
পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ আসমানী কিতাব, যা মানব জাতির হেদায়াতের একমাত্র উৎস। কুরআনের মর্ম অনুধাবন ও উপদেশ গ্রহণ করে সার্বিক জীবনে বাস্তবায়নই এর উদ্দেশ্য। কুরআন অনুধাবনের মাধ্যমেই কুরআন নাযিলের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাছিল হয়। পক্ষান্তরে কুরআন মেনে না চললে ক্বিয়ামতের দিন রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর কাছে কুরআন পরিত্যাগের অভিযোগ পেশ করবেন (ফুরক্বান ২৫/৩০)। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন পরিত্যাগ’ করার অর্থ হ’ল ‘এর অনুধাবন ও যথার্থ বুঝ হাছিলের চেষ্টা পরিত্যাগ করা’।[1] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন পরিত্যাগ করা অনেক প্রকার হ’তে পারে, তান্মধ্যে অন্যতম হ’ল ‘কুরআন অনুধাবন ও বুঝ পরিত্যাগ করা’।[2]
কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবনের জন্য ‘শানেনুযূল’ তথা আয়াতসমূহ নাযিলের প্রেক্ষাপট জানা খুবই যরূরী। আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবনে ‘শানেনুযূলে’র গুরুত্ব আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
শানেনুযূল পরিচিতি : কুরআন নাযিলের প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত ‘ইলম বুঝাতে ‘শানেনুযুল’ (شان نزول) বা ‘সাবাবে নুযূল’ (سبب نزول) শব্দ ব্যবহৃত হয়। ‘শান’ শব্দের অর্থ অবস্থা, মর্যাদা, ঘটনা, পটভূমি। আর ‘সাবাব’ অর্থ- কারণ, হেতু, উদ্দেশ্য ইত্যাদি।[3] আর ‘নুযূল’ অর্থ অবতরণ, নামা, নাযিল হওয়া ইত্যাদি।[4] অতএব শানে নুযূল বা সাবাবে নুযূল অর্থ অবতরণ বা নাযিলের কারণ, নাযিলের পটভূমি। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির হেদায়াতের জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব পবিত্র কুরআন একদিনে নাযিল হয়নি। দীর্ঘ ২৩ বছরে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, কারো প্রশ্নের জবাবে বা কোন সমস্যার সমাধানে কুরআন নাযিল হয়েছে। মূলত একেই ‘আসবাবে নুযূল’ বা ‘শানেনুযূল’ বলা হয়।
শানেনুযূলের পরিচয়ে বলা হয়েছে,ما نزلت الآية أو الآيات متحدثة عنه أو مبينة لحكمه أيام وقوعه، ‘যা কোন ঘটনার উল্লেখ বা হুকুম বর্ণনায় এক বা একাধিক আয়াত নাযিল হয়েছে’।[5] শানেনুযূল বলতে বুঝায় ‘মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের কোন একটি সূরা বা এর অংশবিশেষ অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট বা ইতিহাসকে’।[6]
নাযিলের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় কুরআনের আয়াতগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।[7]
প্রথমত : যেসব আয়াত বা সূরা আল্লাহ কোন উপলক্ষ বা কারো প্রশ্নের জবাব ছাড়াই নাযিল করেছেন। এ ধরনের আয়াতের সংখ্যা অধিক। যেমন আক্বীদা সংক্রান্ত বিষয়াবলী, আল্লাহর সৃষ্টি ও ক্ষমতা সংক্রান্ত আয়াতসমূহ ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত : যেসব আয়াত বা সূরা আল্লাহ বিশেষ কোন কারণে বা কারো প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বা কোন সমস্যা সমাধানের জন্য নাযিল করেছেন। যেমন- যুল-ক্বারনাইন সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে সূরা কাহাফের ৮৩ থেকে ১০১ মোট ১৯টি আয়াত নাযিল হয়েছে। রূহ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে সূরা বনু ইস্রাঈলের ৮৫নং আয়াত নাযিল হয়েছে ইত্যাদি।
কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবনে শানেনুযূলের গুরুতব :
শানেনুযূল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের অন্যতম শাখা। যার মাধ্যমে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত নাযিলের সময়, স্থান, অবস্থা ও বিধান জানা যায়। কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবনেও শানেনুযূলের গুরুত্ব অপরিসীম। বস্ত্ততঃ ইলমে তাফসীরের জন্য শানেনুযূল জানা অপরিহার্য। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল-
(১) কুরআন নাযিলের ধারাবাহিকতা জানা যায় : কুরআন বুঝার জন্য কুরআন নাযিলের ধারাবাহিকতা জানা যরূরী। বর্তমানে আমাদের কাছে আল-কুরআন মুদ্রিত অবস্থায় আছে এবং সূরা ও আয়াতগুলো ধারাবাহিকভাবে সজ্জিত রয়েছে। এভাবে একদিনে কুরআন নাযিল হয়নি। বরং সূরা ‘আলাক্বের প্রথম পাঁচ আয়াতের মাধ্যমে কুরআন নাযিলের সূচনা হয়।[8] অথচ সূরা ‘আলাক্ব কুরআনের শেষের দিকে ৯৬তম সূরা। এরপর ৭৪নং সূরা মুদ্দাছছিরের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়।[9] আর পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে সর্বপ্রথম সূরা ফাতিহা নাযিল হয়।[10] আর সর্বশেষ অবতীর্ণ আয়াত নিয়ে মতভেদ থাকলেও সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হ’ল সূরা বাক্বারার ২৮১নং আয়াত। যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ৭ বা ২১ দিন পূর্বে নাযিল হয়।[11] আর সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে ১১০নং সূরা নাছর নাযিল হয়।[12]
(২) কুআনের বিধান নাযিলের ধারাবাহিকতা জানা যায় : ইসলামের বিভিন্ন বিধান একদিনে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি। এটি বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে যেমন ধারাবাহিক বর্ণিত হয়েছে, তেমনি কোন একটি নির্দিষ্ট সূরায় বর্ণিত না হয়ে বিভিন্ন সূরায় নাযিল হয়েছে। সেজন্য বিধান নাযিলের ধারাবাহিকতা না জানলে আমল করা সম্ভব নয়। যেমন মদ হারাম হওয়ার ধারাবাহিকতা, পর্দা ফরয হওয়ার ধারাবাহিকতা ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, মদ মোট চারটি ধাপে হারাম করা হয়।
শানেনুযূল জানা না থাকলে সূরা বাক্বারার আয়াত পাঠ করে অনেকে মদ হালাল মনে করতে পারেন। সূরা নিসার ৪৩নং আয়াত পাঠ করে ছালাত ব্যতীত অন্য সময় মদ পান করাকে জায়েয মনে করবেন। তাই কুরআনের বুঝ হিসাবে তা নাযিলের ধারাবাহিকতা জানার জন্য শানেনুযূল সম্পর্কে জানা যরূরী।
অনুরূপভাবে পর্দা ফরয হওয়ার ও ছিয়াম ফরযের ধারাবাহিকতাসহ ইসলামের অন্যান্য বিধান নাযিলের ধারাবাহিকতা জেনে সঠিকভাবে কুরআন অনুধাবনে শানেনুযূল জানা যরূরী।
(৩) কুরআনের প্রকৃত অর্থ জানা সহজ হয় : মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের কিছু কিছু আয়াত রয়েছে যার প্রকৃত অর্থ শানেনুযূল জানার মাধ্যমে সহজ হয়। মহান আল্লাহ বলেন, وَلا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ، ‘এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)। আসলাম আবূ ইমরান আত-তুজীবী (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, ‘তিনি বলেন, আমরা রোম সাম্রাজ্যের কোন এক শহরে অবস্থানরত ছিলাম। তখন আমাদেরকে মুকাবিলা করার উদ্দেশ্যে রোমের এক বিশাল বাহিনী যাত্রা শুরু করল। মুসলিমদের পক্ষ হ’তেও একই রকম বা আরো বিশাল একটি বাহিনী যাত্রা শুরু করল। তখন মিসরের শাসক ছিলেন উকবাহ ইবনু আমের (রাঃ) এবং সেনাপতি ছিলেন ফাযালাহ ইবনু উবায়দ (রাঃ)। তখন একজন মুসলিম সেনা রোমীয়দের উপর প্রচন্ড আক্রমণ করেন। এমনকি বুহ্য ভেদ করে তিনি তাদের ভেতরে ঢুকে পড়েন। তখন মুসলিমগণ সশব্দে চিৎকার করেন এবং বলেন, সুবহানাল্লাহ! লোকটি নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। তখন আবূ আইউব আল-আনছারী (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, হে জনমন্ডলী! তোমরা এ (বাক্বারাহ ২/১৯৫) আয়াতের এরূপ ব্যাখ্যা করছ? অথচ এ আয়াতটি আমাদের তথা আনছারদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।
আল্লাহ যখন ইসলামকে বিজয় দান করলেন এবং ইসলামের বিপুল সংখ্যক সাহায্যকারী হয়ে গেল, তখন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে না শুনিয়ে চুপে চুপে বলল, আমাদের মাল-সম্পদ তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ ইসলামকে এখন শক্তিশালী করেছেন। তার সাহায্যকারীর সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যদি আমরা আমাদের মাল-সম্পদ রক্ষাণাবেক্ষণের জন্য অবস্থান করতাম এবং বিনষ্ট হয়ে যাওয়া সম্পদের পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতাম (তাহ’লে ভাল হ’ত)। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর নবীর প্রতি নিম্নোক্ত (বাক্বারাহ ২/১৯৫) আয়াত অবতীর্ণ করেন। কাজেই মাল-সম্পদের তত্ত্বাবধান ও তার সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করা এবং জিহাদ ত্যাগ করাই হচ্ছে ধ্বংস। অতএব আবূ আইউব আনছারী (রাঃ) বাড়ী-ঘর ছেড়ে সব সময় আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে ব্যাপৃত থাকতেন। অবশেষে তিনি রোমে (তৎকালীন এশিয়া মাইনর, বর্তমানে তুরস্ক) মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।[13]
মহান আল্লাহ বলেন,فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوْهُمْ وَاقْعُدُوْا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ، ‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাসগুলি অতিক্রান্ত হ’লে তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা কর, পাকড়াও কর, অবরোধ কর এবং ওদের সন্ধানে প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে থাক। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, ছালাত আদায় করে ও যাকাত দেয়, তাহ’লে ওদের রাস্তা ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবা ৯/৫)। এ আয়াত দিয়ে চরমপন্থীরা জঙ্গীবাদের দলীল দিয়ে থাকেন। অথচ আয়াতটি বিদায় হজ্জের আগের বছর মুশরিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়। যার মাধ্যমে মুশরিকদের সাথে পূর্বেকার সকল চুক্তি বাতিল করা হয়। এর ফলে মুশরিকদের জন্য হজ্জ চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয় এবং পরের বছর যাতে মুশরিকমুক্ত পরিবেশে রাসূল (ছাঃ) হজ্জ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হয়। এটি বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ নির্দেশ মাত্র।[14]
(৪) শানেনুযূল জানার মাধ্যমে কুরআন বুঝা সহজ হয় : কুরআনের বিধান সঠিকভাবে পালন করার জন্য কুরআন বুঝা যরূরী। আর শানেনুযূল কুরআন বুঝতে সহজ করে। এজন্য ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহ.) বলেন,معرفة سبب النزول يعين على فهم الآية، فإن العلم بالسبب يورث العلم بالمسبب ‘শানেনুযূল জানা কুরআন বুঝতে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই নাযিলের জ্ঞান উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান’।[15] মহান আল্লাহ বলেন, نِسَاؤُكُمْ حَرْثٌ لَكُمْ فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّى شِئْتُمْ، ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত স্বরূপ। অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেতে যেভাবে চাও গমন কর’ (বাক্বারাহ ২/২২৩)। এ আয়াত দ্বারা বাহ্যিকভাবে বুঝা যায় যে, আল্লাহ স্ত্রীদের সাথে মিলনের কোন নিয়মনীতি বেধে দেননি। অথচ এ আয়াত আল্লাহ এ উদ্দেশ্যে নাযিল করেননি বরং এ আয়াত নাযিল হয়েছে ইহুদীদের সম্পর্কে। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, ‘ইহুদীগণ তাদের মহিলাদের হায়েয হ’লে তার সাথে এক সঙ্গে খাবার খেত না এবং এক ঘরে বাস করত না। ছাহাবায়ে কেরাম এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন। তখন আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করলেন, ‘আর লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে মহিলাদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে। তুমি বল, ওটা কষ্টদায়ক বস্ত্ত। অতএব ঋতুকালে তোমরা স্ত্রীমিলন হ’তে বিরত থাক...’ (বাক্বারাহ ২/২২২)। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা (সে সময় তাদের সাথে) শুধু সহবাস ছাড়া অন্যান্য সব কাজ কর। এ খবর ইহুদীদের কাছে পৌঁছলে তারা বলল, ‘এ লোকটি সব কাজেই কেবল আমাদের বিরোধিতা করতে চায়’।[16]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ اللهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ، ‘আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)। এখানে ‘ঈমান’ শব্দ দ্বারা ঈমানের প্রচলিত অর্থ নেয়া হ’লে আয়াতের মর্ম হবে এই যে, ক্বিবলা পরিবর্তনের ফলে নির্বোধেরা মনে করতে থাকে যে, এরা দ্বীন ত্যাগ করেছে কিংবা এদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তোমাদের ঈমান নষ্ট করবেন না। কাজেই তোমরা নির্বোধদের কথায় কর্ণপাত কর না। কোন কোন মনীষীর মতে এখানে ঈমানের অর্থ করা হয়েছে ছালাত। মর্মার্থ এই যে, সাবেক ক্বিবলা বায়তুল-মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে যেসব ছালাত আদায় করা হয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা সেগুলো নষ্ট করবেন না; বরং তা শুদ্ধ ও মকবূল হয়েছে।[17]
বারা‘ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) মদীনাতে ষোল অথবা সতের মাস যাবৎ বায়তুল মাক্বদিসের দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেন। অথচ নবী করীম (ছাঃ) বায়তুল্লাহর দিকে তার ক্বিবলা হওয়াকে পসন্দ করতেন। নবী করীম (ছাঃ) ‘আছর ছালাত (কা‘বার দিকে মুখ করে) আদায় করেন এবং লোকেরাও তাঁর সঙ্গে ছালাত আদায় করেন। এরপর তাঁর সঙ্গে ছালাত আদায়কারী একজন বের হন এবং তিনি একটি মসজিদের লোকেদের পাশ দিয়ে গেলেন তখন তারা রুকূ অবস্থায় ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে মক্কার দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করেছি। এ কথা শোনার পর তাঁরা যে অবস্থায় ছিলেন, সে অবস্থায় বায়তুল্লাহর দিকে ফিরে গেলেন। আর যারা ক্বিবলা বায়তুল্লাহর দিকে পরিবর্তনের পূর্বে বায়তুল মাকদিসের দিকে ছালাতরত অবস্থায় মারা গিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাদের সম্পর্কে আমরা কী বলব তা আমাদের জানা ছিল না। তখন আল্লাহ এ আয়াত (বাক্বারাহ ২/১৪৩) অবতীর্ণ করেন’।[18]
(৫) আয়াতে কারীমার সঠিক মর্ম উপলব্ধি করা যায় : কুরআনের সঠিক মর্ম উপলব্ধি না করতে পারলে কুরআন দ্বারা হেদায়াতের পরিবর্তে বিভ্রান্ত হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوْا وَآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ، ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তারা পূর্বে যা (মদ) ভক্ষণ করেছে, তার জন্য তাদের উপর কোন দোষ বর্তাবে না, যখন তারা ভবিষ্যতে সংযত হয় এবং ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে’ (মায়েদাহ ৫/৯৩)।
এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দেখে মনে হয়, আল্লাহর ভয় ও ঈমান থাকলে সবকিছু আহার করা হালাল। কোন কিছুই হারাম নয়। অধিকন্তু আয়াতটি মদ হারাম ঘোষণার পরপর আসায় কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এখানে বোধ হয় ঈমানদার ও নেককার লোকদের জন্য মদ্যপানের বৈধতা ও অনুমতি দেওয়া হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ এ আয়াত নাযিল হয়েছে ঐ সকল ছাহাবীদের সম্পর্কে, যারা মদ হারাম হওয়ার পূর্বে মদপান করে মারা গেছেন। বারা‘ ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ)-এর বেশ কিছু ছাহাবী শরাব নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে মদ্যপানে অভ্যস্ত অবস্থায় মারা যান। মদ হারাম হওয়া সম্পর্কিত আয়াত অবতীর্ণ হ’লে নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের কেউ কেউ বলেন, আমাদের ঐসব সাথীদের কি হবে, যারা মদ পানে অভ্যস্ত থাকা কালে মারা গেছেন? তখন এ আয়াত (মায়েদা ৫/৯৩) অবতীর্ণ হয়’।[19] অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ، ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলমের সাথে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথ প্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন এ আয়াত (আন‘আম ৬/৮২) অবতীর্ণ হ’ল তখন তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছাহাবাদের কাছে গুরুতর মনে হ’ল। তারা বললেন, আমাদের মাঝে এমন কে আছে যারা তাদের ঈমানকে যুলম দ্বারা কলুষিত করেনি? তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘তা অবশ্যই এমনটা নয়, তোমরা কি লোকমানের কথা শ্রবণ করনি? শিরকই বিরাট যুলুম (সীমালঙ্ঘন) (লোক্বমান ৩১/১৩)।[20]
(৬) শানেনুযূল কুরআনের দুর্বোধ্যতা দূর করে : আল্লাহ বলেন,لَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّونَ أَنْ يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلَا تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ، ‘যেসব লোকেরা তাদের কৃতকর্মে খুশী হয় এবং তারা যা করেনি, এমন কাজে প্রশংসা পেতে চায়, তুমি ভেব না যে, তারা শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে’ (আলে ইমরান ৩/১৮৮)। এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে ইয়াহুদীদের সম্পর্কে। আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাছ অবহিত করেছেন যে, মারওয়ান (রহঃ) তাঁর দারোয়ানকে বললেন, হে নাফি‘! তুমি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর কাছে গিয়ে বল, যদি প্রাপ্ত বস্ত্ততে আনন্দিত এবং যা করেনি এমন কাজ সম্পর্কে প্রশংসিত হ’তে আশাবাদী প্রত্যেক ব্যক্তিই শাস্তিপ্রাপ্য হয় তাহ’লে সকল মানুষই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, এটা তোমাদের মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। একদা নবী করীম (ছাঃ) ইহুদীদেরকে ডেকে একটা বিষয় জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাতে তারা সত্য গোপন করে বিপরীত তথ্য দিয়েছিল। এতদসত্ত্বেও তারা তাদের দেয়া উত্তরের বিনিময়ে প্রশংসা অর্জনের আশা করেছিল এবং তাদের সত্য গোপনের জন্য আনন্দিত হয়েছিল। তারপর ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণনাকারী আব্দুর রায্যাক (রহঃ) ও ইবনু জুরাইজ (রহঃ) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।[21]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন,وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللهِ إِنَّ اللهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ، ‘আর আল্লাহর জন্যই পূর্ব ও পশ্চিম। অতএব যেদিকেই তোমার মুখ ফিরাও সেদিকেই রয়েছে আল্লাহর চেহারা। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী ও সর্বজ্ঞ’ (রাক্বারাহ ২/১১৫)।
এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, যে কোন দিকে মুখ করেই ছালাত আদায় করা যায়। নফল ছালাত হোক বা ফরয ছালাত হোক, সফর হোক বা মুক্বীম অবস্থায় হোক। অথচ এ আয়াত মুসাফির ব্যক্তির বাহনে নফল ছালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,يُصَلِّي فِي السَّفَرِ عَلَى رَاحِلَتِهِ، حَيْثُ تَوَجَّهَتْ بِهِ، يُومِئُ إِيمَاءً، صَلاَةَ اللَّيْلِ إِلاَّ الْفَرَائِضَ، وَيُوتِرُ عَلَى رَاحِلَتِهِ، ‘নবী করীম (ছাঃ) সফরে ফরয ছালাত ব্যতীত তাঁর সাওয়ারী হ’তেই ইঙ্গিতে রাতের ছালাত আদায় করতেন সাওয়ারী যে দিকেই ফিরুক না কেন। আর তিনি বাহনের উপরেই বিতর আদায় করতেন’।[22] অন্য বর্ণনায় আছে, তারপর ইবনু ওমর (রাঃ) এই আয়াত পাঠ করলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহর জন্যই। অতএব তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও সেদিকেই আল্লাহর চেহারা’ (বাক্বারাহ ২/১১৫)। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, এ প্রসঙ্গেই উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।[23]
তবে তাকবীরে তাহরীমার সময় ক্বিবলামুখী হওয়া মুস্তাহাব। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) সফরে নফল ছালাত আদায়ের ইচ্ছা করলে স্বীয় উষ্ট্রীকে ক্বিবলামুখী করে নিয়ে তাকবীর বলতেন। অতঃপর সাওয়ারীর মুখ যেদিকেই হ’ত সেদিকে ফিরেই ছালাত আদায় করতেন।[24]
ফরয ছালাত আদায়ের জন্য ক্বিবলামুখী হওয়া শর্ত। জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,يُصَلِّي عَلَى رَاحِلَتِهِ حَيْثُ تَوَجَّهَتْ، فَإِذَا أَرَادَ الْفَرِيضَةَ نَزَلَ فَاسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ، ‘নবী করীম (ছাঃ) নিজের সাওয়ারীর উপর (নফল) ছালাত আদায় করতেন, সাওয়ারী তাঁকে নিয়ে যে দিকেই মুখ করত না কেন। কিন্তু যখন ফরয ছালাত আদায়ের ইচ্ছা করতেন, তখন নেমে পড়তেন এবং ক্বিবলামুখী হ’তেন’।[25] জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,بَعَثَنِي رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِيْ حَاجَةٍ قَالَ فَجِئْتُ وَهُوَ يُصَلِّي عَلَى رَاحِلَتِهِ نَحْوَ الْمَشْرِقِ وَالسُّجُودُ أَخْفَضُ مِنَ الرُّكُوعِ- ‘রাসূল (ছাঃ) আমাকে কোন কাজে পাঠালেন। আমি ফিরে এসে দেখি তিনি সাওয়ারীর উপর পূর্ব দিকে মুখ করে ছালাত আদায় করছেন এবং তাঁর রুকূর চেয়ে সাজদা হ’তে (মাথা) অধিক নত ছিল’।[26]
(৭) কুরআনের হুকুম প্রয়োগে শানেনুযূল জানা যরূরী : কুরআনের বিভিন্ন হুকুম প্রদানের জন্য শানেনুযূল জানা যরূরী। অন্যথা ভুল হ’তে পারে। যেমন আল্লাহ বলেন, فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ، ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)।
খারেজী আক্বীদার মুফাসসিরগণ অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন ‘তাগূতের অনুসারী ঐসব লোকেরা ‘ঈমানের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে। মুখে তারা যত দাবীই করুক না কেন’।[27] অথচ এখানে لاَ يُؤْمِنُونَ ‘তারা মুমিন হ’তে পারবে না’-এর প্রকৃত অর্থ হ’ল, لاَ يَسْتَكْمِلُوْنَ الْإِيْمَانَ ‘তারা পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে না’।[28] কারণ উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছিল দু’জন ছাহাবীর পরস্পরের জমিতে পানি সেচ সংক্রান্ত বিবাদ মিটানোর উদ্দেশ্যে। আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক আনছারী নবী করীম (ছাঃ)-এর সামনে যুবায়ের (রাঃ)-এর সঙ্গে হাররার নালার পানি নিয়ে ঝগড়া করল। মহিলা সেই পানি দ্বারা খেজুর বাগানে সেচ দিত। আনছারী বলল, নালার পানি ছেড়ে দিন, যাতে তা (প্রবাহিত থাকে)। কিন্তু যুবায়ের (রাঃ) দিতে অস্বীকার করেন। তারা দু’জনে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হ’লে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) যুবায়ের (রাঃ)-কে বললেন, হে যুবায়ের! তোমার যমীনে (প্রথমে) সেচ করে নেও। এরপর তোমার প্রতিবেশীর দিকে পানি ছেড়ে দাও। এতে আনছারী অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, সে তো আপনার ফুফাতো ভাই। এতে রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারায় অসন্তুষ্টির চাপ প্রকাশ পেল। এরপর তিনি বললেন, হে যুবায়ের! তুমি নিজের জমি সেচ কর। এরপর পানি আটকিয়ে রাখ, যাতে তা বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছে। যুবায়ের (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমার মনে হয়, এ আয়াতটি (নিসা ৪/৬৫) এ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।[29]
দু’জনই ছিলেন বদরী ছাহাবী এবং দু’জনই ছিলেন স্ব স্ব জীবদ্দশায় ক্ষমাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের কাউকে ‘তাগূতের অনুসারী’ মুনাফিক বা কাফের বলার উপায় নেই। কিন্তু খারেজী ও শী‘আপন্থী মুফাসসিরগণ তাদের ‘কাফের’ বলায় প্রশান্তিবোধ করে থাকেন। তারা এর দ্বারা সকল কবীরা গোনাহগার মুসলমানকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেছেন। ফলে তাদের ধারণায় কোন মুসলিম সরকার ‘মুরতাদ’ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, উক্ত সরকার স্বীয় রাষ্ট্রে কিছু কুফরী কাজের প্রকাশ ঘটাল’।[30]
(৮) কুরআনের বিধান সম্পর্কে জানা যায় : কুরআনে বর্ণিত আয়াতের হুকুম বিভিন্ন রকম রয়েছে। আর বাহ্যিক আয়াত দ্বারা এটা বুঝা যায় না। কোন কোন ক্ষেত্রে শানেনুযূল দ্বারা বুঝা যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ أَوِ اعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا وَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَإِنَّ اللهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ ‘নিশ্চয়ই ছাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। অতএব যারা কা‘বা গৃহে হজ্জ অথবা ওমরাহ করে, তাদের জন্য এ দু’টি প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। আর যদি কেউ স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত কিছু নেকীর কাজ করে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ গুণগ্রাহী ও সুবিজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/১৫৮)।
ছাফা ও মারওয়া সাঈ করা হজ্জের একটি রুকন। অথচ এ আয়াত দ্বারা বাহ্যিকভাবে বুঝা যায় যে, হজ্জ ও ওমরায় ছাফা ও মারওয়া প্রদক্ষিণ করা ফরয নয় বরং নফল। অথচ এটা ফরয, যা শানেনুযূলের মাধ্যমে জানতে পারি। উরওয়াহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, মহান আল্লাহর এ বাণী (বাক্বারাহ ২/১৫৮) সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? (আমার ধারণা যে,) ছাফা-মারওয়ার মাঝে কেউ সাঈ না করলে তার কোন দোষ নেই। তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, ওহে ভাগ্না! তুমি যা বললে, তা ঠিক নয়। কেননা যা তুমি তাফসীর করলে, যদি আয়াতের মর্ম তা-ই হ’ত, তাহ’লে আয়াতের শব্দ বিন্যাস এভাবে হ’ত (لاَ جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ يَطَّوَّفَ بِهِمَا) ‘দু’টোর মাঝে সা‘ঈ না করায় কোন দোষ নেই’। কিন্তু আয়াতটি আনছারদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুশাল্লাল নামক স্থানে স্থাপিত মানাত নামের মূর্তির পূজা করত, তার নামেই তারা ইহরাম বাঁধত। সে মূর্তির নামে যারা ইহরাম বাঁধত তারা ছাফা-মারওয়া সাঈ করাকে অপরাধ মনে করত। ইসলাম গ্রহণের পর তারা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! পূর্বে আমরা ছাফা ও মারওয়া সাঈ করাকে অপরাধ মনে করতাম (এখন কি করব?) এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ (إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللهِ) অবতীর্ণ করেন।[31]
জাহেলী যুগেও যেহেতু এ সাঈর রীতি প্রচলিত ছিল। তখন এ দু’টি পাহাড়ের মধ্যে কয়েকটি মূর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। এজন্য মুসলিমদের কারো কারো মনে একটা দ্বিধার ভাব জাগ্রত হয়েছিল যে, বোধ হয় এ সাঈ জাহেলী যুগের কোন অনুষ্ঠান এবং ইসলাম যুগে এর অনুসরণ করা হয়ত গোনাহের কাজ। এরূপ সন্দেহ নিরসন কল্পে আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে বায়তুল্লাহর ক্বিবলা হওয়া সম্পর্কিত সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দের অবসান ঘটিয়েছেন, তেমনিভাবে এ আয়াতে বায়তুল্লাহ সংশ্লিষ্ট আরও একটি সংশয়ের অপনোদন করে দিয়েছেন।[32]
(৯) সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিতবহ ঘটনা বিস্তারিত জানা যায় : কুরআনের বহু স্থানে সংক্ষিপ্তাকারে বিশেষ কোন ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। উক্ত ঘটনার শানেনুযূল জানা না থাকলে সেসব আয়াতে কারীমার মর্মার্থ যথাযথভাবে বুঝা যায় না। যেমন আল্লাহ বলেন,فَلَمْ تَقْتُلُوْهُمْ وَلَكِنَّ اللهَ قَتَلَهُمْ وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ اللهَ رَمَى، ‘সুতরাং তোমরা তাদের হত্যা করনি, বরং আল্লাহ তাদের হত্যা করেছেন। আর তুমি ধূলি নিক্ষেপ করনি যখন তুমি তা নিক্ষেপ করেছিলে, বরং আল্লাহই তা নিক্ষেপ করেছিলেন’ (আনফাল ৮/১৭)। এ আয়াতে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে, বদর যুদ্ধের দিনে যখন মক্কার এক হাযার সদস্যের বাহিনী ময়দানে এসে উপস্থিত হয়, তখন মুসলিমদের সংখ্যাল্পতা এবং নিজেদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তারা গর্বিত ও সদম্ভ ভঙ্গিতে উপস্থিত হয়। সে সময় রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করেন হে আল্লাহ! আপনাকে মিথ্যা জ্ঞানকারী এই কুরাইশরা গর্ব ও দম্ভ নিয়ে এগিয়ে আসছে। আপনি বিজয়ের যে প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছেন, তা যথাশীঘ্র পূরণ করুন। তখন জিব্রীল (আঃ) এসে নিবেদন করেন, হে রাসূল! আপনি এক মুষ্টি মাটি নিয়ে শক্র বাহিনীর প্রতি নিক্ষেপ করুন। তিনি তাই করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনবার মাটি ও কাকরের মুঠো তুলে নেন এবং একবার শত্রুবাহিনীর ডান অংশের উপর, একবার বাম অংশের উপর এবং একবার সামনের দিকে নিক্ষেপ করেন। সেই এক কিংবা তিন মুষ্টি কাকরকে আল্লাহ এমনভাবে ছড়িয়ে দেন যে, প্রতিপক্ষের সৈন্যদের এমন একটি লোকও বাকী ছিল না, যার চোখ অথবা মুখমন্ডলে এই ধূলি ও কাকর পৌঁছেনি। আর তারই প্রতিক্রিয়ায় গোটা শত্রুবাহিনীর মাঝে এক ভীতির সঞ্চার হয়ে যায়। এভাবে মুসলিম বাহিনী এই বিজয় লাভে সমর্থ হন। আয়াতে মুসলমানদেরকে হেদায়াত দান করা হয় যে, নিজের চেষ্টা-চরিত্রের জন্য গর্ব করো না; যা কিছু ঘটেছে তা শুধুমাত্র তোমাদের চেষ্টা ও পরিশ্রমেরই ফসল নয়; বরং এটা আল্লাহর একান্ত সহায়তারই ফল। তোমাদের হাতে যেসব শক্র নিহত হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে তোমরা হত্যা করনি; বরং আল্লাহই হত্যা করেছেন।[33]
(১০) তাফসীরের জন্য শানেনুযূল জানা প্রয়োজন : কুরআনের তাফসীর করার জন্য যেসকল বিষয় জানা যরূরী তার অন্যতম হ’ল শানেনুযূল। শাহ অলিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী (১১১৪-১১৭৬ হি./১৭০৩-১৭৬২ খৃ.) বলেন, ‘ঐ ব্যক্তির জন্য কুরআনের তাফসীরে প্রবেশ করা হারাম যে ব্যক্তি কুরআনের ভাষা জানে না, যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ), তাঁর ছাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে বর্ণিত ব্যাখ্যা সম্পর্কে অবগত নয় এবং যে ব্যক্তি কুরআনের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও আয়াত নাযিলের কারণ এবং নাসেখ-মানসূখ সম্পর্কে অবগত নয়’।[34]
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, (ক) কুরআনের তাফসীরের জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি হ’ল কুরআন দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। কেননা এক স্থানে আয়াতটি সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হ’লেও অন্য স্থানে সেটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। (খ) যদি তুমি এতে ব্যর্থ হও, তাহ’লে সুন্নাহতে এর ব্যাখ্যা তালাশ কর। কেননা এটি কুরআনের ব্যাখ্যা ও তার মর্ম স্পষ্টকারী। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তোমার নিকটে কুরআন নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের নিকট বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৪)। আর সুন্নাহ নিজেই রাসূলের উপরে অহি আকারে নাযিল হয়েছে, যেমন তাঁর উপরে কুরআন নাযিল হয়েছে। যদিও তা কুরআনের ন্যায় তেলাওয়াত করা হয় না। অতঃপর যখন আমরা কুরআনে বা সুন্নাহতে কোন ব্যাখ্যা না পাব, তখন ছাহাবীগণের বক্তব্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করব। কেননা কোন্ অবস্থায় বা কোন্ প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারণে তাঁরা উক্ত বিষয়ে অধিক অবগত ছিলেন। আর এ বিষয়ে তাঁদের ছিল পূর্ণ বুঝ এবং সঠিক ধারণা ও আমল। বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও বিদগ্ধ ব্যক্তিগণ। যেমন চার খলীফা, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, আব্দুল্লাহ বিন আববাস প্রমুখ বিদ্বানগণ।[35]
(১১) শানেনুযূল সংকীর্ণতাকে দূর করে দেয় : মহান আল্লাহ বলেন,قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ، ‘তুমি বলে দাও, আমার নিকট যা অহি করা হয়েছে, তাতে ভক্ষণকারীর জন্য আমি কোন খাদ্য হারাম পাইনি যা সে ভক্ষণ করে, কেবল মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত ব্যতীত। কেননা এগুলি নাপাক বস্ত্ত। আর ঐ প্রাণী ব্যতীত, যা শিরকের কারণে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে’ (আন‘আম ৬/১৪৫)।
উক্ত আয়াত মক্কার কাফেদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।[36] আর এ আয়াত দ্বারা অল্প কিছু খাবার হারামের কথা বুঝা যায় অথচ আল্লাহ আরো অনেক খাবার হারাম করেছেন যা এ আয়াতের শানেনুযূল থেকে জানা যায়। ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, জাহিলী যুগের লোকেরা কিছু জিনিস খেত এবং ঘৃণাবশত কিছু জিনিস পরিহার করত। এ অবস্থায় আল্লাহ তাঁর নবী (ছাঃ)-কে প্রেরণ করলেন এবং তাঁর কিতাব অবতীর্ণ করলেন এবং তাতে কিছু জিনিস হালাল করলেন ও কিছু জিনিস হারাম করলেন। তিনি যা হালাল করেছেন তা হালাল এবং যা হারাম করেছেন তা হারাম, আর যেগুলো সম্পর্কে নীরব থেকেছেন তাতে ছাড় দেয়া হয়েছে। অতঃপর ইবনু আববাস (রাঃ) আন‘আম ৬/১৪৫ আয়াত তেলাওয়াত করেন।[37]
পরিশেষে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবন করা ও বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জানার ক্ষেত্রে শানেনুযূলের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। শানেনুযূল অবগত হওয়া ব্যতীত সঠিকভাবে কুরআন বুঝা ও কুরআনের উপর আমল করা দুষ্কর। তাই প্রত্যেক মুসলিমের কুরআন জানা ও মানার জন্য শানেনুযূল জানা যরূরী।
মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
তুলাগাঁও, নোয়াপাড়া, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
[1]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা ফুরক্বান আয়াত ৩০-এর তাফসীর দ্র.।
[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ (দারু ইলমিল ফাওয়ায়েদ) পৃ. ১১৮।
[3]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ৫৫১।
[4]. ঐ, পৃ. ১০৬৩।
[5]. মানাহিলুল ইরফান ফী উলূমিল কুরআন (বৈরূত: দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, প্রথম প্রকাশ ১৪১৫ হি./১৯৯৫ খ্রি.) ১/৮৯।
[6].মাওলানা সাঈদ আল-মিছবাহ, শানেনুযূল (ঢাকা : মোহাম্মদী বুক হাউস, অক্টোবর ২০১৩), পৃ. ভূমিকাংশ।
[7]. ইমাম সুয়ূতী, আল-ইতক্বান ফী ‘উলূমিল কুরআন ১/৮২।
[8]. বুখারী হা/৪৯৫৩; মুসলিম হা/১৬০।
[9]. ফাৎহুল বারী, বুখারী হা/৩-এর ব্যাখ্যা দ্র.।
[10]. মান্না‘ আল-ক্বাত্ত্বান, মাবাহিছ ফী উলূমিল কুরআন, পৃ. ৬০। গৃহীত: মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, ৩০তম পারা, পৃ. ৯।
[11]. তাফসীর ইবনে কাছির, সূরা বাক্বারাহ ২৮১নং আয়াতের তাফসীর দ্র.। বিস্তারিত : মাসিক আত-তাহরীক, অক্টোবর ২০১৬ প্রশ্নোত্তর (১৭/১৭)।
[12]. মুসলিম হা/৩০২৪।
[13]. তিরমিযী হা/২৯৭২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩।
[14]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ এবং চরমপন্থীদের বিশ্বাসগত বিভ্রান্তর জবাব, পৃ. ৪।
[15]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৩/১৮১।
[16]. মুসলিম হা/৩০২।
[17]. কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) মদীনা: বাদশাহ্ ফাহদ কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স, ১/১৩৮।
[18]. বুখারী হা/৪৪৮৬।
[19]. তিরমিযী হা/৩০৫১।
[20]. বুখারী হা/৬৯১৮।
[21]. বুখারী হা/৪৫৬৮।
[22]. বুখারী হা/১০০০; মুসলিম হা/৭০০; মিশকাত হা/১৩৪০।
[23]. তিরমিযী হা/২৯৫৮।
[24]. আবূদাঊদ হা/১২২৮।
[25]. বুখারী হা/৪০০, ১০৯৪, ১০৯৯, ৪১৪০।
[26]. আবূদাঊদ হা/১২২৭; তিরমিযী হা/৩৫১।
[27]. সাইয়িদ কুতুব, তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন ২/৮৯৫; জিহাদ ও ক্বিতাল ৬৭ পৃ.।
[28]. ফাৎহুল বারী হা/২৩৫৯-এর ব্যাখ্যা দ্র.।
[29]. বুখারী হা/২৩৫৯।
[30]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, কুরআন অনুধাবন, (হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ১ম প্রকাশ, পৃ.৩০-৩১।
[31]. বুখারী হা/১৬৪৩; মুসলিম হা/১২৭৭।
[32]. কুরআনুল কারীম (বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর), ১/১৮৯।
[33]. কুরআনুল কারীম (বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর), ১/৮৯০-৮৯১।
[34]. কুরআন অনুধাবন, পৃ. ২০।
[35]. কুরআন অনুধাবন ২০-২১ পৃ.।
[36]. তাফসীরে ইবনে কাছীর, সূরা আন‘আম ১৪৬নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
[37]. আবূদাঊদ হা/৩৮০০।