‘হুসনা’ তথা সর্বোত্তম : আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী, যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলোই সর্বোত্তম। অর্থাৎ আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর কোনটিকে কোনটির উপর প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। বরং সবগুলোকেই সর্বোত্তম বলে বিশ্বাস করতে হবে। কেননা তাঁর নাম সমূহ পরিপূর্ণ গুণে গুণান্বিত; যাতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণও ঘাটতি নেই। আর তাই তো তিনি নিজেই কুরআন মাজীদের চারটি আয়াতে তাঁর নাম সমূহকে হুসনা বা সর্বোত্তম বলে উল্লেখ করেছেন।
1- وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوْهُ بِهَا-
১. ‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নাম সমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেই সব নামেই ডাকবে’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)।
2- قُلِ ادْعُوا اللهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوْا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى-
২. বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহবান কর অথবা ‘রহমান’ নামে আহবান কর, তোমরা যে নামেই আহবান কর না কেন, সর্বোত্তম নাম সমূহ তো তাঁরই! (বানী ইসরাইল ১৭/১১০)।
3- اللهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى-
৩. ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। সর্বোত্তম নাম সমূহ তাঁরই’ (ত্বহা ২০/৮)।
4- هُوَ اللهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِيْ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ-
৪. ‘তিনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবক, রূপদাতা। সর্বোত্তম নাম সমূহ তাঁরই। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (হাশর ৫৯/২৪)।
২. আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা নির্ধারিত : আল্লাহ তা‘আলা যেমন তাঁর সর্বোত্তম নাম সমূহের মাধ্যমে তাঁকে আহবান করার নির্দেশ দিয়েছেন; তেমনি তিনি তাঁর নাম সমূহ কুরআন মাজীদে বর্ণনাও করেছেন। তাই কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত নাম সমূহের বাইরে কোন নামে আল্লাহকে ডাকা জায়েয নয়। কেননা আল্লাহর জন্য শোভনীয় নাম সমূহ ও গুণাবলী মানুষের বিবেক দ্বারা নির্বাচন করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহর গুণাবলীর বিষয়টি গায়েবী। যা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। আল্লাহ বলেন, وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ‘আর আল্লাহর নিকটেই রয়েছে গায়েবের চাবি-কাঠি। তিনি ব্যতীত কেউ তা জানে না’ (আন‘আম ৬/৫৯)। তাই আল্লাহকে খোদা, ঈশ্বর, ভগবান, গড ইত্যাদি নামে ডাকা জায়েয নয়। কেননা আল্লাহর নির্ধারিত নামের বাইরে অন্য কোন নামে ডাকা মানেই তাঁর সম্বন্ধে ইলম বিহীন কথা বলা। আর আল্লাহ তা‘আলা ইলম বিহীন তাঁর সম্বন্ধে কথা বলাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন,
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوْا بِاللهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُوْلُوْا عَلَى اللهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ-
‘বল, আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ, যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপরে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না’ (আ‘রাফ ৭/৩৩)।
৩. আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী অসংখ্য : আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীর সংখ্যা কত তা মানুষের অজানা। কেননা রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করেছেন এই মর্মে যে,
أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَداً مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِيْ كِتَابِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِيْ عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ...-
‘হে আল্লাহ!
আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার ঐ সকল নামের দ্বারা যা আপনি নিজেই
আপনার নফসের জন্য নামকরণ করেছেন। অথবা আপনি আপনার সৃষ্টির মাঝে পসন্দনীয়
কোন ব্যক্তিকে শিখিয়েছেন। অথবা আপনি যা আপনার কিতাবে (কুরআন) অবতীর্ণ
করেছেন। অথবা আপনি আপনার নিকট তা ইলমে গায়েবের ভান্ডারে সংরক্ষিত
রেখেছেন’...। [2]
অত্র হাদীছে রাসূল (ছাঃ)
প্রার্থনা করেছেন আল্লাহর ঐ সমস্ত নামের দ্বারা যা তিনি তাঁর ইলমে গায়েবের
মধ্যে সংরক্ষিত রেখেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যা ইলমে গায়েবের মধ্যে সংরক্ষিত
রেখেছেন তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অতএব আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলী
নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা অনির্দিষ্ট। এমনকি ইমাম আবু
বকর ইবনুল আরাবী তাঁর ‘আরেযাতুল আহওয়াযী ফী শারহে তিরমিযী’র মধ্যে উল্লেখ
করেছেন যে, কিছু ওলামায়ে কেরাম কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আল্লাহর এক হাযার নাম ও
গুণাবলী জমা করেছেন।[3]
উল্লেখ্য যে, আমরা
অনেকেই আল্লাহর নাম ৯৯টি বলে জানি। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ
لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِيْنَ اسْمَا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ
أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ- ‘আল্লাহর নিরানববই অর্থাৎ এক কম একশটি নাম
রয়েছে, যে ব্যক্তি তা মুখস্থ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[4]
সম্মানিত পাঠক! উল্লিখিত হাদীছের মাধ্যমে আল্লাহর নাম ৯৯টির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়নি। যদি ৯৯টির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হ’ত তাহ’লে হাদীছের ইবারত এরূপ হওয়া যরূরী হ’ত যে, إِنَّ أَسْمَاءَ اللهِ تِسْعَةٌ وَتِسْعُوْنَ اِسْمًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নাম ৯৯টি’। কিন্তু হাদীছে বলা হয়েছে إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِيْنَ اسْمَا ‘আল্লাহর ৯৯টি নাম রয়েছে।
যেমন- যদি
বলা হয় যে, আমার নিকটে একশত টাকা রয়েছে; যা আমি দান করার জন্য প্রস্ত্তত
রেখেছি। এটা যেমন আমার টাকাকে একশত টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে না; বরং আমার
নিকট আরো টাকা রয়েছে, যা আমি অন্য কাজে ব্যয় করতে পারি। তদ্রূপ আল্লাহর
৯৯টি নাম রয়েছে। এটাও আল্লাহর নাম সমূকে ৯৯টির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে না; বরং
আল্লাহর আরো অনেক নাম রয়েছে।[5]
৪. মুসলমানদের উপর আল্লাহর নামের বিকৃতিকরণ থেকে সতর্ক থাকা ওয়াজিব : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوْهُ بِهَا وَذَرُوْا الَّذِيْنَ يُلْحِدُوْنَ فِيْ أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ-
‘আর আল্লাহর জন্য সর্বোত্তম নাম রয়েছে। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেই সব নামেই ডাকবে, আর তাদেরকে বর্জন কর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে। সত্ত্বরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেয়া হবে’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)।
সম্মানিত পাঠক! অত্র আয়াতে আল্লাহ তাঁর নাম বিকৃতকারীদেরকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর আল্লাহর নামের বিকৃতি কয়েকভাবে হ’তে পারে। যেমন-
(১) আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীর কোন কিছুকে অস্বীকার করার মাধ্যমে বিকৃতকরণ। যেমনভাবে মু‘তাযিলা, জাহমিয়া, কাদারিয়া ইত্যাদি বিভ্রান্ত ফিরক্বা সমূহ মহান আল্লাহ সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন যুক্তিতে তাঁর ছিফাত বা বিশেষণ ও কর্মকে অস্বীকার করেছে। তাদের নিকটে আল্লাহর ছিফাত সমূহ যা পবিত্র কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে তা রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে। যেমন আল্লাহর হাতকে কুদরতী হাত, আল্লাহর পা কুদরতী পা ইত্যাদি।
(২) আল্লাহর ছিফাত বা বিশেষণকে সৃষ্টির ছিফাত বা বিশেষণের সাথে সাদৃশ্য করার মাধ্যমে বিকৃতকরণ। যেমনভাবে মুজাসসিমা বা মুশাবিবহা বিভ্রান্ত ফিরক্বা আল্লাহর ছিফাত বা বিশেষণকে সৃষ্টির বিশেষণের মত বলে কল্পনা করেছে। যেমন আল্লাহর হাত মানুষের হাতের মত, আল্লাহর পা মানুষের পায়ের মত ইত্যাদি।
(৩) আল্লাহকে এমন নামে নামকরণ করা যা তিনি নামকরণ করেননি। যেমন খৃষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র নামকরণের মাধ্যমে আল্লাহকে তার পিতা হিসাবে নামকরণ করেছে। নাঊযুবিল্লাহ।
(৪) আল্লাহর নাম সমূহ থেকে অন্যান্য বাতিল মা‘বূদদের নামকরণ করার মাধ্যমে বিকৃত করা। যেমনভাবে মক্কার মুশরিকরা তাদের পূজনীয় মুর্তি ‘লাত’ নামটি আল্লাহর নাম ‘ইলাহ’ থেকে নিয়েছে। ‘উয্যা’ নামটি আল্লাহর নাম ‘আল-আযীয’ থেকে নিয়েছে। ‘মানাত’ নামটি আল্লাহর নাম ‘আল-মান্নান’ থেকে নিয়েছে ইত্যাদি।
উল্লিখিত ফিরক্বা সমূহ আল্লাহর নামের বিকৃতি ঘটিয়েছে। এদের থেকে সতর্ক থাকা মুসলামানদের জন্য ওয়াজিব।
توحيد الأسماء والصفات (তাওহীদুল আসমা ওয়াছ ছিফাত)-এর পরিচয় : এর সংজ্ঞা বর্ণনায় মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন (রাঃ) বলেন,
هو إفراد الله تعالى بأسمائه وصفاته، وذلك بإثبات ما أثبته الله لنفسه من الأسماء والصفات في كتابه، أو على لسان رسوله صلى الله عليه وسلم من غير تحريف ولا تعطيل ولا تكييف ولا تمثيل.
এটা আল্লাহ তা‘আলার নাম সমূহ ও
গুণাবলীকে এক ও অদ্বিতীয়রূপে বিশ্বাস করা। আর আল্লাহ যেভাবে তাঁর নাম সমূহ
ও গুণাবলীকে তাঁর কিতাবে সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর
মুখনিঃসৃত বাণী দ্বারা সাব্যস্ত করেছেন, তা পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সাদৃশ্য ও
দৃষ্টান্ত ব্যতীত সাব্যস্ত করা।[6]
আল-আক্বীদাতুছ ছাফিয়াহ গ্রন্থ প্রণেতা ড. সাইয়েদ সাঈদ আব্দুল গনী (রহঃ) বলেন,
هو الإيمان بأسماء الله وصفاته كما جاءت في القرآن الكريم، وفي سنة النبي صلى الله عليه وسلم، وذلك على ما يليق بالله سبحانه وتعالى، وعلى ما أراده الله تعالى بدون تحريف ولا تعطيل ولا تكييف ولا تمثيل.
এটা হ’ল,
আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী কুরআনুল কারীম এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর সুন্নাতে
যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই বিশ্বাস করা। যা আল্লাহ তা‘আলার মহান শানে
সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আল্লাহ তা দ্বারা যে উদ্দেশ্য গ্রহণ করেছেন তা
পরিবর্তন, হ্রাসকরণ, সাদৃশ্য ও দৃষ্টান্ত ব্যতীত বিশ্বাস করা।[7]
আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী সম্পর্কে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাহ : এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল,
(১) কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী যেভাবে বর্ণিত হয়েছে বাহ্যিকভাবে সেগুলির শব্দ ও অর্থকে তারা সেভাবেই সাব্যস্ত করেন। তার বহ্যিক স্থান, শব্দ ও উদ্দিষ্ট অর্থ হ’তে কোনরূপ পরিবর্তন ও ব্যাখ্যা করেন না।
(২) আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীর কোন কিছুকেই তারা অস্বীকার করেন না। যেমনভাবে মু‘তাযিলা, জাহমিয়া, কাদারিয়া ইত্যাদি বিভ্রান্ত ফিরক্বা সমূহ মহান আল্লাহ সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন এই যুক্তিতে তাঁর ছিফাত বা বিশেষণ সমূহকে অস্বীকার করেছে।
(৩) তারা আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করেন না। বরং আল্লাহর গুণাবলীর স্বরূপ ও প্রকৃতি আল্লাহর দিকেই সোপর্দ করেন। যেমন- কুরআনে আল্লাহর হাত, পা, মুখমন্ডল ইত্যাদির বর্ণনা এসেছে। তারা আল্লাহর এ সকল গুণাবলীর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করেন। কিন্তু তারা এ সকল গুণাবলীকে সৃষ্টির মত কল্পনা করেন না। কেননা আল্লাহ বলেছেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيرُ ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)।
(৪) তারা আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীর সরল ও স্বাভাবিক অর্থের বাইরে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করেন না। অর্থাৎ তাঁরা এমন ব্যাখ্যা করেন না যে, আল্লাহর হাত অর্থ তাঁর কুদরত বা ক্ষমতা অথবা তাঁর নে‘মত। আল্লাহর ক্রোধ অর্থ তাঁর শাস্তি এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্থ তাঁর পুরস্কার ইত্যাদি। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর ছিফাত বা বিশেষণ বাতিল করে দেওয়া। বিভ্রান্ত মু‘তাযিলা ও ক্বাদারিয়া সম্প্রদায় এরূপ রূপক অর্থ করে থাকে।
(৫) আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করতে গিয়ে তারা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের গন্ডী অতিক্রম করেন না। ফলে আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) যে সকল নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন তারা কেবল সেগুলোই সাব্যস্ত করেন। আর যেগুলো নিষেধ করেছেন সেগুলো থেকে বিরত থাকেন। আর যে বিষয়ে চুপ থেকেছেন সে বিষয়ে চুপ থাকেন।
আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলীর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ চার ইমামের আক্বীদাহ : আয়িম্মাতুল আরবা‘আ তথা ইমাম আবু হানীফা (রহঃ), ইমাম শাফেঈ (রহঃ), ইমাম মালেক (রহঃ) ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) সকলেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁদের আক্বীদা বিশ্লেষণ করলেই তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
(১) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর আক্বীদাহ : আল্লাহর ছিফাত সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন, لا ينبغي لأحد أن ينطق في ذات الله بشيء، بل يصفه بما وصف به نفسه، ولا يقول فيه برأيه شيئا تبارك الله تعالى رب العالمين-
‘আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে কোন প্রকার
কথা বলা কারো জন্য আদৌ সমীচীন নয়। বরং তিনি যেরূপে তাঁর পবিত্র গুণাবলী
বর্ণনা করেছেন সেরূপেই তা সাব্যস্ত করবে। কোন ক্রমেই কেউ তাঁর ছিফাত বা
বিশেষণ সম্পর্কে নিজস্ব রায় প্রদান করবে না। আল্লাহ বরকতময় ও মহান,
বিশ্বজগতের প্রতিপালক।[8]
তিনি আরো বলেন,
‘মহান আল্লাহ সৃষ্টির বিশেষণে বিশেষিত হন না। তাঁর ক্রোধ ও সন্তুষ্টি তাঁর
বিশেষণসমূহের দু’টি বিশেষণ কোন স্বরূপ নির্ণয় ব্যতিরেকে। এটিই আহলুস
সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বক্তব্য। মহান আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট
হন। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর ক্রোধ অর্থ তাঁর শাস্তি এবং তাঁর সন্তুষ্টি
অর্থ তাঁর পুরস্কার। আল্লাহ নিজে নিজেকে যেরূপে বিশেষিত করেছেন, আমরাও
তাঁকে সেভাবেই বিশেষিত করব। তিনি একক, অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি
এবং তিনি জন্ম গ্রহণও করেননি এবং কেউ তাঁর সমকক্ষ নয়। তিনি চিরন্তন,
চিরঞ্জীব, ক্ষমতাবান, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, জ্ঞানী। আল্লাহর হাত তাদের
হাতের উপর, তাঁর হাত তাঁর সৃষ্টির হাতের মত নয়; তা অঙ্গ নয়, তিনি হস্ত
সমূহের স্রষ্টা। তাঁর মুখমন্ডল তাঁর সৃষ্টির মুখমন্ডলের মত নয়; তিনি সকল
মুখমন্ডলের স্রষ্টা। তাঁর নফস তাঁর সৃষ্টির নফসের মত নয়, তিনি সকল নফসের
স্রষ্টা। (আল্লাহ বলেন) ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা,
সর্বদ্রষ্টা’।[9]
তিনি আরো বলেন, ‘তাঁর
(আল্লাহ) হাত আছে, মুখমন্ডল আছে এবং নফস বা সত্তা আছে। কারণ আল্লাহ কুরআনে
এগুলি উল্লেখ করেছেন। আর কুরআনুল কারীমে আল্লাহ যা উল্লেখ করেছেন, যেমন-
মুখমন্ডল, হাত, নফস ইত্যাদি সবই তাঁর ছিফাত বা বিশেষণ কোন স্বরূপ ও প্রকৃতি
নির্ণয় ব্যতিরেকে। এ কথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর কুদরত বা
ক্ষমতা অথবা তাঁর নে‘মত। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা করার অর্থ আল্লাহর ছিফাত বা
বিশেষণ বাতিল করে দেওয়া। এরূপ ব্যাখ্যা করা ক্বাদারিয়া ও মু‘তাযিলা
সম্প্রদায়ের রীতি। বরং তাঁর হাত তাঁর ছিফাত বা বিশেষণ কোন স্বরূপ নির্ণয়
ব্যতিরেকে। তাঁর ক্রোধ এবং তাঁর সন্তুষ্টি তাঁর দু’টি ছিফাত বা বিশেষণ
আল্লাহর বিশেষণ সমূহের অন্তর্ভুক্ত কোন স্বরূপ ও প্রকৃতি নির্ণয়
ব্যতিরেকে’।[10]
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রধান শিষ্য প্রসিদ্ধ তাবে-তাবেঈ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু হাসান আশ-শায়বানী (রহঃ) বলেন,
اتفق الفقهاء كلهم من المشرق إلى المغرب على الإيمان بالقرآن والأحاديث التي جاء بها الثقاة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم في صفة الرب عز وجل من غير تفسير ولا وصف ولا تشبيه، فمن فسر اليوم شيئا من ذلك فقد خرج مما كان عليه النبي صلى الله عليه وسلم وفارق الجماعة؛ فإنهم لم يصفوا ولم يفسروا، ولكن أفتوا بما في الكتاب والسنة ثم سكتوا، فمن قال بقول جهم فقد فارق الجماعة؛ فإنه قد وصفه بصفة لا شيء-
‘পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল দেশের
ফক্বীহগণ সকলেই একমত যে, মহান আল্লাহর বিশেষণ সম্পর্কে কুরআন ও রাসূল (ছাঃ)
থেকে ছহীহ সনদে বর্ণিত হাদীছগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে, কোনরূপ পরিবর্তন,
বিশেষায়ন এবং তুলনা ব্যতিরেকে। যদি কেউ বর্তমানে সেগুলোর ব্যাখ্যা করে তবে
সে রাসূল (ছাঃ)-এর পথ ও পদ্ধতি পরিত্যাগকারী এবং জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন।
কারণ তাঁরা এগুলোকে বিশেষায়িত করেননি এবং ব্যাখ্যাও করেননি। বরং তাঁরা
কুরআন ও সুন্নাতে যা বিদ্যমান তার ভিত্তিতে ফৎওয়া দিয়েছেন, অতঃপর নীরব
থেকেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি জাহম-এর মত গ্রহণ করবে সে ব্যক্তি (ছাহাবী ও
তাবেঈদের) জামা‘আত পরিত্যাগ করবে। কারণ সে আল্লাহকে নেতিবাচক বিশেষণে
বিশেষিত করে।[11]
(২) ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর আক্বীদাহ : ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর অন্যতম শিষ্য ইউনুস ইবনু আব্দুল আ‘লা বলেন, আমি আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী সম্পর্কে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
لِلَّهِ تَعَالَى أَسْمَاءٌ وَصِفَاتٌ جَاءَ بِهَا كِتَابُهُ وَأَخْبَرَ بِهَا نَبِيُّهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُمَّتَهُ، لا يسع أحد مِنْ خَلْقِ اللهِ قَامَتْ عَلَيْهِ الْحُجَّةُ رَدُّهَا؛ لِأَنَّ الْقُرْآنَ نَزَلَ بِهَا وَصَحَّ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْقَوْلُ بِهَا فِيْمَا رَوَى عَنْهُ الْعُدُوْلُ فَإِنْ خَالَفَ ذَلِكَ بَعْدَ ثُبُوتِ الْحُجَّةِ عَلَيْهِ فَهُوَ كَافِرٌ، أَمَّا قَبْلَ ثُبُوتِ الْحُجَّةِ عَلَيْهِ فَمَعْذُوْرٌ بِالْجَهْلِ؛ لِأَنَّ عِلْمَ ذَلِكَ لَا يُدْرَكُ بِالْعَقْلِ وَلَا بِالرُّؤْيَةِ وَالْفِكْرِ وَلَا يَكْفُرُ بِالْجَهْلِ بِهَا أَحَدٌ إِلَّا بَعْدَ انْتِهَاءِ الْخَبَرِ إِلَيْهِ بِهَا وَتُثْبَتُ هَذِهِ الصِّفَاتُ وَيَنْفِي عَنْهَا التَّشْبِيهَ كَمَا نَفَى التَّشْبِيهَ عَنْ نَفْسِهِ تَعَالَى فَقَالَ سُبْحَانَهُ : لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ-
‘আল্লাহর নাম সমূহ ও গুণাবলী রয়েছে। কুরআনে
সেগুলির উল্লেখ রয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ) স্বীয় উম্মতকে তা জানিয়ে দিয়েছেন।
যার কাছে তার দলীল সাব্যস্ত হয়েছে তার জন্য তা প্রত্যাখ্যান করার কোন সুযোগ
নেই। কেননা কুরআনে তা অবতীর্ণ হয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ) থেকে ছহীহ সনদে
বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এগুলো বলেছেন, তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন,
ন্যায়পরায়নগণ কারো কাছে বিষয়গুলি প্রমাণিত হওয়ার পরেও সে যদি বিরোধিতা করে
তবে সে ব্যক্তি কাফির। তবে যদি কেউ তার নিকট প্রমাণিত হওয়ার পূর্বে
বিরোধিতা করে তাহ’লে সে অজ্ঞতার কারণে মা‘যূর। কারণ এ বিষয়ক জ্ঞান মানবীয়
বিবেক-বুদ্ধি, যুক্তি, গবেষণা ও চিন্তা -ভাবনার মাধ্যমে অর্জন করা যায় না।
কাজেই কেউ যেন কারো নিকটে এ বিষয়ক (কুরআন-হাদীছের) সংবাদ পৌঁছানোর পূর্বে
তার অজ্ঞতার কারণে কাউকে কাফির বলে গণ্য না করে। তিনি এ সকল ছিফাত বা
বিশেষণ বিশ্বাস করতেন এবং এগুলি থেকে তুলনা অস্বীকার করতেন। কারণ মহান
আল্লাহ নিজেই নিজের তুলনীয় হওয়ার বিষয়টি বাতিল ঘোষণা করে বলেছেন, কোন কিছুই
তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’।[12]
(৩) ইমাম মালেক (রাঃ)-এর আক্বীদাহ : ওয়ালীদ ইবনু মুসলিম (রহঃ) বলেন,
سألت مالكاً، والثوري، والأوزاعي، والليث بن سعد عن الأخبار في الصفات فقالوا أمِرّوها كما جاءت-
‘আমি
ইমাম মালেক, ছাওরী, আওযাঈ এবং লাইছ ইবনু সা‘দ (রহঃ)-কে আল্লাহর ছিফাত বা
বিশেষণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তদুত্তরে তাঁরা সকলেই বলেছেন যে, ছিফাত
বা আল্লাহর গুণাবলী বিষয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে যেরূপভাবে এসেছে ঠিক
তদ্রূপেই ঈমান আনয়ন কর।[13]
জা‘ফর ইবনু
আব্দিল্লাহ (রহঃ) বলেন, আমরা একদা মালেক ইবনু আনাস (রহঃ)-এর নিকটে উপস্থিত
ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি সূরা ত্বহার ৫নং আয়াত তেলাওয়াত করে বললেন,
আল্লাহ কিভাবে আরশের উপর সমুন্নীত? তখন ইমাম মালেক (রহঃ) বললেন,
الِاسْتِوَاءُ مَعْلُومٌ وَالْكَيْفُ مَجْهُولٌ وَالْإِيمَانُ بِهِ وَاجِبٌ
وَالسُّؤَالُ عَنْهُ بِدْعَةٌ- ‘ইস্তিওয়া বা আরশে সমুন্নীত হওয়া জ্ঞাত, এর
পদ্ধতি বা স্বরূপ অজ্ঞাত, এর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা
বিদ‘আত’।[14]
(৪) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর আক্বীদাহ :
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, لم يزل الله عزَّ وجلَّ متكلماً، ولا
يوصف الله بشيءٍ أكثر مما وصف به نفسه عزَّ وجلَّ- ‘মহান আল্লাহ সর্বদা
কথা বলেন। আর আল্লাহর গুণাবলী স্বয়ং তিনি যেরূপে বর্ণনা করেছেন তদপেক্ষা
অধিক বর্ণনা করা যাবে না’।[15] তিনি আরো বলেন, صفوا الله بما وصف به نفسه،
وانفُوا عن الله ما نفاه عن نفسه- ‘তোমরা ঐরূপে আল্লাহর ছিফাত সমূহকে
বর্ণনা কর যেরূপে আল্লাহ নিজেই বর্ণনা করেছেন। আর আল্লাহ যা নিজের জন্য
নিষেধ করেছেন তোমরাও তা থেকে বিরত থাক’।[16]
[চলবে]
[1]. বুখারী হা/২৭৩৬, ৬৪১০, ৭৩৯২; মুসলিম হা/২৬৭৭।
[2]. মুসনাদে আহমাদ হা/৩৭১২; মিশকাত হা/২৪৫২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৯; ছহীহ তারগীব হা/১৮২২।
[3]. তাফসীর ইবনু কাছীর, আ‘রাফ ৭/১৮০নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।
[4]. বুখারী হা/২৭৩৬, ৬৪১০, ৭৩৯২; মুসলিম হা/২৬৭৭।
[5]. মুহাম্মাদ বিন ছালেহ আল-উছায়মীন, আল-ক্বাওয়াইদুল মুছলা পৃঃ ১৪।
[6]. তাক্বরীবুত তাদমরিয়্যাহ পৃঃ ১১৬।
[7]. আল-আক্বীদাহ আছ-ছাফিয়্যাহ পৃঃ ৩৩৩।
[8]. শারহু আক্বীদাতিত ত্বহাবিয়্যাহ, তাহক্বীক : ড. তুরকী পৃঃ ২/৪২৭; মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান খুমাইস, উছূলুদ দ্বীন ইনদা আবী হানীফা পৃঃ ২৯৯।
[9]. ইমাম আবু হানীফা (রহঃ), আল-ফিক্বহুল আবসাত, পৃঃ ৫৬-৫৭; শারহুল মুয়াস্সার আলাল ফিক্বহায়নি আল-আবসাত ওয়াল আকবার, তাহক্বীত; ড. মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান খুমাইস, পৃঃ ১৫৯।
[10]. ইমাম আবু হানীফা (রহঃ), আল-ফিক্বহুল আকবার, শারহ : মুল্লা আলী ক্বারী (হানাফী), পৃঃ ৯১-৯৩; শারহুল মুয়াস্সার আলাল ফিক্বহায়নি আল-আবসাত ওয়াল আকবার, পৃঃ ২৭।
[11]. ছাঈদ নিসাপুরী, আল-ই‘তিক্বাদ পৃঃ ১৭০; লালকায়ী, শারহু উছুলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত ৩/৪৩২-৪৩৩ পৃঃ।
[12]. হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী, মুখতাছারুল উলু, তাহক্বীক : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, পৃঃ ১৭৭; হাফেয ইবনু আহমাদ ইবনু আলী আল-হাকামী, মা‘আরিজুল কুবূল, পৃঃ ১/৩৬৫।
[13]. দারাকুত্বনী, আছ-ছিফাত, পৃঃ ৭৫; বায়হাক্বী, আল-ই‘তিক্বাদ, পৃঃ ১১৮।
[14]. বায়হাক্বী, আসমা ওয়াছ ছিফাত, পৃঃ ৪০৭; ছাবূনী, আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবুল হাদীছ, পৃঃ ১৭-১৮।
[15]. হাম্বল বিন ইসহাক বিন হাম্বল, কিতাবুল মিহনা, পৃঃ ৬৮।
[16]. ইবনুল জাওযী, মানাকিবে আহমাদ, পৃঃ ২২৮; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৫৯১ পৃঃ।