ভূমিকা :

দুনিয়াতে বান্দা যা কিছু করে ও বলে সবকিছু লিপিবদ্ধ করা হয়। ‘সম্মানিত লেখক ফেরেশতাবৃন্দ সবকিছু লিখে রাখেন’ (ইনফিত্বার ৮২/১১)। ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে তার কাছে সদা উপস্থিত সংরক্ষণকারী রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৮)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُبِيْنٍ ‘আর প্রতিটি বস্ত্তকেই আমি সুস্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষণ করে রেখেছি’ (ইয়াসীন ৩৬/১২)। وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَابًا يَلْقَاهُ مَنْشُورًا، اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا. ‘আর ক্বিয়ামতের দিন আমরা তাকে বের করে দেখাব একটি আমলনামা, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে। (সেদিন আমরা বলব,) তুমি তোমার আমলনামা পাঠ কর। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১৩-১৪)। ‘সবাইকে তাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে’ (নাহল ১৬/৯৩; হিজর ১৫/৯২-৯৩)। পরিশেষে আমল অনুপাতে তাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। এমনকি ‘অণু পরিমাণ ভাল কাজ করলে, সে তা দেখতে পাবে এবং অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে সেও তা দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭)। ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে তার দুনিয়াবী ছোট-বড়, গোপন-প্রকাশ্য, কথা ও কর্ম তথা সব আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তন্মধ্যে কিছু বিষয় কিতাব ও সুন্নাহতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলি সম্পর্কে বান্দাকে সেদিন জিজ্ঞেস করা হবে, যাতে বান্দা সেসব বিষয়ে সতর্ক থাকে, সেগুলির হেফাযত করে, নিজে ও অন্যরাও এসবের হেফাযত না করার ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারে ও এগুলিকে বেশি ভয় করে এবং যত্নবান হয়। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ্।

১. কবরে তিনটি প্রশ্ন করা হবে :

পরকালীন জীবনের সর্বপ্রথম মনযিল কবর। কবরে বান্দাকে তিনটি বিশেষ প্রশ্ন করা হবে। তবে কবরের প্রশ্ন ক্বিয়ামতের দিনের প্রশ্ন হ’তে ভিন্ন। বারা বিন আযিব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, কবরে বান্দাকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। এক. তোমার রব কে? তারপর তাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে, তোমার দ্বীন কি? অতঃপর তৃতীয় প্রশ্নটি করা হবে, এই লোকটি কে ছিলেন, যাকে তোমাদের নিকটে প্রেরণ করা হয়েছিল? বান্দা যদি মুমিন হয়, তাহ’লে এগুলির যথাযথ জওয়াব দিতে পারবে। আর যদি বেঈমান বা কাফির হয়, তাহ’লে বলবে, আফসোস আমি কিছুই জানি না’।[1]

২. ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ছালাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে :

হক দু’প্রকার। এক. আল্লাহর হক। দুই. বান্দার হক। আল্লাহর হকগুলির মধ্যে ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হিসাব নেয়া হবে ছালাতের। যেমন আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,

إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ النَّاسُ بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ أَعْمَالِهِمُ الصَّلاَةُ قَالَ يَقُولُ رَبُّنَا جَلَّ وَعَزَّ لِمَلاَئِكَتِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ انْظُرُوا فِى صَلاَةِ عَبْدِى أَتَمَّهَا أَمْ نَقَصَهَا فَإِنْ كَانَتْ تَامَّةً كُتِبَتْ لَهُ تَامَّةً وَإِنْ كَانَ انْتَقَصَ مِنْهَا شَيْئًا قَالَ انْظُرُوْا هَلْ لِعَبْدِى مِنْ تَطَوُّعٍ فَإِنْ كَانَ لَهُ تَطَوُّعٌ قَالَ أَتِمُّوا لِعَبْدِى فَرِيضَتَهُ مِنْ تَطَوُّعِهِ ثُمَّ تُؤْخَذُ الأَعْمَالُ عَلَى ذَاكُمْ-

‘নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন মানুষের আমলসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম ছালাতের হিসাব নেয়া হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমাদের মহীয়ান গরীয়ান রব ফেরেশতাদেরকে বলবেন অথচ তিনি সর্বাধিক অবগত, ‘তোমরা আমার বান্দার ছালাত দেখ, সে তা পরিপূর্ণ করেছে, না অসম্পূর্ণ রেখেছে’। যদি পূর্ণ হয়, তাহ’লে পূর্ণই লেখা হবে। আর যদি তাতে কিছু কমতি থাকে, তাহ’লে তিনি বলবেন, ‘তোমরা দেখ আমার বান্দার কোন নফল (ছালাত) আছে কি না’। যদি তার নফল ছালাত থাকে তিনি বলবেন, ‘আমার বান্দার ফরযের ঘাটতিকে নফল দ্বারা পূর্ণ কর’। অতঃপর এভাবেই অন্যান্য আমলসমূহকে গ্রহণ করা হবে’।[2]

অন্য বর্ণনায় এসেছে,فَإِنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأَنْجَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ- ‘তার ছালাত যদি সঠিক হয়, তাহ’লে সে সফলকাম ও কৃতকার্য হবে। আর তা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তাহ’লে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে’।[3] অর্থাৎ ছালাত যদি শুদ্ধ হয়, রুকূ, সিজদা, ক্বিয়াম-কুঊদ, খুশু-খুযূ সহ সময় মত আদায় করে। আর যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তথা আদায় করেনি অথবা অশুদ্ধ হয়েছে অথবা গৃহীত হয়নি, তাহ’লে সে ছওয়াব লাভে ব্যর্থ হবে এবং শাস্তি ভোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আর বান্দার হকগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম বিচার করা হবে অন্যায় রক্তপাত বা হত্যার। যেমন ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَوَّلُ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ الصَّلَاةُ، وَأَوَّلُ مَا يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ فِي الدِّمَاءِ- ‘সর্বপ্রথম বান্দার ছালাতের হিসাবে নেয়া হবে। আর মানুষের পরস্পরের মাঝে সর্বপ্রথম বিচার করা হবে রক্তপাত বা অন্যায় হত্যার’।[4] উল্লেখ্য, হাদীছের আলোকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর হক ও বান্দার হকের মধ্যে সর্বপ্রথম আল্লাহর হকের হিসাব নেয়া হবে।

৩. পাঁচটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে :

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,

لاَ تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عِنْدِ رَبِّهِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ وَمَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ-

‘ক্বিয়ামতের দিন পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত আদম সন্তানের পা তার রবের নিকট হ’তে নড়বে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, সে তা কিভাবে কাটিয়েছে। তার যৌবনকাল সম্পর্কে, সে তা কিভাবে শেষ করেছে। তার সম্পদ সম্পকে,র্ সে তা কোথা হ’তে উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে। আর সে যে জ্ঞান অর্জন করেছে, সে বিষয়ে কি আমল করেছে’।[5]

৪. আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতগুলি সম্পর্কে :

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে দুনিয়াতে অসংখ্য নে‘মত দান করেছেন। তিনি বলেন, وَإِن تَعُدُّوْا نِعْمَةَ اللهِ لَا تُحْصُوْهَا ‘তোমরা যদি আল্লাহর নে‘মতকে গণনা কর, তাহ’লে তা গণনা করে শেষ করতে পারবে না’ (নাহল ১৬/১৮)। আর এ সকল নে‘মত সম্পর্কে তিনি তাঁর বান্দাদের জিজ্ঞেস করবেন, যাতে সে তা স্বীকৃতি দেয় এবং এর হক আদায় করেছে কি না তা জানতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন,ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ ‘তোমরা সেদিন অবশ্যই নে‘মতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’ (তাকাছুর ১০২/৮)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) একদা দিনে অথবা রাতে বেরিয়ে পড়েন। হঠাৎ আবু বকর ও উমরের সাথে তার দেখা হল। তিনি তাদের দু’জনকে বললেন, ‘কোন প্রয়োজন তোমাদেরকে এই সময়ে বাড়ি থেকে বের করেছে’? তারা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ক্ষুধা। তিনি বললেন, ‘আমিও তাই। সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আমাকে সে জিনিসই ঘর থেকে বের করেছে যা তোমাদেরকে বের করেছে। চল দেখি’। ফলে তাঁরাও তাঁর সাথে চলতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তারা একজন আনছারী লোকের বাড়িতে এসে পৌঁছলেন। দেখলেন তিনি বাড়িতে নেই। তবে তার স্ত্রী রাসূল (ছাঃ)-কে দেখতে পেয়ে বললেন, মারহাবা! সুস্বাগতম! রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, অমুক কোথায়? তিনি বললেন, আমাদের জন্য সুস্বাদু পানি আনতে গেছেন। ঠিক তখনি আনছারী লোকটি আসলেন। এসে রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর দুই সাথীকে দেখে বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ! আজ আমার চেয়ে সম্মানিত অতিথি আর কেউ পায়নি। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তিনি গিয়ে এক গুচ্ছ ফল নিয়ে এলেন, যাতে রয়েছে শুকনো, পাকা ও কাঁচা খেজুর। তারপর বললেন, আপনারা এগুলি থেকে খেতে থাকুন। এই বলে তিনি ছুরি নিলেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘সাবধান দুধওয়ালা (ছাগল) যবাই করো না’। তিনি তাঁদের জন্য (ছাগল) যবেহ করলেন এবং তারা সেই ছাগলের গোস্ত ও থোকা থেকে ফল খেলেন এবং পানও করলেন। যখন তারা তৃপ্ত ও পিপাসামুক্ত হ’লেন, তখন রাসূল (ছাঃ) আবূ বকর ও উমরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা এই নে‘মত সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। ক্ষুধা তোমাদেরকে বাড়ি থেকে বের করেছিল, অতঃপর তোমরা ফেরার পূর্বেই এই নে‘মত পেয়ে ধন্য হ’লে’।[6] 

তিরমিযীতে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَالََّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مِنَ النَّعِيمِ الَّذِي تُسْأَلُونَ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ظِلٌّ بَارِدٌ وَرُطَبٌ طَيِّبٌ وَمَاءٌ بَارِدٌ. ‘সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন যে সকল নে‘মত সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে তা হ’ল, শীতল ছায়া, পবিত্র খেজুর ও ঠান্ডা পানীয়’।[7]

রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ أَوَّلَ مَا يُسْأَلُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَعْنِي الْعَبْدَ مِنْ النَّعِيمِ أَنْ يُقَالَ لَهُ أَلَمْ نُصِحَّ لَكَ جِسْمَكَ وَنُرْوِيَكَ مِنْ الْمَاءِ الْبَارِدِ. ‘নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন বান্দা সর্বপ্রথম যে নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে তা হ’ল তাকে বলা হবে, আমরা কি তোমার শরীরকে সুস্থ রাখিনি এবং ঠান্ডা পানি দ্বারা তোমাকে পরিতৃপ্ত করিনি’?[8]

আর নে‘মতের হক হ’ল এর শুকরিয়া আদায় করা, অর্থাৎ আল্লাহর নে‘মত সম্পর্কে বলা, তাঁর আনুগত্যে এবং বৈধ কাজে সেগুলিকে ব্যবহার করা। যদি কোন ব্যক্তি এগুলি করে, তাহ’লে সে যেন এসবের হক আদায় করল এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। সে আল্লাহর সন্তষ্টি লাভেও ধন্য হবে। আর যদি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় না করে, তাহ’লে সে যেন নে‘মতকে অস্বীকার করল। আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الله لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَأْكُلَ الأَكْلَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا، أَوْ يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا. ‘আল্লাহ্ তা‘আলা ঐ বান্দার ওপর অবশ্যই সন্তষ্ট হন, যে কোন খাদ্য খেলে এর জন্য তাঁর প্রশংসা করে। অথবা কোন পানীয় পান করলে এর জন্য তাঁর প্রশংসা করে’।

৫. ইলম, শ্রবণ, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে :

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُولًا ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, হৃদয় প্রত্যেকটির বিষয়ে তোমরা (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৬)

কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, لا تقل رأيت ولم تر، وسمعت ولم تسمع، وعلمت ولم تعلم، فإن الله تعالى سائلك عن ذلك كله ‘তুমি বল না যে, আমি দেখেছি অথচ আদৌ দেখনি। আমি শুনেছি অথচ আদৌ শুননি। আমি জানি অথচ জানো না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এসবকিছু সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করবেন’।

কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর এসবকিছুই মহান রবের দেয়া বড় নে‘মত। আর এগুলি সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন আমাদের জিজ্ঞেস করা হবে, সেগুলি কি আল্লাহর আনুগত্যে ও সৎকাজে ব্যবহার করে এগুলির শুকরিয়া আদায় করা হয়েছে, না এগুলি আল্লাহর অবাধ্য ও পাপাচারের কাজে লাগানো হয়েছে? সুতরাং এগুলির সদ্ব্যবহার করতঃ শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কিন্ত অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে গাফেল। মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ هُوَ الَّذِي أَنشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَّا تَشْكُرُونَ ‘বল, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দান করেছেন কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয়। কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (মুল্ক ৬৭/২৩)

৬. জিহাদ, ইলম ও সম্পদের মত তিনটি বড় নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে :

ক্বিয়ামতের দিন বান্দাকে আল্লাহ প্রদত্ত যে সকল বড় নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে তন্মধ্যে রয়েছে ইলম, সম্পদ ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। তার কাছে জানতে চাওয়া হবে, সে এগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহর যে হক রয়েছে তা যথাযথ আদায় করেছে কি-না? সে কি এগুলির হেফাযত করেছে, না সেগুলি নষ্ট করেছে? আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে লোকটির ফায়ছালা করা হবে সে হ’ল একজন শহীদ। তাকে নিয়ে আসা হবে। তাকে তার নে‘মতগুলি স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে এবং সেও তা চিনতে পারবে। আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি এবিষয়ে কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি তোমার রাস্তায় যুদ্ধ করেছি, এমনকি শাহাদত বরণও করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি যুদ্ধ করেছ এজন্য যে, তোমাকে যেন বীর বলা হয়। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেয়া হবে তাকে টেনেহেঁচড়ে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে। ফলে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আর এক ব্যক্তি যে জ্ঞান অর্জন করেছে এবং তা অন্যকে শিক্ষাও দিয়েছে। আর সে কুরআন তিলাওয়াত করতো। তাকে নিয়ে আসা হবে। তিনি তাকে তার নে‘মতগুলি স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সে তা স্মরণ করবে। তিনি তাকে বলবেন, তুমি এসব নে‘মতের কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি এবং তা অন্যকেও শিক্ষা দিয়েছি। তোমার সন্তুষ্টির জন্য কুরআন তিলাওয়াতও করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি জ্ঞান অর্জন করেছ যাতে তোমাকে বলা হয় সে আলিম এবং কুরআন পড়েছ যাতে তোমাকে বলা হয় সে ক্বারী। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেয়া হবে তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে, ফলে তাই করা হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তি যাকে আল্লাহ অনেক প্রাচুর্য দান করেছেন। সর্বপ্রকার সম্পদ তাকে দিয়েছেন। তাকেও নিয়ে আসা হবে। তাকে তার নে‘মতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে এবং সেও তা স্মরণ করবে। তাকে বলবেন, তুমি এসবের ব্যাপারে কি আমল করেছ? সে বলবে, যে পথে খরচ করলে তুমি সন্তষ্ট হও এমন সব ক্ষেত্রে আমি তোমার সন্তষ্টির জন্যে খরচ করেছি। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি তা করেছ যাতে তোমাকে বলা হয় দানবীর। সুতরাং তা বলা হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেয়া হবে তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে, ফলে তাই করা হবে’।[9]

৭. অঙ্গীকার সম্পর্কে :

ক্বিয়ামতের দিন আমাদের দেয়া অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন,وَأَوْفُواْ بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُولًا ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৪)। তিনি আরো বলেন,وَلَقَدْ كَانُوا عَاهَدُوا اللهَ مِن قَبْلُ لَا يُوَلُّونَ الْأَدْبَارَ وَكَانَ عَهْدُ اللهِ مَسْؤُولًا- ‘অথচ তারা ইতিপূর্বে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না। বস্ত্ততঃ আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে’ (আহ্যাব ৩৩/১৫)

৮. কুফর ও শিরক সম্পর্কে :

দুনিয়াতে যারা কুফরী করে ও আল্লাহর সাথে শরীক করে, তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। মহান আল্লাহ্ বলেন,تَاللهِ لَتُسْأَلُنَّ عَمَّا كُنتُمْ تَفْتَرُونَ  ‘আল্লাহর কসম! তোমরা যে মিথ্যা উদ্ভাবন কর, সে বিষয়ে অবশ্যই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে’ (নাহল ১৬/৫৬)

তিনি আরো বলেন,ثُمَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُخْزِيهِمْ وَيَقُولُ أَيْنَ شُرَكَائِيَ الَّذِينَ كُنتُمْ تُشَاقُّونَ فِيهِمْ قَالَ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ إِنَّ الْخِزْيَ الْيَوْمَ وَالسُّوءَ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘এরপর ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাদের লাঞ্ছিত করবেন এবং বলবেন, কোথায় আমার শরীকরা যাদের কারণে তোমরা (আমাদের নবীদের সঙ্গে) শত্রুতা করতে? তখন (ফেরেশতা বা মুমিনগণ) যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তারা বলবে, নিশ্চয়ই সকল লাঞ্ছনা ও অমঙ্গল আজ কেবল কাফেরদের জন্যই’ (নাহল ১৬/২৭)

৯. ফেরেশতাগণের প্রতি মিথ্যারোপ সম্পর্কে :

দুনিয়াতে এক শ্রেণীর মানুষ ফেরেশতাগণের প্রতি মিথ্যারোপ করে এবং তাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বলে, তারা নাকি নারী জাতি। এমনকি তারা তাদেরকে আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করে। ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। এমর্মে মহান আল্লাহ্ বলেন,وَجَعَلُوا الْمَلَائِكَةَ الَّذِينَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَنِ إِنَاثًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ ‘আর তারা ফেরেশতাদের নারী গণ্য করে, যারা দয়াময়ের বান্দা। তবে কি তারা তাদের সৃষ্টির সময় উপস্থিত ছিল? তাদের (এখনকার) সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হবে এবং (কিয়ামতের দিন) তারা জিজ্ঞাসিত হবে’ (যুখরুফ ৪৩/১৯)

১০. রাসূলগণের দাওয়াতে সাড়া দেয়া সম্পর্কে :

আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। ক্বিয়ামতের দিন তিনি তাঁদের উম্মতদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তারা তাঁদের দাওয়াত কবুল করেছে কি-না? এমনকি তিনি তাঁর রাসূলগণকেও জিজ্ঞেস করবেন, তাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত রিসালতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন কি-না? তাঁরা স্বীয় উম্মতদের নিকট তা পৌঁছে দিয়েছেন কি-না? মহান আল্লাহ বলেন, ماذا أجبتم المرسلين. ‘সেদিন তাদের ডেকে আল্লাহ বলবেন, নবীদের আহবানে তোমরা কিরূপ সাড়া দিয়েছিলে?’ (ক্বাছাছ ২৮/৬৫)

তিনি আরো বলেন,فَلَنَسْأَلَنَّ الَّذِينَ أُرْسِلَ إِلَيْهِمْ وَلَنَسْأَلَنَّ الْمُرْسَلِينَ. ‘অতঃপর যাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করা হয়েছিল তাদেরকে এবং রাসূলগণকে অবশ্যই আমরা (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসাবাদ করব’ (আ‘রাফ ৭/৬)

এ আয়াতের তাফসীরে ইবনু জারীর ত্বাবারী (রহঃ) বলেন, ‘যাদের নিকট আমি আমার রাসূলগণকে পাঠিয়েছি তাদেরকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করব, আমার পক্ষ থেকে রাসূলগণ তাদের নিকট যে আদেশ-নিষেধ নিয়ে এসেছিলেন, তারা তা অনুযায়ী কি আমল করেছে? আমি তাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছি তারা কি তা পালন করেছে, আমি যা থেকে তাদেরকে নিষেধ করেছিলাম তারা কি তা থেকে বিরত থেকেছে এবং আমার আনুগত্য মেনে নিয়েছে? না তারা আমার অবাধ্য হয়েছে এবং সেগুলির বিরোধিতা করেছে? আমি যে সকল রাসূলগণকে উম্মতদের নিকট পাঠিয়েছি তাঁদেরকেও জিজ্ঞেস করব, তাঁরা কি তাদের নিকট আমার রিসালত পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে আমি যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম তা কি আদায় করেছেন, না তাঁরা এ ব্যাপারে কমতি করেছেন, ফলে তাঁরা অবহেলা করেছেন এবং তাদের নিকট তা পৌঁছে দেননি’?[10]

পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা যেন আমাদেরকে দ্বীনের ওপরে চলা এবং খাঁটি মুসলিম ও মুমিন হয়ে মৃত্যুবরণ করার তাওফীক্ব দান করেন। সৎ আমল করা এবং কবর সহ পরকালের সকল স্তরে হিসাব সহজ করে দেন। ক্বিয়ামতের দিন যাবতীয় ফিৎনা থেকে আমাদের রক্ষা করে পুলছিরাত পার হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন। তার অশেষ রহমতে আমাদেরকে তাঁর জান্নাত লাভে ধন্য করেন-আমীন।


[1]. আবূদাউদ হা/৪৪৫৩; তিরমিযী হা/৩১২০, সনদ ছহীহ।

[2]. আবূদাউদ হা/৮৬৪, সনদ ছহীহ।

[3]. তিরমিযী হা/৪১৩; নাসাঈ হা/৪৬৫; মিশকাত হা/১৩৩০, সনদ ছহীহ।

[4]. নাসাঈ হা/৩৯৭১; ছহীহাহ হা/১৭৪৮; ছহীহুল জামে হা/২৫৭২।

[5]. তিরমিযী হা/২৪১৬; মিশকাত হা/৫১৯৭; ছহীহাহ হা/৯৪৬।

[6]. মুসলিম হা/২০৩৮; মিশকাত হা/৪২৪৬।

[7]. তিরমিযী হা/২৩৬৯; ছহীহাহ হা/১৬৪১।

[8]. তিরমিযী হা/৩৩৫৮; ছহীহাহ হা/৫৩৯; মিশকাত হা/৫১৯৬।

[9]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত হা/২০৫।

[10]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১২/৩০৫-৩০৬ পৃঃ।





রামাযান ও ছিয়াম সম্পর্কে কতিপয় যঈফ ও জাল বর্ণনা - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতি ও অনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে - জামালুদ্দীন বারী
যেসব ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (২য় কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
হজ্জ সফর (১ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসা - ইহসান ইলাহী যহীর
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব ও ফযীলত - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ : একটি পর্যালোচনা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
ঘোড়ার গোশত : হালাল নাকি হারাম? একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
পথশিশুদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব - মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
বৃদ্ধাশ্রম : মানবতার কলঙ্কিত কারাগার (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম
আরও
আরও
.