ভূমিকা :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা দান করেছেন। তিনি মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন পরিপূর্ণভাবে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করতে এবং নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন অন্য দ্বীন অন্বেষণ করতে। সুতরাং কোন মুমিনের সুযোগ নেই ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করার। সুযোগ নেই এ দ্বীনের মধ্যে কিছু সংযোজন, বিয়োজন কিংবা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার।
বড়ই আফসোসের বিষয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর মুসলিমের মধ্যে ইসলামে সংযোজন-বিয়োজনের প্রবণতা।
আধুনিক কালের পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসী জোয়ারকে যৌক্তিক ভাবে মোকাবিলায় অক্ষম এক শ্রেণীর ইসলামী চিন্তাবিদ এক সময় সমাজতন্ত্র নামক বিজাতীয় মতাদর্শকে কিছুটা সংস্কার করে ইসলামের মধ্যে গ্রহণ করার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। বর্তমানেও ঐ মানসিকতার ইসলামী চিন্তাবিদগণ মানব রচিত গণতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে আত্মীকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
গত শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের জয়-জয়কার চলাকালে তথাকথিত ইসলামী চিন্তাবিদগণ বলেছিলেন, শুধু নাস্তিক্যবাদী চিন্তাটাকে বাদ দিলে সমাজতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে গ্রহণ করতে কোন বাধা নেই। সমাজতন্ত্রকে ইসলাম সম্মত প্রমাণের জন্য তাঁরা ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ পরিভাষা চালু করেন।
বিগত ও বর্তমান শতাব্দীতে প্রভাব বিস্তার করে থাকা বিজাতীয় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মতবাদ ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কেও একশ্রেণীর ইসলামী চিন্তাবিদ অনুরূপ ভাষ্য প্রদান করে গণতন্ত্রকে মুসলিম বিশ্বে গ্রহণযোগ্য করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। তারা বলছেন, শুধু সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গটি বাদ দিলে গণতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে গ্রহণে কোন সমস্যা নেই। ‘মাসিক পৃথিবী’ নভেম্বর ১৯৯১ সংখ্যায় বলা হয়েছে ‘ইসলাম ও গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে সেটি বাদ দিলে গণতন্ত্রের বড় বড় ৪টি পয়েন্টের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই’।
ডঃ ইউসুফ আল-কারযাভী তাঁর Priorities of the Islamic Movement in the coming phase' গ্রন্থের 'The Movement and the Political Freedom and Democracy' শীর্ষক আলোচনায় গণতন্ত্রকে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে জোর ওকালতি করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও চিন্তাবিদ শাহ আব্দুল হান্নান তাঁর ‘ইসলামের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে গণতন্ত্র বিরোধী ওলামায়ে কেরামদেরকে যুগ চাহিদার প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে মেনে নেওয়ার আহবান জানান। তাঁর মতে, গণতন্ত্রকে গ্রহণ করলে পাশ্চাত্যে ইসলামের যে আগ্রাসী ও একনায়কত্ববাদী ভাবমূর্তি রয়েছে তা দূর হবে।
গণতন্ত্রকে ইসলাম সম্মত ও মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তারা ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ পরিভাষা চালু করেছেন। অথচ গণতন্ত্রের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, ইতিহাস, এর মূলনীতি ও আদর্শগুলোকে ইসলামী শরী‘আতের আলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, গণতন্ত্র একটি মানব রচিত শিরকী, কুফরী, জাহেলী মতবাদ। যা কখনো ইসলামের সাথে এক হবার নয়।
মানব রচিত এই মতবাদের কিছু বিষয়কে ইসলামাইজড্ করে গ্রহণ করা হ’লে, তা হবে দ্বীনের বিকৃতি সাধন বা গায়ের ইসলামকে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করার শামিল, যা আল্লাহ তা‘আলা কখনো গ্রহণ করবেন না (আলে ইমরান ৩/৮৫)। গণতন্ত্র ও ইসলাম কেন পরস্পরবিরোধী- এ প্রবন্ধে আমরা তা তুলে ধরায় প্রয়াস পাব।-
গণতন্ত্রের পরিচয় :
গণতন্ত্র একটি মানব রচিত ধর্মহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। তবে ‘জনগণের শাসন ব্যবস্থা’ বা জনগণের সরকার ব্যবস্থা হিসাবেই এটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইংরেজী Democracy শব্দের বাংলা অর্থ গণতন্ত্র। এই ইংরেজী Democracy শব্দটি গ্রীক শব্দ Demos ও Kratia থেকে উৎপন্ন হয়েছে। Demos শব্দের অর্থ জনগণ আর Kratia শব্দের অর্থ শাসন বা ক্ষমতা। সুতরাং উভয় শব্দের মিলিত অর্থ দাঁড়ায় জনগণের শাসন বা জনগণের ক্ষমতা।
সাধারণভাবে গণতন্ত্র বলতে বুঝায়, এমন এক মতবাদ বা ব্যবস্থাকে যেখানে সমাজ-রাষ্ট্রের আইন-বিধান প্রণয়ণের চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয় জনগণের উপর বা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর। মোটকথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে শাসন কার্য পরিচালনাকে গণতন্ত্র বলে।[1] গ্রীক ঐতিহাসিক ও দার্শনিক হিরোডোটাস (Herodotus) গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেন, এটা এক প্রকার শাসন ব্যবস্থা যেখানে শাসন ক্ষমতা কোন শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের উপর ন্যস্ত থাকে না, সমাজের সদস্যগণের উপর ন্যস্ত হয় ব্যাপকভাবে’।
(খ) অধ্যাপক শেলী বলেন, Democracy is a form
of government in which every one has a share in it. অর্থাৎ ‘যে সরকার
ব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকে তাকে গণতন্ত্র বলে’।[2]
আধুনিক
গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ‘আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন
১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গের এক জনসভায় ‘গণতন্ত্র’-এর আধুনিক সংজ্ঞা দেন এভাবে
যে, Democracy is the government of the people by the people and for the
people. অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যা জনগণের উপর জনগণের
দ্বারা পরিচালিত জনগণের শাসন ব্যবস্থা বুঝায়’।[3]
মোটকথা
জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ শাসনের নামই গণতন্ত্র। অন্য কথায় গণতন্ত্র হ’ল
এমন একটি শাসন ব্যবস্থা যা সম্পূর্ণরূপে জনসমষ্টির ইচ্ছাধীনে পরিচালিত।[4]
এই
সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাটি তিনটি মতাদর্শের সমন্বয়। (১)
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (২) গণতন্ত্র ও (৩) জাতীয়তাবাদ। মাওলানা মুহাম্মাদ
আব্দুর রহীম বলেন, ‘বর্তমান দুনিয়ায় যে কয়টি রাজনৈতিক মতবাদ প্রচলিত আছে,
তন্মধ্যে ধর্মহীন জাতীয় গণতন্ত্র অন্যতম। ধর্মহীন জাতীয় গণতন্ত্র মতবাদটি
ধর্মহীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ এই তিনটি মতাদর্শের সমন্বয়। ... মনে
রাখা আবশ্যক যে, এই তিনটি মতবাদ একটি সুদৃঢ় যোগসূত্রে বাঁধা। একটি অপরটি
থেকে বিচ্ছিন্ন হ’তে পারে না। গণতন্ত্র অবশ্যই জাতীয়তাবাদী হবে এবং তা
ধর্মহীনতার ভিত্তিতেই চলতে পারে’।[5]
গণতন্ত্র ও ইসলাম : সংঘর্ষের দিকসমূহ
গণতন্ত্র একটি মানব রচিত মতবাদ। গণ মানুষের ইচ্ছা বা আইন অনুসারে পরিচালিত হয় বলেই এর রাষ্ট্র বা শাসন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা হয়। অন্যদিকে ইসলাম আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহর খলীফা হিসাবে এবং তাঁর ইচ্ছানুসারে পরিচালিত হয় বলে ইসলামের শাসন ব্যবস্থাকে খিলাফত বলা হয়। প্রফেসর ডঃ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বলেন, ‘রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র দু’টিই মানব রচিত মতবাদ। পক্ষান্তরে ‘খেলাফত’ আল্লাহর অনুমোদিত শাসন ব্যবস্থার নাম’।[6] নিম্নে ইসলাম ও গণতন্ত্রের পারস্পরিক সংঘর্ষের দিকগুলো উল্লেখ করা হ’ল।
(১) গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব মানা হয়, যা স্পষ্ট শির্ক। পক্ষান্তরে ইসলামের খিলাফতি রাষ্ট্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানা হয়, যা তাওহীদের অন্তর্ভুক্ত।
(২) গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ হ’ল মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা। পক্ষান্তরে খিলাফতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা অর্থ হ’ল আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা।
(৩) গণতন্ত্রের মূল দর্শন হ’ল মানুষকে সন্তুষ্ট করা যেভাবেই হোক। পক্ষান্তরে ইসলামী খিলাফতের মূল উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত বিধান অনুসারে মানুষের সেবা করা।
(৪) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্ম নিছক একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যক্তিগতভাবে এতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান পালনের স্বাধীনতা স্বীকৃত। কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে ধর্মের কোন প্রবেশাধিকার স্বীকার করা হয় না। এর রাজনীতি ধর্ম-বিবর্জিত। পক্ষান্তরে ইসলামী খিলাফতে ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয় মানুষের সার্বিক জীবনে ধর্মের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করে। রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ধর্মের নীতিমালা অনুসরণ করে চলে।
(৫) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ যেহেতু সকল ক্ষমতার মালিক, তাই ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, এমনকি বৈধ-অবৈধ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় সাব্যস্ত করার অধিকার জনগণের। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে যেকোন ব্যক্তি যেমন রাষ্ট্র প্রধান হ’তে পারে, তেমনি ইচ্ছামত যেকোন আইন রচনা করতে পারে। এজন্য 'Majority must be granted' হ’ল গণতন্ত্রের চূড়ান্ত কথা। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লাহকেই যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানা হয় সেহেতু ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, বৈধ-অবৈধ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে আইন প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতানুসরণ করার নীতিকে ইসলাম এড়িয়ে চলে। কেননা আল্লাহ অধিকাংশের মতানুসরণকে নিরুৎসাহিত করেছেন’ (আন‘আম ১১৬)।
(৬) গণতন্ত্রে রাজনীতি চলে বহুদলীয় পদ্ধতিতে। একদল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনা করে। ভোটে পরাজিত দল বা দল সমূহ বিরোধী দলে থেকে সরকারের সমালোচনা করে। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রে বহু দল, মত ও ধর্মের উপস্থিতি থাকলেও রাষ্ট্র বা সরকার ব্যবস্থায় বহুদলীয় ব্যবস্থাপনা স্বীকৃত নয়। কেননা তাতে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা উম্মাহর দায়িত্বশীল বা খাদেম হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তিনি বিশেষ কোন দলের লোক হন না।
(৭) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র প্রধান বা শাসক একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সার্বিক যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। পক্ষান্তরে ইসলামী খিলাফতে রাষ্ট্রপ্রধান যতদিন যোগ্যতা ও সক্ষমতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবেন ততদিন ঐ দায়িত্বে বহাল থাকবেন। যোগ্যতা হারালে বা অক্ষম প্রমাণিত হ’লে ঐ মুহূর্তেই বিদায় নিবেন বা বিদায় করা হবে। তাঁকে শাসন ক্ষমতায় বসানো বা প্রয়োজনে বিদায় করা শরী‘আতে আবশ্যক।
(৮) গণতন্ত্রে নেতাকে পদপ্রার্থী হ’তে হয়। নিজের যোগ্যতা ও গুণাবলীর ঘোষণা দিয়ে তাকে পদের উপযুক্ত প্রমাণ দিতে হয়। অপরপক্ষে ইসলামে কেউ নেতৃত্ব বা পদ চাইলেই তিনি নেতৃত্ব দানের অযোগ্য বিবেচিত হন, তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় না।
(৯) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শূরা বা পরামর্শ পদ্ধতি এবং ইসলামী রাষ্ট্রের শূরা বা পরামর্শ পদ্ধতি এক রকম নয়। অথচ এই শূরা ব্যবস্থাকেই গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাদৃশ্য প্রমাণের জন্য সবচেয়ে বেশী যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।
গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টের শূরা সদস্যদের যোগ্যতা ও মান এবং তাদের কার্যপ্রণালী আর ইসলামী রাষ্ট্রের শূরা সদস্যদের যোগ্যতা ও মান এবং কার্যপ্রণালীর প্রতি লক্ষ্য করলেই উভয় ব্যবস্থার মধ্যে আসমান-যমীন ব্যবধান পরিলক্ষিত হবে।
গণতন্ত্রে জ্ঞানী-মূর্খ, বোকা-বুদ্ধিমান, সৎ-অসৎ সব ধরনের মানুষের শূরা সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং সব ধরনের মানুষের মতকে গ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মুর্খ বা বোকার দল বেশী হওয়ার কারণে সিদ্ধান্তটি ভুল হোক বা সঠিক হোক।
পক্ষান্তরে উম্মতের বাছাইকৃত সেরা জ্ঞানী-গুণী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের মজলিসে শূরা গঠিত হয় এবং তাঁদের পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত হয়। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ই চূড়ান্ত নয়। কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় বা মত গ্রহণ করা হ’তে পারে, কখনো সংখ্যা লঘিষ্ঠের মতও গ্রহণ করা হ’তে পারে, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের চাইতে সংখ্যা লঘিষ্ঠের মতামত বেশী কল্যাণকর মনে হয়। এমনকি ১০০ জন শূরা সদস্যদের মধ্যে ১ জন সদস্যের পরামর্শ বা মত যদি দলীল-প্রমাণ ও বিবেক-বিবেচনার অনুকূলে হয়, তাহ’লে সেটাই গ্রহণ করা হয়।
আবার আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টের সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যেকোন আইন তৈরী করতে পারে। তারা হালালকে হারাম, হারামকে হালাল, ভালোকে মন্দ, মন্দকে ভালো বলে বিল পাশ করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা স্বাধীন। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রের মজলিসে শূরায় এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত বিধানের বিষয়ে পুণর্বিবেচনা বা মতামত প্রদানেরও কোন সুযোগ নেই। পরামর্শ করা হয় নতুন উদ্ভূত কোন সমস্যা বা বিষয় নিয়ে, যে বিষয়ে কুরআন-হাদীছের বক্তব্য স্পষ্ট নয়।
গণতন্ত্র কেন শিরক, কুফরী?
গণতন্ত্রের মূলনীতিসমূহ সুস্পষ্টভাবে শিরক এবং কুফরী হিসাবে প্রতীয়মান হয়। যেমন :
(১) সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রের মূল কথা জনগণের সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ সকল ক্ষমতার মালিক সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। একথা নিঃসন্দেহে শিরক। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيْكٌ فِي الْمُلْكِ ‘রাজত্বে তাঁর কোন শরীক নেই’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১১১)। তিনি আরো বলেন, قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ ‘তুমি বল, হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন’ (আলে ইমরান ৩/২৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘বরকতময় তিনি যার হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান’ (মূলক ৬৭/১)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন,الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ ‘যার হাতে রয়েছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব। যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেন না এবং তাঁর রাজত্বে কোন শরীক নেই’ (ফুরক্বান ২৫/২)।
আল্লাহর বাণী থেকে বুঝা গেল আল্লাহই সকল ক্ষমতার মালিক। মানুষকে ক্ষমতার মালিক বা উৎস বানানো তাঁর সাথে শরীক স্থাপনের শামিল, যা স্পষ্ট শিরক।
(২) আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রে আইন-বিধান রচনার চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয় পার্লামেন্ট সদস্যদের উপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যেটা বলবে, যে বিষয়ে সম্মত হবে সেটাই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন, যার বিরোধিতা করা আইনত অপরাধ। গণতন্ত্রে সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কুরআন-সুন্নাহর উপরে স্থান দেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন তৈরী করতে পারে, এমনকি আল্লাহর আইনকে বাতিলও করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দেওয়া, মদের লাইসেন্স দেওয়া, সূদের বৈধতা দেওয়া, ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে নিষিদ্ধ করা, ১৬ বছর বয়স পারস্পরিক সম্মতিতে যেনা করলে তার বৈধতা দেওয়া, স্বামীর অনুমতিতে স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে ব্যভিচার করলে তার বৈধতা দেওয়া, যাত্রা, সিনেমাহলে প্রকাশ্যে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার চর্চাকে অনুমোদন দেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের নীতিমালা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বরুবিয়্যাতের (ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের) ক্ষেত্রে শিরক এবং স্পষ্ট কুফরী। কেননা আল্লাহ বলেন, اَلَا لَهُُ الْخَلْقُ وَالْاَمْرُ ‘শুনে রাখ! সৃষ্টি যার হুকুম চলবে তার’ (আ‘রাফ ৭/৫৪)।
তিনি আরো বলেন,إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ- ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত তোমরা অন্য কারু ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৪০)।
তিনি আরো বলেন, وَاللهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ وَهُوَ سَرِيعُ الْحِسَابِ ‘আল্লাহ নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশকে পিছনে নিক্ষেপ করার কেউ নেই। তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী’ (রা‘দ ১৩/৪১)।
(৩) বিরোধ মিমাংসার ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রে যেকোন মতবিরোধ বা বিতর্কের চূড়ান্ত মিমাংসাকারী বানানো হয় সংবিধান ও এর ধারা সমূহ এবং পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে। এটা একটা স্পষ্ট কুফরী। মহান আল্লাহ বলেন,فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا- ‘অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)।
তিনি আরো বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।
গণতন্ত্র কেন জাহেলিয়াত?
গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য ন্যায়-নিষ্ঠতা, জ্ঞান-গরীমা, সততা, আল্লাহভীরুতার কোনই শর্ত নেই। যেকোন নাস্তিক, কাফির, ফাসিক-ফাজির, নির্বোধ-জাহেল ব্যক্তি পার্লামেন্ট সদস্য হ’তে পারে টাকার জোরে বা দলীয় আনুগত্য বিবেচনায়। ফলে এসব সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জাহেলী আইন-কানূন প্রণয়ন করে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটার হওয়ার জন্যও সততা, ন্যায়পরায়ণতা, জ্ঞানী-গুণী হওয়ার শর্তারোপ করা হয় না। ফলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাহেল লোকদের ভোটে শরী‘আত সম্পর্কে অজ্ঞরাই সাধারণত নেতা নির্বাচিত হয়। এজন্য গণতন্ত্রকে অনেক মনীষী মূর্খদের শাসন বলেছেন।
১.
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক প্লেটো গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন,
‘বুদ্ধিমানের চেয়ে মূর্খ ও অবিবেচকের সংখ্যা অধিক। সুতরাং সংখ্যাধিক্যের
শাসন বলে এটা প্রকারান্তরে মূর্খের শাসন।[7]
২.
জন লেকি বলেন, ‘গণতন্ত্র দারিদ্র্য পীড়িত, অজ্ঞতম ও সর্বাপেক্ষা অক্ষমদের
শাসন ব্যবস্থা; কারণ তারাই রাষ্ট্রে সংখ্যায় সর্বাপেক্ষা অধিক।[8]
৩. মিশরীয় ইসলামিক স্কলার মুহাম্মাদ কুতুব বলেন, আল্লাহর দাঁড়িপাল্লায় বিধান হ’ল দু’টি। একটি হ’ল আল্লাহর বিধান অপরটি জাহেলিয়াতের বিধান (মায়েদাহ ৫০)। গণতন্ত্র আল্লাহর বিধান নয়। সুতরাং তা আল্লাহর মাপকাঠিতে জাহেলিয়াতের বিধান।
(১)
শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘ইসলাম ও গণতন্ত্র দু’টি বিপরীতমূখী
ব্যবস্থা। যা কখনো এক হবার নয়। একটি আল্লাহর উপর ঈমান ও আল্লাহ নির্দেশিত
পন্থায় জীবন পরিচালনা, অপরটি তাগূতের (আল্লাহ বিরোধী অনুশাসন) প্রতি ঈমান ও
তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার উপর নির্ভরশীল’।[9]
(২)
আবু কাতাদা ওমর বিন মাহমূদ বলেন, ‘যেসব লোক ইসলামকে গণতন্ত্রের সাথে এক
করে দেখতে চায়, তাদের প্রচেষ্টা যিন্দীকদের (যারা মুখে ইসলাম প্রকাশ করে
অন্তরে কুফুরী গোপন করে) মত, যারা আল্লাহর দ্বীনকে মানুষের প্রবৃত্তির সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য পরিবর্তন করে ফেলে। ... ইসলাম জনগণকে বিধানগত
ক্ষেত্রে পসন্দ-অপসন্দের স্বাধীনতা দেয়নি; যেহেতু জনগণের জন্য ইসলামী বিধান
অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া এবং শাসককে মুসলিম হওয়া আবশ্যকীয়। অপরদিকে গণতন্ত্র
জনগণকে তাদের উপর প্রযোজ্য বিধি-বিধান প্রণয়নে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে।
এটাই গণতন্ত্রের মৌলিক তত্ত্ব, যা সম্পূর্ণ ইসলাম বিনষ্টকারী’।[10]
(৩)
ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বলেন, ‘বর্তমান গণতান্ত্রিক বিশ্বের
সর্বত্র সামাজিক অশান্তির অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল প্রচলিত এই নেতৃত্ব
নির্বাচন ব্যবস্থা। কেন্দ্রে ও স্থানীয় সংস্থা সমূহের সর্বত্র এই নির্বাচনী
ব্যবস্থা চালু হওয়ায় সর্বত্র নেতৃত্বের লড়াই, পারস্পরিক হিংসা-হানাহানি
এবং সামাজিক অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপ্তি লাভ করেছে’।[11]
(৪)
মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেন, ‘মোটকথা ইসলামের মধ্যে গণতান্ত্রিক
শাসন নামে কোন কিছু নেই। এই নব আবিষ্কৃত তথাকথিত গণতন্ত্র শুধু একটি বানানো
প্রতারণার বস্ত্ত। বিশেষ করে এমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যা মুসলিম এবং কাফের
শাসকদের সমন্বয়ে গঠিত, অনৈসলামিক রাষ্ট্র ছাড়া আর কী হবে?[12]
শেষ কথা : ইসলামকে বিদেশী মাপকাঠিতে ব্যাখ্যা দান চিরদিনের জন্য বন্ধ করতে হবে। ইসলামকে তার নিজ জায়গা থেকে দেখতে হবে ও দেখাতে হবে। ইসলামের স্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয়তা বজায় রেখেই আধুনিক যুগে বৈজ্ঞানিক পন্থায় যৌক্তিকভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করা সম্ভব। মানব রচিত কোন মতবাদ বা বস্ত্তবাদী আদর্শের ছত্রছায়ায় ইসলামকে বর্তমান যুগের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা আত্মঘাতী। কোন মানুষই যেমন এক সঙ্গে দুই প্রভুর গোলামী করতে পারে না, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে সম্পূর্ণ বিরোধী দু’টি আদর্শের অনুসরণ একজন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব।
[1]. ডঃ এমাজউদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কথা, পৃঃ ৩৬৫।
[2]. মোঃ মকসুদুর রহমান, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের রূপরেখা, পৃঃ ৭৬।
[3]. সৈয়দ মকসুদ আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, পৃঃ ২৮৫।
[4]. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, গণতন্ত্র বনাম ইসলাম, আহলেহাদীছ যুবসংঘ স্মারক গ্রন্থ ২০১১, পৃঃ ১৬৮।
[5]. ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী), পৃঃ ২৬।
[6]. ইসলামী খিলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন, পৃঃ ১৭।
[7]. ডঃ এমাজউদ্দীন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, পৃঃ ৩৭৪।
[8]. ঐ, পৃঃ ৩৭৩।
[9]. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব, গণতন্ত্র বনাম ইসলাম, আহলেহাদীছ যুবসংঘ স্মারক গ্রন্থ-২০১১, গৃহীত মাজাল্লাতুল আছালাহ, ২য় সংখ্যা, পৃঃ ২৪।
[10]. আল-জিহাদ ওয়াল ইজতিহাদ, পৃঃ ১০৩-১০৪।
[11]. ইসলামী খিলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন, পৃঃ ৩৮।
[12]. মালফূজাতে থানভী, পৃঃ ২৫২।